শূন্যস্থানের শেষ সূত্র

শূন্যস্থানের শেষ সূত্র 

ফিরোজ পাথরের মত জমে গেলেন। মেরিলিনার তীক্ষ্ণ চিৎকার শোনা গেল। 

অন্ধকার হল ঘরে বশিরের কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হল। টর্চের কম্পমান আলোটা লম্বা হয়ে বশিরের মুখমন্ডলকে আলোকিত করল। ক্লিন শেভড অভিব্যক্তিহীন মুখমন্ডল। ফিরোজ এই মানুষটাকে অবচেতনভাবে অনেক ভয় পেতেন। সেই ভয়টা আজ প্রকাশিত হয়ে আসতে চাইল। ফিরোজ প্রাণপণে সেই ভয়টাকে দাবিয়ে রাখতে চাইলেন। কোনভাবেই বশিরকে বুঝতে দেওয়া যাবে না যে তিনি ভয় পাচ্ছেন। প্রয়োজনের চেয়েও উঁচু গলায় বললেন, “মেরিলিনা, ইনিই তোমার বাবা।” 

মেরিলিনা বশিরের মুখের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল, “বাবা”। বশির টর্চের আলোকিত জায়গাটা ছেড়ে মেরিলিনার দিকে এগিয়ে গেলেন। দুই হাত বাড়িয়ে মেরিলিনাকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। মেরিলিনাও এতদিন পরে তার সব থেকে প্রিয় মানুষটাকে জড়িয়ে ধরল। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মেরিলিনা। এই মানুষটাকে ছাড়া সে কাটিয়েছে দীর্ঘ পাঁচটা বছর। 

ফিরোজ হলঘরে আরও মানুষের উপস্থিতি অনুভব করলেন। বশির অবশ্যই একা নন। বোকার মত কোন কিছু করা উচিত হবে না। অপেক্ষা করতে হবে। এলিট ফোর্স আসার আগেই বশিরকে হত্যা করতে হবে। এমনভাবে কাজটা করতে হবে যেন মনে হয় পুরো ব্যাপারটা একটা দুর্ঘটনা। বশির এলিট ফোর্সের হাতে ধরা পড়লে প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্পের কথা ফাঁস হতে দুই মিনিটও লাগবে না। এলিট ফোর্সের টর্চার সেল থেকে কোন মানুষ আজ পর্যন্ত মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে বেরিয়ে আসতে পারেনি। 

বশির মেরিলিনাকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই ফিরোজ প্রশ্ন করলেন, “আপনি ঢুকলেন কি করে? সব দরজায় তো আমি তালা দেখলাম।” 

“যেদিক দিয়ে পালিয়েছিলাম সেদিক দিয়েই এসেছি। আমি আপনার আসার অপেক্ষা করছিলাম।” বশির জামান অন্ধকারের দিকে ইশারা করে মেরিলিনাকে বসতে বললেন। 

মেরিলিনাকে অন্ধকারে কোথায় গিয়ে বসল বুঝতে পারলেন না ফিরোজ। নিশ্চিত হতে হবে আর কয়জন আছে এখানে। 

ফিরোজ কিছু একটায় পা হড়কে পড়ে যাওয়ার অভিনয় করবেন বলে ঠিক করলেন। উফ করে শব্দ করলেন। তারপর “মশা” বলে যেই পা চুলকাতে যাবেন তখনই বশির বললেন, “বোকামী করবেন না মেজর জেনারেল। আপনার মত একজন লোকের কাছ থেকে বোকামী আশা করা যায় না। এই হলটার তৃতীয় স্ট্যান্ডে আপনার দিকে নাইট ভিশন স্কোপ লাগানো স্নাইপার রাইফেল নিয়ে বসে আছে একজন। একটু নড়াচড়ার চেষ্টা করলে কি হবে বুঝতেই পারছেন।” 

ফিরোজ ঘামতে শুরু করলেন। এই প্রথম তার নিজেকে বিভ্রান্ত মনে হল। বশির বললেন, “অনুমান করেন তো কে বসে থাকতে পারে?” ফিরোজ কোন উত্তর দিলেন না। 

সাথে সাথে হলঘরের থার্ড সিলিং লাইটটা জ্বলে উঠল। মৃদু সিলিং লাইট যেই মানুষটার মাথার ওপরে পড়ল, সে আর কেউ নয়, শংকর। শংকরকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন ফিরোজ। দূর থেকেও শংকরের চোখে মুখে ঘৃণা দেখতে পেলেন ফিরোজ। 

বশির জামানকে প্রশ্ন করলেন, “বশির সাহেব। আমার একটা কৌতূহল আছে। আমি চাই আপনি সেই কৌতূহল মেটান।” 

বশির একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন, “কিসের কৌতূহল?”

“আপনি প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্পে প্রথমে রাজি ছিলেন না। পরে আবার রাজি কেন হলেন?” ফিরোজ প্রশ্ন করলেন। 

এটাই নাকি আর কোন কৌতূহল আছে?” বশির বললেন 

“আর প্রধান উদ্যোক্তা হিসেবে আমার এটুকু তো জানার অধিকার আছে যে প্রকল্পের শেষে কী হয়েছিল?” 

বশির জামান মাথা নাড়লেন। বললেন, “অবশ্যই আছে। এবং আমি অবশ্যই আপনাকে সেটা বলব। দুটো কৌতূহলই আমি মেটাব আপনার।” 

কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে বশির জামান বললেন, “আসলে প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্পটা ছিল পুরোটাই একটা লোক দেখানো। আমার আসল উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে কিভাবে আরও উৎপাদনশীল করা যায়।” 

মেরিলিনার কণ্ঠ শোনা গেল অন্ধকারে, “কি বলছ তুমি বাবা! তারমানে তুমি একজন খুনিকে আরও বড় খুনিতে পরিণত করতে চেয়েছিলে?” 

বশির বললেন, “আগে পুরোটা আমাকে শেষ করতে দাও মেরিলিনা। মেজর জেনারেল, আমি কি ফ্রয়েডীয় ভাষায় বলব, নাকি সহজ সরল বাংলা ভাষায় বলব?” 

ফিরোজ বললেন, “যেভাবে আপনি একজন ছাত্রকে বোঝাবেন সেভাবে বলেন।” 

“ঠিক আছে। মনোবিজ্ঞান বলে, মানুষ চাপের মাথায় সর্বোচ্চ উৎপাদনশীল হয়ে থাকে। কিন্তু সেই উৎপাদনশীলতা ক্ষণস্থায়ী। চাপের মাথায় যেসব মানুষ নিজের ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে তারা মিরাকলে বিশ্বাস করতে শুরু করে। ঠিক একইভাবে মানুষের আয়ুষ্কাল কম বলেই মানুষ সব সময় কিছু না কিছু করে। মানুষের আয়ুষ্কাল স্বাভাবিকের থেকে আরও কম করে দিলে কী হবে বুঝতে পারছেন? মানুষ আরও বেশি কাজ করবে। আরও বেশি উৎপাদনশীলতা দেখাবে। একটা উদাহরণ দেই, খুব সাধারণ একটা উদাহরণ, আপনি যদি জেনে যান যে আর একদিন পরে আপনার মৃত্যু হবে, আপনি কী করবেন? শুয়ে শুয়ে ঘুমাবেন নাকি আপনার সব থেকে আকাঙ্খিত বস্তুটা পাওয়ার চেষ্টা করবেন? 

বশির উত্তরের অপেক্ষা করলেন না। বললেন, “আমি তেরোজন অপরাধীর মধ্যে থেকে ছয়জনকে বেছে নেই। যেটা ছিল গ্রুপ দুই। গ্রুপ দুইয়ের সবাইকে যতোটা পারা যায় অমানুষিক চাপের ভেতরে রাখি। তারপর প্রতি সপ্তাহে গ্রুপ এক আর গ্রুপ দুই এর অপরাধীদেরকে একই কাজ করতে দেই, খুব সাধারণ কাজ। এই যেমন ধরেন, রান্না করা, সবজি কাটা, কাঠ কাটা, এইসব আর কি। তো আমি একটা মজার ব্যাপার লক্ষ্য করলাম জানেন? গ্রুপ দুইয়ের সব সময় চাপে থাকা অপরাধীরা অনেক বেশি দ্রুত এবং দক্ষতার সাথে এই কাজগুলো করতে শুরু করল। যেখানে গ্রুপ ওয়ানে রোজ প্রার্থনা করা, বাগান করা আর বই পড়া অপরাধীরা এই দ্রুততা ও এই দক্ষতার ধারে কাছেও যেতে পারল না।” 

কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর বশির আবার বলতে শুরু করলেন, “আমি স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিলাম, চাপে থাকা মানুষ সব থেকে বেশি উৎপাদনশীল। কিন্তু আমাকে সব থেকে সেরাদেরকে বেছে নিতে হত।” 

“সেরাদেরকে কেন?” ফিরোজ বললেন। 

“বলছি বলছি। সেরাদেরকে বেছে নিয়ে আমার অনেক বড় একটা পরিকল্পনা ছিল। আমি এদেরকে দিয়ে একটা সরকারহীন, একটা কাঁটাতারে ঘেরা সীমান্তহীন দেশ দেখতে চাইতাম। একটা সীমানাহীন দেশ দেখতে চাইতাম। যেখানে মানুষ ক্ষমতার লড়াই করে না, মানুষ শুধু বাঁচার লড়াই করবে।” 

“মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন একটা রাষ্ট্রহীন পৃথিবী চান?” ফিরোজ বললেন। 

“হ্যা। আমি চাই না কখনওই একজন মানুষ যেন সাধারণ মানুষদের ভেতর থেকে উঠে গিয়ে সাধারণ মানুষদেরকেই শোষণ করে। মানুষ যখন একদল মানুষের নেতা হয়, তার ভেতরে আজ না হয় কাল ক্ষমতার লোভ আসবেই। আর ক্ষমতা তখনই প্রয়োজন হয় যখন একজন মানুষ খুব বাজে কিছু একটা করতে চায়। সমাজে অপরাধী কেন তৈরি হয় জানেন? এই অসুস্থ ক্ষমতার লড়াইয়ে সমাজে ক্ষত তৈরি হয়। এই অপরাধীরা সেই ক্ষতের ফলাফল। যে সমাজে মানুষ শুধু নিজের জন্য চিন্তা করে, নিজের জন্য দু মুঠো ভাত হলেই খুশি থাকে, সেই সমাজে কখনও অপরাধী তৈরি হতে পারে না।” 

“তো শেষমেষ আপনি সেরাদেরকে কিভাবে বেছে নিলেন?” ফিরোজ প্রশ্ন করলেন। 

“দেখে মনে হল খুবই সহজ। গ্রুপ দুইয়ের সবাইকে আমি একদিন দেখালাম গ্রুপ এক এর সবাই কত আরামে আছে। কত ভালো আছে। তারপর এক সন্ধ্যাবেলা গ্রুপ দুই আর গ্রুপ এক এর পার্টিশন তুলে দিলাম, ব্যস। সবাই যে যার মত যাকে খুশি ছিঁড়ে ফেলতে লাগল। যে তিনজন বেঁচে থাকল তাদেরকে নিয়ে আমি পালিয়ে গেলাম, পেছনের স্টোররুম দিয়ে। যাওয়ার আগে সব প্রমাণ মুছে ফেলতে ফাইল পত্রে আগুন ধরিয়ে দিতে হয়েছিল।” 

কিছুক্ষণ নীরব থেকে বশির বললেন, “ইতালির যে হাসপাতালে কাজ করতাম, সেখানেও আমি এইরকম কিছু একটা করতে চেয়েছিলাম, মেজর জেনারেল। কিন্তু সেখানে কয়েকজন রোগী আমার দেওয়া মানসিক চাপ সহ্য করতে পারেনি। কেউ মারা যায়। কেউ আত্মহত্যা করে। আমি পড়ে গেলাম বিপদে। পরে আমি ভেবে দেখলাম, আপনার এই প্রকল্পটা হাতে নিলে নিজের অসমাপ্ত কাজটা সম্পূর্ণ করতে পারব। তাই আবার আপনার সাথে যোগাযোগ করি।” 

মেরিলিনা তার এতদিনের প্রশ্নের না পাওয়া উত্তর পেয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। 

ফিরোজ চিৎকার করে বললেন, “তুমি একটা উন্মাদ বশির। একটা বদ্ধ উন্মাদ। তোমাকে বিশ্বাস করা আমার ভুল হয়েছে। তুমি আমাকে দিনের পর দিন প্রকল্পের ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছ। তুমি একটা ধোঁকাবাজ” 

বশির চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “এটাই আমি শুনতে চাই মেজর জেনারেল। এটাই আমার প্রথম অনুপ্রেরণা। 

“ তিনি বশিরকে বললেন, “আশফাক চৌধুরী কোথায়?” 

“ওহ হো, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। এই প্রমিত, আশফাক চৌধুরী আর রঞ্জনকে নিয়ে আসো তো।” অন্ধকারে পায়ের শব্দ শোনা গেল। একটা ট্রলি টানতে টানতে নিয়ে আসল কে যেন। ফ্লোর লাইটের ছিটেফোঁটায় ফিরোজ দেখতে পেলেন, একটা শার্ট প্যান্ট পরা মেয়ে একটা বড়সড় ট্রলি নিয়ে আসছে। ট্রলির ওপরে মাছি ভন ভন করছে। ট্রলিটা কাছাকাছি আসতেই একটা বিকট গন্ধ নাকে এসে লাগল ফিরোজের। ফিরোজ নাক চেপে ধরলেন। বশির বললে, “এই যে। এগুলো আশফাক চৌধুরীর কাট পিস।” 

ফিরোজ আশফাক চৌধুরীর শরীরের খন্ডিতাংশের দিকে তাকাতে আর আগ্রহ বোধ করলেন না। তিনি বললেন, “রঞ্জন কই?” 

মেজর রঞ্জন অন্ধকার থেকে ধীর পায়ে বেরিয়ে এলেন। 

বশির বললেন, “রঞ্জনকে আপনি চেয়েছিলেন না মেজর জেনারেল? আমার মনে হয় ওকে আমি জীবিত দিতে পারব না। আমার মেরিলিনাকে প্রয়োজন ছিল। পেয়ে গিয়েছি। রঞ্জনকে গুলি করতে বাধ্য হচ্ছি মেজর জেনারেল।” 

অন্ধকারে রঞ্জনের অভিব্যক্তি বোঝা গেল না। শুধু অস্ফুট স্বরে সে বলল, “এটা একটা জানোয়ার স্যার। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। এই জানোয়ারটাকে শেষ করে দেন।” 

বশির রোগার আলাস্কানটা তুলে ধরার আগেই বিদ্যুৎ বেগে ফিরোজ নিজের হোলস্টার থেকে রিভলভার বের করে রঞ্জনকে তিনটা গুলি করলেন। পুরো হলরুমে গুলির বিকট শব্দ প্রতিধ্বনিত হল। রঞ্জন গুলির ধাক্কায় কয়েক ইঞ্চি দূরে ছিটকে পড়ল। আর উঠল না। সাথে সাথে অন্ধকারে তিনটা রিভলভারের সেফটি ক্যাঁচ খোলার শব্দ শুনতে পেলেন ফিরোজ। 

এই দৃশ্য কেউই আশা করেনি। মেরিলিনা অবাক হল। যে লোকটাকে সে এত কাছাকাছি রাখল, আজ সেই লোকটাকেই এভাবে গুলি করে মেরে ফেলল ফিরোজ! মুহূর্তের ভেতরে ঘটে যাওয়া ঘটনায় শংকরও যেন জমে পাথর হয়ে গিয়েছে। না হলে সে নিশ্চয় গুলি করে বসত। 

প্রমিত নামের ‘মেয়েটা’ ফিরোজের হাত থেকে রিভলভারটা নিয়ে নিল। ফিরোজ ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “বিশ্বাসঘাতক কুকুর। আমাদের সব তথ্য জেনারেল আর আশফাক চৌধুরীর কাছে পাচার করছিল কুকুরটা। প্রথম যেদিন চাবি হারালো আর ডাঃ শফিকের অপহরণ হল, সেদিনই রঞ্জনের ওপরে আমার সন্দেহ হয়। কারণ সে ডাঃ শফিকের অপহরণের ব্যাপারে কোন না কোনভাবে জানতে পেরেছিল। তাই তার কাছে চাবি হারানোটাই সব থেকে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। যে গাড়িটার সাহায্যে অপহরণটা করা হয়, সেইটা রঞ্জন হয়ত চিনত। তারপর যেদিন জানলাম আশফাক চৌধুরী মেরিলিনার ব্যাপারে জানেন, সেদিন রঞ্জনের ওপরে আমার সন্দেহ আরও গাঢ় হয়। নাসরিন বলার পরে নিশ্চিত হই যে রঞ্জনই আশফাক চৌধুরী আর জেনারেলের টিকটিকি। কুকুরটা আমার একজন বিশ্বস্ত আইটি অফিসারকে খুন করেছে। এই কুকুরটাই আমাকে বলে, যে মেরিলিনাকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করে বশিরকে, মানে আপনাকে পাওয়া যেতে পারে। ওর ইচ্ছা ছিল মেরিলিনাকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করে বশিরকে ধরে ফেলবে। কিন্তু, ভাগ্য ভালো যে আমি ততদিনে ওর আসল রূপটা জেনে যাই। মেরিলিনার বদলে অপারেশন মিরর হান্টে আমি রঞ্জনকেই টোপ বানাই। আর টোপের সাথে জুড়ে দেই বড়শির ফলা, আশফাক চৌধুরীকে।” 

নীরবতা নেমে এলো পুরো হল জুড়ে। প্রথমে কথা বললেন বশির জামান। 

বশির খ্যাস খ্যাসে গলায় বললেন, “মানে?”“

“মানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যাওয়ার ‘অপারেশন মিরর হান্ট’ নাটকটা আমারই সাজানো। আমিই সেদিন ইচ্ছা করে রঞ্জন আর আশফাক চৌধুরীকে কোন নিরাপত্তা ছাড়াই বের হতে বলি। আমি জানতাম বশির, আপনি আশফাক চৌধুরীর বাড়ির সামনের সবগুলো সিসিটিভি ক্যামেরা ট্র্যাক করবেন। তাই আশফাককে এমন একটা জায়গা থেকে গাড়িতে উঠতে বলি, যেখান থেকে পরিষ্কার তাকে দেখা যায়। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আপনি ওকেই সিসিটিভিতে দেখবেন এবং ওকেই টার্গেট করবেন। কিন্তু আপনি দুইটা গাড়ি বহরকেই টার্গেট করেছিলেন। রিস্ক নিতে চাননি। দুইটা গাড়ি বহরের জন্য দুইটা টিম পাঠালেন। যখন সাদা করোলাতে আশফাককে পেয়ে গেলেন, তখন আর আমাদের গাড়ি বহরে হামলা করলেন না। সেদিন আমাদেরকে হামলা করলে অবশ্য মেরিলিনা খুন হয়ে যেত।” ফিরোজ বললেন। 

“তারমানে আপনি আশফাক আর রঞ্জনকে আমার কাছে ইচ্ছা করে পাঠিয়েছেন? কেন?” বশির জিজ্ঞাসা করলেন। 

এতক্ষণ টিমটিম করে জ্বলতে থাকা টর্চটা নিভে গেল। ফিরোজ বললেন, “শুধু মাত্র আপনার সাথে যোগাযোগ করার জন্য! আপনাকে যে বলেছিলাম আশফাক চৌধুরী আর রঞ্জনের বদলে মেরিলিনাকে দেব, আসলে সেটাও একটা ফাঁদ ছিল। আমার আপনাকেই প্রয়োজন ছিল আর কাউকে প্রয়োজন ছিল না। আর আমিই অপারেশন মিরর হান্টের সময় নেটওয়ার্ক জ্যাম করে দেই।” ফিরোজ বললেন। 

হলরুমে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। 

ফিরোজ বললেন, “এবার আমাকে একটা কথা বলেন তো, পাঁচ বছর আগে শংকররে মৃত্যুর খবর কি তাহলে মিথ্যা ছিল? আপনি বলেছিলেন যে ওর মৃত্যুটা একটা দুর্ঘটনা ছিল। পাহাড়ি জেল ভেঙে পালানোর সময় শংকর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে পড়ে মারা যায়। ওকে কি তাহলে আপনিই লুকিয়ে রেখেছিলেন? আমাকে খুন করার জন্য?” 

মেরিলিনা পেছনে তাকালো একবার। শংকরের বন্দুকের মাজল এখনও ফিরোজের দিকে তাক করা। বশির বললেন, “সে অনেক কথা মেজর জেনারেল। এখন সেসব শুনে লাভ আছে? শংকর আপনাকে হত্যা করে নিজের পরিবারের হত্যার প্রতিশোধ নিতে চায়। আমি আর বাধা দেইনি। এই প্রকল্পের কাজ শেষ। হয়ত আপনার কাছে এইটা ব্যর্থ হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে এইটা সফলই হয়েছে। আজ আপনাকে এত কিছু বললাম কেন জানেন?” ফিরোজ কোন উত্তর দিলেন না। বশির নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই দিলেন, “কারণ আমি মৃত মানুষের কৌতূহল পুরণ করি।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *