শূন্যঘর

গোধূলি-অন্ধকারে
      পুরীর প্রান্তে অতিথি আসিনু দ্বারে।
           ডাকিনু, “আছ কি কেহ,
           সাড়া দেহো, সাড়া দেহো।’
      ঘরভরা এক নিরাকার শূন্যতা
          না কহিল কোনো কথা।
বাহিরে বাগানে পুষ্পিত শাখা
           গন্ধের আহ্বানে
সংকেত করে কাহারে তাহা কে জানে।
হতভাগা এক কোকিল ডাকিছে খালি,
     জনশূন্যতা নিবিড় করিয়া
           নীরবে দাঁড়ায়ে মালী।
           সিঁড়িটা নির্বিকার
      বলে, “এস আর নাই যদি এস
           সমান অর্থ তার।’
           ঘরগুলো বলে ফিলজফারের গলায়,
      “ডুব দিয়ে দেখো সত্তাসাগর-তলায়
বুঝিতে পারিবে, থাকা নাই-থাকা
           আসা আর দূরে যাওয়া
      সবই এক কথা, খেয়ালের ফাঁকা হাওয়া।’
      কেদারা এগিয়ে দিতে কারো নেই তাড়া,
           প্রবীণ ভৃত্য ছুটি নিয়ে ঘরছাড়া।
      মেয়াদ যখন ফুরোয় কপালে,
           হায় রে তখন সেবা
           কারেই বা করে কেবা।
      মনেতে লাগিল বৈরাগ্যের ছোঁওয়া,
                 সকলি দেখিনু ধোঁওয়া।
           ভাবিলাম এই ভাগ্যের তরী
                 বুঝি তার হাল নেই,
      এলোমেলো স্রোতে আজ আছে কাল নেই।
           নলিনীর দলে জলের বিন্দু
                 চপলম্‌ অতিশয়,
           এই কথা জেনে সওয়ালেই ক্ষতি সয়।
                 অতএব — আরে অতএবখানা থাক্‌
                       আপাতত ফেরা যাক।
      ব্যর্থ আশায় ভারাতুর সেই ক্ষণে
                 ফিরালেম রথ, ফিরিবার পথ
                       দূরতর হল মনে।
           যাবার বেলায় শুষ্ক পথের
                 আকাশ-ভরানো ধূলি
                 সহজে ছিলাম ভুলি।
           ফিরিবার বেলা মুখেতে রুমাল,
                 ধোঁয়াটে চশমা চোখে,
           মনে হল যত মাইক্রোব-দল
                 নাকে মুখে সব ঢোকে।
           তাই বুঝিলাম, সহজ তো নয়
                 ফিলজফারের বুদ্ধি।
           দরকার করে বহুৎ চিত্তশুদ্ধি।
                       মোটর চলিল জোরে,
           একটু পরেই হাসিলাম হো হো করে।
      সংশয়হীন আশার সামনে
                       হঠাৎ দরজা বন্ধ,
      নেহাত এটার ঠাট্টার মতো ছন্দ।
      বোকার মতন গম্ভীর মুখটারে
                 অট্টহাস্যে সহজ করিনু,
                       ফিরিনু আপন দ্বারে।
      ঘরে কেহ আজ ছিল না যে, তাই
                 না-থাকার ফিলজাফি
                 মনটাকে ধরে চাপি।
                 থাকাটা আকস্মিক,
      না-থাকাই সে তো দেশকাল ছেয়ে
                 চেয়ে আছে অনিমিখ।
      সন্ধেবেলায় আলোটা নিবিয়ে
                 বসে বসে গৃহকোণে
      না-থাকার এক বিরাট স্বরূপ
                 আঁকিতেছি মনে-মনে।
           কালের প্রান্তে চাই,
      ওই বাড়িটার আগাগোড়া কিছু নাই।
           ফুলের বাগান, কোথাও তার উদ্দেশ,
           বসিবার সেই আরামকেদারা
                 পুরোপুরি নিঃশেষ।
      মাসমাহিনার খাতাটারে নিয়ে পিছে
      দুই দুই মালী একেবারে সব মিছে।
           ক্রেসান্থেমাম্‌ কার্নেশনের
                 কেয়ারি-সমেত তারা
                 নাই-গহ্বরে হারা।
                 চেয়ে দেখি দূর-পানে
সেই ভাবীকালে যাহা আছে যেইখানে
           উপস্থিতের ছোটো সীমানায়
              সামান্য তাহা অতি–
                 হেথায় সেথায় বুদ্‌বুদ্‌সংহতি।
যাহা নাই তাই বিরাট বিপুল মহা।
              অনাদি অতীত যুগের প্রবাহ-বহা
      অসংখ্য ধন, কণামাত্রও তার
              নাই নাই হায়, নাই সে কোথাও আর।
“দূর করো ছাই,’ এই বলে শেষে
                 যেমনি জ্বালিনু আলো
ফিলজফিটার কুয়াশা কোথা মিলালো।
           স্পষ্ট বুঝিনু যা-কিছু সমুখে আছে,
                 চক্ষের ‘পরে যাহা বক্ষের কাছে
                       সেই তো অন্তহীন
                       প্রতিপল প্রতিদিন
                 যা আছে তাহারি মাঝে
           যাহা নাই তাই গভীর গোপনে
                       সত্য হইয়া রাজে।
           অতীতকালের যে ছিলেম আমি
                 আজিকার আমি সেই
                 প্রত্যেক নিমেষেই।
           বাঁধিয়া রেখেছে এই মুহূর্তজাল
                 সমস্ত ভাবীকাল।
অতএব সেই কেদারাটা যেই
           জানালায় লব টানি,
বসিব আরামে, সে মুহূর্তেরে
           চিরদিবসের জানি।
অতএব জেনো সন্ন্যাসী হব নাকো,
           আরবার যদি ডাকো
আবার সে ওই মাইক্রোব-ওড়া পথে
           চলিব মোটর-রথে।
           ঘরে যদি কেহ রয়
নাই ব’লে তারে ফিলজফারের
           হবে নাকো সংশয়।
দুয়ার ঠেলিয়া চক্ষু মেলিয়া
           দেখি যদি কোনো মিত্রম্‌
কবি তবে কবে, “এই সংসার
           অতীব বটে বিচিত্রম্‌।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *