শূন্য

শূন্য

সিঁড়ির সর্বোচ্চ ধাপে একঠায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল ক্রামার, কিছু শোনার চেষ্টা করল, তার পেছনের রাস্তাটা খালি এবং নির্জন, মিশে গেছে দিগন্তরেখার সাথে। যেন কার্ডবোর্ডের ওপর চকখড়ির একটা হালকা দাগ। মাথার ওপরে শুকনো, স্থির বাতাসে নিঃসঙ্গ একটা কিলোটা চক্কর দিচ্ছে, খুঁজছে শিকার। নেই, ওকে কেউ অনুসরণ করার কোনও চিহ্ন নেই।

ক্রামার ওর জিনিসপত্রগুলো আবার চেক করল: ক্যান্টিন, খাবারের ট্যাবলেট, স্যান্ড মাস্ক, আর সবচে’ মূল্যবান বস্তুটি-ম্যাপ। ছোট অয়েলস্কিন থলের মধ্যে রাখা প্রাচীন ম্যাপটার দিকে চোখ বুলাতেই রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল সে।

সোমবার। সকাল ১১:১৪। ঘড়ি দেখল ক্রামার। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ঠিক এগারো দিনের দিন সে ‘ক্যানাল টোয়েন্টি এইট নর্থ ওয়েস্ট’-এ পৌঁছুবে। তারপর আর অসুবিধে নেই। জাল পাসপোর্ট দেখিয়ে সহজেই ক্রেটার সিটি পোর্টে ঢুকে যাবে ক্রামার। প্রতিদিন দুপুরের নিয়মিত ‘আর্থ এক্সপ্রেস’-এ চড়ে সে পগার পার হবে। রানচার্ডের বাপেরও সাধ্য নেই বুঝতে পারে ওই পথে সে পালিয়েছে। মাসখানেক আগে যখন প্ল্যানটা করল ক্রামার তখনই প্রতিটি ডিটেইল সে পরীক্ষা করেছে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে, ঘড়ির কাঁটা ধরে এগিয়েছে সমস্ত কাজ।

সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল ক্রামার, আনমনে গুণছে: ছাপ্পান্ন, সাতান, আটান্ন। লেভেল ওয়ান। কালের আঁচড়ে মলিন, অস্পষ্ট সাইনবোর্ডটা হঠাৎ চোখে পড়ল

এই খালে প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ
আদেশক্রমে
জারা

নামটা পড়ে অবাক হলো ক্রামার। জারা, ইতিহাস বইতেই শুধু এই নামটা দেখেছে সে। জারা, মার্শিয়ান রাজত্বের শেষ সম্রাট, বিস্মৃত হয়েছে কবে। ক্রামার মনে করার চেষ্টা করল তৃতীয় নাকি চতুর্থ সম্রাটের সময় এই খালগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

একশো আটাশ, একশো ঊনত্রিশ। তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম লেভেল। আরেলিয়াম স্টীলের তৈরি প্রকাণ্ড এক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল ক্রামার। টর্চের আলোতে দ্বিতীয় সাইনবোর্ডটা যেন ভেঙচি কাটল ওকে:

এই খালে প্রবেশ সম্পূর্ণ…

পকেট থেকে একটা চাবি বের করল ক্রামার। খুব সাবধানে রাজকীয় সীলটা তুলল, চাবি তালায় ঢুকিয়ে মোচড় দিল। আস্তে খুলে গেল দরজা।

ভেতরে ঢুকল ক্রামার। সতর্কতার সাথে সীলটাকে আবার আগের জায়গায় লাগাল। ওর অনুপ্রবেশের কোনও চিহ্নই আর থাকল না। নিঃশব্দ হাসিতে ভরে উঠল ক্রামারের মুখ।

ক্যানাল গ্র্যান্ড-উত্তর আর দক্ষিণ মঙ্গলগ্রহের মধ্যে যোগসূত্রতার প্রধান ধমনী। ক্যানাল গ্র্যান্ড মিশেছে শূন্যে, ওর পলায়নের উৎকৃষ্ট পথ। ক্রামার জানে পৃথিবীর কোনও মানুষ কিংবা মার্শিয়ান কখনও শূন্যে অভিযানে বেরোয়নি, ওখানে গেলেও কেউ ফিরে আসেনি কোনওদিন। শূন্য যেন এক বিশাল দানব। গ্রাস করে সবাইকে। আজও শূন্যকে নিয়ে বহু গল্পকথা প্রচলিত, বেশিরভাগই হয়তো কুসংস্কার থেকে উদ্ভূত, কিন্তু এটা ঠিক শূন্যে এ পর্যন্ত যে-সব অভিযান চালানো হয়েছে, পাঠানো হয়েছে রকেট শিপ, প্লেন ইত্যাদি-কোনটারই আর সন্ধান মেলেনি। শূন্য, একা এবং বিশাল, লাল রঙের গ্রহটাকে দুই ভাগে ভাগ করে অবিচল দাঁড়িয়ে আছে।

দ্রুত সামনে পা বাড়াল ক্রামার। ওর পরনে গরম, আরামদায়ক স্পেসসুট, মাথায় হেক্সটার হেলমেট। হাঁটতে হাঁটতে খালের মাঝখানে চলে এল। মাটি এখানে শক্ত, ফুটপাথের মত সমতল। দু’পাশের দেয়ালগুলো উঁচু এবং অন্ধকার।

হাঁটতে হাঁটতে ভাবছে ক্রামার। ভাবছে মানুষের জীবনে কত অদ্ভুত ঘটনাই না ঘটে। মাসখানেক আগেও সে ফাগান্ডা-র মেট্রোপলিটান পাওয়ার ইউনিটের সাধারণ একজন রেশিও ক্লার্ক ছিল। ছকে বাঁধা জীবনটা ছিল একঘেয়ে। মাঝে মধ্যে দু’একটা চুরিচামারির ঘটনা খানিকটা উত্তেজনার খোরাক যোগাত। তারপর একদিন হঠাৎ করেই প্ল্যানটা মাথায় এল ওর।

প্ল্যানটা করেছিল সে শূন্যের গোপনীয়তা জানার জন্য, যে গোপনীয়তা সহস্র বছর ধরে মানব জাতিকে হতবুদ্ধি করে রেখেছে। ৩০৯১ সালে ইতিহাসবিদ স্টোলা লিখেছিলেন:

আমি নিশ্চিত যে ভয়ঙ্কর কোনও বিপর্যয়ের কারণে খালগুলো সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেছে এবং পূর্ববর্তী মার্শিয়ান রাজবংশের যে পতন শুরু হয়েছিল তার পেছনে ওই করিডর যাকে আমরা শূন্য বলে জানি, তার বিশেষ ভূমিকা ছিল।

আমরা নিশ্চিতভাবে এটাও জানি, ক্যানাল গ্র্যান্ড বহু আগেই ওই করিডরকে গ্রাস করে চলে গেছে, এবং বর্ণালিবীক্ষণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানা যায় মহাখালটির কোথাও জমা আছে মহামূল্যবান রেটনাইট যার বৈজ্ঞানিক নাম কেমিক্যাল এক্স। কেমিক্যাল এক্স আজও মানব জাতির সর্বাধিক প্রত্যাশার বস্তু। আমার কোনই সন্দেহ নেই একদিন অবশ্যই এই মহামূল্যবান বস্তুটি আবিষ্কার হবে এবং জানা যাবে শূন্যের সকল রহস্য।

ক্রামার জানে ইন্টারপ্ল্যানাটেরী কাউন্সিলে নয়জন সদস্যের তত্ত্বাবধানে বর্তমানে চোদ্দ কিলোগ্রাম রেটনাইট সংরক্ষিত আছে। রেটনাইট এক ধরনের ড্রাগ, মেন্টালস্টিমুল্যান্ট, ঠিকমত ডোজ নিলে মস্তিষ্কের চিন্তা শক্তি বাড়িয়ে দেয় হাজার গুণ। রেটনাইট-এর ডোজ যে নিতে পারে সে পরিণত হয় সুপার ইন্টেলেকচুয়ালে।

ক্রামার এই পরশমণির সন্ধানই চায়। চায় কারণ রেটনাইট তার জন্য সাফল্যের দ্বার খুলে দেবে। তাকে আর ছোটখাট চুরি বা ঠগবাজী করতে হবে না, পুলিশের ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতেও হবে না।

হেলমেটের চিবুকের দিকে একটা বোতামে চাপ দিল ক্রামার। স্বয়ংক্রিয়ভাবে মার্শিয়ান চুরুট বেরিয়ে এল একটা র‍্যাক থেকে, টুপ করে ওর ঠোঁটের ওপর পড়ল। খুদে একটা তাপপ্রবাহ ওটাকে ছুঁয়ে গেল, জ্বলে উঠল চুরুট। ঘাড়ের পেছনের এগজস্ট বালব্ ফুলে উঠল ধোঁয়া বের করে দেয়ার জন্য। চুরুট ফুঁকতে ফুঁকতে হেঁটে চলল ক্ৰামার।

প্ল্যানের সূচনাপর্ব ক্রামারের মাথায় এসেছিল অদ্ভুত উপায়ে। ফাগান্ডার ছোট এক কিউরিও শপে সে পুরানো একটা ফুলদানি কিনেছিল। ফুলদানিটার একপাশে ছিল কিছু বর্ণমালা, অন্যপাশে ছন্দহীন একটা কবিতা।

আশ্চর্য হয়ে ক্রামার আবিষ্কার করল বর্ণমালা আর কবিতা দুই মিলে ইঙ্গিত করছে ‘ব্যুরো অভ স্ট্যান্ডার্ডস’-এর প্রাচীন এক পার্চমেন্টকে।

ক্রামার পরদিন রাতে লুকিয়ে থাকল গ্যালারিতে। ‘একশো ছাব্বিশটা গ্লাসকেস থেকে বাছাই করে একটা বিশেষ বই চুরি করল সে। ওটার মধ্যেই শূন্যের সকল রহস্য নিহিত, জানত ও। কিন্তু বই চুরির ব্যাপারটা শিগগিরই জানাজানি হয়ে যাবে যদি হোম ভাল্লাকে চিরতরে সরিয়ে না দেয় সে। হোম ভাল্লা মার্শিয়ান ভাষাবিজ্ঞানী। বহুবছর গবেষণায় নিয়োজিত থাকার পর কিছুদিন আগে ঘোষণা দিয়েছে অচিরেই সে প্রাচীন মার্শিয়ানদের সকল পুস্তকের মর্মার্থ উদ্ধার করবে।

সুযোগের সন্ধানে থাকল ক্রামার। জানল হোম ভাল্লা ছুটি কাটাতে কিছুদিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে যাবে। তারপর সে একদিন ভাল্লার বাড়িতে ঢুকে হিট গানের আঘাতে ভাল্লাকে মেরে লাশটাকে লুকিয়ে ফেলল নগরীর পরিত্যক্ত টিউবগুলোর একটাতে।

কিন্তু ব্ল্যানচার্ড? হ্যাঁ, ব্ল্যানচার্ড সম্ভবত তিনটে ঘটনার মধ্যে কোনও কু খুঁজে পাবে: চুরি যাওয়া বই, হোম ভাল্লার মৃত্যু এবং ক্রামারের অন্তর্ধান 1 কিন্তু সব জানতে ওরও সময় লাগবে। ইতিমধ্যে ক্রামার আইনের নাগালের বাইরে চলে যাবে।

হাঁটার সময় খালটাকে ভাল করে লক্ষ করল ক্রামার। ধারাল ব্লেডের মত সোজা চলে গেছে গ্র্যান্ড ক্যানাল সামনের দিকে। দেয়ালগুলো খাড়া, লাল পাথরের। করাতের মত কালো, খাঁজকাটা দাগ দেখল সে মাটিতে | শুকিয়ে যাওয়া পানির দাগ, জানে ক্রামার।

শূন্যের রহস্য জানার জন্য কত অভিযাত্রী এই পথ পাড়ি দিয়েছে কে জানে, কিন্তু সবাই শেষ পর্যন্ত নিখোঁজ থেকেছে। যদি শূন্যের গর্ভে রেটনাইট থেকেই থাকে তা হলে কোন্ সেই শক্তি সকল অনুপ্রবেশকারীদের গ্রাস করে নিচ্ছে?

চুরি করা বইটা ক্রামারকে হতাশই করেছে। গোলক ধাঁধার মত অসংখ্য খাল আঁকা আছে বইয়ের মানচিত্রে, কিন্তু আসল রহস্য সম্পর্কে একটা কথাও উল্লেখ নেই।

দুপুরের দিকে বিশ্রাম নেয়ার জন্য থামল ক্রামার। আধঘণ্টা পর আবার যাত্রা শুরু করল। কিছুদূর এগোবার পর ওর চোখের ওপর ‘ভিশন প্লেট’-এ ম্লান একটা আলো জ্বলে উঠল।

ভয়ের ঠাণ্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল ক্রামারের শিরদাঁড়া বেয়ে। ভিশন প্লেটে একটা লাল দেয়াল আর বড় একটা দরজা দেখতে পেল সে। ওই দরজা পেরিয়ে এসেছে সে বহুক্ষণ আগে। ক্রামার দেখল খুলে গেল দরজাটা, স্পেসসুট পরিহিত এক লোক আবির্ভূত হলো। ক্রিস্টাল হেলমেট মাথায় তার, চেহারা স্পষ্ট চেনা গেল। ব্ল্যারচার্ড!

পুলিশ ইন্সপেক্টর ব্ল্যানচার্ড মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসল, বালু পরীক্ষা- করছে। হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়াল সে, দ্রুত পা বাড়াল সামনে।

গালি দিল ক্রামার। দু’ঘণ্টাও হয়নি হোম ভাল্লাকে সে খুন করে এসেছে, এরই মধ্যে ধূর্ত লোকটা ওর পিছু লেগে গেল? এত দ্রুত সে কী করে এখানে হাজির হলো! ক্রামার নিশ্চয়ই কোনও চিহ্ন ফেলে এসেছে।

আতঙ্কের একটা ঢেউ মুহূর্তের জন্য গ্রাস করল ক্রামারকে। পরক্ষণে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনল সে। শুয়ে পড়ল বালুতে, খাবার ট্যাবলেট চিবাতে চিবাতে ঘুমিয়ে পড়ল একটু পরই।

ভোরের আগে ঘুম ভেঙে গেল ক্রামারের। আবার এগোতে শুরু করল অন্ধকারে। কিন্তু সূর্যের প্রথম আলো গ্র্যান্ড ক্যানালে প্রবেশ করতেই তিনটে কোয়ানথ্র ওকে আক্রমণ করে বসল।

কোয়ানথ্রগুলোর বছরের এই সময় দক্ষিণ মণ্ডলে থাকার কথা। এগুলো কোত্থেকে এল? সোর্ড ফিশ চেহারার তিনটে কিম্ভূত কোয়ানথ্র-র পাখার আওয়াজ প্রবল আঘাত হানল ক্রামারের ইয়ার ফোনে।

এক গুলিতে প্রথমটাকে মেরে ফেলল ক্রামার, হিট পিস্তলের ডাবল চার্জে দ্বিতীয় পাখিটা মারাত্মক আহত হলো, কিন্তু তৃতীয়টা ইস্পাত কঠিন দাঁত বের করে ভয়ঙ্কর গতিতে তেড়ে এল ওর গলা লক্ষ্য করে।

ঝট করে মাথা সরাল ক্রামার। একটুর জন্য ধারাল দাঁত বসল না গলায়। পকেট থেকে ছুরি বের করার আগেই ভয়ঙ্করদর্শন পাখিটা কামড় দিল ওর কাঁধে। একই সঙ্গে ওটার বুকে চকচকে ব্লেড ঢুকিয়ে দিল ক্রামার। প্রাণহীন দেহটা ছিটকে পড়ল দূরে।

অনেকক্ষণ হাঁপরের মত হাঁপাল ক্রামার। একটু সুস্থির হতেই চিন্তাটা মাথায় এল ওর।

তিনটে কোয়ানথ্রকে মেরেছে সে। তার মানে বাকি সাতানব্বইটা কাছে পিঠেই আছে। কোয়ানথ্ররা সবসময় একশোর একটা ঝাঁক মেলে ওড়ে। কাঁধের যন্ত্রণা সত্ত্বেও ক্রামারের মুখে চওড়া হাসি ফুটল, মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে ওর।

হ্যাভারস্যাক খুলল ক্রামার, তিনটে মৃতদেহের গায়ে লবণ ছিটাতে শুরু করল। লবণ খেতে খুব পছন্দ করে কোয়ানথ্ররা। তা ছাড়া শিগগিরই ওরা টের পেয়ে যাবে ঝাঁক থেকে তিনজন নিখোঁজ। সঙ্গীদের খুঁজতে বেরুবে ওরা। লবণের গন্ধে গোটা ঝাঁকটা হাজির হবে এখানে, থাকবেও অনেকক্ষণ। আর তখন যদি ব্ল্যানচার্ড এসে হাজির হয়…! নতুন উদ্যমে হাঁটা দিল ক্রামার।

ডুরেসিলেন্ট টেপ লাগাতেই কাঁধের কাটা দাগটা মিলিয়ে গেল। কিন্তু বেজার হয়ে ক্রামার আবিষ্কার করল কোয়ানথ্রর আক্রমণে ওর ভিশন সেটের ক্ষতি হয়েছে। ব্ল্যানচার্ডকে দেখার জন্য যতবার সুইচ টিপল সে, প্রতিবারই ভিশন প্লেট ঝাপসা হয়ে থাকল।

দ্বিতীয় দিন রাতে ফার্স্ট ওয়ে স্টেশনে পৌঁছুল ক্রামার। দরজাহীন খুদে একটা ঘরে ঢুকল, মেঝেতে আবর্জনা বোঝাই। এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল সে। এদিক ওদিক তাকাতেই এক দেয়ালের গায়ে অক্ষত একটা স্প্যানার গ্লাস চোখে পড়ল ক্রামারের। গ্লাসটা পরীক্ষা করে খুশি হয়ে উঠল ও। গ্লাসটার ব্যাটারির সঙ্গে নিজের সুটের ডিভাইসের কানেকশন লাগিয়ে বোতাম টিপতেই গ্লাসের গায়ে হিজিবিজি রেখা ফুটে উঠল। কয়েক সেকেন্ড পরেই পরিষ্কার হয়ে গেল পর্দা। ব্ল্যানচার্ডকে স্পষ্ট দেখা গেল, নাছোড়বান্দার মত এগিয়ে আসছে। যা দেখার দেখা হয়ে গেছে। কানেকশন খুলল ক্রামার। আরেকটা চুরুট ধরাল। ধোঁয়া ফুঁকতে ফুঁকতে সতর্ক চোখে চারদিক লক্ষ করতে লাগল। নাহ্, ধূর্ত ইন্সপেক্টরটাকে ফাঁদে ফেলা যায় তেমন কিছু নেই এই ঘরে। বেরিয়ে এল ক্রামার, সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটা ধরল।

রাস্তার ডানধারে একটা গম্বুজাকৃতির বাড়ি চোখে পড়ল ক্রামারের। খাল শ্রমিকরা এখানে বহু আগে রাত্রিযাপন করত। রাস্তার বাঁ পাশে উঁচু একটা টাওয়ার। প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় মার্শিয়ান রাজবংশ টাওয়ারটাকে ক্যানাল গ্র্যান্ডে ঢোকা এবং বেরুবার সময় ট্রাফিক সিগন্যাল হিসেবে ব্যবহার করত।

সর্বশেষ বিল্ডিংটার চেহারা এখনও ভাল। বিল্ডিংটায় দরজাও নেই। বালুর একটা স্তূপ জমে আছে ওখানে। ফুট পাঁচেক উঁচু। ভেতরে ঢুকল ক্রামার। তনুভূত বায়ু (rare fied air) ভেতরের জিনিসগুলো এখনও ঠিকঠাক রেখেছে।

লম্বা ডেমডেম বারটা এক দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে আছে এখনও। ছোট কয়েকটা চোরা-কুঠুরি দেখতে পেল ও। ওগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে ভয়ঙ্কর ইলেকট্রো হিপনোটিক মেশিন।

একটা ভাঙাচোরা মেশিনের সামনে এসে দাঁড়াল ক্রামার। আগের শতাব্দীর মার্শিয়ানরা সেল্ফ অ্যাপ্লাইড হিপনোটিজম-এর দক্ষতা অর্জন করেছিল। মেশিনটা তুলে নিল ক্রামার, দরজার কাছে চলে এল। বালির স্তূপের ওপর বসাল ওটাকে, তারপর দ্রুত হাতে কাজ শুরু করল। এসব মেশিন কী করে সচল করা যায় জানা আছে ক্রামারের। আর হাতের কাছে তো ইন্সট্রুমেন্ট রয়েইছে। অল্প সময়ের মধ্যে জিনিসটাকে আগের অবস্থায় রূপ দিল ক্রামার। সন্তুষ্ট হয়ে উঠে দাঁড়াল। ইলেকট্রিক স্টাইলাসটা বের করে সম্মোহন যন্ত্রের রিফ্রাক্টো গ্লাস প্যানেলে গোটা গোটা অক্ষরে লিখল:

‘ব্ল্যানচার্ড আমি জানি তুমি আমার পিছু নিয়েছ, কিন্তু এখান থেকে আমাদের পথ আলাদা হয়ে যাচ্ছে। তুমি যদি জানতে চাও আমি কোন্ খাল দিয়ে গিয়েছি, তা হলে জবাবটা গ্লাসের মধ্যে থেকে খুঁজে নাও।’

নিজের নাম দস্তখত করে নিঃশব্দে হাসল ক্রামার, এই ফাঁদটা বেশ জটিল। কিন্তু ব্ল্যানচার্ডও কম ধুরন্ধর নয়, জানে সে, তবে ব্ল্যানচার্ডকে এই পথে অবশ্যই আসতে হবে, ব্লু খুঁজবে। হিপনোটিজম মেশিনটাকে চোখেও পড়বে, এবং তারপর লেখাটার দিকে তাকাবে সে।

রিফ্রাক্টো গ্লাসের দিকে তাকানো মাত্র কাজ শুরু করে দেবে যন্ত্র। দ্রুত এবং গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবে সে, আর জাগবে না। আর যদি সে পিছু হটে আসতে চায়, তা হলে ধাক্কা খাবে দেয়ালের সঙ্গে। ভারী গার্ডারটা ওখানে জায়গামত ঝুলিয়ে রেখেছে ক্রামার। ওকে একেবারে পিষে ফেলবে।

এই ওয়ে স্টেশনে পাঁচটি খুদে খাল এসে মিশেছে গ্র্যান্ড ক্যানালের সঙ্গে। কিন্তু ক্রামার কোনও খালের দিকেই যাবে না। কথাটা সে লিখেছে স্রেফ তার অনুসরণকারীকে ধোঁকা দেয়ার জন্যে। উৎফুল্লচিত্তে ক্রামার ক্যানাল গ্রান্ড ধরে হাঁটতে লাগল।

যেতে যেতে ক্রামার বার কয়েক চেষ্টা করল তার ভিশন সেটটাকে ঠিক করতে। একবার প্রায় ঠিক হয়ে এসেছিল কিন্তু পরক্ষণে ঝাপসা হয়ে গেল ছবি, তারপর কন্ট্রোল থেকে আর সাড়াশব্দই এল না। কাঁধের যন্ত্রণাটা আবার ফিরে এসেছে, বাঁ হাতটা অবশ ঠেকছে। ক্রামার টের পেল বগলের নীচের গ্ল্যান্ড ফুলে উঠেছে।

দুপুরের দিকে ক্রামার লক্ষ করল চারপাশের দৃশ্যপটের খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে। ক্যানালের দেয়ালগুলো যেন আরও গভীর, আরও চেপে আসছে। বড়বড় পরিখাগুলোর রঙ টকটকে লাল, ঝলসে দিচ্ছে চোখ।

হঠাৎ থমকে দাঁড়াল ক্রামার, চোখ বড় হয়ে গেল বিস্ময়ে। সিকিমাইল দূরে ওর পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে কালো রঙের বিশাল এক পাথরের ঢিবি।

পাহাড়! কাছে যেতেই বড়বড় বোল্ডারগুলো স্পষ্ট দেখতে পেল ক্রামার, একটার ওপর আরেকটা স্তূপ হয়ে আছে, কেমন ভয় ধরানো একটা ভাব আছে ওগুলোতে। এগুলো এখানে এল কোত্থেকে? ক্যানালের মাথার ওপর দিয়ে নিশ্চয়ই গড়িয়ে আসেনি, আর শিলাস্তূপের আকৃতিটা এত নিখুঁত যে ক্রামারের বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল না এটা প্রকৃতির কোনও সৃষ্টি।

সাবধানে আগে বাড়ল ক্রামার। বিশ গজ দূরত্ব থাকতে সে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল, ভয়ের একটা ঢেউ ওকে নাড়া দিয়ে গেল। পাথরগুলোর মধ্যে জ্যান্ত কী যেন একটা আছে। ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে ওর দিকে যেন তাকিয়ে আছে পাথরগুলো।

হঠাৎ গলা চিরে ভয়ার্ত একটা চিৎকার বেরুল ক্রামারের, ঘুরেই দৌড় দিল। দৌড়াতে দৌড়াতে এক সেকেন্ডের জন্য পেছন ফিরে চাইল ও, অবিশ্বাস্য দৃশ্যটা দেখে ছানাবড়া হয়ে গেল চোখ। ‘পাথরগুলো’ ঢিবি থেকে নেমে এসেছে, ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল শক্ত মাটিতে। ধীরে, তবে নির্ভুল নিশানায় ওকে অনুসরণ শুরু করল ‘ওরা’।

ক্রামারের চকিতে মনে পড়ে গেল কথাটা। বুঝতে পারল কীসের পাল্লায় পড়েছে। গ্র্যান্ড ক্যানালের মূর্তিমান আতঙ্ক ওগুলো-ক্যানালৱাস।

প্রথমদিকে সহজেই দৌড়ে ওদের পেছন ফেলে দিল ক্রামার। কিন্তু ওরাও গতি বাড়ালে দিশেহারা বোধ করল সে। বালির ওপর দিয়ে গড়িয়ে আসছে ক্যানাব্রাসেরা, যেন ওজন শূন্য। পেছন ফিরলেই ওগুলোর গুহার মত মুখ আর অসংখ্য চোখ দেখতে পাবে ভেবে ওদিকে তাকাল না ক্রামার।

ওদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে সে। ক্যানালব্রাসরা অজৈব, তবে সর্বভুক। ওরা জৈব পদার্থ বা প্রাণী থেকে খাবার সংগ্রহ করে। কিন্তু মাটির ওপর এমনভাবে পড়ে থাকে যেন কয়লার একটা ডিপো।

ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে ক্রামার। কীভাবে দানবগুলোর হাত থেকে নিস্তার পাবে জানে না। হঠাৎ অনেকদিন আগে একটা বইতে পড়া তথ্যটা মনে পড়ে গেল ওর। ক্যানালব্রাসরা সব-সনিক কম্পন সহ্য করতে পারে না। একমাত্র এই জিনিসটাই ওদের ঠেকিয়ে রাখতে পারে। কিন্তু ক্রামারের কাছে এই মুহূর্তে ভাইব্রেটর নেই, তবে হিট পিস্তল আছে। উন্মাদের মত হোলস্টার থেকে একটানে অস্ত্রটাকে বের করল ক্রামার, ঘুরে দাঁড়াল, এবং গুলি করল।

রেজাল্ট কী হবে জানা ছিল না ক্রামারের। নল থেকে আগুনের একটা ঝলক বেরুল্ শুধু, যেন ঝাঁকি খেয়ে থেমে গেল ক্যানালব্রাসদের দলটা। স্নো মোশন ছবির মত একসঙ্গে ঘুরে গেল সব ক’টা, রণেভঙ্গ দিল। আগের জায়গায় ফিরে গেল ওরা, একটা আরেকটার ওপর চড়ে বসল, ঠিক আগের পজিশনে ফিরে গেল কয়েক মিনিটের মধ্যে।

অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল ক্রামার, এখনও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না একটু আগের ঘটনাটাকে। তারপর সাহসের সঙ্গে পরীক্ষাটা করল।

ক্রামারের হিট পিস্তলটা লেটেস্ট গান-লারকিটন টাইপের, বিদ্যুৎপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের ছোট্ট যন্ত্রটা কম্পন নিয়ন্ত্রণে ওস্তাদ। খুব কম অস্ত্রেই সুপার-সনিক চার্জ থাকে। ক্রামারের পিস্তলটা সেগুলোর মধ্যে একটা।

সাব-সনিক চার্জ দিয়ে যদি ক্যানালব্রাসদের সাময়িকভাবে স্থির করে দেয়া যায়, তা হলে সুপার-সনিক কিংবা আলট্রা-সনিক ওয়েভ দিয়ে ওদের সচল করা কি সম্ভব নয়?

সেই চেষ্টাই চালাল ক্রামার, অস্ত্রটা অ্যাডজাস্ট করল, গুলি ছুঁড়তেই পাথুরে আকৃতিগুলো যেন জীবন ফিরে পেল। সাব-সনিক আগুনের একটা গোলা ওদেরকে আগের মত আগ্রাসী হামলা চালানোর পর্যায়ে নিয়ে গেল।

আবিষ্কারের আনন্দে একটা সিগার ধরাল ক্রামার। পনেরো মিনিটের মধ্যে সে তৃতীয় ফাঁদটা পাতল। যদিও এই ফাঁদ পাতার কোনওই দরকার ছিল না। কিন্তু কোন রকম ঝুঁকি নিতে রাজি নয় ক্রামার ি

হিট গানটা বালুতে পুঁতল সে, শুধু ব্যারেল আর ট্রিগারটা বেরিয়ে থাকল। একটা দড়ি শক্ত করে আড়াআড়ি বাঁধল ক্যানাল ফ্লোরের বিশগজ জায়গা জুড়ে। দড়ির একটা গিঁট বাঁধা থাকল ট্রিগারের সঙ্গে। ব্যারেলটা সোজা তাক করে রাখল ক্রামার ক্যানাব্রাসদের দিকে।

‘এখন,’ বিড়বিড় করে বলল সে, ‘যদি এই পথে ব্ল্যান র্ড ওয়ে স্টেশনের দিকে আসে তা হলে সে মস্ত একটা সারপ্রাইজ পাবে। আসলে আজকালকার যুগে মস্তিষ্ক না থাকলে কোনও কাজ করা সম্ভব না। ‘

আত্মতুষ্টিতে বলীয়ান ক্রামার জ্যান্ত পাথরগুলোকে পেছনে রেখে লম্বা পায়ে ক্যানালের দিকে এগোল।

সিকি মাইল এগোবার পর ও চুরি করা ম্যাপটা বের করে চোখ বোলাতে লাগল। ম্যাপ আঁকা বইটা হাতে নিয়ে চারদিকে লক্ষ করতে করতে হাঁটতে লাগল।

প্রতি একশো গজ যাওয়ার পর একবার করে থামল ক্রামার, গ্র্যান্ড ক্যানালের শাখা মুখগুলোকে পরীক্ষা করে দেখল। কোনও কোনওটা গ্র্যান্ড ক্যানালের মতই বড়। একবার সন্দেহ হলো ক্রামারের, পথ ভুল ধরেছে কিনা। কিন্তু হাল ছাড়ল না সে। চলার গতি একটুও শ্লথ হলো না। গ্র্যান্ড ক্যানালের মূল ধমনীতে ঘুরপাক খেলেও একসময় ঠিকই আসল জায়গায় পৌঁছে যাবে, শপথ করল ক্রামার।

এদিকটাতে, গ্র্যান্ড ক্যানালের দেয়ালের গায়ে অসংখ্য চিত্রলিপি চোখে পড়ল ক্রামারের। অনেক লেখাই মুছে গেছে, কিছু অস্পষ্ট। তবুও চেষ্টা করল যদি পড়া যায়। একটা চিত্রলিপি পড়তে গিয়ে ধাক্কা খেল, ভ্রূ কুঁচকে উঠল। অনুবাদ করল ক্রামার: ‘প্রতিধ্বনি থেকে সাবধান।

কিন্তু চিত্রলিপির কথা একটু পরই সে ভুলে গেল। ব্ল্যানচার্ডের অবস্থান জানার জন্য ভিসা ‘সেটে হাত লাগাল। যন্ত্রটা কর্কশ শব্দ তুলল, গুঞ্জন ধ্বনি শোনা গেল, এক সেকেন্ডের জন্য কাজ শুরু করে দিয়েই আবার নষ্ট হয়ে গেল।

ওই এক সেকেন্ডেই যা দেখার দেখে নিয়েছে ক্রামার। বালুর সমুদ্র ভেঙে অপ্রতিরোধ্য গতিতে থপথপ করে এগিয়ে আসছে ব্ল্যনিচার্ড। দুটো ফাঁদকেই সে ফাঁকি দিয়ে এসেছে। চমকে উঠল ক্রামার। লোকটাকে কি কিছুতেই থামানো যাবে না?

অজান্তেই হাঁটার গতি দ্রুততর হলো ক্রামারের, প্রতিটি পদক্ষেপে মুখ বিকৃত হয়ে উঠল ওর। কাঁধের ব্যথাটা বেড়ে গেছে খুব।

লক্ষ করল ক্রামার ক্যানালের লাল রঙের দুই তীরের দ্যুতি অনেকটাই ম্লান হয়ে আসছে, কেমন ধাতব রঙের লাগছে। এদিকের তীরের দেয়ালের রঙ ক্রমশ স্লেটরঙা হয়ে উঠল, আরও উঁচু, যেন টানেলের মত মাথায় সমকেন্দ্রী হয়ে আছে। হঠাৎ টের পেল ক্রামার একটা অস্বস্তিবোধ ঘিরে ধরছে ওকে, ইচ্ছে করল চিৎকার করে এই ভয়াবহ নৈঃশব্দ ভেঙে খান খান করে দেয়।

আরও হাত বিশেক এগোবার পর ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠল মনে। যেন শব্দহীন এই নীরবতা চেপে বসছে কানে। ইচ্ছের বিরুদ্ধেই ক্রামার এগিয়ে গেল কাছের দেয়ালটার দিকে। একটা বড় পাথরের টুকরো হাতে নিয়ে পাগলের মত ধাতব দেয়ালটায় আঘাত করতে লাগল। কিন্তু কোনও শব্দ হলো না। যেন কাঠের হাতুড়ি দিয়ে সে তুলোর বস্তা পিটাচ্ছে। হঠাৎ স্থির হয়ে গেল ক্রামার। চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেল পাথরের টুকরোটা থেকে কী যেন একটা বেরিয়ে অবিশ্বাস্য গতিতে ছুট দিল ক্যানালের পথ ধরে। ছায়ার মত জিনিসটা, কিন্তু হাত-পা আছে, বোতামের মত ছোট্ট একটা মাথাও চোখে পড়ল।

টুকরোটা দিয়ে আবারও আঘাত হানল ক্রামার। আবারও একটা ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এসে সবেগে ছুটে গেল সামনে। ক্রামার শুয়ে পড়ল বালুতে, যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। বিপরীত দিকের দেয়াল থেকে এবার আবির্ভূত হলো ওরা, বারোজনের একটা দল। গুঞ্জনের শব্দ উঠল, ধীরে বেড়ে চলল আওয়াজটা। ভয়ঙ্কর শব্দটা প্রায় পাগল করার জোগাড় করল ক্রামারকে। হেডসেটের সুইচ অফ করে দিল সে। কিন্তু শব্দের কম্পনটা যেন ঢুকে গেল ওর স্পেসসুটের ভেতরে, হেক্সটার হেলমেটের মধ্যে। যেন ছোট ছোট হাতুড়ি দিয়ে ছায়ামূর্তিগুলো ক্রমাগত বাড়ি মেরে চলেছে ওর মাথায়।

এগুলোই কি সেই প্রতিধ্বনি তোলা ছায়ামূর্তি যাদের কথা কিছুক্ষণ আগে এক চিত্রলিপিতে দেখে এসেছে ক্রামার? নাকি গোটা ব্যাপারটাই ওর মস্তিষ্কের উদ্ভট কল্পনা, আহত হাতের আঘাতজনিত জ্বরের ফল? জানে না সে।

ক্রামার ওখানেই তালগোল পাকিয়ে বসে থাকল। এক সময় প্রতিধ্বনিটা পুরোপুরি থেমে গেল। ক্রামার ভাবল এটাকেও ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করা যায় কিনা। শেষ একটা ফাঁদ, যেটা ব্ল্যানচার্ডকে থামিয়ে দিতে পারবে চিরতরে।

কিন্তু ভাবনা চিন্তার বেশি সময় নেই ওর হাতে। পেছন ফিরে তাকাল ও, সঙ্গে সঙ্গে চোয়াল ঝুলে পড়ল প্রবল অবিশ্বাসে

একটা লোক বালুর ওপর দিয়ে ধীরগতিতে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। ব্ল্যানচার্ড!

লাফিয়ে উঠল ক্রামার, যেন ভূতে তাড়া করেছে এমন ভাবে দৌড় দিল সে, এক মুহূর্তের জন্যেও আর কোথাও থামল না। প্রাণভয়ে দৌড়ে চলল সে।

দিন ছয় পরে ক্রামার তার অভিযানের শেষ পর্বে চলে এল। ক্রামারের বিশ্বাস এখন যে কোনও মুহূর্তে রেটনাইট ডিপোজিটের গুহামুখটা তার চোখে পড়তে পারে। আর তারপরই সকল দুশ্চিন্তা আর টেনশনের অবসান হবে। প্রচুর পরিমাণে রেটনাইট নেবে সে। বইতে লেখা আছে ওটাকে পরিশুদ্ধ করার নিয়ম। ক্যানাল টুয়েন্টি এইট নর্থ-ওয়েস্টের পথ ধরে এগোলে যেভাবেই হোক সে পৌঁছে যাবে ক্রেটার সিটিতে। ব্ল্যানচার্ড যদিও এখন তার খুব কাছে চলে এসেছে, কিন্তু সে ওর একটা ব্যবস্থা করতে পারবে।

তাকে এক বছর-বড় জোর ছয় মাস সময় দাও, সাফল্য হাতের মুঠোয় নিয়ে আসবে ক্রামার। মনের দরজা খুলে যাবে ওর, সকল দুশ্চিন্তা তাড়িয়ে দেবে সে। আর আইনকে নিজের হাতে তুলে নেয়ার ক্ষমতা অর্জন করবে সে তখন।

কিন্তু তারপরও একটা প্রশ্নের জবাব অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে-ওই শূন্য। ক্যানাল গ্র্যান্ডে প্রবেশ করার পর থেকে চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে চেয়েছে ক্রামার। কিন্তু জোঁকের মত সেঁটে আছে ওটা মস্তিষ্কে। কিন্তু ও যতই নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ততই চিন্তাটা ওকে আলোড়িত করছে।

ওটা সামনে কোথাও হবে, হয়তো একটা উপসাগরের মত, যেটাকে তার পাড়ি দিতেই হবে। কিন্তু ওখানে না পৌঁছা পর্যন্ত প্রশ্নটার জবাব সে পাচ্ছে না।

ক্যানালের আশপাশ সতর্কতার সাথে পরীক্ষা করতে লাগল ক্রামার। ওর গলা শুকিয়ে কাঠ, হাত আর বাহুতে কোনও সাড়া নেই, যেন শরীরের কোনও অঙ্গ নয় ও দুটো। বিশ্রামের সময় প্রতিবার ও চোখের সামনে লাল ফুটকি ফুটতে দেখল।

বেলা তিনটার দিকে ক্রামার বিস্মিত হয়ে লক্ষ করল ক্যানালের বাঁ দিকের দেয়াল স্পর্শকের মত উঠে গেছে ওপরে, ওর সামনে সৃষ্টি করেছে এক বিশাল উপবৃত্ত। একই সঙ্গে বালুর মেঝে নেমে গেছে নীচের দিকে, গভীর থেকে গভীরে। এক সময় তীর আর চোখেই পড়ল না ওর।

ঘণ্টাখানেক পর একটা দৃশ্য দেখে সবিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল ক্রামার।

সিকি মাইল সামনে, ক্যানালের ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অদ্ভুত কিছু বস্তু। ক্রামার দেখল ওগুলোর মধ্যে রয়েছে আধুনিক রকেট শিপ, ত্ৰিশ শতাব্দীর বিশাল ডানাওয়ালা স্টেপটো বিমান। সবগুলো চুপচাপ পড়ে আছে, দরজা খোলা। যেন ক্রুরা বাইরে গেছে কিছুক্ষণের জন্য, এখুনি ফিরবে।

কিন্তু কাছে আসতে ক্রামার বুঝল উডুক্কু যানগুলো বহুদিন থেকে এভাবে পড়ে আছে। কাঠামোর অর্ধেক ডুবে আছে বালুতে। জীর্ণ চেহারা, কাঁচের রঙ হলদেটে।

মোট বিশটা যান, গুণল ক্রামার, এর মধ্যে একটার নাম পড়ে যানটাকে চিনতে পারল সে। গোলিয়াথ। বহু আগে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। পুরানো বাহনগুলোর বেশিরভাগই সে ইতিহাস বইতে দেখেছে।

ক্রামার বুঝতে পারল বিমানগুলোর শেষ গন্তব্য ছিল এখানেই। ওরা হয়তো শূন্যকে আবিষ্কারের আশায় এতদূর এসেছিল। কিন্তু ক্রুদের কী হলো? তারা আর ফেরেনি কেন?

শেষ বিমানটা পার হয়ে খানিক এগোবার পর দাঁড়িয়ে পড়ল ক্রামার। অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। অয়েলস্কিনের খুদে বটুয়াটা খুলে বইটা বের করে মনোযোগ দিয়ে একটা জায়গায় চোখ বোলাতে শুরু করল সে।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উল্লাস ধ্বনি বেরিয়ে এল ক্রামারের গলা থেকে। আরি, জিনিসটা তো আগে চোখে পড়েনি ওর। কিন্তু ক্যানালের এই জায়গাটা ম্যাপে চিহ্নিত আছে। তার চেয়েও বেশি; মানচিত্র স্পষ্ট বলছে বিশাল এক বাটির মধ্যে জমা হয়ে আছে মহামূল্যবান সেই পরশমণি-রেটনাইট।

ক্যানালের মুখে দুটো ট্রেইল দেখা যাচ্ছে। একটা সরু, ডট লাইন দিয়ে চিহ্নিত করা। অন্য ট্রেইলটা বড়, দুটি মাত্র শব্দে প্রাচীন মার্শিয়ানদের প্রবেশের কথা বলা হয়েছে। এ-ক্রি মেনাগ্রা, লেখা আছে ম্যাপে।

ক্রামার উঠে দাঁড়াল, পুব দিক লক্ষ্য করে শ’খানেক গজ হেঁটে গেল। কিন্তু কোনও ট্রেইল চোখে পড়ল না। ধু ধু বালু ছাড়া কিছু নেই। তারপর, অন্যমনস্কভাবে মাথা সামান্য ওপরে তুলতেই ওটাকে দেখতে পেল সে।

ওর সামনে একটা সরু করিডর, ম্যাপে বর্ণিত ট্রেইলটার মত। বালুর মেঝে ওখানে ঢালু হয়ে আছে বিচিত্র ভঙ্গিতে। কিন্তু করিডরের মুখে একটা চকচকে ভাব। যেন ডাবল গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আছে সে।

দুটো ট্রেইলের একটাকে আবিষ্কার করেও এবার আর লাফিয়ে উঠল না ক্রামার। সরু ট্রেইলটার তো খোঁজ পাওয়া গেল, কিন্তু বড়টা কোথায়? ওটা হয়তো আরও সামনে হবে। ম্যাপটাকে ফেলে দিল সে বালুতে, মাড়িয়ে গেল। যেন ভুলে ফেলে গেছে ওটাকে।

পুবদিক ধরে হাঁটতে থাকল ক্রামার। অল্পক্ষণের মধ্যেই পেয়ে গেল যা খুঁজছিল। দ্বিতীয় ট্রেইলটা বড়, বেশ বড়। বালু থেকে একটা পাথুরে দেয়াল উঠে গেছে ওর সামনে। এখানেও, ট্রেইলের মুখে গ্লাসের মত জিনিসটাকে দেখতে পেল ও।

তবে ইতস্তত না করে ভেতরে ঢুকে পড়ল ক্রামার। সঙ্গে সঙ্গে উল্লাস বোধ করল সে। পেছনের পথটা বন্ধ হয়ে গেছে, এরকম একটা অনুভূতি একই সঙ্গে কাজ করল ওর ভেতরে।

এ-ক্রি মেনাগ্রা? কী মানে ওই শব্দগুলোর? মেনার, জানে ক্রামার, প্রাচীন একটি মার্শিয়ান শব্দ। মানে হচ্ছে কুঞ্চিত বা বক্র হওয়া। আর ক্রি শব্দের অর্থও তার জানা-উন্মুক্ত, ফাঁকা জায়গা।

দাঁড়িয়ে গেল ক্রামার, শীতল একটা স্রোত নামল মেরুদণ্ড বেয়ে। শব্দগুলোর সম্পূর্ণ অর্থ এখন ওর কাছে পরিষ্কার। তা হলে শূন্যের আসল রহস্য হচ্ছে এই! কেন অভিযাত্রীরা শূন্যে যাত্রা করেও আর ফিরে আসেনি বুঝতে পেরে গা ঠাণ্ডা হয়ে এল ক্রামারের, কেন গ্র্যান্ড ক্যানাল শুকিয়ে গেছে তার জবাবও পেয়ে গেছে সে ইতিমধ্যে। এ আলাদা এক জগৎ-আলাদা ডাইমেনশন-এখানে যে একবার প্রবেশ করে সে আর ফেরে না, নিখোঁজ হয়ে যায় চিরদিনের জন্য। শূন্য তাকে গ্রাস করে।

খুব আস্তে আবার হাঁটতে শুরু করল ক্রামার। জোর করে চোখ দুটো সামনের দিকে নিবদ্ধ রাখল সে। কিন্তু একসময় আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না, ঘুরে দাঁড়াল।

নেই! ওর পেছনে কিচ্ছু নেই। যেন যাদুমন্ত্রে অদৃশ্য হয়ে গেছে গ্র্যান্ড ক্যানাল। আছে শুধু বিশাল এক অন্ধকার কালো পর্দা। আর সামনে সীমাহীন এক দূরত্ব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শূন্য

শূন্য

শূন্য

কার কথা দিয়ে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। মৈত্রসাহেবের কথা দিয়ে আরম্ভ করতে পারলে ভাল হত কিন্তু তাতে অনেকখানি পথ পিছু ফেলে যেতে হয়। ঘুরেফিরে এই পথটুকুর কথা আসবেই। মৈত্রসাহেবের কাছে আমি কেন গিয়েছিলাম, আমি কী চেয়েছিলাম তাঁর কাছে, কিসের যন্ত্রণা আমায় কলকাতা থেকে তাঁর কাছে মধ্যপ্রদেশের সেই পাহাড়ি শহরে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল—এ-সব কথা তো উঠবেই। কাজেই নিজের কথা দিয়ে শুরু করাই ভাল।

আমার নাম নিশীথ। এখন বয়স পঁয়ত্রিশ। কলকাতায় থাকি। বাড়িতে মা আছেন। বাবা মারা গেছেন অনেককাল। সহোদর এক বোন ছিল। বিয়ে হয়েছিল; ঠিক জানি না কি কারণে স্বামীর সঙ্গে তার বনেনি। শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কটা সে ত্যাগ করেছিল। তারপর আমাদেরও। আত্মীয় স্বজন বলতে আর আছেন আমার কাকা। তিনি আলাদাভাবে থাকেন, অন্য বাড়িতে। আমাদের কাছে আসেন যান। আমাদের জন্যে তাঁর স্নেহ আছে কিন্তু কোনো আতিশয্য নেই। মৈত্রসাহেব কাকার বন্ধু। কাকার মতনই আমি তাঁর কাছে গিয়েছিলাম।

মৈত্রসাহেবের কাছে আমি কেন গিয়েছিলাম তা বলতে হলে আগের ক’টা কথা বলা দরকার। অবশ্য এ-কথা বলে রাখা ভাল, মৈত্রসাহেব ডাক্তার আর আমি রুগী, আমি গিয়েছিলাম নিজেকে দেখাতে, আমার রোগের কথা বলতে।

আমার মনে হয় না, যে-ব্যাধিতে আমি ভুগেছি সেটা নতুন কিছু। এমন নয় যে এ-রোগ আর কারুর হয় না। বরং আমার মনে হয়েছে, মানুষ মাত্রেরই, বিশেষ করে আমার মতন যাদের কপাল তাদের পক্ষে এ-রোগের হাত থেকে নিস্তার পাবার উপায় নেই।

ত্রিশ বছর যখন বয়স তখন থেকেই রোগটা দেখা দেয়। তার আগে মাঝে মাঝে উপসর্গ দেখা দিয়েছে। সে সব আমি তেমন বুঝি নি, বোঝার মতন আগ্রহও হয়ত ছিল না। ত্রিশ বছর বয়সে আমি প্রথম বুঝতে পারলুম, জীবনে এমন এক-একটা ঘটনা ঘটে যা ভুলে যাওয়া দরকার। এই ঘটনাগুলো এক-একটা স্পর্শনীয় বস্তু নয়, এগুলো এমন নয় যে, নোংরা বিশ্রী কিছু তোমার চোখের সামনে পড়ে আছে মন দিয়ে সরিয়ে দিলে বা ফেলে দিলে—আর তারপর তোমার চোখের সামনে অস্বস্তিকর কিছু থাকবে না। জীবনের ধরনটা আলাদা, মনটাও অন্যরকম কিছু। আমরা তো অনেক কিছু ভুলে যাই, ত্রিশ বছরের এই জীবনের সব কথা, সমস্ত কথা, প্রতিদিনের কথাই কি আমার মনে আছে? না, নেই। তার কোটি কথার বড় জোর দশটা কি বিশটা কথা আমার মনে আছে, বাকি সব কোন্ অতলে তলিয়ে গেছে। আমি জানি না, হাজার চেষ্টা করেও মনে করতে পারব না। হ্যাঁ, আমরা ভুলি—জীবনের অজস্র কথা ভুলে যাই। কিন্তু সেই সব অজস্র কথা তেমন নয় যেগুলো মনে রাখার মতন। এরা মনে আঁচড় কাটতে পারে না, পারলেও তা এত সামান্য, এত ক্ষণিক যে একটি কি দুটি দিনের বেশি তার আয়ু নেই। অথচ যে-সব কথা, যে-সব ঘটনা মনে আঁচড় কেটে গেছে গভীরভাবে তা ভোলা যায় না; কিছুতেই না। (যদি ভোলা যেত!)

ত্রিশ বছর বয়সে আমার মনে হয়েছিল, জয়ন্তীর কথা আমায় ভুলে যেতেই হবে। না ভোলার কি আছে, জয়ন্তী সুন্দরী নয়, সে অসাধারণ কোনো মেয়ে নয়, তার এমন কোনো গুণ নেই যা আর কোথাও আর কখনো দেখা যাবে না। জয়ন্তীকে আমি ভোলবার চেষ্টা করেছি। আশ্চর্য, যত ভোলবার জন্যে ছটফট করেছি তত বেশি করে তাকে মনে পড়েছে। এক এক সময় মনে হত ও আমার মনের মধ্যে ভূতের মতন সারাদিন সারারাত তাড়া করে বেড়াচ্ছে। কত সুন্দর সকাল, দুপুর আর নিরিবিলি ঘুমের রাত—আমি সুখী মনে নিশ্চিন্ত হয়ে কাটাতে পারতাম কত আরাম আর আয়েশ করে—কিন্তু পারিনি। পারিনি জয়ন্তীর জন্যে। তার কথা কোন্ সূত্রে কি ভাবে যে মনে এসে গেছে! আর জয়ন্তীর কথা মনে পড়ার অর্থই হল—নিজের জীবনের পাঁচটা বছরকে তন্ন তন্ন করে দেখা। অসংখ্য টুকরো টুকরো দৃশ্যকে নতুন করে চোখের সামনে টেনে আনা, অজস্র কথাকে কানের কাছে আবার করে বলানো, নিজের মনে বলা কথাগুলো আবার করে বলা। আর শেষ পর্যন্ত এটা জেনে নেওয়া, মানুষ সৎ নয়, ভালবাসা কিছু নয়। হৃদয় এমন বস্তু যেখানে শিকড় গেড়ে কিছু বসে না। খুব সুন্দর নক্‌শা আর আয়না বৈ হৃদয় আর কি!

এ-কথা বলার দরকার করে না, জয়ন্তীর কথা ভাবতে আমার কষ্ট হত! কষ্ট হত বলেই তাকে আমি ভুলতে চাইতুম—কিন্তু পারতুম না।

মা আমার অবস্থাটা বুঝতে পেরেছিলেন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতেন, পুরুষ মানুষের পক্ষে এ-সব ছোটখাটো ব্যাপারে ভেঙে পড়া ভাল নয়। ও-সব কিছু না, যত প্রশ্রয় দেবে তত বাড়বে। একটা সামান্য জিনিস ভুলে যাওয়া এমন কি কঠিন! বিশেষ করে যখন সেই কথাটা ভেবে ভেবে শরীর মন খারাপ হতে বসেছে।

ব্যাপারটা খুবই তুচ্ছ, ছোটোখাটো কি না আমি জানি না। হয়ত মা যা বলেছিলেন তাই ঠিক। কোনো মেয়েকে পাঁচ বছর ধরে ভালবাসাটা এমন কিছু নয়, খুবই সামান্য জিনিস। একটা মনোহারী কুকুর কি বেড়াল পোষা। তুলোট গায়ে হাত বুলনো। আর সেই আরামে খুশি হওয়া। আমি এই তুচ্ছ বিষয়টাকে প্রশ্রয় দিচ্ছি। বড় করে তুলছি। হয়ত সবই ঠিক—কিন্তু তবু আমি জয়ন্তীকে ভুলতে পারিনি, পারতুম না।

বছরখানেক পরে আমি বিয়ে করলাম। মা-র তাগিদ ছিল, কাকারও সেই রকম ইচ্ছে ছিল। আর আমার তরফ থেকে জয়ন্তীকে আমি বোধহয় এইভাবেই ভুলতে চেয়েছিলাম। (মানুষ ভালবাসাও ভুলতে চায়!)

লতিকা সুন্দরী ছিল। নিজের স্ত্রী বললে অতিশয়োক্তি করছি না, বাস্তবিকই অসাধারণ সুন্দরী ছিল লতিকা। তার রূপে আগুনের আঁচ ছিল। হয়ত তাই শেষ পর্যন্ত আগুনও জ্বলেছিল। কিন্তু সে-কথা পরে। লতিকাকে বিয়ে করে আনার পর আমার মনে হয়েছিল জয়ন্তীকে আমি ভুলতে পারব। জলজ্যান্ত স্ত্রীর এত রূপ, এই দাহ, এই তীব্র উত্তেজনার কাছে—পাঁচ বছরের হাতধরাধরি ভালবাসার ছবিটা নিশ্চয়ই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। সত্যি কথা বলতে কি, বিয়ের পর মাসখানেক আমি লতিকার ছায়াকে আমার ছায়া থেকে সরে থাকতে দিইনি।

তবু জয়ন্তীকে ভুলতে পারলুম না। বরং লতিকার পাশে শুয়ে জয়ন্তীকে আরো বেশি করে মনে পড়ত। কেন পড়ত জানি না। লতিকার কিছু অগোচরে ছিল না। সে জানত। আমার সব কথা লতিকা জেনেছিল, কিন্তু আমিই তার কথা জানতুম না। পরে জানলুম।

পাঁজি পুঁথিতে আমার বিশ্বাস কোনো কালেই ছিল না। কিন্তু বত্রিশ বছর বয়সটা আমার যে-ভাবে গেছে তাতে মনে হয়, সবরকম দুষ্টগ্রহ এই সময়টায় আমার দিকে শকুনিচোখে তাকিয়েছিল। যেন দেখছিল আমার কি হয়, আমি কি করি। আমি কিছুই করিনি। চুপচাপ শুধু দেখেছিলুম। নীরব দর্শকের ভূমিকা। জীবনের আর একটা ভূমিকা। সকলকেই এ-ভূমিকায় অভিনয় করতে হয়। না করে উপায় কি! মাত্র পাঁচটা মাস বেঁচে থেকে ছেলেটা মরে গেল। খুব সুন্দর দেখতে হয়েছিল খোকা। লতিকার মতন গায়ের রঙ পেয়েছিল, তারই মতন ঠোঁট গাল, আর আমার মতন চোখ নাক চুল। খোকা এক শীতের সকালে মরে গেল। আশ্চর্য! কি সহজেই মানুষ মরে যায়! আর তারপর এক বর্ষার শুরুতে লতিকা পালিয়ে গেল। লতিকার কথা আমি জানতুম না, আমার কথা লতিকা জানত। আমি জানতুম না লতিকার পছন্দকরা এক মানুষ আছে, যে মানুষ চমৎকার ‘রাইড’ করতে পারে, রাইফেল চালাতে পারে। এই মানুষটি আগে থাকতেই ছিল। মাঝে পড়ে বিয়েটা আমার হয়ে গিয়েছিল। এটা একটা ভুল। অনেক মারাত্মক ভুল জীবনে হয়, বুঝে না-বুঝে। লতিকা তার মামার ভুলটা এইবার শুধরে নিল বোধহয়। লতিকা পালিয়ে যাবার পর আমার মনে হয়েছে ছেলেটা কার ছিল? আমারই তো! যারই হোক, সে-কথা আজ আর দরকার নেই। সেই শিশু তো কবেই নিঃশব্দে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। আমি তাকে খুব ভালবেসেছিলুম, পাঁচ মাসের ওই শিশুকে। খোকাকে আমার খুব ভাল লাগত।

কিন্তু তাতে কি! জয়ন্তী তার বাইশ বছরের জীবন আর মন দিয়ে বুঝতে পারেনি আমি তাকে কত ভালবাসতুম, পাঁচ মাসের শিশু কি করে বুঝবে! ওরা সব একে একে যাচ্ছিল—জয়ন্তী, খোকা, লতিকা। শেষ পর্যন্ত আভা—আমার বোন আভা সেও। আভা আত্মহত্যা করল। কেন করল আমি জানি না। স্বামীর সঙ্গে তার বনিবনা না হলেও আমাদের বাড়িতে অন্তত কোন কষ্ট হয়নি; কোন অসুবিধে ছিল না। তবু সে আত্মহত্যা করল। তার মনের কথা আমি জানি না, তার দুঃখ আমার বোঝার বাইরে। আত্মহত্যা কী ভীষণ! আভার আফিং খেয়ে মরার সেই চেহারা আমি ভুলতে পারি না।

অথচ এ সবই আমি ভুলতে চাইছিলুম—। ভুলতে চাইছিলুম জয়ন্তীকে, খোকাকে, লতিকাকে, আভাকে। ভুলতে পারছিলুম না। আমার মন যেন দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছিল। শরীরও। মা প্রায় পাগল হয়ে যেতে বসেছিলেন। তছনছ হয়ে যাওয়া এই সংসারটা আর তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না। বিশেষ করে আমার জন্যে, যখন আর কেউ নেই তাঁর এক আমি—তখন আমার জন্যে, তাঁর ছেলের জন্যে মা যে কী অসহ উদ্বেগ আর আশংকায় এবং দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছিলেন তা অনুমান করা কঠিন নয়।

আমি চেষ্টা করেছিলুম এ-সব ভুলে যেতে। জানতুম না কি করে ভুলে যাওয়া যায়! বন্ধু যোগাড় করে মদ খেয়েছি, রেসের মাঠে গিয়েছি, কখনো সখনো বেশ্যা বাড়িতে। এ-সব জিনিস এমন কিছু নয় যাতে ভালবাসার কথা ভোলা যায়, পালিয়ে যাওয়া সুন্দরী বউয়ের কথা ভোলা যায়, ভোলা যায় একটি সুন্দর সন্তানের কথা, বেচারি আর সেই আফিং খেয়ে মরা মুখটা। আমি অন্তত ভুলতে পারিনি। আমার কোনো লাভ হয়নি। বরং লোকসানই হয়েছে। মদে, রেসে, বেশ্যাবাড়িতে—কিছু টাকা গেছে, পৈতৃক অর্থ। আর শেষে এই সূত্রে আলাপ হওয়া এক বন্ধু নিরঞ্জন চক্রবর্তীকে যে হাজার আষ্টেক টাকা দিয়েছিলুম ফাটকাবাজি করতে—তাও জলে গেল। ও আমার সঙ্গে জোচ্চুরি করল।

সব ছেড়ে দিয়ে এবার ঘরকে আশ্রয় করলুম। কিন্তু কই, এই ঘরও তো আমার জীবনের ক’টা বছরকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দিতে পারল না। মা-র ইচ্ছে ছিল আমি পূজো আর্চা করি। এতে নাকি মন ভাল হয়, মানুষ দুঃখ কষ্টকে ভুলতে পারে। কিছুদিন আমি সেই চেষ্টাও করেছি। পট সামনে রেখে মূর্তি ধ্যান করবার জন্যে চোখ বন্ধ করে বসেছি—ঘরে অনেক সুগন্ধি ধূপ জ্বেলেছি, ধুনো দিয়েছি। কিন্তু পটের আড়াল থেকে জয়ন্তী আমার চোখের সামনে ভেসে উঠত, ধূনো ধোঁয়ায় রেখাগুলো উড়ে উড়ে খোকার অস্পষ্ট একটি অবয়ব তৈরি করত, লতিকা আমার মনের মধ্যে হেঁটে চলে বেড়াত, দেখতে পেতাম আভাকে, তার কথা শুনতে পেতাম।

ঈশ্বরে আমার বিশ্বাস ছিল না, মঠে মাঠে আস্থা ছিল না—তবু ক’টা দিন মা-র কথায় একটা অর্থহীন ক্রিয়া করা গেল। শেষে ছেড়ে দিলাম।

শরীর আমার আরও খারাপ হয়ে পড়েছিল। খুব খারাপ। আয়নায় নিজের চেহারা দেখলেই সেটা বুঝতে পারতাম। মন আমার ভীষণ অন্যমনস্ক থাকত, কোনো কথা ভাল বুঝতাম না, কারুর কথা শোনার মতন ধৈর্যও থাকত না। আমার ঘুম ছিল না। সারা রাত ভাঙা ভাঙা তন্দ্রা ছিল। আর সেই তন্দ্রার গায়ে দুঃস্বপ্ন। সেই জয়ন্তী লতিকা, খোকা, আভা।

বাড়িতে ডাক্তার আসত। মা ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলেন। কাকাও উদ্বেগ অনুভব করতে শুরু করেছিলেন। প্রায়ই তাই নূতন নূতন ডাক্তার আসত। তারা নাড়ি দেখত, বুক দেখত। টাকা নিত, ওষুধ দিত।

মা বলতেন, নিশীথ তুই যে পাগল হয়ে যাবি। মনটা একটু শক্ত কর। কত লোকের কত কিছু যায়, তা বলে কি তারা এমনভাবে ভেঙে পড়ে। আমার দিকে তাকিয়ে দেখ—স্বামী গেছে, মেয়ে গেল, ছেলের বউ, নাতি। তবু তো আমি দাঁড়িয়ে আছি! সত্যি মা দাঁড়িয়ে ছিলেন। কি করে কেমন করে তিনি শক্ত হয়ে আছেন আমি বুঝতে পারতুম না। তবু মাকে আমি বলেছি, ‘লতিকাকে কি তুমি ভুলতে পেরেছ মা? ঠিক করে বল!’

আমি জানতুম মা জবাব দেবেন না। লতিকা যদি মরে যেত, আত্মহত্যা করত—স্বামী এবং মেয়ের মতন মা তাকে ভুলতে পারতেন। মৃতকে ভোলা সহজ। মৃতের সঙ্গে আমি জড়িয়ে থাকি না। কিন্তু লতিকার সঙ্গে এ-সংসারের সম্ভ্রম, মর্যাদা, গৌরব—অনেক কিছুই জড়িয়েছিল, মা যার অংশীদার। নিজের অংশের এই নিলাম মার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। লতিকাকে মা তাই কিছুতেই ভুলতে পারতেন না।

আমি কাউকেই ভুলতে পারতাম না। জয়ন্তী, লতিকা, আভা, খোকা—এদের সবার সঙ্গে আমার জীবনের অনেক কিছু জড়িয়ে ছিল। বিশ্বাস, ভালবাসা, সততা, মর্যাদা, স্নেহ—এ সবই যে জড়িয়ে ছিল। কি করে আমি ভুলব!

আমার কথা কাউকে বোঝাবার নয়। নিজের কথা নিজেকেই ভাবতে হত। নিজেকেই শুধোতে হত। আমি যা বিশ্বাস করে এসেছি ছেলেবেলা থেকে, ভালবেসেছি, শ্রদ্ধা করেছি—দেখতাম তার সবই প্রায় আতসবাজির ফুলের মতন। ওরা এক একটি চোখ ভোলানো স্বপ্ন। মুহূর্তের মোহ। সত্য নয়, চিরকালের জন্য নয়, সুন্দর নয়।

একদিনের কথা মনে পড়ছে। কাকা এক ডাকসাইটে ডাক্তার এনে হাজির করেছিলেন। ভদ্রলোক আমায় প্রথমেই প্রশ্ন করেছিলেন, “আপনার অসুবিধে কি? মানে কমপ্লেনটা কিসের?”

জবাবে আমি আমার কপাল দেখিয়ে বলেছিলাম, “মাথায়।”

“কি কষ্ট হয়?”

“তা বলতে পারব না।”

“স্ট্রেঞ্জ…কি না হলে আপনার মনে হবে আপনার আর কষ্ট নেই?”

“শুধু যদি পাঁচ ছ’ বছরের কথা আমি ভুলতে পারি—যদি এই ক’বছরের স্মৃতি বলে আমার কিছু না থাকে…!’

আমার কথায় ভদ্রলোক বোধ হয় খুবই অবাক হয়েছিলেন। একটু সময় আর কথা বলতে পারেননি। তারপর আস্তে আস্তে কাকাকে বলেছিলেন, “দিস ম্যান্ ওয়ান্টস টু ড্রপ এ পোরশান অফ হিজ মেমারি!” তার পর আমার দিকে তাকিয়ে সান্ত্বনা দেবার সুরে বলেছিলেন, “আপনি যদি একটা হাত কি পা কেটে বাদ দেবার কথা বলতেন বুঝতাম, বোঝা সম্ভব ছিল—এবং সেটা করাও অসাধ্য ছিল না। কিন্তু ডোন্ট মাইন্ড, আমি জানি না—আমি শুনিনি, স্মৃতিকে কি ভাবে চাকলা করে কেটে সরিয়ে ফেলা যায়।”

এর পরই, খুব সম্ভব সেই ডাক্তার ভদ্রলোকের কথায় কাকা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন এবং ভেবেছিলেন আমার আর পাগল হতে বেশি দেরি নেই। তাড়াতাড়ি একটা কিছু করা দরকার। আমাকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা আর কি।

পুরনো বন্ধু মৈত্রসাহেবকে কাকার মনে পড়ল। প্রায় বছর বিশ আর্মিতে সার্জেনগিরি করে এখন স্বদেশে ফিরে এসে নির্জনে এবং নিভৃতে জীবন কাটাচ্ছেন। কাকা তার বন্ধুর সম্বন্ধে যা বলেছিলেন, তা থেকে বুঝতে পারলুম—মৈত্রসাহেব বিচক্ষণ লোক। সারভিসে থাকার সময় কয়েকশ’ ‘হেড ইনজিউরি’ কেস হাতে কলমে ঘেঁটেছেন। তারপর সারভিস থেকে সরে এসে ও-দেশের বড় বড় হাসপাতালে মানুষের মাথা নিয়ে নিজের মাথা খাটিয়েছেন কয়েক বছর। অবশেষে কী খেয়াল হল—সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে চলে এলেন স্বদেশে। “বাংলা দেশে স্বাস্থ্য পোষাবে না, কলকাতা ভাল লাগে না—। সিটি লাইফ আর নয়; একটু ঠাণ্ডা নিরিবিলি নির্জন জায়গায় থাকতে চাই, বুঝলে কুমুদশংকর। এম পি-র এই জায়গাটা আমার পছন্দ হয়েছে। একটা বাংলো বাড়ি কিনেছি। খাসা আছি।”—মৈত্রসাহেব কাকাকে লিখেছিলেন।

মৈত্রসাহেবের সঙ্গে কাকার চিঠি লেখালেখি শেষ হল। মার সঙ্গে আলোচনা। শেষে কাকা বললেন আমাকে, “তুমি একবার ওঁর কাছে যাও। অভিজ্ঞ লোক, খুব সুন্দর মানুষ। উনি তোমার কিছু করতে পারবেন। জায়গাটাও ভাল—, কিছুদিন বেড়িয়ে আসতে পারবে। ভাল লাগবে তোমার।”

আপত্তি করার, অরাজী হবার কিছু ছিল না। আমি পাগল হয়ে যাই, কি মরে যাই—এ আমি চাইনি। বাঁচতেই চেয়েছি আমি। খালি বুঝতে পারছিলাম না, কি করে বাঁচব—জীবনের কতকগুলো অস্বস্তিকর, যন্ত্রণাদায়ক দিনের কথা ভুলে গিয়ে কি করে আবার বাঁচতে পারি!

মৈত্রসাহেবের কথা

কুমুদশংকরের ভাইপো নিশীথ দিনকয়েক হল এখানে এসেছে। ওর সমস্ত কথা আমি শুনেছি। ছেলেটির বয়স অল্প। এই বয়সেই বেচারিকে পরপর কয়েকটা বড় রকম দুঃখের আঘাত পেতে হয়েছে। খুব নরম ধাতের মানুষ হলে যা হয়—নিশীথেরও দেখছি তাই—দুঃখ আঘাতগুলো মনে বড় বেশি করে বেজেছে। ছেলেটি মনের দিক থেকে একেবারে ভেঙে পড়েছে।

এক ধরনের মানুষ আছে যাদের কতকগুলো শব্দের ওপর অস্বাভাবিক একটা টান আছে। আমি যদিও ‘শব্দ’ কথাটা ব্যবহার করছি—কিন্তু আসলে এ-গুলো শব্দ নয়—শব্দের মধ্যেকার আইডিয়া। যেমন ধরা যাক ‘পেটরিয়টিজম্’ শব্দটা। বাংলায় বলে স্বদেশপ্রীতি। এই শব্দ তা ইংরিজী হোক, কি বাংলা, কি অন্য কিছু—এর মধ্যে এমন একটা আইডিয়া আছে বা বেশির ভাগ মানুষই যতটা না বোঝে—তার চেয়ে ঢের বেশি ভালবাসে। এরকম কিছু কিছু শব্দ আছে—যার অর্থ আমরা বুঝি না—বুঝি, তার সম্পর্কে আমার ধারণা কম থাক বেশি থাক—যায় আসে না, সব সময় তার বড়রকম মূল্য দিয়ে থাকি—ভালবাসা, বন্ধুত্ব, পবিত্রতা—এ-সব হচ্ছে তেমন শব্দ। মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে এই কথাগুলো এক একটি সম্পদ।

নিশীথ, আমার দৃঢ় ধারণা—এইরকম কতকগুলো শব্দকে খুবই মূল্য দিয়েছিল। ভালবাসা, সততা, স্নেহ, দাম্পত্য জীবন—এইসব ছোট ছোট চার কি পাঁচ অক্ষরের শব্দগুলোর মধ্যে যে-ধারণাগুলো থাকে সেগুলো কিন্তু ছোট নয়। এরা প্রত্যেকেই এক একটা জগৎ। এবং বিভিন্ন মানুষের মনে এ-জগৎ বিভিন্ন আকারের। কারুর ছোট, কারুর বড়। নিশীথের মনে এরা বড় জীবন্ত, বড় মোহময়। অল্পদিনের মধ্যে পরপর কয়েকটা ভীষণ রকমের আঘাত পেয়ে তার সেইসব বহুদিনের গড়া জগতগুলো ছত্রাকার হয়ে ভেঙে পড়েছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ছাড়া তার কষ্ট দুঃখ হতাশা অনুভব করার উপায় নেই। অনুমান করা চলে মাত্র।

নিশীথ তার জীবনের এই পাঁচ সাতটা বছরের কথা ভুলতে চায়। স্মৃতির একটা অংশ।

নিশীথকে আমি ‘মেমারি’ নামের আশ্চর্য বিষয়টার কথা বার কয়েকই বোঝাবার চেষ্টা করেছি। ‘মেমারি’র ফিজিয়লজি ওর পক্ষে বোঝা সহজ নয়। তবু সহজ করে একটা ধারণা মনে গেঁথে দেবার চেষ্টা করেছি। স্টিমুলাম, সেন্স অর্গান, নার্ভাস ইম্‌পাল্‌সেস্‌, ব্রেন, নিউরোনস—এ-সব কঠিন কঠিন কথার আড়ালে সরল যে ব্যাখ্যা হতে পারে নিশীথকে বোঝাতে হয়েছে। তারপর ওকে বুঝিয়েছি কি অবস্থায় ঘটনাগুলো স্মৃতি হয়ে বেঁচে থাকে, আর কখন থাকে না। এ-বিষয়টা কঠিন নয়। নিশীথ বুঝতে পারল।

এই বিষয়টা বোঝাতে গিয়ে আমি ইচ্ছে করেই আমার খুব প্রিয় একটা প্রসঙ্গ টেনে আনলাম। নিশীথকে আমি বলেছিলাম, বুঝলে নিশীথ, ভবিষ্যৎটা সব সময় বর্তমানের ওপর নির্ভর করে—আর বর্তমান অতীতের ওপর। এরা বিচ্ছিন্ন নয়, বিচ্ছিন্ন হতেই পারে না। তোমাকে আমি রিটেনটিভনেসের কথা বলেছি। জীবনের এটা হচ্ছে আদি সত্য। সব রকম প্রাণের বৃদ্ধির প্রথম কথাই হচ্ছে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। অতীতের অনেক জিনিস তুমি বর্তমান পর্যন্ত টেনে আন। বর্তমানে এসে এই অতীত নষ্ট হয়ে যায় না, বর্তমানে রূপান্তর নেয়। তেমনি অতীতও এই বর্তমানেরই রূপান্তর। একটা নদীর সঙ্গে এর তুলনা করতে পার। এক এক জায়গায় এক এক নাম—কিন্তু সেই একই জলস্রোত। তেমনি হচ্ছে স্মৃতি। স্মৃতির মধ্যে প্রথম আছে সঞ্চয়ের কথা, অভিজ্ঞতার সঞ্চয়—। সব সঞ্চয় নয়—তেমন সঞ্চয় যা ভালভাবে ছাপ ফেলে গেছে। ছাপ যত গভীর হবে তত বেশি তার আয়ু। তারপর হচ্ছে পারিপার্শ্বিকের শক্তি। আমার ঠাকুমাকে আমার মনে নেই, খুব বাচ্চা তখন, কিন্তু সেই রাতটার কথা আমার এখনো মনে আছে। দেশের বাড়ি, প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি—এক একটা বাজ পড়ছিল যেন আমাদের বাড়ি বাগান সমস্ত জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেবে। আর সে কি ঝড়ের শব্দ! তেমনি মুষলধারে বৃষ্টি। ভয়ে আমরা তিনটি ভাই-বোন জড়াজড়ি করে চোখ বন্ধ করে বসেছিলাম। ঠাকুমাকে মনে নেই, মুখই মনে পড়ে না—কিন্তু ঠাকুমার কথা মনে পড়লে সেই রাতটার কথা মনে পড়ে। আর খুব দুর্যোগের রাতে সেই দিনটার, সেই সঙ্গে ঠাকুমার কথা মনে পড়ে। …কিন্তু ও-সব কথা থাক্‌—যা বলছিলাম। তুমি কোনো মেয়ের শঠতা, কারুর অসততা, আঘাত, স্ত্রীর ছলনা, অপরাধ—অর্থাৎ মানুষের এই নোংরামিগুলো ভুলতে চাও। কিন্তু তা তো হবার নয়। এ পৃথিবী এইরকম। আমার এক বিদেশী বন্ধু বলত, মানুষ যদি যুগ থেকে যুগে—বংশ থেকে বংশপরাক্রমে তাদের পাপগুলো সন্তান-সন্ততির ঘাড়ে—এক রক্ত থেকে অন্য রক্তে চালান করে না দিয়ে যেত তা হলে আমরা অন্যরকম হতুম। এ পৃথিবীর অন্য রূপ হত। কথাটা খুব বাজে কথা নয়, আমি যদি না জানতুম হিংসে কি, না জানতুম কি করে ছোরা মারতে হয়, বন্দুক চালাতে হয়—যদি আমায় না শেখানো হত, জোচ্চুরী কর, মিথ্যে কথা বল, পরস্ত্রী সম্ভোগ কর, অন্যকে ঘৃণা কর—তবে, নিশীথ ভেবে দেখ আমি কেমন হতুম। মানুষ কেমন হত—এ পৃথিবী কেমন হত। পাপ আকাশ থেকে লাফিয়ে মাটিতে পড়েনি। এরও চাষ করতে হয়েছে। এখন আর কোনো উপায় নেই। মানুষকে আর তুমি শোধরাতে পারবে না, সে আশা কম। Mneme… এ হচ্ছে রক্তে গচ্ছিত রাখা পৈতৃক মূলধন। তুমি আমি তার অভিশাপ থেকে পালিয়ে যেতে পারব না। …মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছে হয়—এত মাথা ঘাঁটলুম—এত দেখলুম, যদি জানতুম, যদি কোনোভাবে ধরতে পারতুম স্মৃতিকেন্দ্রের কোথায় এই পাপ যুগ থেকে যুগে জমা থাকে—তবে সেই জায়গাটুকু অসাড় করে কেটে বাদ দিয়ে দিয়ে দেখতুম মানুষ কি, সে কেমন, সে কি করে!

আমি বেশ একটু ভাবালু হয়ে উঠেছিলাম। নিশীথ তা শ্রান্ত, ক্লান্ত বিষণ্ণ মুখে আমার দিকে অদ্ভুতভাবে চেয়েছিল। আস্তে আস্তে তার চোখের দৃষ্টি বদলে যাচ্ছিল। ভেতরে ভেতরে সে খুব চঞ্চল আর বিচলিত হয়েছে। উত্তেজনা বাড়ছিল ওর।

হঠাৎ নিশীথ আমার পায়ের কাছে বসে পড়ল। বললে, “কাকাবাবু আমার ওপর একবার চেষ্টা করে দেখুন।”

“তোমার ওপর?”

“হ্যাঁ ক্ষতি কি। আমি তো মরব না। অন্যভাবে বাঁচব। অন্য মানুষ হয়ে।”

“পাগল নাকি তুমি নিশীথ?”

নিশীথ খুব হতাশ হয়ে পড়ল। খানিক পরে বললে, “আমি জানি এ-ভাবে, এই মন নিয়ে, লতিকাদের স্মৃতি নিয়ে আমি সুস্থ মানুষের মতন বেঁচে থাকতে পারব না। হয়ত পাগল হয়ে যাব, না হয় আত্মহত্যা করব। আপনি চেষ্টা করলে আমায় হয়ত বাঁচাতে পারতেন। আপনি তা করবেন না।” নিশীথের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল।

নিশীথকে আমি সব কথা কি করে বোঝাই। আমি কি করতে পারি না-পারি তা ওকে আমি কেমন করে বিশ্বাস করবো। আমি নিশীথের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছিলুম।

হঠাৎ…হঠাৎ মনে হল…

“তুমি তোমার মাকে ভালবাস নিশীথ?”

“বাসি।” নিশীথ মাথা নাড়ল।

“তোমার কাকাবাবুকে?”

“শ্রদ্ধা করি খুব।”

“আর কি কি ভালবাস তুমি, মানে কি কি তোমার ভাল লাগে?”

“সে তো অনেক কিছুই আছে।”

“তবু বল দু-চারটে, শুনি।”

“আমি পাখি ভালবাসি, ফুল, গান, ছবি, কোনো কোনো বই, ছেলেবেলার কোনো কোনো বন্ধুকে…।”

“থাক, বুঝতে পারছি।” আমি চুপ করলাম।

খনিকটা চুপচাপ। তারপর হঠাৎ নিশীথের চোখে চোখ রেখে বললাম, “একটা কাজ আমি পারি নিশীথ, আমার ক্ষমতায় কুলোবে। আমি তোমার গোটা স্মৃতিকেই নষ্ট করে দিতে পারি—ফর সাম আওয়ার্স—কয়েক ঘণ্টার জন্য আট দশ ঘণ্টা—বড় জোর চব্বিশ ঘণ্টা। তুমি যদি সে-অভিজ্ঞতা লাভ করতে চাও—”

“আমি রাজী।”

“ভেবে দেখ ভাল করে।”

“ভাববার কিছু নেই, কাকাবাবু আমি রাজী, এখুনি।”

“তোমার ভয় হচ্ছে না—?”

“ভয়, কেন—?”

কথাটা বলে ফেলতে যাচ্ছিলাম আর একটু হলেই। তাড়াতাড়ি সামলে নিলুম। হেসে বললুম, “বেশ, আজ রাত্রে শোবার আগে একটা ওষুধ দেবো খেয়ে নিও তারপর যাকরার আমি করব।”

নিশীথ মাথা নাড়ল।

আমার কথা

সকালে ঘুম থেকে উঠলুম যখন, অনেক বেলা হয়েছে। মাথাটা কেমন ধরা ধরা লাগছিল। অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছি বলেই হয়ত। মনে পড়ল মৈত্রসাহেবের ওষুধ খেয়ে কাল ঘুমিয়েছিলুম। আজ তিনি আরও সব কি কি করবেন। কখন করবেন জানি না। কি ভাবে করবেন তাও জানি না। মাথাটা বড় ধরা ধরা লাগছে। খুব খিদে পেয়েছে। স্নান করতে ইচ্ছে করছে। জল তেষ্টাও পেয়েছে। আমি কি স্নান করব?

দরজা খুলে বাইরে এলুম। মৈত্ৰসাহেব বাংলোর বারান্দায় পায়চারি করছিলেন।

আমি তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়ালুম।

“ঘুম ভাঙলো?” মৈত্রসাহেব হাসিমুখে বললেন।

“হ্যাঁ। মাথাটা কেমন ধরা ধরা লাগছে। স্নান করে আসব?”

“নিশ্চয়। যাও, স্নান সেরে এসো। আমি খাওয়ার ঘরে থাকব।”

স্নান করার পর শরীরটা খুব ভাল লাগছিল। মাথাটা খুব হাল্কা মনে হচ্ছিল। এতক্ষণ আমার চোখে ঘুমের মতো কিছু জড়িয়ে ছিল, সবই কেমন আবছা অস্পষ্ট—। স্নানের পর দৃষ্টিটা পরিষ্কার হয়ে গেল। বাইরের রোদ, সবুজ কাচের জানলা, হালকা নীল পর্দাগুলো এবার খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল।

মৈত্রসাহেব ডাইনিং টেবিলের সামনে বসে ছিলেন। সামনে কতকগুলো লেখা কাগজ ক্লিপ দিয়ে গাঁথা।

আমি টেবিলে এসে বসতে মৈত্রসাহেব চা ঢালতে শুরু করলেন। ইশারায় রুটি মাখন ডিম কলার প্লেটটা তুলে নিয়ে খেতে বললেন।

খিদে পেয়েছিল খুব। কোনো কথা না বলে আমি খেতে লাগলাম। আর মাঝে মাঝে মৈত্রসাহেবের দিকে তাকিয়ে ভাববার চেষ্টা করছিলাম, কখন উনি আমার ওষুধ-পত্র ইনজেকশনের সেই ঘরটাতে ডেকে নিয়ে যাবেন, কি হবে তারপর, কি হওয়া সম্ভব।

কয়েক চুমুক চা খেয়ে মৈত্রসাহেব একটা সিগারেট ধরালেন। তাকালেন আমার দিকে। আমি তখন ডিমটা শেষ করে সবে চায়ে ঠোঁট ঠেকিয়েছি। মৈত্রসাহেব একটুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে বড় সুন্দর শান্ত হাসি হেসে বললেন, “তারপর—বলো কেমন আছ?”

“ভালো।” আমি মৈত্রসাহেবের কথাটা বুঝলাম। ‘মাথা ধরার ভাবটা আর নেই।’

“না থাকারই কথা।” মৈত্রসাহেব আর এক চুমুক চা খেলেন।

চায়ের পেয়ালা থেকে মুখ তুলে আমি বললাম, “কখন শুরু করবেন?”

“কিসের শুরু?”

আমি অবাক। মৈত্রসাহেব কি কালকের কথা ভুলে গেলেন না কি মন বদলে ফেলেছেন। বললাম, আমার স্মৃতিকে কিছুক্ষণের জন্যে—কয়েক ঘণ্টার মতো নষ্ট’—

“সে তো হয়ে গেছে। আই ডিড্‌ ইট।” মৈত্রসাহেব আমার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকালেন।

হয়ে গেছে? কখন হল? কেমন করে হল? কই আমি তো কিছুই জানতে পারলাম না।

আমার বিস্ময়, অবিশ্বাস, এত ভাল করে চোখে মুখে ফুটে উঠল যে মৈত্ৰসাহেবকে সেটা আর মুখে বলার দরকার করল না, তিনি সহজেই বুঝতে পারলেন।

দেওয়ালের ক্যালেন্ডারের দিকে আঙুল দিয়ে দেখালেন মৈত্ৰসাহেব, তারপর পকেট থেকে একটা এনভেলাপ বের করে সীল-মোহরের ছাপটা আমায় দেখতে দিলেন।

“আজ ১৬ তারিখ। ১৪ই রাত্রে তুমি ঘুমোতে গিয়েছিলে। মাঝের একটা দিন তুমি কোথায় ফেলে এলে নিশীথ?”

আমি চমকে উঠলাম এরকম ভাবে জীবনে বোধহয় আর কখনও চমকে উঠিনি। কোথা থেকে একটা দুরন্ত ভয় লাফিয়ে আমার বুকে এসে পড়ল। আর সে-ভয় কী ভীষণ, কী চঞ্চল! বুক থেকে লাফিয়ে আমার হৃদপিণ্ড চেপে ধরল, তারপর গলা। নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না। বুঝতে পারছিলাম আমার সমস্ত শরীর যেন বরফের জলে ডুবনো রয়েছে। এত ঠাণ্ডা, এত অসাড়।

মৈত্রসাহেব নিশ্চয়ই সব লক্ষ্য করছিলেন। শুনতে পেলাম তিনি বলছেন, ‘কি হল? অসুস্থ বোধ করছ? গরম দুধ খাবে খানিকটা?’

ধীরে ধীরে চেষ্টা করে ভয়টা আমি কাটিয়ে উঠলাম, তাকালাম মৈত্রসাহেবের দিকে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। কি দেখছিলাম তাঁর মুখে জানি না। যেন নিজেকে দেখছিলাম। আমি বেঁচে আছি—এই বোধ আর বিশ্বাসটা যেন নতুন করে অনুভব করছিলাম।

“কাকাবাবু!”

“বলো।”

“আমি কি কাল বেঁচে ছিলাম?”

“তার মানে!— বেঁচে ছিলে বৈকি।”

“আমার কি জ্ঞান ছিল?”

“অফকোর্স।”

“তাহলে এ কি হল। একটা পুরো দিন আমি কি করলুম, কোন্ কথা বললুম, কাকে দেখলুম—কিছুই জানলাম না। মরার চেয়ে এই বাঁচার তফাৎ কি?”

মৈত্রসাহেব আমার দিকে তাকিয়ে তেমনি সুন্দর শান্ত চোখে আবার হাসলেন। ক্লিপ দিয়ে আঁটা গম্বুজগুলো তুলে নিয়ে আমার হাতে গুঁজে দিলেন। খুব মৃদু অথচ স্পষ্ট গলায় বললেন, “এই কাগজগুলো পড়। এর মধ্যে সব লেখা আছে। যে-দিনটার কথা তুমি মনে করতে পারছ না—এই কাগজে সে-দিনের সমস্ত কথাগুলো লেখা আছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তুমি কি করে কোথায় গেছ।”

মৈত্রসাহেব লিখে রেখেছেন—কলমের আঁচড়ে। প্রথম পাতাটা এক নিশ্বাসে পড়ে ফেললাম। আমার বুকের মধ্যে আবার সেই ভয়টা ছুটে এল। নিশ্বাস ভারি হয়ে আসছিল। দ্বিতীয় পাতাটা কেমন একটু অন্যমনস্ক ভয় ভয় ভাবে পড়তে লাগলাম। বুঝতে পারছিলাম আমার মধ্যে বিশ্রী এক অস্বস্তি জমে উঠেছে, খুব বিচলিত হয়ে পড়ছি এবং বিহ্বলতা আমায় শূন্যে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। আমার হাত ঘামছিল, কপাল, গলা, বুক। আঙুলগুলো যেন নীল হয়ে আসছিল। …দ্বিতীয় পাতাটা শেষ করার পর তৃতীয় পাতায় এলাম। দু-চারটে লাইন হয়ত পড়েছি—আমার সমস্ত শরীরটা যেন হঠাৎ কেমন হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল…কি মনে হচ্ছিল বলতে পারব না, বোঝাতে পারব না। শুধু হাতের কাগজগুলোকে তাল করে পাকিয়ে এমনভাবে ছুঁড়ে দিলাম যেন হাতের ওপর এতক্ষণ আমার অজান্তে একটা নোংরা, বিষাক্ত, কিলবিলে, কুৎসিত সাপ জটলা পাকিয়ে পড়েছিল। চমকে উঠে, ভয়ে, ভীষণভাবে একটা ভীতার্ত চিৎকার করে ছুঁড়ে দিয়েছি।

তারপর আমি কেঁদেছি। হয়ত অনেকক্ষণ ধরে। মৈত্রসাহেব কখন উঠে বাইরে চলে গেছেন। একটিও কথা না বলে।

আমার কান্নাও থামল। ঘরটা নিস্তব্ধ। ওয়াল-ক্লকটা টিক্‌টিক্‌ করে বেজে চলেছে। আমি ঘড়িটা দেখলাম মনে হল, ওই ঘড়িটায় টিক্‌টিক্‌ এখন বন্ধ হয়ে গেলে যেমন হবে—আমার তেমনি হয়েছিল কাল। আমি ছিলাম, কিন্তু সে-থাকা একটা বন্ধ ঘড়ির মতন।

ঘর ছেড়ে বাইরে চলে এলাম। মৈত্রসাহেব বাগানের রোদে ফুলগাছের কাছে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। ওই বাগান আমায় টানছিল, ওই সুন্দর রোদ, মৈত্রসাহেবের সুঠাম দেহ, তাঁর পোশাক। একটা কাক ডাকছিল, ক’টি চড়ুই উড়ছিল, দেবদারু গাছের পাশ দিয়ে নীল আকাশটা উঁকি দিচ্ছিল। একটি মেয়ে বাইসাইকেল চেপে রাস্তা দিয়ে চলে গেল।

আমি জানি না, পা পা করে কখন বাগানে মৈত্রসাহেবের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। আমি কথা বলতে পারছিলাম না। কি বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না।

মৈত্রসাহেব একটা হলুদ গোলাপ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, “এটা কী ফুল বলতে পার?” বলে হাসলেন।

“গোলাপ।” আমিও হাসলুম।

“আজ পারলে, কাল কিন্তু পারনি।’

সত্যিই পারিনি। কাল আমি কিছুই চিনতে পারিনি! ঘাস, পাখি, ফুল, নদী, মানুষ, রাস্তাঘাট, আকাশ, মাটি—কিছুই না। এ-জগতের কোনো জিনিস আমার চেনা ছিল না। আমার মুখে কথা ছিল না, কারণ ভাষা আমার জানা ছিল না। আমি জানতাম না, আগুন কি, আগুন, কেমন? আমি বুঝতে পারিনি…না, কিছুই পারিনি। আমার এতো চেনা জগৎ একেবারেই অজানা, অচেনা হয়ে গিয়েছিল। কী সাঙ্ঘাতিক!

মৈত্রসাহেব গোলাপ ফুলটা ছিঁড়ে আমার হাতে দিলেন। বললেন, “নিশীথ, তুমি। কি স্মৃতিকে সত্যিই নষ্ট করতে চাও? মেমারি অ্যান্ড ইমেজ…”

“আমি আর কিছু চাই না, কাকাবাবু। এই কষ্ট অনেক ভাল।”

“ইয়েস। এ-কষ্ট অনেক ভাল। তবু আবার করে শিশু হওয়া যায় না।”

মরশুমী ফুলের ঝোপটা পেরুতে পেরুতে মৈত্ৰসাহেব আবার বললেন, “তুমি যেন সত্যিই ভেব না—আমি তোমার স্মৃতিকে নষ্ট করে দিয়েছিলাম একটা দিনের জন্যে! না, সে-ক্ষমতা আমার নেই। হয়ত কারুরই নেই এখন পর্যন্ত। আমি শুধু তোমায় ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলুম গোটা একটা দিন। তবে কাগজে আমি যা লিখেছিলাম সেটা কল্পনা নয়। ইফ্‌ ইউ হ্যাভ্‌ নো মেমারি—এমনটিই হবে। এ-জগৎ শূন্য হয়ে যাবে তোমার কাছে। একেবারেই শূন্য। তোমার মা থাকবেন না, ফুল, বই, পাখি, গান—ছেলেবেলা, তোমার বাবার স্মৃতি—শত শত ছোট ছোট সুখের অভিজ্ঞতা, আনন্দ। এটাই কি তুমি চাও?”

“না।”

“কেউ চাইবে না। আফ্‌টার অল শূন্য থেকে আমরা শুরু করেছিলাম। এখন এক দুই ক’রে নয় পর্যন্ত এসেছি। আমরা শুধু আশা করব—পরের শূন্য আসুক,—কিন্তু শুরুর শূন্য নয়, শেষের শূন্য। লেট আস মেক টেন, টুয়েন্টি..”।

একটা সাদা বক আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। আমি দেখছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *