শুরু ও শেষের কান্না আজও ভুলতে পারি না – প্রভাতী মুখোপাধ্যায়

শুরু ও শেষের কান্না আজও ভুলতে পারি না – প্রভাতী মুখোপাধ্যায়

সকলেই ঈশ্বর-বিশ্বাসী নন৷ আবার অনেকেই জীবনের প্রতিটি দিন-রাত্রির সঙ্গে ঈশ্বরের অপার করুণা খুঁজে পান৷ এবং এই বিশ্বাস বস্তুটার নির্ভুল আবিষ্কারও সম্ভব নয়, যদি অবশ্য কেউ তা সততার সঙ্গে ঘোষণা করেন, তবেই তা জানা যায়৷ আমি ছোট্ট বয়স থেকেই ঈশ্বরে নিবেদিতপ্রাণ৷ এ-জীবনে যা পেয়েছি, তা ওই ঈশ্বরের অপার করুণা ছাড়া পাওয়া যেত বলে কখনও বিশ্বাস করিনি৷ এবং তার মধ্যে ‘আম্মিজি’-র কাছে পৌঁছতে পারাটা আমৃত্যু স্মরণীয় হয়ে থাকবে৷

ঠিক কী কারণে কান্নার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত দুর্বলতা জন্মেছে তা জানি না, কিন্তু ভালবাসা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে আবেগের কোনও রকম সম্পর্ক ঘটলেই আমার চোখে জল চলে আসে৷ এই চরিত্রগত স্বভাবটাও বোধহয় ওই ঈশ্বরেরই শিল্পকর্ম৷ যাঁদের মনে আছে, তাঁরা নিশ্চয়ই মনে রেখেছেন (তাঁদের কথাই বলছি যাঁরা ‘আজকাল’-এ প্রকাশিত আমার স্মৃতিকথা ‘ইয়াদেঁ’ পড়েছিলেন৷) যে ‘আম্মিজি’ অর্থাৎ অতুলনীয়া বেগম আখতার-এর সঙ্গে আমার প্রথম মোলাকাত-এর লগ্নেও প্রচুর কান্নাকাটির দৃশ্য আপন আবেগেই তৈরি হয়েছিল৷ তিনি চলে গেছেন প্রায় একচল্লিশ বছর আগে, কিন্তু তাঁরই দোয়া ও দয়াতে আজও প্রতিটি সকাল-সন্ধেতে তাঁকে স্মরণ করতে হয়৷ এবং সেই স্মরণের কান্না আমাকে যেভাবে ছুঁয়ে যায় তা অন্যদের বোঝানোর ভাষা আমার জানা নেই৷ কী পরিমাণ স্নেহ-ভালবাসা, তা বোঝাতে গেলে নতুন করে দুনিয়ার সব নির্মল মোহাব্বত-এর আনজাম ব্যাখ্যা করতে হবে৷ এবং আমার সাধ্যের মধ্যে তা নেই৷

যদিও একলব্য-র উপমাটা খুবই পুরনো, প্রায় সকলেই ব্যবহার করেন, কিন্তু নির্ভুল সত্যি বলে আমাকেও তা বলতে হচ্ছে৷ ‘আম্মিজি’র গান প্রথম শুনেছিলাম রেডিওতে৷ ওঁর জীবনের প্রথম দিকের সেই রেকর্ডগুলো তখন রেডিওতে বাজানো হত, আর একলব্যের মতো আমি ঠিক সেইভাবেই গাইবার চেষ্টা করতাম৷ সোজাসুজি বললে, মনে মনে পুজো করেই দিন কাটাতাম৷ ভাবতাম ওই আওয়াজটা কী করে পাওয়া যায়! ভেবে ভেবেই কেঁদে ভাসাতাম৷ ছোটবেলায় তেমন কিছু না-বুঝে, না- জেনে গাওয়ার চেষ্টা আর কি৷ তবে সেই বয়সে যা বুঝেছিলাম, আজও প্রায় সেই বোঝাটাই একটু অন্যভাবে বলছি— ওঁর মতো কণ্ঠ বা ওঁর আশ্চর্য গায়কিতে গান গাওয়া গোটা দুনিয়ায় কারও পক্ষেই সম্ভব নয়৷ এবং আরও একটা পরম বিস্ময় হচ্ছে অত সহজ করে, অনায়াসে গাইবার ক্ষমতা! কী করে পারতেন তা তখনও বুঝিনি, আজও প্রায় সেই না-বোঝার স্তরে থেকে গেছি৷

আমাদের যখন শেখাতে বসতেন, তখনও একেবারে সেই সহজ ভাব-ভঙ্গি ফুটে উঠত৷ সর্বদা যে একটা গানকে খুব ভেঙে, আলাদা করে শেখাতেন, তা নয়৷ তখন একটু বড় হয়েছি৷ রেডিও ছাড়া এদিক-ওদিক নানা কনফারেন্সেও গাইছি৷ সেই গাইবার সুবাদে অনেক গুণিজনের সঙ্গে পরিচয়ও ঘটছে৷ গানবাজনা শেখার প্রসঙ্গে নানা বিষয়ে বিশেষজ্ঞের উপদেশও শুনছি৷ যেমন— ‘হিয়ারিং মে গোল্ড মিলতা হ্যায়৷’ সত্যিই তাই, শুনতে শুনতেই সোনা ফলে৷ আমার বিরল সৌভাগ্য বহুদিন আমি একাই ওঁর কাছ থেকে তালিম পেয়েছি৷ এবং তাতে ওঁর স্নেহ-ভালবাসার ছবিটা যেন আরও বড় হয়ে উঠত আমার কাছে৷ উনি তখন জীবন্ত কিংবদন্তি ভারতবিখ্যাত বেগম আখতার, আর আমি একজন সাধারণ শিক্ষার্থী৷ সুদূর কলকাতা থেকে প্রচুর কাঠখড় পুড়িয়ে এবং সময় ব্যয় করে ওঁর কাছে পৌঁছেছি— এসব বোঝার কোনও উপায় থাকত না৷ যেন ওঁরই মেয়ে বা বোনঝি অথবা পাশের বাড়ির একটা মেয়ে গানের পড়া বুঝে নিতে এসেছে— এমন একটা পরিবেশ ও পরিস্থিতি৷ ওঁর ব্যক্তিত্ব দয়াময়ী অথচ রসিক মেজাজ-এর বিচিত্র মিশ্রণ৷ সব মিলিয়ে ওঁকে যেন আরও আকর্ষণীয়া করে তুলত৷ যন্ত্রের মতো কোনও ভঙ্গি উনি কখনও ধরে রাখতেন না৷ কথা বলার আওয়াজ আর গানের গলার মধ্যে বেশ পার্থক্য ছিল৷ কথা বলার আওয়াজটা বেশ গম্ভীর, বেস থেকে উঠে আসছে বলে মনে হত৷ প্রচুর কথা বলতেন, কিন্তু তার মধ্যে একটাও বাজে কথা থাকত না৷ তবে আচরণ ও কথা বলা— দুটোই মেজাজ-নির্ভর ছিল৷

কোনও কোনও দিন সামনে রাখা হারমোনিয়ামটা টেনে নিয়ে নিজেই পুরো গানটা গেয়ে শোনাতেন, যেন তাঁর ঘরে উনি একাই গাইছেন৷ গাইবার আগে শুধু বলতেন— ‘দিমাগসে শুনো’৷ প্রথম প্রথম আমি রীতিমতো সমস্যায় পড়ে যেতাম৷ উনি গাইলে শুধু অবাক হয়ে, মুগ্ধ হয়ে শোনা ছাড়া অন্য কিছুর দিকে মাথা দেওয়া যায়? অথচ উনি ‘দিমাগসে শুনো’ বলতে বোঝাতে চাইতেন একই সঙ্গে অনেক কিছু৷ শব্দের উচ্চারণ, এক্সপ্রেশন এবং গানটার সুরের চলন নিয়ে সামগ্রিকভাবে গায়কি— সবই যেন খেয়াল করি৷

আবার অন্য কোনওদিনে ওঁর সেই বিখ্যাত রুপোর পানের ডিব্বাটা কাছে নিয়ে বসতেন৷ সারাদিনে প্রচুর পান খেতেন৷ নিজেই সুপুরি কাটতেন সালোতা দিয়ে (সালোতা মতলব ‘জাঁতি’, আবার একটু দূরেই রয়েছে ওঁর সেই হারমোনিয়াম৷ কী আশ্চর্য দক্ষতায় যে হারমোনিয়াম বাজাতেন তা যাঁরা মনে রেখেছেন, তাঁরা জীবনে কখনও ভুলবেন বলে মনে করি না৷ সেই হারমোনিয়ামটার রিডগুলোর ওপর ওঁর (ক্রমাগত বাজানোর ফলেই সম্ভবত) হাতের আঙুলের চাপে গর্ত হয়ে গিয়েছিল৷

শুধু আমারও বয়স হয়েছে বলে নয়, জীবনের নিজের স্টাইলের কথা মনে পড়ার জন্য হঠাৎ সেই দৃশ্যটা যেন আবার চোখের ওপর দেখতে পাচ্ছি৷ আম্মিজি চলে যাওয়ার বছরখানেক পরে আবার লক্ষ্ণৌ গিয়েছি৷ স্বাভাবিক টানে হ্যাভলক প্লেস-এর সেই বাংলোতেও গেছি৷ আম্মিজির গান শেখানোর ঘরটায় তালা দেওয়া ছিল৷ আমি যাওয়াতে সেই ঘরের তালাটা খুলে দেওয়া হয়েছিল৷ যদিও নিজস্ব অভ্যাস অনুযায়ী আমি তখন চোখে ঝাপসা দেখছি৷ চোখ মুছে সামনেই দেখতে পেয়েছিলাম একটা টেবিলের ওপরে রাখা আছে সেই গর্ত হয়ে যাওয়া রিডের চিরচেনা হারমোনিয়ামটা৷

গান গাইতে গাইতে থেমে গিয়ে কখনও কখনও বলতেন— দেখ বেটি, অ্যায়সা করকে গানা, ইয়ে আওয়াজ যো হ্যায় উসকো সমঝকে বোল না চাহিয়ে ইত্যাদি ইত্যাদি৷ কিন্তু ওঁর পক্ষে যা অবহেলায় করা সম্ভব হত, তা অন্যদের পক্ষে কী করে করা সম্ভব হবে— ওঁর কথাবার্তায় এইসব সমস্যার কোনও অস্তিত্বই নেই যেন৷

আম্মিজির কথাপ্রসঙ্গে নিজের কথা কিছু বলতে হচ্ছে বলে দুঃখ ও লজ্জা দুটোই পাচ্ছি৷ কলকাতা বা বাংলার বাইরে গেলেই সর্বত্র হিন্দি বলতে হবে, সেটাই দস্তুর৷ ছোটবেলা থেকেই শুধু বাংলা নয়, বাংলার বাইরেও বিস্তর অনুষ্ঠান করেছি, বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া— এইসব কারণের জন্য আমার হিন্দি-উর্দু-ভোজপুরি বলার অভ্যেস তৈরি হয়েছিল৷ সবচেয়ে বাস্তবিক সুবিধে হয়েছিল ‘পিতাজি’র (উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খান) কাছে গণ্ডাবাঁধা আর ওঁদের বাড়িতে সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত থেকে যাওয়ার জন্য৷ ওঁরা বাড়িতেও সারাক্ষণ খানাপিনা আউর গানায় চোস্ত উর্দু বলতেন৷ শুনে শুনে (সেখানে আমারই স্বার্থে দিমাগ ব্যবহার করতে হত) ওঁদের উচ্চারণভঙ্গিও খানিকটা শিখে নিতে পেরেছিলাম বলে মনে হয়৷ এবং সেই হিন্দি-উর্দু বলতে পারার যোগ্যতাও আমাকে আম্মিজি-র প্রিয় বেটি হতে সাহায্য করেছিল৷

কখনও কারও ওপর নিজের ইচ্ছে বা হুকুম চাপিয়ে দিতেন না৷ তা সে যত ছোট বা বড় মানুষই হোক না কেন৷ নানা ঘটনা ও পরিস্থিতির খবর ততদিনে সকলের মতো আমিও খানিকটা জেনে গিয়েছিলাম৷ ওঁর জীবনে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা ছিল, কিন্তু সেই অর্থে স্বস্তি বোধহয় ছিল না৷ কিন্তু সে কথা থাক৷ অন্য কথায় ফিরি৷ গান গাওয়াটাও ওঁর স্নেহ-ভালবাসার যেন এক তুলনাহীন উদাহরণ৷ ওঁর গাওয়া ঠুমরি, দাদরা,

কাজরি নিয়েও কোনও প্রশ্ন নেই৷ শ্রোতারা সেইসব গানেও, যথারীতি পাগল৷ কিন্তু গজল তাঁকে গভীরতম অর্থে সম্রাজ্ঞী করেছিল৷ কলকাতায় কথা দিয়েছিলেন লক্ষ্ণৌ পৌঁছে ওঁর কাছে গেলে উনি অবশ্যই তালিম দেবেন৷ এবং উনি সেই আশ্বাসবাক্যের কিছুই ভোলেননি৷ এতকাল পরে, আম্মিজির এই জন্মশতবর্ষেও ওঁর কাছে সেই প্রথম গানটা শেখার স্মৃতি আমাকে আজও তাড়া করে ফেরে৷ অল্পবয়সে তো অনেক নির্বোধের মতো কাণ্ডও ঘটে যায়! মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করেছিলেন— কোন গানটা দিয়ে আমাদের শেখা ও শেখানোর অধিবেশন শুরু হবে? আমি প্রবল আনন্দ ও বীরত্বের সঙ্গে বলেছিলাম— ‘অ্যায় মোহাব্বত তেরে আনজাম পে রোনা আয়া’৷ উনি তারপর আর মুচকি নয় একেবারে গলা খুলেই হেসেছিলেন৷ পণ্ডিত, গবেষক ও রসিক লেখকরা বলেছেন ও লিখেছেন, ওই গানটা যেন আম্মিজিরই জীবন সম্পর্কিত গভীরতম সত্যের চেহারা নিয়েছে৷ অনেক জানার, বোঝার পরই কেউ এমন একটা চিরকালীন গাইবার বা শেখবার সাহস পায়, আমি উৎসাহের আনন্দে প্রকৃত অবুঝের মতো প্রথমে ‘অ্যায় মোহাব্বত’ শিখতে চেয়েছিলাম৷

স্বয়ং ঈশ্বরের দয়ায় আমি যেমন সঙ্গীতের অবিস্মরণীয় ও অবিস্মরণীয়াদের কাছ থেকে পেয়েছি অনেক, তেমন কিছু স্মৃতিচিহ্ন চিরকালের মতো হারিয়েও ফেলেছি৷ হয়ত সেটাও আমার দুর্ভাগ্য৷ আম্মিজিও তাঁর ছোটবেলার স্মৃতি, যেমন ওঁর সঙ্গে ওঁর মা মুস্তারিবাঈ-এর ছবি, ওঁর সিনেমার ছবি, পুরনো রেকর্ড ইত্যাদি—কত কী দিয়েছিলেন! বারবার বাসাবদলের বিপর্যয়ে সব হারিয়েছি৷ জীবনে কিছু ভাঙা পাঁজর বোধহয় কখনও জোড়া লাগে না, সেই সব স্মৃতিচিহ্ন হারানোর ঘটনাগুলোও তাই৷

বড্ড যত্ন করে শেখাতেন৷ সেই কাজে পেশাদারিত্বের চেয়ে স্নেহ- ভালবাসাই ছিল বেশি৷ গজল-এ, সব্বাই জানেন সুনির্বাচিত শব্দের সঙ্গে সুরের রঙে সুখ-দুঃখের ছবি আঁকা হয়৷ সেখানে ঠিক কীভাবে শব্দটা বলতে হবে, তার ওজন ও অর্থবোধক উচ্চারণের সময়েও, সুরসে হিলনা নেহি— সেটা মনে রাখার কথা বলতেন বারবার৷ এ-পৃথিবীর কোনও শিল্পী ওঁর মতো করে গজল-এর কথা শ্রোতাদের হৃদয়ে পৌঁছে দিতে পারেন বলে আজও বিশ্বাস করি না৷ শাকিল বাদায়ুনির লেখা গানটা শেখানোর জন্য গাইছেন, দেখো দেখো—

ইউ তো হর শাম উমিদো মে গুজর যাতি থি

আজ কুছ বাত হ্যায় যো শাম পে রোনা আয়া

সেদিন আমাকে যা বলেছিলেন, তা আজও মনে আছে— ‘কথাগুলো নিজে বুঝে তবেই শ্রোতাকে বোঝাতে হবে৷’

নির্ভুল আলফাজ অবশ্য একদিনে শেখার বিষয় নয়, আমাদেরও যতটুকু হয়েছে, তা ওই গাইতে গাইতেই হয়েছে৷ আবার জানাচ্ছি, শুনে শেখার প্রশ্নে উনি যতটা ভাল আবার ততটাই গোলমেলে৷ সে ছাত্রছাত্রীই হোক বা শ্রোতাই হন, ওই আওয়াজ শুনলেই আর শিক্ষার সতর্ক মনোভাব থাকে না, মানে উচ্ছ্বাস বা কান্না— কোনও একটা পথে চলতে হবে, তখন হিসেবি শ্রোতা থাকা খুবই কঠিন হয়৷

শেখানোর প্রশ্নে শুনেছি অনেক বড় বড় উস্তাদ বা পণ্ডিত রীতিমতো কৃপণতা দেখান৷ কিন্তু আম্মিজি একেবারে উল্টো স্বভাবের মহিলা ছিলেন৷ সময় থাকলে শেখানো নিয়ে ওঁর পক্ষ থেকে কোনও বাধা ছিল না৷ আরও নিখুঁত করে শেখার জন্য একই গান কখনও কখনও দু’বারও শিখেছি৷ ওঁর দাদরা, কাজরি ও ঠুমরির সঙ্গে বেশ কিছু ভোজপুরি গানও শিখেছিলাম৷ সেগুলোও খুবই মজা করে, উৎসাহের সঙ্গে শেখাতেন৷

জীবনে অনেক পরোক্ষ প্রাপ্তিও থাকে৷ এবং সেই পাওয়াও দীর্ঘদিন ধরে স্মৃতির ঘরে আলো জ্বালিয়ে রাখে৷ আম্মিজি ছোটবেলায় যখন কলকাতায় এসেছিলেন, ওঁর প্রথম গানের রেকর্ড কলকাতা থেকেই বেরিয়েছিল৷ এখানে নাকি থিয়েটারও করেছিলেন ইত্যাদি সব কথাবার্তা আমিও শুনেছি৷ তবে ওই, কেবল শুনেছি মাত্র, বয়সের প্রশ্নে আমি খুবই ছোট, সেইসব দিনের কথা কিচ্ছু জানি না৷ পরের দিকে আম্মিজির কলকাতায় প্রবল জনপ্রিয়তার কারণ অবশ্যই রেডিওতে গান গাওয়া আর তাঁর বাংলা গানের রেকর্ড প্রকাশিত হওয়া৷ জ্ঞানমামা (পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ) আম্মিজির বিখ্যাত দাদরা ‘কোয়েলিয়া মাত কর পুকার’-এর বাংলা করে ওঁকে দিয়ে গাইয়েছিলেন— ‘কোয়েলিয়া গান থামা এবার’, সেটা বোধহয় এই বাংলায় সকলেই কোনও না কোনও সময়ে গেয়েছে বা গাইবার চেষ্টা করেছে৷ অন্য গানগুলো অর্থাৎ মোট আটটা গানের বাকি চারটে গান রবিমামার তৈরি৷ রবিমামা মানে রবি গুহমজুমদার৷ ওঁর সঙ্গে আমার রেডিও স্টেশনে এক বিচিত্র পরিস্থিতিতে পরিচয়৷ আমার গান শুনে ওঁর নাকি মনে হয়েছিল আমিই বাংলার বেগম আখতার এবং আমাকে ওঁর চাই-ই চাই৷ আমার মাকে উনি কথাগুলো এমন আগ্রহ আর অধিকারের ভঙ্গিতে বলেছিলেন যে শুনতে শুনতে হাসি পেলেও তা অস্বীকারের কোনও উপায় ছিল না৷ হাজরা রোডে রবিমামার বাড়ি৷ সেখানে গানবাজনার বিশাল আয়োজন৷ কথা আর সুর সেখানে সকাল-সন্ধে ঘুরে বেড়ায়, বেড়াতেই থাকে৷ রবিমামার লেখা ও সুর দেওয়া ‘জোছনা করেছে আড়ি/ আসে না আমার বাড়ি’-র জনপ্রিয়তায় এখনও বিস্ময়বোধ করি৷ ১৯৭৪-এ আম্মিজি মারা যাওয়ার পর রবিমামা প্রায় ভাঙাবুকের দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমাকে বলেছিলেন— ‘কেউ জানে না, আমি উনি গাইবেন বলে কয়েকশো গান তৈরি করে রেখেছিলাম, সেইসব গান কেবল উনিই গাইতে পারতেন, অন্যরা নয়৷ ওই আওয়াজ আর এক্সপ্রেশন আমি কোথায় পাব!’

আজও ভাবতে খারাপ লাগে, রবিমামার মতো সত্যিকারের গুণী ও রসিক মানুষকে বাংলার গানবাজনার জগৎ চেনেনি বা বোঝেনি৷ যিনি নিজে লিখে সুর দিয়ে শচীন দেববর্মণকে দিয়ে ‘তুমি এসেছিলে পরশু, কাল কেন আসোনি’ বা আম্মিজিকে দিয়ে ‘জোছনা করেছে আড়ি’ বা ‘চুপি চুপি চলে না গিয়ে’-র মতো গান গাওয়াতে পারেন, তাঁর যোগ্যতা নিয়ে কি কারও কোনও সন্দেহ থাকা উচিত? ওঁর কি আরও একটু সম্মান ও যত্ন প্রাপ্য ছিল না?

আমি শিল্প নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতো কিছু বলতে পারব না৷ কিন্তু গান বোধহয় এমন একটা শিল্প যা মাত্র কিছুক্ষণের মধ্যেই কোনও শিল্পী বা সুরকার-গীতিকারদের প্রকৃত যোগ্যতা চিনিয়ে দিতে পারে৷ আম্মিজির কোনও গান কে কীভাবে মনে রেখেছেন তার বিস্তৃত বিবরণ দিতে পারব না, তবে সেইসব গানই জীবনের সব স্মৃতি স্বমহিমায় ফিরিয়ে দিয়েছে বারবার৷

আমি আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখার মতো মানুষ নই৷ স্মৃতি তাই এলোমেলো হয়ে আগে-পরে এসে হাজির হচ্ছে৷ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিলাম৷ বললেই সঙ্গে সঙ্গে দেশেরই দূরে কোথাও উড়ে যাওয়ার মতো সঙ্গতি বা বন্দোবস্তর কোনওটাই ছিল না৷ পিতাজি চলে যাওয়ার আগে খবর পাইনি৷ আমাকে বলা হয়েছিল— ‘এই আলি, পিতাজি (উস্তাদবড়ে গুলাম আলি খান) তোকে খুব দেখতে চাইছেন, তুই আয়৷’ যেতে পারিনি৷ আম্মিজির চলে যাওয়ার খবরও পেয়েছিলাম রেডিও মারফত৷ সঙ্গে সঙ্গে সুদূর আমেদাবাদ যাওয়ারও বন্দোবস্ত ছিল না, করতেও পারিনি৷

কিন্তু তিনি চিরকালই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অফুরন্ত স্নেহ-ভালবাসার সঙ্গে সঙ্গে নানা ধরনের স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন৷ পরের বছর লক্ষ্ণৌ রেডিও স্টেশনে গাইতে গিয়েছি৷ গাইছি— ‘দিওয়ানা বনানা হ্যায় তো দিওয়ানা বনা দে’৷ অনুষ্ঠানের পর রেডিও স্টেশনেরই এক কর্মী আমাকে বললেন, ‘আপনার জন্য একজন বাইরেই অপেক্ষা করছেন৷’ আমি তো অবাক৷ লক্ষ্ণৌ-এ রেডিও স্টেশনে এসে, ভেতরে ঢুকে স্টুডিওর ঠিক বাইরে আমার জন্য কে অপেক্ষা করতে পারেন! তাড়াতাড়ি বাইরে এসে দেখি টুপি পরা দীর্ঘদেহী এক ভদ্রলোক পায়চারি করছেন৷ ফিরে তাকাতেই চিনতে পারলাম৷ আম্মিজির বাহিনোই মুক্তার আহমদজি৷ বললেন, ‘আপকি আম্মিজি অভিভি জিন্দা হ্যায়, আপ ইস তরহা গাতে রহিয়ে৷’ আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম আর চিরকাল যা হয়, সঙ্গে সঙ্গে চোখে জলও এসে গেল৷

আম্মিজি ঠিক কতদূর স্নেহপ্রবণ ও নিত্য শুভার্থী ছিলেন তা লিখে বোঝানো প্রায় অসম্ভব৷ বিয়ের পর যখন তালিম-এর জন্য লক্ষ্ণৌ যেতাম, তখন আমার স্বামী প্রদীপ্তশঙ্করও সঙ্গে যেত৷ একবার হঠাৎই যেতে হয়েছিল, কারণ লক্ষ্ণৌতে অনুষ্ঠিতব্য সঙ্গীত-নাটক আকাদেমির অনুষ্ঠান৷ অনুষ্ঠানের পর খুব স্বাভাবিক কর্তব্য হিসেবে ওঁর বাড়ি, আম্মিজির সেই ‘আশিয়ানা প্যালেস’-এ গিয়েছি৷ কিন্তু গিয়ে দেখি উনিও হঠাৎ দিল্লি যাবেন, গাড়িও তৈরি, ওঁকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেবে৷ উনি বোরখা পরে একেবারে বাড়ির বাইরে৷ পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ওঁর স্বামী আব্বাসি সাব৷ আমাদের হঠাৎ হাজির হওয়াটা এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে৷ কিন্তু উনি সেই অবস্থাতেই প্রদীপ্তশঙ্করের দিকে এগিয়ে এসে মুখের আবরণ সরিয়ে সহজ ও নিজস্ব অভ্যাসে যা বলেছিলেন, যা বাংলা অনুবাদ এইরকম— ‘দেখো দামাদজি, আমার বেটিকে সামলে রেখো, খেয়াল রেখো যেন নিত্য রেওয়াজ করে, আর ওর গানবাজনায় যেন কোনওরকম অসুবিধে না হয়, তোমাকেই এই দায়িত্ব দিলাম৷’ প্রদীপ্ত আজও সেই উপদেশের একটা কথাও ভোলেনি৷ স্মৃতির চরিত্রে হিসেবিপনাও থাকে কিনা সে সম্পর্কে আমি খুব নিশ্চিত নই৷ আম্মিজিকে নিয়ে আজও একই সঙ্গে অনেক কথা মনে পড়ে৷ পড়তেই থাকে৷ অফুরন্ত স্নেহ ছিল৷ একই সঙ্গে ছিল জেদও৷ যা বলবেন তা-ই করতে হবে সব্বাইকে৷ বাবার সঙ্গে প্রথম সেবার লক্ষ্ণৌ গেছি তালিম নিতে৷ সবাই যা করে তাই করতে চেয়ে বাবা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন হোটেলে থাকব আমরা দুজনে৷ উনি যখন বলবেন তখন আবার সেই ‘আশিয়ানা প্যালেস’-এ উপস্থিত হব৷ কিন্তু উনি সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন— ‘হামারি বেটি ইধারি রহেগি’৷ বাবাকে সেই শর্তেই রাজি হতে হয়েছিল৷ তখন বয়স কম ছিল৷ জীবনে বেঁচে থাকারও কিছু নিয়মকানুন আছে এবং সেগুলোও যে পরোক্ষভাবে তালিমের কাজে লাগে তা বুঝতাম না৷ তখন সেগুলো যে বোঝা সম্ভবও ছিল না সেকথা আজ বুঝতে পারি৷

আম্মিজির বাড়িতে ওঁদের আত্মীয়স্বজন-সহ অসংখ্য লোকজন আসা-যাওয়া করতেন৷ ওঁদের মতো খানদানি পরিবারের আচার-আচরণের মধ্যেও অনেক কিছু শেখার ছিল৷ নিখুঁত-নির্ভুল উর্দু উচ্চারণের শব্দগুলো সারা দিন-সারা সন্ধে কানের মধ্যে ঢুকে পড়ত৷ সেই শব্দগুলোর মধ্যে কিছু থাকত গজল-দাদরা-ঠুমরি-কাজরির মধ্যেও৷ তবে স্নেহ-ভালবাসা থাকলে তালিমের প্রশ্নে কিন্তু কোনও ছাড় ছিল না৷ যে-গানটা আগের দিন শেখা শুরু হয়েছে, পরের দিন সেটারই এক বেসরকারি পরীক্ষা হত৷ তখন হেসে হেসে বকুনি দিতেন৷ জুবান, আলফাজ ঠিক না হলে সমঝদার শ্রোতারা আসরে হাসবে এবং সেটা একেবারেই কাম্য নয়৷ —এই কঠোর সত্য উনি তালিমের সময়েই দ্বিধাহীনভাবে বলে দিতেন৷ আম্মিজির গান গাওয়ার বিশেষত্ব নিয়ে বিশ্লেষণ করার আমি অধিকারী নই, সেটা উস্তাদরা বলতে পারবেন, তবে একটা অদ্ভুত ধরনের উপলব্ধি হত৷ যখন যে গানটা গাইতেন, মনে হত সেই গানটাই ওঁর সবচেয়ে প্রিয় গান৷ অনায়াসে গাওয়ার এমন উদাহরণ আমি জীবনে আর কোথাও দেখিনি বা শুনিনি৷

অত বড় একজন মানুষ, শেষ বয়সে অর্থ-খ্যাতি-প্রতিষ্ঠা, সম্মান সবই পেয়েছিলেন৷ কিন্তু আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময়ে কোনওদিন বিন্দুমাত্র অহঙ্কারের প্রকাশ দেখিনি৷ সত্তরের শুরুর দিকের সময়ে ওঁকে সাদা পোশাক পরতে দেখেছি বেশি৷ গয়না পরতে বেশ পছন্দ করতেন৷ বিশেষ করে মুক্তো ও হীরে ব্যবহার করতে দেখেছি, কিন্তু কখনও উৎকট সাজ-পোশাকে দেখিনি৷ কখনও উঁচু গলায় কথা বলতেন না৷ ওঁর চিরমধুর স্বভাবে বোধহয় তা কোনওদিন প্রয়োজনই হয়নি৷

কান্নার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক জীবনের শুরু ও শেষ লগ্নের৷ যিনি চলে যান তিনি তখন হয়ত আর কাঁদতে পারেন না৷ কিন্তু অন্যদের তো তখন অন্য কোনও অভিব্যক্তি থাকে না৷ আম্মিজির সঙ্গে আমার প্রথম দেখার মুহূর্তে আমি তাঁর পা জড়িয়ে কেঁদেছিলাম৷ উনি চলে যাওয়ার এক বছর পর ‘আশিয়ানা প্যালেস’-এ গিয়ে আমাদের সেই তালিম পাওয়ার ঘরে ওঁর সেই আঙুলের চাপে গর্ত হয়ে যাওয়া, ধুলো জমা হারমোনিয়ামটা দেখে কাঁদতে কাঁদতে যে গানটা গাইতে বাধ্য হয়েছিলাম, সেটাও সেই প্রথম দিন শেখা গান ‘অ্যায় মোহাব্বত তেরে আনজাম পে…’৷ পরের দিনে আয়োজিত স্মরণ অনুষ্ঠানে এসেছিলেন অসংখ্য বিখ্যাত সঙ্গীতরসিক৷ এসেছিলেন ক্যাইফি আজমি, জাভেদ আখতার, রাজেন্দ্রকুমার, জালাল আগা, সুব্রত রায় ও আরও অনেকে৷ সেখানেও শেষ গান হিসেবে গাইতেই হয়েছিল ‘অ্যায় মোহাব্বত…’৷ সকলেরই ‘রোনা’ এসেছিল বলে আজও মনে আছে৷

অনুলিখন: অলক চট্টোপাধ্যায়

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *