শুরুর আগে ও পরে
১
শুরুতে কিছুই ছিল না, স্বর্গ-মর্ত্য কিছুই না, না ছিল আকাশ, না ছিল তারা। শুধু ছিল অন্তহীন আকার আকৃতিবিহীন ধোঁয়াশা আর সদা জ্বলন্ত আগুনের জগত।
উত্তরে ছিল নিলহাইম। সেখানে ১১টি বিষাক্ত নদী কুয়াশার বুক চিরে বয়ে চলেছিল। নদীগুলোর উৎসমুখে ছিল এক গর্জনশীল ঘূর্ণি, নাম তার হেভেরগেলমির। নিলহাইম ছিল ঠান্ডার চেয়েও ঠান্ডা। সেখানে অন্ধকার ঘন কুয়াশা চতুর্দিকে ঘিরে থাকত। আকাশ সেখানে কুয়াশায় ঢাকা থাকত, ভূমিও থাকত ঠান্ডা কুয়াশায় আচ্ছন্ন।
দক্ষিণে ছিল মাসপেল। মাসপেল ছিল অগ্নিগর্ভ। সেখানে সবকিছু উজ্জ্বল আর জ্বলন্ত। মাসপেল যেমন ছিল আলোকিত, নিলহাইম ছিল ধূসর বরফ আর কুয়াশায় আকীর্ণ। মাসপেল ছিল কামারের আগুনের মতো জ্বলন্ত আর উত্তপ্ত। সেখানে নিরেট কোনো ভূমি ছিল না, ছিল না কোনো আকাশ। শুধু ছিল আগুনের লেলিহান শিখা, উত্তাপের ঘূর্ণি আর গলিত লাভার সাগর।
মাসপেলের আগুনের শেষপ্রান্তে যেখানে কুয়াশা প্রজ্জ্বলিত হয়ে আলোকিত হয়েছিল, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সুরটার, যে দেবতাদের চেয়েও প্রাচীন। সময়ের শুরু থেকে সেখানে সে আজও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে আছে এক জ্বলন্ত তরবারি, যেখানে গিয়ে মিশেছে গলিত লাভা আর জমাট কুয়াশা।
বলা হয়ে থাকে, যখন দুনিয়া ধ্বংস হবে, রাগনারকের সময়, শুধুমাত্র তখনই সুরটার তার স্থান ত্যাগ করবে। সে মাসপেল থেকে আগুনের তরবারি হাতে বেরিয়ে পড়বে আর পৃথিবীকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেবে। একে একে সকল দেবতা তার সামনে ধরাশায়ী করবে।
২
মাসপেল আর নিলহাইমের মাঝে ছিল এক অসীম শূন্যস্থান। কুয়াশার জগতের নদীগুলো সেই শূন্যস্থানে প্রবাহিত হতো। এই শূন্যস্থানকে বলা হতো গিনুনগাগাপ। অনন্তকাল ধরে প্রবাহিত হয়ে বিষাক্ত নদীগুলো আগুন আর কুয়াশার জগতের মধ্যবর্তী স্থানে সৃষ্টি করল বিশালাকৃতির হিমবাহ। শূন্যস্থানের উত্তরে বরফের জগত ঠান্ডা কুয়াশা আর বরফ শীলায় ঢাকা ছিল কিন্তু দক্ষিণে, যেখানে হিমবাহ আগুনের জগতকে স্পর্শ করেছিল, যেখানে মাসপেলের আগুনের শিখা বরফের সাথে মিলিত হয়েছিল, আগুনের দুনিয়ার উত্তপ্ত হাওয়া বরফের ওপর বসন্তের এক মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল।
যেখানে আগুন আর পানি মিলিত হয়েছিল, আগুন বরফকে গলিয়ে দিয়েছিল আর বরফগলা জলে সৃষ্টি হলো প্রথম জীবের, দেখতে মানুষের মতো কিন্তু আকারে পৃথিবীর চেয়েও বড়, সকল দানবের চেয়েও বৃহৎ। সে না ছিল পুরুষ, না ছিল মহিলা আবার একসাথে দুটোই ছিল।
এই জীবটিই সকল দানবের পূর্বপুরুষ, একে বলা হতো ইমির।
বরফগলা জলে শুধুমাত্র ইমিরের জন্ম হয়নি, আরো সৃষ্টি হয়েছিল এক শিংবিহীন গাভির, কল্পনাতীত বড় তার আকার। গাভিটি খাদ্য ও পানির জন্য বরফের পাহাড় চেটে খেত। তার ওলান থেকে নদীর স্রোতের মতো দুধ প্রবাহিত হতো। সেই দুধ খেয়ে ইমির পুষ্টি পেত।
দানব ইমির দুধ খেয়ে খেয়ে ক্রমেই বৃহৎ হতে লাগল।
ইমির গাভিটিকে ডাকত অধুমলা।
গাভিটির জিহ্বা বরফের ভিতর থেকে প্রথম মানুষকে চেটে বের করে আনল। প্রথম দিনে শুধু মানুষটির চুল দৃশ্যমান হলো, দ্বিতীয় দিন মাথা ও তৃতীয় দিনে পুরো শরীর আবির্ভূত হলো।
সে ছিল বুরি, সকল দেবতাদের পূর্বপুরুষ।
ইমির ঘুমিয়ে পড়ল, ঘুমন্ত অবস্থায় ইমিরের বাম বাহুর নিচ থেকে জন্ম নিল এক পুরুষ আর নারী দানব, পা থেকে জন্ম হলো আরেক ছয়মাথা দানব। ইমিরের এই সন্তানদের থেকেই পরবর্তীতে সকল দানবের সৃষ্টি হয়েছিল।
বুরি এই দানবদের থেকে একজনকে তার স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করল। তাদের এক পুত্রসন্তান হলো, তাকে তারা ডাকত বোর নামে। বোর বেস্টলা নামে এক দানবকন্যাকে বিয়ে করল। তাদের তিন ছেলে জন্ম নিল, ওডিন, ভিলি আর ভি। বোরের তিন ছেলে ওডিন, ভিলি আর ভি যুবক বয়সে উপনীত হলো। মাসপেলের আগুন আর নিলহাইমের অন্ধকার দেখতে দেখতে তারা বড় হয়ে উঠেছিল। কিন্ত তারা জানত, দুটি স্থানই তাদের জন্য মৃত্যুপুরী। তারা তিন ভাই অনন্তকাল ধরে গিনুনগাগাপের অসীম শূন্যতায় আগুন আর কুয়াশার জগতের মাঝে আটকা পড়ে থাকল।
সেখানে না ছিল সমুদ্র, না ছিল বালুকাবেলা; ছিল না কোনো লতা-পাতা বা ঘাস- পাথর, ছিল না মাটি বা গাছপালা; কোনো আকাশ ছিল না, তারাও ছিল না; কোনো পৃথিবী ছিল না, স্বর্গ-মর্ত্য কিছুই না। শুধু ছিল এক অসীম শূন্যতা, এক বিশাল শূন্যস্থান, যাকে দুনিয়া আর জীবন দ্বারা পূরণ করতে হবে।
এটা ছিল সবকিছু সৃষ্টি হওয়ার সময়। ভি, ভিলি আর ওডিন গিনুনগাগাপের অসীম শূন্যতায় দাড়িয়ে পরস্পরের দিকে তাকাল আর কী করতে হবে সে বিষয়ে আলোচনা করল। আলাপ করল জীবন আর ভবিষ্যৎ নিয়ে।
ওডিন, ভিলি আর ভি দানব ইমিরকে হত্যা করল। এটা তাদের করতেই হতো। বিশ্বজগত সৃষ্টি করার জন্য এছাড়া আর কোনো পথ ছিল না। এটা ছিল সবকিছুর শুরু, একটি মৃত্যু যেটি জীবনের শুরু করেছিল।
তারা বিশাল দানবটিকে চুরিকাঘাত করল। ইমিরের শরীর থেকে অবিশ্বাস্য পরিমাণে রক্ত বের হয়ে আসতে লাগল। সমুদ্রের জলের মতো নোনা, মহাসাগরের পানির মতো ধূসর রক্তের ঝরনা বন্যার মতো সহসা বেরিয়ে আসতে লাগল; সেই রক্তের স্রোত এত শক্তিশালী আর গভীর ছিল যে, সকল দানব সেই রক্তের বন্যায় ভেসে গেল আর ডুবে মারা গেল। শুধুমাত্র ইমিরের দৌহিত্র বারজেলমির আর তার স্ত্রী বেঁচে রইল। তারা একটি কাঠের বাক্সকে নৌকার মতো ব্যবহার করে বন্যা থেকে বেঁচে গেল। যেসব দানবকে আমরা ভয় পাই বা আজও দেখি, তারা সবাই এই দুজনের বংশধর।
ওডিন আর তার ভাইয়েরা ইমিরের মৃতদেহ থেকে মাটি সৃষ্টি করল। ইমিরের হাড়গোড় জড়ো করে বানাল পাহাড়-পর্বত
যে নুড়ি-পাথর, কাঁকড়-বালি তোমরা দেখো, সেগুলো হলো ইমিরের দাঁত আর হাড়ের ভাঙা অংশ, যেগুলো ওডিন, ভিলি আর ভির সাথে ইমিরের সংঘাতের সময় ইমিরের গা থেকে খসে পড়েছিল।
পৃথিবীকে বেষ্টন করে আছে যে সমুদ্রগুলো, সেগুলো আসলে ইমিরের ঘাম আর রক্ত। আকাশের দিকে তাকাও, তুমি আসলে ইমিরের খুলির ভিতর দিয়ে দেখছ। রাতের আকাশে যে তারকারাজি, গ্রহ নক্ষত্র, ধূমকেতু আর খসে পড়া তারা, সেগুলো সব মাসপেলের অগ্নিদুনিয়ার আগুনের ফুলকি। আর যে মেঘমালা আমরা দিনের বেলা আকাশে দেখি? সেগুলো একসময় ইমিরের মগজ ছিল, না জানি তারা আজও কী কথা ভেবে চলেছে!!
৩
পৃথিবী একটা সমতল চাকতি। সমুদ্র তার চতুর্দিক ঘিরে আছে। দানবরা বাস করে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে গভীর সমুদ্রের ধারে।
দানবদের দূরে রাখতে ওডিন, ভিলি আর ভি ইমিরের চোখের পাপড়ি দিয়ে পৃথিবীর মাঝখান ঘিরে তৈরি করল এক উঁচু দেওয়াল।
তারা জায়গাটার নাম দিল মিডগার্ড।
মিডগার্ড ছিল নয়নাভিরাম কিন্তু তার তৃণভূমিতে কেউ হেঁটে বেড়াত না, স্বচ্ছ সলীল জলে কেউ মাছ ধরত না, সুউচ্চ পাহাড়গুলোতে কেউ চড়ত না, আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকার জন্য কেউ ছিল না।
ওডিন, ভিলি ঘার ভি জানত, পৃথিবীটা পৃথিবী হয়ে উঠবে না, যদি না সেখানে কেউ বাস করে। তারা জনমানবের খোঁজে উচ্চভূমিতে তাকাল, খুঁজল নিম্নভূমিতে, কিন্তু কাউকে খুঁজে পেল না। শেষ পর্যন্ত দূর সমুদ্রের ধারে তারা দুই খণ্ড কাঠের গুঁড়ি দেখতে পেল, যেগুলো সমুদ্রের ঢেউয়ে ভেসে ভেসে তীরে আছড়ে পড়েছিল।
প্রথম শুঁড়িটি ছিল এশ গাছের। এশ গাছ স্থিতিস্থাপক, দেখতে সুন্দর আর তার শিকড় মাটির অনেক গভীরে যায়। এর কাঠ সহজে খোদাই করা যায়, সহজে চিড় ধরে না বা ভেঙে যায় না।
দ্বিতীয় গুঁড়িটি যেটি প্রথম শুঁড়ির খুব কাছাকাছিই পড়ে ছিল, ছিল এলম গাছের। এলম গাছ দেখতে কমনীয় কিন্তু এর কাঠ দিয়ে দারুণ শক্ত তক্তা আর খুঁটি তৈরি করা যায়। তুমি এলম কাঠ দিয়ে চমৎকার ঘরবাড়ি তৈরি করতে পারবে।
দেবতারা কাঠের গুঁড়িগুলো তুলে নিল, সেগুলোকে সোজা করে দাঁড় করাল, উচ্চতায় সেগুলো মানুষের মতোই দেখতে হলো। ওডিন গুঁড়িগুলোর ওপর তার হাত রাখল। একে একে তাদের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করল। সেগুলো তখন আর মৃত কাঠের গুঁড়ি থাকল না, তারা জীবন্ত মানুষে পরিণত হলো।
ভিলি তাদের ইচ্ছেশক্তি দিল, দিল বুদ্ধিমত্তা আর উদ্যম। তখন তারা চলতে ফিরতে সক্ষম হলো।
ভি গুঁড়িগুলোকে আকৃতি দিল, মানুষের আকৃতিতে খোদাই করল; সে কান খোদাই করল, যাতে তারা শুনতে পারে; চোখ দিল, যাতে তারা দেখতে পারে; ঠোঁট বানাল, যাতে তারা কথা বলতে পারে।
কাঠের গুঁড়ি দুটি সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে ছিল, দুই আদিম মানুষ। ভি তাদের একজনকে পুরুষ বানিয়েছেন, আরেকজনকে নারী।
পৃথিবীর শেষ প্রান্তে সমুদ্রসৈকতে দাড়িয়ে থাকা দুই মানব-মানবীকে নোনা জলের ঝাপটা থেকে রক্ষা করার জন্য আর উষ্ণ রাখার জন্য দেবতা ভাইয়েরা পোশাক বানিয়ে তাদের ঢেকে দিল।
সবশেষে তারা তাদের সৃষ্টি মানুষ দুজনের নাম দিল। পুরুষটির নাম দিল আস্ক অর্থাৎ এশ গাছ, নারীটির নাম দিল এম্বলা অর্থাৎ এলম।
আস্ক আর এম্বলা আমাদের আদি পিতামাতা। সকল মানব-মানবীর পূর্বসূরি তারা। তুমি যদি পিছনে যেতে থাক, দেখবে তোমার বংশলতিকা আস্ক আর এম্বলা পর্যন্ত পৌঁছেছে।
আস্ক আর এম্বলা মিডগার্ডে বাস করতে লাগল, ইমিরের চোখের পাপড়ি দিয়ে দেবতা ভাইদের বানানো দেওয়ালের ভিতর, দানবদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে। তারা ঘর বানাল গভীর সমুদ্রের বিপদ আর দৈত্য-দানোদের থেকে সুরক্ষিত থেকে। মিডিগার্ডে বাস করে তারা সুখে শান্তিতে তাদের সন্তানদের লালন পালন করতে লাগল।
ওডিনকে বলা হয় বিশ্বপিতা, কারণ সে সকল দেবতাদের পিতা, কারণ সে আমাদের দাদার দাদার দাদার… দাদার ভিতর জীবন ফুঁকে দিয়েছিল। সকল মানুষ আর দেবতা, ওডিন আমাদের সকলের পিতা।