শুয়োর চরানো রাজকুমারের কথা
অনেকদিন আগে এক বেচারা রাজকুমার ছিল ; তার একটা রাজ্যও ছিল । রাজ্যটা কিন্তু খুব ছোটো, তবু তার যা আয় হত, তাতেই বিয়ে করা চলত। রাজকুমারের বিয়ে করার বড়ো ইচ্ছা । দেশ-বিদেশের লোকে তার নাম জানত | একশো রাজকন্যার কাছে প্রস্তাব জিজ্ঞাসা করলে, তারা খুশি হয়ে বলত, “তোমাকে বিয়ে করব ? হ্যা, নিশ্চয়ই ; অনেক অনেক ধন্যবাদ ?” এখন মুস্কিল হল যে রাজকুমারের ইচ্ছা সম্রাটের মেয়েকে বিয়ে করে। রাজকুমারের বাবার সমাধির উপরে একটা গোলাপগাছ গজিয়েছিল, সে যে কী সুন্দর গাছ, তার তুলনা হয় না। পাঁচ বছরে একটিবার মাত্র একটি ফুল ফুটত । কিন্তু সে কি ফুল ! তার সুবাস নাকে গেলে সব দুঃখ-ভাবনা দূর হয়ে যেত। তার উপরে রাজকুমারের একটি নাইটিঙেল পাখিও ছিল। সে পাখি এমনি মিষ্টি গান গাইত যে শুনলে মনে হত দুনিয়ার যত মধুর স্বর, সব বুঝি ওর ঐ ছোটো গলাটিতে বাসা বেঁধেছে! তাই রাজকুমার দুটি বড়ো-বড়ো রুপোর কৌটোয় গোলাপটি আর নাইটিঙেল পাখিটি ভরে, রাজকন্যাকে পাঠিয়ে দিল । সম্রাট তার বড়ো সভাঘরে জিনিস দুটিকে আনলেন। সেখানে রাজকন্যা সখীদের সঙ্গে বাড়ি-বাড়ি খেলছিল। উপহারের কৌটো দেখে রাজকন্যা আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। রাজকন্যা বলল, “আহা, ওর মধ্যে যদি একটা ক্ষুদে বেড়ালছানা থাকে তো কি মজাই-না হয়!” কিন্তু বাক্স খুলতে বেরুল একটি গোলাপগাছ, তাতে একটিমাত্র গোলাপ ফুটে রয়েছে । সখীরা বলল, “আহা, কি সুন্দর করে বানিয়েছে গো !” সম্রাট বললেন, “শুধু সুন্দর কি বলছ, অতিশয় মনোহর বল ?” কিন্তু রাজকন্যা গাছটাকে একবার ছুয়ে দেখে, কেঁদে ফেলে আর কি ? সে বলল, “এ রাম ! ও বাবা, ওটাকে মোটেই কেউ বানায় নি ! ওটা সত্যিকার গাছ ! ছিঃ !” সম্রাট বললেন, “মেজাজ খারাপ করবার আগে দেখাই যাকনা অন্য কৌটোতে কি আছে।” কৌটা খুলতেই নাইটিঙেল পাখি বেরিয়ে এমনি মিষ্টি গান ধরল যে গোড়ায় কারও মুখে একটিও নিন্দার কথা জোগাল না। সভার মহিলারা বললেন, “অপূর্ব ! চমৎকার!” ফরাসী ভাষায় বললেন, কারণ তাঁরা নিজেদের মধ্যে সর্বদা ভুলভাল ফরাসী বলতেন । একজন বুড়ে সর্দার বললেন, “পাখিটাকে দেখে আমাদের স্বৰ্গীয়া সম্রাজ্ঞীর যে কলের গানের বাক্স ছিল, সেটার কথা বড্ড মনে পড়ে যাচ্ছে ; সেই একই সুর, একই কারিকুরি ।” সম্রাট বললেন, “ঠিক তাই, ঠিক তাই ” বলে চোখের জল ফেলতে লাগলেন । রাজকন্যা বলল, “এখনো মনে মনে আশা করে আছি ওটা সত্যি পাখি নয় ।” যারা উপহার এনেছিল, তারা বলল, “সত্যিকার পাখি বৈকি ?” রাজকন্যা বলল, “তা হলে পাখিটাকে উড়িয়ে দাও!” রাজকুমারের সঙ্গে সে দেখা করতেও রাজি হল না। রাজকুমার কিন্তু অত সহজে হাল ছাড়ল না। সারা মুখে কালো মেটে রঙ মেখে, ভূত সেজে, গিয়ে একেবারে রাজবাড়ির দোরে ধাক্কা দিল । দরজা খুলতেই সম্রাটকে বলল, “নমস্কার, মহামান্য সম্রাটবাহাদুর । রাজবাড়িতে একটা চাকরি মিলবে ?” সম্রাট বললেন, “নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই! গাদা-গাদা শুয়োর আছে আমাদের, তাদের দেখাশুনোর জন্য লোক দরকার ।” অগত্য রাজকুমার ‘রাজ-শুয়োরের পালক’ পদে বহাল হল । শুয়োরদের খোয়াড়ের পাশে তাকে নোংরা একটা খুপরি দেওয়া হল । ঐখানে সে সারাদিন বসে বসে কাজ করতে লাগল আর সন্ধ্যা নামার আগেই একটা আশ্চর্য হাড়ি বানিয়ে ফেলল। হাড়িটার চারদিকে ঘণ্টা ঝোলানো, যেই-না হাড়ির রান্না ফুটতে থাকে, ঘণ্টাগুলোও টুংটং করে ওঠে আর পুরনো একটা গানের স্থর বাজতে থাকে। গানটি হল—
হায় রে আমার প্রাণের অগাস্টিন, সব গেল যে, সব গেল যে, সব গেল !
কিন্তু তার চাইতেও আশ্চর্য ব্যাপার হল, হাঁড়ি থেকে বেরুনো বাষ্পে একবার আঙুলটি ধরলে, শহরের যেখানকার যত রান্নাঘরের যত উনুনে, যা রান্না হচ্ছে সব কিছুর গন্ধ পাওয়া যেত । রাজকন্যা ঐখান দিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছিল, সুরটা কানে যেতেই সে থামল ; মনে হল যেন বেশ খুশিই হয়েছে। কারণ ঐ একটা সুরই তার জানা ছিল, ওটাকে সে এক আঙুলে বাজাত । রাজকন্যা বলল, “আরে, ওযে আমার সুর। তা হলে তো শুয়োর চরাবার লোকটা বেশ শিক্ষিত ! যা, যন্ত্রটার দাম জেনে আয়।” সখীদের একজন, আগে পায়ে কাঠের খড়ম পরে নিল, তার পর এক দৌড়ে ভিতরে গেল। সখী জিজ্ঞাসা করল, “হাড়িটার কত দাম নেবে ?” শুয়োর চরাবার লোকটা বলল, “রাজকন্যার কাছ থেকে দশটা চুমো।” তাই শুনে রাজকন্যা বলল, “ব্যাটার আস্পর্ধা তো কম নয়! জেনে আয়, সখীরা কেউ দিলে চলবে কি না ।” শুয়োর চরাবার লোকটা বলল, “মাপ করবেন, তাতে চলবে না। রাজকন্যের কাছ থেকে দশটা চুমো, নইলে রইল হাড়ি আমার কাছে ” রাজকন্যা বলল, “না, তা হলে তো চলবে না। আচ্ছা তোরা সবাই আমাকে ঘিরে দাঁড়া দিকিনি, যাতে কেউ না দেখে ।” কাজেই সখীরা তাদের পোশাকগুলো বেশ করে ছড়িয়ে রাজকন্যাকে আড়াল করে দাঁড়াল, শুয়োর চরাবার লোকটা পেল দশটা চুমো, রাজকন্যা পেল হাড়িটা। দিব্যি মজা হল । সমস্ত সন্ধ্য আর তার পর সমস্ত দিন হাঁড়ি ফুটতে থাকল আর রাজবাড়ির অধ্যক্ষমশাই থেকে রাস্তার মুচি পর্যন্ত সারা শহরে কার বাড়িতে কি রান্না হচ্ছে না হচ্ছে সখীদের জানতে বাকি রইল না। তারা ফুর্তির চোটে নাচল, কুদল, হাততালি দিল । এদিকে শুয়োর চরাবার লোকটা একটিদিনও বাদ দিত না ; রোজ নতুন কিছু তৈরি করত। শেষে একটা ঝুমঝুমি বানাল, সেটিকে ঘোরালে যেখানকার যত নাচের সুর, সব বেজে ওঠে। পাশ দিয়ে যাবার সময়, তাই শুনে রাজকন্যা বলল, “বাঃ, বেড়ে জিনিস তো ! এমন খাসা সুর তো কখনো শুনি নি । যা, দাম জেনে আয়, কিন্তু সাবধান! আর চুমোটুমে পাচ্ছে না ব্যাটা ” সখী ফিরে এসে বলল, “ও তো একশোটা চুমো চায়।”
রাজকন্যা বলল, “লোকটা ক্ষেপেছে নাকি ?” এই বলে রওনা দিল। কিন্তু কিছুদূর গিয়ে আবার থেমে বলল, “দেখ, সর্বদা শিল্পসৃষ্টিকে উৎসাহ দিতে হয়। হাজার হোক, আমি হলাম গিয়ে সম্রাটের মেয়ে। যা, বল গে, সেদিনের মতো আমার কাছ থেকে দশটা চুমো পাবে, বাকিটা নাহয় আমার সখীদের কাছ থেকে আদায় করুক।” সখীরা বলল, “ওমা ! তা কেন ! ও আমাদের ভালো লাগে না ।” রাজকন্যা বলল, “কি বিড় বিড় করছিস্ ? আমি যদি ওকে চুমে খেতে পারি, তোরাও খুব পারবি।” অগত্য সখীদের আরেকবার লোকটার কাছে যেতেই হল । সে বলল, “রাজকন্যের কাছ থেকে একশো চুমে !” রাজকন্যা বলল, “ঘিরে দাঁড়া।” সখীরা অমনি ঘিরে দাঁড়াল, চুমো খাওয়া চলতে লাগল। ঠিক সেই সময়ে সম্রাট তার দোতলার বোলানো বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েই অবাক হয়ে বললেন, “শুয়োরের খোয়াড়ের কাছে ও কিসের ভীড় ?” তার পর চোখ ঘষে, চশমা এটে, তার চক্ষু চড়কগাছ । “ওযে আমার রাজসভার মহিলারা মনে হচ্ছে ? একবার নিজে গিয়ে দেখতে হয় কী ব্যাপার!” সখীরা এদিকে চুমে গুণতে এতই ব্যস্ত যে সম্রাটের আগমন কেউ টের পায় নি। সম্রাট পায়ের আঙলে ভর করে উকি দিলেন, ব্যাপার দেখে তে তিনি চটে কাই ! “এ-সব কি হচ্ছেটা কি ?” এই বলে রাজকণ্যার কান ধরে কষে পেঁচিয়ে দিলেন। তার পর সম্রাট মেয়েকে বললেন, “পথ দেখ! ” তিনি বাস্তবিকই বেজায় রেগে গিয়েছিলেন । তার পর শুয়োর চরাবার লোকটাকে আর রাজকন্যাকে, দুজনকেই শহর থেকে বের করে দেওয়া হল ।
রাজকন্যে কেঁদেকেটে একাকার, শুয়োর চরাবার লোকটা খুব খানিকটা বকবিকি করল, তার উপর মাথার উপর ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল । রাজকন্যা বলল, “হায়, হয়, আমার মতে অভাগিনী কে আছে । সেই সুন্দর দেখতে রাজকুমারকে বিয়ে করলেই হত । আমার কপালটাই মন্দ !” শুয়োর চরাবার লোকটা তখন একটা গাছের পিছনে গিয়ে মুখ থেকে মাটি ময়লা ধুয়ে ফেলে, ছেঁড়াখোড়া কাপড়-চোপড় ছেড়ে, আবার রাজকুমারের মতো পোশাক পরে বেরিয়ে এল । তার চেহারার সে কী মহিমা ! তাই দেখে রাজকন্যা মাথা নিচু করে নমস্কার না করে পারল না। রাজকুমার বলল, “তোমাকে ঘৃণা জানাতে এসেছি। সম্মানিত রাজপুত্র তোমার মনে ধরল না! গোলাপ ফুল আর নাইটিঙেল পাখির মূল্য বুঝলে না! অথচ দেখো একটা খেলনার জন্য শুয়োর চরাবার লোককে চুমো খেতে রাজি হলে ? ঠিক হয়েছে! তোমার উচিত সাজাই হয়েছে!” এই বলে রাজকুমার নিজের ছোটো রাজ্যটিতে ফিরে গিয়ে, রাজকন্যার নাকের উপর দরজা এঁটে দিল । আর রাজকন্যা ? রাজকন্যা তখন সেই গানটি গাইল—
হায় রে আমার প্রাণের অগাস্টিন, সব গেলযে, সব গেল যে, সব গেল।