“শুয়রের বাচ্চাদের” অর্থনীতি

“শুয়রের বাচ্চাদের” অর্থনীতি 

আরম্ভের পূর্বেও আরম্ভ আছে। “শুয়র কা বাচ্চাদের” আগে মাইকেল ক্যারিটের কথা বলতে হবে, কেননা এ রচনার অনুপ্রেরণা আমি তাঁর কাছ থেকেই পেয়েছি। তবে ভুলেও মনে করবেন না যে, “শুয়র কা বাচ্চাদের” সাথে তাঁর কোন সম্পর্ক ছিল। তিনি শুধু অতি সজ্জনই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিত্ব। তাঁর পিতা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন পড়াতেন। তিনি নিজেও অক্সফোর্ড থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯২৯ সালে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে তিনি ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। তাঁর চাকুরি শুরু হয় মেদিনীপুর জেলাতে। চাকুরির প্রথম বছরে তাঁরই সামনে উগ্রপন্থী জাতীয়তাবাদীদের হাতে পর পর দুজন ইংরাজ জেলা প্রশাসক নিহত হন। তৃতীয় জেলা প্রশাসক চাকুরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই অবসর গ্রহণ করে ভারত থেকে পালিয়ে যান। মেদিনীপুরে উপদ্রুত অঞ্চলে ক্যারিট সাম্রাজ্যবাদী শাসনের চণ্ডরূপ প্রথমে প্রত্যক্ষ করেন। পরবর্তীকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করতে গিয়ে ইংরাজ শাসনের কপটতা দেখে তিনি স্তম্ভিত হন। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমন করতে গিয়ে তিনি নিজেই ভারতীয়দের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েন এবং সাম্যবাদী আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯৩৪ সালে ছুটি নিয়ে তিনি বিলাতে ফিরে যান এবং সেখানে কমিউনিস্টদের সাথে যোগাযোগ করেন। ১৯৩৬ সালে তিনি ভারতে ফিরে আসেন এবং বাংলা প্রদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক অনুবিভাগের আন্ডার সেক্রেটারির দায়িত্ব লাভ করেন। এ পদে থাকাকালে তিনি বেআইনী ঘোষিত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের কাছে সরকারের গোপনীয় খবর পাচার করে দিতেন। এ কাজে তাঁর দোসর ছিল আরেকজন ইংরেজ মাইকেল – পাদ্রী মাইকেল স্কট। সরকারের গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে তিনি পদত্যাগ করে বিলাতে চলে যান। চাকুরি ছাড়ার প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে ক্যারিট তাঁর স্মৃতিকথা রচনা করেন। তিনি যখন আসানসোলে মহকুমা প্রশাসক ছিলেন সে সময়ে একজন পাঞ্জাবী ঠিকাদারের সাথে তাঁর সাক্ষাৎকারের নিম্নরূপ ঘটনা তাঁর স্মৃতিকথাতে লিপিবদ্ধ করেছেন[১] : 

Meanwhile the Punjabi with assumed humility pleaded forgiveness, and then, in quiet and dignified tones he recited his set piece Your honour is a noble man. In this sad country there are three sorts of men. These are the good men who take no bribes, of whom you are one; there are the bad men who take bribes, and (looking me in the eyes) there are the suer-ka-batchhas ( sons of pig) who take bribes but do not help the bribe —giver. Salam, Your Honour, Salam. 

(ইতোমধ্যে পাঞ্জাবী লোকটি কপট বিনয়ের সঙ্গে মাফ চাইল। তারপর সে শান্ত অথচ গম্ভীর কন্ঠে তার মুখস্থ বক্তৃতা ঝাড়লো : হুজুর হচ্ছেন মহানুভব ব্যক্তি। এই দুর্ভাগা দেশে তিন কিসিমের লোক আছে। আছেন সজ্জন যাঁরা ঘুষ খান না, যেমন আপনি আছে বদলোক যারা ঘুষ খায় এবং (আমার চোখের দিকে চেয়ে) আছে শুয়রের বাচ্চারা যারা ঘুষ নেয় অথচ ঘুষ প্রদানকারীকে কোন সাহায্য করে না। সালাম। হুজুর সালাম)। 

স্মৃতিকথার উপসংহারে ক্যারিট লিখেছেন যে তিনি তাঁর দীর্ঘ জীবনে সজ্জন, বজ্জাত ও শুয়রের বাচ্চা–তিন কিসিমের লোকই দেখেছেন। 

অনেক ঐতিহাসিকই মনে করেন যে, এদেশে শুয়রের বাচ্চাদের পয়দা হয়েছে ব্রিটিশ শাসন আমলে। বেশির ভাগ জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের বদ্ধ ধারণা হল যে, ব্রিটিশ শাসনের আগে এ দেশে দুর্নীতি, অন্তত ব্যাপক দুর্নীতি ছিল না। তাঁদের মতে ইংরাজ শাসকরা সাধারণত (প্রাথমিক পর্যায়ের ইংরাজ বিজেতারা ছাড়া) নিজেরা দুর্নীতিপরায়ণ না হলেও তারা যে শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলে তা এদেশে ব্যাপক দুর্নীতির সৃষ্টি করে। ব্রিটিশ রাজ এদেশে তাদের নিজেদের দেশের আদলে সকল আইন কানুন ও প্রতিষ্ঠান প্রবর্তন করে। অথচ বিলাতের সাথে কোন দিক দিয়েই এ দেশের বাস্তবতার মিল ছিল না। ফলে বিজাতীয় প্রশাসনের সাথে স্থানীয় জনগণের যোগসূত্র স্থাপনের জন্য গড়ে ওঠে এক অন্তর্বর্তী শ্রেণী (intermediary class)। এই অন্তর্বর্তী শ্রেণীর হাতেই এদেশে দুর্নীতির ব্যাপক প্রসার ঘটে। 

জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের দুর্নীতি সম্পর্কিত বিশ্লেষণে ইতিহাসের অতিসরলীকরণ করা হয়েছে। দুর্নীতি দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে নতুন কিছুই নয়। দীর্ঘদিন ধরে এ দেশের প্রশাসন ব্যবস্থায় ব্যাপক দুর্নীতি চলছে। প্রায় দু হাজার বছর আগে মনুস্মৃতি সংকলিত হয়। দুইজন মার্কিন অধ্যাপক মনুস্মৃতির সপ্তম অধ্যায়ের ১২৩ ও ১২৪ অনুচ্ছেদের নিম্নরূপ ইংরাজি অনুবাদ করেছেন[২] : 

(123) For the men who are appointed by the king to protect (his subjects) generally become hypocrites who take the property of others and he must protect those subjects from them. ( 124 ) The king should banish and confiscate all the property of those evil-minded men who take money from parties to law suits. [(১২৩) প্রজাদের রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে রাজা যাঁদের নিয়োগ করেন তাঁরাই ভণ্ডামি করে অন্যদের সম্পত্তি গ্রাস করে এবং রাজাকে এ ধরনের কর্মকর্তাদের হাত থেকে প্রজাদের রক্ষা করতে হবে। (১২৪) রাজার দায়িত্ব হল যে সব দুষ্ট লোক মামলার বিভিন্ন পক্ষ থেকে উৎকোচ গ্রহণ করে তাদের নির্বাসনে পাঠিয়ে দেওয়া এবং তাদের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা]। 

চাণক্যের অর্থশাস্ত্রের বয়সও প্রায় দু হাজার বছর হবে। চাণক্য লিখেছেন, সরকারী কর্মচারিরা দু’ভাবে বড়লোক হয় : হয় তারা সরকারকে প্রতারণা করে, অন্যথায় প্রজাদের অত্যাচার করে। চাণক্যের অর্থশাস্ত্রে সরকারী কর্মচারিদের চল্লিশ ধরনের তছরুপের ও দুর্নীতির পন্থা চিহ্নিত করা হয়েছে।[৩] দুর্নীতির কুফল সম্পর্কে সজাগ থাকা সত্ত্বেও চাণক্য রাজস্ব বিভাগে দুর্নীতি অনিবার্য মনে করতেন। অর্থশাস্ত্রের দুটি অনুচ্ছেদের নিম্নরূপ ইংরাজি রূপান্তর করা হয়েছে[৪]: 

Just as it is impossible not to taste honey or poison that one may find at the tip of one’s tongue, so it is impossible for one dealing with government funds not to taste, at least a little bit of the king’s wealth. Just as it is impossible to know when a fish moving in water is drinking it, so it is impossible to find out where government servants in charge of undertaking misappropriate money. (জিহ্বার ডগায় বিষ বা মধু থাকলে তা না চেটে থাকা যেমন অবাস্তব তেমনি অসম্ভব হলো সরকারের তহবিল নিয়ে লেনদেন করে একটুকুও সরকারের সম্পদ চেখে না দেখা। জলে বিচরণরত মাছ কখন জল পান করে তা জানা যেমন অসম্ভব তেমনি নির্ণয় সম্ভব নয় কখন দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারিরা তহবিল তছরুপ করে)।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের মত বাংলাদেশেও ব্যাপক দুর্নীতি ছিল। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে দুর্নীতির জীবন্ত বর্ণনা রয়েছে। ষোড়শ শতকের কবি মুকুন্দরাম লিখেছেন[৫] : 

“সরকার হইলা কাল       খিল ভুমি লিখে লাল 
বিনা উপকারে খায় ধুতি” 

সরল ভাষায় এর অর্থ নিম্নরূপ : রাজস্ব কর্মকর্তা (সরকার) অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনাবাদী জমিকে কর্ষিত জমি গণ্য করছে (যার ফলে অতিরিক্ত খাজনা দিতে হবে) এবং ধুতি ঘুষ নিয়েও সঠিকভাবে কাজ করছে না। মুকুন্দরামের লেখা পড়ে মনে হয় ঘুষ দেওয়াতে তার দুঃখ নেই। তার দুঃখ হল ধুতি উৎকোচ দিয়েও কাজ হচ্ছে না। ষোড়শ শতকের বাঙ্গালী কবি ও ক্যারিটের বর্ণিত পাঞ্জাবী ঠিকাদারের নালিশ একই : “শুয়র কা বাচ্চারা” জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলছে। বাংলা লোকসাহিত্যেও এই ধরনের দুর্নীতির উল্লেখ রয়েছে। মলুয়া লোকগীতিতে স্থানীয় কাজী সম্পর্কে নিম্নরূপ বর্ণনা দেখা যায়[৬]: 

“বড়ই দুরন্ত কাজী ক্ষেমতা অপার
চোরে আশা দিয়া মিয়া সাউদেরে দেয় কার 
ভাল মন্দ নাহি জানে বিচার আচার 
কুলের বধূ বাহির করে অতি দুরাচার।” 

(বড় দুরন্ত কাজীর অপার ক্ষমতা রয়েছে। সে চোরকে আশ্রয় দেয়, সাধুকে দেয় কারাবাস, ভাল মন্দ বা আচার বিচার জানে না। সে এতই খারাপ যে কুলের বধূদের ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসে।) 

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এ ধারণাই স্পষ্ট হয় যে, দুর্নীতি এ দেশে মোটেও অভিনব নয়। অন্যান্য সমাজেও দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি রয়েছে। দুর্নীতি একটি অতি পুরানো ও জটিল সামাজিক সমস্যা হওয়া সত্ত্বেও অর্থনীতিবিদরা তাঁদের তত্ত্বে দুর্নীতির ক্ষতিকর দিকসমূহ দীর্ঘদিন ধরে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছেন। এ উপেক্ষার কারণ দুটি : একটি ঐতিহাসিক ও অন্যটি তাত্ত্বিক। 

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, দুর্নীতির সাথে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোন বৈরিতা নেই। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে, দুর্নীতির পঙ্কেই বিকশিত হয়েছে পুঁজিবাদের শতদল। ইউরোপে অনেক পুঁজিপতিই জীবন শুরু করেন একচেটিয়া ব্যবসায়ের লাইসেন্সের এবং কর ইজারার মত সরকারী দায়িত্বের অপব্যবহার করে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রাদেশিক ও স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাপক দুর্নীতি বিশ্ব—বিশ্রুত। লুণ্ঠন হতে প্রাথমিক পুঁজি সংগ্রহ করে যাঁরা বড়লোক হয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁরাই দস্যু-কুবের (robber baron) নামে পরিচিত। চীন দেশে দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে : বড় ধরনের ডাকাতরা ব্যাংক স্থাপন করে। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে দুর্নীতি সত্ত্বেও উন্নত দেশসমূহে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। তবে এ সব তথ্যের ভিত্তিতে দুর্নীতি ও উন্নয়নের মধ্যে কোন কার্যকারণ সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠা করা যায় না। 

তাত্ত্বিক দিক থেকেও অনেক সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন যে, দুর্নীতি উন্নয়নের জন্য সহায়ক। পুঁজিবাদের বিকাশের পথে রাষ্ট্রযন্ত্রে যে সব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, ব্যাপক রাজনৈতিক পরিবর্তন ছাড়া তাদের অপসারণ সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে প্রশাসনিক অচলায়তনে দুর্নীতির মাধ্যমে স্বল্প ব্যয়ে বিভিন্ন বাধা এড়ানো সম্ভব হয়। ঘুষের মাহাত্ম্যে লাল ফিতার দৌরাত্ম্যকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত পাওয়া সম্ভব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরামর্শক হান্টিংটন তাই ফতোয়া দেন, অতি কেন্দ্ৰীভূত সৎ আমলাতন্ত্রের চেয়ে অতি কেন্দ্রীভূত ঘুষখোর আমলাতন্ত্র শ্রেয়।[৭] অবশ্য এ ধরনের যুক্তির দুর্বলতা রয়েছে। দ্রুত সিদ্ধান্তের জন্য একবার ঘুষ দেওয়া শুরু হলে, ঘুষ ছাড়া কোন সিদ্ধান্তই পাওয়া যাবে না। ঘুষ না পাওয়া পর্যন্ত সকল সিদ্ধান্তই আটকে থাকবে। দীর্ঘ মেয়াদে দুর্নীতি দ্রুত সিদ্ধান্তের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে। 

হান্টিংটন সাহেবের বক্তব্যের সব চেয়ে বড় দুর্বলতা হল যে, তিনি দুর্নীতি-পরায়ণ আমলাদের নেহাত খারাপ লোক মনে করেন। কিন্তু তিনি “শুয়রের বাচ্চা” পর্যায়ের আমলাদের কথা চিন্তা করেননি। আধুনিক অর্থনীতিবিদ্‌গণ বলছেন, ঘুষ হচ্ছে এক ধরনের “শুয়রের বাচ্চাদের” অর্থনীতি অলিখিত চুক্তি। আদালতের মাধ্যমে এ ধরনের চুক্তি কার্যকর করা সম্ভব নয়। বিশ্বাস ভঙ্গের সম্ভাবনা এখানে বেশি। তাই অর্থনীতিবিদ্রা দু’ধরনের দুর্নীতির মধ্যে তফাৎ করে থাকেন : নির্ভরযোগ্য (predictable) দুর্নীতি ও অনির্ভরযোগ্য (unpredictable) দুর্নীতি। নির্ভরযোগ্য দুর্নীতি হলো সে ধরনের ব্যবস্থা যেখানে ঘুষ দিলে লক্ষ্য অর্জন নিশ্চিত। বিনিয়োগকারীদের এ ধরনের দুর্নীতিতে অরুচি নেই, বরং এ ধরনের দুর্নীতি তাঁরা পছন্দ করেন, কেননা ঘুষ দিয়ে তাড়াতাড়ি কাজ করিয়ে নেওয়া যায়। অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর হলো অনির্ভরযোগ্য দুর্নীতি, যাকে মাইকেল ক্যারিট সাহেব “শুয়রের বাচ্চাদের” দুর্নীতি বলে অভিহিত করেছেন। অনির্ভরযোগ্য দুর্নীতিতে ঘুষ দিয়েও কার্যসিদ্ধির কোন নিশ্চয়তা নেই। বিভিন্ন রাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, একনায়কত্ব ও কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা নির্ভরযোগ্য দুর্নীতির জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে।[৮] যেখানে ক্ষমতা খণ্ডিত সেখানে ঘাটে ঘাটে নজরানা দিতে হয়। এর ফলে ঘুষ বাবদ ব্যয় বেড়ে যায়। অন্যদিকে বহু সংখ্যক ব্যক্তি ঘুষের ক্ষেত্রে নিমকহালালি করবে তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। গণতান্ত্রিক পরিবেশে তাই “শুয়রের বাচ্চা” কর্মকর্তাদের প্রাধান্য দেখা দিতে পারে। 

দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতিবিদ্‌গণ দুর্নীতিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছেন। তাঁরা দুর্নীতিকে একটি অর্থনৈতিক সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করতে রাজি হননি। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ্ গুনার মিরডাল (Gunnar Myrdal) ১৯৬৮ সনে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Asian Drama প্রকাশ করেন।[৯] এ গ্রন্থে তিনি অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে দুর্নীতি প্রতিহত করার পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন। গত তিন দশক ধরে মিরডালের বক্তব্য ছিল নিছক অরণ্যে রোদন। তবে দুটো কারণে সম্প্রতি অর্থনীতিবিদ্‌গণ দুর্নীতির গুরুত্ব অনুধাবন করছেন। প্রথমত, বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির দ্রুত প্রসার ঘটেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমলাতন্ত্র তস্করতন্ত্রে (kleptocracy) পরিণত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, অতীতে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা উপেক্ষা করা হত। অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে সাম্প্রতিক তাত্ত্বিক অগ্রগতির ফলে দুর্নীতি থেকে সৃষ্ট ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার কুফলসমূহ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। 

সাম্প্রতিক গবেষণায় দুর্নীতির চার ধরনের কুফলের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। প্রথমত, দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হয়। রাজস্ব বিভাগে দুর্নীতির ফলে সরকারের পক্ষে প্রয়োজনীয় সম্পদের যোগান দেওয়া সম্ভব হয় না। অন্যদিকে দুর্নীতিপরায়ণ সরকারের ব্যয় বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা দেয়। আয় ও ব্যয়ের অসামঞ্জস্যের ফলে বাজেট ঘাটতি বেড়ে চলে এবং মূল্যস্ফীতির ধাবমান ঊর্ধ্বগতি দেখা দেয়। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতিপ্রবণ সমাজে পরিবেশের দ্রুত অবক্ষয় ঘটে। দুর্নীতির কারসাজিতে পরিবেশ সংক্রান্ত আইন কানুন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয় না। তৃতীয়ত, দুর্নীতি সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্যকে প্রকটতর করে। দুর্নীতির পূর্ণ দায় বহন করে সমাজের দরিদ্র ও বিত্তহীন জনগোষ্ঠী। যারা ধনী তারা ঘুষ দিয়ে সাত খুন মাফ পেয়ে যায়। দুর্নীতির মাশুল শোধ করে অসহায় ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী। সর্বোপরি বিভিন্ন সমীক্ষা হতে দেখা যায় যে, দুর্নীতি বিদেশী বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করে। নেহাত নিরুপায় না হলে বৈদেশিক বিনিয়োগকারিগণ ঘুষ দিয়ে বিনিয়োগ করতে চান না। 

অবশ্য দুর্নীতির কোন সরলীকৃত ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। দুর্নীতির সংজ্ঞা নিয়েও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দুর্নীতিকে “ব্যক্তিগত স্বার্থে সরকারী দায়িত্বের অপব্যবহার” বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।[১০] এ সংজ্ঞা অতি সংকীর্ণ। শুধু সরকারী কর্মচারিরাই দুর্নীতিবাজ হন না, বেসরকারী খাতে ব্যবসায়ীদের মধ্যেও দুর্নীতি (যথা, প্রতারণা, ভেজাল ইত্যাদি) রয়েছে। উপরন্তু দুর্নীতি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক দুর্নীতি দেখা যায়। ভারতে জনৈক রসিক ব্যক্তি বলেছেন, রাজনীতিবিদ্রা ও ডাকাতরা একই ধরনের কাজ করে থাকে, তবে সম্পূর্ণ উল্টো পরম্পরায়। ডাকাতরা প্রথমে ডাকাতি করে তারপর জেলে যায়; রাজনীতিবিদ্রা প্রথমে জেলে যান, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ডাকাতি করেন। তবু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্নীতির চেয়েও বড় সমস্যা হল প্রশাসনিক দুর্নীতি। প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সুদৃঢ় তত্ত্বাবধান ছাড়া অর্থনৈতিক দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। 

অপরাধ সম্পর্কে দার্শনিকদের মধ্যে সাধারণত দু’ধরনের মতবাদ দেখা যায়। প্রথমত, এক ঘরানার (school) দার্শনিকরা মনে করেন যে অপরাধীরা নির্দোষ ও তারা সমাজের অন্যদের চেয়ে কোন মতেই ভিন্ন নয়। কিন্তু বিভিন্ন অনাচার ও অব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজ নির্দোষ ব্যক্তিদের অপরাধীতে পরিণত করে। কাজেই অপরাধ দমনের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন। দ্বিতীয় ঘরানার দার্শনিকদের মতে অপরাধের জন্য সমাজ নয়, অপরাধীরাই দায়ী। তাই অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। অপরাধ সম্পর্কে দার্শনিকদের মধ্যে যে মতবিরোধ রয়েছে দুর্নীতির বিশ্লেষণেও তা প্রযোজ্য। 

এক ঘরানার সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, দুর্নীতির মূল কারণ কতিপয় সরকারী কর্মচারিদের অন্তর্নিহিত অপরাধপ্রবণতা নয়; এর মূল কারণ হলো, বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশে সরকারী কর্মচারিদের বেতন নেহাত অপ্রতুল। উন্নয়নশীল জগতে স্বল্প আয়ের সরকারী কর্মচারিদের মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়। তাই তাদের পক্ষে উৎকোচ গ্রহণ অত্যন্ত স্বাভাবিক। এই ঘরানার পণ্ডিতদের সুপারিশ হল দুর্নীতি হ্রাস করতে হলে সরকারী কর্মচারিদের বেতন বাড়াতে হবে। পর্যাপ্ত বেতন পেলে সরকারী কর্মচারিরা তাদের মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারবে। এর ফলে তাদের উৎপাদনশীলতা বেড়ে যাবে। উপরন্তু বেতন বাড়লে সরকারী কর্মচারিদের চাকুরির জন্য মমতা বাড়বে। তারা ঘুষ নিয়ে চাকুরি হারানোর ঝুঁকি নিতে রাজি হবে না। উৎপাদনশীলতা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের দৃষ্টিকোণ থেকে তৃতীয় বিশ্বে সরকারী কর্মচারিদের বেতন বাড়ানোর যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। কিন্তু এর ফলে দুর্নীতি হ্রাস পাবে কি না সে সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে। এ সন্দেহের চারটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, পর্যাপ্ত বেতন দিয়ে নতুন কর্মচারি নিয়োগ করা হলে তাদের মধ্যে দুর্নীতির প্রবণতা হয়ত কমতে পারে। কিন্তু যারা ইতোমধ্যে দুর্নীতিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে তাদের বেশি বেতন দিয়ে সৎ পথে ফেরানো কি সম্ভব? এদের অনেকেই বেশি বেতনও নেবে, ঘুষও খাবে। প্রশাসনে দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারিরা সৎ কর্মচারিদের শান্তিতে থাকতে দেবে না। মুদ্রার জগত সম্পর্কে লর্ড গ্রেশাম বলতেন: খারাপ মুদ্রা ভাল মুদ্রাকে তাড়িয়ে দেয়। প্রশাসনেও একই প্রবণতা দেখা যায়; দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারিরা সৎ কর্মচারিদের তাড়িয়ে বেড়ায়। 

দ্বিতীয়ত, বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশেরই সরকারী কর্মচারিদের বেতন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানোর সংগতি নেই। উপরন্তু সরকারী চাকুরের সংখ্যার আশঙ্কাজনক বিস্ফোরণ ঘটেছে। এদের অনেকেরই কোন প্রয়োজন নেই। এ পরিস্থিতিতে সকল কর্মচারির বেতন বৃদ্ধি বাঞ্ছনীয় নয়, সম্ভবও নয়। 

তৃতীয়ত, উন্নত দেশসমূহে আশা করা হয় যে, সরকারী খাতে কর্মচারিদের মাইনে বেসরকারী খাতের মাইনের অনুরূপ বা বেশি হলেই সরকারের পক্ষে সৎ ও দক্ষ কর্মচারিদের আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের মত অনেক উন্নয়নশীল দেশে সরকারী খাতে নিম্ন শ্রেণীর কর্মচারিদের মাইনে ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বেসরকারী খাতের অনুরূপ কর্মচারিদের থেকে বেশি। কিন্তু এ সব দেশের সরকারী খাতের কর্মচারিরা বেসরকারী খাতের চেয়ে সৎ বা কর্তব্যনিষ্ঠ নয়। 

সবচেয়ে বড় কথা হলো যে, বেতন বেশি দিলেই দুর্নীতি দূর হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। মার্কিন অর্থনীতিবিদ গর্ডন তুলক (Gordon Tullock) একটি আপাত—স্ববিরোধী সত্য তুলে ধরেছেন। এ বক্তব্য তুলকের আপাত-স্ববিরোধী সত্য (Tullock paradox) নামে পরিচিত।[১১] তুলক বলছেন যে, অভিজ্ঞতা হতে দেখা যায়, যারা অনেক বেশি বেতন পায় তারাই অনেক সময় খুব অল্প টাকার ঘুষ নেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উপ—রাষ্ট্রপতি স্পিরো এগ্ (Spirow Agnew) অতি সামান্য উৎকোচের জন্য পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। নিউইয়র্ক রাজ্যের এক বিধায়ক মাত্র তিন হাজার ডলার ঘুষের বিনিময়ে লক্ষ লক্ষ ডলার ভর্তুকির ব্যবস্থা করে। সরকারী কর্মচারিদের বেতন বৃদ্ধি দুর্নীতি দমনে সহায়ক হতে পারে, কিন্তু কোন অবস্থাতেই যথেষ্ট নয়। 

আরেক ঘরানার অর্থনীতিবিদ্রা মনে করেন যে, দুর্নীতি হ্রাসের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন হল দুর্নীতিপরায়ণদের আইন অনুসারে সাজা দেওয়া। এ মতবাদের সমর্থকগণ এ প্রসঙ্গে হংকং, চিলি ও নিউ সাউথ ওয়েলসের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে থাকেন। ষাটের দশকে হংকং নগর-রাষ্ট্রে দুর্নীতি প্রতিরোধ সংস্থা উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছিল। দুর্নীতি সংক্রান্ত নিরপেক্ষ কমিশন চিলিতে ও অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যে দুর্নীতি দমনে কার্যকর হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন সংস্থা সফল হলেও বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশেই এ ধরনের প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ হয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান সকল সমাজে সফল হয় না। শুধুমাত্র যে সব দেশে প্রশাসনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সৎ কর্মকর্তা রয়েছে সে সব দেশে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সাজা দেওয়া সম্ভব। যে সব দেশে প্রশাসনের অধিকাংশ কর্মকর্তাই ঘুষখোর সেখানে দুর্নীতি ধরবে কে? সর্ষেতে ভূত ঢুকে পড়ে। দুর্নীতি দমন সংস্থা নিজেই দুর্নীতিতে সংক্রমিত হয়। এ ধরনের সংস্থা দুর্নীতি দমন করতে পারে না, শুধুমাত্র ঘুষের বখরার সুষম বণ্টন করে। দুর্নীতি দমন একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া। দুর্নীতি দমনের জন্য দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক অঙ্গীকার নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। মাঝে মাঝে অভিযান করে দুর্নীতি তাড়ানো সম্ভব নয়। 

দুর্নীতি যদি সমাজের কয়েকটি খাতে সীমাবদ্ধ থাকে তবে তা দমন করা সহজ; কিন্তু দুর্নীতি মুষ্টিমেয় লোকের বিচ্যুতি নয়, দুর্নীতি সারা সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। দুর্নীতি একটি সামগ্রিক কাঠামোগত (systemic) সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এ ধরনের সমাজে দুর্নীতি নিরন্তর প্রতিক্রিয়ার (chain reaction) সৃষ্টি করে। এক ধরনের দুর্নীতি অন্য ধরনের দুর্নীতির জন্ম দেয়, এক খাত হতে দুর্নীতি অন্য খাতে সংক্রমিত হয়। এই পরিস্থিতিতে আইন সমাজের পরাক্রমশালীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ঐতিহাসিক উইল ডুরান্ট (Will Durant)-এর ভাষায় [১২]: 

Law is a spider’s web that catches the little flies and lets the big bugs escape. 

(আইন হল মাকড়শার জালের মত যা ছোট ছোট পতঙ্গদের আটকাতে পারে, কিন্তু বড় পোকাদের ঠেকাতে পারে না)। 

সরকারী প্রশাসনে যে কোন দুর্নীতিতে তিনটি পক্ষ রয়েছে। এক পক্ষে রয়েছে সরকারী কর্মচারিরা, দ্বিতীয় পক্ষ হলো জনগণ ও তৃতীয় পক্ষে রয়েছে সরকার। বেতন বাড়িয়ে বা শাস্তি দিয়ে সরকারী কর্মচারিদের কিছুটা প্রভাবিত করা যেতে পারে। কিন্তু দুর্নীতি দূর করতে হলে সরকার ও জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে। 

দুর্নীতির ক্ষেত্রে প্রাচীন রাষ্ট্রের সাথে আধুনিক রাষ্ট্রের একটি বড় তফাৎ রয়েছে। প্রাচীন রাষ্ট্রে যখন শোষণের মাত্রা বাড়ত তখন দুর্নীতির তীব্রতা বেড়ে যেত। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রে সরকার যখন জনগণের ভাল করতে চায় তখনও দুর্নীতি ফুলে ফেঁপে ওঠে। এর একটি কারণ হল আধুনিক রাষ্ট্রে সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ হচ্ছে অনুপযোগী আর পদ্ধতিসমূহ হচ্ছে অবাস্তব। 

অনুপযোগী প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বড় নজির হল রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাসমূহ। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মূল যুক্তি ছিল যে, এ সব প্রতিষ্ঠানের মুনাফা দিয়ে দরিদ্রদের জন্য কল্যাণকর ব্যবস্থার অর্থের যোগান দেওয়া হবে। প্রকৃত পক্ষে পৃথিবীর সকল দেশেই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাসমূহ রাষ্ট্রের জন্য প্রকাণ্ড বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন সাংবাদিক উইল রজার্স (Will Rogers) যথার্থই পরামর্শ দিয়েছেন [১৩]: 

The business of the government is to keep the government out of business – that is, unless business needs government aid. 

(সরকারের কাজ হচ্ছে সরকারকে ব্যবসাবাণিজ্যের বাইরে রাখা যদি না ব্যবসায়ীরা সরকারের সাহায্যের প্রয়োজন বোধ করে)। 

বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের মূল লক্ষ্য হল মুনাফা। সরকারী প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব হল জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা। লাভের টাকা হাতে গোনা যায়; জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা মাপা সম্ভব নয়। বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান দায়িত্ব হল উৎপাদন। পক্ষান্তরে ঠিকমত ওজর-অজুহাত দেখানো হল সরকারী প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বড় কাজ। সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ তাই দুর্নীতির জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। দুর্নীতি হ্রাস করতে হলে অবশ্যই সরকারের আকার ছোট করতে হবে এবং রাষ্ট্রীয় খাতের বাণিজ্যিক লেনদেন কমাতে হবে। 

পদ্ধতিগত দিক থেকে আধুনিক রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, আজকের রাজনীতিবিদ্‌গণ অর্থনৈতিক সমস্যার অর্থনৈতিক সমাধান না করে রাজনৈতিক সমাধান দিতে চান আর রাজনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান না করে আর্থিক সমাধান করতে চান। এর কারণ হল রাজনীতিবিদ্‌গণ অত্যন্ত অসহিষ্ণু। ক্ষণভঙ্গুর হলেও তাঁরা চটজলদি যাদু দেখাতে চান। ভোটারদের দেখাতে চান যে, তাঁরা সব সমস্যার সমাধান জানেন। অথচ বাস্তবে এখন অনেক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা রয়েছে যার কোন নিশ্চিত সমাধান নেই। এর ফলে হিতে বিপরীত হয়। একটি নজির দিচ্ছি। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে যখন সামরিক শাসন জারি হয় তখন সামরিক শাসকরা শহরাঞ্চলের নাগরিকদের খুশী করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ঐ সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের শহরগুলিতে একটি বড় সমস্যা ছিল খাঁটি দুধের অভাব। দুধে পানি মেশানো হতো। অর্থনৈতিক দিক থেকে দুধে পানি মেশানোর কারণ হল এই যে, খাঁটি দুধের দাম দেওয়ার মুরদ বেশিরভাগ ক্রেতারই নেই। ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতার অভাবে দুধের উৎপাদন ছিল সীমিত। দুধের সরবরাহ না বাড়লে দুধের দাম বা দুধে ভেজাল কোনটিই কমবে না; কাজেই এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সমাধান হল দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি। এ ধরনের সমাধানে সময় লাগবে, আরও লাগবে অর্থ। সামরিক শাসকরা তাই অর্থনৈতিক সমাধান উপেক্ষা করে এর রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা করে। সামরিক শাসনের আগে দুধে ভেজাল দিলে বিচারক তার ইচ্ছামত নগণ্য জরিমানা করত। সামরিক শাসকরা মনে করে যে, ভেজালের জন্য জরিমানা বাড়ালেই ভেজাল দেওয়া কমে যাবে। তাই ১৯৫৯ সনে একটি নতুন আইন জারি করে খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার সর্বনিম্ন জরিমানা ১৫০ টাকাতে নির্ধারণ করা হয়। ১৯৫৯ সনে ১৫০ টাকা আজকের কয়েক হাজার টাকার সমান। ষাটের দশকে এই আইন প্রয়োগ করার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল। এ আইনের অধীনে একটি মফস্বল শহরে প্রায় শ’ খানেক আসামীকে আমি দেড় শত টাকা হারে জরিমান করি। এরপর আমি আশা করেছিলাম যে, দুধে পানি মেশান কমে যাবে। বাজার থেকে খবর নিয়ে জানা গেল যে, এসব শাস্তির পর দুধে পানি মেশানো বেড়ে গেছে। এর কারণ হল, আদালত কর্তৃক ভেজালের জন্য উঁচু হারে জরিমানা আরোপের ফলে বাজারে স্যানিটারি ইনসপেক্টরদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। তারা দুধ ব্যবসায়ীদের হুমকি দিতে থাকে যে, তাদের ঘুষ না দিলে তারা আদালতে মামলা ঠুকে দেবে এবং আদালতে গেলেই নতুন হাকিম দুধওয়ালাদের জরিমানা করবে। স্যানিটারি ইনসপেক্টরদের ঘুষ দেওয়ার ক্ষতি পোষানোর জন্য দুধে পানি মেশানো আরও বেড়ে গেল। বিচারক হিসাবে আমি স্বচক্ষে দেখতে পেলাম যে, সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে সমস্যাটিকে আমি আরও প্রকট করে তুলেছি। বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে শুধু আইন করে সরকারের পক্ষে দুধে পানি মেশানো বন্ধ করা সম্ভব নয়। যে আইন সরকার কার্যকর করতে পারবে না সে আইন প্ৰণয়ন করে কোন লাভ হয় না, বরং ক্ষতি হয়। প্লেটো যথার্থই বলছেন যে, আইন করে কোন লাভ নেই, কেননা যারা ভাল লোক তাদের না বললেও তারা দায়িত্বশীল থাকবে; আর যারা খারাপ লোক তারা আইন ফাঁকি দেওয়ার কোন না কোন পথ বের করে নেবে।[১৪] দুর্নীতি হ্রাস করতে হলে অবাস্তব আইনসমূহ বাতিল করতে হবে। সাথে সাথে সরকারের কর্মকর্তাদের ঐচ্ছিক ক্ষমতা হ্রাস করতে হবে। যতদিন পারমিট ও লাইসেন্স থাকবে ততদিন দুর্নীতিও থাকবে। যেখানে সম্পদ অপ্রতুল ও দাবিদার অনেক সেখানেই লাইসেন্স ও পারমিটের জন্ম হয়। লাইসেন্স ও পারমিট হচ্ছে অর্থনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান। অথচ এ ধরনের সমস্যার অর্থনৈতিক সমাধান খুবই সহজ। কোন জিনিষের সরবরাহ কম হলে তার দাম বাড়বে। নিয়ন্ত্রণ তুলে দিলে বাজার যথাযথ মূল্যে যে কোন পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করবে। বাজারকে অস্বীকার করলে সমস্যার সমাধান হবে না, শুধুই দুর্নীতি বাড়বে। 

নিজেদের দুর্নীতি হ্রাসে সরকারী কর্মচারিদের সাধারণত কোন আগ্রহ থাকে না; তাদের অনেকেই হচ্ছে দুর্নীতির প্রধান পোষক। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অনেকেই দুর্নীতি দূর করতে চান। কিন্তু সরকারী কর্মচারিদের প্রতিরোধের সামনে তাঁরা অকার্যকর; অনেক সময় তাঁরা নিজেরাও একই ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। দুর্নীতি দূর করতে তাই প্রয়োজন সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। তবু দুর্নীতি নির্মূল করা সহজ হবে না। শুয়রের বাচ্চারা একদিনে জন্ম নেয় না, কাজেই রাতারাতি তারা উধাও হবে না। দীর্ঘস্থায়ী এ প্রক্রিয়ার প্রথম পদক্ষেপ হতে হবে সরকারের আয়তন হ্রাস। জনগণেরও ভাল করে বুঝতে হবে যে, বর্তমান কাঠামোতে সরকার জনগণের ভাল করতে গেলে তাদের উপকার হবে না, হবে অনিষ্ট। সরকার সম্পর্কে উইল রজার্স ঠিকই বলেছেন [১৫]: 

We should never blame the government for not doing something. It is when they do something is when they become dangerous. (কিছু না করার জন্য সরকারকে দোষারোপ করা আমাদের উচিত হবে না। যখন সরকার কিছু করতে চায় তখনই সরকার বিপজ্জনক হয়ে ওঠে)। 

উন্নয়নশীল দেশের জনগণকে তাদের সরকারকে বলতে হবে : “হুজুর আমরা আপনার কাছে উপকার চাই না, শুধু মেহেরবানি করে আপনার শুয়রের বাচ্চাদের সামলান।” 

.

তথ্যসূত্র 

১. Carritt, Michael, A Mole in the Crown (London: Central Books Ltd., 1985), p. 62 

২. Doniger, Wendy and Smith, Brian. K., tr., The Laws of Manu (New Delhi : Penguin Books India, 1991), p. 141 

৩. Kautilya, The Arthasastra, Rangarajan, L., tr., (New Delhi : Penguin Books India, 1992), p. 296 

৪. Kangle, R. P., The Kautilya Arthasastra (Bombay : University of Bombay, 1972), p. 91 

৫. উদ্ধৃত, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লা, বাংলা সাহিত্যের কথা, দ্বিতীয় খণ্ড (ঢাকা : রেনেসাঁস প্রিন্টার্স, ১৯৬৭), পৃষ্ঠা ৩৯২ 

৬. মুখোপাধ্যায়, সুখময়, ময়মনসিংহ গীতিকা, (কলিকাতা : ভারতী বুক স্টল, ১৯৭০), পৃষ্ঠা 

৭. Huntington, Samuel P., Political Order in Changing Societies (New Haven: Yale University Press. 1968), p. 386 

৮. Bardhan, Pranab, “Corruption and Development: A Review of Issues”, Journal of Economic Literature, vol. XXXV. No. 3, pp. 1320-1346 

৯. Myrdal, Gunnar, Asian Drama (New York: Pantheon, 1968), vol. II

১০. World Bank, World Development Report 1997 (New York: Oxford University Press, 1997). p. 102 

১১. Tullock, Gordon, “The Costs of Special Privilege” in Perspectives on Positive Political Economy, Alt, James E. and Shepsle, Kenneth A., ed., (Cambridge: Cambridge University Press, 1990), pp. 195-211

১২. Durant, Will, The Life of Greece (New York: Simon and Schuster, 1963), p. 117 

১৩. Peter, Laurence J., Peter’s Quotations (New York: Quill, 1977), p. 84 

১৪. উদ্ধৃত Howard, Philip K. The Death of Common Sense (New York: Random House, 1994), p. 99 

১৫. Rogers, Will, The Wit and Wisdom of Will Rogers, Ayres, Alex, ed., (New York: Penguin, 1993), p. 93 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *