শুভ্রদীপের বুদ্ধি – রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়

শুভ্রদীপের বুদ্ধি – রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়

রহস্য-রোমাঞ্চ লাইনে আসার অভিজ্ঞতার বয়েস হল বত্রিশ। এই বত্রিশ বছরে, বাংলায় যত বাঘা বাঘা গোয়েন্দা আছে, সবারই ছাড়পত্র মিলেছে আমার হাতে। এই দুনিয়ায় যত রকমের কূটবুদ্ধির মানুষ আছে, রহস্য উন্মোচনের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর প্রতিভা আছে, সবারই চেহারা আর চরিত্র আমার নখদর্পণে। আকাশে, মাটিতে ও পাতালে বিচিত্র সব ঘটনার সৃষ্টি করে বিচিত্রতর যে মানুষগুলো আজ পৃথিবীর বুকে দাপটে রাজত্ব করে চলেছে, তারা সকলেই আমার পরিচিত। কারণ, আমার কলমের ডগাতেই নির্ভর করে তাদের অস্তি এবং নাস্তি।

সেই আমি কিনা একেবারে বোকা বনে গেলাম— যাকে বলে একেবারে থ। তাও আবার একটা বাচ্চা ছেলের কাছে, যার বয়েস এখন মোটে তেরো।

আসছিলাম বহরমপুর থেকে কলকাতায়। উদ্দেশ্য আমার ছোট ছেলে শুভ্রদীপের ‘আই কিউ’ টেস্ট করানো। যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ যত বড় বড়ই দেওয়া হোক না কেন, শুভ্রদীপের কাছে তা জলবৎ তরলম্‌। সিঁড়ি-ভাঙা সরলও তার কাছে অতি সরল। কিন্তু আশ্চর্য, বুদ্ধির অঙ্কের বেলায় সে একেবারে ঠিক উলটোটি। অর্থাৎ ভীষণ রকম ভোঁতা। ক্লাস টু-এর একটা ছেলেও যা ঝট করে বলে দিতে পারে, ক্লাস সেভেনে পড়েও শুভ্র তা ধরতেই পারে না। ফলে, প্রতি বছর প্রতি পরীক্ষাতেই বুদ্ধির অঙ্কগুলোর জন্যে সে দু’টাকা দামের রসগোল্লার চেয়েও বড় সাইজের গোল্লা পায় এবং মায়ের গোল গোল চোখের সামনে থেকে সরে পড়ে। ওদের স্কুলের হেডমাস্টারমশাই একদিন আমাকে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন, আমি তাঁর দু’-একটা কথার জবাব দিলাম এবং বেশির ভাগ সময়ই নিশ্চুপ থাকলাম। শুভ্রদীপের এহেন নির্বুদ্ধিতার আসল কারণটা কী, আমি নিজেই জানি না তো জবাব দেব কী। উপস্থিত সেই হেডমাস্টারমশাইয়ের নির্দেশেই আমি চলেছি কলকাতায়, একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়ে ওর আই কিউ টেস্ট করাবার জন্যে। পাশ করার মতো নম্বর নিচু ক্লাসে ও পেয়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এবার তো ক্রমেই উঁচুতে উঠছে, আর এড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না! বিশেষ করে অন্যান্য সাবজেক্টগুলোয় সে যখন রেকর্ড মার্কস রাখে।

দুপুরের খাওয়া সেরে যথাসময়ে লালগোলা প্যাসেঞ্জার ধরলাম। গাড়িখানা নামে প্যাসেঞ্জার, কিন্তু ছোটে ভাল। সব স্টেশনে ধরে না, যেখানে ধরে, বেশি সময় নেয় না। মাঝামাঝি জায়গায় একটা ফাঁকা কম্পার্টমেন্ট দেখে আমরা উঠেছিলাম। কী একটা উপলক্ষে সেদিন ছুটি ছিল, নাকি আমাদের বরাতজোর জানি না, যাত্রীও ছিল তাই খুব কম। আমাদের তিনজনকে নিয়ে সর্বসাকুল্যে জনা কুড়ি-পঁচিশ। হাত-পা ছড়িয়ে দিব্যি গল্প করতে করতে চলেছি। কৃষ্ণনগর পার হল, রানাঘাট পার হল, নৈহাটিও পেরিয়ে গেল গাড়িখানা। ট্রেনের যাত্রীসংখ্যা তখন আরও কমে এসেছে। বড়জোর জনা বারো-তেরো। বুড়ো-বুড়ি জনাপাঁচেক, জনা-চারেক বছর কুড়ি-বাইশের ছোকরা, আর আমরা তিনজন।

হাতঘড়ির দিকে তাকালাম। মোটামুটি রাইট টাইমেই রান করছে গাড়িখানা। কিন্তু হঠাৎ কাঁকিনাড়ার কাছাকাছি এসে ট্রেনখানার গতি গেল কমে। জানলার ফাঁক দিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম। কিছুই দেখা যায় না, নীরন্ধ্র অন্ধকার চারদিকে। এদিকে ট্রেনের গতি তখন ক্রমেই কমতে শুরু করেছে। হয়তো থেমেও যেতে পারে এমন অবস্থা।

শুভ্রদীপের দু’চোখে তখন রাজ্যের ঘুম। গৃহিণীর মুখের দিকে তাকালাম। বলতে চলেছি, এই বোধহয় লেট করা শুরু হল, শেয়ালদা পৌঁছতে অনেক দেরি হয়ে যাবে, কিন্তু বলা আর হল না। দেখি, গৃহিণীর মুখ-চোখের অবস্থা তখন কাহিল। একমাথা ঘোমটা টেনে শাড়ির প্রান্তটা তিনি তখন তাঁর গলায় চাপা দিচ্ছেন। অর্থাৎ গয়নাগুলো ঢাকা দিচ্ছেন। আজকাল এই লাইনে যে যখন-তখন ডাকাতি ছিনতাই হয়, সে-খবর তিনি রাখেন ঠিকই, কিন্তু ওই রাখা পর্যন্তই। কোথাও বেরোবার সময় সে-কথা আর মনে রাখেন না কিছুতেই। যতক্ষণ না শরীর ভারী ভারী মনে হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি গয়না দিয়ে মুড়িয়ে নেন নিজেকে। এ নিয়ে অনেক বাক-বিতণ্ডা ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে, কিন্তু শেষে এগুলো ডাকাতের ধন ওঁর কাছে গচ্ছিত রয়েছে মনে করে হাল ছেড়ে দিয়েছি। অলংকার ওঁর কাছে একটা মস্ত বড় অহংকার যেন।

কিন্তু এখন? এখন তবে সোনামুখ সিসে হয়ে গেল কেন বাপু। এ-কথা তো মুখে বলা যাবে না, তাই চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “কী হল, অমন করে তাকিয়ে আছ কেন?”

গৃহিণী কিছু বললেন না, মুখখানা ঘুরিয়ে নিলেন। নিলেও, বেশ বুঝতে পারলাম, সকরুণ দৃষ্টিটা ওঁর ওই ছোকরা চারজনের দিকেই। অর্থাৎ অকূল পাথারে আজ ওরাই ওঁর ভরসা। যদি কিছু বিপত্তি ঘটে, ওরাই সামলাতে পারে। হাজার হলেও জোয়ান ছেলে তো!

প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেনখানা থামো থামো হয়ে গেল এই সময়। সেই ঝাঁকুনিতে শুভ্রদীপের তন্দ্রাও গেল টুটে। হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে জানলার বাইরে মুখ বাড়ালাম আবার। কৃষ্ণপক্ষের শীতের রাত যেন থমথম করছে। লাইনের ধারে একটা সরু রাস্তা, রাস্তার ওপারে এক-আধটা দোকান, দু’-চারজনের অস্পষ্ট গলার স্বর। ট্রেনটা বোধহয় সিগন্যাল পায়নি, তাই স্টেশনের একটু আগেই থেমে পড়েছে। হঠাৎ—

চোখের পলকে কামরার সমস্ত দৃশ্যপটটাই যেন পালটে গেল। ছোকরা চারজনের দু’জন দেখি দু’ধারে দুটো দরজা আগলে দাঁড়িয়ে পড়েছে, আর বাকি দু’জনের একজন যেন ম্যাজিক-হাতে ঝপঝপ করে আমার গৃহিণীর হাত গলা থেকে গয়নাগুলো খুলে খুলে নিয়ে একটা রুমালে জড়ো করে রাখছে। বাকিরা দাঁড়িয়ে আছে সামনেই। হাতে একটা ছোরা জাতীয় কিছু, কামরার টিমটিমে আলোতেও যার ফলাটা বেশ চিকচিক করছে। আর, আমার গৃহিণী ভয়-ফ্যাকাশে মুখে একবার তাকাচ্ছেন আমার দিকে, আরেকবার ছোরাটার দিকে। কিন্তু আমি তখন করতেই বা পারি কী? করা মানেই তো মরা।

শুভ্রদীপ এতক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল ওদের দিকে। শেষ চুড়িগাছা খুলে নিয়ে দরজার দিকে এগোচ্ছে ছোকরা দু’জন, হঠাৎ সে আমার দিকে ফিরে বলে উঠল, “ওরা কী বোকা দেখো বাবা, গিল্টি আর সোনাও চেনে না! ওগুলোর নতুন দামই তো তিরিশ-পঁয়ত্রিশ টাকার বেশি নয়। তার চেয়ে—”

শুভ্রদীপ থেমে গেল। হঠাৎ দেখি ছোকরা দু’জন এক মুহূর্তের জন্যে কেমন থমকে গেল। কী যেন ভাবল, তারপর পেছনের ছোকরাটি, যার হাতে ছোরা, এগিয়ে এল আমার কাছে। এসেই টপ করে আমার বাঁ হাত থেকে ঘড়িটা নিল ছিনিয়ে। তারপর আমার বাঁ গালে প্রচণ্ড একটা চড় কষিয়েই দে ছুট!

চোখের সামনে আমি তখন সর্ষেফুল দেখছি। বেশ কিছুক্ষণের জন্যে আমি বোধহয় আর আমার মধ্যে ছিলাম না। দরজার ওপারের অন্ধকারে নিঃশব্দে ওদের লাফিয়ে পড়া, আমার গৃহিণীকে লক্ষ্য করে একটা কিছু ছুড়ে মারা, “ঘড়িটা তো আর ছেলে-ভুলোনো নয়” কথা ক’টা কানে আসা ছাড়া বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সব কিছুই আমার কাছে তখন ঝাপসা।

যখন সংবিৎ ফিরে পেলাম, ট্রেন তখন ঝড়ের গতিতে শেয়ালদার রেলওয়ে ইয়ার্ডের মধ্যে ঢুকছে। নিজের কোলের ওপর বাঁ হাতটা চেপে ধরে ডান হাতটা আমার গালে বুলোতে বুলোতে গৃহিণী বললেন, “চড়টা খুব জোরেই মেরেছে মুখপোড়াটা, পাঁচ আঙুলের দাগ বসে গেছে গা একেবারে!”

সঙ্গে সঙ্গে আমার লুপ্ত পৌরুষ যেন ফিরে এল। একরকম দাঁত খিঁচিয়েই বলে উঠলাম, “হল তো, গয়না পরার শখ মিটেছে? মাঝ থেকে তোমার গয়নার সঙ্গে আমার ঘড়িটা পর্যন্ত—”

শাড়ির আড়াল থেকে রুমালে-জড়ানো একটা পুঁটলি দেখিয়ে একমুখ হেসে গৃহিণী একটু চাপা গলায় বললেন, “কিচ্ছু খোয়া যায়নি গো, কিছু খোয়া যায়নি। তোমার ছেলের জন্যে সব কিছু ফিরে পেয়েছি। শুধু তোমার ঘড়িটা—”

অবাক বিস্ময়ের একটা অস্ফুট শব্দই শুধু আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, “তার মানে?”

মুখঝামটা দিয়ে গৃহিণী বলে উঠলেন, “তার মানে কলকাতায় গিয়ে ছেলের বদলে তোমার নিজের বুদ্ধিটাই একবার মেপে নেবে চলো! বৃথাই এতদিন রহস্য-কাহিনি নিয়ে মাথা ঘামালে—ঘটে যদি উপস্থিতবুদ্ধি বলতে কিছু থেকে থাকে। তোমার একফোঁটা ছেলেটার যা আছে—”

হাতে আয়না থাকলে বলতে পারতাম, সেই সময় আমার চোখজোড়া ঠিক রসগোল্লার মতো গোল গোল হয়ে উঠেছিল কি না!

৯ মার্চ ১৯৮৩

অলংকরণ: সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *