নবম পরিচ্ছেদ
শুক্লা একাদশী রজনীর প্রায় দ্বিপ্রহর অতীত হইয়া গিয়াছে। ভাগীরথীতীরের অর্ধবনাবৃত একটা ভগ্ন শিবমন্দিরের চাতালের উপর একজন দ্বাবিংশবর্ষীয় যুবক যেন কাহার জন্য পথ চাহিয়া বহুক্ষণ হইতে বসিয়া আছেন।
যুবকের নাম শারদাচরণ রায়। এই হলুদপুর গ্রামের একজন বর্ধিষ্ণু লোকের একমাত্র সন্তান। লেখাপড়া কতদূর হইয়াছিল বলিতে পারি না, কিন্তু বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান এবং কর্মদক্ষ তাহা বলিতে পারি। বৃদ্ধ পিতার সমস্ত সাংসারিক কর্ম নিজেই নির্বাহ করিয়া আসিতেছেন। শারদাচরণের জননী জীবিত নাই। যতদিন তিনি জীবিত ছিলেন, ততদিন হারাণ মুখুজ্যেদের বাটীর সহিত ইঁহাদের খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা ছিল। রাসমণি ও শারদার জননী উভয়ের অত্যন্ত প্রণয় ছিল। এখন তিনিও গত হইয়াছেন, আত্মীয়তা বন্ধুত্বও গত হইয়াছে। বিশেষ শারদাচরণের পিতা হরমোহনবাবু দরিদ্রের সহিত কোনরূপ সম্বন্ধ রাখা যুক্তিযুক্ত মনে করিতেন না।
এইখানে একটু ললনার কথা বলিয়া রাখি; কেননা, তাহার সহিত এ আখ্যায়িকায় আমাদিগের অনেক প্রয়োজন আছে। বালিকা–কাল হইতেই শারদার সহিত তাহার ভাব ছিল, তাহার পর তাহার বিবাহ হয়। হারাণবাবুর অবস্থা তখন মন্দ ছিল না, ক্ষুদ্র আয়তনে যতখানি সম্ভব, ঘটা করিয়া বড়মেয়ের বিবাহ দেন; কিন্তু দুর্ভাগ্যে ললনা দুই বৎসরের মধ্যেই বিধবা হইয়া বাটী ফিরিয়া আইসে। তখনও শারদাচরণের সহিত তাহার ভাব ছিল। সে ভাব কমিল না, বরং উত্তরোত্তর বাড়িতে লাগিল। ক্রমে দুইজনেরই বয়ঃক্রম বৃদ্ধি হইতে লাগিল; ক্রমে দুইজনেই বুঝিতে লাগিল যে, এ প্রণয় পরিণামে বড় সুখের হইবে না। শারদাচরণ না বুঝুক কিন্তু ললনা একথা বেশ বুঝিতে লাগিল। ক্রমশঃ ললনা ভালবাসার দোকান-পাট একে একে বন্ধ করিয়া দিতে লাগিল। সে আর কাছে আসে না, আর আসিতে বলে না, আর ভালবাসা জানায় না, আর গোপনে তেমন করিয়া পত্র লিখে না—দেখিয়া শুনিয়া শারদাচরণ বড় বিপদে পড়িল। প্রথমে সে অনেক বুঝাইল, অনেক আপত্তি প্রকাশ করিল, অনেক যুক্তি দেখাইল, কিন্তু ললনা কর্ণযুগল বন্ধ করিয়া রহিল। একদিন সে একরূপ স্পষ্টই কহিল যে তাহার এসব আর ভাল লাগে না।
শারদাচরণও সে-দিবস কুপিত হইল, বলিল, যদি ভাল লাগে না তবে এতদিন লাগিল কেন?
এতদিন ছেলেমানুষ ছিলাম, এখন বড় হইয়াছি।
বড় হইলে বুঝি আর ভাল লাগিতে নাই?
না।
কিন্তু বুঝিয়া দেখ—
কথা শেষ না হইতেই ললনা বলিয়া উঠিল, আর বুঝিয়া কাজ নাই। তুমি আমাকে আর কুপরামর্শ দিও না।
শারদাচরণ চটিয়া উঠিয়া বলিল, আমি বুঝি তোমাকে কুপরামর্শ দিই?
দাও না ত কি!
দিই?
দাও
তবে এস আজ সব শেষ করে দিই।
ভালই ত।
তোমার সঙ্গে এজন্মে আমি আর কথা ক’ব না।
ক’য়ো না।
তখন দুইজনে দুজনের গন্তব্যপথে চলিয়া গেল। সমস্ত পথটা শারদাচরণ গর্জিতে গর্জিতে গেল, সমস্ত পথটা ললনা চক্ষু মুছিতে মুছিতে চলিল।
সে আজ চারি বৎসরের কথা। চারি বৎসর পরে শারদাচরণ আবার ললনার পথ চাহিয়া ভগ্ন মন্দিরে বসিয়া রহিল। সে পূর্বের কথা একরকম ভুলিয়া গিয়াছিল, অন্ততঃ যাইতেছিল; কিন্তু ললনাই পুনর্বার অনুরোধ করিয়া তাহাকে এস্থানে আনয়ন করিয়াছে। তাই পূর্বের কথা পুনরায় একটির পর একটি করিয়া তাহার মস্তিষ্কে উদয় হইতে লাগিল। কেহ বলে, বাল্যপ্রেমে অভিসম্পাত আছে; কেহ বলে, বাল্যপ্রেম দৃঢ় হয় না; কেহ কহে, দৃঢ় হয়। যাহাই হউক এবিষয়ে ঠিকঠাক একটা কোনরূপ বন্দোবস্ত করা নাই। সকল রকমই হইতে পারে; কিন্তু যাহাই হউক, ইহার একটি স্মৃতি চিরদিনের জন্য ভিতরে রহিয়া যায়। যেমন করিয়া উপড়াইয়া ফেলিয়া দেওয়া হউক না কেন, একটু ক্ষুদ্রতম শিকড় বোধ হয় অনুসন্ধান করিলে অনেক হাত জমির তলে পাওয়া যায়।
শারদাচরণের অনেক কথা মনে হইতে লাগিল। আজ চারি বৎসর পরে সে আবার আসিবে, কাছে বসিবে, কথা কহিবে! শারদার ভিতরটা যেন একটু শিহরিয়া উঠিল, আনন্দে যেন অল্প রোমাঞ্চ হইল। কিন্তু কেন? কেন আসিবে? কেন আমাকে এসময়ে এস্থানে আসিতে অনুরোধ করিল? আর কি সম্বন্ধ আছে?
রাত্রি প্রায় একটা বাজে। একজন স্ত্রীলোক অবগুণ্ঠনে মুখ ঢাকিয়া সেই পথে আসিতে লাগিল। শারদাচরণ ভাবিল, একি ললনা? ললনাই ত বটে, কিন্তু বড় হইয়াছে।
ললনা আসিয়া নিকটে দাঁড়াইল। শারদাচরণ সঙ্কোচ ছাড়িয়া বলিল, বসো।
তখন বহুদিন পর দুইজনে মুখোমুখি হইয়া চাঁদের আলোকে ভগ্ন মন্দিরে সেই চাতালের উপর উপবেশন করিল। বহুক্ষণ অবধি কেহ কথা কহিতে পারিল না। তাহার পর শারদাচরণ সাহস করিয়া বলিয়া ফেলিল, আমাকে এখানে ডাকাইয়া আনিলে কেন?
ললনা মুখ তুলিয়া বলিল, আমার প্রয়োজন আছে।
কি প্রয়োজন?
বলিতেছি।
পুনরায় বহুক্ষণ নিস্তব্ধে অতিবাহিত হইলে শারদাচরণ বলিল, কই বলিলে না?
বলিতেছি। পূর্বে তুমি আমাকে ভালবাসিতে, এখন আর বাস কি?
প্রশ্নের ভাবে শারদাচরণ বড় বিস্মিত হইল। কহিল, সে কথা কেন?
কাজ আছে।
যদি বলি এখনও ভালবাসি?
ললনা মৃদু হাসিয়া সলজ্জে বলিল, আমাকে বিবাহ করিবে?
শারদাচরণ একটু পিছাইয়া বসিল। বলিল, না।
কেন করিবে না?
তোমাকে বিবাহ করিলে জাতি যাইবে।
গেলেই বা।
খাইব কি?
খাইবার ভাবনা তোমাকে করিতে হইবে না।
কিন্তু পিতার মত হইবে না।
হইবে। তুমি তাঁহার ত একটিমাত্র সন্তান; ইচ্ছা করিলে মত করিয়া লইতে পারিবে।
কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া শারদাচরণ বলিল, তবুও হয় না।
কেন?
অনেক কারণ আছে। প্রথমতঃ পিতার মত হইলেও, তোমাকে বিবাহ করিলেই জাতি যাইবে। জাতি খুইয়ে হলুদপুর তিষ্ঠান আমাদিগের সুখের হইবে না। আর আমার এমন অর্থও নাই যে, তোমাকে লইয়া বিদেশে গিয়া থাকিতে পারি। দ্বিতীয়তঃ যাহা ফুরাইয়া গিয়াছে তাহা ফুরাইয়াই যাউক, ইহা আমার ইচ্ছাও বটে, মঙ্গলের কারণও বটে।
ললনা কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া কহিল, তবে তাহাই হউক। কিন্তু আমার একটি উপকার করিবে?
বল, সাধ্য থাকে ত করিব।
তোমার সাধ্য আছে, কিন্তু করিবে কিনা বলিতে পারি না।
বল; সাধ্যমত চেষ্টা করিয়া দেখিব।
আমার ভগিনী ছলনাকে বিবাহ কর।
শারদাচরণ ঈষৎ হাসিয়া বলিল, কেন, তাহার কি পাত্র জুটিতেছে না?
কৈ জুটিতেছে? আমরা দরিদ্র; দরিদ্রের ঘরে কে সহজে বিবাহ করিবে? শুধু তাই নয়। আমরা কুলীন; অঘরে বিবাহ দিলে হয়ত বর জুটিতে পারে, কিন্তু তাহা হইলে কুলে জলাঞ্জলি দিতে হয়। তোমরা আমাদের পালটি ঘর; তুমি বিবাহ করিলে সবদিকই রক্ষা হয়। বিবাহ করিবে?
আমি পিতার সম্পূর্ণ আজ্ঞাধীন। তাঁর মত না লইয়া কোন কথাই বলিতে পারিব না।
তবে মত লইয়া বিবাহ কর।
আমি যতদূর জানি, এ বিবাহে তাঁহার মত হইবে না।
ললনা ম্লানভাবে কহিল, কেন মত হইবে না?
তবে তোমাকে বুঝাইয়া বলি। লুকাইয়া কোন ফল নাই। আমার পিতা কিছু অর্থপিপাসু; তাঁহার ইচ্ছা যে আমার বিবাহ দিয়া কিছু অর্থ লাভ করেন। তোমরা অবশ্য কিছুই দিতে পারিবে না, তখন বিবাহও হইবে না।
ললনা কাতর হইয়া বলিল, আমরা দরিদ্র, কোথায় কি পাইব? আর তোমাদের অর্থের প্রয়োজন কি? যথেষ্ট ত আছে।
শারদাচরণ দুঃখিতভাবে মৃদু হাসিয়া বলিল, সেকথা আমি বুঝি, কিন্তু তিনি বুঝিবেন না।
তুমি বুঝাইয়া বলিলে নিশ্চয় বুঝিবেন।
আমি একবার মাত্র বলিব; বুঝাইয়া বলিতে পারিব না।
ললনা নিতান্ত বিষণ্ণ হইয়া বলিল, তবে কেমন করিয়া হইবে?
আমি কি করিব?
তোমার বোধ হয় বিবাহ করিতে ইচ্ছা নাই।
না।
ছলনার মত কন্যা তুমি সহজে পাইবে না। সে সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, কর্মিষ্ঠা—অধিকন্তু একজন দরিদ্রের যথেষ্ট উপকার করা হইবে, একজন ব্রাহ্মণের জাতি-কুল রক্ষা করা হইবে এবং আমি চিরদিন তোমার কেনা হইয়া থাকিব। বল, এ বিবাহ তুমি করিবে?
পিতা যাহা বলিবেন তাহাই করিব।
আজ তোমাকে সকল কথা বলি। হয়ত এজন্মে আর কখন বলিবার অবসর পাইব না, তাহাই বলি—তোমাকে লজ্জা কখন করি নাই, আজও করিব না। সমস্ত কথা খুলিয়া বলিয়া যাই—তোমাকে চিরদিন ভালবাসিয়া আসিয়াছি, এখনো ভালবাসি। একথা পূর্বে একবার বলিয়াছিলাম, আজ বহুদিন পরে আর একবার শেষ বলিলাম। তুমি, আমার একমাত্র অনুরোধ—বোধ হয় এই শেষ অনুরোধ—রাখিলে না। যা হইবার হইল, আর এমন কখন হইবে না। মিথ্যা তোমাকে এত ক্লেশ দিলাম, সেজন্য ক্ষমা করিও।
শারদাচরণ মনে মনে ক্লেশ অনুভব করিল। ললনা চলিয়া যাইতেছে দেখিয়া বলিল, পিতাকে এবিষয়ে অনুরোধ করিব।
ললনা না ফিরিয়াই বলিল, করিও।
কিন্তু আমি পিতার আজ্ঞাধীন।
ললনা চলিতে চলিতে বলিল, তাহা ত শুনিলাম।
যদি কিছু করিতে পারি তোমাকে জানাইব।
ভাল।
ললনা, আমাকে ক্ষমা করিও।
করিয়াছি।