ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
শ্রীসদানন্দ চক্রবর্তীকে গ্রামের অর্ধেক লোক ‘সদাদাদা’ বলিয়া ডাকিত, অর্ধেক লোক ‘সদাপাগলা’ বলিয়া ডাকিত। এই হলুদপুর গ্রামেই তাহার বাটী। তাহার পিতা গোঁড়া হিন্দু ছিলেন। ইংরেজি ম্লেচ্চ ভাষা, ইংরেজি শিখিলে ধর্ম নষ্ট হইতে পারে এই আশঙ্কায় তিনি পুত্রকে লিখিতে পড়িতে শিখান নাই। আর প্রয়োজনই বা কি? যে দু-দশ বিঘা জমিন আছে তাহাতে পরের চাকুরি করিতে হইবে না, তবে মিছামিছি জাতি দিয়া কি হইবে? কেহ বলিত, সে সংস্কৃত ভাষা জানে, কেহ বলিত, জানে না; যাহা হউক এ বিষয়ে মতভেদ আছে, কিন্তু সে যে পাগল তাহাতে আর মতভেদ নাই। আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই স্বীকার করে, তাহার একটু বাতিকের ছিট আছে। জমি দেখে, রামপ্রসাদী গান গাহে, মড়া পোড়ায়, এ বাটী ও বাটী করে, এমনি করিয়া মনের আনন্দে দিন কাটিয়া যায়। দূরসম্পর্কের এক পিসি ভিন্ন সংসারে আপন বলিতে তাহার কেহ নাই; তাই গ্রামসুদ্ধ লোককে সে আপনার করিয়া লইয়াছে। সকলেই তাহার আত্মীয়, সকলের সহিতই তাহার সম্পর্কের ডাক, সকল স্থানেই তাহার অবারিত দ্বার।
পূর্বেই বলিয়াছি, সংসারে তাহার কেহ আপনার লোক নাই। বাল্যকালে সদানন্দর পিতা অনেক টাকা পণ দিয়া তাহার বিবাহ দিয়াছিলেন, কিন্তু ভাগ্যদোষে এক বৎসরের মধ্যেই বধূটির মৃত্যু হয়। সেই অবধি, আজ ছয় বৎসর হইল, সদানন্দ একাকী আছে। টাকা জুটিয়া উঠে নাই বলিয়াই হউক, আর ইচ্ছা ছিল না বলিয়াই হউক, সে আর বিবাহ করে নাই। তাহাদিগকে অনেক টাকা পণ দিয়া বিবাহ করিতে হইত; কেহ বিবাহের কথা পাড়িলে সে তাহারই উল্লেখ করিয়া বলিত, অত টাকা পাই কোথায় যে বিবাহ করিব?
আজ অপরাহ্নে আকাশে ভারী মেঘ করিয়াছে। সমস্ত নিশ্চল, নিস্তব্ধ। প্রকৃতি এমনি ভাব ধরিয়া আছে যেন সে ইচ্ছা করিলে এখনই প্রবলধারে জল ঢালিতে পারে এবং ইচ্ছা না করিলে হয়ত এখনও তিন-চারি ঘণ্টা স্থগিত রাখিতে পারে।
পিসি রাসমণি ডাকিয়া বলিলেন, ও ললনা, ঘরে যে একফোঁটা খাবার জল নেই। চট করে ঘাট থেকে এক কলসী জল নিয়ে আয় না, মা।
ললনা কলসী কাঁকালে গঙ্গার ঘাটে আসিল। জল লইয়া দুই পদ অগ্রসর হইতে না হইতেই মেঘ হইতে বড় বড় ফোঁটা জল পড়িতে লাগিল। ললনা হনহন করিয়া পথ বাহিয়া চলিতে লাগিল। আসিবার পথেই সদানন্দর বাটী; পথের ধারের আটচালাঘরের বারান্দায় বসিয়া সে তখন রামপ্রসাদী সুরে কালীনাম গাহিতেছিল। ললনাকে দেখিয়া সে গান থামাইয়া বলিল, ললনা, ভিজচ কেন?
ললনা ঈষৎ হাসিয়া বলিল, তুমি গান থামালে কেন?
সদানন্দও হাসিল; হাসি গান তাহার মুখে অষ্টপ্রহর লাগিয়াই আছে। সুর করিয়া বলিল, গান থামিয়া গেছে ; তাহার পর স্বাভাবিক স্বরে কহিল, সেকথা যাক, মিছামিছি ভিজো না, এইখানে একটু দাঁড়াও।
ললনা বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইল।
সদানন্দ তাহার মুখপানে কিছুক্ষণ চাহিয়া বলিল, দাঁড়িও না, বাড়ি যাও।
সে কি?
পিসিমা বাড়ি নাই, বেশি জল আসিলে যাইবে কেমন করিয়া?
ললনা ভাবিল, সেকথাও বটে; দুই পদ অগ্রসর হইয়া আবার পিছাইয়া আসিল।
সদানন্দ বলিল, ফিরিলে কেন?
কাল রাত্রে আমার জ্বর হয়েছিল, জলে ভিজলে অসুখ বাড়তে পারে।
তবে যেও না, এইখানে দাঁড়িয়ে থাক।
সদানন্দ তখন আপন মনে গান ধরিল—
কভু তারে পাব না বুঝি, মিছে হাত বাড়ায়ে দাঁড়ায়ে আছি।
কত জ্বালায় জ্বলে মরি, তুই কি জানবি পাষাণী মা!
আমার সোনার তরি ডুববে এবার—
ললনা কলসী নামাইয়া গান শুনিতেছিল; মিষ্ট গলায় মিষ্ট গান তাহার বড় ভাল লাগিতেছিল। হঠাৎ মাঝপথে থামিয়া যাওয়ায় বলিল, ওকি থামিলে যে?
আর গাইব না।
কেন?
আর মনে নাই।
ললনা মৃদু হাসিয়া বলিল, তবে গাইলে কেন?
আমি অমন গেয়ে থাকি। তাহার পর কিছুক্ষণ আকাশপানে চাহিয়া বলিল, মেঘের উপর পদ্ম ফোটে, তুমি দেখেচ?
ললনা সহাস্যে বলিল, কই না, তুমি দেখেচ?
হ্যাঁ দেখেচি। কবে দেখলে?
প্রায়ই দেখি।যখন আকাশে মেঘ হয় তখনই দেখতে পাই।
সদানন্দর গম্ভীর মুখশ্রী দেখিয়া ললনার হাসি আসিল। মুখে কাপড় দিয়া বলিল, তা কি হয়?
কেন হবে না? পদ্ম ত জলেই ফোটে, মেঘেতেও জলের অভাব নেই, তবে সেখানে ফুটবে না কেন?
মাটি না থাকলে শুধু জলেতে কি পদ্ম ফোটে?
সদানন্দ ললনার মুখপানে অনেকক্ষণ চাহিয়া চাহিয়া বলিল, তাই বটে! সেই জন্যই শুকিয়ে যাচ্ছে।
ললনা আর কিছু কহিল না। সকলেই জানিত সদাপাগলা দিনের মধ্যে অমন অনেক অসম্ভব ও অসংলগ্ন কথা কহিয়া থাকে।
কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া সদানন্দ আবার কহিল, ললনা শারদা আর তোমাদের বাটীতে যায় না?
ললনা অন্যদিকে মুখ ফিরাইল। বোধ হয় তখনকার মুখ সদানন্দকে দেখাইবার তাহার ইচ্ছা ছিল না।
সদানন্দ পুনর্বার জিজ্ঞাসা করিল, যায় না?
না।
কেন?
তা বলতে পারি না।
সদানন্দ গান ধরিল—
গান থামিল, কিন্তু বৃষ্টি কিছুতেই ছাড়িতে চাহে না। বরং আকাশের মেঘ গাঢ়তর হইয়া আসিতে লাগিল। ললনা কাঁকে কলসী তুলিয়া লইল। সদানন্দ দেখিয়া বলিল, ওকি, যাও কোথা?
বাড়ি যাই।
এত বৃষ্টিতে যাইলে অসুখ করিবে যে।
কি করব!
ললনা চলিয়া গেলে সদানন্দ আবার গান ধরিল।