শুভঙ্করের ফাঁকি

শুভঙ্করের ফাঁকি

প্রতিম ভয়ে ভয়ে বলল, ”এই অচ্যুত, আর কদ্দুর যাবি তুই? এবার ফেরত চল। আর দেরি হলে ফেরার বাস পাওয়া মুশকিল হবে।”

”আর একটু গিয়েই ফিরব। কী সুন্দর জায়গাটা রে, আমি এত সবুজ কোনদিনও দেখিনি!” অচ্যুত মুগ্ধচোখে চারপাশে তাকাচ্ছিল।

সবুজে মোড়া অরণ্যপ্রান্তর। তার মধ্যে উল্লম্ব দাঁড়িয়ে রয়েছে নাম না জানা লম্বা লম্বা গাছের সারি। সেগুলোর পাতা ঢেকে ফেলেছে যেন গোটা আকাশটাকে। নাম না জানা এক বন্যফুলের মনমাতানো গন্ধ শরীরে একটা আদিম আমেজ ছড়িয়ে দিচ্ছে।

চারপাশ দেখতে দেখতে অচ্যুত একটা অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করল, ”আচ্ছা প্রতিম, তোর সেই গল্পটা এবার বল তো।”

”কোন গল্প?” প্রতিম জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়।

”আরে তোর সেই পূর্বপুরুষ। সকালে ট্রেনে আসার সময় তো ভাল করে শোনাই হল না। এখানে এসে তো দেখছি তিনি বেশ বিখ্যাত মানুষ। কিন্তু আমি নাম শুনিনি।”

প্রতিম বলে, ”তুই কী করে শুনবি? এখনকার অর্ধেক ছেলেমেয়ে নামই জানেনা। অথচ আজ থেকে পঞ্চাশ ষাট বছর আগেও বাংলার প্রতিটা প্রাইমারী স্কুলে শুভঙ্করী পড়ানো হত।”

”শুভঙ্করী?”

”হ্যাঁ। মনে করে দ্যাখ, পথের পাঁচালিতে অপু শুভঙ্করী মুখস্থ করত।”

 ”হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে।” অচ্যুত উল্লসিতচোখে তাকাল, ”কিন্তু এরকম খুবলে খাবলে বললে বুঝতে পারব না। ভাল করে বল। তোদের বাড়িতে সকালে যে ভদ্রলোক এসেছিলেন, তিনি তো দেখলাম তুই অঙ্ক নিয়ে পড়ছিস শুনেই বললেন, শুভঙ্করের বংশ বলে কথা, অঙ্ক নিয়ে তো পড়তেই হবে।”

প্রতিম লজ্জা পেল। সঙ্কোচ কাটাতে পায়ের সামনে পড়ে থাকা একটা মাটির ঢেলা পা দিয়ে সজোরে ঠেলল। ঢেলাটা কিছুটা শূন্যে উঠল, তারপর পাক খেতে খেতে হারিয়ে গেল বুনো ঝোপের মধ্যে।

প্রতিম প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে। গ্রামবাসীরা ওকে বিশাল কিছু ভাবে, ওই বনগাঁয়ে শিয়ালরাজা হলে যা হয় আর কী! অচ্যুতের কাছে ও নেহাতই চুনোপুঁটি। অনার্স পড়তে পড়তে এর মধ্যেই অচ্যুতের জ্যামিতির ওপর দুটো গবেষণাপত্র ছাপা হয়েছে বিদেশের জার্নালে। একবার তো বিদেশের এক সেমিনারে পেপার প্রেজেন্ট করতেও গিয়েছিল।

ওর সামনে নিজের প্রশংসা শুনলে লজ্জা লাগে বৈ কী! কিন্তু তা তো আর ওর গ্রামের লোকেরা বুঝবে না।

তবে কিনা নম্বরটাই সব নয়। ভাল নম্বর পাক না পাক, প্রতিম অঙ্ক বিষয়টাকে বড় ভালবাসে। ওর ইচ্ছে হয় সারাদিন অঙ্ক নিয়ে থাকতে।

মেসের ঘুপচি ঘরে একচিলতে তক্তপোশটায় বাবু হয়ে বসে ও যখন অঙ্ক করে, মনে হয় ভেতর থেকে কে যেন উৎসাহ দিচ্ছে তাকে। বলছে, আরও এগিয়ে যাও। সফল তুমি হবেই।

ও তখন বাতিল কাগজে হিজিবিজি কষে। ঘড়ির কাঁটা কখন ঘুরে যায়, ওর হুঁশই থাকে না।

শুধু অঙ্ক করার সময়ে নয়, ঘুমের মধ্যেও বহুবার ও স্বপ্ন দেখেছে হঠাৎ করেই যেন কোন দুরূহ গাণিতিক সমস্যার সমাধান করে ফেলছে। আর স্বীকৃতি বা পুরস্কারের আনন্দের চেয়েও সেই সমাধান করে ফেলার তৃপ্তি ঠিকরে বেরোচ্ছে ওর চোখমুখ দিয়ে।

”ওসব বাদ দে তো! কানুজ্যাঠা একটু বেশি বেশি বলেন।” প্রতিম কথা ঘোরানোর চেষ্টা করে। চারপাশে তাকিয়ে ভীতুগলায় বলে, ”ভাই আমার কিন্তু বেশ ভয় করছে এবার। এখনই বিকেল সাড়ে চারটে। নভেম্বর মাসের বিকেল। ঝুপ করে সন্ধে নেমে যাবে। তখন কী বিপদে পড়ব বল তো!”

অচ্যুত তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, ”বিপদ আবার কী! বিষ্ণুপুর ঘুরতে এসেছি, আর এত কাছে এমন সুন্দর জয়পুরের জঙ্গল, একটু ঘুরে যাব না?”

”আরে ঘুরব না কেন! ঘুরতেই তো এসেছি। কিন্তু ঘোরার তো কথা ছিল বিষ্ণুপুরের মন্দিরগুলো। সেখান থেকে তো এই জঙ্গলে আসার কথা ছিল না অচ্যুত! তার ওপর তুই ঘুরতে ঘুরতে পিচের রাস্তা ছেড়ে এতটা ভেতরে চলে এলি। কিছু বিপদ হলে তোর বাবা-মা তো আমাকেই বকবেন।” প্রতিম ভার গলায় বলে।

অচ্যুত এবার বিরক্ত হয়, ”ক্লাস ফাইভের বাচ্চাদের মত কথা বলিস না তো! বকাবকির কী আছে? কলকাতায় ফিরেই তো আবার কলেজে ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। তখন আর নিঃশ্বাস ফেলারও সময় পাব না। থোড় বড়ি খাড়া সেই একঘেয়ে জীবন।”

প্রতিম চুপ করে গেল। এই কথাটা অচ্যুত অবশ্য ঠিকই বলেছে। কলকাতায় ফিরলেই সেই বৈচিত্র্যহীন রুটিনে ঢুকে পড়তে হবে ওদের।

ওরা দুজনেই অঙ্ক অনার্স নিয়ে পড়ছে। এটাই ফাইনাল ইয়ার। আর অচ্যুত তো কলেজের গর্ব। আগের দুটো বছরই শুধু যে কলেজের মধ্যে ও প্রথম হয়েছে তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়েও সেরা হয়েছিল। তাই, ফাইনাল ইয়ারে সেই গৌরব থেকে কিছুতেই ও নিজেকে বঞ্চিত করতে চাইবে না। কলকাতায় ফিরেই কঠোর পরিশ্রমে ডুবিয়ে দেবে নিজেকে।

মাঝে মাঝে প্রতিমের ভাবলে অবাক লাগে যে, অচ্যুতের মত মেধাবী ঝাঁ চকচকে ছেলের সঙ্গে ওর এতটা বন্ধুত্ব কী করে হল। ওদের দুজনের মধ্যে সব দিকে মিলের চেয়ে অমিল এতটাই বেশি যে এটা ওদের বন্ধুমহলের কাছেও বিস্ময়ের ব্যাপার।

কিন্তু তবু ওদের বন্ধুত্ব হয়েছে। আর এই তিন বছরে সেটা এতটাই গাঢ় হয়েছে যে এখন ওরা হরিহর আত্মা বললেও অত্যুক্তি হয় না।

অচ্যুত উচ্চবিত্ত পরিবারের একমাত্র সন্তান এবং বরাবর অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র, পড়ে কলকাতার সেরা কলেজে। আর সেখানে প্রতিম খুবই সাধারণ পরিবারের ছেলে। তার ওপর নেহাতই মধ্যমেধার ছাত্র। উচ্চমাধ্যমিকে ওর নম্বরও ছিল গড়পড়তা, তবু একরকম জোর করেই ও অঙ্ক অনার্স পড়বে ঠিক করেছিল। ভাল নম্বর পেয়ে ঝকঝকে কেরিয়ার গড়বে সেই আশায় নয়, শুধুই অঙ্ককে ভালবেসে, অঙ্ককে আরও গভীরভাবে জানতে।

প্রতিমের বাড়ি এই বাঁকুড়া জেলারই কুণ্ডপুষ্করিণী বলে একটা গ্রামে। চাইলে বাঁকুড়ার কোন কলেজে ও পড়তেই পারত। কিন্তু ভাল টিউশন পাওয়ার জন্য ও তখন ধনুরভাঙা পণ করেছিল যে কলকাতায় থেকেই পড়বে। কলকাতা শহরে স্বাভাবিকভাবেই কোন ভাল কলেজে ওর জায়গা হয়নি, ভর্তি হতে হয়েছিল শহরতলির এক সাধারণ কলেজে। মেস ভাড়া নিয়েছিল শিয়ালদা ষ্টেশনের কাছে।

আর তারপরেই এক নামজাদা প্রোফেসরের বাড়িতে অনার্সের টিউশন পড়তে গিয়ে ওর আলাপ হয়েছিল অচ্যুতের সঙ্গে। অজস্র অমিল থাকলেও একটা বিষয়ে ওদের মিল ছিল দেখার মত। সেটা হল, অঙ্কের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা।

অচ্যুতের নম্বর দুরন্ত, সে তো অঙ্কে দারুণ হবেই। কিন্তু নম্বর খুব বেশি না পেলেও অঙ্কের প্রতি প্রতিমের অনুরাগ ছিল চিরকালীন। আর কেন জানেনা, সিলেবাসের বদলে বাইরের অঙ্ক, জটিল কোন প্রবলেম সমাধান করতে ও দারুণ ভালবাসে।

আর এই ব্যাপারেই দুই বন্ধুর মধ্যে খুব মিলে গিয়েছিল। পাঠ্যক্রমের বাইরেও দুজনে দেশবিদেশের নানা অঙ্কের সমস্যা, যেগুলোর এখনও কেউ কোন সমাধান বের করতে পারেনি, তাই নিয়ে মেতে থাকত। অচ্যুত নিজের বইপত্র নিয়ে চলে যেত প্রতিমের মেসে, সেখানে দুজনে অঙ্কে বুঁদ হয়ে যেত।

এই করতে করতে চুম্বকের বিপরীত মেরুদুটোর আকর্ষণের মতই ওদের বন্ধুত্বও দিনদিন গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠেছে। কখনও ওরা মেতে থাকে মিলেনিয়াম প্রাইজ প্রবলেম নিয়ে। গোটা পৃথিবীতে সাতটা এমন অঙ্ক রয়েছে, যেগুলো আজ পর্যন্ত কেউ সমাধান করতে পারেনি। পারলেই তার জন্য রয়েছে অবিশ্বাস্য অঙ্কের পুরস্কার। আবার কখনও সারাদিন রাত কাবার করে মিলেনিয়াম বাক প্রবলেম নামের বারোটা অঙ্ক নিয়ে। এই বারোটা অঙ্কের সমাধানও এখনও পর্যন্ত অধরা।

সদ্য কৈশোর পার করে ওরা দুজনেই পা দিয়েছে তারুণ্যে, এইসময় উৎসাহ, উদ্দীপনা সবই থাকে তুঙ্গে। হিসাব, যুক্তির ধার না মেনে অত্যুৎসাহী মন চায় আকাশ ছুঁতে। সাবধানে পা ফেলার চেয়ে এবড়োখেবড়ো পথ চলাতেই হয় আনন্দ। ওদেরও তাই হয়েছে। বিশ্বের কিংবদন্তী গণিতজ্ঞরা যা পারেননি, ওরা এই বয়সেই দুম করে তার সমাধান করে ফেলবে, এই অলীক আশাতেই দুজনে বিভোর হয়ে থাকে। ভাবে এভাবেই একদিন জিতে যাবে অঙ্কের জন্য বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার—আবেল প্রাইজ বা ফিল্ডস মেডেল।

তাই এবারে থার্ড ইয়ারের ক্লাস শুরু হওয়ার পরেই কয়েকদিনের ছুটিতে প্রতিম যখন বাড়ি আসছিল, অচ্যুতও ওর সঙ্গে চলে এসেছে। বন্ধুর বাড়ি ঘোরাও হবে, একসঙ্গে অঙ্ক করাও হবে। প্রতিম আপত্তি করেনি। দুজনের আর্থিক বৈষম্য থাকলেও অচ্যুত যে অমন নয়, তা সে জানে।

প্রতিমের বাড়ি থেকে মন্দিরনগরী বিষ্ণুপুর ঘন্টাদেড়েকের রাস্তা। আজ সকালে দুই বন্ধু ঘুরতে এসেছিল এদিকে। প্রতিম গাইডের ভূমিকা নিয়েছিল। ছোটবেলা থেকে সে অজস্রবার এসেছে বিষ্ণুপুর। এখানকার টেরাকোটার মন্দিরগুলোর ইতিহাস, ভাস্কর্য সম্পর্কে বিশদে বোঝাচ্ছিল অচ্যুতকে।

তারপরই অচ্যুতের যে কী খেয়াল চাপল, জোর করে চলে এল বিষ্ণুপুর থেকে আধঘন্টা দূরের এই জঙ্গলে। এসেও ওর শান্তি হল না, জঙ্গলের এতটা ভেতরে চলে এল।

প্রতিম নিজে এদিককার ছেলে বলে ভাল করেই জানে, এই জঙ্গলের কিছু অংশ অত্যন্ত গভীর। শাল, পলাশ, কুসুম, নিমগাছ ছাড়াও ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র অজানা গাছ। এখনও এখানে এমন কিছু কিছু জায়গা আছে যেখানে সূর্যের আলোও ঠিকমত প্রবেশ করতে পারে না। আর হাতি থেকে শুরু করে চিতল হরিণ, বাঁদর কী নেই এখানে! রয়েছে বিচিত্র প্রজাতির অসংখ্য পাখিও।

যতদূর পর্যন্ত পর্যটকরা আসে, সেই সীমানা ওরা অনেকক্ষণ আগেই পেরিয়ে এসেছে। বন্য প্রাণীদের জল খেতে আসা দেখার ওয়াচ টাওয়ার, ফরেস্ট ডিভিশনের অফিস, রিসর্ট কিংবা বহু বছর আগে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তৈরি পরিত্যক্ত বিমানবন্দরের রানওয়ে এসব ফেলে ওরা ঢুকে এসেছে গভীর অরণ্যে।

এখন ওদের আশপাশে আদিম প্রকৃতি ছাড়া আর কিছুই নেই। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দূরে দেখা যাচ্ছে প্রাচীন কোন প্রাচীরের ভগ্নাবশেষ। কখনও চলার পথে পড়ছে বন্য ডোবা, কখনও ওদের চোখের সামনে দিয়েই রুদ্ধশ্বাসে ছুটে পালাচ্ছে বেজির মত কোন সরীসৃপ।

এই পড়ন্ত বিকেলে জঙ্গলের এতটা গভীরে এইভাবে দুজন হেঁটে চলাটা যে শুধু ভয়ের তাই নয়, অত্যন্ত বিপজ্জনক।

তবু অচ্যুতের যেন কোন হুঁশ নেই। অতি উৎসাহে মোহাবিষ্ট হয়ে ও হেঁটে চলেছে। হাতে নিয়েছে একটা গাছের মরা শুকনো ডাল, সেই ডাল দিয়ে চারপাশের বুক পর্যন্ত বুনো ঘাসের স্পর্শ ঠেকাতে ঠেকাতে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। বাধ্য হয়ে প্রতিমকেও পিছু পিছু চলতে হচ্ছে।

মাথার ওপর আকাশ দেখা যাচ্ছে না। দৈত্যের মত অতিকায় গাছগুলো আকাশ ঢেকে দাঁড়িয়ে রয়েছে যেন অনন্তকাল ধরে। অনেক উঁচুতে সেই গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ভেসে আসছে সূর্যের নরম আলো। আশপাশে ঝিঁঝিঁ পোকার মত এক জাতীয় পোকার গুঞ্জন ক্রমশই বেড়ে চলেছে।

”কীরে বল না।” অচ্যুত আবার তাড়া দিল, ”হু ওয়্যাজ মিঃ শুভঙ্কর?”

”শুভঙ্কর রায় ছিলেন আমার পূর্বপুরুষ। অনেকে ভাবে তাঁর পদবী দাস, কিন্তু তা ভুল।” প্রতিম বলল, ”এই যে বিষ্ণুপুরের মন্দিরগুলো দেখে এলি, সেগুলো সব বানানো হয়েছিল মল্লরাজাদের আমলে। এই অঞ্চলে মল্ল রাজারা প্রায় হাজার বছর শাসন করেছিলেন। তো, পঞ্চান্নতম মল্লরাজ গোপাল সিংহদেবের সময় শুভঙ্কর রায় ছিলেন তাঁর ভূমিরাজস্ব সচিব।”

একটা অপেক্ষাকৃত ফাঁকা জায়গা দেখে অচ্যুত এবার একটা গাছের তলায় বসে পড়ল। পকেট থেকে দুটো চ্যুইং গাম বের করে একটা প্রতিমের দিকে ছুঁড়ে দিল। অন্যটা মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে বলল, ”তো ওঁর সঙ্গে অঙ্কের রিলেশনটা কী? উনি কি পার্ট টাইমে অঙ্কের টিউশনি করতেন? নাকি রাজাকে অঙ্ক শেখাতেন?”

”ইয়ার্কি মারিস না তো!” প্রতিম ওর পাশে হাত পা ছড়িয়ে এবার বসে পড়ল, ”শুভঙ্কর রায় ছিলেন সেইসময়কার নামকরা গণিতজ্ঞ। উনি জন্মেছিলেন ১৬৭২ সালে। জন্মের পরই তাঁর বাবা অনন্ত রায় মারা যেতে তাঁর এক ধনী আত্মীয় তাঁকে তখনকার বিখ্যাত পণ্ডিত ভৃগুরাম দাশের কাছে পড়তে পাঠান। সেখানে শুভঙ্কর আর্যভট্ট, ব্রহ্মগুপ্ত, ভাস্করাচার্য, লীলাবতীর লেখা প্রাচীন সমস্ত গণিতশাস্ত্র পড়ে মহাপণ্ডিত হন। পরে নিজের যোগ্যতায় রাজদরবারের সচিব পদে ওঠেন। তখন দিল্লীর মসনদে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব। মল্লরাজারা শাসক হলেও তরফদার, জায়গিরদার, কটকিনাদার এদেরই সব গ্রামেগঞ্জে ছিল বাড়বাড়ন্ত।”

”তরফদার, জায়গিরদার বুঝলাম, কোটকি না কী, সেটা আবার কী?” অচ্যুত বাধা দিয়ে বলল।

 ”তরফের মালিক ছিল তরফদার। আর তিন-চারটে তরফ যার থাকত, তাকে বলা হত কটকিনাদার। এরা সবাই জমিজায়গা নিয়ে অনেক অত্যাচার চালাত।” প্রতিম বলল, ”এদিকে সাধারণ মানুষ তো তখন শুধু জানত কৃষিকাজ। তারা না বুঝত জমিজমার হিসেব, না বুঝত টাকাকড়ি নিয়ে অঙ্কের জটিল মারপ্যাঁচ। তাই তারা সবদিক থেকেই ঠকত। তাঁদের বাঁচাতে শুভঙ্কর রায় তখন জটিল সমস্ত হিসেব সহজ ছড়ার আকারে বানিয়েছিলেন। তখন তো আর ক্যালকুলেটর ছিল না, মানুষকে বাজারহাটে জটিল হিসেব মুখে মুখে করতে হত। তাকে বলতো মানসাঙ্ক। এই মানসাঙ্কের সঙ্গে জিনিসের দাম, জমির হিসেব, ভূমিরাজস্বের সব কঠিন অঙ্ক মিলিয়ে শুভঙ্কর রায় এমনভাবে ছড়া লিখেছিলেন, যে অশিক্ষিত মানুষও সেই ছড়া দিয়ে নির্ভুলভাবে হিসেব করে ফেলতে পারত। এগুলোকে বলতো শুভঙ্করীর আর্যা। তারপর থেকে প্রায় আড়াইশো বছর বাংলার ঘরে বাইরে শুভঙ্করীর আর্যা লোকে ব্যবহার করেছে। বুঝলি?”

অচ্যুত মন দিয়ে শুনছিল। প্রতিম থামতেই বলে উঠল, ”কীরকম ছিল এই শুভঙ্করীর আর্যা?”

”তখন তো অন্যরকম সব হিসেব ছিল। মণ, ছটাক, পোয়া এইসব। এদের মধ্যে নানারকম হিসেব কষার ছড়া। যেমন ধর।” প্রতিম বলল,

”ছটাকের দাম যদি জানিবারে চাও।

আধ পোয়ার দামের অর্ধেক মনে ধরি লাও।।”

”ইন্টারেস্টিং!” অচ্যুত গোল গোল চোখে বলল, ”এ তো আমাদের ফর্মুলার মত রে।”

প্রতিম মাথা নেড়ে বলল, ”একদমই তাই। আরেকটা যেমন বাজারহাটে হিসেবের জন্য লিখেছিলেন,

মণ প্রতি যত টঙ্কা হইবেক দর।

আড়াই সেরের দাম তত আনা ধর।।

আনা প্রতি পাঁচ কড়া সিকি প্রতি পাই।

গণ্ডা প্রতি এক কাক মনে রাখ ভাই।।

কড়া প্রতি ধরিতে হইবেক পঞ্চতিল।

শুভঙ্কর রায় কহে এই মত মিল।।

অচ্যুত বলল, ”ওয়ান্ডারফুল! অঙ্ক, আবার কবিতাও।”

প্রতিম বলল, ”ঐকিক নিয়মও উনিই মানুষের মধ্যে সহজসরল করে ছড়ায় শেখান জানিস তো? কেশব নাগের যে ওই বিখ্যাত তেলমাখানো বাঁশে বাঁদর চড়ার অঙ্কটা আছে না? ওটার মূল ভাবনাও কিন্তু শুভঙ্করীর আর্যা থেকেই নেওয়া।”

অচ্যুত বলল, ”কীরকম বল একবার শুনি?”

”দাঁড়া, ছোটবেলায় বাবার মুখে এটা শুনেছিলাম, অতটা মনে নেই।” প্রতিম থেমে থেমে বলতে লাগল,

ত্রিশ হাত উচ্চ বৃক্ষ ছিল এক স্থানে

চূড়ায় উঠিবে এক কীট করে মনে।

দিবাভাগে দশ হাত উঠিতে লাগিল

নিশাযোগে অষ্টহাত নিচেতে নামিল

না পায় যাবত চূড়া করে সে অটন

কতদিনে উঠেছিল করো নিরুপণ!”

”আরিব্বাস!” অচ্যুত বলল, ”পুরো সত্যেন দত্তের মত ছন্দ মেলাতেন ভদ্রলোক।”

প্রতিম এবার হাসল, ” উনি যে শুধুই ছন্দ মিলিয়ে আর্যা লিখে গিয়েছেন তা কিন্তু নয়। শুভঙ্কর রায় উচ্চতর গণিতের ওপর অনেক গবেষণাও করেছিলেন।”

”তাই?” অচ্যুত যত শুনছিল তত বিস্মিত হচ্ছিল, ”কীসের ওপর ছিল সেই গবেষণা?”

প্রতিম বিষণ্ণমুখে মাথা নাড়ল, ”তা আর জানা যায় না। শুভঙ্কর রায় ছিলেন খুব অন্তর্মুখী, নিজের কাজ নিয়ে থাকতে ভালবাসতেন। তাঁর সেই গবেষণাপত্র রাখা ছিল বিষ্ণুপুর রাজবাড়ির মহাফেজখানায়। রাজা গোপাল সিংহদেব সেটাকে ছাপাবেন ভেবেছিলেন।”

”ভেবেও ছাপালেন না কেন?”

 ”সেই সুযোগই পাননি। তার আগেই যে বর্গীরা বিষ্ণুপুর আক্রমণ করে। সেটা ১৭৪৪ সাল। মারাঠা দস্যু ভাস্কর পণ্ডিত আর তার দলবল ছারখার করে দেয় প্রায় গোটা বাংলা। সেই সময়ে শুভঙ্কর রায় সহ অনেক পারিষদের ওপরে বর্গীরা অতর্কিতে হামলা চালায়। শুভঙ্কর রায় প্রাণভয়ে নাকি আশ্রয় নেন রাজধানীসংলগ্ন এক জঙ্গলে।”

”তারপর?”

”সেখানেই সম্ভবত ওঁকে হত্যা করা হয়।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল প্রতিম।

”ইশ! কী লোকের কী পরিণাম!” অচ্যুত মুখ দিয়ে আফসোসের শব্দ করল, ”আর্কিমিডিসের মত। মূর্খ রোমান সৈন্যরা কিছু না জেনেই ওঁকে মেরে ফেলেছিল। শুভঙ্কর রায়ও তাই।”

প্রতিম বলল, ”তার কিছুবছর পর বিষ্ণুপুরের রাজা হন চৈতন্যসিংহদেব। তাঁর খুড়তুতো ভাই দামোদর সিংহদেব তাঁর বিরুদ্ধে মুর্শিদাবাদের নবাব মীর জাফরের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেন। পরে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আদালতে মামলায় হেরে গেলে সেই রাগে দামোদর সিংহদেব ওই মহাফেজখানায় আগুন লাগিয়ে দেন। অন্য অনেককিছুর সঙ্গে গবেষণাপত্রটাও পুড়ে ছাই হয়ে যায়।”

”মাই গুডনেস! কীভাবে মানুষ হিংসার বশে বিজ্ঞানের গতি পিছিয়ে দেয় ভাব!” অচ্যুত হতাশ গলায় বলল।

”হ্যাঁ। তবে এত ভাল কাজের অনেক অপভ্রংশও ঘটেছিল পরবর্তীকালে। শুভঙ্করী আর্যাকে বিকৃত করে ভেতরে গোঁজামিল ঢুকিয়ে অনেক ভুলভাল ছড়াও বের করা হয়, মানুষকে ঠকাতে। তাই বাংলায় ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ নামে একটা প্রবাদও আছে।” প্রতিম বলল।

”হুম।” অচ্যুত মাথা দুলিয়ে বলল, ”তবে এখন বুঝতে পারছি, তোর অঙ্কের প্রতি এত আগ্রহ কেন। যার জিনে এইরকম জিনিয়াস একজন ম্যাথমেটিশিয়ান রয়েছেন, সে তো অঙ্কপাগল হবেই!”

প্রতিম হেসে ফেলল, ”ধুর! কার সঙ্গে কার তুলনা। তুই হাসালি।”

পরক্ষণেই ও উপলব্ধি করল, এরমধ্যেই ঝুপ করে যেন রাত নেমে এসেছে জঙ্গলে। হঠাৎ করেই যেন সামান্য দূরত্বে বসে থাকা অচ্যুত অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে ওর কাছে।

ও চমকে উঠে বলল, ”অ্যাই অচ্যুত, চারপাশ তো পুরো অন্ধকার হয়ে গেছে রে!”

সত্যিই তো। দুই বন্ধু কথায় কথায় খেয়ালই করেনি। আশপাশে সামান্য হলেও যে আলো ছিল, তা কখন যেন ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে, ঘন কালো মেঘের মত অন্ধকার এখন জমা হয়েছে চারপাশে। পোকার ডাকের মাত্রা বেড়ে গিয়েছে, সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও কিছু অজানা প্রাণীর শব্দধ্বনি। তাপমাত্রাও যেন নেমে গিয়েছে অনেকটা, শীত শীত করতে শুরু করেছে দুজনেরই।

অচ্যুত এবার সাদামুখে প্রতিমের দিকে তাকায়। এত কাছে বসেও প্রতিমকে ও তেমন দেখতে পায় না। মুহূর্তে মোবাইলের আলো জ্বালায়, শুকনো মুখে বলে, ”কী হবে প্রতিম?”

প্রতিম কিছুক্ষণের জন্য আতঙ্কে ভয়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। অচ্যুতের কথায় বাস্তবে ফিরে এসে ও চিৎকার করে উঠল, ”তোকে কখন থেকে বলছিলাম আমি ফেরার জন্য? এখন কী হবে? এই গভীর জঙ্গলে কী করব আমরা?”

যতই বড়দের মত হাবভাব করুক, বয়সটা দুজনেরই কুড়ির কোঠায়। তাই উদ্বেগে, অজানা বিপদের আশঙ্কায় দুজনেই এই ঠাণ্ডাতেও দরদর করে ঘামতে লাগল।

”ওই?” অচ্যুত ভয়ে প্রতিমের হাতটা আঁকড়ে ধরল, ”এই জঙ্গলে বাঘ আছে রে?”

”না। বাঘ নেই।” প্রতিম ফিসফিস করে বলল, ”কিন্তু হাতি আছে, বুনো শুয়োর আছে। বুনো শুয়োরেরা দল বেঁধে থাকে। সামনে পড়লে পেট ফুটো করে দেবে।”

অচ্যুতের গলা কাঁপতে থাকে, ”কী হবে রে তাহলে?”

প্রতিম এমনিতে নরমসরম, অচ্যুতই হইহুল্লোড় করে বেশি।

কিন্তু বিপদে পড়লে অচ্যুত নার্ভাস হয়ে যায়, প্রতিম বরং মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারে। মোবাইল ফোনে সময় দেখে ও বলল, ”ছ’টা বাজে। ফরেস্ট রেঞ্জারের অফিস অবধি গেলে কাউকে পেয়ে যাব। তারপর তেমন হলে ওখানেই রাতটা কাটিয়ে দিতে পারব। চল, আগে রেঞ্জারের অফিস অবধি পৌঁছই। এখানে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কোন মানে নেই।”

চারপাশের মন মাতাল করা মহুয়ার গন্ধের মধ্যে ওরা দুজন দুরুদুরু বক্ষে হাঁটতে শুরু করল। আচমকা আসা এই বিপদের জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। অচ্যুত নিজের ফোনের আলো জ্বেলে প্রতিমের হাত শক্ত করে ধরে পা ফেলছিল। দূর থেকে আচমকা কোন অজানা শব্দে বুকের ভেতরটা ভয়ে হিম হয়ে আসছিল মাঝে মাঝেই, পরক্ষণেই সে নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছিল, আর তো একটুখানি। কয়েক পা হাঁটলেই রেঞ্জারের অফিস!

কিন্তু না।

অদৃষ্ট যেদিন প্রতিকূলে থাকে, সেদিন নিয়তি এভাবেই পরিহাস করে। ঘড়ির কাঁটা সাত পেরিয়ে আট, আট পেরিয়ে নয়ের দিকে চলতে লাগল, কিন্তু ফরেস্ট রেঞ্জার অফিসের সেই আলো ওরা কিছুতেই দেখতে পেল না।

ওদিকে অচ্যুতের ফোন আগেই চার্জের অভাবে দেহ রেখেছে, প্রতিমের ফোনের ব্যাটারিও পিঁ পিঁ শব্দে জানান দিচ্ছে নিজের অন্তিম দশা। জিপিএসের সাহায্যে লোকেশন দেখার চেষ্টা করেও কোন লাভ হয়নি, এই গহীন বনে নেটওয়ার্কই নেই।

অচ্যুত ক্রমশ তার স্নায়ুর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিল। প্রচণ্ড ভয়ে মনে হচ্ছিল ওর শরীরের প্রতিটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে, এখুনি এলিয়ে পড়বে মাটিতে। দুর্বল কণ্ঠে ও বলল, ”কী হচ্ছে বল তো?”

 ”এত ঘন জঙ্গল তো, তার ওপর গভীর রাত, আমরা তো এমনিই চিনি না রাস্তা। সব দিকই মনে হচ্ছে একরকম।” বিড়বিড় করল প্রতিম, ”মনে হচ্ছে আমরা পথ হারিয়েছি।”

”কী বলছিস তুই!” অচ্যুতের গলাটা এবার কেঁপে গেল।

”ঠিকই বলছি।” প্রতিম চাপা গলায় বলল, ”তোর সাময়িক হঠকারিতার জন্য এই অবস্থা হল। কী করব এখন?”

অচ্যুতের উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা নেই। সে জন্মাবধি শহরে মানুষ, সবুজ বনের সৌন্দর্য দিনের আলোয় দেখে তাই সে মুগ্ধ হয়েছিল, কিন্তু সেই সৌন্দর্যই যে একটু ভুলে রাতের নিকষ কালো অন্ধকারে এমন ভয়াল রূপ নেবে তা ও কল্পনাও করতে পারেনি।

পারিপার্শ্বিক সব কিছু ভুলে ওর কান্না পাচ্ছিল। প্রচণ্ড ভয়ে অবসন্ন হয়ে আসছিল শরীর। অদ্ভুত সব শব্দে ওর কানে তালা লেগে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, ও মরে যাচ্ছে। কোনভাবেই আর বাবা-মা’কে দেখতে পাবে না। ঝাঁকে ঝাঁকে ধেয়ে আসা মশাগুলোকে অন্ধকারে ও এলোপাথাড়ি মারার চেষ্টা করছিল।

বনে পা লেগে সামান্য খচখচ শব্দে কেঁপে উঠছিল ওর বুক, মনে হচ্ছিল বন্য কোন আদিম জন্তু বুঝি চুপিসাড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। নিঃসাড়ে অপেক্ষা করছে অতর্কিতে হামলা করার।

তখন থেকে প্রতিম বারণ করছিল, কেন যে ওর কথায় গুরুত্ব দেয়নি, তাই ভেবে আফসোসে পুড়ে যাচ্ছিল ওর মন।

ক্রমশই ওর গলা শুকিয়ে আসছে, কাঁপা কাঁপা গলায় ও যেন কী বলতে যাচ্ছিল ফিসফিসিয়ে, এমন সময় প্রতিম বলল, ”চুপ! একদম চুপ কর!”

অচ্যুত ঠাণ্ডা বরফের মত জমে গেল।

প্রতিম আবার বলল, ”কেউ একটা আসছে। শুনতে পাচ্ছিস? শুনতে পাচ্ছিস পায়ের শব্দ?”

অচ্যুতের বুকের ভেতর কেউ যেন নির্দয়ভাবে হাতুড়ি পিটছিল। তবু তারই মধ্যে ও কান খাড়া করল।

না। কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছে না ও। বলল, ”না তো!”

”ভাল করে শোন।” নিশুতি রাতে প্রতিম কেমন যেন অচেনা গলায় বলে, ”এদিকে এগিয়ে আসছে কেউ একজন।

অচ্যুতের শরীরের হাড়গুলো যেন কাঁপতে থাকে ভয়ে, প্রচণ্ড শিহরণে ওকে আবারও জানান দেয়, না, কোন পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে না ও।

প্রতিম হয়ত পুরোটাই কল্পনা করছে, গাছের পাতায় ঘষাঘষির শব্দ, বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজকে ভাবছে কারুর পায়ের আওয়াজ!

 অচ্যুত বন্ধুকে আঁকড়ে ধরে সেকথা বলতে যাবে, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে একটা আশ্চর্য কাণ্ড হল।

প্রতিম যন্ত্রমানবের মত হঠাৎ সটান পেছনদিকে ফিরল, তারপর হাঁটতে উদ্যত হল। হাঁটা শুরুর আগে হ্যাঁচকা টান দিল অচ্যুতের হাতে।

”কী হল? ওটা তো উল্টো দিক! ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস? আরও ভেতরে চলে যাব তো?” অচ্যুত আন্দাজে চেপে ধরল প্রতিমকে।

কিন্তু প্রতিম পরোয়া করল না।

মন্ত্রমুগ্ধের মত চলতে শুরু করল পেছনদিকে, সঙ্গে নিয়ে চলল অচ্যুতকে।

অদ্ভুত যান্ত্রিক সেই গতি!

বনবাদার, গাছপালা, কিচ্ছু খেয়াল করছিল না ও, নিশির ডাকে মানুষ যেমন ঘুমন্ত অবস্থায় হেঁটে চলে, তেমনভাবেই এগিয়ে চলেছিল, সঙ্গে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে নিয়ে যাচ্ছিল অচ্যুতকে।

অন্ধকারে গাছের ডালে অচ্যুতের পা কেটে দরদর করে রক্ত পড়ছিল, ও প্রথমে চাপা গলায়, পরে চিৎকার করে বলতে লাগল, ”কি হয়েছে তোর প্রতিম? এমন করছিস কেন? এভাবে অন্ধকারে কেউ ছোটে?”

কিন্তু প্রতিমের কোন হুঁশ নেই।

রুদ্ধশ্বাসে সে ছুটে চলেছে কোন এক অশরীরী আলেয়ার পেছনে।

অচ্যুতের বারংবার চিৎকারে ও শুধু মোহাবিষ্টের মত বলল, ”আহ! শুনতে পাচ্ছিস না? ওই যে, ওই যে এবার ডানদিকে বেঁকতে বলছে? এই যে, এই যে এবার বাঁ দিকে ঘুরেই চার পা হেঁটে চলতে হবে সোজা!”

”কে বলছে? কোথায় বলছে?” অচ্যুত পাগলের মত চিৎকার করে উঠল। নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে ছাড়িয়ে নিতে চাইল প্রতিমের বজ্রমুঠি। রেহাই পেতে চাইল সাক্ষাত মৃত্যুর হাত থেকে।

কিন্তু পারল না। লোহার করাতের মত প্রতিমের হাত যেন চেপে বসেছে ওর হাতে।

জোর করলে যেন হাড়গোড় গুঁড়ো হয়ে যাবে।

প্রতিমের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। জ্বোরো রুগীর মত কাঁপতে কাঁপতে সে ছুটছিল। আর ঘুম ঘুম গলায় বিড়বিড় করে বকে চলেছিল, ”ওই যে! ওই যে ছড়া করে বলে চলেছে! শুনতে পাচ্ছিস না?

”ডাইনে হাঁটো আট পা পূবে রেখে পলাশ।

কম পথ কম শ্বাস, নাই কোন অবকাশ।।

এবার সোজা তেত্রিশ পা উত্তরে যাও ধেয়ে।

তেকোনা বনে আজ আলো গিয়াছে মিলায়ে।।

শুভঙ্কর রায় কহে শুন জনগণ।

ইহাকে বুঝিলে হয় বুদ্ধি বিচক্ষণ।।”

অচ্যুত আর পারল না। ছড়ার শেষ বাক্যটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করামাত্র একটা হিমস্রোত নেমে গেল ওর মেরুদণ্ড বেয়ে।

প্রচণ্ড ভয়ে আতঙ্কে জ্ঞান হারাতে হারাতে ও উপলব্ধি করল, সামনে যেন মহাপ্রলয় শুরু হয়েছে। তোলপাড় হচ্ছে অতিকায় গাছগুলোতে, আগুন লেগে গিয়েছে গোটা বনে।

আর সেই আলোতে সামনে ধীরে ধীরে প্রকট হচ্ছে দৈত্যসমান একটা কালো মিশমিশে ছায়া।

প্রতিমের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। সে তখনো নিরন্তর সেই ছড়া শুনতে শুনতে ছুটে চলেছে আগুনে ঝাঁপ দেওয়া পাখির মত।

ক্রমবর্ধমান সেই দীর্ঘদেহী অশরীরী ছায়াকে দেখতে দেখতে অচ্যুত জ্ঞান হারাল।

* * *

অচ্যুতের জ্ঞান যখন ফিরল, তখন ঘরময় খটখটে আলো।

চারপাশ পুকুরের নিস্তরঙ্গ জলের মতই শান্ত। যে বিছানায় ওকে শুইয়ে রাখা হয়েছে, তার এককোণে এসে পড়ছে নরম রোদ। বাইরে পাখীর কূজন কানে এসে পৌঁছচ্ছে।

ধীরে ধীরে উঠে বসতে যেতেই ও অনুভব করল, গায়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণা। মাথাও ভার হয়ে রয়েছে ভীষণ।

বিছানার সামনে রাখা চেয়ারে বসে চা খাচ্ছিল একটা খাকি উর্দির লোক।

ওকে উঠতে দেখে বাজখাঁই গলায় বাইরের ঘরের দিকে কাউকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, ”ওই যে, আরেক নবাবপুত্তুরের ঘুম ভেঙেছে। সুখলাল, যা তো। স্যারকে খবর দে।”

লোকটা অচ্যুতকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল, ”তা মাঝরাতে জঙ্গলের মধ্যে ঘুরছিলে কী গুপ্তধন খুঁজতে?”

অচ্যুত কিছু বুঝতে পারল না।

লোকটা আবার বলল, ”কপালে আয়ু ছিল তাই বেঁচে গেলে। কাল সারারাত হাতির দল দাপাদাপি করেছে জঙ্গলে। সামনে পড়লে এতক্ষণে মর্গের ঘরে শুয়ে থাকতে।”

অচ্যুত এবারও চুপ করে রইল।

লোকটা গজগজ করতে করতে উঠে বাইরে চলে গেল। আর তখনই পাশের বিছানায় ও প্রতিমকে দেখতে পেল।

প্রতিমেরও মাথায় ব্যান্ডেজ, কপালে কালশিটে। চুপচাপ তাকিয়ে রয়েছে দেওয়ালের দিকে।

অচ্যুত বলল, ”কীরে!”

প্রতিম যেন ভাবতে ভাবতে দূরে কোথাও চলে গিয়েছিল। ওর ডাকে চমক ভেঙ্গে এদিকে তাকাল। ওর চোখে খেলা করছে এক অদ্ভুত বিষাদ।

ক্ষীণগলায় বলল, ”আমরা যেখানটায় ঘুরে মরছিলাম কাল রাতে, হাতিদের একটা দল সেই জায়গাটাকে আজ পুরো মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে জানিস!”

”শুনলাম তাই!”

প্রতিম একটু থেমে বলল, ”শুভঙ্কর রায় আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে অচ্যুত! গোটা সময়টা শুধু কানের পাশে অদ্ভুত এক গলায় ছড়া শুনে গিয়েছি। কেমন ঘোরে চলে গিয়েছিলাম শুনতে শুনতে। খালি ছড়া শুনছিলাম, আর সেইমত চলছিলাম। কীভাবে যে ফরেস্ট রেঞ্জারের এই অফিস পর্যন্ত তোকে নিয়ে এসে পৌঁছেছি, নিজেই জানি না।”

অচ্যুত উত্তর দিল না। ওর মাথা প্রতিমের চেয়ে বরাবরই পরিষ্কার, কাল জ্ঞান হারানোর আগেই যে ছড়াটা প্রতিমের মুখে ও শুনতে পেয়েছিল, তাতে ও তখনই বুঝে গিয়েছিল, যুক্তির চোখে যত অসম্ভব যত অলীকই হোক না কেন, কোন এক অজ্ঞাত শক্তিতে মৃত্যুর সাড়ে তিনশো বছর পর ওদের সমূহ বিপদ থেকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন মল্লভূমির কিংবদন্তী গণিতজ্ঞ শুভঙ্কর রায়।

তিনি যেন ভীষণ এক প্রতিজ্ঞা করেছেন, যেভাবেই হোক, রক্ষা করবেন নিজের নিজের বংশধরকে।

তাঁকে সম্ভবত এই জঙ্গলেই হত্যা করেছিল বর্গীরা। হাতিরা যে একটু পরেই গোটা অঞ্চলটা তছনছ করবে তা জেনেই বোধ হয় শুভঙ্কর রায়ের আত্মা নিজের রক্তের টানে ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছিল ওই গভীর অরণ্যের মাঝে।

প্রাণপণ চেষ্টায় বাঁচাতে চাইছিল নিজের উত্তরসুরীকে।

আর রক্তের জোরেই বোধ হয় একমাত্র প্রতিমই শুনতে পাচ্ছিল সেই অপার্থিব দিকনির্দেশ!

কিন্তু অচ্যুত ভাবছিল অন্য কথা। অস্ফুটস্বরে ও বলল, ”আচ্ছা, কাল তুই একদম শেষে যে ছড়াটা বলেছিলি, সেটা মনে আছে তোর?”

প্রতিম দুর্বলভাবে দুপাশে মাথা নাড়ল, ”আমার আর কিছুই মনে নেই, কী বলেছি, কী করেছি। কিচ্ছু না। ভাবলেই মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।”

অচ্যুত মনে মনে কী যেন হিসেব করছিল। বিড়বিড় করতে করতে বলল, ”কম পথ কম শ্বাস, নাই কোন অবকাশ! মানে সবচেয়ে কম দূরত্ব সবচেয়ে কম সময়ে অতিক্রম করে গন্তব্যে পৌঁছনো। অঙ্কের ভাষায় অপটিমাইজেশন প্রবলেম!”

প্রতিম কিছুই বুঝতে না পেরে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইল।

অচ্যুত বলল, ”বুঝতে পারছিস না? পরের লাইনটা ছিল, তেকোনা বনে আজ আলো গিয়াছে মিলায়ে। মানে জঙ্গলের আকার তিনকোণা।”

প্রতিমকে এখনো হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে অচ্যুত বলল, ”আমেরিকান গণিতজ্ঞ রিচার্ড বেলম্যানের সেই প্রবলেমটা মনে পড়ছে না তোর? লস্ট ইন অ্যা ফরেস্ট প্রবলেম? ট্রেনে আসতে আসতেই তো আলোচনা করছিলাম। কেউ একটা জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গেলে সেই জঙ্গলের আকার ও আয়তন জানা থাকলে সবচেয়ে কম সময়ে ন্যূনতম দূরত্ব অতিক্রম করে সে কীভাবে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারবে? ১৯৫৫ সালে রিচার্ড বেলম্যান এই প্রশ্নটা তুলেছিলেন। ইউক্লিড জ্যামিতির প্রবলেম।”

প্রতিম এবার বিস্ফারিত চোখে বলল, ”এটা তো বিশ্বের যে বারোখানা মিলিয়ন বাক প্রবলেম এখনো সমাধান করা যায়নি, তার একটা!”

”একেবারেই তাই! আধুনিক পৃথিবীতে এখনও কেউ এর সমাধানসূত্র বের করতে পারেনি।” অচ্যুত একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, ”অথচ ভারতবর্ষের এই প্রত্যন্ত গ্রামে বসে অসম্ভব প্রতিভাবান শুভঙ্কর রায় আজ থেকে সাড়ে তিনশো বছর আগে শুধু যে এর সমাধান বের করেছিলেন তাই নয়, কাল তাঁর ওই সমাধানের জন্যই আমরা প্রাণে বেঁচেছি।”

”মানে?”

”মানে আবার কী? তাঁর সেই সমাধানসূত্র ধরেই তো কাল আমরা বেরিয়ে এসেছি গভীর বন থেকে।”

প্রতিম কিছুক্ষণ বাক্যহারা হয়ে গেল।

তারপর বলল, ”মহাফেজখানায় সেই আগুনে ছাই হওয়া গবেষণাপত্রে তার মানে এত বড় আবিষ্কার ছিল!”

”আরও কী কী মণিমুক্তো ছিল তা তো আর জানার উপায় নেই প্রতিম!” অচ্যুত মাথা নাড়ল, ”অকালে আমরা যে কত বড় প্রতিভা হারিয়েছি, তা ভাবা যায় না।”

”ঈশ! ছড়াটা শুনতে পেলাম, কিন্তু সমাধান বের করার সেই পদ্ধতিটা তো জানলাম না অচ্যুত!” প্রতিমের গলা থরথর করে কাঁপছিল।

”দরকার নেই তো।” অচ্যুত কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।

তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে এসে প্রিয়বন্ধুর হাত ধরল, ”সেটা বের করবি তুই।”

”আমি?”

”হ্যাঁ। শুভঙ্কর রায়ের যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে তুই-ই বেলম্যানের সেই লস্ট ইন দ্য ফরেস্ট প্রবলেমটা সলভ করবি। বন্ধু হিসেবে আমি এইটুকুই চাই। হয়ত শুভঙ্কর রায় নিজেও তাই চান! তাই তো আমাদের প্রাণে বাঁচালেন, কিন্তু সমাধানে ফাঁকি দিলেন। যাতে তোর নাম সমাধান করার পর পৌঁছে যায় বিশ্বের কাছে।”

”কিন্তু, কিন্তু আমি কী পারব?” দুর্বল কণ্ঠে বলল প্রতিম।

”অবশ্যই পারবি।” দৃঢ় ভাবে বলল অচ্যুত, ”তোর রক্তে যে বইছেন শুভঙ্কর রায়। তুই পারবি না তো কে পারবে প্রতিম?”

প্রতিম ছলছলে চোখে বন্ধুর হাত জড়িয়ে ধরল।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে ও উপলব্ধি করল, কেউ ফিসফিসিয়ে সরু হাওয়ার মত ওর কানে কানে যেন বলল, ”পাশে আছি। এগিয়ে যাও।”

প্রবল আত্মবিশ্বাসে প্রতিম চোখ বুজে ফেলল।  

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *