শুনঃশেফ
আমার নাম যতি। জ্যোতি নয়। যতি। বর্গীয় জ আর অন্তঃস্থ য-এর মধ্যেকার এই তফাতটা আমার জীবনে খুব গুরত্বপূর্ণ। কেন যে এই তফাত তা নিয়ে খুব অল্প বয়সেই আমার মধ্যে একটা আবছা কৌতূহলের জন্ম হয়েছিল। আমার সঙ্গে আমাদের ক্লাসে আরেক জ্যোতি পড়ত। সে বর্গীয় জয়ের জ্যোতি। মাস্টারমশাইরা দুজনকে তফাত করবার জন্যে আমাকে ডাকতেন ওয়াইতি। অবিকৃত জ্যোতি নামের সম্মান আমার সহপাঠীই পেত। এবং তাই নিয়ে একটু বড়ো হতে না হতেই সে কলার তুলতে শুরু করে। আরেক দল মাস্টারমশাই ছিলেন, তাঁরা আবার বলতেন, জ্যোতি দা ব্রাইট আর যতি দা ডার্ক। স্কুলে পড়ার ওই বয়সে যখন ঠ্যাং সবে বেখাপ্পা রকমের লম্বা হতে শুরু করেছে, গাল খসখস করছে, কপালে গালে দু চারটে ব্রণ উঁকিঝুঁকি মারছে, সেই লজ্জাকর, মুখচোরা সময়ে যতি দা ডার্ক কিংবা ওয়াইতি ডাক আমাকে যে কী ভয়ানক আত্মগ্লানির কটাহে নিক্ষেপ করত তা একমাত্র আমিই জানি। মাস্টারমশাইরা একজনও আমায় পছন্দ করতেন না। প্রাণপণে পড়া মুখস্থ করলেও না। অঙ্ক সব মিলে গেলেও না। হাতের লেখা ভালো করেছিলুম অনেক অভ্যেস করে করে, কিন্তু তাতেও তাঁদের অপছন্দের নিরেট দেয়াল ভেদ করতে পারিনি। কিন্তু অভয়পদ স্যারের যেন আমার ওপর একটা বিজাতীয় ঘৃণা ছিল। কেমন একটা আক্রোশ কাজ করত ওঁর আমার প্রতি সব ব্যবহারের পেছনে। উনি পড়া জিজ্ঞেস করবেন বলে বিশেষ করে ওঁর ক্লাসের পড়া ভালো করে তৈরি করে যেতুম। ভেতরের সমস্ত কাঁপুনি সংযত করে সঠিক, সুন্দর উত্তর দিচ্ছি, উনি মাঝপথে থামিয়ে দিতে ছড়া কেটে উঠতেন, আতা গাছে তোতা পাখি, ডালিম ডাছে মৌ। ক্লাসে ইতস্তত হাসি শুরু হত। আমি লজ্জায়, ক্ষোভে বেগনি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতুম।
এই অভয়পদবাবু একদিন সু-মেজাজে থাকায় এবং বাইরে তুমুল বৃষ্টি হওয়ায় ক্লাসে গল্পগুজব হচ্ছিল, হঠাৎ উনি বললেন, একটা থট-রিডিং-এর ম্যাজিক দেখবি? যতি দা ডার্ক, ওঠো বাবা! আমি উঠে দাঁড়াতে কিছুক্ষণ শ্যেন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ডান হাতের দুটো আঙুল মুখের সামনে ঘোরাতে লাগলেন, তারপরে বললেন, যতি দা ডার্কের তো দেখছি তিন তিনটে দিদি আছে! সত্যি? সত্যি? আশেপাশে সবাই আমায় জিজ্ঞেস করতে লাগল। আমি কথা বলতে পারছিলুম না, ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলে বসে পড়েছিলুম। আমি থাকি শিকদার বাগান লেনে। অভয়পদবাবু আসতেন বরানগর থেকে, আমাদের বাড়ির কারও সঙ্গেই কোনো সম্পর্ক ছিল না। থাকবার কথা নয়। তবু অভয়পদবাবু কী করে আমার তিন দিদির কথা জানলেন? ধূর্ত চোখে আমার দিকে চেয়ে ছিলেন অভয়পদবাবু। যেন আমার তিন দিদি থাকা ব্যাপারটা খুব দূষণীয়। প্রায় অশ্লীল। ব্রণ ওঠার মতোই অশ্লীল। তখন অভয়পদবাবু প্রত্যেকটি শব্দ চেটেপুটে খেতে খেতে বলছেন, এই যতেটা না জন্মালেও কোনো ক্ষেতি ছিল না। এই ধরনের ছেলেপুলেরাই বাপ-মায়ের চক্ষুশূল হয়ে থাকে। অভয়পদবাবু এই চূড়ান্ত ঘোষণাটি করবার পর টিফিনের ঘন্টা পড়ে গেল। মনে হল সহপাঠীরা ঘৃণা এবং ভয়ের দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইতে চাইতে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমায় শিরদাঁড়া দিয়ে হিমের স্রোত, গলা শুকিয়ে কাঠ, হাত পা কাঁপছে, কোনোক্রমে নিজের বইখাতা ব্যাগে ভরে সবার শেষে ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে অনুভব করলুম—আমার শুধু বাবা-মা কেন, একজন বন্ধুও নেই। এই বিশাল জগতে আমি একদম একা।
টিফিনের পয়সায় সেদিন কিছু খেলুম না। আইসক্রিম কেনবার ছল করে স্কুলগেটের বাইরে বেরিয়ে এলুম। তারপর এদিক ওদিক দেখে বড়ো রাস্তা পার হয়ে দেশবন্ধু পার্কের দিকে হাঁটা দিলুম।
দুপুরবেলাটায় দেশবন্ধু পার্ক ফাঁকা-ফাঁকা থাকে। আমায় একটা প্রিয় কলকে ফুলের গাছ ছিল, গাছটার তলায় বসে হাঁটুর ওপর মাথা রেখে প্রথমটায় খানিকটা গরম চোখের জল বেরিয়ে যেতে দিলুম। তারপর প্রতিজ্ঞা করলুম আর স্কুলে যাব না। বাড়ির থেকেও নিজেকে আস্তে আস্তে মুক্ত করে নেব। সত্যিই তো, আমি যে বাবা-মার চক্ষুশূল এ বিষয়ে কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তিরই সন্দেহ থাকতে পারে না। বাবা অত্যন্ত রাশভারী, কড়া প্রকৃতির মানুষ। এতদিন ভাবতুম অনেক বড়ো, প্রায় বুড়ো বলেই বাবা আমায় সঙ্গে কথা বলেন না, এখন বুঝতে পারছি তা নয়, আসলে চক্ষুশূল, আমি চক্ষুশূল। চোখ বুজে মনে করবার চেষ্টা করলেই দেখতে পাচ্ছি ওই তো বাবা দাদাকে ডেকে কি বললেন, ওই তো দিদির সঙ্গে, মেজদির সঙ্গে, ওই তো এমন–কি ছোড়দির সঙ্গেও বাবা কথা বলছেন।
কই দিনের পর দিন যায়, বাবা সোজাসুজি, মুখোমুখি আমার সঙ্গে তো কথা বলেন না। বড়ো জোর—পড়াশোনা কেমন হচ্ছে? কিংবা কোথায় চললে? আর মা? মা আমাকে দিনের মধ্যে সাতবার দোকানে পাঠায়। এই হারুর দোকান থেকে একটু গরম মশলা নিয়ে আয় এই আবার দৌড়ে যা তো যতি, তোর বাবার দই আনাতে ভুলে গেছি। এক ঘন্টাও যাবে না, লান্ট্রি থেকে দাদার শার্ট প্যান্ট আনতে হবে। অমনি একপাতা সেফটিপিন, ভুলুর জন্যে একটা পেনসিল, ফরমাশের আর শেষ নেই। যে অনুপাতে মা আমাকে খাটায় সেই অনুপাতে আবদার রাখে কি? রাখে না। বিশ্বকর্মার সময়ে ঘুড়ির লাটাই-মাঞ্জার পয়সা মাপা মাপা। দোলের সময়ে পেতলের পিচকিরি আজও হল না। একটা ভালো ক্রিকেটব্যাট মা আজও দিচ্ছে, কালও দিচ্ছে। নেমন্তন্ন বাড়িতে যাবার সময়ে সর্বদা সঙ্গে যাবে ভুলু, মায়ের কোলপোঁছা। আমার অবশ্য নেমন্তন্ন যেতে একটুও ভালো লাগে না। কিন্তু ভোজের দিকটাও তো আছে! মাকে কোনোদিন বলতে শুনিনি, যতি আজ আমার সঙ্গে চল।
সেইদিন থেকে আমি স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলুম। ঠিক সময়মতো খেয়ে দেয়ে, স্কুলব্যাগ পিঠে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই। তারপরে কোনোদিন দেশবন্ধু পার্ক, কোনোদিন গড়ের মাঠ। কোনোদিন গঙ্গার ধার চলে যাই। কিন্তু ভীষণ দীর্ঘ সময়। কাটতে চায় না। লোকেরা কীরকম সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে চায়। আমার মনে হয় যে যেখানে আছে সবাই বুঝতে পারছে আমি স্কুল পালিয়েছি। সবচেয়ে মুশকিল হয় বইয়ের ব্যাগটা নিয়ে, ওইটা দেখলেই লোকে ধরে ফেলে আমি স্কুলের ছেলে। সেই জন্যে কোথাও বসার চেয়ে আমায় মনে হয় হাঁটাই ভালো। হাঁটতে হাঁটতে বহুদূর চলে যাই। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যাল, রেস কোর্স, খিদিরপুর, চিড়িয়াখানা। চিড়িয়াখানার ভেতরে ঢুকে সময়টা বেশ কেটে যায়। বাঘের গায়ে কটা ভোরা, সিংহী কটা হাই তুলল, ভালুক কতবার দাঁড়াল, কতবার পড়ে গেল, ভোঁদড় যখন মাছ ধরে ডাঙায় ওঠে, মাছটা কীভাবে মুখের মধ্যে ঝটপট করে এইসব দেখতুম কেমন অন্যমনস্ক হয়ে।
একাধিকবার মুশকিলেও পড়লুম। চিড়িয়াখানায় মন দিয়ে শিম্পাঞ্জির খিচুনি দেখছি, পিঠের ওপর একটা ভারী হাত পড়ল, যতি না? মুখ ফিরিয়ে অস্পষ্টভাবে চিনতে পারলুম ভদ্রলোককে। বাবার কেমন ভাই হন। বিজয়ার পর সপরিবারে আসেন বছরে একবার।—স্কুল থেকে এসেছ? নিজেই সমাধান করে দিলেন সমস্যার। আমি তাড়াতাড়ি বললুম হ্যাঁ। কোথায় আর সব ছেলেরা? টিচার? আমি বললুম ওইদিকে আছে। দেখো আবার, হারিয়ে যেয়ো না। বাবার ভাই এগিয়ে যান। আরেক দিন পাঁচ নম্বর বাসে চড়েছি, লেকের দিকে যাব। লেডিজ সিট থেকে এক ভদ্রমহিলা ডেকে বললেন, এই যতি, যতি, জায়গা খালি হচ্ছে এইখানে বোসো। আমি দূর থেকেই যথাসম্ভব হাত নেড়ে বোঝালুম আমি বেশ আছি। ভদ্রমহিলা আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন। আমি ওঁকে চিনতে পারছি না, কিন্তু উনি আমাকে ঠিকই চিনেছেন। দূর থেকে বিশেষ কিছু বলতে পারছেন না, কিন্তু ওঁর খুব সন্দেহ হয়েছে। এখন দুপুর একটা, আমার পিঠে স্কুল ব্যাগ। এই ব্যাগটাই হয়েছে আমার কাল। যতটা পারি ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে বাবার চেষ্টা করি, তারপর স্টপ আসতেই নেমে পড়ি। সামনে যে গলি পাই, তারই মধ্যে ঢুকে পড়ি, ইশ ভুল হয়ে গেছে, ভদ্রমহিলা প্যাঁট প্যাঁট করে দেখছেন। রাস্তা পার হয়ে উলটো দিকের গলিতে ঢোকা উচিত ছিল। অনেকটা সময় গলিটার মধ্যে ঘোরাঘুরি করে যেই বেরিয়েছি, দেখি ভদ্রমহিলা রাস্তার ওদিক থেকে আসছেন হনহন করে। আমার চোখে চোখ পড়ে গেল। চোখ পাকিয়ে বললেন, একদম নড়বে না, পালাবে না। কাছে এসে একটা হাত পাকড়ে ধরে বললেন, তুমি রমলাদির ছেলে যতি না? আমাকে চিনতে পারছ না? সুপ্রভাত কাকা … রথীন … আমি বললুম, আপনাকে আমি চিনি না। আপনি কে আমি জানি না। আমার নাম যতি নয়।
যতি নয়? তাহলে তখন যতি বলে ডাকতেই বাসের মধ্যে সাড়া দিলে যে!
আমার নাম ব্ৰতী। আমি শুনেছি ব্রতী।
তাহলে আমাকে দেখে বাস থেকে নেমে পড়লে কেন? এই গলির মধ্যে ঢুকেছিলে কেন? লুকোবার জন্যে নয়?
আমি বললুম, আমি একটা ঠিকানা খুঁজছি। খুব দরকার। আমার বাবার খুব অসুখ, মা পাঠিয়েছে, এক জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ি। তাই …।
মিথ্যে কথা বলা হচ্ছে? বাবার অসুখ? মা পাঠিয়েছে? কী নাম তোমার বাবার?
গা-ভরতি ঘৃণা নিয়ে আমি উচ্চারণ করলুম, অভয়পদ মজুমদার। এত চট করে বললুম যে ভদ্রমহিলা থতিয়ে গেলেন। বললেন, কী ঠিকানা খুঁজছ? তোমাকে একেবারে রমলাদির ছেলে যতির মতো দেখতে। না, যতি এতটা কালো নয়, এত রোগাও নয়।
যাক কী ঠিকানা যেন খুঁজছিলে?
আমি বললুম, পঁচিশের এক বকুলবাগান রো না রোড গুলিয়ে ফেলেছি, বাড়িটা দেখলেই আমি চিনতে পারব।
ভদ্রমহিলা বললেন, কিছু মনে কোরো না। আমায় এক আত্মীয়ার ছেলের সঙ্গে তোমার খুব মিল। যাও তোমার দেরি করিয়ে দিলুম। আমারও দেরি হয়ে গেল।
হাতঘড়ির দিকে একবার চেয়ে উনি আবার বাস স্টপে গিয়ে দাঁড়ালেন, আমি বকুলবাগানের মধ্যে সেঁধিয়ে যেতে থাকলুম।
সারা কলকাতা, দক্ষিণেশ্বর থেকে লেক কালীবাড়ি পর্যন্ত ঘুরে বেড়াতুম। কিন্তু পথও আমায় টানত না। কোনো কিছুকেই আমার বিন্দুমাত্র আকর্ষণীয় বলে মনে হত না। এই সমস্ত বাড়ি ঘর ইট-কাঠের দৈত্য সব, গলি রাস্তা, মোড় অজানা এক জনহীন গ্রহের। জনহীন। এত মানুষ বাসে ঝুলতে ঝুলতে যাচ্ছে, ফুটপাতে ভিড় করে যাচ্ছে, দোকানবাজার গমগম করছে কিন্তু আমায় মনে হত কেউ নেই। কেউ কোথাও নেই। যেন সিনেমা দেখছি। টিকিটের পয়সা জমিয়ে জমিয়ে এক এক দিন কোনো হলে ঢুকে পড়তুম। সারাদিন ঘোরা, খাওয়াদাওয়া নেই, পর্দার হট্টগোল কান ফাটিয়ে দিত, তুমুল নাচ-গানের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমার কোমর, উরু সব ব্যথা করত, রক্ত অস্বস্তিকর রকমের গরম হয়ে উঠত, সস্তার সিট, চারপাশ থেকে অশ্রাব্য খিস্তি, সিটি বেজে উঠছে, পর্দার নাচিয়ে মেয়েটির পেটের দিকে আঙুল দেখিয়ে পাশের সিটের লোক বলত, কী খোকা পছন্দ হয়? জবাব না দিলে ছাড়ত না। ইস্কুল পালিয়ে তো দেখতে এসেছ, পছন্দটা বলতে দোষ কী, আমার সঙ্গে মেলে কিনা দেখতুম। বলে লোকটা খা খা করে হাসত। পান গুণ্ডি খাওয়া কালো মাড়ি কালো দাঁত দেখা যেত। আমার ভেতরটা গুলিয়ে উঠত। ইনটারভ্যালের সময়ে উঠে পড়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিতুম। হেঁটে হেঁটে সময় ভরানো। কোনো কোনো দিন সময়ের ঠিক রাখতে পারতুম না। হা-ক্লান্ত হয়ে আগে আগেই বাড়ি ফিরতুম। মা বলত—কী রে! আজ সকাল-সকাল ছুটি হয়ে গেল?
বললুম, হ্যাঁ, একজন টিচার মারা গেছেন।
কোন টিচার রে! আহা! ছেলে মেয়ে আছে!
গম্ভীরভাবে বলতুম, পুরোনো টিচার। আমি ঠিক চিনি না।
একদিন খুব দেরি হয়ে গেছে, পা টিপে টিপে বাড়ি ঢুকছি, নীচের দালানে মৃদু আলো জ্বলছে। সিঁড়ির ওপর থেকে একটা খুব জোরালো নারীকণ্ঠ ভেসে এলো। কেমন চেনা-চেনা।
না রমলাদি, তোমার যতিকে আজ আর দেখা হল না। বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে। আসলে কী জানো, পাঁচ নম্বর বাসে ক মাস আগে একটা যতির মতো ছেলেকে দেখলুম। পিঠে ব্যাগ। আমি যতি, যতি কোথায় যাচ্ছ বলে ডাকতে নেমে বকুলবাগানের মধ্যে ঢুকে গেল। তো আমিও নেমে ছেলেটাকে পাকড়েছি। কী ভুল দেখো। ছেলেটার নাম ব্রতী। বাবার হঠাৎ স্ট্রোক হয়েছে। জ্যাঠার বাড়িতে খবর দিতে এসেছে। বরানগরে থাকে, স্কুলের টাইমে এসেছে বকুলবাগান। তা ছেলেটাকে ছেড়ে দিলুম। কিন্তু তারপর মনে হল স্কুলের ব্যাগ কেন পিঠে? আর ধরতে পারলুম না। সেই থেকে মনটা খচখচ করছে।
ভদ্রমহিলা সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। আমি তৎক্ষণাৎ দালানের অপর প্রান্তে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে উঠোন, উঠোনের ওদিকে কলতলা, তার মধ্যে।
মিনিট দশেক পরে আস্তে আস্তে বেরিয়ে ওপরে উঠছি, মা রান্নাঘরের থেকে বেরিয়ে বলল, কী রে যতি, আজ এত দেরি যে? উঃ আমি আর বানাতে পারি না, পারি না।
ড্রিল সার ডিটেন রেখেছিলেন, যা মুখে আসে তাই বললুম।
ডিটেন রেখেছিলেন? কেন? মার ভুরু কুঁচকে উঠল।
ড্রিল পারিনি, তাই।
ড্রিল কি মুখস্থ করা যায় যে না পারলে ডিটেন করবে? আস্পদ্দা তো কম নয়! মা বিরক্ত মুখে গজগজ করতে করতে ভেতরে ঢুকে গেল। দোতলায় উঠতে মেজদি বলল, হ্যাঁরে যতি, স্কুল থেকে ফিরেই কলঘরে ঢুকেছিলি কেন রে?
বাথরুম পেয়ে গিয়েছিল।
মেজদি বলল, দিদি দেখেছিস যতিটা কী ভীষণ কালো আর রোগা হয়ে গেছে?
দিদি বলল, তাই তো বুলু, ঠিক বলেছিস তো! হ্যাঁরে যতি, আজকাল তো আমার কাছে সংস্কৃত দেখাতে আসিস না! দাদার কাছে অঙ্ক-ইংরিজি দেখাতে তো দেখি না?
আমি উত্তর দিচ্ছি না দেখে দিদি এগিয়ে এসে আমাকে ঝাঁকানি দিল কী রে, কথা বলছিস না যে? এ কী? তোর হাতগুলো কী ময়লা রে? কী নোংরা তুই, ছি। ছি।
মা নীচে থেকে ডাকল, যতি, জলখাবার খেয়ে যা! লুচি ভাজার গন্ধ আসছিল। আমি সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই দিদি বলল, সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে খেতে বসবি যতি। খেতে বসে কিন্তু আমায় বমি পেতে লাগল। কোনোক্রমে একটা লুচি গলাধঃকরণ করে আমি উঠে পড়লুম। মা অবাক হয়ে বলল, তোর জন্যে টাটকা ভেজে তুললুম, না খেয়ে উঠছিস যে! আমারই ঝকমারি হয়েছিল দেখছি …
ভালো লাগছে না—কোনোমতে বলে আবার সিঁড়ি দিয়ে উঠছি, দেখি দুই দিদি তখনও সিঁড়ির মাথায় গুলতানি করছে। আমাকে উঠতে দেখে দিদি কী যেন বলতে বলতে আমার দিকে এগিয়ে এল। আর আমার ভেতর থেকে কতদিনের ঘেন্না, কষ্ট, রাগ, দুঃখ, খালি পেটে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরার অনিয়ম, সমস্ত হড়হড় করে বমি হয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল। ভীষণ কষ্টে আমি সিঁড়ি টপকে নীচে পড়তে থাকলুম। প্রচণ্ড লাগল মাথায়, তারপর সব কালো।
মাথাটা পরিষ্কার হতে চোখ মেলে দেখি অনেক জোড়া চোখ আমার ওপর। মাথার যেখানটায় লাগছে সেখানে ঠান্ডা কিছু চেপে ধরেছে কেউ। চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দিচ্ছে কেউ। চোখ মেলতে দেখে মা আতঙ্কিত গলায় বলল, যতি, যতি, ও যতি, বমি করে অমন অজ্ঞান হয়ে গেলি কেন? খুব লেগেছে মাথায়? গা টা গরম গরম লাগছে। কখন থেকে শরীর খারাপ হল?
মা একটানা বকেই যাচ্ছে, বকেই যাচ্ছে। দিদি বলল, মা, ওকে এখন কথা বলিয়ো না। দাঁড়াও ওর জামা-টামাগুলো পালটে দিই। কী বিশ্রী গন্ধ বেরচ্ছে। বুলু বালতি করে জল নিয়ে আয় তো? আমার নড়াচড়া করার ক্ষমতা নেই। কথা বলবার চেষ্টা করলেও বলতে পারছি না। শরীরটা যেন কাঠের মতো শক্ত। আমি দেখতে পাচ্ছি বমিতে মাখামাখি কাঠের মতো আমার শরীরটা মেঝেতে পড়ে আছে। সেটাকে ঘিরে মা আর দুই দিদি। মেজদি জল নিয়ে এল, খোসা ছাড়াবার মতো করে জামাকাপড় ছাড়িয়ে নিচ্ছে দিদিরা, মুখটা কাত করে ভালো করে গামছা ভিজিয়ে ধুয়ে দিচ্ছে মুখ। আমার চোখ দুটো কড়িকাঠের দিকে চেয়ে আছে। গায়ে পাউডার দিয়ে দিল মেজদি। কোমরের ওপর চাদর চাপা দিয়ে দিদি আমার প্যান্ট খুলে নিল। পাজামা পরিয়ে দিল। পায়ের পাতাগুলো ঘষে ঘষে মুছিয়ে দিচ্ছে। কী বিশ্রী দেখতে আমাকে। ঠিক একটা পোড়া কাঠের টুকরোর মতো। কানগুলো মস্ত বড়ো বড়ো, লতপত করছে। মাথার পেছনের চুল খাড়া খাড়া। ঠোঁটের ওপর মুখের কালি যেন গাঢ় হয়েছে। এমন স্পষ্টভাবে নিজেকে আমি কী করে দেখতে পাচ্ছি? চোখের ওপর একটা আয়না ধরা আছে নাকি? তারপর দেখলুম মা ভয়ার্ত গলায় বলছে, বুলু, ডাক্তার ডাক, ও ওরকম কড়িকাঠের দিকে চেয়ে রয়েছে কেন? ও সাড়া দিচ্ছে না কেন? যতি, ও যতি। আমি তখন বললুম, মা যতি মানে কী, আমার নাম যতি কেন? তোমরা সবাই কেন আমার ওপর এত বিরূপ? কেন, আমি কী করেছি মা? দেখতে পেলুম মা আমাকে ঝাঁকাচ্ছে আর কাঁদছে, যতি, যতি রে, অমন করে চেয়ে আছিস কেন? আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস না? বুঝতে পারলুম মা আমার কথা আদৌ শুনতে পায়নি। তখন আমার খেয়াল হল আমি মাকে কথাগুলো বললুম রাস্তার দিকের জানলার কাছ থেকে, যদিও আমার কাঠের মতো শরীরটা পড়ে আছে দরজার কাছে মেঝেয়। দুই দিদি আর মা শরীরটাকে অনেক কষ্টে তুলে তক্তাপোশে শোয়ালে। দিদি বলল, মা কেঁদো না, পড়ে গিয়ে এরকম হয়েছে। কী যে মুশকিল, দাদার এখনও পাত্তা নেই। বাবা কখন আসবে কে জানে, বুলু তুই ও বাড়ি থেকে টুলটুলকে ডেকে নিয়ে ডাক্তারবাবুর কাছে যা। মেজদি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, টুলটুলকে আর ডাকবার সময় নেই, আমি যাচ্ছি। মেজদি এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। জানলার কাছ থেকে আমি আমার চোখ দুটোকে প্রাণপণে বুজিয়ে চেষ্টা করতে লাগলুম, মা ভীষণ ভয় পাচ্ছে। ক্রমাগত কাঁদছে আর দুর্বল গলায় বলে যাচ্ছে, যতি, যতি রে। আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস না! কী হবে এখন, শীলা, কী হবে? দিদি ক্রমাগত আমার শক্ত হাতে পায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর বলছে, মা চুপ করো, কাঁদছ কেন, অসুখবিসুখ মানুষের হয় না?
আস্তে আস্তে জানলার কাছেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ খেয়াল হল ঘরে বাবা, ভুলু, দাদা, ডাক্তারবাবু, পেছনে ছোড়দি, মেজদি। ডাক্তারবাবু আমায় নাড়ি দেখছেন, বাবার পরনে এখনও কোর্টের পোশাক। বাবা আমার পায়ের কাছে বসেছেন। পা দুটো নিজের কোলে তুলে নিয়েছেন। আমি শুনতে পাচ্ছি—বাবা তারস্বরে বলে চলেছেন, নারায়ণ নারায়ণ, দুর্গে দুর্গতিনাশিনী, এ কী বিপদ মা! বাবার ঠোঁট নড়ছে কি নড়ছে না। জানলার ধার থেকে এখন আমি ঘরের মাঝখান অবধি সরে এসেছি।
কী রকম দেখলেন অবিনাশদা?
আরে প্রেশার ভীষণ লো। একটা ফিটের মতো হয়েছে মনে হচ্ছে। ইঞ্জেকশন দিচ্ছি একটা।
খাটের পাশে দাঁড়িয়ে আছি আমি। একটু হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারব কান্নায় ভিজে মুখ মাকে। চোখ ছলছল করছে দিদির এতক্ষণ একলা একলা সমস্ত দায়িত্ব বহন করে। মেজদি উদ্বেগে বুকে আছে, ভুলু ভয়ের চোটে মুখে একটা আঙুল পুরে দাঁড়িয়ে রয়েছে খাটের মাথার দিকে। বাবা। অনেক দূরের মানুষ এখনও, যতির পা কোলে করে জপ করে চলেছেন? দাদা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, মুখ শুকনো। আমি প্রত্যেককে ছুঁয়ে ছুঁয়ে জিজ্ঞেস করলুম, আমার নাম যতি কেন? যতি মানে বিরতি, ক্ষান্তি। বড়ো বিরক্ত হলে মানুষ তবে ক্ষান্তি চায়। বাবা মা আমি তোমাদের ভীষণ বিরক্ত করেছি, উত্ত্যক্ত করেছি, আমার হাত থেকে তোমরা মুক্তি চাও আমি জানি। এই তো তোমাদের কত আদরের বড়ো ছেলে রয়েছে গোপাল। শান্ত, সৌম্য মুখ চোখে সোনালি চশমা। তোমাদের সাধ পূর্ণ করতে কত জলপানি পায়, কত বড়ো বড়ো বই পড়ে, কত জানে। ওই তো তোমাদের বড্ড আদরের বড়ো মেয়ে শীলা, কী সুন্দর ফর্সা। ঠিক মায়ের চেহারা পেয়েছে বলে সবাই। বি. এ পাশ করে গেল গত বছর। যতি কোনোদিনও পারবে না। তোমাদের মেজ মেয়ে বুলু, বাড়ির আরেক ছেলের মতো, সব দিকে নজর আছে, সে-ও কত যত্নের। বিকেলবেলা মা যখন তিন মেয়ের চুল বেঁধে দেয়, তখন বোঝা যায় কত যত্নের, কত ভালোবাসার মেয়ে সব। চমৎকার গান করে, বড়ো বড়ো বই পড়ে, ভালো ভালো পাস করে। আর সব থেকে ছোটো ভুলু, ও তো আদরের দুলাল। সব সময়ে মায়ের পায়ে পায়ে, মায়ের কোলপোঁছা, কোলেরটি। এই চাঁদের হাটে যতি? ক্ষ্যামা দাও মা, বড়ো ঘেন্না, মুখে ব্রণ, বারো বছরেই গোঁফ উঠছে। কাঠি কাঠি পা, কোনো কিছু মাথায় যেতে চায় না, ভালো লাগে না কিছু, আমি আর স্কুলে যাব না। শরীরের যন্ত্রগুলোর মধ্যে দিয়ে শিরশিরে হাওয়ার মতো শব্দগুলো ফিসফিস করে বেরোল।
বাবা বললেন, অবিনাশদা, ও কিছু বলল?
ডাক্তারবাবু ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করলেন, যতি, কিছু বলছ?
আমি পাঠাচ্ছি আমার বার্তা, আমার শরীর সেটা কিছুতেই ধরতে পারছে না।
ডাক্তারবাবু বললেন, ও শুধু গোঙাচ্ছে। তিনি ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ বার করলেন।
দিদিরা বলে আমি নাকি বুভুক্ষুর মতো ঘুমিয়েছিলুম, একটা হা-ঘুম, যো-ঘুম মানুষের মতো। একবারও নড়িনি, একবারও পাশ ফিরিনি। কী করে নড়বো? আসলে আমি তো কড়িকাঠের কাছে। ঘরে মৃদু সবুজ আলো জ্বলছে। মা আমাকে ছুঁয়ে শুয়েছিল। বাবা অন্য ঘর থেকে মাঝে মাঝে এসে দাঁড়াচ্ছিলেন। বেশ খানিকক্ষণ ধরে আমার বুকের ওঠা-পড়া দেখে মাকে জিজ্ঞেস করছিলেন, কী গো? কী বুঝছ? ও ঘুমোচ্ছে না অজ্ঞান হয়ে আছে!
মা বলছিল কাঁদো-কাঁদো গলায়, আমি তো সেটাই বুঝতে পারছি না। শীলু, তোর কী মনে হচ্ছে?
ও ঘুমোচ্ছে মা, ডাক্তারবাবু ইনজেকশন দিয়ে গেলেন না?
তারই এফেক্ট বলছিস? বাবা যেন হাঁফ ছেড়ে বললে।
তা ছাড়া কী? তুমি শুতে যাও।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল না। দুপুরেও না। বিকেলে যখন পশ্চিমের জানলা দিয়ে রাঙা রাঙা রোদ ঘরের মেঝেয় এসে পড়েছে তখন আমার ঘুম ভাঙল। ঠিক সেই সময়টায় ঘরে কেউ ছিল না। আমি জেগে উঠে বুঝতে পারিনি ওটা বিকেল। ওপর থেকে দেখলুম একটা শূন্য ঘরে তক্তাপোশের বিছানার ওপর যতি শুয়ে আছে। গায়ের চাদরটা কোমরের কাছে। ঘরে রোদ। আমি ভাবলুম ভোর হয়েছে। পশ্চিমের জানলা দিয়ে যে সকালবেলার রোদ আসতে পারে না অতসব আমার খেয়াল ছিল না। বিশেষত আমি। আসল আমি রয়েছি কড়িকাঠে, উপুড় হয়ে দেখছি ঘরটা। কিন্তু পাশের বাড়িতে ঝাঁটার শব্দ জানলার ঠিক বাইরে টিউবওয়েলে, সকালে একটা মস্ত লাইন পড়ে যায়। তার হট্টগোল, চেঁচামেচি এইসব মেশানো থাকে সকালের হাওয়ায়। সেগুলো পাচ্ছিলুম না, তাই কেমন গা ছমছম করছিল। এ যেন অন্য কোথাওকার সকাল। একা, আমি একা। পাশ ফেরবার চেষ্টা করলুম, যেন একটা পাথরকে নাড়াচ্ছি এমনি শক্ত, ঠান্ডা হয়ে আছে শরীরটা। ছোড়দি ঘরে এল। ছোড়দির মাথায় কষে আঁট করে বাঁধা দুটো মোটা মোটা বিনুনি। একটা খয়েরি রঙের ডুরে শাড়ি, খয়েরির ওপর হলুদ ডুরে, ছোড়দির মুখে আলতো পাউডার, কপালে টিপ। এখন অর্থাৎ সকালে ছোড়দির চুল ভিজে এলো থাকার কথা, মুখ তেলতেলে, স্নিগ্ধ। আমার বিভ্রম আরও বেড়ে গেল। কীরকম মনে হল আমাকে ফেলে রেখে ওরা সবাই কোথায় চলে যাচ্ছে। ছোড়দি বোধহয় নিজের কিছু জিনিস ভুলে গিয়েছিল তাই একবারটির জন্য ফিরে এসেছে। যাক, তাই যাক। আমি এখন সব শেষের জন্য প্রস্তুত। যা ঘটার তো তা ঘটবেই। হঠাৎ মাথার মধ্যে মায়ের অর্ধেক কান্না অর্ধেক মমতামাখানো ডাক শুনতে পেলুম, যতি। যতি রে! ঘাড় সামান্য বেঁকিয়ে ছোড়দির দিকে চাইলুম। ছোড়দি আমার পাশে বসে পড়ে ঝলক ঝলক হেসে বলল, উঠেছিস? একখানা ঘুম দেখালি বাবা! কটা বাজে জানিস? সাড়ে তিনটে। বিকেল সাড়ে তিনটে। প্রায় চব্বিশ ঘন্টা ঘুমোলি। দাঁড়া দিদি মেজদিকে ডাকি। এইবারে, এই ছুতোয় ও চলে যাবে, প্রাণপণ চেষ্টায় আমি ছোড়দির আঁচলে একটাই দুর্বল টান দিলুম, বোস না ছোড়দি। বাঃ তোকে মুখ ধুতে জামাকাপড় ছাড়তে হবে না? খেতে হবে না? আগে মুখ ধুয়েই খেতে হবে। কীরকম চিঁচি করছিস দেখছিস না?
ছোড়দি ছুট্টে চলে গেল। আমার দিদি খুব গম্ভীর প্রকৃতির, দায়িত্বশীল, মায়ের চেয়েও যেন বড়ো, মেজদিও কতকটা তাই। কিন্তু ছোড়দি টুলটুল কথায় কথায় হাসে। হাসলে ছোড়দির ঝকঝকে দাঁত দেখা যায়, সামনে পেছনে বাতাস লাগা গাছের মতন ছোড়দি দোলে। ছোড়দির অদ্ভুত অদ্ভুত কথা আছে, আদরের ডাক আছে, সিঁড়ি দিয়ে লাফ দিয়ে দিয়ে নামতে নামতে বলে, মাং, দিদিং খিদিং পেয়েছেং। কখনং হবেং? ক্রিপস-মিশনং ব্যর্থং ব্যর্থং। অর্থাৎ ও ইতিহাস পড়ছিল। ক্রিপসমিশনের ব্যর্থতার কথা পর্যন্ত পড়েছে। আর পারছে না, এবার ওকে খেতে দিতে হবে। ভুলুকে ও কখনও বলে ভুলিওকাস দা সেকেন্ড। কখনও ভুল ভুলাইয়া, কখনও সাদাসিধে ভুল-মহারাজ। শুধু বলে না, চটকে চটকে উৎখাত করে দেয় একেবারে, যতক্ষণ না ভুলু ওঁমা। ওঁ দিদি দেখোঁ না বলে নাকি সুর ধরছে। অমন যে গম্ভীর দাদা এম, এসসি কয়ে রিসার্চ করছে, চোখে সোনালি চশমা, তাকেও ছোড়দি ছেড়ে কথা কয় না। কখনও বলবে গোপাল গোবিন্দ মুকুন্দ শৌরে কখনও বলবে, এই যে গ্যাপেলিও গ্যালিলিও আঁকটা কষে দিন তো { দাদার একটা অদ্ভুত শাসন আছে। বাঁ হাত দিয়ে, দাদা ন্যাটা তো! বাঁ হাতের শুধু তর্জনী দিয়ে গালের ওপর চড়াৎ করে মারে। ভীষণ লাগে। আমি অনেকবার খেয়েছি ছোড়দিও খেয়েছে। যে দাদার কাছে পড়তে যাবে সে-ই একবার না একবার খাবে। ওইরকম এক আঙুলের চড় খেয়েও ছোড়দি এক হাতে গাল চেপে বলবে, উফফ এ কী চড়কোভস্কি রে বাবা, মাথাটা যে গোগোল গোগোলোভিচ হয়ে গেল। আঁকগুলো প্যাঁক প্যাঁক করে পালিয়ে যাচ্ছে! ছোড়দি সবে শাড়ি ধরেছে। তাই ছোড়দিকে আমার কেমন অচেনা লাগে। বড্ড বেশি মেয়ে মেয়ে! আর মেয়ে দেখলেই আমি কুঁকড়ে যাই। মেয়েরা আমাকে দেখলে হাসে, নিজেদের মধ্যে কীসব চুপিচুপি বলাবলি করে, মেয়েদের ছায়া আমি পারতপক্ষে মাড়াই না। ছোড়দিটা ইদানীং ফ্রক-স্কার্ট ছেড়ে সেই ভয়ংকর মেয়েদের দলে ভরতি হয়েছে।
দরজা দিয়ে গামলা-মগ-গামছা-তোয়ালে আরও কী কী নিয়ে মেজদি-ছোড়দি ঢুকল। মেজদি বলল, যতি, নিজে নিজে দাঁত-টাত মাজতে পারবি তো?
আমি দেখলুম কনুইয়ে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে উঠতে পারছি। মুখ-টুখ ধুয়ে ছোড়দির কাঁধে ভর দিয়ে কলঘরে যাচ্ছি, ছোড়দি বলল, জটিয়াবাবা কথা বলছিস কেন রে? রাগ করেছিস আমার ওপর? আমার চোখ জ্বালা করছে। কলঘরে ঢুকে চোখের জল লুকোই। দোতলায় ধরা জল। কল থেকে যদি জল পড়ত তো কলটা খুলে রেখে আমি খানিকটা শব্দ করে কেঁদে নিতে পারতুম। নিজের এইসব প্রবৃত্তিতে আমার নিজের ওপর ঘেন্না আরও বেড়ে যায়। ছেলেরা, আমার বয়সের ছেলেরা কাঁদে না। দাদাকে দেখেছি, ফার্স্ট ক্লাস ফসকাতে ভীষণ মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু দিদিদের মতো কান্নাকাটি করেনি। কেমন গুম হয়ে ছিল অনেকদিন। যখন জ্যাঠামশাই মারা গেলেন, বাবা জ্যাঠামশাইকে ভীষণ ভালোবাসতেন, শ্মশান থেকে এসে দাঁড়ালেন—মুখটা যেন ঝলসে গেছে। সেই কালচে ভাব বাবার মুখে এখনও আছে। কিন্তু কাঁদতে দেখিনি। আমি যে কোনোমতেই আমার বাবার মতো, দাদার মতো নই হতে পারছি না—এটাই প্রমাণ করে মানুষ হিসেবে আমি কত নিকৃষ্ট। ভালোবাসবার মতো, পছন্দ করবার মতো আমার মধ্যে কিছু নেই। মেজদি দরজায় টোকা দিচ্ছে যতি, হল? সাড়া দে একটা। অনেক কষ্টে গলা পরিষ্কার করে বললুম, যাচ্ছি। নিজের গলাটা নিজের কানেই হতকুচ্ছিত লাগল। তিন চারটে স্বর বেরোচ্ছে যেন। কী করে আমি তাড়াতাড়ি করব। জুতোর মধ্যে পা-গলানোর মতো আমার নিজেকে যে শরীরের মধ্যে গলাতে হয়।
বাবা, বাবা আমার সঙ্গে কথা বলছেন! বা বা। কী ভীষণ ভয় পাই বাবাকে, সম্রম করি। আমার মতো একটা অবাঞ্ছিত উৎপাত, কুরূপ, নির্গণের সঙ্গে বাবা আলাদা করে কী কথা বলতে চেয়েছেন? ভয়ানক ভয়ে প্রায় মাটির সঙ্গে মিশে আমি দাঁড়িয়ে আছি।
বোসো যতি—বাবার চেম্বার এটা। রাত নটা। সবেমাত্র শেষ মক্কল, সেইসঙ্গে মুহুরি কাকা চলে গেলেন। অতবড়ো গদিওলা চেয়ারে আমার হালকা শরীরটা রাখতে আমার ভয় করছিল। এত হালকা আমি … যদি আবার …।
শরীরটা এখন কেমন বোধ করছ?
মুখ নীচু করে বলি, ভালো।
সত্যিই মাসখানেকের ওপর আমি বাড়িতেই আছি। অহরহ ফলের রস, দুধ, ছানা, ডিম খাচ্ছি। তাকিয়ে দেখি আমার বাইরের চেহারাটা একটু একটু চকচকে হয়েছে বটে। চোখের সেই গর্তে-বসা ভাবটা নেই আর। গাল-টালগুলো অত কালো নেই। চুল কাটা হয়নি অনেকদিন। মাথার পেছনের কতকগুলো চুল কীরকম খাড়া থাকত। এখন সেগুলো বসে গেছে। চুলগুলো বড়ো হয়ে ঘাড়ের কাছে কেমন একটু পাকিয়ে গেছে। কিন্তু এ সবই তো বাইরের ভেতরে আমি প্রায় সেই একইরকম কৃষ্ণকায়, কাষ্ঠকঠিন, নির্বান্ধব, যতি দা ডার্ক। রাতের আঁধার, সবুজ বাতির লক্ষ্মণের গণ্ডির প্রান্ত থেকে রোজ উঁকিঝুঁকি মারে। আমার আসল জায়গা, আমি জানি, সবুজ আলোর বৃত্তের ওপারে, ওই অন্ধকারে, অজানায়। যা পাচ্ছি, আমার প্রাপ্য বলে পাচ্ছি না, নারীজাতির চরিত্রে অসীম করুণা, তাই তার থেকে আমার মতো অভাজনও কিছু পায়। নিজস্ব কোনো গুণে নয়।
বাবা গলাটা একটু পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, খোঁজ নিয়ে জানলাম গত তিন চার মাস তুমি স্কুলে যাওনি, কোয়ার্টারলি পরীক্ষাটাও মিস করেছ, কেন? কেনটা বাবা খুব ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলেন যেন বাবাকে আমি যতটা লজ্জা পাচ্ছি, ভয় করছি, বাবা তার চেয়েও ভয় লজ্জা আমাকে পাচ্ছেন। আমি কিছুই বলতে পারছি না। যে চেয়ারে আমি বসে আছি, তারই পাশে আমি দাঁড়িয়ে আছি অসহায়, উদাসীন।
পড়াশোনা করতে ভালো লাগছে না যতি? তোমার প্রোগ্রেস তো খারাপ নয়?
এই সময়ে দাদা বাড়ি ফিরল। সে টেবিলের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে গেল। বাবার দিকে একবার, আমার দিকে একবার চাইছে। চোখে খুব দুশ্চিন্তা। সুইং-ডোরটা খুলে আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকে এল বড়দি। পেছনে মেজদি, ছোড়দি, মা-ও। ওরা কি আড়ালে কোথাও অপেক্ষা করছিল? দিদি বলল, যতি, আজ তোকে বলতেই হবে স্কুলে তোকে কে এমন কী বলেছে যে স্কুলে যাবার নাম করে … মেজদি বলল, যতি, তোকে যদি বদমাশ লোকে ধরত। তুই যদি হারিয়ে যেতিস …ও কি রে তুই কাঁদছিস? আমার চোখ দিয়ে নিঃশব্দে জল পড়ছিল ভীষণ জ্বালা করে। আমি দেখতে পেলুম মা আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে, ছোড়দি কাঁদছে। বাবা বললেন, ঠিক আছে। শরীরটা ঠিক কয়ে নাও। দেখি কী করা যায়।
আমি তখন উঠে দাঁড়াচ্ছিলুম। পাতালের দেবতা আমাকে দু-হাতে ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন। তাই আমার হাতে হাত, পারে পা, চোখে চোখ, কানে কান সব খাপে খাপে বসে যাচ্ছিল। কাটা দরজাটা দিয়ে ভেতরবাড়িতে যেতে যেতে শুনতে পাচ্ছিলুম বাবা আস্তে করে বলছেন, আর মনটা যতি, মনটাকেও ঠিক করো। বাবা হয়তো আর বলেননি, কিন্তু গুনগুন করছিল আমার কানের সন্নিকটে বাবার গলা, মন, মন, মনটা যতি মন।