শুধুই কি দুর্ঘটনা? – সমরজিৎ কর
দক্ষিণ পশ্চিম ভারতের গৌরিবাদানুর যেন বড়োই নির্জন। উতকামন্ড। সেখানে থেকে পাহাড়ের খাড়াই উৎরাই দিয়ে একটানা পথ। মাঝে মাঝে দু-চারটে ঘর নিয়ে এক একটি বসতি। কোথাও বা ঝরনা। পাহাড়ের গায়ে কফি বাগিচা। কোথাও গভীর অরণ্য। এরই ফাঁকে গৌরবাদানুরের এই এলাকাটা একটা খাদের মতো। চারিদিকে পাহাড়। তাদের মাঝখানে খাদ।
বলতে পার, বনবাস। সত্যিই বনবাস। এখানে যারা বাস করেন, কয়েকজন বিজ্ঞানী এবং তাঁদের সহকর্মী-গোড়ায় এখানকার সৌন্দর্য দেখে সবাই তারা অভিভূতই হয়েছিলেন। তারপর কয়েকটা দিন যেতেই কেমন একটা বিমর্ষভাব। এক প্রান্তে কয়েকটি ঘর। তাদের মধ্যে একটিতে এক দঙ্গল কমপিউটার। বাইরে ভূকম্পন মাপার যন্ত্র। কমপিউটারের সাহায্যে ভূকম্পন মাপা—এই তো কাজ। পৃথিবী নামক বিরাট গোলকটি দুরন্ত বেগে সূর্যের চারপাশ পরিক্রমণ করছে। আর গতিশীল যে বস্তু সে তো কাঁপবেই। সেই কম্পন সমানে লিপিবদ্ধ হচ্ছে ছক আঁকা কাগজের ওপর। একটানা দেখতে দেখতে পাগল হওয়ার মতো অবস্থা।
আর এক প্রান্তে সেই রেডিয়ো টেলিসকোপটা। ধাতব রড এবং পাত দিয়ে তৈরি—যেন একটি নৌকো। এক কিলোমিটার লম্বা। অনুচ্চ খাড়াই এর ওপর, একটি গবেষণাগার। সেখানেও পাগল করার মতো নির্জনতা। শুধু দেখে যাও, দূর মহাকাশে কী ঘটছে। টেলিসকোপে কোনো নিউট্রন নক্ষত্র, রেডিয়ো তরঙ্গের উৎস, অথবা অন্যকিছু ধরা পড়ে কিনা তার জন্যে অপেক্ষা করা। সেই পর্যবেক্ষণের কাজে কোনো বিরতি নেই। পুরো ব্যাপারটাই মাঝে মাঝে বড়ো একঘেয়ে মনে হয়। ফলে এখানকার যারা কর্মী, তাঁদের চিন্তাধারা এবং চালচলন মাঝে মাঝে বড়ো ঢিলে হয়ে পড়ে।
এই ভাবেই চলছিল। বলতে পার, যাকে বলে নিস্তরঙ্গ জীবন। কিন্তু হঠাৎ, কোনো কিছু অনুমান করার আগেই এমন একটি ঘটনা ঘটল কেউ ভাবতেই পারেনি।
ভূকম্পনজ্ঞাপক পরীক্ষাগারটি লম্বায় কুড়ি ফুট, চওড়ায় পনেরো ফুট। চারদিকে কাচে ঢাকা জানালা। মে মাস বাইরে যথেষ্ট গরম। ভেতরটা শীততাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকায় খুবই আরামপ্রদ ছিল দিনটা রবিবার। দু-জন পর্যবেক্ষক বিজ্ঞানী ছাড়া সবাই বাসায়। সন্ধে সবে গড়িয়েছে। পরিষ্কার আকাশ। তার গায়ে তারাগুলি জ্বল জ্বল করছে। চাঁদ নেই। তাই অরণ্যের ওপর নেমে এসেছে অন্ধকারের পুরু চাদর।
পর্যবেক্ষক বিজ্ঞানী বলতে রাঘবন এবং অশোক মিত্র। তাদের হাতে কফির পেয়ালা। সময়—আলোর প্রচণ্ড ঝলসানি। তারপর অদূরে, তা সাত-আট কিলোমিটার দূরে হবে, প্রচণ্ড শব্দ। পরমুহূর্তে ভূকম্পন যন্ত্রের কমপিউটারটি চঞ্চল হয়ে উঠল। যার মানে প্রচণ্ড ভূকম্পন ঘটল।
রাঘবন এবং অশোক এক লাফে গিয়ে দাঁড়াল লেখচিত্রের সামনে।—
কী কাণ্ড! বলল রাঘবন।
একেবারে দশ রিখটার! যেন ভিরমি খেল অশোক। কারণ এ ধরনের অভিজ্ঞতা তার জীবনে এই প্রথম ঘটল।
একই সময় গৌরিবাদানূরের রেডিয়ো টেলিসকোপের পর্যবেক্ষণ কক্ষেও তখন রীতিমতো নাটক। এই ঘরটির পুরোটাই মাটির নীচে। অতএব বাইরে কি হচ্ছে, সেটা কারোরই দেখার কথা নয়। রেডিয়ো অ্যাস্ট্রনমার ড. চিদাম্বরম তাঁর সহকারী নিগাভেজরকে নিয়ে সাইরাস নক্ষত্র বরাবর একটি রেডিও নক্ষত্রের ওপর পর্যবেক্ষণ চালাচ্ছিলেন। হঠাৎ—
অদ্ভুত ব্যাপার। স্ট্রং রেডিয়ো নয়েজ। কম্পিউটারের দিকে চাইতেই চোখ। যেন ছানাবড়া হয়ে উঠল ড. চিদাম্বরমের। —কী হচ্ছে, দেখ তো? পাশে অঙ্ক কষছিলেন নিগাভেজর। তাঁর ডাকে তিনি কম্পিউটারের ভিশন প্লেটটির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। তারপর মুহূর্তের জন্যে হতবাক অবস্থায় থাকার পর তাঁর মুখে একটা শব্দই উচ্চারিত হল—’আশ্চর্য!’
ঝানু পর্যবেক্ষক ড. চিদাম্বরমের বুঝতে অসুবিধা হল না, তাঁদের অতিকায় রেডিয়ো টেলিসকোপে বিচিত্র বেতার সংকেত ধরা পড়েছে। সেই সংকেত যে সুদূর কোনো নক্ষত্রের নয়, সে সম্পর্কে কখনোই তিনি ভুল করতে পারেন না।
কিন্তু এর পর যা ঘটল তা আরও অবাক করার মতো। নিয়ম মতো ভূমিকম্পের খবরটা পাঠিয়ে দিলেন দিল্লির কেন্দ্রীয় দপ্তরে। জানালেন, ‘ভূকম্পনের মাত্রা খুবই মারাত্মক। তার উৎপত্তিস্থলটি আমরা ধরতে পারছি না। অদ্ভুত ব্যাপার, এখানে কোনো ক্ষয় ক্ষতিও হয়নি।
মিনিট পনের পর দিল্লির অফিস থেকে টেলিফোনট করেছেন দপ্তরের খোদ কর্তা ড. বিশ্বনাথন। ‘হ্যালো!’ ফোন ধরলেন অশোক।
‘কী ব্যাপার, অশোক? দশ রিখটার স্কেলে যদি ভূকম্পন হয়, তাঁর মানে কী দাঁড়ায় জান? এতক্ষণে তোমরা তো পাথরের গর্তে তলিয়ে যেতে? অ্যাবসার্ড এমন প্রচণ্ড কম্পন, অথচ কোথাও কিছু হল না। একটা কুটির ভাঙার খবরও তো আমি পেলাম না। পাগল হলে নাকি তোমরা?’ ড. বিশ্বনাথন যে খুবই বিরক্ত হয়েছেন, তাঁর কণ্ঠস্বরেই তা বোঝা গেল।
‘আমাদের যন্ত্র ঠিকই আছে, ড. বিশ্বনাথন। ভুল আমাদের হয়নি।’
কিন্তু কথা শেষ না হতেই রেডিয়ো টেলিফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
রাঘবন এবং অশোক তো হতভম্ব।
তার পরক্ষণেই আর একটা টেলিফোন কল।
‘হ্যালো? অশোক মিত্র হিয়ার?’ রিসিভারটি তুলে নিয় কথা বললেন অশোক।
‘একটা অনুরোধ। ভূমিকম্পের খবরটা আপাতত চেপে যান। বিষয়টি জরুরি।’ ওপার থেকে কে কথা বলল। এবং এইটুকুই। তারপর টেলিফোনের সংযোগ কেটে গেল।
ওদিকে রেডিয়ো টেলিসকোপের তথ্যকেন্দ্রে তখন দারুণ উত্তেজনা। এই মাত্র পাওয়া রেডিয়ো সংকেতগুলি বিশ্লেষণ করে ড. চিদাম্বরম বুঝতে পারলেন, ঘটনাটি আশপাশেই ঘটেছে। কম্পিউটারের ভিশন প্লেটে ভেসে উঠেছে বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের তরঙ্গ। তারা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরছে। বলতে কী এ ধরনের অভিজ্ঞতা এর আগে তাঁর কখনো হয়নি।
এ ক্ষেত্রেও অবাক কাণ্ড! ড. চিদাম্বরম খবরটা পাঠালেন বোম্বাই-এর জিওম্যাগনেটিক রিসার্চ ইনসটিটিউটের ডিরেক্টর ড. অরিজিৎ সরকারের কাছে। ভেবেছিলেন, খবরটা পেয়ে ড. সরকার বেশ অবাকই হবেন। আশ্চর্য! অবাক হওয়া তো দূরের কথা। বরং তিনি যেন জ্বলন্ত আগুনের উপর এক বালতি ঠান্ডা জল ঢেলে দিলেন। জানালেন : ‘ব্যাপারটা আমরা জানি ড. চিদাম্বরম। বরং আমিই এ নিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় আপনার ফোন এল। যাই হোক, আমরা পরে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করছি। আপাতত এ নিয়ে কারোর সঙ্গে আর কথা বলবেন না।’
হাতের গ্রাহক যন্ত্রটি ক্র্যাডেলের ওপর নামিয়ে রেখে একেবারে পাথর হয়ে বসে পড়লেন ড. চিদাম্বরম। সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
ড. নিগাভেজার জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার কী মনে হয়, ড. চিদাম্বরম?’
‘একটা ধাঁধা ছাড়া কিছুই না।’ বললেন, ড. চিদাম্বরম।
এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। ভূকম্পন কেন্দ্র এবং রেডিয়ো টেলিসকোপের মানমন্দিরে সে রাতে কেউ আর ঘুমতে পারলেন না। সবাই বুঝতে পারলেন, যা ঘটেছে তার প্রচলিত চিন্তাভাবনায় ব্যাখ্যা চলে না।
২
ব্যাপারটা যে এই ভাবে একেবারে নাগালের বাইরে চলে যাবে সে কথা কল্পনাও করতে পারেননি ড. জেমস অ্যান্ডার্সন। দক্ষিণ ভারত মহাসাগরের এই যে দ্বীপটি, আয়তনে এতই অকিঞ্চিৎকর যে মানচিত্রে কোনো স্থানই পায়নি। দৈর্ঘ্যেপ্রস্থে প্রায় এক মাইল। কুমারিকা অন্তঃরীপ থেকে কত দূরত্ব? তা হাজার দুই মাইল হবে। মাঝে মাঝে কিছু ঝোপ-ঝাড়। বেশির ভাগই ফার্ন জাতীয় গাছ।
মনুষ্য সভ্যতা থেকে বহু দূরে নির্জন এই দ্বীপে গত তিন বছর ধরে বিচিত্র এক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় মগ্ন ছিলেন জেমস অ্যান্ডার্সন। জন দশেক সহকারী নিয়ে শুরু হয়েছিল গবেষণা। কাজ কর্ম চলছিল খুব গোপনে। বাইরে থেকে তাঁদের সাহায্য করছিলেন তিন জন—ড. বাসু, জাভিয়ের সাইমন, এবং ড. করডিনি। এঁদের মধ্যে ড. বাসুই প্রবীণ। জাভিয়ের মেকসিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞানের, করডিনি অধ্যাপনা করেন মিলান বিশ্ববিদ্যালয়ে, ধাতুবিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর প্রচুর নাম ডাক।
বছর পাঁচ আগে এক খণ্ড উল্কাপিণ্ড পেয়েছিলেন কর্ডিনি। তাতে তিনি এমন এক ধরনের মৌলিক পদার্থের সন্ধান পান যা আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে আবিষ্কৃত হয়নি। জেমস তখন বার্জলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পরমাণু বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করছেন, আন্তর্জাতিক একটি সম্মেলনে যোগ দিতে ড. বাসু, জেভিয়ের এবং তিনি এসেছিলেন মিলানে। ওই সময় উল্কার ব্যাপারটা তাদের বলেন কর্ডিনি শুধু এলেই ক্ষ্যান্ত হননি, উল্কা পিণ্ডটি তাঁদের দেখান।
‘গুড গুড। এ যে সুপার হেভি!’ প্রথম দেখাতেই বুঝতে পেরেছিলেন ড. বাসু,—’করডিনি, আমার অনুরোধ এ নিয়ে আপনি হইচই করবেন না। ব্যাপারটা চেপে যান।’ বলেছিলেন তিনি। তারপর সেদিনই পুরো পরিকল্পনাটির ছক করে ফেলেন তিনি। ঠিক হয় যা কিছু করণীয় জেমসই করবেন। দূর থেকে মতলব দিয়ে তাঁকে সাহায্য করবেন ড. বাসু কারডিনি এবং জেভিয়ের।
ড. বাসুর পরিকল্পনাটি শুনে সবাই, বিস্মিত হন, তাঁরা বুঝতে পারেন, তাঁর পরিকল্পনা যদি সফল হয় মানুষ কোনো দিন যা ভাবতে পারেনি, পৃথিবীতে সেটাই ঘটবে।
‘কিন্তু এ কাজে তো প্রচুর অর্থ দরকার?’ প্রশ্ন করেছিলেন জেমস।
‘হবে, সব হবে, জেমস!’ তাঁকে আশ্বাস দিয়েছিলেন ড. বাসু।
এর পর সব কিছুই ঘটল দ্রুত লয়ে, প্রচুর অর্থ এল, গবেষণার যন্ত্রপাতি, সাজসরঞ্জাম, উভযান বিমান। সবই যোগালেন ড. বাসুর তিন মার্কিন শিল্পপতি বন্ধু। বছর দুই ঘুরতেই গবেষণায় পাওয়া গেল অসামান্য সাফল্য। আর তারপর থেকেই শুরু হল জটিলতা।
৩
এপ্রিলের গোড়ায় সোভিয়েত দেশের একটি স্পাই উপগ্রহ বেশ নির্দেশ মতোই আকাশ-পথে পরিক্রমণ করছিল আতলান্তিক মহাসাগরের ওপর দিয়ে। বৈকানুর মহাকাশ স্টেশনের পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে বসে তার ওপর নজর রাখছিলেন দ্রিমিত্রি কাজিরেং, তার সামনে কম্পিউটার যন্ত্রগুলি সচল। ভিশান প্লেটের ওপর ভেসে উঠেছে উপগ্রহটির ছবি, এমন সময় ব্যাপারটা মুহূর্তেই ঘটে গেল। প্রথমে একটি আলোর ফুলকি, তারপর বিস্ফোরণ, দিমিত্রি দেখলেন, উপগ্রহটি ধবংস হয়ে গেল।
ভয়ে সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগল দিমিত্রির। ‘স্যাবোটাজ?’ নিজের মনেই বলে উঠলেন তিনি। আর তাঁর পরক্ষণেই কানের পাশে বেজে উঠল টেলিফোন ‘দি মি ত্রি! কাণ্ডটা কী ঘটল লক্ষ করলে? হায় ভগবান!’ কথা বললেন, গুপ্তচর বিভাগের প্রধান মিখাইল পেত্রোভিচ। ক্ষোভে ফেটে পড়লেন যেন তিনি।
‘কিছুই তো বুঝতে পারছি না।’ শুকনো গলায় জবাব দিলেন দিমিত্রি। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে বৈকানুর থেকে যে খবরটা মস্কোর হেডকোয়ার্টারসে পৌঁছেছে সেটা বুঝতে তাঁর অসুবিধে হল না।
‘ইয়াংকিদের কাজ?’
‘একটু সবুর করুন, ব্যাপারটা আমি খতিয়ে দেখছি।’
ঘন্টাখানেক কম্পিউটারের সাহায্যে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন দিমিত্রি, এবং শেষ পর্যন্ত….’একেবারে জট কাকে বলে’…বলেই মিখাইলের সঙ্গে টেলি সংযোগ করলেন।
‘কী বুঝলে?’ জিজ্ঞেস করলেন মিখাইল, তাঁর কণ্ঠে রীতিমতো উদবেগ।
‘না। আশেপাশে কোনো মার্কিন উপগ্রহ নেই। আমাদের অন্য একটি উপগ্রহ থেকে ছবি এসেছে। তাতে উপগ্রহটি যেখানে ধবংস হয়েছে, আকাশের সেই অংশে আমরা এক ছোপ মেঘ দেখছি….ঈষৎ হলুদ রঙের। সেখান থেকে কয়েক ঝলক গামা রশ্মি এসেছে, আমাদের গামা রশ্মি ক্যামেরায়।’ বললেন দিমিত্রি।
দিমিত্রির এই খবর বিশেষজ্ঞদের পাঠান হল। শুরু হল জল্পনা।
পরবর্তী কয়েক দিনে একই ধরনের আরও কয়েকটি ঘটনা ঘটল। কয়েকটি সোভিয়েত এবং মার্কিন উপগ্রহ একই ভাবে ধবংস হল। এবং খুঁটিনাটি পরীক্ষা এবং উভয় দেশের বিজ্ঞানীরা পরস্পর কথাবার্তা বলে সিদ্ধান্ত করলেন ! ব্যাপারটা একান্তই নৈসর্গিক ঘটনা। প্রাকৃতিক কোনো কারণেই এমনটি ঘটেছে। কিন্তু কী সেই কারণ, সেটা কেউই ধরতে পারলেন না।
আর ঠিক এই সময়েই পড়ল ড. বাসুর ডাক। একটি আন্তর্জাতিক কমিটি তৈরি হল। কমিটির সদস্যরা ঘটনাটি গোপনে খতিয়ে দেখতে লাগলেন।
দেখতে দেখতে এক মাস কেটে গেল। এর মধ্যে আর কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। তবু অজ্ঞাত আশঙ্কা কেউ যেন মন থেকে মুছে ফেলতে পারলেন না। রহস্যটা যে কী, ধরতেই পারলেন না। এমনকী ড. বাসুর মতো ডাকসাইটের বিজ্ঞানীও না।
৪
কিন্তু অবশেষে বলতে পার, কাকতলীয় ভাবেই যেন ঘটে গেল ব্যাপারটা। এবং তা ধরলেন স্বয়ং ড. বাসু। গত ছয় মাস জেমসের সঙ্গে তিনি কোনো যোগাযোগ রাখতে পারেননি। হঠাৎ জেমসের কাছ থেকে টেলিফোন। তিনি জানাচ্ছেন, পরিকল্পনা মতো সব কাজ ঠিক মতোই চলছে তিনি বুঝতে পেরেছেন, কার্টিনির সেই উল্কাপিণ্ডটি সত্যিই একটি অসাধারণ বস্তু। সেটিকে ভেঙে দশটি টুকরো করেছেন তিনি। ড. বাসুর পরিকল্পনা মতো প্রতিটি টুকরো এক একটি বিশেষ ধরনের পারমাণবিক রিঅ্যাকটারের মধ্যে রাখা হয়। তাদের মধ্যে নয়টি ইতিমধ্যেই রকেটের সাহায্যে মহাকাশে উৎক্ষেপ করেছেন তিনি প্রশান্ত মহাসাগরের সেই দ্বীপটি থেকে কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব কটিই মহাকাশে নির্দিষ্ট কক্ষ ছেড়ে কোথায় হারিয়ে গেছে।
ড. বাসু অস্ট্রেলিয়ার উত্তমারোয় রেডিয়ো টেলিসকোপে একটি সুপারনোভার বিস্ফোরণ পর্যবেক্ষণ করছিলেন তখন, যখন জেমসের টেলিফোন বার্তাটি পেলেন, কথা ছিল এখানকার কাজ সেরে তিনিই জেমসের ওখানে যাবেন সেখানকার ব্যাপার দেখতে। বলতে কী, তাঁর ওপর বিরক্তই হয়েছিলেন তিনি। জেমসের এই এক বাজে চরিত্র। নিজের গবেষণার ব্যাপারে মাঝে মাঝে এমন চুপচাপ থাকেন, কাউকে কিছু বলাটা সে দায়িত্ব বলে মনে করেন না। ভাবেন সাফল্য যখন হাতের মুঠোয়, সব কিছুই সেরেই সব কথা প্রকাশ করবেন, এখন নাও তার ঝক্কি সামলাও।
জেমসের কথার ফাঁকেই প্রশ্ন করলেন ড. বাসু, ‘কী বললেন? নয়টি টুকরো এর মধ্যে আকাশে পাঠিয়েছেন?’
‘ঠিক তাই ড. বাসু।’ ওপার থেকে কথা বললেন জেমস।
‘এই তা হলে ব্যাপার!’ রেগে ফেটে পড়লেন ড. বাসু।
‘ভুলচুক কিছু হয়েছে, ড. বাসু?’
‘আমার মুণ্ডু হয়েছে। এখন বাকি টুকরোটি নিয়ে কী করছেন, বলুন দেখি?’
‘এই মাত্র উৎক্ষেপ করলাম।’
‘যাক, যোল কলা তা হলে পূর্ণ হল।’ ড. বাসু ক্ষোভে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন।
‘কিছু বলছেন, ড. বাসু?’
‘চটপট আপনার এই শেষ উৎক্ষেপণটির বিবরণ দিন তো?’ ড. বাসুর কণ্ঠে আদেশের সুর।
একটা গোলমাল যে হয়েছে, জেমসের বুঝতে সেটা অসুবিধে হল না, মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন পরিবেশে গবেষণার কাজটি নীরবেই চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিলেন, তিনি সফল হতে চলেছেন। কিন্তু সে সম্পর্কে স্থির নিশ্চয় হওয়ার আগে তিনি এ নিয়ে হইচই করতে চাননি। আসলে আত্মপ্রচারের ব্যাপারটা কোনো দিনই তিনি পছন্দ করেন না। অনেক বিজ্ঞানী যৎসামান্য সাফল্যের ইঙ্গিত পেলেই যেমন পৃথিবীময় প্রচারের বেলুন ওড়াতে থাকেন, সে দলে পড়েন না তিনি, তাই এ নিয়ে ড. বাসুর সঙ্গেও কোনো যোগাযোগ রাখেননি।
ড. বাসুর কথায় সন্ত্রস্ত হলেন জেমস। কী এমন ঘটল?
‘ব্যাপার কি, ড. বাসু?’ তিনি প্রশ্ন করলেন।
‘সে আর শুনে কী হবে। নয়টি কৃত্রিম উপগ্রহ সাবাড়। আপনার ভাগ্য ভালো, পৃথিবীর দুই মহাশক্তির মধ্যে এখনো বাধেনি। যাক যা বললাম, সেটা করুন দেখি।’ বললেন ড. বাসু।
জেমস সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শেষ উৎক্ষেপণের বিবরণটি জানিয়ে দিলেন, বিবরণটি পড়ে ড. বাসু বুঝতে পারলেন, জেমসের বস্তুটি এবারও লক্ষ্যচ্যুত হয়েছে। তিনি আঁতকে উঠলেন, আবার কি কোনো উপগ্রহ সাবাড় হবে?
কিন্তু সমস্যার সময় মাথাটি ঠান্ডা রাখতে জানেন ড. বাসু। কয়েকজন বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে হিসেব করে জেমসের বস্তুটি মহাকাশের কোন পথে ছুটে চলেছে, সেটা বের করতে তাঁর দেরি হল না। তারপর অনুরোধ করলেন নাসার জনৈক বিজ্ঞানীকে। তাঁকে জানালেন, বস্তুটি নিরক্ষরেখার আকাশ বরাবর বিচরণ করছে। তার কাছাকাছি রয়েছে আপনাদের লেজারবাহী কৃত্রিম উপগ্রহ। সেই উপগ্রহ থেকে 30 গিগা হার্টজ-এর বেতার তরঙ্গের সংকেত পাঠান সেই বস্তুটিতে। তাহলেই সেটি ভারতমহাসাগরের নেমে এসে বিলীন হয়ে যাবে।’ তারপর বোম্বাই এর জিয়োম্যাগনেটিক কেন্দ্রে ড. অরিজিৎ সরকারকে জানালেন, ‘নজর রাখুন একটি বস্তু পিণ্ড দক্ষিণ আকাশ থেকে প্রচণ্ড বেগে ভারতের দক্ষিণ উপকূলের কাছাকাছি নামবে। সেটি থেকে নির্গত হবে তীব্র চৌম্বক ক্ষেত্র।’ সময় এবং বস্তুটির নেমে আসার পথটিও বলে দিলেন তিনি।
কয়েকঘন্টা অপেক্ষা মাত্র। তারপর যা ঘটল সে কথা গোড়াতেই বলেছি—গৌরিবাদানুরের ভূমিকম্প এবং বেতার ঝড়।
ঘটনাটির তিন দিন পর ড. বাসু গৌরিবাদানুরে এলেন। সঙ্গে অরিজিৎ। সেখানে সবাই তাঁরা সঙ্গে কথা বলার জন্যে উৎকণ্ঠিত হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। দিল্লি থেকে ড. বিশ্বনাথনও এসেছেন।
ভূকম্পন যন্ত্রের কক্ষে মিটিং বসল, ড. বাসু সেখানেই মূল রহস্যটির কথা বললেন ; আসল ব্যাপার হল, একটি উল্কাপিণ্ড, এটি মহাকাশের কোথা থেকে এসেছিল আমরা জানি না। উল্কাটির মধ্যে ছিল সুপার হেভি এলিমেন্ট। ইউরেনিয়ামকেই তো বলা হয় সব চেয়ে ভারী পদার্থ। এটি তার চেয়েও ভারী। পারমাণবিক ভর 233। এ ধরনের বস্তু পৃথিবীতে পাওয়া যায়নি। ঠিক হয়, উল্কাটি টুকরো করে এক একটি টুকরোয় ঘটান হবে পারমাণবিক বিভাজন। সেই বিভাজনের ফলে কি পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়, সেটাই পরীক্ষা করার পরিকল্পনা নিয়েছিলাম আমরা। এর জন্যে ব্যবহার করা হয় বিশেষ ধরনের রিঅ্যাকটর। ঠিক হয় বিভাজন মহাকাশে ঘটান হবে। সেই সময় নির্গত হবে প্রচুর পরিমাণ উচ্চশক্তির ইলেকট্রন কণা এবং গামা রশ্মি। তাদের পরিমাপ করে বিভাজন শক্তি কতটা দাঁড়ায় তা জানা যাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, জেমস উল্কার যে নয়টি টুকরো এর জন্যে মহাকাশে পাঠান তার প্রতিটিই কক্ষচ্যুত হয়ে এক একটি কৃত্রিম উপগ্রহ ধবংস করে। ধবংসের ফলে সৃষ্ট হয় প্রচণ্ড উত্তাপ। প্রচুর গামা রশ্মি এবং ইলেকট্রন, প্রচণ্ড গতিশীল ইলেকট্রনের ফোয়ারাই বলতে পারেন, যা সৃষ্টি করে অত্যন্ত তেজসম্পন্ন বেতার তরঙ্গ, শেষবারের মতো ভারত মহাসাগরে যেটি ফেলার ব্যবস্থা হয়, সেটি লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে এসে পড়ে আপনাদের এই গৌরিবাদানুরের জঙ্গলে, একটি বড়ো-সড়ো পাথরে এসে আঘাত করে, ঘটে বিস্ফোরণ। সেই বিস্ফোরণই এখানে অমন আলোর ঝলকানি সৃষ্টি করেছিল, পাথরের টুকরোয় আঘাত করে সৃষ্টি করে ভূমিকম্প, সেই কম্পনও আপনার এই এলাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, ভূস্তরের গভীরে ঢুকে বিস্ফোরণ ঘটালে সেই কম্পন বহুদূরে পর্যন্ত প্রসারিত হত। সৌভাগ্য তা হয়নি। বিস্ফোরণের সময় সৃষ্টি হয় ইলেকট্রনের জোট যা প্রচণ্ড শক্তিশালী বেতার তরঙ্গ সৃষ্টি করে। এখানকার রেডিয়ো টেলিসকোপে সেই কম্পনই ধরা পড়েছিল। অরিজিৎ চৌম্বক ক্ষেত্রে আগেই ধরতে পেরেছিলেন।
ড. বাসু বললেন, ব্যাপারটা আমার কাছেও বিস্ময়কর বলে মনে হচ্ছে, ড. বিশ্বনাথন। কিন্তু এ নিয়ে এতই জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যে, এ ব্যাপারে কাউকেই আমরা কিছু বলতে পারব না। বললে জটিলতা বাড়বে। তাই আমার অনুরোধ, আপাতত আপনারা মুখে কুলুপ দিয়ে থাকুন।