শুকনো গোলাপ
ঝমঝম শব্দে একটা ট্রেন ঢুকছে স্টেশনে৷ নাঃ, এটায় ভীষণ ভিড়৷ উঠলে চিঁড়ে চ্যাপটা হয়ে যাবে৷ সাগরিকা ঠিক করল পরের ট্রেনটায় উঠবে৷ আজ সঙ্গে রুনু আছে৷ ওর ভিড় ট্রেনে ওঠার অভ্যাস নেই৷ খানিকটা পিছিয়ে আসতেই কার সঙ্গে যেন ধাক্কা লেগে গেল সাগরিকার৷ পিছন ফিরে ‘সরি’ বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু শব্দটা বেরোল না মুখ থেকে৷ তার বদলে অনাবিল হাসি খেলে গেল ঠোঁটের কোনায়, ‘আরে তুই৷ আমি তো…’
যে মেয়েটার সঙ্গে ওর ধাক্কা লেগেছে তার নাম কাকলি, স্কুলে একসঙ্গে পড়ত, কলেজে ওঠার পরেও দেখা হয়েছে বারকয়েক৷
‘ওঃ! তুই… আমি আসলে…’ উত্তরটা দিতে ইতস্তত করল কাকলি৷ রুনু এসে দাঁড়াল সাগরিকার পাশে৷
‘অফিস যাসনি আজ?’ সাগরিকা আগের মতোই হেসে জিজ্ঞেস করে৷
‘না, আজ… একটা ট্রেন ধরে…’
‘কোথায় যাবি?’
‘ওই একটু ঘুরতে… আর কী…’
সাগরিকার মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে যায়৷ ওর সঙ্গে দেখা হয়ে কাকলি যে খানিকটা অস্বস্তিতে পড়েছে, সেটা মেয়েটার হাবভাব দেখেই বোঝা যায়৷ সেই সঙ্গে আর-একটা ব্যাপার লক্ষ করে সাগরিকা৷ থেকে থেকে কাকলির চোখ চলে যাচ্ছে প্ল্যাটফর্মে এক বিশেষ জায়গায়৷ যেন কারও উপরে নজর রাখছে৷
সেদিকে চেয়ে সাগরিকা দ্যাখে একটা বছর তিরিশেকের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে৷ গায়ে একটা কালো রঙের টি-শার্ট, মাথায় ক্যাপ৷ কাকলির অস্থির চোখের মণি যেন তার গতিবিধি অনুকরণ করছে৷ ছেলেটাকে কি ফলো করছে ও? কিন্তু কেন?
‘আ… আমি এখন আসি… পরে কথা বলব৷’
প্রায় চোরের মতোই সাগরিকার সামনে থেকে সরে পড়ে ও৷ উত্তরের জন্য অপেক্ষাও করে না৷
‘কে রে এটা? মাথায় গোলমাল আছে নাকি?’ রুনু জিজ্ঞেস করে৷
‘সে তো আগে থেকেই ছিল, ইদানীং মনে হয় বেড়েছে… অবশ্য…’ সাগরিকা বিড়বিড় করে৷
‘অবশ্য কী?’
‘মেয়েটার লাইফ খুব দুঃখের৷ ছোটোবেলায় বাবা-মা মারা যায়, এক পিসির কাছে মানুষ৷ তখন ওর বয়স বছর আটেক হবে৷ একদিন পিসেমশাই একটা ফাঁকা ঘরে নিয়ে গিয়ে… ও এত হকচকিয়ে গিয়েছিল যে প্রতিবাদ করতে পারেনি কিছু৷ তারপর থেকে মাথাটা খারাপ হয়ে যায়৷’
‘কেমন মাথা খারাপ?’ রুনুর স্বরে কৌতূহল বেড়ে ওঠে৷
‘তা তো জানি না৷ তবে স্কুলে অদ্ভুত আচরণ করত মাঝে-মধ্যে৷ একে-ওকে ধরে মারত৷ কেউ বকাবকি করলে আরও অ্যাগ্রেসিভ হয়ে যেত৷ একটা মেন্টাল ইনস্টিটিউশনেও ছিল কিছুদিন৷ তবে বড়ো হতে ব্যাপারটা খানিকটা ঠিক হয়… এখন মনে হয় আবার…’
রুনু মুখ বাড়িয়ে আর-একবার কাকলিকে দেখার চেষ্টা করে৷ কিন্তু লোকজনের ভিড়ে আর দেখা যায় না তাকে৷
দু-জনে আর মাথা ঘামায় না ব্যাপারটা নিয়ে৷ প্ল্যাটফর্মের একদিকের দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে একজন গান শোনে, অন্যজন ফেসবুক ঘাঁটাঘাঁটি করে৷ গানের সুর ছাপিয়ে অ্যানাউন্সমেন্ট ভেসে আসতে দু-জনেই ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে এগিয়ে যায়৷ ট্রেন আসছে৷
কিন্তু তীব্র হুইসলের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে আর-একটা শব্দ শোনা যায়৷ লেডিস কম্পার্টমেন্ট যেখানে থামে, তার ঠিক আগের জায়গাটায় কিছু লোকজন হইহল্লা করে উঠেছে৷ যেন আতঙ্ক আর হাহাকার মিশ্রিত একটা শব্দ করে উঠেছে সবাই৷
‘কী হয়েছে রে?’ সাগরিকা উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করে৷ রুনু সাগরিকার থেকে খানিকটা এগিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল৷ সে আতঙ্কিত মুখে পিছিয়ে আসে, ‘একজন লাইনের উপর পড়ে গিয়েছে৷ ওঃ… কেউ একটু নেমে…’
একটা অদম্য কৌতূহল সাগরিকাকে প্ল্যাটফর্মের কিনারায় টেনে আনে৷ সে চেয়ে দ্যাখে লাইনের ঠিক উপরে একটা মানুষের দেহ পড়ে আছে৷ মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে দেহটা৷ যেন এইমাত্র কেউ প্ল্যাটফর্ম থেকে ঠেলে লাইনের উপরে ফেলে দিয়েছে তাকে৷ প্ল্যাটফর্ম কাঁপিয়ে তার দিকে ধেয়ে আসছে দানবাকৃতি ট্রেনটা৷ চোখ বন্ধ করার আগে ও দ্যাখে লাইনের উপরে পড়ে-থাকা মানুষটার গায়ে একটা কালো টি-শার্ট, লাইন থেকে কিছুটা দূরে ছিটকে পড়েছে একটা চেনা ক্যাপ৷
(২)
মেয়েটাকে প্রথম দেখে অদ্ভুত লাগার চেয়ে মনে হয়, আগ্রহটাই হয়েছিল বেশি৷ ছিপছিপে স্মার্ট চেহারা৷ দেখেই বোঝা যায় উচ্চবিত্ত ঘরের মেয়ে৷ গায়ের রং কালোর দিকে৷ রোজই একটা সালোয়ার-কামিজ পরে আমার পাশের বেঞ্চে এসে বসে ও৷ হাতে একটা চামড়ার খয়েরি সাইডব্যাগ৷ চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো৷ মুখেও শৌখিনতার ছাপ৷
পার্কের বেঞ্চে বসে একটানা সামনে তাকিয়ে থাকে ও৷ মনে হয় যেন কিছু ভাবে৷ বিকেলের দিকে এই পার্কে অনেকেই হাঁটতে আসে৷ তবে এ মেয়েটা মোটেই তাদের মতো নয়৷ দেখে বোঝা যায়, ও বাড়ি থেকে নয়, আসছে অফিস থেকে৷ আগে ভেবেছিলাম হয়তো ছুটির পরে অফিস ফিরতি পার্কে এসে বসে৷ আজ বুঝলাম ব্যাপারটা অত সহজ কিছু নয়৷ পার্কে এসে বসার পিছনে কিছু উদ্দেশ্য আছে ওর৷
আমি রোজ বিকেলের দিকে জিমিকে ঘোরাতে নিয়ে আসি এখানে৷ একসময় পুলিশের কে-নাইন ডগ স্কোয়াডে ছিল জিমি৷ জাতে জার্মান শেফার্ড৷ ঘ্রাণশক্তি কাজে লাগিয়ে অপরাধীকে খুঁজে বের করায় সে সিদ্ধহস্ত৷ শেষ-বয়সে খানিকটা বুড়িয়ে যাওয়ায় কাজ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে তাকে৷ তবে রোজ বিকেলের দিকটা খানিকটা খোলা হাওয়ায় ছুটোছুটি করতে না দিলে ভারী বিরক্ত হয় সে৷
পার্কের চারদিকটা রেলিং দিয়ে ঘেরা বলে জিমির বাইরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই৷ আমি তার গলার বকলস খুলে দিয়ে বেঞ্চে এসে বসি কিছুক্ষণ৷ ঘণ্টাখানেক পরে আবার বাড়ি ফিরে যাই৷
সপ্তাহখানেক হল লক্ষ করছি, রোজই আসছে মেয়েটা৷ পার্কের বেঞ্চে আমার ঠিক পাশেই বসছে৷ মিনিট তিরিশেক কী যেন ভাবছে৷ সেইভাবে আধ ঘণ্টা বসে থেকে উঠে চলে যাচ্ছে আবার৷ ব্যাপারটায় এতদিন আলাদা করে কিছু মনে হয়নি৷ কিন্তু আজ ওর আচরণ দেখেই কেমন অদ্ভুত লাগল আমার৷ আজ আমি এসে বসার প্রায় মিনিট দশেক পরে ঝড়ের মতো পার্কের ভিতরে ঢুকে একরকম দৌড়োতে দৌড়োতেই আমার পাশটায় এসে বসে পড়ল ও৷ যেন আর-একটু হলেই জায়গাটা দখল করে নিত কেউ৷ চারপাশে মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম৷ নাঃ, কেউ তো নেই৷ তাহলে এত হুড়োহুড়ির কী আছে?
তাড়াহুড়োতে ওর হ্যান্ডব্যাগটা ছিটকে আমার কোলের উপর এসে পড়েছিল৷ সেটা সরিয়ে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ব্যাগ খুলে বোতল বের করে একটোক জল খেল মেয়েটা৷ সম্ভবত দ্রুত দৌড়োতে গিয়েই হাঁপিয়ে গিয়েছে৷ জল খেয়ে ক্লান্ত গলায় বলল, ‘কিছু মনে করবেন না প্লিজ৷ আসলে…’ ভিতরে ভিতরে কৌতূহলটা বেড়ে উঠছিল৷ ওর দিকে চেয়ে একটু হেসে বললাম, ‘না না, মনে করার কী আছে, তাড়া থাকলে অমন হতেই পারে৷’
‘ঠিক তাড়া নয়, ভয়৷’
মেয়েটা শেষ শব্দটা এমন করে উচ্চারণ করল যেন সেটা মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছে ওর৷ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কীসের ভয় বলুন তো?’
‘যদি মিস হয়ে যায় কিছু…’
আমার অদ্ভুত লাগল কথাটা৷ ট্রেন ধরতে মিস হয়ে যাওয়ার ভয় থাকতে পারে মানুষের৷ পার্কের বেঞ্চ দখলে ভয়ের কী আছে?
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকল ও৷ কিছু বলতে গিয়েও যেন বলল না৷ মনে হল, প্রসঙ্গটা পালটাতেই বলল, ‘আপনাকে তো রোজ দেখি না এখানে৷ অন্যদিন অফিস থাকে বুঝি?’
আমি একটু হাসলাম, ‘অফিস আমার নেই আপাতত৷’
‘কেন বলুন তো? আচ্ছা, আপনার অফিসটা কীসের?’
আমি বেঞ্চের একদিকের হাতলে হাত রাখলাম, মুখ সরিয়ে নিলাম ওর দিক থেকে, ‘পুলিশে কাজ করতাম৷ আপাতত মাসখানেক কম্পালসরি লিভে আছি৷’
‘কেন?’ প্রশ্নটা করেই লাজুক হাসে মেয়েটা, ‘ইয়ে… মানে আপনার যদি বলতে অসুবিধা না থাকে৷’
‘একজন দাগি ক্রিমিনালকে চেজ করতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্টালি আমার হাত থেকে গুলি বেরিয়ে যায়৷ লোকটার ঘাড়ের কাছে গুলি লাগে৷ পরে হসপিটালে মারা যায়৷’
‘কিন্তু এতে লিভের কী আছে, লোকটা ক্রিমিনাল ছিল যখন…’
‘সেটা কেবল আমি জানতাম৷ এভিডেন্স ছিল না কিছু৷ দীর্ঘদিন চাইল্ড ট্রাফিকিং-এর একটা গ্যাংকে ট্র্যাক করছিলাম আমরা৷ মেটিয়াবুরুজে একটা ঠেক ছিল ওদের৷ সেখানে হানা দিয়ে প্রায় সব ক-টাকেই ফ্রিজ করি, কিন্তু একটা পাখি পালিয়ে যায়৷ সেটাকে চেজ করতে গিয়েই…’
‘গুলিটা অ্যাক্সিডেন্টালি চলেনি, তা-ই না?’
আমি কিছু বললাম না৷ মেয়েটা আবার বলল, ‘আচ্ছা ধরুন, লোকটা ওই গ্যাং-এর কেউ ছিল না৷ হয়তো একটা সাধারণ লোক, কোনওভাবে সেদিন ওই ঠেকের আড্ডার মধ্যে ভিড়ে গেছিল৷ পুলিশের ভয়ে পালাতে শুরু করে…’
একটু বাঁকা হাসি হাসলাম আমি, ‘পনেরো বছর পুলিশে চাকরি করছি৷ এতটা ভুল হয় না আমার৷ মোটিভ যদি থাকে, সারকামস্টেনশিয়াল এভিডেন্স যদি থাকে, হাবভাব যদি সন্দেহজনক হয় তাহলে সাসপেক্ট ক্রিমিনাল কি-না আমি চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি…’
‘দেখে যা মনে হয়, মন, অভিজ্ঞতা যা বলে তা-ই কি সত্যি হয় সবসময়? তার মাঝেও তো অনেক কিছু থাকে, তাই না?’ উদাস গলায় বলে মেয়েটা৷ আমি আর উত্তর দিই না৷
শুকনো হাসি হেসে মুখ ঘুরিয়ে নেয় ও৷ তারপর আবার তাকিয়ে থাকে সামনে৷ সেদিকে দেখার মতো আহামরি কিছু নেই৷ পার্কের উলটোদিকে একটা বেসরকারি হসপিটালের বিল্ডিং চোখে পড়ে৷ চৌকো পার্কটাকে ঘিরে রাস্তা৷ তার লাগোয়া হাসপাতালের প্রবেশপথ৷ সেদিকেই স্থির নেত্রে তাকিয়ে আছে মেয়েটা৷
‘একটা প্রশ্ন করব? যদি কিছু মনে না করেন…’ ইতস্তত করে বলেই ফেললাম৷
মেয়েটা অন্যমনস্ক হয়ে জবাব দিল, ‘অ্যাঁ? হ্যাঁ হ্যাঁ৷ করুন-না৷’
‘আমি যে ক-দিন এখানে এসেছি রোজই দেখছি, আপনি বেঞ্চের ঠিক এখানে এসেই বসেন৷ একই দিকে চেয়ে থাকেন৷ কোনও বিশেষ কারণ…’
মেয়েটার গলকণ্ঠটা ওঠানামা করল একবার, ‘আসলে একজনের সঙ্গে এখানে দেখা হত আমার৷ সে আর আসে না৷ তাই আমি একাই…’
দুঃখের সুরেই বলল ও৷ তা-ও জানি না কেন আমার মনে হল, কথাগুলো বানিয়ে বলছে৷ থুতনিটা খানিক ঝুলে গেল কি?
‘আপনার বিশেষ কেউ…’
‘আমার বয়ফ্রেন্ড… এক্স-বয়ফ্রেন্ড…’
এইবার কিন্তু তার গলার পর্দা সত্যি কেঁপে গেল৷ বুঝলাম এ কথাগুলো আর বানিয়ে-বলা নয়৷
আমি লজ্জিত গলায় বললাম, ‘সরি৷ আমি আসলে আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি৷ তা ছাড়া এভাবে অন্যের ব্যাপারে আগ্রহ…’
মেয়েটাকে বরং উৎসাহিত দেখাল, ‘আরে না না৷ আমিও অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম, কথাগুলো খুলে বলব কাউকে৷ এসব কথা চেনা লোককে বললে সমস্যা হবে, বুঝতেই পারছেন৷ আপনাকে চিনি না-জানি না৷ মন হালকা হবে একটু৷’
‘বেশ, বলুন তাহলে৷’
মেয়েটার জন্য কিছুটা খারাপ লাগল আমার৷ ছেলেটিকে হয়তো এখনও ভালোবাসে, কিন্তু কারও কাছে সেটা প্রকাশ করতে পারে না৷ মেয়েটা কী যেন ভেবে নিয়ে বলতে আরম্ভ করল, ‘কলেজ লাইফ থেকে ওর সঙ্গে সম্পর্ক আমার৷ সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল৷ এমন সময়…’ ও কথাটা এগোতে পারল না৷ তার আগেই একটা ঘটি-গরমওয়ালা এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের সামনে৷ আমার দিকে চেয়ে একটু হেসে ও বলল, ‘ঘটি গরম খাবেন? অফিস থেকে ফিরতে তাড়াহুড়োতে কিছু খাওয়া হয়নি৷ বড্ড খিদে পেয়েছে৷’
মাথা নেড়ে দিলাম৷ ও ব্যাগ থেকে টাকা বের করে ঘটি-গরমওয়ালাকে দিল৷ আমি বাধা দিতে যাচ্ছিলাম, ও শুনল না৷ বলল, ‘না না, আপনাকে গল্প বলে হালকা হতে পারছি৷ এর তো একটা দাম আছে না কী?’ আমি একরকম জোর করে টাকাটা মিটিয়ে দিতেই মেয়েটা গম্ভীর হয়ে বলল, ‘এটা কিন্তু ঠিক করলেন না৷ আচ্ছা দাঁড়ান, আমি একটা জিনিস দিচ্ছি আপনাকে৷’
‘কী?’
সাইডব্যাগের ভিতর হাত ঢুকিয়ে কী যেন একটা বের করে আনল ও, ‘এই নিন৷ এটা আপনার৷’
তাকিয়ে দেখলাম প্যাকেটের ভিতরে একগুচ্ছ টকটকে লাল ভেজা গোলাপ৷ তার মধ্যে থেকেই একটা আমার দিকে এগিয়ে দিল ও, ‘আমি ফুল কিনি রোজ৷ ঘর সাজাই৷ নেশা বলতে পারেন৷’
কথা না বাড়িয়ে সেটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে পকেটে ঢুকিয়ে নিলাম৷ ফুল-টুল নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই আমার৷
ঘটি-গরম মুখে দিয়ে সে যেন গল্পের কথা ভুলেই গেল৷ আবার একমনে তাকিয়ে থাকল সামনের দিকে৷ সবুজ পার্ক জুড়ে এখন কিছু বাচ্চা বুড়ো হাঁটাহাঁটি করছে৷ একটা ঝোপের ফাঁক দিয়ে জিমিকে দেখতে পেলাম৷ এতক্ষণে বিকেলের রোদ মরে এসেছে৷ ঠান্ডা বাতাস খেলা করে যাচ্ছে আমাদের ঘিরে৷ মনটা হালকা হয়ে গেল৷
জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল কী করে?’
মেয়েটার মুখে করুণ হাসি খেলল৷ বলল, ‘ছাড়াছাড়ি ঠিক নয়৷ আমি নিজেই ওকে আমার সঙ্গে মেলামেশা করতে বারণ করেছিলাম৷ ও রাজি হয়নি বলে অপদস্থও করেছিলাম৷ আসলে তখনও বুঝিনি…’
‘কী?’
জানি না কেন মনে হল, মেয়েটার গলার স্বরে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন এসেছে৷ যেন আগের কথাগুলোর সঙ্গে এই কথাটার কোনও যোগাযোগ নেই৷ অথচ সেটা যে আছে তা কথাগুলো শুনলেই বোঝা যায়, ‘বুঝিনি যে একদিন ভালোবাসার সুযোগটা এভাবে এসে যাবে৷’
‘সুযোগ? কেমন সুযোগ?’ আমার কৌতূহলটা ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছিল৷ সেই সঙ্গে এ-ও বুঝতে পারছিলাম, এই নিয়ে প্রশ্ন করতে থাকলে ব্যক্তিগত পরিসরে নাক গলানোর মতো শোনাবে৷ ও কিন্তু বলে চলল, ‘হ্যাঁ, সুযোগ৷ আগে কোনওদিন পাইনি৷ আগেও অনেকগুলো সম্পর্কে জড়িয়েছিলাম৷ জানেন? একটাও টেকেনি৷’
আমার মনে হল, মেয়েটা আজ মন খুলে কথা বলতেই বসেছে৷ হয়তো পরিচিত কারও সঙ্গে এতগুলো ব্যক্তিগত কথা এর আগে ভাগ করে নিতে পারেনি ও৷
‘আমার দিক থেকেই টেকেনি৷ আমার নিজেরই কিছু সমস্যা আছে মনে হয়…’
আমি আর কথা বললাম না৷ কেমন যেন অসংলগ্ন কথাবার্তা মেয়েটার৷
কথাগুলোর কিছু একটা মানে আছে হয়তো৷ তবে সেটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়৷
কয়েকটা নিস্তব্ধ মুহূর্ত কেটে গেল৷ মেয়েটা এখনও সামনের দিকে তাকিয়ে আছে একমনে৷ চোখে পড়ল, হসপিটালের সামনে কয়েকটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে৷ একদল লোক স্ট্রেচারে করে কিছু রোগীকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে৷
‘ঝাল একটু বেশি দিয়েছে, তা-ই না?’ ঘটি-গরমটার দিকে চেয়ে মেয়েটা বলল, ‘আমি আবার একদম ঝাল খেতে পারি না৷’
‘কই? আমার তো তেমন লাগছে না৷’
মেয়েটা ঠোঁট ওলটায়, ‘আচ্ছা, আপনাকে তো গল্পটা বলাই হল না৷ আজকাল সব কিছু খুব ভুলে যাই, জানেন…’
আমি হেলান দিয়ে বসলাম, ঘড়ি দেখে বললাম, ‘আপনি তো আরও কুড়ি মিনিট আছেন৷ ধীরেসুস্থে বলবেন না হয়৷’
‘আমি যে আধ ঘণ্টা থাকি, সেটা খেয়াল করেছেন দেখছি…’ মিষ্টি করে হাসল ও৷
‘না-করার কী আছে?’
মেয়েটা একবার আমার দিকে তাকিয়েই আবার মুখ ঘুরিয়ে নেয়, বলে, ‘যারা আমার জীবনে এসেছিল তাদের সবাইকেই আমি ভুলে গিয়েছি৷ কিন্তু রণিত আমার সত্যিকারের প্রেম৷ ওকে আমি ভালোবাসি৷ আগেও হয়তো বাসতাম৷ এখন তো আরও বেশি…’
খেয়াল করলাম, মেয়েটার চোখের পাতা দুটো ভিজে উঠেছে৷ হাতের ব্যাগটা শক্ত করে খামচে ধরেছে ও৷ আমার দিকে ফিরে ভাবুক গলায় বলল, ‘এমন কেন হয় বলুন তো? আমরা যাকে ভালোবাসি, তার সঙ্গে কিছুতেই থাকতে পারি না৷’
‘এর উত্তর তো আমার কাছে নেই৷ তবে আপনার সমস্যাটা জানতে পারলে কিছুটা সাহায্য করতে পারতাম৷’
আমার কথাতে যেন পাত্তাই দিল না মেয়েটা৷ আগের মতোই করুণ গলায় বলল, ‘আমার খুব ভয় করে, ভীষণ ভয় করে…’
‘কীসের ভয়?’
‘হয়তো ওর কাছকাছি থাকা কোনওদিন হবে না আমার, তবু মৃত্যুর পরেও ওকে ভালোবেসে যাব আমি৷’
আমি আর কী বলব, ভেবে পেলাম না৷ মেয়েটার জন্য খারাপও লাগছে, আবার ওকে কী বলে বোঝাব, সেটাও বুঝতে পারছি না৷ সত্যি কোনও মানসিক সমস্যা আছে মেয়েটার? অবশ্য এই ভালোবাসা জিনিসটাই গোলমেলে৷ আচমকাই ঘটি-গরমের প্যাকেট ফেলে উঠে দাঁড়াল মেয়েটা৷ এতক্ষণ ওর চোখ দুটো ছলছল করছিল৷ এবার যেন আতঙ্কে শিউরে উঠল৷
‘আমি… আমি আজ যাই৷ দেরি হয়ে যাচ্ছে৷’
কথাটা বলেই সে হনহন করে পার্কের গেটের দিকে পা বাড়াল৷ আমি থতমত খেয়ে গলা তুলে বললাম, ‘সেকি! আপনার আধ ঘণ্টা তো হয়নি এখনও৷’
মেয়েটা কোনও উত্তর দিল না৷ দ্রুত মিলিয়ে গেল বাইরের রাস্তার দিকে৷ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম৷ জিমি এগিয়ে এসে মুখ ঘষতে লাগল আমার হাঁটুর কাছে৷
তাকে নিয়ে পার্কের ভিতরের দিকে হেঁটে আসতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় একটা ব্যাপার খেয়াল হল৷ পার্কের উলটোদিকের গেট থেকে হেঁটে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে একটা লোক৷ জানি না কেন মনে হল, এই লোকটাকে দেখতে পেয়েই তড়িঘড়ি সরে পড়ল মেয়েটা৷ তবে কি এই সেই এক্স-বয়ফ্রেন্ড?
লোকটা কিন্তু আমাকে খেয়ালও করেনি৷ সে ধীরেসুস্থে এসে আমার থেকে মিটারখানেক দূরে দাঁড়াল৷ তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগল৷ ভেবেছিলাম, ব্যাপারটা নিয়ে আর মাথা ঘামাব না৷ তা-ও ক-টা প্রশ্ন জাগল মনে৷ মেয়েটা কি জানত, ছেলেটা এখানে আসবে? যদি তার সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যেই ও এখানে এসে থাকে তাহলে এমন আচমকা উঠে পালাল কেন? গলাখাঁকারি দিয়ে লোকটার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিছু মনে করবেন না৷ আপনিই কি রণিত?’
লোকটা একবার অবাক হয়ে মুখ তুলে তাকাল আমার দিকে, ‘না৷ রণিত আমার মাসতুতো ভাই৷ কেন বলুন তো?’
আমি পড়লাম ফাঁপরে৷ প্রশ্নটা যখন করেই ফেলেছি তখন উত্তর না দিয়ে উপায় নেই, বললাম, ‘না, আসলে এতক্ষণ এখানে একটা মেয়ে বসে ছিল৷ রণিত বলে একজনের কথা বলছিল৷ মনে হল, আপনাকে দেখেই পালিয়ে গেল৷’
‘মেয়ে! কেমন দেখতে?’
উত্তর দিতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই লোকটা থামিয়ে দিল আমাকে, ‘মাঝারি হাইট? হাতে একটা চামড়ার সাইডব্যাগ ছিল? তা-ই তো? ওর নাম কাকলি৷ কিছুদিন হল স্টক করতে শুরু করেছে৷ মেয়েটার মাথা খারাপ আছে৷’
‘হ্যাঁ৷ উনি নিজেও বলছিলেন, কিছু সমস্যা আছে ওঁর৷’
‘সমস্যা-টমস্যা নয়,’ লোকটা কাঁধ ঝাঁকায়, ‘বড়োলোকের বকে-যাওয়া মেয়ে৷ বুঝলেন কি না? ওদের আজ একটা ছেলে তো কাল আর একজন৷ রণিতকেও তো ফাঁসিয়েছিল ওইভাবেই৷’
‘বটে৷ কিন্তু ওঁর কথা শুনে মনে হল, এখনও…’
‘আরে রাখুন মশাই৷ সব চেনা আছে আমার৷ ওকে নিয়ে কম ভুগতে হয়েছে আমাদের? ছেলেটা একসময় নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল৷ সারাদিন দরজা বন্ধ করে একটা ঘরে পড়ে থাকত৷ কাকলি নাকি ওর সঙ্গে আর থাকতে চায় না৷’
‘কেন?’
‘কেন, সে কি আর জানি ছাই? রণিতকেও কিছু জানায়নি৷ জিজ্ঞেস করলে অপমান, অপদস্থ করত৷ বন্ধুবান্ধবের সামনে চড়ও মেরেছিল একবার৷ আমরা জানতে পেরে ওদের মেলামেশা বন্ধ করে দিই৷’
লোকটা সিগারেটে আর-একটা লম্বা টান দিয়ে একটু আগে কাকলি যেখানে বসেছিল ঠিক সেখানেই গিয়ে বসে পড়ল৷
এতক্ষণে ব্যাপার খানিকটা পরিষ্কার হল আমার কাছে৷ কোনও কারণে রণিতকে প্রত্যাখ্যান করে কাকলি৷ কিছুদিন পরে নিজের ভুল বুঝতে পারে৷ হয়তো অনুতপ্তও হয়৷ তারপর থেকেই তার ভালোবাসা নতুন করে জেগে ওঠে৷ এ জিনিস তো আজকাল আকছার হচ্ছে৷
লোকটার পাশে গিয়ে আবার বসে পড়ে বললাম, ‘তখন বললেন, উনি নাকি স্টক করছেন৷ রণিত কি এই পার্কে…’
‘হসপিটালে৷’ লোকটা আঙুল তুলে হসপিটাল বিল্ডিংটা দেখায়, ‘এক মাস হল ওখানেই আছে ও৷ কন্ডিশন ভালো নয়৷ আমি আজ ওকে দেখতেই এসেছিলাম৷’
জিমি আবার দৌড়ে সরে গেল৷ পার্কের অন্য প্রান্তে আরও কয়েকজন কুকুর নিয়ে এসেছে৷ সেদিক লক্ষ করেই দৌড় দিল৷
‘কী হয়েছে ওঁর?’
‘মাসখানেক আগে অফিসে যাওয়ার জন্য ট্রেন ধরতে গিয়েছিল৷ পা হড়কে লাইনের উপরে পড়ে যায়৷ তখনই ট্রেন ঢুকছিল৷ লোকজন মিলে ট্রেন থামিয়ে ওকে উপরে তোলে৷ কিন্তু মাথায় ভয়ংকর চোট লেগেছিল৷ ইন্টারনাল হ্যামারেজ৷ তারপর থেকেই কোমায় চলে গিয়েছে৷’
আমি আর কিছু বললাম না৷ মিনিটখানেক সেখানে বসে থেকে উঠে পড়লাম৷ বাড়ি ফেরার সময় হয়েছে৷ একটু পরেই অন্ধকার নেমে পড়বে৷
লোকটাও সিগারেট শেষ করে উঠে পড়েছে৷ হসপিটালের দিকে এগিয়ে গেছে সে-ও৷
পার্কের বাইরে আসতেই পিছন থেকে সেই মেয়েলি গলাটা শুনতে পেলাম, ‘একটু শুনবেন প্লিজ?’
দেখলাম সেই মেয়েটা৷ ভয়-ভয় চোখে পেছন থেকে আমাকে ডাকছে সে৷ এতক্ষণ কি তাহলে নজর রাখছিল আমার উপর?
আমি এগিয়ে গেলাম, ‘আপনি লুকিয়ে পড়লেন কেন বলুন তো?’
‘উনি আমাকে ঠিক পছন্দ করেন না৷ ও কেমন আছে?’ উদ্বিগ্ন মুখে প্রশ্ন করল মেয়েটা৷
‘তা তো আমি জিজ্ঞেস করিনি৷ তবে শুনে মনে হল, অবস্থা খুব একটা ভালো নয়৷’
মেয়েটার মুখে কয়েকটা অচেনা রেখা দেখা দিল, গালের উপরে ভাঁজ পড়ল কিছু, মনে হল, আর-একটু হলেই কেঁদে ফেলবে ও, ‘বিশ্বাস করুন৷ আমি ঠেলা দিইনি ওকে…’
অজান্তেই আমার মেরুদণ্ড সোজা হয়ে গেল, ‘আপনি! আপনি স্টেশনে ঠেলা দিয়েছিলেন ওঁকে?’
‘দিইনি, বিশ্বাস করুন৷ ওরা আমার নামে বলে বেড়াচ্ছে এসব৷’
‘কই, আমাকে তো তেমন কিছু বললেন না!’
‘বলেনি?’
মেয়েটা অবাক হয়ে তাকায় আমার দিকে, ‘ওরা আমাকে একদম পছন্দ করে না৷ বলে আমি নাকি ওকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দিয়েছি৷ কিন্তু কী করে বোঝাব, আমি ওর ভালোর জন্যেই ওকে ছেড়ে…’
চাপা একটা আগ্রহ জন্মাতে শুরু করেছে আমার মনে৷ সেটা দমন করে মুখে একটা বিরক্তির ভাব এনে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘দেখুন, আমার মনে হয়, আপনার রোজ এভাবে পার্কের বেঞ্চে বসে হাসপাতালের দিকে চেয়ে থাকাটা এক ধরনের পাগলামো৷ যাকে একদিন নিজেই ছাড়তে চেয়েছিলেন, আজ কেন তার জন্য এতটা ভাবনাচিন্তা করছেন জানি না৷ তবে উনি নিজে মানিয়ে নিয়েছেন যখন তখন আপনার এখান থেকে বেরিয়ে আসাই ভালো৷’
মেয়েটা কিছু বুঝল কি না জানি না৷ তবে আর কোনও কথা বলল না ও৷ নিজের মনেই কিছু বিড়বিড় করতে করতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলে গেল৷ জিমিকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে জানি না কেন মেয়েটার মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল আমার৷ প্যান্টের পকেটে ওর দিয়ে-যাওয়া ভেজা গোলাপটা ঠান্ডা স্পর্শে উপস্থিতি জানান দিচ্ছে পায়ে৷ অসহায়, করুণ একটা মুখ৷ ছেলেটিকে যে কাকলি সত্যি ভালোবাসে, তাতে সন্দেহ নেই৷ আগে কি তবে খেয়ালবশেই কেবল ছাড়তে চেয়েছিল ওকে? তা ছাড়া ছেলেটার বাড়ির লোক যখন ট্রেনের ব্যাপারটাকে অ্যাক্সিডেন্ট বলেই ধরে নিয়েছে তখন মেয়েটা আগ বাড়িয়ে একটা অচেনা মানুষের কাছে স্বীকারোক্তি দিতে গেল কেন?
এর পিছনে কিছু একটা রহস্য আছে৷ কোথাও যেন একটা অপরাধেরও গন্ধ পাচ্ছি৷ নাঃ, ব্যাপার যতটা সহজ মনে হচ্ছে, ঠিক ততটা নয়৷
চাকরি না থাকলেও পুলিশি স্বভাবটা মনে হয় এত সহজে ঘোচে না৷ সেদিন বাড়ি ফেরার পর থেকেই কাকলিকে নিয়ে আমার আগ্রহ বেড়ে উঠতে থাকে৷ রণিতের বাড়ির লোকের কাকলিকে নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই৷ তবে কাকলি আগের মতোই পার্কে এসে হাসপাতালের দিকে চেয়ে থাকে৷ অবশ্য তাতে আপত্তিও করা যায় না কিছু৷ তবে বিকেল হলেই পার্কে যাবার একটা তাগিদ চেপে বসে আমার উপর৷ দেখাও হয় কাকলির সঙ্গে৷ রোজই মনে হয়, আমাকে কিছু একটা কথা বলতে চায় ও, কিন্তু সাহস করে বলতে পারে না৷ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমার কাছে কিছু একটা স্বীকার করতে চায় ও৷ কী সেটা?
আজ পার্কের সামনে পৌঁছে গেট খুলে ঢোকার আগে উঁকি দিলাম বেঞ্চের উপর৷ নাঃ আজ ফাঁকা৷ সেটাকে ঘিরে কয়েকটা বাচ্চা ছেলে ধরাধরি খেলছে৷ মানে এখনও এসে পৌঁছয়নি কাকলি৷ এত দেরি তো সচরাচর করে না ও৷ ভিতরে ঢুকে জিমির গলার বকলস খুলে দিলাম৷ সে ছাড়া পেয়ে একদৌড়ে হারিয়ে গেল পার্কের মধ্যে৷ আমি চারপাশটা ভালো করে খেয়াল করলাম একবার৷ নাঃ, সত্যি মেয়েটার কোনও চিহ্ন নেই আজ৷ মনে মনে একটু হাসি পেল৷ এতদিনে হয়তো ভয় পেয়েই প্রেমে ভঙ্গ দিয়েছে৷
নিশ্চিন্ত হয়ে বেঞ্চে বসতে যাব, এমন সময় দূরের দিকে চাইতেই একটা ব্যাপার চোখে পড়ল৷ হসপিটাল বিল্ডিং-এর একেবারে সামনে একটা ছোটোখাটো ভিড় জমেছে৷ কোনও একটা কারণে উত্তেজিত হয়ে হাত-পা ছুঁড়ে কথা বলছে কিছু মানুষ৷
অন্যসময় হলে তেমন গুরুত্ব দিতাম না৷ কিন্তু আজ মনের ভিতরে একটা চাপা কৌতূহল দ্যাখা দিল৷
পার্কটা পার করে হেঁটে এলাম হাসপাতালের কাছে৷ আসতেই সেদিনের লোকটাকে দেখতে পেলাম৷ ওয়েটিং রুমের বাইরে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে-থাকা কয়েকটা লোককে তুমুল ধমক ধামক দিচ্ছেন৷
জায়গাটাকে ঘিরে কিছু উৎসাহী লোকজন ভিড় করেছে৷ তাদের মধ্যে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে বলুন তো? এত গোলমাল কীসের?’
লোকটা নাক বাঁকাল, ‘কী জানি দাদা৷ শুনছি, একটা ডেডবডি নাকি গায়েব হয়ে গিয়েছে!’
‘বডি গায়েব? কার?’
‘ওঁর ভাইয়ের মনে হয়৷’ আঙুল তুলে সেই লোকটাকে দেখিয়ে দিলেন ভদ্রলোক৷
ডেডবডি? মানে রণিত মারা গেছে? যত দূর সম্ভব আজই মারা গিয়েছে সে৷ কিন্তু হসপিটাল থেকে ডেডবডি গায়েব হবে কেন?
জানি না কেন বিশ্বাস হল না কথাটা৷ ভালো করে বোঝার চেষ্টা করলাম৷ চিৎকার চেঁচামেচির মাঝে যেটুকু বুঝলাম, তাতে মনে হল, ঘণ্টাখানেক আগেই রণিতকে মৃত ঘোষণা করেছে হসপিটাল অথরিটি৷ তারপরেই এখানে কিছু গোলমাল হয়৷ দুটো অপরিচিত তাগড়াই লোক নাকি কোন ফাঁকে ঢুকে পড়েছিল হাসপাতালের ভিতরে৷ তারাই সরিয়েছে বডিটা৷ লোকগুলো এমনভাবেই ঢুকেছিল যে তাদের মুখ দেখা যায়নি৷
অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ৷ একটা আধুনিক হসপিটালের ভিতর থেকে এতগুলো লোকের সামনে একটা বডি গায়েব হবে কী করে? আর যদি হয়ও-বা, তার কারণই বা কী?
মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছিল৷ সেদিনের সেই লোকটার যা মেজাজ তাতে আজ আপাতত আর তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে ভরসা হল না৷ সিদ্ধান্ত নিলাম, এ ব্যাপারটা নিয়ে আর মাথা ঘামাব না৷ পায়ে পায়ে হেঁটে আবার বেঞ্চের কাছে ফিরে এলাম৷
হেলান দিয়ে বসে খানিক আড়মোড়া ভাঙলাম৷ আশপাশে তাকাতে আগের দিনের সেই ঘটি-গরমওয়ালাকে দেখতে পেলাম৷ হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকলাম ওকে৷
‘দাও দেখি একটা বেশি ঝাল দিয়ে৷’
‘অন্যদিন তো দুইটা নেন…’
আমি হাসলাম, ‘আজ একটাই দাও৷ উনি তো নেই আজ৷’
‘ছিলেন তো৷ সঙ্গে দুইটা লোকও ছিল৷’
আমি সোজা হয়ে বসলাম, ‘দুটো লোক? ঠিক দেখেছ তুমি?’
লোকটা উপরে-নীচে মাথা নাড়ল৷ মনে হল, আমাকে আরও কিছু যেন বলতে চায় লোকটা৷ আমি কয়েক সেকেন্ড তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে সে বলল, ‘আজ খুব তাড়াহুড়োয় ছিলেন৷ এইটা ফেলে গিয়েছেন৷ আমি দেখতে পেয়ে তুলে রেখেছি৷’
লোকটা ওর হাতের থলের ভিতর থেকে বের করে দিল খয়েরি চামড়ার ব্যাগ৷ কাকলির হ্যান্ডব্যাগ৷ আমি হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম সেটার দিকে৷
‘উনি আজ অনেক আগে এসেছিলেন৷ লোক দুটো তখন সঙ্গে ছিল৷ তারপর লোক-দুটো চলে গেল৷ উনি এইখানে পায়চারি করছিলেন৷ মনে হল, খুব চিন্তায় আছেন৷ তারপর একটা ফোন এল৷ আমি একবার রাউন্ড দিয়ে এসে দেখি, ভুল করে ব্যাগটা ফেলে গিয়েছেন৷ ফেরত দেব বলে খুঁজতে গিয়ে আর দেখতে পেলাম না৷ আপনি তো চেনেন যদি এইটা দিয়ে দেন…
‘কোনদিকে গিয়েছে ওরা?’
লোকটা আঙুল তুলে পার্কের একটা দরজার দিকে দেখিয়ে দিল৷ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ৷ কাকলিই তাহলে চুরি করিয়েছে রণিতের দেহ? কিন্তু কেন?
আমার হাতে ব্যাগটা দিয়ে এগিয়ে গিয়েছে ঘটি-গরমওয়ালা৷ আমি কাঁপা-কাঁপা হাতে খুলে ফেললাম ব্যাগটা৷ ভিতরে কয়েকটা ফাইল রয়েছে৷ সম্ভবত সেগুলো ওর অফিসের কাগজপত্র৷ একটা পয়সার ব্যাগ আর চাবিও চোখে পড়ল৷ ব্যাগের ঠিক লাগোয়া একটা কার্ড হোল্ডার৷
একটা কার্ড হাতে তুলে দেখলাম আমি৷ কোনও মেন্টাল ইনসটিটিউশনের অ্যাপয়েন্টমেন্ট কার্ড৷ কাকলি বলছিল বটে, কিছু মানসিক সমস্যা আছে ওর৷ ব্যাগের ভিতরে আরও কয়েকটা কাগজ চোখে পড়ল৷ সেগুলো হাতে নিয়ে অবাক হয়ে গেলাম৷ হসপিটালের গেটে কখন কে ঢোকে, কোথায় যায়, কখন কোন সিসিটিভি অপারেটর আসে, এমনকি কোন কর্মচারীদের টাকাপয়সা দিয়ে হাত করা যেতে পারে, তার সব বিবরণ লেখা আছে সেগুলোতে৷ অর্থাৎ রণিত মারা গেলে তার দেহ চুরি করার প্ল্যান অনেকদিন থেকেই করছে কাকলি, কিন্তু কেন? দেহ নিয়ে গিয়েছেটাই বা কোথায়?
জিমি এতক্ষণে ফিরে এসেছে আমার কাছাকাছি৷ একটা বুদ্ধি খেলে গেল আমার মাথায়৷ এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তরের কাছে আমাকে পৌঁছে দিতে পারে জিমি৷ পুলিশের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কে-নাইন জার্মান শেফার্ড৷
চামড়ার ব্যাগটা এগিয়ে দিলাম জিমির নাকের কাছে৷ বহুদিন পরে এই চেনা অনুরোধটা বুঝতে একটু সময় লাগল তার৷ কয়েকবার সেটা শুঁকল জিমি৷ তারপর মুখ তুলে ব্যতাস অনুভব করার চেষ্টা করল৷ অদৃশ্য কোনও আততায়ীর উদ্দেশ্যে সজোরে ধমক দিল কয়েকবার৷ পরমুহূর্তে আমার তোয়াক্কা না করে দৌড়ে গেল পার্কের খোলা দরজার দিকে৷
আমিও ছুটলাম তার পিছন পিছন৷ মৃদু ভৌ ভৌ স্বরে ডাকতে শুরু করেছে সে৷ পুরোনো খেলার আনন্দটা আবার তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে তার অস্থির পা চারটেকে৷
খানিক দূর গিয়ে পিচের রাস্তা পেরিয়ে একটা গলির ভিতরে ঢুকে পড়ল সে… তারপর আর-একটা গলি… প্রায় আধ ঘণ্টা গলিঘুঁজির ভিতর দৌড়োদৌড়ির পর মোটামুটি নির্জন গলির শেষ প্রান্তে একটা ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল জিমি৷
আমার প্যান্টের নিচের দিকটা ধরে টানতে লাগল৷ বুঝলাম, আমাকে কোথাও একটা নিয়ে যেতে চাইছে সে৷ গড়গড় করে একটা শব্দ বেরিয়ে আসছে মুখ থেকে৷
অ্যাপার্টমেন্টের ঠিক বাইরেই সিকিউরিটি গার্ড বসে ছিল৷ ঘুমে চোখ ঢুলে আসছিল ওর৷ আমি এগিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিলাম ওকে, ‘শুনছেন?’
লোকটা যেন ঘুম ভেঙে নড়েচড়ে বসল, ‘কোথায় যাবেন?’
‘কাকলি আছে?’
লোকটাকে একটু ভাবুক দেখাল, ‘কাকলি… ওহো! মিস ব্যানার্জি? উনি তো একটু আগে এলেন৷’
‘একা এসেছেন? হাতে কিছু ছিল না?’
আমার গলার স্বরে একটা কর্তৃত্ব মিশে ছিল৷ জিমির গলা থেকে গড়গড় শব্দটা বেরিয়ে আসছে এখনও৷ পালটা প্রশ্ন করার সাহস দেখাল না লোকটা, ‘হ্যাঁ৷ একাই তো এলেন৷ হাতে তো কিছু ছিল না৷’
খটকা লাগল৷ মানে ফ্ল্যাটে ঢোকার আগেই বডিটাকে কোথাও পাঠিয়ে দিয়েছে কাকলি? কিন্তু কেন? মেয়েটা চাইছেটা কী? কিছুই স্পষ্ট নয়৷ বেরিয়ে আসতে যাচ্ছিলাম৷ এমন সময় লোকটা নিজে থেকেই বলল, ‘ম্যাডাম এতদিন এই ফ্ল্যাটে আছেন, কোনওদিন জ্বরজ্বালা হতে দেখিনি, আজ মনে হয় শরীরটা ভালো ছিল না৷’
চকিতে একটা সম্ভাবনার কথা ফুটে উঠল মাথায়, ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওঁর জ্বর হয়েছে, আপনি জানলেন কী করে?’
‘আমাকে সামনের দোকান থেকে ওষুধ আনতে পাঠালেন তো৷’
‘কখন?’
‘এই তো ফেরার সময়৷ বললেন ফ্ল্যাটে গিয়ে দিয়ে আসতে৷’
আমার মাথার ভিতর বিদ্যুৎ খেলে গেল৷ মানে কাকলি ফেরার ঠিক পরপরই বেশ কিছুক্ষণ সিকিউরিটি গার্ড ফ্ল্যাটের কাছাকাছি ছিল না৷ কাকলি ইচ্ছা করেই ওষুধ আনানোর অছিলায় সরিয়ে দিয়েছিল ওকে৷ সেই ফাঁকেই লোক দুটো ফ্ল্যাটের ভিতরে চালান করেছে দেহটা৷ মানে রণিতের দেহ এখনও ফ্ল্যাটের ভিতরেই আছে৷
‘কোন ফ্লোরে থাকেন উনি?’
‘চারতলা৷ কিন্তু আপনি…’
‘মাস্টার-কি আছে এই ফ্ল্যাটের?’
‘আছে… কিন্তু…’
‘আসুন আমার সঙ্গে৷’
দ্রুত উঠে এলাম সিঁড়ি দিয়ে৷ উত্তেজনায় আমার কানের পাশের বাতাস গরম হয়ে উঠেছে৷ দৌড়ে চারতলায় পৌঁছে একটা প্যাসেজে এসে দাঁড়ালাম৷
‘শেষের ঘরটা মিস ব্যানার্জির৷’
গার্ড নিজেই সেদিকে এগিয়ে গিয়ে পকেট থেকে চাবি বের করে খুলে দিল দরজাটা৷ বন্ধ দরজার ওপার থেকে একটা স্যাক্সোফোনের মিষ্টি সুর কানে এসেছে আমার৷ সেটা ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই৷
দরজাটা খুলতেই ঘরের ভিতরটা একটু একটু করে স্পষ্ট হল চোখের সামনে৷ মাঝারি সাইজের একটা ঘর৷ দেওয়ালের ভিতরে লুকোনো আলো জ্বলছে৷ ভারী যত্ন করে নিপুণ হাতে সাজানো৷ একটা চাকুরিরতা অবিবাহিত মেয়ে এ ঘরে থাকে বলে মনে হয় না৷ এ ঘর পাকা গৃহিণীর হাতে সাজানো৷
টেবিলের উপরে কয়েকটা ছবি সাজিয়ে রাখা আছে৷ দুটো মানুষের একসঙ্গে ছবি৷ একজনকে চিনি৷
ছবির পাশেই ফুলদানির ভিতর রজনীগন্ধার স্টিক গোঁজা৷ তার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে৷ হালকা স্যাক্সোফোনের সুর বারবার মিশতে চাইছে তার সঙ্গে৷
এ ঘরের লাগোয়া একটা ছোটো ঘর৷ সেটার ভিতর থেকেই আসছে সুরটা৷ পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম সেদিকে৷ চৌকাঠের আগেই মেঝেতে কয়েকটা কাগজ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে৷ তার উপরেই পা পড়ল আমার৷
যেন ইচ্ছা করেই মেঝেতে সেগুলো ছড়িয়ে দিয়েছে কেউ৷ হাতে তুলে নিয়ে দেখলাম৷ মানসিক হাসপাতালেরই কাগজ সম্ভবত, কিছু একটা রোগের কথা লেখা আছে সেখানে৷ এ ঘরে আলো কম৷ ভালো করে পড়তে পারলাম না৷ গার্ডের মুখ এতক্ষণে হাঁ হয়ে গিয়েছে৷ ও আর এগোল না৷
অস্বাভাবিক কিছু নেই, তা-ও আমার মন বলল ওই ছোটো ঘরের ভিতরে এই মুহূর্তে কিছু একটা ঘটে চলেছে, ডানহাতটা অজান্তেই কোমরের কাছে অদৃশ্য কোনও যন্ত্রের খোঁজ করে ব্যর্থ হল৷ কাগজগুলো হাতে নিয়ে ছোটো ঘরটায় ঢুকে এলাম৷
আর ঢুকতেই আমার পা আটকে গেল৷ মুখ দিয়ে একটা শব্দ বেরিয়ে এসেছিল প্রায়৷ হাত দিয়ে চাপা দিলাম সেটা৷
ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা ছোট বিছানা৷ সাদা চাদর পাতা আছে তাতে৷ চাদর ভরে ছড়ানো আছে তাজা গোলাপের পাপড়ি৷ যেন ফুলশয্যার খাট সাজিয়েছে কেউ৷
গোলাপের পাপড়ির মাঝে শুয়ে আছে দুটো দেহ৷ একটা পুরুষের৷ অপরটা নারীর৷ দু’জনেই নগ্ন৷
পুরুষটির স্থির বক্ষের উপরে মাথা রেখে চোখ বুজে আছে মেয়েটি৷ আগের দিন পার্কে দেখা সেই মুখটাকে চিনে নিতে অসুবিধা হয়নি আমার, কাকলি৷ আতঙ্কে দেওয়ালের কাছে সরে এসেছিলাম৷ চোখ চলে গেল হাতের কাগজটার দিকে৷ কাকলির অল্প বয়সের একটা ছবি লাগানো আছে রিপোর্টটার উপর৷ ঠিক নীচেই লেখা রোগের নাম- নেক্রোফিলিয়া৷ অর্থাৎ জীবিতের বদলে মৃতদেহের উপর যৌন আকর্ষণ৷
চোখ সরে এল নীচের ছোটো লেখাগুলোতে৷ পাঁচ বছর বয়সে বিকৃত যৌন-লালসার শিকার হয় কাকলি৷ সে অভিজ্ঞতা ট্রমা হয়ে রয়ে যায় সারাজীবন৷ জীবিত আগ্রাসী পুরুষ শরীরের প্রতি ঘৃণা জন্মায় তার৷ মৃত, ক্ষমতাহীন পুরুষদেহের প্রতি জন্মায় লোভ৷
ধীরে ধীরে ছবিটা পরিষ্কার হল আমার কাছে৷ রণিতের জীবন্ত শরীরের উপরে কোনও আকর্ষণ ছিল না কাকলির৷ মৃত, শীতল শরীরে লোভ ওর৷ তাই সেদিন স্টেশনে নিজে হাতে রণিতকে খুন করে ও৷ তারপর তার মৃতদেহটা চুরি করে…
শরীরের সমস্ত কোষ নিংড়ে বেরিয়ে-আসা ক্রোধ আর ঘৃণার ঢেউ কাঁপিয়ে দিল আমাকে৷ এত বর্বর, এত বিকৃত লালসা থাকতে পারে মানুষের৷ যদি আজ সত্যি রিভলভারটা থাকত…
জানি না কেন ঠিক এই মুহূর্তে কাকলির বলা একটা পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল আমার, ‘দেখে যা মনে হয়, মন, অভিজ্ঞতা যা বলে তা-ই কি সত্যি হয় সব সময়? তার মাঝেও তো অনেক কিছু থাকে, তা-ই না?’ কী থাকে? জানি না৷ কিন্তু কথাটা মাথায় আসতেই একটা অসংগতি মনে এল আমার৷ কাকলি যদি রণিতের দেহের লোভে তাকে খুন করে থাকে তাহলে ট্রেনের সামনে ফেলে দেবে কেন? রণিতের দেহ তো একটা কুৎসিত রক্তাক্ত মাংসপিণ্ডে পরিণত হবে তাহলে৷ ট্রেন যে রণিতকে চাপা দেবে না, সেটা তো খুনির পক্ষে আগে থেকে জানা সম্ভব ছিল না৷ তাহলে?
স্যাক্সোফোনের সুর ছাপিয়ে একটা চাপা মেয়েলি স্বর কানে এল এবার, ‘রণিত, এই রণিত… শুনছ? বলেছিলাম না, তোমাকে মৃত্যুর পর আরও বেশি ভালোবাসব তোমাকে৷ শুধু ভয় পেতাম৷ তোমাকে আরও ভালোবাসতে গিয়ে হয়তো কোনওদিন নিজে হাতেই মেরে ফেলব তোমাকে৷ তাই তো দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম তোমাকে৷ কেবল আড়াল থেকে ফলো করতাম তোমাকে৷ তুমি যেখানে যেতে… দূর থেকে নজর রাখতাম৷ তারপর যেদিন পা পিছলে লাইনের উপরে পড়ে গেলে তুমি… সবার মতো আমিও কষ্ট পেয়েছিলাম খুব৷ বুক ফেটে গিয়েছিল, জানো?
যেদিন বুঝলাম, তোমার মৃত্যু আসন্ন, সেদিনও খুব কেঁদেছিলাম৷ আমি একটুও খুশি হইনি, বিশ্বাস করো৷ সব দুঃখের মাঝেও শুধু একবার… একবার ভেবেছিলাম, তোমাকে নিজের করে পাব আমি… এইভাবে… এত কাছ থেকে… ভীষণ কাছ থেকে… আর তো কোনওদিন পাব না, তা-ই না? বলো… বলো…’
কাকলির অশ্রুমিশ্রিত খলখল হাসির শব্দে ভেসে যাচ্ছে ঘরটা৷ কে বলবে যে শরীরটাকে কাছে পেয়ে ওর মুখ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে এই প্রাণোচ্ছল হাসি, সেই শরীরটা নিষ্প্রাণ?
ধীরে ধীরে পিছিয়ে এলাম আমি৷ খেয়াল করলাম, বিছানার উপরে পড়ে-থাকা গোলাপের কয়েকটা পাপড়ি শুকিয়ে দলা পাকিয়ে গেছে৷ ওই গোলাপগুলো মৃত, রজণীগন্ধার স্টিক মৃত, কোনও জড়যন্ত্রের কারসাজিতে বেরিয়ে আসছে মৃত স্যাক্সোফোনের শব্দ… অথচ তা-ও দিব্যি ওদের দিয়ে ঘর সাজিয়েছে কাকলি৷
কাল সকালে ওদের শরীরটাও শুকিয়ে আসবে৷ তখন আর গন্ধ দেবে না ওরা৷ ওদের এই রূপ… এই মাদকতা ক্ষণিকের৷ ক্ষণিকের সৌন্দর্যই গায়ে মাখতে চায় কাকলি৷ কেবল সে প্রেম-নিবেদনের সুযোগ কম তার… ভীষণ কম… কাকলির প্রেম কি তাহলে বিকৃত নয়? আরও হাজারটা স্বাভাবিক মানুষের মতো তার প্রেমও কি শাশ্বত?
দরজাটা টেনে দিয়ে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে৷ গার্ড এতক্ষণে ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আমাকে বেরিয়ে আসতে দেখে উদ্বিগ্ন মুখে প্রশ্ন করল ও, ‘কী হয়েছে ম্যাডামের?’
আমি বাইরের দরজাটা টেনে দিয়ে তার উপর একটা হাত রেখে বললাম, ‘জ্বর হয়েছে একটু৷ তবে আজ রাতে বিরক্ত না-করাই ভালো৷ কাল সকালে একটা ডাক্তার ডাকবেন না হয়৷’
‘আর আপনি কি ওঁর…’
‘আত্মীয় বলতে পারেন৷’
বাইরে বেরোতে জিমিকে চোখে পড়ল৷ এতক্ষণে বাইরেই ঘুরঘুর করছিল সে৷ সামনে হাঁটতে গিয়েও থমকে গেলাম৷ ফ্ল্যাটের ঠিক বাইরেই ছোটো বাগিচা করে ফুলের চাষ করেছে কেউ৷ নানা রকমের ফুল হয়েছে তাতে৷ গোলাপও৷
‘কে লাগিয়েছে এগুলো?’
‘মিস ব্যানার্জিরই বানানো৷ উনি ফুল-টুল খুব ভালোবাসেন৷’
কী যেন একটা খচখচ করে উঠল পকেটে৷ হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলাম জিনিসটা৷ চিনতে পারলাম৷ সেদিন কাকলির দেওয়া সেই, টাটকা লাল গোলাপটা৷ আজ শুকিয়ে গিয়েছে….