শুঁড়
‘দাদা আপনার ফোন এসেছিল, বউদি বলছিলেন…’
‘জানি জানি? সকাল থেকে ফোন ধরছি না, এই তো?’
‘হ্যাঁ স্যার, কিন্তু আপনি…’
প্রবীরের পিঠে ধাঁই করে একটা চাপড় বসিয়ে দিলাম৷ গলা নামিয়ে বললাম, ‘বউদির কথা রাখো এখন৷ বলি জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে কিছু জ্ঞানগম্যি আছে?’
‘জ্যোতি…’ একটু খাবি খেল প্রবীর, ‘স্যার আমার বাবা ঠিকুজি করিয়েছিলেন ছোটোবেলায়, তাতে লেখা ছিল আমি বড়ো হয়ে আর্মি জয়েন করব৷ দেশের জন্য যুদ্ধে গিয়ে গুলি খাব৷’
‘আর এখন ফ্ল্যাটের সিকিউরিটি গার্ড হয়ে কুকুর তাড়াচ্ছ৷ শোনো, জ্যোতির্বিজ্ঞান মানে আকাশের গ্রহনক্ষত্র নিয়ে পড়াশোনা, ওই বুজরুকি আংটি, মাদুলি ঝোলানো বাবাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই৷ একটা জিনিস এনেছি আজ, দেখলে তাক লেগে যাবে৷’
‘কী জিনিস?’
আমি চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে হাতের ব্যাগটা অল্প খুলে ফাঁক করে ভিতরটা দেখালাম৷
‘স্যার আজ বিলিতি এনেছেন, আমার কাছে ভালো চাট আছে৷ সকালেই যদুকে বলে মুরগির ঠ্যাং…’
‘ধুর শালা, চোরের মন বোঁচকার দিকে৷’ আমি খেঁকিয়ে উঠলাম, ‘বোতলটার পাশে দেখো হতভাগা৷’
এইবার মন দিয়ে দেখল প্রবীর৷ বোতলের পাশে রাখা স্বচ্ছ প্যাকেটের ভিতরের জিনিসটা মনে হল খেয়াল করল এতক্ষণে, ‘ওটা কী স্যার?’
‘ওই যে বললাম, গ্রহ নক্ষত্র৷ আপাতত আমার ব্যাগবন্দি৷ তোমার ওই মুরগির ঠ্যাং-ট্যাং যা আছে নিয়ে উপরে চলে এসো ঘণ্টাদুয়েক পরে, একটা জিনিস দেখাব৷’ আর কথা না বাড়িয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালাম, প্রবীর হঠাৎ পিছু ডেকে বলল, ‘ওঃ স্যার, আজ এইটা কিনলাম৷’
পেছনে তাকিয়ে দেখলাম আমার দিকে একটা ছোটোদের ম্যাগাজিন বাড়িয়ে ধরেছে সে, একটা দেঁতো হাসি ঝুলছে মুখে, ‘আপনার নাম দেখেই কিনলাম৷ হেব্বি লিখেছেন কিন্তু৷’
ম্যাগাজিনের কভারে আমার নামটা জ্বলজ্বল করছে, অপরেশ ঘোষ৷ আমি ভুরু কুঁচকালাম, ‘এই লেখাটা এখনই বের করে দিল৷ এই তো ক-দিন আগেই পাঠালাম…’ উপরে উঠে আজ আর তর সইছিল না৷ হাতমুখ না ধুয়েই ব্যাগ থেকে প্যাকেটটা বের করলাম আনলাম৷ তারপর ধীরেসুস্থে মুখটা খুলে বের করে আনলাম নক্ষত্রগুলোকে৷ ঘরের আলো কম, ফলে নীলচে আভা ঠিকরে বেরিয়ে ভরিয়ে দিচ্ছে ঘরটা…
প্রবীর আমার ঘরে এল ঠিক দেড় ঘণ্টা পরে৷ দরজা খুলে ভিতরে ঢুকেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ আমি একদিকের সোফায় আরাম করে বসেছিলাম৷ তাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই একটা পায়ের উপর অন্য পা তুলে দিয়ে বললাম, ‘কী বুঝছ হে!’
‘করেছেন কী স্যার!’ তেমন অবাক চোখেই সিলিংয়ের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে সে বলল, ‘কোথা থেকে কিনলেন এগুলো?’
‘এ জিনিস কি আর বাজারে কিনতে পাওয়া যায়?’ এবার আমিও মুখ তুলে তাকালাম ছাদের দিকে, আমার ঘর অন্ধকার৷ কোথাও কোনও আলো জ্বলছে না৷ অথচ সমস্ত ছাদ ভরে গেছে নীলচে আলোয়৷ তার রেশ বাকি ঘরটাকেও ডুবিয়ে রেখেছে মায়াজালে৷ সমস্ত সিলিং জুড়ে ছড়িয়ে আছে একটা আস্ত গোল চাঁদ আর ইতস্তত কিছু তারা৷ তাদের গা থেকেই বেরিয়ে আসছে নীলচে আলোটা, রাতের আকাশের মতোই এই চাঁদ তারাগুলো থেকেও আলো বেরোয়৷ আমার ছোটো ঘরটায় যেন পৃথিবীর এক অন্ধকার গোলার্ধ ফুটিয়ে তুলেছে তারা৷
‘আমার এক লেখক দাদা, বুঝলে, তার গ্যান্ডফাদার ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী৷ বিদেশে থাকতেন৷ এই সপ্তাখানেক আগে দেহ রেখেছেন৷ এ জিনিসটা ওর তৈরি একটা খেলনা বলতে পারো৷ তবে রাতের আকাশ গুলে না খেলে এ খেলনা কাজে লাগবে না৷’
‘মানে?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে প্রবীর৷
‘মানে ছাদের সিলিংয়ে শুধু চাঁদ তারা লাগিয়ে দিলেই তা থেকে আলো আসবে না৷’
‘তাহলে?’
আমি উঠে দাঁড়িয়ে ছাদের একেবারে মাঝখানে বিরাট গোল চাঁদটা দেখিয়ে বললাম, ‘মানে এই ধরো চাঁদ৷ এটা লাগালাম ছাদের একেবারে মাঝামাঝি৷ এবার বাকি তারাগুলোকে লক্ষ করো৷ এই সবক-টা তারার একটা আলাদা আলাদা নাম আছে৷ আকাশের গায়ে তাদের চেনার পদ্ধতি আছে৷ চাঁদের সাপেক্ষে যে তারাটা যেখানে থাকে সিলিংয়েও ঠিক সেখানেই সেই তারাকে স্থান দিতে হবে৷ নইলে আলো জ্বলে না৷’
‘উরিসশালা!’ এবার অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায় প্রবীর, ‘এতো রীতিমতো হ্যাপা দেখছি৷’
‘ওই লাগানোর সময় একটু হ্যাপা খালি৷ এখন আকাশের সঙ্গে মিলিয়ে রোজ চাঁদটা ছোটোবড়ো হবে, তারাগুলো দিনদিন একটু একটু করে সরে যাবে, মানে একেবারে রাতের আকাশ যেমন হয়… কেবল আমার ঘরের ছাদটুকুনির মধ্যে…’ কথাগুলো বলে ভারী মিষ্টি একটা স্বাদ পেলাম জিভে৷ প্রবীর এগিয়ে এসে আমার পাশে বসে পড়ল৷ তেমন বিস্ময় মাখা গলাতেই বলল, ‘আপনি একা একা সব জায়গামতো লাগিয়ে ফেললেন, এলেম আছে বলতে হবে৷’
হঠাৎ উঠে পড়লাম আমি৷ ঘরের আলোটা জ্বালালাম, টেবিলের উপর থেকে একটা চাকতি তুলে নিয়ে বললাম, ‘সবগুলোই লাগালাম, কিন্তু এইটা কোথায় লাগবে বুঝতে পারছি না৷’
এতক্ষণে নীল মুছে গিয়ে টিউবের সাদা আলোয় ভরে উঠেছে ঘরটা৷ আমার হাতের সাদাটে চাকতিটার দিকে চেয়ে দেখল প্রবীর৷ ইঞ্চিচারেক ব্যাসের একটা নিটোল ডিস্ক৷ চাঁদটার চেয়ে একটু ছোটো, কিন্তু তারাগুলোর থেকে বড়ো৷ বহু ভাবনাচিন্তা করেও আকাশের গায়ে চিনতে পারিনি এটাকে৷
‘এটাও কোনও তারা স্যার৷’ প্রবীর আন্দাজ করার চেষ্টা করল৷
‘হতে পারে, কিন্তু একটা খটকা লাগছে জানো?’
‘কী?’
‘খেয়াল করে দেখো এই তারাগুলোর আকৃতি আমরা রাতের আকাশে যেমন দেখতে পাই তেমন করে বানানো৷ চাঁদ আকারে অন্য নক্ষত্রগুলোর থেকে ছোটো, কিন্তু আমরা বড়ো করে দেখি তাই বড়ো করে আঁকা হয়েছে৷ তাই যদি হয় তাহলে এ জিনিসটাকেও আমাদের দেখতে পাওয়ার কথা…’
দাড়িতে হাত বোলাল প্রবীর৷ আমি চাকতিটা টেবিলের উপরে রেখে হুইস্কির বোতলটা বের করতে করতে বললাম, ‘মনে হচ্ছে খেলনাটা বানানোর সময় টুকরোটা বাড়তি রয়ে গেছিল, প্যাকেটের মধ্যেই ঢুকিয়ে দিয়েছে…’ সিলিংয়ের একদিকে আঙুল দিয়ে দেখাল প্রবীর, ‘ওই জায়গাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে স্যার৷ ওটা ওখানেই লাগিয়ে দিন বরং…’
আইডিয়াটা মনে ধরল আমার৷ সত্যি ছাদের ওই জায়গাটা ন্যাড়ান্যাড়া লাগছিল৷ একটা টুল ফিট করে লাগিয়ে দিলাম চাকতিটা৷ একবার ঘরের আলোটা নিভিয়ে একটু অবাক হলাম৷ এই নক্ষত্রটা থেকে নীলের বদলে একটা বেগুনি আভা বের হচ্ছে৷ বেশ উজ্জ্বল৷ অদ্ভুত তো!
টিউবলাইটটা আবার জ্বালিয়ে দিলাম৷
প্রবীর এতক্ষণে টেবিলের উপরে গ্লাস রেখে তাতে সোডা মিশিয়ে রেডি করে ফেলেছে৷ আমি চেয়ারে বসে সেটাই একগ্লাস তুলে নিলাম৷ তারপর পিঠ এলিয়ে দিলাম৷
শরীরটা ঠান্ডা হয়ে আসছে এতক্ষণে৷ আজ অফিস থেকে এসে একবারও পিঠ পাতার সুযোগ হয়নি৷ সত্যি বলতে কী, রাতের আকাশের দিকে চেয়ে থাকার শখ আমার ছোটো থেকে৷ আমার এক জেঠু ছিলেন সে সময়ে৷ গ্রামে থাকতেন৷ শীতকালে আমাদের বাড়ি আসতেন৷ সন্ধেবেলা ছাদে শতরঞ্চি পেতে শুয়ে থাকতেন তিনি৷ আমি তার পাশে গিয়ে শুতাম৷ জেঠু এক মনে গ্রাম্য ভূতের গল্প বলতেন আমাকে৷ আলপথ, ঝিঁঝিঁর ডাক, রাতের বৃষ্টি, বাঁশবন, বেঁশোভুত, গোভূত, আরও কত কী গল্প…
জেঠু মারা যাওয়ার পরে কতবার আমি একাই ছাদে গিয়ে শুয়ে থাকতাম৷ সেই থেকেই বুঝি অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল৷ বড়ো হওয়ার পথে যে ক-জন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তাদের কারওই বোধহয় আমার মতো রাতের আকাশ নিয়ে আদিখ্যেতা ছিল না৷ এক সুনন্দিনী ছাড়া৷
সুনন্দিনীর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার সময় থেকেই বুঝেছিলাম ওর সঙ্গে আমার বহু অসম্ভব মিল আছে৷ দু-জনেই সিনেমার পোকা, দু-জনেই সময় বিশেষে ভয়ানক ল্যাধখোর, দু-জনেরই গল্পের বইয়ের প্রতি ঝোঁক৷ তবে সুনন্দিনী আমার মতো লেখালিখি করেনি কখনও৷ ওর আঁকার শখ ছিল৷ এখনও আছে৷ তবে অফিসের ঠেলায় আর সময় পায় না৷ ফিরতে ফিরতেই রাত দশটা বেজে যায়৷
আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম, সাড়ে আটটা বাজছে৷ মৃদু অ্যালকোহলের গন্ধে ভরে উঠেছে ঘরটা৷ প্রবীরটা শালা ফুল পেঁচো৷ দু-তিন পেগ পেটে পড়লেই আর কিছু খেয়াল থাকে না৷ আমাকেই তুই-তোকারি শুরু করে মাঝে মাঝে৷ তবে ওর সঙ্গে মাল খেয়ে মজা আছে৷ একটা সময়ে গিয়ে আমিও হয়তো ভুলভাল বকি৷ ও তার আগেই আউট হয়ে যায় বলে আর বিপদের আশঙ্কা থাকে না৷
(দুই)
‘স্যার… স্যার…’ প্রবীর টাল গলায় হঠাৎ ডেকে ওঠে৷ বুঝলাম যা বলতে চলেছে তার সমস্তটা মস্তিষ্ক থেকে নয়, পাকস্থলী থেকেও আসছে৷
‘ধরুন আকাশে এমন একটা গ্রহ আছে যেটা আমরা দেখতে পাই না, অদৃশ্য… ইনভিজিবল…’
আমি গ্লাসটা বাঁহাতে নিয়ে ডানহাতে ওর মাথায় চাপড় মারলাম একটা, ‘বাওয়া, পেটে প্রসাদ পড়লে দেখছি তুমি কোপারনিকাসের বাবা হয়ে যাও…’
‘ইয়ার্কি না স্যার, হতেও তো পারে, মানে ধরুন চাঁদটা… আগে একটা শপিং মলে ডিউটি ছিল স্যার, মাইরি গেটটা এমন কাচের মতো যে আপনি ধরতেই পারবেন না সেখানে গেট আছে বলে৷ আমি প্রথমদিন ধাক্কাটাক্কা খেয়ে এক কাণ্ড…’
গ্লাসে একটা বড়ো দেখে চুমুক দিলাম, ‘আরে সে না হয় আমরা দেখতে পাব না, বিজ্ঞানীরা তো বুঝবে৷ আকাশের গায়ে অত বড়ো একটা মাল থাকবে আর যন্ত্র কিছু ধরতে পারবে না? তুইও শালা যেমন…’
নিজের ভুল বুঝতে পেরে খিকখিক করে হাসে প্রবীর, তারপর কপালে হাত ঘষে বলে, ‘আসলে পড়াশোনা করিনি তো৷ তার উপর গার্ডের চাকরিতে ফালতু সময় অনেক৷ সংসার বলতেও নেই…’
‘তো বানিয়ে ফেল… আটকাচ্ছে কে?’
‘এবার প্রবীরের মুখ দেখে মনে হল ভারী চটুল টাইপের কিছু বলতে চলেছে সে, তবে সেটা বদলে ফেলে ভারী গলায় একটা দীর্ঘশ্বাস মেখে সে বলল, ‘সবার কি আর আপনার মতো ভাগ্য হয় স্যার?’ কথাটা বলে কয়েক সেকেন্ড থেমে থাকে প্রবীর, তারপর বলে, ‘বউদি আপনাকে খুব ভালোবাসে স্যার৷ আপনি ফোন না ধরলেই অফিস থেকে আমাকে ফোন করে খবর নেয়৷’
আমি মাথা নাড়লাম, ‘হুঁ, ওর অফিসটা হওয়ার পর থেকেই আর দু-জনের টাইম ম্যাচ করছে না৷ রাতে আর ছাদে গিয়ে বসা হয় না৷ বিয়ের পরপর ক-মাস শুতাম একসঙ্গে ছাদে গিয়ে…’
‘আপনি ওই জন্যেই এগুলো এনেছেন, না?’
আমি কিছু উত্তর দিলাম না৷ ছাদের একপ্রান্তে সেই নিটোল ফাঁকা চাকতিটার দিকে চেয়ে রইলাম একটানা৷ বেগুনি আলোটা টিমটিম করে জ্বলছে এখনও৷ কী যেন একটা আছে চাকতিটায়৷ একবুক অপরিচিত ফাঁকা জায়গা৷ যেন ধীরে ধীরে হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমাকে৷ আমার আর সুনন্দিনীর আকাশে একটুকরো অপরিচিত অতিথি৷ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চোখ ভারী হয়ে এল আমার…
(তিন)
ঘুম যখন ভাঙল তখন ঘরের আলো নিভে গেছে৷ চোখ খুলতেই ছাদ জুড়ে সেই নীলচে আলো দেখতে পেলাম৷ সুনন্দিনীর হাতটা আমার বুকের উপরে৷ তার মৃদু নিঃশ্বাসের শব্দ আসছে৷ ঘড়ির দিকে তাকালাম৷ বারোটা বেজে গেছে৷ সোফার উপরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তার মানে৷ সুনন্দিনী ফিরে আমাকে বিছানায় শুইয়ে নিজেও শুয়ে পড়েছে পাশে৷
ইশ… মনে মনে খিস্তি দিলাম নিজেকে, ভেবেছিলাম ঘটা করে তারাগুলো দেখাব ওকে… মহেশ ভটের সিনেমার মতো…
ওর হাতটা ধরেই হালকা ঠেলা দিলাম, ‘এই, সত্যি ঘুমিয়ে গেছ?’
‘উঁহু, ঘুমানোর ভান করছি৷’ সে চোখ বুজেই উত্তর দেয়৷
‘পরে করবে, আগে বলো ঘরটা কেমন লাগছে আজ?’
‘ভালো৷’ কেমন যেন নিরামিষ টাইপের উত্তর দেয় সুনন্দিনী৷
‘ধুর, শুধু ভালো? এত কষ্ট করে তোমার জন্য জোগাড় করলাম ওগুলো আর ভালো করে দেখোইনি৷’
‘কে বলেছে দেখিনি৷ দেখলাম তুমি হাঁ করে সোফায় পড়ে আছো আর খোলা মদের বোতল টেবিলের উপরে৷ নফরচাঁদা ছেলে আমার, আমি না দেখলে সেগুলো ঠিক জায়গায় রাখত কে?’
‘আরে আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আর আমি আজ জ্যাজ চালিয়ে হুইস্কি খাব সারারাত৷ কতদিন খাইনি বলতো, ওই হতভাগা প্রবীরটা দেখে নিল বোতলটা…’
সুনন্দিনী আরও কিছুটা সরে এল আমার দিকে৷ ওর হাতটা আমার বুক ছাড়িয়ে উলটোদিকের বিছানার চাদর স্পর্শ করল, ‘বেশি বকবক কোরো না তো৷ ঘুমাতে দাও৷ কাল সকালে আবার অফিস আছে৷’
‘তুমি না… কেমন একটা৷’ আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘বিয়ের পর কতদিন আমরা ছাদে গিয়ে শুয়ে থাকতাম সারারাত৷ এখন আর হয় না… তাই ভাবলাম…’
‘সে তখন সদ্য বিয়ে হয়েছিল৷ আমি ভালো করে বুঝতাম না৷’ ‘
কী বুঝতে না?’
‘আকাশ, চাঁদ, তারা এগুলো বড়ো কথা না৷’
‘তাহলে কোনটা বড়ো কথা?’
হঠাৎই সুনন্দিনী আমার বুকের উপরে ওর মাথাটা গুঁজে দেয়, ঘুমন্ত অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করে, ‘এইটা… এইটা বড়ো কথা…’
ছাদের গায়ে গাঁথা তারাগুলো আর একটু নিভে আসে৷ সুনন্দিনীর মুখটা চুলে ঢেকে গেছে৷ আঙুল দিয়ে সেগুলো সরিয়ে দিই আমি৷ নীলচে তরল আভা ওর চোখের কোল, নাক আর ঠোঁটের খাঁজ বেয়ে আমার বুকে নামতে থাকে৷ আমি একটা হাত রাখি ওর মাথার পেছনে…
‘সুনন্দিনী, একটা শেষ প্রশ্ন…’
‘উফ বাবা! আচ্ছা করো৷’
‘তুমি একদিন হুট করে চলে যাবে না তো? সত্যি সত্যি সবসময় থাকবে তো?’ সুনন্দিনী অল্প হাসে, ‘তুমি একদিন বলেছিলে মনে আছে? সেভাবে মানুষের চোখের দিকে তাকালে সে সত্যি বলছে না মিথ্যে, বলে দেওয়া যায়…’
‘যায়, কিন্তু তোমার তো চোখ বন্ধ৷’
‘তাহলে যতক্ষণ না খুলছি অপেক্ষা করে থাকো৷’
আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করি না৷ চোখ চলে যায় ঘরের একদিকের কোণে জেগে থাকা সেই অজানা চাকতিটার দিকে৷ ওর পরিচয় জানি না আমি৷ আকাশের ঠিক কোন জায়গাটায় থাকার কথা ওর? সত্যি কোনও গ্রহ নাকি কোনও সোলার অবজেক্ট? নাকি নেহাতই ম্যানুফ্যাকচারারের খেয়াল?
হ্যাঁ তাই হবে৷ শত খোঁজাখুঁজি করেও জিনিসটার সম্পর্কে কিছুই জানতে পারিনি৷ ওটার ব্যাপারে জানতে গেলেও কি অপেক্ষা করে থাকতে হবে? যতক্ষণ না নিজে থেকে জানাচ্ছে…
(চার)
সকালের টেলিগ্রাফটা টেবিলের উপরে রাখা ছিল৷ ঘুম থেকে উঠে আগে সেটাকেই কোলের উপরে টেনে নেওয়া স্বভাব আমার৷ সুনন্দিনী অফিসে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করছিল৷ তবে যত তাড়াই থাক আমার জন্য চা-টুকুনি করে রেখে যায় সে৷ আজও দেখলাম সেটা টেবিলের উপরে রাখা আছে৷ খানিক চোখ রগড়ে বেসিনে মুখ ধুয়ে সেটাতে একটা চুমুক দিয়ে কাগজ মেলে ধরলাম আমি, ‘আজও রাত হবে তোমার?’
‘দেখি৷ একটা মিটিং আছে৷ সন্ধের মধ্যেই বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব৷ দেরি হলে আবার জেগে থেকো না তুমি৷’
‘এই শোনো শোনো…’ হঠাৎ করেই ডেকে উঠলাম আমি৷
‘এখন শোনার সময় নেই আমার, বলো কী হয়েছে…’
‘আরে এই খবরটা পড়ে দেখো…’ আমি হাতে মেলে ধরা কাগজটার দিকে ইশারা করলাম৷
‘পারব না, পড়ে শোনাও৷’ সে মুখে কী যেন একটা ঘষতে ঘষতে বলল৷ আমি ইংরেজিটা নিজের মতো বাংলা করে পড়ে শোনাতে লাগলাম, ‘নাসার বিজ্ঞানী মহলে নতুন চাঞ্চল্যকর খবর৷ নাসার এমআরও মার্স অরবিটার থেকে আসা কিছু ছবি হইচই ফেলে দিয়েছে৷ ছবিতে দেখা যাচ্ছে আমাদের সৌরজগৎ থেকে মাত্র কয়েক হাজার আলোকবর্ষ দূরে একটা নতুন সেলেসচিয়াল বডি তৈরি হয়েছে…’
আমি একটু থামলাম৷ অনুবাদটা ঠিকঠাক হল না বোধহয়৷ যাই হোক, ব্যাপারটা বোঝানো গেছে৷ সুনন্দিনী চোখে কাজল টানতে টানতে বলল, ‘তৈরি হয়েছে মানে? একি গোপের কুলফি নাকি? এক রাতে তৈরি হয়ে গেল?’
আমি ঠোঁট উলটালাম, ‘কী জানি, হয়তো আগে থেকেই ছিল৷ বিজ্ঞানীরা এতদিন খেয়াল করেনি৷’
‘কী ভুলোমনা বিজ্ঞানী রে বাবা! আচ্ছা শোনো আজ ইলেক্ট্রিক বিল জমার লাস্ট ডেট, ওটা আবার ভুলে যেও না৷’
আমি বাকি খবরটা পড়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম, ‘আচ্ছা তোমার এটা আশ্চর্য লাগছে না? কালই আমি…’
‘কালই কী?’
মনে পড়ল সুনন্দিনীকে ওই সাদা চাকতিটার কথা বলা হয়নি৷ আমি আর কিছু বললাম না৷ সে সাজগোজ করে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷
আমি বুকের তলায় বালিশ নিয়ে গুগলে কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করলাম৷ হুঁ, খবরটা মিথ্যে নয়৷ রেডিও সিগন্যালও বলছে আকাশের ঠিক ওই জায়গাটায় কিছু একটা আছে৷ অথচ এতদিন বিজ্ঞানীদের চোখে পড়েনি জিনিসটা৷ সেটা অবশ্য নতুন কিছু নয়৷ কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হল জিনিসটা গতিশীল নয়৷ একই জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেটা৷ সাধারণত আকাশের বুকে গ্রহ, নক্ষত্র, ধূমকেতু যাই হোক না কেন সেটা একটা নির্দিষ্ট দিকে হয় এগিয়ে যায় নাহয় প্রদক্ষিণ করতে থাকে৷ অদ্ভুত তো!
যে সাইটটা আপাতত আমার সামনে খোলা আছে সেটা অনেকক্ষণ থেকে নোটিফিকেশন অন করার বায়না করে চলেছে৷ এরপর ওই সেলেসচিয়াল বডি সম্পর্কে যে কোনও আপডেট এলেই সাইট পত্রপাঠ আমার ফোনে নোটিফিকেশন পাঠিয়ে দেবে৷ সেটা অন করে দিলাম আমি৷ তারপর কাগজটা হাতে নিয়েই নীচে চলে এলাম৷
ছাদে আটকানো তারাগুলো এখনও আগের মতোই সেঁটে রয়েছে৷ তবে অন্ধকার নেই বলে আলোটা আর বোঝা যাচ্ছে না৷ চাকতিটার উপরেও একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম৷ নাঃ আলাদা কিছু নেই৷
লিফট বেয়ে নীচে নামতে দেখলাম দরজার বাইরে ছোটো ঘরটায় বসে আছে প্রবীর৷ আমাকে দেখে তার মুখে হাসি ফুটে উঠল, ‘কাল স্যার আপনাকে…’
‘শাট আপ, আগে একটা জিনিস দেখো৷’
টেলিগ্রাফটা খুলে ওর সামনে মেলে ধরলাম আমি, ‘পড়ে দেখো খবরটা…’
‘কী আছে স্যার খবরে?’
বুঝলাম প্রবীরের ইংরেজির দৌড় টেলিগ্রাফের পাতা অবধি আসছে না৷ বাংলা কাগজে তো এসব ছাপে না৷ রাজনীতি আর খেলাধুলো ছাড়া আর কিছু নিয়েই আগ্রহ নেই এদের৷ আমি প্রবীরের পাশের চেয়ারে বসে পড়ে বললাম, ‘কাল রাতে আকাশের এক জায়গায় একটা অজানা কিছু দেখা গেছে৷ এতদিন বিজ্ঞানীদের চোখে পড়েনি৷’
‘ও…’ প্রবীর তেমন আগ্রহ দেখাল না৷
‘ও কী? তোমার কাকতালীয় মনে হচ্ছে ব্যাপারটা?’
‘কোন ব্যাপার স্যার?’
‘আরে অদ্ভুত তো! কাল রাতে আমরা না জেনে একটা আননোন অবজেক্ট আকাশের বুকে লাগালাম আর আজ সকালে কাগজে খবর বেরল আকাশে একটা নতুন কিছু দেখা গেছে…’
‘আমার স্যার সকাল থেকে মাথাটা একটু ব্যথা করছে, কাল ড্রিঙ্কটা একটু বেশি…’ মনে হল একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছি ব্যাপারটা নিয়ে৷ প্রবীরের ফ্লাস্কে চা ছিল৷ তার থেকেই খানিকটা কাগজের কাপে ঢেলে আমার দিকে এগিয়ে দিল সে৷ ‘নিন স্যার, মাথাটা ঠান্ডা করুন…’
‘হুঁ’ আমি আর বাক্যব্যয় করলাম না৷ সামনেই কালকের ম্যাগাজিনটা পড়েছিল৷ সেটাই তুলে নিয়ে পাতা উলটাতে লাগলাম৷
আমার লেখা গল্পটায় এসে থেমে গেলাম৷ ছাপা কাগজে নিজের নামটা লেখা থাকতে দেখলে এখনও সেই প্রথমবারের মতোই আনন্দ হয়৷ গল্পের নাম—নবচরণের অদ্ভুত মেশিন৷ বাচ্চাদের জন্যে রোবট নিয়ে লেখা একটা সায়েন্স ফিকশন৷ কভারের ছবিটিও দিব্যি হয়েছে৷ প্রবীর সেদিকে তাকিয়েছিল, বলল, ‘আপনার মাথায় এইসব প্লট আসে কী করে বলুন তো স্যার?’
আমি বাঁকা হাসি হাসলাম, ‘ওইটেরই অভাব হয়নি ছোটো থেকে৷ এখন টাইম পাই না বলে লেখালিখিও কমিয়ে দিয়েছি…’
‘কমিয়ে দিলেন কেন?’
‘লিখে কি আর পেট চলে রে ভাই? পেটের চিন্তা আগে তারপর তো লেখালিখি…. অবশ্য…’
‘অবশ্য কী স্যার?’
‘তোমার বউদি চাকরি করছে যখন আমার আর না করলেও চলে যাবে৷ ও একবার বলেছিল আমায়৷ চাকরি-বাকরি ছেড়ে দিয়ে লেখালিখিটাই মন দিয়ে করো… তারপর…’
‘তারপর কী?’
আমি হাসলাম, এই এক স্বভাব প্রবীরের৷ সব কিছুই জানতে আগ্রহী সে৷ হয়তো এতটা ফাঁকা সময় পায় বলেই খেঁজুর করার বাতিক হয়ে গেছে৷
বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে৷ আমাকেও অফিসে বেরোতে হবে৷ উঠে পড়তে যাচ্ছিলাম, এমন সময় পকেটে মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল৷ কী একটা যেন নোটিফিকেশন এসেছে৷ আমি পকেট থেকে ফোন বের করে সামনে ধরলাম৷ এবং ধরতেই শিরদাঁড়া দিয়ে বিদ্যুৎ খেলে গেল৷ মনে হল আমার চটি ফুঁড়ে দুটো শীতল বরফের রেখা মাটির অতল থেকে ছড়িয়ে পড়ছে শরীরের ভিতরে৷
একটু আগে সাবস্ক্রাইব করা সাইটটা থেকে নোটিফিকেশন এসেছে৷ কাল রাতে হঠাৎ আবিষ্কার হওয়া সেলেসচিয়াল বডিটার কয়েকটা স্পষ্ট ছবি তুলেছে এমআরও৷ তাতে ক্ষীণ হলেও বোঝা যাচ্ছে জিনিসটার রং, ফিকে বেগুনি…
(পাঁচ)
লিফটে করে উপরে উঠতে উঠতেই একটা ছটফটানি ক্রমশ ঘিরে ধরছিল আমাকে৷ এও কি সম্ভব? খবরটায় আবার চোখ বোলালাম আমি৷ হ্যাঁ, কোনও ভুল নেই৷ ফিকে বেগুনি রং৷ এক সঙ্গে দু-দুটো কো ইন্সিডেন্স!
ঘরে ঢুকেই আগে সেই দিকটায় এগিয়ে গেলাম আমি৷ এখন জানলা দিয়ে সকালের কাঁচা রোদ এসে ভরিয়ে ফেলেছে ছাদটা৷ তারাগুলো প্রায় দেখাই যাচ্ছে না৷
টুলটা টেনে এনে উঠে দাঁড়ালাম তার উপরে৷ এখন আমি হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারছি চাকতিটাকে৷ কী মনে হতে হাত দিয়ে টেনে খুলে আনার চেষ্টা করলাম সেটা৷ উঁহু, খুলল না৷ ভীষণ শক্ত কোনও আঠা লাগানো আছে ওর পেছনে৷ সজোরে টানাটানি করতে চাকতিটার একদিকের কোণ ভেঙে উঠে এল আমার নখে৷
কী দিয়ে তৈরি কে জানে, কনকনে ঠান্ডা একটা অনুভূতি খেলা করছিল হাতে৷ একটু দূরে ঘরের আয়নায় নিজেকে দেখতে পাচ্ছি৷ টুলের উপরে দাঁড়িয়ে আছি আমি৷ এ কী পাগলামি শুরু করলাম৷ হতেই পারে একসঙ্গে দুটো কাকতালীয় ঘটনা ঘটেছে আমার জীবনে৷ নীচে নেমে এলাম৷ আজ রাতে তাড়াতাড়ি ফিরবে সুনন্দিনী, ওকে সব খুলে বললেই দু-জনে মিলে হাসাহাসি করব ব্যাপারটা নিয়ে… কিন্তু তার আগে…
সারাটা দিন একটা চাপা উত্তেজনায় কেটে গেল৷ অফিসে গেলাম না আর৷ ঝিম ধরে রয়েছে মাথার মধ্যে৷ কাল জিনিসটা এনে দিয়েছিলেন অর্ধেন্দুদা৷ ভদ্রলোক স্কুলে চাকরি করেন৷ সকালে ওনার তাড়া থাকে৷ ঘড়িতে আড়াইটে বাজতেই বুঝলাম এখন টিফিন চলছে৷ আর অপেক্ষা না করে ফোন করলাম তাঁকে৷ কয়েকবার রিং হতে ওপাশ থেকে গলা শোনা গেল—হ্যাঁ অপরেশ, বলো৷
‘অর্ধেন্দুদা, কাল একটা ফ্লুরোসেন্ট দিয়েছিলেন আপনি আমাকে৷ ওটার ব্যাপারেই একটু কথা ছিল৷’
‘হ্যাঁ বলো ভাই৷’
‘আপনার দাদু, মানে যার কাছ থেকে ওটা পেয়েছিলেন তিনি ওটার ব্যাপারে কিছু বলেছিলেন আপনাকে?’
‘বলেছিলেন বলতে সব তো তোমাকে কাল বলেই দিলাম৷ তোমার একটু সায়েন্স ফিকশনের দিকে আগ্রহ-টাগ্রহ আছে, তাই ভাবলাম তোমার হাতেই ওটা…’
‘চাঁদ আর তারা ছাড়াও একটা বড়ো চাকতি ছিল ওর মধ্যে৷ সেটার ব্যাপারে কিছু বলেননি?’
‘উঁহু, তেমন কিছু তো মনে পড়ছে না৷’
‘আপনার দাদু কী নিয়ে গবেষণা করছিলেন জানেন?’
‘অ্যাস্ট্রোনমার ছিলেন৷ আমার তো হিস্ট্রি ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল ভাই, ওসব অত বোঝার চেষ্টাও করিনি৷ কিন্তু তোমার কী হয়েছে বল তো? এত উত্তেজিত লাগছে যে, ডাক্তার…
‘উঁহু, ঠিক আছে৷ আপনি তার মানে কিছুই জানেন না?’
‘যা বললাম তার বাইরে…’
‘আচ্ছা বেশ৷’
হুট করেই রেখে দিলাম ফোনটা৷ বুঝলাম ঝোঁকের মাথায় একটু খারাপ ব্যবহারই করে ফেলেছি ভদ্রলোকের সঙ্গে৷ আজ আর সম্ভব হবে না, ঠিক করলাম কাল একবার সশরীরে গিয়ে হাজির হব অর্ধেন্দুদার বাড়িতে৷ সেখান থেকে দাদুর ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া যাবে না হয়৷
অন্যদিন বাড়ি থাকলে দুপুরের দিকটা লেখালিখি নিয়ে বসি, আজ আর সেসবে মন বসল না৷ গুগলে ঘাঁটাঘাঁটি করে কাটল সারাদিন৷ বিকেলে এসে যখন খাওয়াদাওয়ার তোড়জোড় করলাম ততক্ষণে খিদে মরে এসেছে৷ সেসব সমাধা হতে হতে সন্ধে নেমে পড়ল৷ সারাটা দিন এই সময়টার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম৷ একটা একটা করে তারা ফুটে উঠেছে আকাশে৷ একদিকের কোণে গোল চাঁদটা ভেসে উঠেছে আকাশের বুক ফুঁড়ে৷
ছাদের একদিকের কিনারায় দাঁড়িয়েছিলাম৷ বাড়ির ঠিক পাশেই একটা ছোটোদের পার্ক৷ তার গায়ে লাগোয়া শপিং মল৷ পার্ক আর মল ভরে আছে ঝকমকে আলোয়৷ ক-টা বছর পনেরোর ছেলেমেয়ে নেট টাঙিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলছে পার্কে৷ তাদের থেকে একটু দূরেই একটা সিমেন্টের বেঞ্চে ওদেরই মধ্যের দুটো ছেলেমেয়ে বসে আছে৷ পাশে তাকিয়ে দেখলাম শপিং মল থেকে হাসিমুখে জামাকাপড় কিনে বেরিয়ে আসছে একটা ফ্যামিলি৷
জমাট উদ্বেগটা কেটে গিয়ে মজা লাগল আমার৷ সুনন্দিনীর সঙ্গে ওই পার্কের সময়টা কাটিয়েছি, আবার শপিং মল থেকে বেরিয়ে আসা স্বামী-স্ত্রীর সময়টাও৷ মনে আছে সায়েন্সসিটির একটা বেঞ্চে বসে আইসক্রিম খাচ্ছিলাম আমরা দু-জন৷ আমার মাথাটা হেলান দেওয়া ছিল ওর কাঁধে৷ ও ভারী রোগা-পাতলা ছিল তখন৷ কাঁধের হাড়টা যেন কানের কাছে খোঁচা দিত৷ শুধু একটা বিশেষ ভঙ্গিমায় মাথাটা রাখলে ভীষণ কমফোর্টেবল লাগত৷ ওই কাঁধ, ওই ভঙ্গিমাটুকু চিনে যাওয়াটাই হয়তো এক সঙ্গে এতদূর ভাসিয়ে দিল আমাদের৷
হঠাৎ মনে হল আমার পাশে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে৷ বাঁদিকে চাইলাম৷ নীচু গলায় সে জিজ্ঞেস করল, ‘কী খবর ভাই?’
আমি তার দিক থেকে আবার শপিং মলের দিকে মুখ ফেরালাম, ‘কেমন অদ্ভুত একটা মেলা বসেছে, না রে? সবাই হাসছে খেলছে, নিজেদের পরিসরে যতটুকু আনন্দ পাওয়া যায় সব চেটেপুটে নিচেচ…’
‘তো? তুই খুশি নোস?’
‘আমি কোনওদিনই এই মেলার অংশই ছিলাম না৷ আমি পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে মেলাটা দেখছি৷ এদের গল্পগুলো জানার চেষ্টা করছি৷’
‘কোথায় যাচ্ছিস?’
‘জানি না৷ তবে মেলায় ঢুকতে আসিনি এটুকু বুঝতে পেরেছি৷ জীবনের একটা সময় মনে হয়েছিল ঢুকে গেলেই বেশ হয়৷ কী হবে কোথাও গিয়ে… ওই তো কত লোক রাইডে চড়ে ভয়ে চিৎকার করছে, বাচ্চারা ক্লাউনের হাত থেকে পালাচ্ছে, জিলিপি, গুড়কাঠি বিকোচ্ছে, গুলি ছুঁড়ে বেলুন ফাটিয়ে প্রাইজ জিতছে কেউ, তারই মাঝে একটা ডাইনোসরের পেটের ভিতরে অন্ধকারে হাত ধরে চোখ বুজে আছে দু-জন৷ চলছে তো বেশ, আছে তো কত কিছু… থেকে গেলেই বেশ হয়…’ ‘হুম… তারপর কী ঠিক করলি… কোনটা বেছে নিলি?’
আমি একটু হেসে আবার তার দিকে তাকালাম, ‘গল্পটা বেছে নিলাম৷ সুনন্দিনীকে দেখে মনে হল ও মেলাতেই থাকতে চায়, আমার সঙ্গেও৷ থাকলও, নিজেকে দু-ভাগে ভাগ করে মেলায় থাকল, আমার সঙ্গেও চলল৷ এই ভাগাভাগির কাজটা সবাই পারত না, জানিস৷ সুনন্দিনীকে না পেলে আমি হয়তো অন্য কিছু হতাম আজ৷ ওর কাছ থেকে মেলার গল্পগুলো শুনে নিলাম আমি৷ ব্যস, শ্যাম, কুল দুটোই রইল…’
হঠাৎ সে এগিয়ে এল আমার দিকে, আমার মুখোমুখি দাঁড়াল৷ ওর মুখটা আমার চেনা, ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছি৷ সব থেকে পুরোনো মুখ৷ ধীরে ধীরে আমার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল সে, ‘কেমন আছিস অপরেশ?’
আমি কিছু একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় একটা যান্ত্রিক শব্দ ভেসে এল৷ আবার একটা নোটিফিকেশন এসেছে সাইটটা থেকে৷ পরে দেখব না হয়৷
এখন উত্তর দেওয়াটা জরুরি৷ সামনে তাকালাম৷ নাঃ, কেউ নেই… অগত্যা ফোনটা সামনে আনলাম৷ এবারের নোটিফিকেশনটা কোনও খবর নয়৷ সাইটে একটা নতুন ফিচার যোগ হয়েছে৷ ফিচারটা ভারী মজাদার৷
ফোনের ক্যামেরা অন করে চাঁদটাকে স্ক্রিনের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে আকাশের ছবি তুললে সেই রহস্যময় সেলেসচিয়াল বডি আকাশের ঠিক কোনখানে আছে সেটা বলে দেবে সাইট৷ আমার হাত কেঁপে উঠল৷ অন্য কিছু না ভেবে দ্রুত উইচ টিপে অন করলাম ক্যামেরাটা৷
সন্ধ্যার গাঢ় অন্ধকার নেমেছে এতক্ষণে৷ আকাশের ঠিক মাঝখানে চাঁদ জ্বলজ্বল করছে৷ সেটাকে স্ক্রিনের মাঝে ধরে একটা ছবি তুললাম আমি৷ কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করতে ছবির বাঁদিকের উপরের একটা জায়গা বেগুনি হয়ে উঠল৷ ওখানেই অবস্থান করছে সে৷
আমি ছাদের মেঝের উপরেই বসে পড়লাম৷ এ কি করে সম্ভব! আর কোনও সন্দেহ থাকতে পারে না৷ কাল আমি নিজের হাতে লাগিয়েছি ওই চাকতিটাকে৷ এভাবে নিখুঁত মিলে যাওয়া… আমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল তাহলে?
আবার সেই শব্দ৷ আবার নোটিফিকেশন এসেছে৷ আজ এমআরও থেকে আসা নতুন ছবিতে দেখা যাচ্ছে রহস্যময় গোলকটার একদিকের বেশ কিছুটা ক্ষয়ে গেছে৷ মনে হচ্ছে বড়ো উল্কা বা কোনও অবজেক্টের সঙ্গে ধাক্কা লেগেছিল গোলকটার৷ আমি নিজের কাঁপা কাঁপা হাতের দিকে তাকালাম৷ নখের ফাঁকে এখনও লেগে আছে টানাটানিতে গোলকটার ভেঙে আসা অংশটুকু…
(ছয়)
‘স্যার… স্যার দরজা খুলুন স্যার… আপনি ফোন ধরছেন না… বউদি অনেকবার আপনাকে…’
দ্রুত সরে এসে দরজাটা খুলে ফেললাম আমি৷
প্রবীরকে বেশ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে, আমি তার একটা হাত ধরে টেনে আনলাম ঘরের ভিতরে, ‘উঁহু, সুনন্দিনীকে এখন কিছু বলা যাবে না৷ ও ভয় পেয়ে যাবে আগে…’
‘আপনার মুখ চোখের কী অবস্থা হয়েছে স্যার? শরীর খারাপ করছে নাকি?’
‘না… কিছু খারাপ হয়নি৷ ভেবেছিলাম মাথাটা খারাপ হয়েছে, কিন্তু না, যত সময় যাচ্ছে… আচ্ছা একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো…’
প্রবীরকে দেখে মনে হল খানিকটা ভয় পেতেও শুরু করেছে সে৷ হয়তো আমার হাবভাব দেখেই কিছুটা পিলে চমকে গেছে তার৷ মিনমিন করে বলল, ‘কী প্রশ্ন?’
‘ধরো তোমার হাতে বিরাট একটা ক্ষমতা আছে৷ বিরাট একটা কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারো তুমি৷ তোমার নিজের ভালোর জন্য, চারপাশের মানুষের ভালোর জন্য চাইলেই একটা জিনিসকে ধ্বংস করতে পারো, কিন্তু ধ্বংস করলে তোমার হাত থেকে সেটার নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে৷ কী করবে তুমি?’
‘আপনি কী বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না৷ কী ধ্বংস করব?’
আমি সাইটটা আবার খুলে ধরলাম তার দিকে৷ সেখানে ফুটে আছে একটা মহাকাশের বুকে ভাসমান বেগুনি গোলকের ছবি৷ তার একদিকের কিছুটা অংশ ভেঙে গেছে৷ আমি নিঃশ্বাস না নিয়েই বলতে লাগলাম, ‘আজ সকালে এটার কথা বলেছিলাম মনে আছে তোমার? এই গোটা গ্রহটাকে আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি প্রবীর, নিজের ইচ্ছামতো চালাতে পারি৷ শুধু তাই নয়, সমস্ত পৃথিবীর ভাগ্য আজ কেবল আমার ঘরের সিলিংয়েই ঝুলে আছে৷’
কয়েক সেকেন্ড থম হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল প্রবীর, তারপর থেমে থেমে বলল, ‘বউদি অনেকবার কল করেছে আপনাকে, উনি বলছিলেন…’
‘আচ্ছা কাল তোমার একটা কথা মনে হয়নি? আমার সিলিংয়ে যে আকাশটা দেখা যায় সেটা মানুষের খালি চোখে দেখা আকাশ৷ এখানে ওই গ্রহটা প্রায় চাঁদের সমান৷ অথচ ছাদে উঠে খালি চোখে আমরা ওটা দেখতে পাই না কেন?’ প্রবীর আর কিছু উত্তর দেয় না৷ মুখ দেখে বোঝা যায় আমার বলা কথার এক বর্ণও সে বুঝতে পারেনি৷
ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাই আমি, ‘আমি হিসেব করে দেখেছি প্রবীর, এ ঘরের সিলিংয়ে যে আকাশটা আমরা দেখছি সেটা আজকের আকাশ না, ভবিষ্যৎ কোনও সময়ের আকাশ৷ তারাদের অবস্থান বলছে আজ থেকে দু-মাস পরে আকাশে তারাদের অবস্থানের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে আমার সিলিং৷ এর মানে বুঝতে পারছ?’
কপালে হাত ঘষছে প্রবীর৷ মুখে হাসি ফুটছে তার৷ কী ভাবছে? আমি পাগল হয়ে গেছি? উঁহু, ওকে বোঝাতেই হবে আমাকে৷ এরপর আরও অনেককে বোঝাতে হবে…
‘মানে আজ থেকে দু-মাস পরে আমাদের পৃথিবীর একেবারে সামনাসামনি এসে পড়বে ওটা৷ এত কাছে যে চাঁদের থেকে ছোটো একটা গ্রহকে আমরা প্রায় চাঁদের সমান দেখব, হয়তো তারপর আরও কাছে আসবে… তারপর…’
‘স্যার আমি নীচে যাচ্ছি… আপনি…’
‘যাবে, আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাও৷’ আমি তার কাঁধ চেপে ধরলাম, ‘কী করবে তুমি? নিজের সব কিছু বাঁচাতে গিয়ে এত বড়ো একটা অলৌকিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে? পনেরো বছর ধরে সায়েন্স ফিকশন লিখছি আমি, অথচ ক-টা লোক চেনে আমাকে? কিন্তু ধরো আমি এমন একজন লেখক হলাম যে নিজে একটা আস্ত গ্রহকে ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারে… যদি বস্তুটা পৃথিবীর পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে যায়? যদি কোনও কলিশন না হয়? তাহলে তো ক্ষতির সম্ভাবনা নেই… তাহলে… অপেক্ষা করব? কিন্তু ততদিনে যদি দেরি হয়ে যায়?’
আমার গলা কি কেঁপে যাচ্ছে? বড্ড অবাস্তব কিছু বলে চলেছি? একটু আগে আয়নায় দেখেছি আমার চোখদুটো সত্যি অস্থির হয়ে আছে৷ কী যে বলছি, কী যে করছি কিছুই বুঝতে পারছি না৷
ফোনটা আমার হাতে ধরিয়ে দেয় প্রবীর, ‘বউদি লাইনে আছেন, উনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান৷ আমি নীচে যাই স্যার, যা বলার ওনাকেই বলুন…’ সত্যি ধরা আছে ফোনটা৷ আমার কথা তাহলে এতক্ষণ শুনেছে সুনন্দিনী? আমি দ্রুত কানে চেপে ধরলাম ফোনটা৷
‘সুনন্দিনী… এখনও ফিরলে না তুমি? কত রাত হবে আজ? প্লিজ চলে এসো এক্ষুনি…’
‘পাগলামি করো না৷ আমার কিছু কথা আছে তোমার সঙ্গে…’
‘আমারও…’ আমি চিৎকার করে উঠলাম প্রায়, ‘কত কথা বলার আছে তোমাকে তুমিও জানো না৷ এক্ষুনি অফিস থেকে বেরিয়ে একটা ক্যাব নিয়ে…’
‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে অপরেশ? কেন ছেলেমানুষি করছ? আচ্ছা শোনো…’
‘আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দেবে প্লিজ? ভীষণ আর্জেন্ট…’
‘এই জন্যে এত রাগ হয় তোমার উপর৷ আমি কী বলছি না বলছি কোনওদিন শোনার চেষ্টাই করনি৷ বল…’
‘আমাকে ভালোবাস সুনন্দিনী? হুট করে ছেড়ে চলে যাবে না তো কোনওদিন?’ কয়েক সেকেন্ড কেটে গেল৷ ওপাশ থেকে কোনও উত্তর এল না৷ আমি অল্প হেসে বললাম, ‘এখনও তোমার চোখদুটো দেখতে পাচ্ছি না আমি৷ আচ্ছা বেশ, বাড়ি এসে জবাব দিও নাহয়৷ শোনো না…’
‘হ্যাঁ, বলো…’
ও কি কাঁদছে? গলাটা কাঁপছে কেন ওর?
‘তুমি বাড়ি চলে এসো তাড়াতাড়ি৷ দেখো, একদিন তোমার অফিস থাকবে না৷ আমার মাথায় গল্পের প্লট ঘুরবে না৷ পৃথিবীটা হঠাৎ খুব অন্ধকার আর শান্ত হয়ে যাবে… তুমি আর আমি আবার একদিন ছাদে শুয়ে থাকব আকাশের দিকে চেয়ে… থাকবে না বলো?’
সুনন্দিনী বোধহয় এতক্ষণে কাঁদতে শুরু করেছে৷ ওপাশ থেকে কেটে গেল ফোনটা৷ আমার উত্তর আমি পেয়ে গেছি৷ ধুর! কী সব ভাবছিলাম এতক্ষণ? সুনন্দিনী, আমার ছোটো ছাদটুকু, আমাদের বাকি জীবনের এতগুলো বছরের সামনে একটা অলৌকিক সম্ভাবনা? একটা গ্রহান্তরের অদ্ভুত ক্ষমতা? বিখ্যাত হওয়ার প্রবল তাড়না? এটা একটা বার্গেন হল?
একটা যন্ত্র দরকার আমার৷ বিশেষ একটা যন্ত্র৷ কোথায় পাই? মোবাইলের কন্ট্যাক্টসে গেলাম৷ ক-দিন আগে একজন ইলেকট্রিশিয়ান কাজ করে গেছে৷ তার নম্বরটা সেভ করে রেখেছিলাম৷ একটু খুঁজতেই পেয়ে গেলাম—মনজিৎ৷
‘হ্যাঁ অপরেশদা, বলুন৷’
‘ভাই তোমার কাছে ড্রিল মেশিন আছে?’
‘ড্রিল মেশিন! আছে৷ কিন্তু কেন বলুন তো?’
‘নিয়ে একটু চলে আসবে ভাই তাড়াতাড়ি? দেওয়ালের এক জায়গায় ফুটো করতে হবে, আর্জেন্ট৷’
‘কিছু দিয়ে ফুটো করে নিন না৷ এইটুকুর জন্য…’
‘আঃ, যা বলছি কর তাড়াতাড়ি৷’
(সাত)
‘একী! এসব কী করে রেখেছ তুমি!’ ঘরে ঢুকে বেসিনের কাছে যেতে গিয়েই আঁতকে উঠল সুনন্দিনী৷ চাকতিটার উপরে ড্রিল করার সময় দেওয়ালের বেশ কিছুটা সিমেন্ট এসে পড়েছিল মেঝেতে৷ উত্তেজনায় সেটা আর সরানোর কথা মনে ছিল না৷
‘এ কী৷ দেওয়ালে এসব কী অনাসৃষ্টি করেছ বলো তো?’
আমি সোফায় বসে একটা বই পড়ছিলাম৷ মুখ তুলে একটা বাঁকা হাসি হেসে বললাম, ‘সে গল্প বলব বলেই তো অপেক্ষা করলাম এতক্ষণ৷ ফ্রেশ হয়ে এসো৷ সব বলছি৷’
টাওয়েলটা কাঁধে ফেলে বাথরুমে ঢুকতে যাচ্ছিল সে৷ আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা তখন কী বলছিলে বলতো?’
‘কখন?’
‘ওই যে যখন ফোন করলে?’
সুনন্দিনীর মুখে কঠিন রেখা খেলে কয়েকটা, ‘রোজ দুপুরে ফোন করি আর তুমি ফোন ধরো না৷ অগত্যা গার্ডকে ফোন করতে হয়৷ ভাবলাম একটু কথা শোনাব, আর তুমি…’
আমি হাসলাম, ‘আসলে এই ক-দিন যা চলছে৷ এবার থেকে ধরব…’
সে বাথরুমে ঢুকে যেতে আমি আবার উঠে এসে দাঁড়ালাম চাকতিটার তলায়৷ অবশ্য জিনিসটা এখন আর চাকতির পর্যায়ে নেই৷ ড্রিল মেশিন দিয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আপাতত একটা ভাঙা ডিমের খোলার মতো সেঁটে আছে দেওয়ালে৷ মনজিৎ ড্রিল করার সময় কিছুটা অবাকই হয়েছিল৷ খামোখা একটা ফ্লুরোসেন্টের উপরে আমার এত রাগ কেন সেটাই হয়তো বুঝতে পারেনি৷ না বুঝুক, আমি বুঝেছি৷ একটু পরেই সুনন্দিনীকে খুলে বলব সব৷ আমি জানি সবার আগে কী বলবে ও, ‘সায়েন্স ফিকশন লিখতে লিখতে তোমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে৷’ আমি হাসব, তারপর একটা একটা করে প্রমাণ তুলে ধরব ওর চোখের সামনে৷
বাথরুম থেকে জলের আওয়াজ আসছে৷ স্নান করছে সুনন্দিনী৷ সুনন্দিনী কতদূর কী বুঝল জানি না৷ তবে শুনল ভারী মন দিয়ে৷ ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়েছি আমি৷ আবার জ্বলে উঠেছে ছাদের দেওয়ালের গায়ে অসংখ্য নক্ষত্রের দল৷ কেবল সেই বেগুনি আভাটা আর নেই৷
আজ বহুক্ষণ ধরে গল্প করলাম দু-জনে৷ একসময় দু-চোখ জড়িয়ে গেল ঘুমে৷ চোখ বন্ধ করলেও চোখের পাতায় লেগে রইল তারাদের নীলচে আভাটা৷ তার সঙ্গে একটা মানুষের পরিচিত একটানা নিঃশ্বাসের শব্দ বড়ো নিশ্চিন্তে ঘুম পাড়িয়ে দিল আমাকে৷
ঘুম ভাঙল একটা মিহি শব্দে৷ কোথা থেকে যেন খুব চাপা একটা পোকার ডাকের মতো শব্দ আসছে৷ বিচ্ছিন্ন নয়৷ একটানা আওয়াজ৷ এতই আস্তে যে মন দিয়ে খেয়াল না করলে বোঝাও যায় না৷ অথচ খেয়াল করলে আর উপেক্ষা করা যাচ্ছে না৷ এতেই আমার ঘুম ভাঙল কি?
চেয়ে দেখলাম সুনন্দিনী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন৷ ওকে আর ডাকলাম না৷ কোনও পোকা ঢুকল কি ঘরে? আলো জ্বাললে ওর ঘুম ভেঙে যেতে পারে৷ নীলচে আলোতেই চারপাশটা ভালো করে খুঁজে দেখতে লাগলাম৷ এবং দেখতে গিয়েই বুঝলাম আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে…
ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম ঘরের একটা কোণে৷ এখন আর মেঝের উপরে সিমেন্টের গুঁড়ো পড়ে নেই৷ একটু আগেই সেগুলো পরিষ্কার করে দিয়েছে সুনন্দিনী৷ উপরের দিকে চাইলাম৷ হ্যাঁ… ওই ভাঙা গ্রহটার মধ্যে থেকেই আসছে আওয়াজটা…. কিন্তু কী করে?
আমি অবাক হয়ে সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে দেখলাম সেই ভাঙা খণ্ডগুলোর ভিতর থেকে কিছুটা বেরিয়ে এসে… না একটা নয়, অনেকগুলো লালচে ছোটো ছোটো শুঁড়…
ভাঙা জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে একটু একটু করে বাকি তারাগুলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা৷ শুঁড়ের ডগাগুলো কেঁপে উঠছে বারবার৷ এক পৈশাচিক হিংস্রতায় তারাগুলোকে গ্রাস করতেই অগ্রসর হচ্ছে তারা… সেখান থেকেই বেরিয়ে আসছে পোকার মতো শব্দটা৷ একটা প্রাণী! একটা মহাজাগতিক প্রাণী! ওই তারাটা যেখানে ছিল সেখানেই জেগে উঠছে সে….
কিন্তু কী ওটা? তারাটাকে তো আমি নষ্ট করে ফেলেছি আজ সন্ধেয়৷ আর কিছুর তো সেখানে থাকার কথা নয়৷ তাহলে?
আজ সারাদিনে বিস্তর পড়াশোনা করেছি মহাকাশ নিয়ে৷ কিছু বাস্তব আর কিছু কষ্টকল্পিত সম্ভবনার কথা, কন্সপিরেসি থিওরি৷ তার মধ্যে থেকেই একটা ভেসে উঠল আমার চোখের সামনে…
আকাশের বুকে হঠাৎ জেগে ওটা ওই সেলেসচিয়াল বডিটা কোনও ধূমকেতু কিংবা পরিত্যক্ত গ্রহ নয়৷ ওটা একটা আবরণ, যা লুকিয়ে রেখেছিল কোনও মহাজাগতিক অস্তিত্বকে… ঠিক একটা ডিমের মতো৷
আজ সন্ধ্যায় সেই আবরণটাকেই ভেঙে ফেলেছি আমি৷ আর ঠিক সেই কারণেই মুক্তি পেয়েছে সেই প্রাণীটা… তার আগ্রাসী শুঁড়গুলো সে বাড়িয়ে দিয়েছে বাকি তারাগুলোর দিকে… সৌরজগতের দিকে…
আমার পা কাঁপছিল৷ মনে হচ্ছিল এক্ষুনি হৃৎপিণ্ডটা স্তব্ধ হয়ে যাবে৷ এ কী করে ফেললাম আমি! এবার কী হবে?
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আরও কিছুটা এগিয়ে গেছে শুঁড়গুলো৷ লতানে গাছের মতো একটা তারার গা বেয়ে উঠছে সেগুলো৷ ধীরে ধীরে নিভে আসছে তারার আলো৷ ছাদের সেই জায়গাটা অন্ধকার হয়ে আসছে৷
নাঃ আর কোনও কিছুর উপরে নিয়ন্ত্রণ নেই আমার৷ এই মুহূর্তে সমস্ত ব্যাপারটা জানানো দরকার আমার৷ তবে সুনন্দিনীকে নয়, ভারী নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে ও, ওকে জাগিয়ে…
‘অর্ধেন্দুদা… আমি অপরেশ বলছি৷’
ফোনটা ধরেই ভদ্রলোক কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, আমি তার আগেই বলে উঠলাম, ‘আমার ভীষণ দরকার আছে আপনার সঙ্গে… আপনি ভাবতেও পারবেন না…’
‘এত রাতে! কী ব্যাপার ভাই, তুমি ঠিক আছো তো?’
‘একটা… একটা মারাত্মক ভুল করে ফেলেছি আমি৷ সব শেষ হয়ে যাবে অর্ধেন্দুদা… প্লিজ আপনি একটু তাড়াতাড়ি…’
গলা শুনে মনে হল ভদ্রলোক বিছানার উপরে উঠে বসেছেন, ‘তোমার কি সমস্যা হচ্ছে কিছু? প্লিজ মাথা ঠান্ডা করো৷’
‘আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন আমার বাড়ি চলে আসুন৷ সুনন্দিনী ঘুমাচ্ছে৷ ওকে কিছু জানাইনি এখনও৷ প্লিজ হারি, যত তাড়াতাড়ি হয় খবরটা ছড়িয়ে দিতে হবে আমাদের…’
‘আচ্ছা বেশ, তুমি দাঁড়াও… আমি যাচ্ছি তোমার বাড়ি৷’
ভদ্রলোক এত সহজে রাজি হয়ে যাবেন ভাবতে পারিনি৷ ফোনটা কেটে যেতে আমি আবার ফিরে এলাম বিছানার কাছে৷ এখন আরও বেড়ে উঠেছে সেই একটানা ঝিমধরা শব্দটা৷ আরও আরও জোরে শোনা যাচ্ছে… আমার কানের ভিতরে যেন গরম তরল ঢেলে দিচ্ছে৷ কান চেপে ধরলাম আমি৷ নাঃ সুনন্দিনীকে কিছুতেই জাগানো যাবে না৷ যন্ত্রণায় মাটির উপর বসে পড়লাম৷
খেয়াল করলাম একটা একটা করে তারা ছাদ থেকে খসে পড়ছে মেঝেতে, বিছানায়, সুনন্দিনীর ঘুমন্ত শরীরের উপর৷ ভোরের মিহি কুয়াশার মতো লাগছে ওর শরীরটা৷ দু-হাতে ঢেকে আমি মেঝের উপরেই শুয়ে পড়লাম৷
সিঁড়ি দিয়ে উঠে উঠে আসছে দুটো পায়ের আওয়াজ… আমার চোখ কী এক মরণ ঘুমে বন্ধ হয়ে এল৷
(আট)
‘মিস্টার ঘোষ… শুনছেন?’
‘অপরেশ… ভাই… ঠিক লাগছে এখন?’
কারা যেন ডাকছে আমাকে৷ চোখ খুলে সামনে তাকালাম৷ আমার নিজের ঘরের মেঝেতেই শুয়ে রয়েছি আমি৷ সাদা টিউবের আলো জ্বলছে ঘরে৷ কানের মধ্যে সেই অসহ্য শব্দটা আর আসছে না৷ উঠে বসতে গেলাম, দুটো শক্ত হাত শুইয়ে দিল আমাকে, ‘আগে তাকান এদিকে, দেখুন তো, চেনেন আমাদের?’
ভালো করে চোখ মেলে তাকালাম৷ তিনটে লোক তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে৷ তাদের দু-জনকে আমি চিনি৷ অর্ধেন্দুদা, প্রবীর… অন্যজনকে চিনি না৷
‘আপনারা… ওঃ…’ মনে পড়ল আমিই আসতে বলেছিলাম অর্ধেন্দুদাকে, ‘আমার মাথাটা একটু ঘুরে গেছিল৷ আসলে ওই প্রাণীটা…’
‘কোন প্রাণী মিস্টার ঘোষ?’ অজানা লোকটা জিজ্ঞেস করল৷
‘তারা ফেটে যেটা বেরিয়ে এসেছে, আমার দোষেই…’
ধীরে ধীরে উঠে বসলাম আমি৷ বিছানা খালি৷ বারান্দার পরদাটা উড়ছে৷ সুনন্দিনী সেখানেই আছে তার মানে৷ এই শীতের রাতে, বারান্দায়…
‘স্যার পরশু থেকেই এরকম বলে চলেছেন,’ প্রবীর অর্ধেন্দুদার দিকে চেয়ে বলল, কোথায় নাকি কি তারা দেখা গেছে, কী যে ভূত চাপল মাথায়…’
‘তোমাকে তো বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম৷ তুমি গণ্ডমূর্খ হলে আমার কী করার আছে?’ আমি ঝাঁঝিয়ে উঠলাম, ‘আজ রাতেই সুনন্দিনীকে বুঝিয়েছি সব, ও এলেই সব বুঝিয়ে দেবে… অর্ধেন্দুদা, তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে আমাদের৷’
‘সুনন্দিনী ঘোষ? মানে আপনার স্ত্রী? কখন বুঝিয়েছেন তাকে?’ অচেনা লোকটা জিজ্ঞেস করল, ‘বাই দ্য ওয়ে, আমি অপরূপ ব্যানার্জি… অর্ধেন্দুর মুখে আপনার ব্যাপারে শুনে… যাক গে, আপনার স্ত্রীকে কখন বলেছেন এসব কথা?’
‘কেন? এই একটু আগে, ও অফিস থেকে ফেরার পর৷’
লোকটা এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রাখল, ‘মিস্টার ঘোষ, আপনার স্ত্রী আজ কয়েক সপ্তাহ হল আপনাকে ফোন করছেন, আপনি তার ফোন ধরছেন না৷’ ‘হ্যাঁ আসলে দুপুরে আমি একটু লেখালিখি নিয়ে…’
‘ম্যাগাজিনের জন্য লেখালিখি করেন, তাই তো?’
‘হ্যাঁ, কী প্রবীর, বলে দাও, কালই তো দেখলে আমার গল্পটা…’
‘ওটা আপনার গল্প নয় অপরেশবাবু…’
‘এই আপনি শালা পাগল নাকি, আমার নাম অবধি লেখা ছিল…’
‘লেখক অপরেশ ঘোষ টলিগঞ্জে থাকেন, তাঁর বয়স ষাটের কাছাকাছি৷ আপনাকে সারা জীবনে কখনও দেখেননি তিনি৷ তাঁর সঙ্গে আপনার নাম মিলে যাওয়ায় লোককে এই মিথ্যেটা বলে বেড়ান আপনি—যে আপনি নামকরা লেখক৷ আজ একটু আগে অবধি আপনার সিকিউরিটি গার্ড অবধি তাই বিশ্বাস করত…’
‘কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না এতে ওর লাভ কী?’ অর্ধেন্দুদা এগিয়ে গেলেন অপরূপবাবুর দিকে, ‘তাছাড়া অকারণে সুনন্দিনীর ব্যাপারেই বা মিথ্যে বলছে কেন?’
‘কী মিথ্যে বলেছি আমি?’ আমি চেঁচিয়ে উঠলাম অর্ধেন্দুদার দিকে চেয়ে৷ যাচ্ছেতাই বলে চলেছে লোকটা৷
‘ভাই, অপরেশ৷ আজ একমাস হয়ে গেল সুনন্দিনী তোমার সঙ্গে থাকে না৷ সে রোজ দুপুরে তোমাকে ফোন করে ডিভোর্সের পেপার রেডি করতে বলার জন্য৷ তুমি ফোন রিসিভ কর না৷’
আমার হাসি পেল৷ বারান্দায় এখনও পরদা উড়ছে৷ বললেই হল সুনন্দিনী আমার সঙ্গে থাকে না? সে রোজ রাতে অফিস থেকে ফিরে ঘুমায় এই বিছানার উপরে, সকালে আমার জন্য চা করে দেয়… রোজ দুপুরে আমাকে না পেয়ে গার্ডের কাছে ফোন করে…
‘সুনন্দিনী…’ বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি৷ হাতের ধাক্কায় পরদা সরিয়ে ঢুকে এলাম
ভিতরে, ‘সু…’
শব্দটা গলাতেই আটকে গেল৷ ছাদে গেছে তার মানে৷ নিশ্চয়ই এই লোকগুলো ছাদে পাঠিয়ে দিয়েছে ওকে৷
একছুটে দরজা দিয়ে বেরিয়ে ছাদের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলাম আমি৷ এক ধাক্কায় খুলে ফেললাম ছাদের দরজাটা৷
(নয়)
শনশন করে হাওয়া বইছে ছাদময়৷ চারপাশে ঘুমিয়ে রয়েছে কলকাতা শহর৷ কোথা থেকে যেন ঘণ্টার শব্দ ভেসে আসছে৷ উপরে এক বিচিত্র মায়াবি তেরপলের মতো আকাশে ফুটে রয়েছে নক্ষত্ররা৷ যেন এইমাত্র কোনও ছবি ফুটে উঠবে সেখানে৷ অথচ এত আয়োজনের মাঝে সুনন্দিনী নেই৷ কোথাও নেই…গেল কোথায়?
আমি চোখ রগড়ে নিলাম৷ এত আলো ছড়িয়ে আছে আজ ছাদ জুড়ে৷ তাও কি ভুল হচ্ছে চোখে?
‘ছোটো থেকে কিছু স্বপ্ন ছিল আপনার অপরেশবাবু…’ আবার সেই লোকটা এসে দাঁড়িয়েছে ছাদে৷ উফ কী অসহ্য৷
‘বড়ো লেখক হওয়ার স্বপ্ন, বিখ্যাত হওয়ার স্বপ্ন৷ কিন্তু প্রতিভা ছিল না৷ ফলে বড়ো কিছু হতে পারেননি৷ মিসেস ঘোষের সঙ্গে সম্পর্কটাও ভেঙে যায় মাসখানেক আগে, কাগজের অফিসে চাকরি করতেন, সেটাও চলে যায়৷ সমস্ত দিক থেকে হতাশা এসে ঘিরে ধরে আপনাকে… আপনি বুঝতে পারেন জীবন আর আপনার নিয়মে চলছে না, ঠিক যেরকম জীবন আপনি বাঁচতে চেয়েছিলেন তার বিপরীত প্রবাহে সময় নিয়ে যাচ্ছে আপনাকে, আপনি একা হয়ে পড়েন…’
‘দেখুন আপনি নিশ্চয়ই জানেন সুনন্দিনী কোথায়? বেশি জ্ঞান না মাড়িয়ে বলে ফেলুন দেখি ও কোথায়?’
‘মানুষ আসলে কী চায় জানেন?’ লোকটা আমার মুখের দিকে একটানা চেয়ে আছে, যেন পড়ে ফেলতে চাইছে আমার সমস্ত শিরার কম্পন, ‘ইমপ্যাক্ট, ক্ষমতা৷ সেটা টাকাপয়সার হোক, সেক্স কিংবা ফেম যা-ই হোক না কেন৷ মানুষ তার নিজের জীবনকে নিজের ক্ষমতা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়৷ আপনি বুঝতে পারছিলেন আপনার হাতে আর কোনও ক্ষমতা নেই৷ না কাউকে আটকে রাখার, না নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার৷ সোজা কথায় আপনার কিছুতে আর কারও কিছু যায় আসে না…’ আমি ছাদের কিনারে সরে এলাম৷ আরও জোরে হাওয়া বইতে শুরু করেছে কি এখন?
‘অর্ধেন্দুবাবুর থেকে একদিন একটা ফ্লুরোসেন্ট প্যাক নিয়ে এলেন৷ তার মধ্যে একটা অপরিচিত গোল চাকতি আপনাকে ভাবিয়ে তুলল৷ এবং সেই সুযোগেই আপনার অবচেতন মন নিজেই নিজেকে একটা গল্প বলল৷ সে চাকতিটা নাকি মহাকাশের কোনও একটা কোনায় একটা গ্রহকে নিয়ন্ত্রণ করে৷ আপনি ভাবলেন পৃথিবীর ভাগ্য আপনার ছাদের দেওয়ালে আপনার হাতের মুঠোয় ঝুলে আছে… নিজেকে সাত বিলিয়ন মানুষের রক্ষাকর্তা মনে হল আপনার… ওই যে… বলছিলাম না, মানুষ আসলে ইমপ্যাক্টফুল হতে চায়…’
‘সুনন্দিনীর কথা ভেবেছিলাম আমি, আর কারও না… আমার আর কাউকে রক্ষা করার দায় পড়েনি…’
‘আপনি কাউকে রক্ষা করেনওনি মিস্টার ঘোষ৷’
‘প্রমাণ আছে আমার কাছে… ওই সাইটটা…’ ফোনটা হাতে নিয়ে বুকমার্কটা বের করলাম৷ কিন্তু কই? কোথায় গেল সাইটটা? একটু আগেই তো খুলেছিলাম৷
‘ওরকম কোনও সাইট ছিল না কখনও অপরেশ৷ সিকিউরিটি গার্ডকে যে কাগজটা আপনি দেখিয়েছিলেন তাতে আদৌ ওরকম কোনও খবর ছিল না৷’
প্রবীর এসে দাঁড়িয়েছে ছাদে৷ আমার দিকে চেয়ে আছে সে৷ তারাদের আলো এখন আরও বেড়ে উঠেছে৷ এক টুকরো মেঘ নেই আকাশের কোথাও৷ আমি উদভ্রান্তের মতো দেখতে লাগলাম চারিদিকে৷ এরা যা বলছে তার কোনওটাই বিশ্বাস হচ্ছে না আমার৷ ওই শুঁড়গুলো হয়তো এখন ছড়িয়ে পড়েছে আমার গোটা সিলিংয়ে…. আর কোনও তারা ফুটে নেই… অন্ধকার… কত শখ করে জোগাড় করেছিলাম সুনন্দিনীর জন্যে… আমাদের জন্য…
‘নিজের উপরে বিশ্বাস রাখুন মিস্টার ঘোষ৷ জীবনে যে কোনও জায়গা থেকে ঘুরে দাঁড়ান যায়৷ কেবল একটু বিশ্বাস দরকার, সময় দরকার… মিস্টার ঘোষ…’
‘আপনি ভুল বলছিলেন স্যার৷ একটা জিনিসের উপরে নিয়ন্ত্রণ আছে আমার৷’ আমি হেসে বলি৷ এখন সেই ঘণ্টার শব্দটা থেমে গেছে৷ চারতলা ফ্ল্যাটের ছাদটা এখন অদ্ভুত নিস্তব্ধ হয়ে আছে, ‘আমার শরীরটা, এটা এখনও আমার ইচ্ছাতেই চলে৷’ ছাদের কিনারেই সরে এসেছিলাম৷ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম পাঁচিলের উপরে৷
‘একী! এসব কী করছেন আপনি?’
দু-জনেই এগিয়ে এল আমার দিকে৷ তারপর থেমে গেল, ‘প্লিজ পাগলামি করবেন না স্যার৷’
কানের পাশ দিয়ে সজোরে হাওয়া বইছে, কেন জানি না মনে হচ্ছে কলকাতা শহরে আমার এই ছাদের পাঁচিলের থেকে উঁচু জায়গা নেই আর, ‘আচ্ছা ধরুন যদি সত্যি দু-মাস পরে এই পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যেত, কী করতেন আপনারা?’ লক্ষ করলাম প্রবীর একটু একটু করে এগিয়ে আসছে আমার দিকে৷ নীচে তাকিয়ে পায়ের ফাঁক দিয়ে দেখলাম ফ্ল্যাটের সামনের রাস্তাটা ফাঁকা পড়ে আছে৷
‘আমাদের সবার এরকম একটা ছোটো পৃথিবী থাকে৷ যেখানে থাকতে ভালোবাসি আমরা৷ সেটা হুট করে একদিন শেষ হয়ে গেলে মানুষেরও আর মাথার ঠিক থাকে না জানেন, দেখতেই পাচ্ছেন আমারও ঠিক নেই…’
উপরের দিকে মুখ ফেরালাম আমি, ‘দেখুন, কী উজ্জ্বল একটা রাত আজকে, ঠিক এরকম একটা রাতে…’
‘অপরেশবাবু উ..উ..উউউ.’
একটা চিৎকার ভেসে এল ছাদের দিকে থেকে৷ অনুভব করলাম আমার পায়ের নীচে পাঁচিলটা নেই আর৷ হাওয়ায় ভেসে পড়েছি আমি৷ শরীরটা যেন শুয়ে পড়তে চাইছে ফাঁকা হাওয়ার উপরে৷ আবার চোখে পড়ছে সেই বিরাট বিপুল আকাশটা… তার ঠিক মাঝখানে চাঁদের পাশে জেগে আছে একটা বেগুনি গোলক… ডিমের খোলার মতো ফেটে গেছে সেটা… ভিতর থেকে কিছু বেরিয়ে আসছে… আমার শরীরটা কি নীচে এসে পড়েছে? একটা গরম তরল ছুঁয়ে যাচ্ছে পিঠ৷ চেয়ে দেখলাম আমার ঠিক পাশেই কেউ শুয়ে আছে৷ হাসলাম৷
‘সুনন্দিনী, তোমাকে বলেছিলাম না, আবার একদিন আমরা খোলা আকাশের নীচে শুয়ে থাকব? দেখো, আজ ঠিক তেমন একটা রাত… শুধু সময়টা…’ সুনন্দিনী কিছু উত্তর দেয় না৷ অস্থির চোখে আমার মুখে কী যেন খুঁজে চলেছে সে৷
‘ভালোবাস না আজ আর আমাকে?’
এবারেও উত্তর দিল না সে৷ তবে ওর চোখ দুটো খোলা আছে এখন৷ সেদিকে চেয়ে রইলাম আমি৷ বহুদিন পর ওর চোখদুটো আমাকে জানিয়ে দিল সব কথা৷ এমন একটা চোখের দিকে তাকালেই তো জেনে নেওয়া যায় সব…
একটু আগের সেই গুনগুন শব্দটা বেড়ে উঠেছে৷ আকাশ ছাপিয়ে গোটা মহাবিশ্ব জুড়েই যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সেটা৷
সুনন্দিনী কিছু একটা বলছে আমাকে৷ কিন্তু তার গলার আওয়াজ ঢেকে যাচ্ছে শব্দটায়৷ সে আমার আরও কাছে সরে আসার চেষ্টা করল, আমিও হাত বাড়িয়ে দিলাম তার দিকে৷ কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে…
ভেঙে যাওয়া সেই বেগুনি গ্রহটার বুক ফেটে বেরিয়ে এল অজস্র দানবিক শুঁড়৷ লকলকে সাপের মতো কয়েক আলোকবর্ষ পেরিয়ে ছুটে এল আমার দিকে৷ ক্রমশ গোটা আকাশ, আমার ফ্ল্যাট, সুনন্দিনীকে ছাপিয়ে সে জড়িয়ে ধরল আমাকে…