শীতল শহুরে গুঞ্জন

শীতল শহুরে গুঞ্জন 

একটা বিরাটাকায় সাপ আকাশে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছিল। মাঝে মাঝে নিচের ঘন বনে ডুব দিয়ে আবার আকাশে ভেসে উঠছিল সাপটা। সূর্যটা মাঝে মাঝে সাপের আড়ালে ঢেকে যাচ্ছিলো। আবার বেরিয়ে আসছিল যখন সাপটা সরে যায়। আঁকাবাঁকা হয়ে আকাশে খুব ধীর গতিতে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছিল সাপটা। খাইরুল সেই বনের ভেতরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মাথা উঁচু করতেই সাপটাকে দেখতে পেলেন। বিশালাকায় সাপটার কাছে খাইরুল সাহেবের নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হল। সাপটার মুখ দেখতে পাচ্ছিলেন না তিনি। শুধু বিশাল শরীরটাই দেখতে পাচ্ছিলেন তিনি। সাদা আঁশের ওপরে কালো কালো ফুটকি। তিনি সাপটাকে জিজ্ঞাসা করলেন, 

“এই বন থেকে বের হওয়ার রাস্তা কোন দিকে?” 

“এই বনে যে ঢোকে সে বের হওয়ার জন্য ঢোকে না।” সাপটা হিসহিস করে বলল। 

“আমাকে খুব তাড়াতাড়ি বের হতে হবে। মেয়েটার খুব কষ্ট হচ্ছে। মেয়েটা খুব বড় বিপদে আছে।” 

“সব ক্ষত শুকিয়ে যায়। সে যত বড় ক্ষতই হোক। এই ক্ষতও শুকিয়ে যাবে। আমি সব খেয়ে ফেলব। প্রতিদিনের হাসি। সেই হাসির সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলো। আর প্রতিদিনের কান্না আর সেই কান্নার জল- সব খেয়ে ফেলব। ঠিক যেভাবে কাক শকুন আবর্জনা খেয়ে ফেলে, ঠিক সেভাবে আমি তোমাদের দুঃখের স্মৃতিগুলোকে খেয়ে ফেলব।” 

“আমার ক্ষতগুলোও খেয়ে ফেল। আমার ক্ষতের প্রলেপ বুলিয়ে দাও।”

“এর বদলে তুমি কী দেবে?” 

“আমার জীবন।” 

হঠাৎ খাইরুল সাপটার মুখ দেখতে পেলেন। ঘন গাছগুলোর ভেতর দিয়ে বিরাটাকায় একটা মানুষের মুখ বের হয়ে আসল। সারা মুখ নীল সবুজাভ আঁশে ঢাকা। চোখজোড়া নীল আলোর মত জ্বলছে। সরু ঠোঁটজোড়ার ফাঁক দিয়ে বের হয়ে এলো সাপের জিভ। খাইরুল হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন। নীল সমুদ্রের পানির মত টলটলে সেই চোখের দিকে তাকিয়ে খাইরুল ভুলে গেলেন সব অতীত। বর্তমান। ভবিষ্যৎ। নিজেকে যেন এক গভীর বনের ভেতরে হারানো হ্রদে সাঁতার কাটতে থাকা বুনোহাঁস বলে মনে হল। খাইরুল ডুবে যেতে লাগলেন সেই গভীর শীতল জলে। আরও গভীরে। অনেক অনেক গভীরে। 

খাইরুল ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন। সারা ঘর রোদে ভেসে যাচ্ছে। শরতের সকালের রোদ। ব্যালকনি থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে রোদ সারা বসার ঘরে ছড়িয়ে গিয়েছে। খাইরুল বিস্ফোরিত চোখে সেই রোদের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙা আজ নতুন না। ঘুম ভাঙার কিছুক্ষণ পরেই সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিন্তু আজকের দুঃস্বপ্নটা খাইরুল সাহেবের মাথা থেকে গেল না। অনেকক্ষণ চোখের সামনে সেই সাপটার চেহারাটা ভাসতে থাকল। 

টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালেন খাইরুল। দু’হাতে ঘর্মাক্ত মুখটা ঘসলেন। ঘামে ভিজে জবজব করছে সারা শরীর। কিছুক্ষণ ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে এলোমেলো পায়ে হেঁটে রান্না ঘরে গেলেন। ঘরের কোণায় রাখা লম্বা আয়নাটাতে তার উলঙ্গ শরীরের প্রতিবিম্ব ফুটে উঠল কিছুক্ষণের জন্য। মাথার ভেতরে একটা চাপা যন্ত্রণা। এক কাপ কফি খেতে হবে। কফি নেই। প্রায় শেষ। আজ ফেরার পথে আনতে হবে। 

কফির পানি ফুটছে। 

খাইরুল একটা বক্সার পরলেন। কাল রাতে কি কি হয়েছিল সেটা একবার মনে করার চেষ্টা করলেন। পুরো ব্যাপারটা তার কাছে সিনেমার মত মনে হল। ফুটপাত থেকে লোকটার গায়েব হয়ে যাওয়া, মেরিলিনার চলে যাওয়া। মেরিলিনার কথা মনে হতেই খাইরুল সাহেবের মনে অভিমান, রাগ আর ঘৃণা একসাথে জমা হল। চিরকুটটার কথা মনে হল। যে মেয়েটাকে তিনি বার বার বাঁচাতে চাচ্ছিলেন, সাহায্য করতে চাচ্ছিলেন, সেই মেয়েটা আজ এইভাবে তাকে না বলে পালিয়ে গেল? কী এমন করেছিলেন তিনি যে মেরিলিনাকে পালিয়ে যেতে হবে? কেন তাকে জানোয়ার বলে গালি শুনতে হবে? খাইরুল রাগ করলেন না। একটা তীব্র অভিমানে তার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেল। পাশের ঘরটার দিকে একবার তাকালেন তিনি। বদ্ধ দরজার ওপাশে মেয়েটা পুরো একটা দিন কাটিয়েছে। সারা এপার্টমেন্টে এখনও যেন মেয়েটার গায়ের গন্ধ লেগে আছে। ঠিক কি এমন হল যে তাকে চলে যেতে হবে? 

কফি ঢালতে ঢালতে বারবার গতরাতের কথা পড়ল তার। হঠাৎ খাইরুলের মনে পড়ল সেই চাবিটার কথা। যেটা থানায় আছে তার লকারে। ভুল করে তিনি কাল ফেলে এসেছেন। কিন্তু অভিমান একটা সামান্য চাবির চিন্তাকে বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে দিল না। খাইরুল সাহেবের কাছে হঠাৎ করে পুরো পৃথিবীটা অর্থহীন মনে হল। যে মানুষটার আপন বলতে কেউ নেই, একটা কথা শোনার মত কেউ নেই- তার জীবনের অর্থ কি হতে পারে? সারাদিন চোর ডাকাত ধরা আর তাদেরকে ধরে ধরে জেলে পোরা? যে মানুষটা নিজের বোনকে বাঁচাতে পারে না তার নিজের বাঁচার অধিকার কতটুকু? খাইরুল সাহেবের মনে হল মাথাটা এখনি যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাবে। দেওয়ালে একটা ঘুষি মেরে কফির কাপটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন ব্যালকনি দিয়ে। একটা চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো তার মুখ দিয়ে। 

হঠাৎ একটা মৃদু সুর কানে এলো খাইরুল সাহেবের। একই সুর। বার বার বাজছে। মোবাইলের রিংটোন। খাইরুল তার মোবাইলটা খুঁজতে লাগলেন। মাথার ভেতরের মতই এলোমেলো ঘর। অনেক খোঁজাখুঁজির পর শেষমেশ মোবাইলটা পাওয়া গেল সোফার দুই সিটের ভাঁজে। 

থানার সেকেন্ড অফিসার সাজ্জাদ ফোন দিচ্ছে। 

“হ্যালো স্যার?” 

“হ্যাঁ সাজ্জাদ। বল।” 

“স্যার অসুস্থ নাকি স্যার?” 

“আরে না। মানে…… হ্যাঁ। একটু।” 

“থানায় একগাদা লোকজন এসেছে। আপনার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে। কাল আসতে বলব?” 

“না। আমি আসছি।” 

“আর এসপি স্যার ফোন দিয়েছিলেন স্যার। আপনাকে মোবাইলে পাচ্ছিলেন না। তাই থানায় ফোন দিয়েছিলেন।” 

“দেখছি।” 

লাইনটা কেটে গেল। খাইরুল দু হাতে মুখ ঢেকে অনেকক্ষণ বসে থাকলেন সোফার ওপরে। অন্যসময় হলে সাথে সাথে এসপি স্যারকে ফোন করতেন তিনি। আজ এক নির্লিপ্ততা পেয়ে বসল যেন। কিছুতেই যেন কিছু আর এসে যায় না। অনেকক্ষণ ধরে গোসল করলেন তিনি। তারপর অনেক সময় নিয়ে ইউনিফর্ম পরলেন। খাওয়ার টেবিলের ওপরে একটা একশ টাকার নোট রাখলেন। এটা তার অনেক পুরনো অভ্যাস। তারপর নিচে নামলেন। 

গার্ড রুমের সামনে টুল পেতে শামসুল খুব আগ্রহ নিয়ে পায়ের আঙুলের নখ কাটছে। খাইরুলকে দেখে উঠে দাঁড়ালো। সালাম দিল। খাইরুল সাহেবের মনে হল, কালকে দেরি করে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করা উচিত শামসুলকে। তারপর খুব কঠিন কিছু কথা বলে উচিত। চাকরিই নট করে দেওয়া উচিত আসলে। কিন্তু পরক্ষনেই তার মনে হল, মেরিলিনা তো নিজের ইচ্ছায় চলে গিয়েছে। শামসুলকে বলার কিছুই নেই। শুধু শুধু নিজের সম্মান নষ্ট। 

খাইরুল তার দেড়শ সিসির মোটরসাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। 

থানায় অনেক মানুষ। প্রতিদিনের চাইতে আজ যেন অনেক বেশি মানুষ। খাইরুল সাহেবের আজ যেন এই জায়গাটাকে খুব বেশি অচেনা আর বিরক্তিকর মনে হল। রোজকার মত তোয়ালে ঢাকা তেল চিটচিটে চেয়ারটাতে বসতেই পিয়ন চা দিয়ে গেল। রোজকার মত সেকেন্ড অফিসার সাজ্জাদ এসে একটা স্যালুট ঠুকল। তারপর বলল, “তারাগাছি থেকে কয়েকজন লোক এসেছে স্যার। লাশের ছাড়পত্র চায়। সেই ভোরবেলা থেকে বসে আছে। 

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “ডাকো ভেতরে।” 

সেকেন্ড অফিসার সাজ্জাদ দুইজন মাঝবয়সী লোককে নিয়ে এলো। দুইজনের ভেতরে একজন বলল, “হার। আমরা গরীব মানুষ। আজ তিনদিন আমার ভাইটার লাশ মর্গে পছতিছে। মুর্দা মাটি চায় ছার। আমরা আর কোট কাছারির ঝামেলায় যেতে চাচ্ছিনে। আপনি যদি ইট্টু চিঠি দি দিতেন। আমি ভাইয়ের লাশটা নিয়ে বাড়ি ফিত্তাম। গরীবের জন্যি কোট কাছারি মানেই ফাঁদ বোজেনই তো।” 

“পোস্টমর্টেম হয়েছে?” খাইরুল সাজ্জাদকে জিজ্ঞাসা করলেন। সাজ্জাদ হ্যাঁ সুচক মাথা নেড়ে একটা খাম এগিয়ে দিল। খাইরুল নির্লিপ্ততার সাথে খামটা নিলেন। তারপর সেখান থেকে একটা চিঠি বের করে সই করে দিলেন। তারপর মাঝ বয়সী লোকটার দিকে বাড়িয়ে ধরলেন। একবারও জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা হল না যে পোস্টমর্টেমটা কে করল আর কিই বা লিখল রিপোর্টে। 

কালকেই যে মানুষটা এই লাশ নিয়ে বাদী হয়ে মামলা করতে যাচ্ছিলো, আজ সে এমন নির্লিপ্ত হয়ে লাশের ছাড়পত্র দিয়ে দিল। পোস্টমর্টেমের রিপোর্টটা পর্যন্ত একবার দেখল না! সাজ্জাদের চোয়াল ঝুলে গেল। মাঝ বয়সী লোকগুলো চলে যাওয়ার পরে সাজ্জাদ আরও একবার জিজ্ঞাসা করল, “স্যার শরীর ঠিকঠাক আছে তো? নাকি?” 

খাইরুল মাথা নাড়লেন। উদ্দেশ্যহীন মাথা নাড়া। সাজ্জাদ বুঝতে পারলেন না স্যার হ্যাঁ বললেন নাকি না বললেন। তারপর বললেন, “স্যার, বহরমপুরে যতগুলো কালো টয়োটা আছে সবগুলোর সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছি। ডাঃ শফিককেও খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। খুঁজে পাওয়া গিয়েছে মানে কাল রাতে তিনি নাকি নিজেই বাড়ি ফিরেছেন। উনার উয়াইফ তো আরেকটু হলেই মিসিং ডায়েরি করে ফেলছিলেন।” 

খাইরুল ক্লান্ত গলায় বললেন, “সাজ্জাদ তুমি এখন আসো।” 

সাজ্জাদ একটা মাথা নেড়ে চলে গেল। খাইরুল সাহেবের বুকের ভেতরে যেন শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। কনকনে শীতলতায় ভেতরটা যেন অনুভূতিহীন। কোন কিছুই আর তাকে স্পর্শ করছে না যেন। হঠাৎ চাবিটার কথা মনে হতে তিনি লকার থেকে চাবিটা বের করলেন। ধাতব পাত লাগানো চাবিটা। হাতের মুঠোয় নিলে মনে হয় যেন একটা সাপের মৃতদেহ। ঠাণ্ডা। নিস্তরঙ্গ। মেরিলিনার হাতটাও কি এমন ঠাণ্ডা ছিল? চাবিতে লেখা ঠিকানাটা একবার দেখলেন তিনি। কৌতূহলহীন চোখে ঠিকানাটা যেন নিরর্থক কিছু অক্ষর আর সংখ্যা মনে হল। মেরিলিনার শেষ স্মৃতি হিসাবে তিনি চাবিটা পকেটে ঢুকালেন। 

বিকাল পর্যন্ত কোনরকম ভাবে কেটে গেল। সাজ্জাদকে স্বাভাবিকভাবেই আজ বেশি দৌড়াদৌড়ি করতে দেখা গেল। বেশ কয়েকটা ফাইল জমা হয়ে গেল খাইরুল সাহেবের টেবিলে। খাইরুল ফিরেও দেখলেন না। এসপি স্যারকেও ফোন করলেন না। সন্ধ্যা নামতে নামতেই খাইরুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, তিনি চাকরি ছেড়ে দেবেন। তারপর অনেক দূরে কোথাও চলে যাবেন। যেখানে হারানোর কিছু নেই, পাওয়ারও কিছু নেই। আজীবন মানুষের জন্য যতটা করেছেন, মানুষগুলো ঠিক ততটাই তার থেকে দূরে সরে গিয়েছে। 

“স্যার?” 

“কে? এসপি ভূষন?” 

“জী স্যার।” 

“বলেন। বহরমপুরের ওসির সাথে কথা হয়েছে? কি যেন নাম? খাইরুল না?” 

“হ্যাঁ। হয়েছে স্যার। ইয়াং ছেলে তো। বেয়াড়া। বুঝছেন? তারাগাছির কেসটা বন্ধ করবে না বলে মনে হল। আপনি চিন্তা করবেন না স্যার। আমি যখন আছি, তখন কোন ব্যাপার না। কেসটা আমি হ্যান্ডেল করব। ফাইলগুলো কালকেই থানা থেকে নিয়ে আসানোর ব্যবস্থা করব।” 

“আচ্ছা। নিয়ে আসা হলে আমাকে জানাবেন। আমার একজন এজেন্ট গিয়ে আপনার ওখান থেকে কাল ফাইলগুলো নিয়ে আসবে।” 

“অবশ্যই স্যার। কোন ব্যাপার না। আর কিছু করতে হবে স্যার?”

“আপাতত না। অনেক ধন্যবাদ।” 

“স্যার একবার এদিকে আসলে চা খেয়ে যাবেন কিন্তু।”

“নিশ্চয়।” 

***

খাইরুল যখন বাসায় ফিরলেন তখন মাগরিবের আজান হচ্ছে। সদর গেটে মোটরসাইকেল থামাতেই শামসুল এসে দরজা খুলে দিল। মোটরসাইকেলটা রেখে খাইরুল আস্তে আস্তে তিনতলায় উঠলেন। এপার্টমেন্টের দরজা খুলেই সোফার ওপরে শুয়ে পড়লেন। একবারও লক্ষ্য করলেন না, খাওয়ার টেবিলের ওপরে রাখা একশ টাকার নোটটা নেই। কেউ এপার্টমেন্টে ঢুকেছিল। যেটা খুঁজছিল সেটা তখন খাইরুল সাহেবের প্যান্টের বাম পকেটে। তাকিয়া মহলের চাবি। 

সন্ধ্যার পরে কফি বানাতে গিয়ে খাইরুল সাহেবের খেয়াল হল কফি আনা হয়নি। একরাশ বিরক্তি চাপা দিয়ে তিনি আবার বাইরে বের হলেন। বেশ কিছুদূর হেঁটে গিয়ে দ্বীপ শহরের মোড়। বহরমপুর শহর থেকে সাত কিলোমিটার দুরে হলেও সন্ধার সময় বেশ জমজমাট থাকে মোড়টা। কিন্তু আজ একটা বড়সড় ভিড় দেখতে পেলেন খাইরুল। ভিড়টা যেন খাইরুলকে চুম্বকের মত টানল। একটা চাপা গুঞ্জন ভিড়ের ভেতরে। কিন্তু ভিড়ের দিকে যেতে গিয়েও গেলেন না খাইরুল। শাপলা স্টোর থেকে কফি কিনে নিয়ে হাঁটা ধরলেন নিজের এপার্টমেন্টের দিকে। 

খাইরুল যদি ভিড় ঠেলে সামনে যেতেন, তাহলে দেখতে পেতেন মোড়ের ট্রাফিক সিগন্যাল পোস্টের সাথে একটা লাশ ঝুলানো আছে। লাশের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে ঝুলছে। তার কিছুটা নিচে পিচ রাস্তার ওপরে পড়ে আছে। মাছি ভন ভন করছে লাশটাকে ঘিরে। বীভৎস এক দৃশ্য। লাশের গলায় একটা প্ল্যাকার্ড লাগানো। সেখানে লেখা, 

“নিজের পাপের কারণ বিনাশ করাই সব থেকে বড় প্রায়শ্চিত্ত”

*** 

খাইরুলের মোবাইলের রিংটোন বাজলো। সাজ্জাদের ফোন। খাইরুল ধরলেন না। ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন সোফার ওপরে। ফোনটা ধরলে খাইরুল শুনতেন, বহরমপুর রেলওয়ে স্টেশনে আর শিশুপার্কের সামনে লাশ পাওয়া গিয়েছে। প্রতিটা লাশেই প্ল্যাকার্ড টাঙানো। যেটাতে লেখা, “নিজের পাপের কারণ বিনাশ করাই সব থেকে বড় প্রায়শ্চিত্ত।” 

পরদিন সকাল পর্যন্ত লাশের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো চারে। সবগুলোই বীভৎস। তাকানো যায় না। সারা শহরে গুঞ্জন শুরু হল। আতংক ছড়িয়ে যেতে শুরু করল বহরমপুরের অলিগলিতে। লাশগুলো স্থানীয় রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের। যাদের পায়ের কাছে পুরো বহরমপুর শহর মাথা নত করে থাকত, তাদেরকে এমন বীভৎসভাবে দেখে সাধারণ লোকজনের ভেতরে একটা অস্বাভাবিক অস্থিরতা দেখা গেল। চায়ের দোকানগুলো ফাঁকা হতে শুরু করল সন্ধ্যার পরেই। পুলিশের তৎপরতা বেড়ে গেল হঠাৎ করে। এমন এক অস্থির সময়ে খাইরুল তার ইস্তফাপত্র লিখে ফেললেন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *