শিশু তপন

শিশু তপন

ছোটোবেলায় শুনিয়াছি—রূপকথার রাজপুত্র সোনার কাঠি স্পর্শ করাইয়া রাজকন্যার নিদ্রা ভাঙিয়া দেয়। বুড়া ঠাকুরমার মুখে ইহা শুনিয়া মনে হইত, নিছক একটি কাহিনি। কিন্তু বয়স হইবার সঙ্গে সঙ্গে সেই বিশাল জনহীন পুরীর মাঝে অনুপম সৌন্দর্যলক্ষ্মী রাজকন্যা ও তেজস্বী এক রাজপুত্রের সাক্ষাৎকার ক্রমশই অপরূপ হইয়া উঠে।

সেইরকম একটি জীবন্ত কাহিনি ছোটোবেলায় দেখিয়াছিলাম। তখন ভাবিয়াছিলাম— মানুষের কথা ও কাজের মধ্যে সত্য কতটুকু! কেবল প্রয়োজনবোধে বলিয়া ও করিয়া চলিয়াছে। কিন্তু এখন মনে হয়, কথার পিছনে যে অনুপ্রেরণাটুকু থাকে, অন্তরের ভিতরকার সেই বস্তুটির দাম অনেক।

অভ্রভেদী অচলায়তন, অস্ত সূর্যের রাঙা রশ্মি, লাল ও দেবদারু গাছ : ইহাদিগের মাঝে দুইটি একান্ত অজ্ঞাত বালক-বালিকার ইতিহাসই আমি বলিব। ঢাকা শহরে বাড়ি। বাড়ির মালিক যিনি তিনি কায়স্থ, নাম অবিনাশ রায়। বয়সে প্রৌঢ়, দোহারা ছিপছিপে গঠন, শ্যামবর্ণ, চোখে সোনার চশমা, চুল দুই-এক গাছি পাকিয়াছে। একটি ছেলে আছে, বছর এগারো। নাম তপন। স্ত্রী নাই, অনেকদিন মারা গিয়াছে। এক বিধবা বোন আছে, আর ঝি।

একটা অয়েলক্লথের কারবার আছে, বেশ চলে। সচ্ছল, কিন্তু খাইবার লোক নাই। চারিটি মাত্র প্রাণী। কনিষ্ঠা বিধবা বোনটি ভাইয়ের পানে চাহিয়া থাকে আর ভাবে, বয়স আর এমন কী হইয়াছে যে আবার বিবাহ করিলে সংসার ওলট-পালট হইয়া যাইবে। মৃত এক প্রাণীর স্মৃতি লইয়া বাঁচিয়া থাকা মরারই শামিল। একটি ডাগর দেখিয়া বউ আনিবে, নিজে তাহাকে সাজাইয়া দিবে, না একি অনাসৃষ্টি কান্ড! বউ যদি খারাপই হয়, তাহা হইলে সে আছে কী করিতে? কিন্তু বলিয়াই বা লাভ কী? আট বছর ধরিয়া তো বলা হইতেছে, কই কিছুই তো হয় না! তবুও একবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও সরযু কথাটি ঘুরাইয়া বলে, এই-তো আমাদের পাশের বাড়ির ভদ্রলোকটি আবার বিয়ে করেছেন, একপাল ছেলেমেয়েও রয়েছে। কই কেউ বলুক দেখি, কতটুকু অশান্তি ওদের বাড়িতে আছে? ভগ্নীর কথায় অবিনাশ মুখ তুলিয়া নীরবে হাসেন, বাহিরের পানে একবার তাকাইয়া বলেন, তা আমি অস্বীকার করছিনে সরো, আমার ওরকম নাও ঘটতে পারে, এইটুকুই শুধু বলি। আর বিয়ে করলে আমাকেই বা বিশ্বাস কী? আমিও বদলে যেতে পারি। তখন তপুকে দেখবে কে? শেষ সময় অবিশ্যি সে আমাকে আবার বিয়ে করতে বলে গেছে। তোমরা বলতে পার, সে যখন বলেছে তখন তার কথাটা রাখা দরকার। কিন্তু আমি যে তার মনের কথাটি পড়েছিলাম তার মুখের উপর। আর বুঝেছিলাম এই যে, তপুর উপর কোনো খারাপ ব্যবহার হলে সারাক্ষণ তার মুখ আমার মনে পড়বে। আচ্ছা, এখন তুমিই বল বোন, আমি যদি আবার সুখের সংসার পেতে পুণ্যি সঞ্চয় করি, তাহলে কি তার স্বর্গগত আত্মা তৃপ্তি পাবে? অবিনাশের চোখ দুটি ছলছল করিয়া উঠিল। সরযু ইহার পর আর বলিবে কি?

পিছনে একটা শব্দ হইল, হুম—অবিনাশ চকিত দৃষ্টিতে ফিরিয়া চাহিলেন, দেখিলেন, তপন দাঁড়াইয়া ঘাড় কাৎ করিয়া মুচকি হাসিতেছে। তিনিও হাসিয়া ফেলিলেন, জিজ্ঞাসা করিলেন, এত সকালে যে ইস্কুল থেকে এলি তপু? তপন থপ, করিয়া বইগুলা টেবিলের উপর ফেলিয়া বলিল, আজ আমাদের ইস্কুলের ফাইন্যাল ম্যাচ কি না, তাই ছুটি হল। আমি কিন্তু দেখতে যাব। তারপর পিতার গলা জড়াইয়া বলিল, আচ্ছা, তোমাদের সময় তোমরা ক্রিকেট খেলতে বাবা, এই আমরা যেমন খেলি!

অবিনাশ তপনের মুখটি দুহাত দিয়া ধরিয়া বলিলেন, খেলতুম, কিন্তু তোদের মতো নয় রে। তখন এসব কেনার পয়সা জুটত না, কাজেই বানিয়ে নিতুম।

–দুত্তোর, বানিয়ে আবার খেলা যায় নাকি?

সরযুর ডাক আসিল, ওরে তপু, খাবি আয়।

তপু জুতা পায়েই মসমস করিয়া খাবার ঘরের কাছে গিয়া বলিল, যা দেবে দাও, আমার হাতেই দাও পিসিমা, বাইরে থেকেই খেয়ে যাই। সরযু ব্যস্ত হইয়া বলিল, না, ওসব হবে না বাপু, এ আমি বলে রাখছি। জুতো ছেড়ে ভিতরে বসে খেয়ে যাও। তপু বিরক্ত হইয়া বলিল, আজ যে আমাদের ক্রিকেট ম্যাচ, তা জান না বুঝি?

-আচ্ছা তা পরে হবেখন, আগে খেয়ে নে বলছি? অগত্যা তপু জুতা ছাড়িয়া খাইতে বসিয়া গেল। একটু পরেই তাহাকে উঠিয়া যাইতে দেখিয়া সরযু বলিয়া উঠিলেন, ওকি রে, উঠছিস যে, সবটুকু খেয়ে যা। আমি আর পারিনে, কী দস্যি ছেলে বাবা! কালই আমি তোদের ছেড়ে চলে যাচ্ছি।

তপু যাইতে যাইতে বলিল, তাহলে বেশ হবেখন, মজা করে খাব আর ঘুরে বেড়াব।

পরের বৎসর। বর্ষাকাল। বিদ্যুৎ চমকাইয়া মেঘ ডাকে। ঝমঝম করিয়া বৃষ্টি আসে। বিশ্বপ্রকৃতি মুখর হয় ঘন কালো আকাশের অবিশ্রান্ত বারিপতনের অপরূপ শব্দে। এমন দিনে অতর্কিতে অবিনাশের এক বন্ধু আসিলেন। বলিলেন, চল অবিনাশ, আসামের হিল সেকশনটা দেখে আসি। যাবে? সে এক মজার জিনিস দেখতে পাবে। বৃষ্টিতে একটু কষ্ট হবে বটে।

তপনের তখন গ্রীষ্মের ছুটি। অবিনাশ যাইতে স্বীকৃত হইলেন। তপনও সঙ্গে গেল। তাহার মুখে খুশি আর ধরে না—নতুন দেশ দেখিতে পাইবে বলিয়া!

গৌহাটিতে গাড়ি পৌঁছিলে পর তপন বলিয়া উঠিল, এখানে সব টিনের ঘর কেন, বাবা? খুব গরিব বুঝি ওরা? ইট দিয়ে দালান বানাতে পারে না? অবিনাশ হাসিয়া বলিলেন, এখানে সবাই টিনের ঘরে থাকে। আমাদের চেয়ে বড়োলোকও, গরিবও।

বন্ধুর এক আত্মীয়ের বাসায় তাহারা উঠিল। আত্মীয়টি খুব আদর-যত্ন করিলেন, এই দূর দেশে নতুন একটি বাঙালির মুখ দেখিয়া। ভদ্রলোকের নম সতীশ। এক স্ত্রী, ছেলেমেয়ে হয় নাই, তিনি সকলের খাওয়ার আয়োজন করিতে লাগিলেন। সতীশ অভ্যগতদের স্নানের আয়োজন করিয়া দিয়া এক ফাঁকে রান্নাঘরে আসিয়া হাসিয়া বলিলেন, অতিথি খাওয়াতে তুমি খুব আমোদ পাও বীণা, এটা আমি জানি। কেমন, আজ পেলে তো? দূরে আছ বলেই ওদের খাওয়ানোর এত শখ। বাংলাদেশে থাকলে অতিথিসেবা কোথায় উঠে যেত! সতীশ মৃদু হাসিতে লাগিল।

বীণা মুখটি তুলিয়া গম্ভীরভাবে বলিল, হুঁ, চল না দেশে। দেখিয়ে দিই কাকে বলে খাওয়ানো। পুরুষ তোমরা, তোমরা কি বুঝবে একটি মানুষ খাইয়ে আমাদের কত সুখ!

সতীশ দুই হাত তুলিয়া বলিল, থাক, আর বলতে হবে না। কিন্তু মানুষ খাওয়ানোর অজুহাতে যেন এই অসহায় ক্ষীণ দেহটার উপর অবিচার করে বস না, এইটুকুই আমার অনুরোধ। তাহার কথা বলার ভঙ্গি দেখিয়া বীণা হাসিয়া ফেলিল। সতীশ তাহার মুগ্ধ আঁখি দুটি কর্মরত নারীটির উপর স্থাপন করিয়া বলিল, বাঃ, কি সুন্দরই না দেখাচ্ছে তোমাকে! দেখাবে না, সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা কি না—বিশেষত আজকের এমন একটা দিনে। তাই ভাবি, ভগবান যে আমায় এত সুখ দিলেন, এত সুখ আমি রাখব কোথায়? আচ্ছা তুমিই বল বীণা, এত ঐশ্বর্যের মাঝে দাঁড়িয়েও কীসের অভাবে মনটা আরও নিবিড় হতে পারে না?

অভ্যগতদের গলার আওয়াজ শোনা গেল। সতীশ আর দেরি না করিয়া চলিয়া গেলেন।

খাওয়া-দাওয়ার পর বীণা তপনকে একান্তে ডাকিয়া বলিলেন, তোমার নাম কী খোকা?

—তপন।

–তোমার মা নেই বুঝি?

নরম জায়গায় আঘাত পড়িল। তপনের মুখ করুণ হইয়া গেল। সে বলিল, আমার মা-র কথা বলছেন? যখন আমার বয়স তিন বছর তখন তিনি মারা যান। আমাদের বাসায় গেলে দেখবেন মা-র মস্ত বড়ো একটা ফটো। এতবড়ো ফটো আপনি দেখেননি কখনও। বাবা রোজ ভোরবেলায় মার দিকে চেয়ে কি যেন বলেন। অন্য কোথাও বেড়াতে গেলেও একটা ছোটো ফটো সব সময়েই ওঁর কাছে থাকে। আনব বাবার কাছে বলে? এই সরল ছেলেটির কথায় বীণার মুখ অবিনাশের প্রতি প্রশংসায় প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল। সে সস্নেহে তপনকে বুকের কাছে টানিয়া বলিল, ফটো অন্য সময় দেখিও তপু, কিন্তু তোমার বাবা যেন না জানেন। এমন সময়ে অবিনাশ ছেলেকে খুঁজিতে খুঁজিতে শেষে তাহাকে এই অবস্থায় দেখিয়া হাসিয়া ফেলিলেন। নিরুদবেগ প্রশান্ত মুখ সরল হাসিতে ভরিয়া গেল।

কয়েকদিন পরে একদিন ভোরবেলায় অবিনাশ সতীশকে ডাকিয়া বলিলেন, আজ কামাখ্যায় যাওয়া যাক, কী বলেন? সতীশ হাতজোড় করিয়া মাপ চাহিবার ভঙ্গিতে বলিল, ঐটিই আমাকে মাপ করবেন অবিনাশবাবু, কাছ থেকে এত দেখেও যার ঘেন্না না ধরে সে তাহলে মানুষ নয়। আপনি একলা গিয়েই না হয় উপলব্ধি করে আসুন, আমি সব ব্যবস্থা করে দিই।

যাইবার সময় বীণা তপনকে ডাকিয়া বলিল, আবার আজকেই ফিরে এস কিন্তু তপু। তপন হাসিয়া বলিল, আর যদি আজকেই না ফিরি?

-তাহলে তোমার সঙ্গে আড়ি। একটি দিনের তরেও কথা কইব না-বীণা বলিল।

একেবারেই যদি না ফিরি বেশ মজা হবে তাহলে না? দেখাও হবে না, আড়িও চলবে না কেমন? দুজনেই হাসিয়া ফেলিল।

তাহারা রওনা হইল।

দুই পাশে পাহাড়, বড়ো বড়ো গাছ। মাঝে মাঝে দু-একটা বাড়ি এবং তাহাদের মধ্যে আঁকা-বাঁকা পথের উপর দিয়া অবিনাশও তখন মন্থর গতিতে হাঁটিতেছিল। কামাখ্যার মন্দিরে পৌঁছিতে বেশি দেরি হইল না। পাহাড়ের উপর মন্দির, সেখানেই পান্ডাদের বাড়ি, তাহাদের অবস্থা ভালো। তীর্থযাত্রীরা সেখানে গিয়া কুমারী পূজা করে। কুমারী হয় পান্ডাদের মেয়েরাই।

টিলার উপরে উঠিবার সময় তপন ক্লান্ত হইয়া পড়িল। ঘর্মাক্ত মুখে লাল আভা পড়িয়া তাহাকে ভারী সুন্দর দেখাইল। কিন্তু ক্লান্ত হওয়া সত্ত্বেও সে ক্লান্তিকে স্বীকার করিতে চায় না। কী যেন একটা ইংরেজি ছবিতে সে দেখিয়াছিল কতকগুলা লোককে সাদা বরফের পাহাড়ে উঠিতে। তাহার মধ্যে একটা বালক একজনের কোমর ধরিয়া কেমন সুন্দর মার্চ করিবার ভঙ্গিতে বড়ো বড়ো পা ফেলিয়া উপরে উঠিতেছিল। এক নিবিড়ো সুখের অনুভূতিতে তপনের মনের শিশু আনন্দে নাচিয়া উঠিল। সে ছবির খোকাটির মতো বাবার কোমরের জামাটা হিচড়াইয়া টান দিল। অবিনাশ মুখ ফিরাইয়া হাসিয়া ফেলিলেন, বলিলেন ও কী হচ্ছে রে? আমার হাত ধরে আয়। কষ্ট হচ্ছে বুঝি উঠতে?

তপন তাচ্ছিল্যের সহিত ঠোঁট উলটাইয়া তেমনিভাবে বড়ো বড়ো পা ফেলিয়া বলিল, এরকম করে পা ফেলতে পারবে তুমি? কোথেকে পারবে, জানলে তো পারা যায়?

উপরে উঠিলে পর পান্ডারা ঘিরিয়া ধরিল। থাকিতে হইবে কিন্তু একজনের বাড়িতেই। কাছে একজন নিরীহ গোছের পান্ডা দাঁড়াইয়া ছিল। চেহারা দেখিয়া মনে হয় সে আর সকলের চেয়ে অপেক্ষাকৃত গরিব। অবিনাশের চোখ পড়িল তাহারই উপরে। সেই পান্ডাটা তাহার দৃষ্টিপথে পড়িয়া বলিল, বাবু আমার কাছে আসুন। অবিনাশ খুশি হইয়া বলিল, চল। আয়রে তপু।

বাড়ির উঠানে পা দিতেই নবাগতদের চোখ পড়িল একটি মেয়ের উপর। দশ বছর বয়স। উপুড় হইয়া কতকগুলা মটির পাত্রে কী যেন রাঁধিতেছিল। ছোটো ছোটো কোঁকড়ানো চুলওলা ছড়ানোকপালে, কানে, পিঠে।

পায়ের শব্দে চাহিয়া মেয়েটি গম্ভীরভাবে কহিল, এসেছ? আমি তোমাকেই খুঁজছিলাম বাবা, কবে রান্না হয়ে গেছে। এখনও তোমাদের জন্য আমি বসে আছি। আমার দিকেও তো চাইতে হয় বাপু। খেটে খেটে হয়রান হলুম।

পান্ডাটি মেয়ের কথা বলার ভঙ্গি দেখিয়া হাসিয়া উঠিল। অবিনাশের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, দেখেছেন বাবু? মেয়ে আমার কেমন পাকা গিন্নী, অবসর পাচ্ছে না এখনও, কী উপায় করি বলুন তো?

পিতার গলার অনুকরণ করিয়া মেয়ে বলিল, কী উপায় করি বলুন তো! না আমার আর সয় না বাপু! খাবে তো এস, না হয় আমি সব ফেলে দিই। অবিনাশের দিকে চাহিয়া বলিল, বাবু, আপনারাও আসুন। অবিনাশ স্মিতমুখে বলিলেন, আসব, মা আসব। তপন মুগ্ধ চোখে দাঁড়াইয়া দেখিতেছিল, কী সুন্দর! মনে মনে ভাবিতে লাগিল : সে তো তাহাদের পাড়ার কত মেয়েকেই দেখিয়াছে, কিন্তু এই মেয়েটির মতো সুন্দর কেহই নয়। তপন ফিরিয়া আস্তে আস্তে তাহার কাছে গিয়া বলিল, কেন ডাকছ আমায়?

–বস, বলিয়া সে হাত টানিয়া বসাইয়া দিল।

–তোমার নাম কী?

—তপন!

–বেশ নাম তো! তুমি কি বোকা! আমি তোমার নাম জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কেন করলে না? আমার নাম বাসন্তী। কেমন, আমার নাম ভালো কি না বল? না, তোমায় বলতে হবে, আমি যে বললাম।

তপবন হাসিয়া বলিল, বেশ ভালো নাম।

বাসন্তী বলিল, খাবে কিছু? দাঁড়াও আমি বেড়ে দিচ্ছি। মাটির পাত্রে ভাত, আগাছার ঝোল, চচ্চড়ি দেওয়া হইল। তপন হাত দিয়া মাখিয়া মুখের কাছে নিয়া ফেলিয়া দিল।

বাসন্তী হাসিয়া বলিল, দূর! অমন করে বুঝি খেতে হয়? তুমি একটা বোকা! মুখ সত্যি সত্যি খাওয়ার মতো করে নাড়তে হয় না? তা না করলে খাওয়া হল কী করে? খাওয়া শেষ হইলে তপন বাসন্তীর দিকে চাহিলে বাসন্তী বলিল, পেট ভরেনি বুঝি? তা না ভরলে আমি আর কী করব বল।

তপন হাসিয়া বলিল, তা হলে উঠি।

–আঃ দুধ যে রয়েছে, তা একেবারেই ভুলে গেছি। এই বলিয়া বাসন্তী একটু চুনমেশানো জল পাতের উপর ঢালিয়া দিয়া বলিল, তাড়াতাড়ি খেয়ে লও, মা দেখলে বকবে। চুন যে চুরি করে এনেছি। খেয়ে আবার হাত ধোবে চল। এঁটো তো! জল আমাদের কোথেকে আনতে হয় জান? অনেক দূরে একটা ঝরনা আছে, ওখান থেকে আনতে হয়। যাবে দেখতে, কী সুন্দর দেখবে!

তপন ঝরনার প্রসঙ্গে খাওয়ার কথা ভুলিয়া গেল। বলিল, চল, এক্ষুনি চল। বাসন্তী ও তপন চলিল। চলিল দুটি স্বল্প-পরিচিত বালক-বালিকা, ছোটো নরম পা ফেলিয়া, শিশুসুলভ কথাবার্তা কহিয়া, কলহাস্যে হাসিয়া। কেহই জানিল না, কোন কাহিনি তাহাদের মধ্যে গড়িয়া উঠিতেছে, কেহই ভাবিল না, এতটুকু সময়ের পরিচয়ের মাঝে তাহারা কেমন করিয়া পরস্পরকে এত আপনার বলিয়া গ্রহণ করিল। কেমনে বলিব, এই দুটি বালক-বালিকার মনের ভাষায় কত যুগের ইতিহাস। তাহাদের বাক্যতরঙ্গে ফুটিয়া উঠে পৃথিবীর সকল সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না–চাঁদের আলোর মতো নরম, নীল আকাশের মতো সুন্দর।

যাইতে যাইতে বাসন্তী একটা বুনো গাছের দিকে আঙুল বাড়াইয়া বলিল, এ রকম গাছ দেখেছ কখনো?

তপন বলিল, না। সব গাছই কি আর শহরে দেখা যায়! তুমি বুঝি শহরে কোনোদিন যাওনি?

—কে বললে তোমায়, আমি যাইনি? গৌহাটী গিয়েছি না!

তপন জোরে হাসিয়া উঠিল, বলিল, ছেঃ, গৌহাটী আবার একটা শহর! গোরা সৈন্য দেখেছ কখনো?

–না।

—ব্যস। কেমন ঠকিয়ে দিলাম।

বাসন্তী অপ্রতিভ হইয়া গেল। কতক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, আচ্ছা, তুমি। তোমাদের বাড়িতে কার সঙ্গে খেল?

—কত ছেলে আছে আমাদের ইস্কুলে। তাদেরি সঙ্গে খেলি।

–ইস্কুল! ইস্কুলে কী পড় তোমরা? তপনের মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলিয়া গেল, একটু চিন্তা করিয়া বলিল, পড়ি কী জান? পড়ি, পৃথিবীটা গোল।

এইবার হাসিবার পালা বাসন্তীর। সে হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। হাসিতে হাসিতে লাল হইয়া গেল।

–বারে! তুমি হাসছ যে?

—তুমি একটা আস্ত গাধা। পৃথিবী আবার কোনোদিন গোল হয় নাকি? চোখ দুটো ছোটো করিয়া, একটা পা উঠাইয়া একটু কাত হইয়া বাসন্তী বলিল, তাহলে এই যে দাঁড়িয়ে আছি, পড়ে যাব না?

তপন রাগিয়া বলিল, চল বাবার কাছে যাই। কী বলেন। কিছু জানলে তো বুঝবে? আবার হাসা হচ্ছে! অত হেসো না কিন্তু, তা হলে আমি কথা বলব না। আবার হাসছ যে! বেশ, এখন থেকে তোমার সঙ্গে আমার আড়ি।

তপন নীরবে চলিতে লাগিল।

বাসন্তী হঠাৎ পিছন ফিরিয়া বাড়ির পানে দৌড়াইতে লাগিল। তপন ভয় পাইয়া গেল। পিছনের দিকে দৌড়াইতে দৌড়াইতে বলিল, বা, তুমি দৌড়াচ্ছ যে? যাবে না ঝরনা দেখতে? বাসন্তী মুখ ফিরাইয়া বলিল, থাক এখানে পড়ে।

কতদূরে গিয়ে বাসন্তী বসিয়া পড়িল। মুখ লাল হইয়া গিয়াছে রোদে-আমার সঙ্গে পারবে দৌড়াতে? তোমার মত মানুষে না, হাঁপাইতে হাঁপাইতে সে বলিল।

তপন তাহার পায়ের কাছে ঘাসের উপর হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া বাসন্তীর পানে চাহিয়া বলিল, হুঁ, পারব না আবার! জান আমি প্রাইজ পেয়েছিলাম ভালো দৌড়বার জন্যে।

বাসন্তী নতুন একটা কথা শুনিল, সব ভুলিয়া আগ্রহের সহিত তপনের গলা দুই হাত দিয়া জড়াইয়া বলিল, পাইজ! কী তপু!

তপন বিজ্ঞের হাসি হাসিল, প্রাইজ! পাইজ আবার কাকে বলে? আচ্ছা বোকা তুমি! কিচ্ছু জান না। বললাম, প্রাইজ, না পাইজ! কতকগুলো বই বা অন্য জিনিস এমনি দিয়ে দেয়, ওকেই বলে প্রাইজ। কত ছবি কত গল্প থাকে ওর মধ্যে। আনলে তোমাকে দেখাতাম! বাসন্তী উপরের দিকে একবার চাহিয়া বলিল, ইস, কত বেলা হয়েছে! সূর্যি একেবারে মাথার উপরে উঠেছে। বাবা দেবেখন আজকে আমায়। চল, শীগগির চল।

বাড়ির কাছে আসিতেই চোখে পড়িল, এক মহা হৈচৈ পড়িয়া গিয়াছে। বাসন্তীর বাবা তাহাকে দেখিয়া রাগতস্বরে বলিল, এই যে, এতক্ষণে আসা হয়েছে! পরের ছেলেকে নিয়ে কোথায় যাওয়া হয়েছিল, শুনি? দাঁড়াও, আজ তোমাকে মজা দেখাচ্ছি। পান্ডাটি একটা কঞ্চি লইয়া অগ্রসর হইল। বাসন্তী ভয়ে বিবর্ণ হইয়া গেল! শব্দ হইল, সপাং, সপাং–

—আমি আর যাব না বাবা। আমায় এরকম করে মেরো না। বলছিই তো আর যাব না—না—

তপনের দুটি ভয়ব্যাকুল চোখ ছলছল করিতে লাগিল। এমন সময় অবিনাশ ফিরিয়া আসিলেন। একবার তপনের দিকে চাহিয়া পান্ডাটির কাছে গিয়া বলিলেন, ওকি করছ? আহা ও রকম করে মারতে আছে! এই তোমাদের দোষ, মারতেই শুধু জান।—শব্দ থামিল। বাসন্তী ফুপাইয়া কাঁদিতে লাগিল। সেদিনই অবিনাশ চলিয়া গেলেন। পথে তপন জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা, ওরা এরকম করে মারে কেন বাবা? তুমি তো আমাকে মারোনি কোনোদিন।

–খুব মেরেছে নারে? অবিনাশ কহিলেন। পরের দিন আবার তাহারা আসিল, কুমারী পূজা দিতে। বাসন্তী দূর হইতেই তিনজনকে দেখিয়া আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া গেল। কাছে আসিলে সে তপনের হাত ধরিয়া টান দিল। অবিনাশ পিছন ফিরিয়া একটু হাসিলেন, তারপর চলিয়া গেলেন।

বাসন্তী বলিল, ঝরনা দেখতে যাবে তপন! কালকে যে তুমি দেখতে চেয়েছিলে!

তপন ভয়ে শিহরিয়া উঠিল। মাথা নাড়িয়া বলিল, না না, কাজ নেই, আবার তোমায় মারবে যে!

থামিয়া পুনরায় কহিল, জান, আমরা কুমারী পুজো দিতে এসেছি, কে কুমারী হবে বল তো?

—জানিনে।

–দূর বোকা, তুমি কিছুই বলতে পার না। বাবা বলেছে কুমারী হবে তুমি। বাবা তোমার জন্য নূতন কাপড় এনেছে।

বাসন্তীর মুখ খুশিতে ভরিয়া গেল।

পূজা হইতেছে। তপন মুগ্ধ চোখে দেখিতেছিল। এমন আর সে কখনও দেখে নাই। নূতন কাপড় পরিলে বাসন্তীকে কি সুন্দরই না দেখায়। রৌদ্রে ঝলমল। করিতেছে কাপড়, বিচিত্র গৌরবর্ণ মুখ লাল হইয়া গিয়াছে।

পূজা শেষ হইলে তপন হাত নাড়িয়া তাহাকে ডাক দিল। বাসন্তী মুক্তি পাইয়া। যেন দৌড়িয়া আসিল।

-কেন ডাকছ?

তপন হাসিয়া বলিল, তুমি কী সুন্দর, না? নূতন কাপড় পরে থাকবে কিন্তু।

–দুর, সবসময় বুঝি নূতন কাপড় পরে থাকে? তপন তাহার কথায় কান দিল না, কী যেন চিন্তা করিয়া বলিল, চল, ওদিকটায় যাই।

বাসন্তী তৎক্ষণাৎ রাজী হইয়া বলিল, চল।

কিছুদূর গিয়া তাহারা থামিল। সম্মুখে একটা গাছ ডালপাতা লইয়া অনেকটা জায়গা জুড়িয়া দাঁড়াইয়া আছে।

তপন বলিল, দাঁড়াও এখানে। পাতা দিয়ে মুকুট বানাতে পার তুমি?

–না।

তপন কতকগুলা সরু সরু লতা ছিড়িল আর ছিড়িল অজস্র বুনোপাতা। তারপর পাতার উপর পাতা গাঁথিতে লাগিল। এবং শিশু কারিগরের হাতে নির্মিত হইল একটা মুকুট। সে একবার মুখের কাছে মুকুটটা ধরিয়া হাসিয়া উঠিল। শিশু বৈজ্ঞানিক নিজের কৃতকার্যতায় বেজায় খুশি।

মুকুটপরিহিত বাসন্তীকে চমৎকার দেখাইল। দুই-একগোছা নরম চুল বাহির হইয়া রহিল। বাসন্তী ঋজু হইয়া দাঁড়াইল ও তপন তাহার পায়ের কাছে বসিল। পকেট হইতে সে একটা ছোট্ট ক্যামেরা বাহির করিল। বিস্মিত হইয়া বাসন্তী জিজ্ঞাসা করিল, এটা কী তপু?

তপন ক্যামেরাটা খুলিতে খুলিতে বিজ্ঞের মতো বলিল, দেখেছ কখনও? ছবি তোলা যায় এটা দিয়ে। আমি তোমার ছবি তুলব, খুব মজা হবে, না!

—হুঁ। একটা ছবি দেবে আমায়!

তপন হাসিয়া বলিল, আর কাকে দেব, বল? ঢাকায় গিয়ে প্রিন্ট করে পাঠিয়ে দেবখন।

বাসন্তী কিছুই বুঝিল না। শুধু তপনের ঘাড় ধরিয়া মুখের কাছে মুখ নিয়া উৎসুক নেত্রে এই অভিনব জিনিসটি দেখিতে লাগিল। কিছু পরে তপন বলিল, পেছনে যাও তো এখন তোমার ফটো তুলব। ওই গাছটার তলে যাও।

বাসন্তী পিছু হাটিয়াই যাইতে লাগিল। তপন ক্যামেরাটার দিকে চোখ রাখিয়া মনোযোগের সহিত উহা ঠিকমত ধরিতেছিল। হঠাৎ একটা কাজে চকিত হইয়া সে মুখ তুলিয়া চাহিয়া দেখিল, বাসন্তী নাই। শব্দের মধ্যে একটা চীৎকারের রেশ ছিল। তপন উদভ্রান্তের মতো গাছটার কাছে আসিয়া দেখিল, গাছটার ঠিক পরেই একটা গভীর খাদ। কিছু দেখা যায় না। সে ক্যামেরাটা দূরে ফেলিয়া পাগলের মতো ডাকিল, বাসন্তী, বাসন্তী? আমি যে তোমার জন্যে বসে আছি, ফটো তুলবে না! শিগগির এসো, লক্ষ্মীটি, আমি তোমার সঙ্গে আর কখনও ঝগড়া করব না। এসো বাসন্তী, বা-স-ন-তী–

কেহই উত্তর দিল না। কতকগুলি প্রতিধ্বনি তাহাকে ব্যঙ্গ করিয়া উঠিল।

তপনের মুখ বিবর্ণ। সে কাঁদিয়া উঠিল, মাটি আঁচড়াইতে লাগিল।

অচলায়তন ও নির্জনতার মাঝে একটা প্রাণের বিসর্জন, কতটুকু তাহার মূল্য জানি না। জানি পৃথিবী টলিবে না এই ঘটনায়। পৃথিবীর বুকে ইহা নূতন নয়, জানি মানবজীবন কেমন দ্রুতগতিতে চলিয়াছে, তেমনই চলিবে, কিন্তু অকালে যে ফুলটি ঝরিয়া পড়িল তাহারই কাহিনি লিখিতে কেন আমার এত আগ্রহ! চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হইয়াই আসে যদি, তবু কলম কেন থামে না! কেমনে বলিব, ইহা যে আজও বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই।

উপরে মেঘাচ্ছন্ন আকাশে প্রলয় নৃত্য আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। নীচে মাটির বুকে বিয়োগ-বিধুর এক শিশুচিত্তের বেদনা, মনে করিতে কষ্ট হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *