শিশুশিক্ষা (২)
এক মনোবিজ্ঞানী সমাজের বিভিন্ন স্তরের শিশুদের বিভিন্ন বিষয়ে মানসিক অবস্থান পরীক্ষা করে দেখছিলেন। এই বিজ্ঞানীর তথাকথিত সাজ-সরঞ্জাম যন্ত্রপাতি বিশেষ কিছু ছিল না। তিনি নিজের খুশি ও বিবেচনামতো নানাধরনের জিনিস দিয়ে শিশুদের পরীক্ষা করতেন, শিশুমনের অতল রহস্যের সন্ধান করতেন।
মনোবিজ্ঞানীর কাছে একটা ছবি ছিল। বেড়ালের ছবি, একটা বেড়ালের বাচ্চা কাঁদছে আর তার সামনে বেড়ালের মা গম্ভীর মুখে বসে আছে।
সেদিন বিজ্ঞানী দুটি শিশুর মানসিকতা সমীক্ষা করছিলেন।
এর মধ্যে একটি শিশু এসেছে রীতিমতো বড়লোকের বাড়ি থেকে, ধনী পরিবারের সন্তান।
দ্বিতীয় শিশুটি নিতান্ত নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়ির, বেশ গরিব পরিবারের।
মনোবিজ্ঞানী প্রথম শিশুটিকে বেড়ালের মা আর বাচ্চার ছবিটা দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা, বেড়ালের বাচ্চাটা কাঁদছে কেন বলো তো?’
বড়লোকের বাড়ির ছেলেটি বলল, বেড়ালের বাচ্চার পেট ভরে আছে, সে খেতে চাইছে না। কিন্তু বেড়ালের মা জোর করছে তাকে আরও খাওয়ানোর জন্য।
দেখছেন না মায়ের মুখটা কেমন থমথমে। আর বাচ্চাটা খাবে না বলে কাঁদছে।’
ধনী ছেলেটি বিদায় নেওয়ার পর গরিবের ছেলেটিকে সেই একই ছবি দেখালেন সমীক্ষক। এবং একই প্রশ্ন তাকেও করলেন। গরিবের ছেলেটিও অনেকক্ষণ ধরে ছবিটি মন দিয়ে দেখল, তারপর বলল, ‘বেড়ালের বাচ্চাটা মার কাছে খেতে চাইছে। ওর খিদে লেগেছে, তাই এত কাঁদছে। ওর মা খেতে দিতে পারছে না বলে মন খারাপ করে বসে আছে।’
পাড়ার ইস্কুলে পরিতোষবাবুর নাতিকে ভর্তি করতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু অনিকেত নামে সেই শিশুটি ভর্তির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। অসফল হয়ে অনিকেত বাড়ি ফিরে আসে।
অনিকেত পাড়ার ইস্কুলে ভর্তি হতে পারেনি বলে অনিকেতের ঠাকুরদা পরিতোষবাবু ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। ‘ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হবে, তার আবার পরীক্ষা, তার আবার মৌখিক, পাড়ার মধ্যে ইস্কুল, আমরাই দেখেশুনে রাখি। আর সেই ইস্কুলই আমার নাতিকে নেবে না।’… এইরকম মনোভাব পরিতোষবাবুর।
তিনি শ্রীমান অনিকেতকে নিয়ে ইস্কুলে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সোজা বড়দিদিমণির ঘরে।
বড়দিদিমণি পরিতোষবাবুকে চেনেন, এখন অনিকেতকে দেখেও চিনতে পারলেন। বুদ্ধিমতী মহিলা পরিতোষবাবুকে বসতে বলে তাঁকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সোজাসুজি বললেন, ‘আপনার নাতিকে আমরা নিতে পারিনি বলে দুঃখিত।’
এই ‘দুঃখিত’ কথাটা শুনে পরিতোষবাবুর আরও রাগ হল। শুকনো দুঃখ প্রকাশ নয়, তিনি চান সুরাহা। পরিতোষবাবু প্রশ্ন করলেন, ‘আমার নাতি শ্রীমান অনিকেত কীসে অযোগ্য প্রমাণিত হল।’
এ ধরনের প্রশ্নে বড়দিদিমণি মোটেই কোনও উত্তর দেন না। কিন্তু হাতে কাজ আছে। আপাতত এই পরিতোষবাবুকে বিদায় করতে হবে।
বড়দিদিমণি বললেন, ‘আপনার নাতি সব বিষয়েই কাঁচা। অঙ্কে তো বিশেষ করে কাঁচা। একবছর বাসায় পড়ে সড়গড় হোক। সামনের বছর নিয়ে নেব।’
এর পরেও পরিতোষবাবু ইতস্তত করছেন দেখে বড়দিদিমণি অনিকেতকে তাঁর কাছে ডাকলেন। তার পর পরিতোষবাবুকে বললেন, ‘আমি আপনার সামনে আপনার নাতির টেস্ট নিচ্ছি। আপনি নিজেই দেখুন সে কেমন যোগ্য।’
দপ্তরি দিয়ে বড়দিদিমণি অঙ্কের দিদিমণি সুরমাকে ডেকে পাঠালেন। ছোটখাটো সুরমাদি খুটখুট করে চলে এলেন। তাঁকে বড়দি বললেন, ‘সুরমা, এই ছেলেটির অঙ্কের একটা মৌখিক পরীক্ষা নাও তো, ক্লাস ওয়ানের জন্য।’
সুরমাদি অনিকেতকে একবার ভাল করে দেখে বললেন, ‘একে তো আজ সকালেই একবার টেস্ট করেছি।’
সুরমাদির কথা শুনে বড়দিদিমণি বললেন, ‘তা হোক। তুমি এর ঠাকুরদার সামনে ওর একটা টেস্ট নিয়ে দেখাও তো।’
সুরমাদি অবস্থাটা অনুধাবন করতে পারলেন। বড়দিদিমণির পাশের চেয়ারে বসে পরিতোষবাবুর নাতিকে প্রশ্ন করলেন, ‘কী নাম তোমার?’
উত্তর এল, ‘অনিকেত।’
সুরমাদি বললেন, ‘আচ্ছা বাবা অনিকেত, তুমি বলো দেখি, তোমাকে যদি চারটে কলা দিই, তার মধ্যে তুমি যদি দুটো খেয়ে ফেলো, তা হলে আর কটা কলা থাকবে?’
অনেক ভেবেচিন্তে অনিকেত উত্তর দিল, ‘একটা।’
বড়দি পরিতোষবাবুকে বললেন, ‘দেখলেন তো!’
পরিতোষবাবু আর কী দেখবেন, তিনি ততক্ষণে পাঞ্জাবির পকেট থেকে মানি-ব্যাগ বার করে তার থেকে এক টাকার একটা কয়েন বার করেছেন। সেই টাকাটা বড়দির হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘মাত্র একটা কলার জন্যে আমার নাতি ফেল হয়ে যাবে। এই নিন একটা কলার দাম দিয়ে দিলাম। এবার আমার নাতিকে ভর্তি করে নিন।’