শিশুশিক্ষা (১)
এক বাড়িতে বাইরের ঘরে বসে অপেক্ষা করছিলাম গৃহস্বামীর জন্য। কিছুই খেয়াল করিনি, হঠাৎ পায়ের গোড়ালিতে একটা দংশনের যন্ত্রণা অনুভব করলাম। পা দুটো ছিল একটা নিচু বেতের টেবিলের তলায়। তাড়াতাড়ি চমকে উঠে দেখি একটি দশ-বারো মাস বয়সের শিশু কখন নিঃশব্দে হামাগুড়ি দিয়ে টেবিলের নীচে ঢুকে জুতোর ওপরে আমার গোড়ালির মাংস তীক্ষ দুধদাঁত দিয়ে কামড়ে ধরেছে। যখন ঘুরে ঢুকেছিলাম ঘর খালিই ছিল কিংবা হয়তো শিশুটি সোফা-টোফার পিছনে হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরছিল; এমনও হতে পারে ভিতরের ঘর থেকে পর্দার নীচ দিয়ে চলে এসেছে, অন্যমনস্ক থাকায় আমি টের পাইনি। অবশ্য একটু পরেই বাড়ির ভিতরে শোরগোল শোনা গেল, ‘ডাকু কোথায় গেল, ডাকু?’ বুঝলাম এই অবোধ শিশুটিই নিজ যোগ্যতায় এই সামান্য বয়সে এই নাম অর্জন করেছে।
খুঁজে খুঁজে বাইরের ঘরে এসে এক পরিচারিকা ডাকুকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলেন। ততক্ষণে তার ধারালো দংশন থেকে আমি আমার পা ছাড়িয়ে নিয়েছি, চারটে দাত গর্ত হয়ে বসে গেছে, সেখানে লাল মুক্তোর মতো রক্তের বিন্দু।
মনে পড়ল কয়েক বছর আগে যোধপুর পার্কে এক বাড়িতে সদর গেটে নোটিশ দেখেছিলাম,
Beware of Children— শিশু হইতে সাবধান।
সেদিন ওই নোটিশটি দেখে কৌতুক অনুভব করেছিলাম, গৃহস্বামীর সস্নেহ বিপদসংকেত যথেষ্টই আনন্দ দিয়েছিল। কিন্তু আজ এতদিন পরে ওই রকম একটি বিজ্ঞপ্তির প্রকৃত অর্থ আমার হৃদয়ঙ্গম হল।
অবশ্য এ রকম অভিজ্ঞতা এই প্রথম নয়। একবার এক বিবাহবাসরে একটু তাড়াতাড়ি পৌঁছে গিয়েছিলাম। বিশাল হলঘরে একা একা তাকিয়া ঠেসান দিয়ে বসে থাকতে বেশ ভালই লাগছিল। কিন্তু বিপদ বাধাল একপাল শিশু। তারা অবশ্য দশ-বারো মাস বয়সের নয়, তার চেয়ে বেশ বড়, সাত-আট বছরের দল একটা। তারা চোর চোর খেলা আরম্ভ করল। প্রথমে বুঝতে পারিনি, খেলা আরম্ভ হওয়ার পরে ধরতে পারলাম আমাকেই তারা বুড়ি বানিয়েছে। একজন চোর আর বাকিরা চোরের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য বুড়ি ছুঁয়ে অর্থাৎ আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ে পরিত্রাণ পেতে লাগল। ফলে অনতিবিলম্বে আমাকে উঠে পড়তে হল, কিন্তু তাতে রক্ষা নেই, প্রথমে শিশুরা তাদের বুড়িকে চেপে ধরে আটকে রাখার চেষ্টা করল এবং তারপরেও যখন আমি গায়ের জোরে তাদের হাত ছাড়িয়ে বেরিয়ে এলাম, এক দঙ্গল ক্ষুদে শয়তান আমার চারদিকে ঘুরে ঘুরে হাততালি দিয়ে ‘বুড়ি পালাল’, ‘বুড়ি পালাল’ বলে নাচতে লাগল। তখন বিয়েবাড়িতে লোকসমাগম শুরু হয়েছে; সুন্দরী রমণীরা এবং সুবেশ ভদ্রলোকেরা আমার এই কৌতুককর অবস্থা নিয়ে যথেষ্ট মজা পেলেন। সেদিন সেই বিবাহবাসর থেকে কিছু না খেয়েই বাড়ি ফিরে এসেছিলাম, কারণ বেশিক্ষণ এ ভাবে থাকা সম্ভব ছিল না।
এসব আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। তবে আমি এর চেয়েও অনেক হিংস্র এবং নিষ্ঠুর শিশুর কথা শুনেছি যারা বাড়িতে বাইরের লোক পেলে তাকে ছাতা দিয়ে খোঁচায় কিংবা রবারের বল ছুড়ে মারে। আমার স্ত্রী একদিন এক বাড়ি থেকে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ফিরে এসেছিলেন, তার প্রিয় বান্ধবীর পুত্র তার খেলার ছোট ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে তার হাঁটুতে বিনা প্ররোচনায় অতর্কিতে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করে। শিশুটির জনকজননী তখন সামনের সোফায় হাসিমুখে বসেছিলেন, শুধু আমার স্ত্রী যখন আর্তনাদ করে ওঠেন, বলেছিলেন, ‘ছিঃ, বাবলু, অত জোরে মারতে নেই’।
অনেক সরল চেহারার শিশুকে দেখে বোঝার উপায় নেই তাদের কী প্রকৃতি। তাদের ভাসা ভাসা চোখ, পাতলা ঠোঁট, এলোমেলো চুল দেখে অমলতার প্রতীক বলে মনে হয়। কিছুতেই বোঝার উপায় নেই এই শিশুটিই দশ মিনিট আগে ইস্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে সিড়ির উপরে একজন অচেনা ভদ্রলোককে ল্যাং দিয়ে ফেলে দিয়েছে কিংবা এই মুহূর্তেই সে পারে আলমারির মাথার উপরে উঠে গগনভেদী হুঁউউ চিৎকার করে যে কোনও অপ্রস্তুত ব্যক্তির উপরে আচম্বিতে লাফিয়ে পড়ত।
এসব দৈহিক নির্যাতন ছাড়াও মৌখিক ব্যাপারেও শিশুদের দৌড় কিছু কম নয়। আমার এক প্রতিবেশীর কন্যা ‘বাবা’, ‘মা’ ইত্যাদি প্রথম যে তিন-চারটি শব্দ শেখে তার মধ্যে একটি ছিল ‘শালা’। বাড়িতে কেউ এলেই তাকে ‘শালা-শালা’ করে গালাগাল করতে থাকত। সুখের বিষয় সে তখনও ‘শ’ উচ্চারণ করতে পারত না। ফলে সে বলত শালা-শালা’—কিন্তু শোনাত থালা-থালা। তার মা বাইরের লোকদের বলতেন, ও খুব ঘটি-বাটি-থালা নিয়ে খেলতে ভালবাসে, তাই খালি থালা-থালা বলে’।
এর চেয়ে একটু বড় যারা তারা অনেক রকম দুষ্ট বুদ্ধি ও ইয়ারকি ইস্কুল থেকে, কখনও বড়দের কাছ থেকে শিখে ফেলে। কিছুদিন আগেও যে কোনও বিবাহযোগ্য অথচ অবিবাহিত ছেলে বা মেয়েকে এই রকম শিশুদের অন্তত একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হত। প্রশ্নটি অতি সরল, বাটা বানান কী? সঙ্গে সঙ্গে যে কেউ বলবে, কেন বি এ টি এ। আর তখনই প্রশ্ন, ‘কী হল, তুমি বিয়ে-টিয়ে করবে না?’
অবশ্য তরলমতি প্রাপ্তবয়স্করা অনেক সময় শিশুদের প্ররোচিত করেন। সেদিন এক বাড়িতে একটি বছর তিনেকের শিশু তার দুধ খাওয়ার স্টেনলেস স্টিলের বাটিটা হাতে করে নিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘বলো তো, এটা কী?’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কেন, এটা একটা বাটি’। ছেলেটা আমাকে মুহূর্তের অবকাশ না দিয়ে বলল, ‘তোর বউয়ের সঙ্গে সাঁতার কাটি’।তার এই সাহসে এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষায় আমি যথেষ্ট পুলকিত হলাম। আমি রেগে না যাওয়ায় সে যথেষ্ট দুঃখিত হল।
পরে জানতে পেরেছি এক তরুণ সাংবাদিক তার ভাগিনেয়কে এই চমৎকার বাক্যালাপটি প্রথম শিক্ষা দেয় এবং এখন সংক্রামকভাবে এটি শিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।
শিশুদের বিরুদ্ধে সব খারাপ কথা লেখার পরে একটি চমৎকার দৃশ্যের বর্ণনা করি। সেদিন পার্কে দেখলাম একটি সদ্য দাঁড়াতে শেখা শিশু থপ থপ করে হাঁটতে চেষ্টা করছে, দু’কদম গিয়েই পড়ে যাচ্ছে। দেখি তার গলায় সুতো দিয়ে ঝোলানো আছে একটা টিনের চাকতি, তাতে লাল অক্ষরে লেখা ইংরেজি ‘এল’। অর্থাৎ লার্নার, মোটরগাড়ি চালানো শেখার সময় গাড়িতে যেমন লাগানো থাকে, শিশুটির মা সদ্য হাঁটিয়ের গলায় সে-রকম ঝুলিয়ে দিয়েছেন। সে যদি আপনার গায়ে পড়ে তার কোনও দায়িত্ব নেই।