শিশুরা অকারণেই কাঁদে
—‘না বাবা, আমি ইঞ্জেকশন নেব না, কিছুতেই না৷’
—‘ওরকম করে না লিলি৷ কথা না শুনলে বাবা কিন্তু খুব রেগে যাবে৷ আর রেগে গেলে…’
হাতের ইঞ্জেকশনটা তুলে ধরে মানুষটা৷ নিডল চুইয়ে একফোঁটা তরল এসে পড়ে মাটিতে৷
—‘আমার কষ্ট হয়, আমার…’ কথাটা শেষ হওয়ার আগেই একটা শক্ত হাতের চড় এসে পড়ে মেয়েটার গালে৷ ঠোঁটের নীচে রক্তের স্বাদ পায় সে৷ হাত-পা কুষ্ঠ রোগীর মতো কাঁপছে৷ শুধু ভয়ে নয়৷ চাইলেও হাতটা নিজের আয়ত্তে রাখতে পারে না ও৷
—‘নাও, কাম অন লিলি, হাতাটা তোলো তো দেখি…’ আদর করে মেয়েটার হাতের উপরদিকে হাত বুলোতে থাকে লোকটা৷
—‘আমাকে আর কষ্ট দিও না বাবা, ইঞ্জেকশন দিলে আমি আর চলতে পারি না, হাত দিয়ে কাজ করতে পারি না৷’
মেয়েটার থুতনিতে আদর করে একটা হাত রাখে লোকটা, ‘যাতে তুমি আমার মনের মতো হয়ে থাকো, সেইজন্যেই তো দিচ্ছি ইঞ্জেকশন৷ ড্যাডিস লিটল গার্ল৷’
—‘আমি মায়ের সঙ্গে থাকব৷’ অনুরোধটা আর্তনাদের মতো শোনায়৷ লোকটার মুখে একবার করুণ হাসি খেলে ‘কিন্তু মা তো তোমার সঙ্গে থাকবে না মামণি… তার তো আলাদা সংসার আছে… উঁহুঁ, এদিকে তাকাতে হবে না…’
মেয়েটা কিন্তু মুখ ঘোরায় না৷ হাতে সিরিঞ্জ ঢোকায়, ছিটকে খানিকটা রক্ত বেরিয়ে আসে৷ এই প্রথম রক্তের লাল রংটাই এখন নেশা ধরাচ্ছে ওকে৷ সেই রক্তটার দিকে জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে থাকে সে৷
* * *
ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি নামতেই দৌড়ে একটা দোকানের শেডের নীচে এসে দাঁড়াল অনিন্দ্র৷ আচমকা বৃষ্টি এসে পড়ায় একেবারে কাকভেজা হয়ে গেছে৷ হাঁপাতে হাঁপাতে কপালে এসে-পড়া ভেজা চুলগুলোকে সরিয়ে দিল৷ চারপাশে তাকিয়ে খুঁজে দেখতে লাগল বসার মতো কোনও জায়গা পাওয়া যায় কি না৷
দোকানটা অনেকক্ষণ আগে বন্ধ হয়ে গেছে৷ শাটার নামানো৷ বাইরে একটা সাদা টিউব জ্বলছে৷ সেটা থেকে আলো এসে সামনে পড়েছে বটে, তবে এখন ত্যারচা করে পড়া ঝাঁক-ঝাঁক বৃষ্টির ফোঁটা ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না৷ শাটারের সামনেই একটা কাঠের বেঞ্চ রাখা৷ কাঁধ থেকে ব্যাগটা খুলে তার উপর রেখে পাশেই বসে পড়ল অনিন্দ্র৷ বৃষ্টির যা তেজ, তাতে সহজে কমবে বলে মনে হচ্ছে না৷
শনশনে ঠান্ডা হাওয়া ভেসে আসছে৷ জোলো, হাড়কাঁপানো হাওয়া৷ অনিন্দ্রর শরীরটাও শিউরে উঠল কয়েকবার৷ জামাটা যেভাবে ভিজে আছে, তাতে কাল নিশ্চয়ই ঠান্ডা লাগবে৷
পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে হতাশ হল৷ নেটওয়ার্ক গায়েব৷ ফোন লাগছে না, ইন্টারনেটও নিষ্ক্রিয়৷ অগত্যা ইয়ারফোন কানে গুঁজে রেডিয়ো অন করল সে৷ দু-চারটে ফ্রিকোয়েন্সি ধরছে অ্যান্টেনা৷ তিনটেয় বিজ্ঞাপন৷ একটায় গান হচ্ছে৷ রাতে বাড়ি ফিরতে ফিরতে এই রেডিয়ো স্টেশনটা আগেও শুনেছে অনিন্দ্র৷ এই সময়ে একটা বিশেষ অনুষ্ঠান হয়, ‘রাতের হেল্পলাইন’৷ রাতবিরেতে কলকাতার রাস্তায় কী কী সমস্যা হতে পারে সেই নিয়ে আলোচনা, আর মাঝে মাঝে পুরোনো গান৷ কখনও আবৃত্তি করে শোনানো হয়৷ এখন পুরোনো দিনের একটা বাংলা গান চলছে৷ সুরটা ভারী ভালো লাগল অনিন্দ্রর৷ মনটা জুড়িয়ে এল৷
গানের মধ্যে মজে গিয়েছিল৷ এমন সময় আচমকাই থেমে গেল গানটা৷ বিরক্ত হল অনিন্দ্র৷ বেশ লাগছিল শুনতে৷ গান থেমে ঘোষকের গলা ভেসে আসছে৷ ভারী, সিরিয়াস গলায় একটা ঘোষণা পড়ছে৷ আধা মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগল অনিন্দ্র, ‘রাতের হেল্পলাইনে আজ আমাদের আলোচনা সিরিয়াল কিলিং নিয়ে৷ আপনাদের জানিয়ে রাখি, গত সপ্তাহে উত্তর কলকাতার রাস্তায় কয়েকটি নৃশংস খুন হয়ে গেছে৷ পুলিশ আশঙ্কা করছে এ কাজ কোনও সিরিয়াল কিলারের৷ আততায়ী সদ্যোজাত শিশুর কান্না নকল করতে পারে৷ এই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েই খুনগুলো করছে সে৷ অসহায় পরিত্যক্ত শিশুর টোপ দেখিয়ে ভিকটিমকে বাড়ির বাইরে টেনে আনছে৷ খুন করার পর প্রতিটি খুনের অকুস্থলে ফেলে যাচ্ছে একটি পুতুলের কাটা মাথা৷ শহরবাসীর মুখে এ সিরিয়াল কিলারের নাম, ‘ক্রায়িং বেবি’৷ পুলিশের নির্দেশ, মাঝরাতে আপনি যদি বাড়ির বাইরে কিংবা রাস্তায় কোনও সদ্যোজাত শিশুর কান্না শুনতে পান তবে দয়া করে সাড়া না দিয়ে ফোন করুন ৯৪৬৪৬ নম্বরে বা অভিজ্ঞতা জানাতে পারেন আমাদের লাইভ ইন অনুষ্ঠানে ৮৮৮৮ নম্বরে৷ বাড়ির সমস্ত জানালা-দরজা বাড়তি যত্নে লক করে রাখবেন৷ অযথা ভয় পাবার প্রয়োজন নেই৷ ধন্যবাদ৷’
ঘোষণা শেষ হতেই আগের গানটা আর শোনা গেল না৷ ক্রায়িং বেবিকে নিয়েই আলোচনা শুরু হয়েছে৷ অনিন্দ্রর কিন্তু আর ভালো লাগল না শুনতে৷ মনটা আশঙ্কায় ভারী হয়ে গিয়েছে৷ এই মুহূর্তে সে উত্তর কলকাতারই একটা গলির ভিতর আশ্রয় নিয়েছে৷ চতুর্দিক বৃষ্টি আর অন্ধকারে ঢেকে আছে৷ দু’হাত দূরে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকলেও তাকে দেখা যাবে না৷ রাস্তাটা কি খালি?
—‘এ ব্যাপারে আলোচনা করতে আজ আমাদের সঙ্গে আছেন মনস্তাত্ত্বিক সমীরণ গাঙ্গুলি৷ মিস্টার গাঙ্গুলি, আপনার কী মনে হয়, কেন খুনগুলো করছে ক্রায়িং বেবি?
দ্যাখো ভাই, এ ধরনের সিরিয়াল কিলারদের মোটিভ তাদের ছেলেবেলার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে৷ খুনের ধরন দেখে আমার মনে হচ্ছে খুনি কোনও কারণে ছেলেবেলায় নিজের বাবা-মা-র কাছে রিপিটেডলি অ্যাবিউজড…’
বৃষ্টিটা এর মধ্যে আরও বেড়েছে৷ ইয়ারফোন বেয়ে-আসা শব্দ প্রায় ঢেকে যেতে বসেছে৷ অনিন্দ্র উঠে দাঁড়াল৷ ব্যাগের ভিতরে ছাতা আছে বটে, কিন্তু ছাতায় এ বৃষ্টি আটকাবে না৷ তা-ও, খবরটা শোনার পর থেকে আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা করল না তার৷
ছাতা খুলে বাইরের দিকে পা বাড়াল অনিন্দ্র৷ সঙ্গে সঙ্গে পা আটকে গেল৷ বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে মিশে আর একটা আওয়াজ কানে আসছে- একটা শিশুর কান্না৷ মনে হচ্ছে একটু দূরেই কোথাও মাটির উপর বসে কেঁদে চলেছে কোনও বাচ্চা৷ অক্ষম শব্দে কাউকে ডাকছে৷
এগিয়ে-রাখা পা-টা পিছিয়ে নিল সে৷ একটু আগে রেডিয়োর ঘোষণাটা মনে পড়ে গেল৷ আততায়ী সদ্যোজাত শিশুর কান্না নকল করতে পারে৷ শব্দটা ঠিক যেদিক থেকে আসছে সেদিকে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেল না৷ বুকের ভিতর চাপা উত্তেজনার স্রোত বইছে৷ হাঁটু কেঁপে উঠল৷ সত্যি কি কোনও শিশু কাঁদছে? এত রাতে রাস্তায় একটা সদ্যোজাত শিশুকে কে ফেলে যাবে?
অনিন্দ্র ভেবে দেখল, সিরিয়াল কিলার যদি সত্যি তার পিছু নিয়ে থাকে তবে শাটারের তলায় দাঁড়িয়ে বিশেষ লাভ হবে না৷ উলটে আলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকলে আততায়ীর সুবিধেই হবে৷
ছাতাটা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল সে৷ দৌড়াবে কি?
বাইরে বেরিয়ে কিন্তু মনের জোর বেড়ে গেল অনিন্দ্রর৷ কান্নার আওয়াজ খুব একটা দূর থেকে আসছে না৷ সত্যি যদি কোনও শিশু হয়? এই অবস্থায় রাস্তার উপর পড়ে থাকলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই মারা যাবে৷ হয় বৃষ্টির জলে, না হয় কোনও গাড়ি পিষে দেবে৷
সাহসে ভর করে শব্দটা লক্ষ্য করে আরও এগিয়ে এল অনিন্দ্র৷ হঠাৎ তার মনে হল বাচ্চার কান্নাটা ঠিক— ‘স্বাভাবিক’ নয়, তবে গোলমালটা ঠিক কোথায়, সেটা বুঝতে পারল না৷ একটানা ফোঁপানো কান্না৷ হাতের ফোনে ফ্ল্যাশলাইটটা জ্বেলে নিল সে৷
কয়েক পা এগোতেই মাটির উপরে কিছু চোখে পড়ল৷ হ্যাঁ, ওখান থেকেই আসছে কান্নাটা৷ একটা সদ্যোজাত বাচ্চাই তো… ফ্ল্যাশলাইট মাটির দিকে ধরে জিনিসটার কাছাকাছি এসে দাঁড়াল সে৷ আর সঙ্গে সঙ্গে ভুলটা বুঝতে পারল৷
কোনও বাচ্চা নয়, মাটির উপরে পড়ে রয়েছে একটা ইঞ্চি দশেক লম্বা, জমা জলে প্রায় আধডোবা হয়ে যাওয়া পুতুল৷ আর সেই পুতুলের ভিতরে লাগানো কোনও যন্ত্র থেকেই বেরিয়ে আসছে কান্নার আওয়াজটা৷ পুতুলটাকে দেখে কিন্তু পরিত্যক্ত বলে মনে হল না৷ তবে এই মুহূর্তে বৃষ্টির ধাক্কায় তার চুলগুলো পিচের রাস্তার উপরে ছড়িয়ে গেছে৷
আশ্চর্য! এমন একটা পুতুল রাস্তার উপরে কে ফেলে গেল? তবে কি গাড়ি করে যেতে যেতে কারও হাত থেকে পড়ে গেছে?
আগ্রহ হতে নীচু হয়ে সেটা মাটি থেকে তুলে নিল অনিন্দ্র, ঠিক এমন সময় পিছন থেকে আসা একটা মেয়েলি গলার চিৎকারে বুক কেঁপে গেল তার৷ বৃষ্টির মধ্যে থেকে দমকা হাওয়ার মতো সাদাটে কিছু একটা ছুটে এসে তার হাতে ধরা পুতুলটা ছিনিয়ে নিল৷ তারপর মিলিয়ে গেল রাস্তার উলটোদিকের ফুটপাথে৷ সরু নখে লেগে কবজির কাছে কিছুটা চিরে গেল অনিন্দ্রর৷
পুতুলটা ছিনিয়ে নিয়েই মানুষটা হারিয়ে গেছে বৃষ্টির মধ্যে৷ কান্নার শব্দটা মিলিয়ে গেছে সেই সঙ্গে৷ আবার মুষলধারায় বৃষ্টির ঝমঝম৷ অনিন্দ্রর হাতের চেরা অংশটা দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে৷ বৃষ্টির জলে মুহূর্তে ধুয়ে যাচ্ছে সেই রক্ত৷
চামড়ার ব্যাগটা আগলে ধরে সেদিক লক্ষ্য করে এগিয়ে গেল অনিন্দ্র৷ কয়েক পা এগোতেই মানুষের শরীরের অবয়ব চোখে পড়ল তার—একটা মেয়ে৷ রাস্তার ধারে দোতলা বাড়ির কার্নিসের নীচে দাঁড়িয়ে পুতুলটা বুকে আঁকড়ে ধরে হাঁপাচ্ছে৷ চুল দিয়ে মুখের বেশির ভাগটাই ঢাকা৷ অনিন্দ্রকে বৃষ্টির চাদর পেরিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখে আর একটু শক্ত করে চেপে ধরল পুতুলটা৷ তারপর একপাশ ফিরে দাঁড়াল৷
—‘ওটা কি আপনার?’ মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল অনিন্দ্র৷
মেয়েটা উত্তর দিল না৷ তার মুখে-চোখে আতঙ্কের ছাপ৷ অনিন্দ্র লক্ষ করল মেয়েটার বয়স সতেরো-আঠেরোর বেশি নয়৷ গায়ে ঢোলা লম্বাটে গোছের জামা কোমর ছাড়িয়ে হাঁটুর খানিক নীচ অবধি নেমে এসেছে৷
—‘আপনি ঠিক আছেন তো?’ আবার প্রশ্ন করে অনিন্দ্র৷ কোনও উত্তর আসে না৷ একইভাবে পুতুল চেপে ধরে লুকোনোর চেষ্টা করছে মেয়েটা৷ অনিন্দ্র বুঝতে পারে, মেয়েটার কিছু একটা সমস্যা আছে৷ মুখ-চোখ দেখে মাথায় খানিকটা ছিট আছে বলেও মনে হয়৷ তাকে আর না ঘাঁটিয়ে পিছিয়ে আসতে যাচ্ছিল সে, এমন সময় বিড়বিড় করে কথা বলে ওঠে মেয়েটা,
—‘ও… ও মেরে ফেলবে আমাদের৷’
অনিন্দ্র ঘুরে দাঁড়ায় ‘কে মেরে ফেলবে?’
—‘ওই…’ আঙুল দিয়ে বৃষ্টির চাদরের ভিতর একটা জায়গা দেখিয়ে দেয় মেয়েটা৷ ধোঁয়াশা ছাড়া আর কিছু নেই সেখানে৷
অনিন্দ্র মুখ ফিরিয়ে নেয় ‘আমাদের বলতে? আপনার সঙ্গে আরও কেউ আছে?’
এতক্ষণে অনিন্দ্রর দিকে মুখ তুলে তাকায় মেয়েটা, হাতের পুতুলটা দু’হাতে সামনে তুলে ধরে- ‘মিনি, আমার মেয়ে৷’
এবার ব্যাপারটা বুঝতে পারে অনিন্দ্র৷ মেয়েটা সম্ভবত পাগল৷ তবে চেহারা দেখে রাস্তায় ঘুরে-বেড়ানো ভবঘুরে পাগল বলে মনে হয় না৷ সম্ভবত কাছেই কোনও বাড়িতে থাকে৷ রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়তে দরজা খোলা পেয়ে বেরিয়ে এসেছে বোধহয়৷
ভয়টা এবার কেটে যায় অনিন্দ্রর, বলে, ‘ভয় নেই, কেউ মারবে না তোমাদের, কোথায় থাকো তুমি?’
মেয়েটা উত্তর দেয় না৷ পুতুলটার চুলগুলো আঙুল দিয়ে আঁচড়ে দিচ্ছে৷ মিহি সুরে একটা লালাবাই গেয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে৷
—‘পুতুলটা… আই মিন তোমার মেয়ে… পড়ে গেল কী করে বলো তো?’ অনিন্দ্র পাশে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে৷
—‘আ… আমাদের মারতে চাইছিল৷ আমি ওকে নিয়ে পালিয়ে এসেছি৷’
—‘মারতে চাইছিল! কে?’
আচমকাই অনিন্দ্রর শার্টের নীচের দিকটা খামচে ধরে মেয়েটা—‘ওই যে… আওয়াজ শুনতে পাচ্ছ না?’
—‘কীসের আওয়াজ?’
—‘পায়ের আওয়াজ৷’ মেয়েটার অস্থির চোখের মণি দুটো বৃষ্টির চাদরের ভিতর কাকে যেন খুঁজে চলেছে৷ বিড়বিড় করে কিছু আওড়ে চলে সে৷ ভয় পেয়ে অনিন্দ্রর পিছনে লুকিয়ে পড়ে মেয়েটা৷
অনিন্দ্র ভালো করে কান পাতার চেষ্টা করে৷ বৃষ্টির অঝোর ধারার শব্দ আসছে, তা ছাড়া আর কিছু তো নেই৷ মেয়েটার মাথায় যে ছিট আছে, সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে৷
সেই সঙ্গে স্কিতজোফ্রেনিয়াও আছে নাকি? অনিন্দ্র পিছন ঘুরে প্রশ্ন করে, ‘তোমার মেয়ের নাম মিনি তো বুঝলাম, তোমার নাম কী?’
—‘আমি পিয়ালি৷’
মিষ্টি গলার স্বর মেয়েটার, পুতুলের মায়ের মতোই দেখতে বটে৷ অথচ ডিলিউশনে ভুগছে৷ অনিন্দ্রর মায়া হয় মেয়েটার জন্য—‘তা পিয়ালি, এত রাতে বৃষ্টিতে বাড়ির বাইরে এভাবে ঘুরে বেড়ালে মেয়ের তো শরীর খারাপ করবে৷’
—‘তুমি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে?’ নিষ্পাপ গলার প্রশ্ন৷
—‘নিশ্চয়ই, কিন্তু তার আগে তো জানতে হবে তুমি কোথায় থাকো?’ এবারে এক-পা, এক-পা করে পিছিয়ে যায় পিয়ালি—‘আর যদি তুমিই সে হও? যদি মাঝপথে পিছন থেকে একটা ছুরি দিয়ে…’
—‘ধ্যাত!’ হেসে ফেলে অনিন্দ্র—‘আমার কাছে ছুরি কোথায়?’
পিয়ালির চোখ নেমে আসে অনিন্দ্রর হাতে ধরা চামড়ার ব্যাগের দিকে—‘ওতে কী আছে?’
এবার বেশ খোলা গলাতেই হেসে ওঠে অনিন্দ্র ‘ওতে ছুরি নেই৷ তবে অন্য একটা জিনিস আছে৷ দাঁড়াও, দেখাচ্ছি৷’
ব্যাগ খুলে ছোট চেন থেকে চিরুনি বের করে আনে অনিন্দ্র৷ মেয়েটার দিকে বাড়িয়ে ধরে—‘নাও, এটা দিয়ে ওর চুল আঁচড়ে দাও৷’
পিয়ালির গোটা মুখ জুড়ে সরু হাসি খেলে যায়৷ চিরুনিটা হাতে নিয়ে পুতুলের চুল আঁচড়াতে থাকে৷ লালাবাইটা আবার শোনা যায়৷ সুযোগ বুঝে কার্নিসের তলায় বেশ কিছুটা তফাতে সরে আসে অনিন্দ্র৷ মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে দ্যাখে, অল্প হলেও এতক্ষণে নেটওয়ার্ক এসেছে তাতে৷ মনটা খুশি হয়ে ওঠে৷ নম্বর ডায়াল করতে গিয়েও কিন্তু থেমে যায়৷ কোন নম্বরে কল করতে বলেছিল যেন? অনিন্দ্রর প্রথম নম্বরটা মনে পড়ে না৷ দ্বিতীয়টা সহজ বলে সেটা মনে আছে— ৮৮৮৮৷ অগত্যা সেটাই ডায়াল করে৷
ওপাশ থেকে প্রথমে গানের শব্দ ভেসে আসে৷ লাইনটা কানেক্ট হতে একটু সময় লাগে৷
—‘কাকে ফোন করছ তুমি?’ পিয়ালি হঠাৎই ফিরে তাকিয়েছে তার দিকে৷ ফোনটা কেটে দেয় অনিন্দ্র৷ হেসে বলে, ‘বাড়িতে করছিলাম৷ আসলে দেরি হচ্ছে তো, চিন্তা করবে তো সবাই…’
—‘তোমার বাড়িতে কে কে আছে?’
—‘মা আছে, বোন আছে৷’ ঘাড় নেড়ে বলে অনিন্দ্র৷
—‘বাবা নেই? মরে গেছে, তা-ই না?’ অনিন্দ্রকে আর কিছু বলার সুযোগ দেয় না সে, নিজের মনেই বলতে থাকে, ‘আমারও নেই, জানো৷ সেই ছোটবেলায় দেখেছিলাম৷ আমাদের কত মিল, তা-ই না?’
—‘কই? বেশি তো না৷ একটা হল সবে…’
পিয়ালিকে একটু চিন্তিত দেখায়, ভেবেচিন্তে বলে ‘ও আমাকেও মারতে চায়, আর তোমাকেও মারতে চায়৷’
অনিন্দ্রর পায়ের পাতা কেঁপে ওঠে, ‘আমাকে! আমাকে মারতে চায়, কী করে জানলে?’
—‘ওই যে, ও তোমার দিকে তাকিয়ে আছে…’ আঙুল দিয়ে অনিন্দ্রকে সামনে ইশারা করে মেয়েটা৷
সামনে ফিরে অনিন্দ্র দ্যাখে অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে৷ ঝমঝমে বৃষ্টির চাদরে প্রায় কিছুই দেখা যায় না৷ কয়েক সেকেন্ড অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে৷ কয়েকটা ধাতুর মতো ঠান্ডা আঙুল তার হাত চেপে ধরে, খলখল হাসির শব্দ ভেসে আসে ‘ভীতু… আমার মিনিও এত ভয় পায় না৷ আবার বলে, আমাদের বাড়ি পৌঁছে দেবে… হিহিহিহি…’
প্ল্যাঙ্ক করল মেয়েটা? নিশ্চিন্ত হয়ে তার হাসিভরা নির্মল মুখটার দিকে চেয়ে থাকে অনিন্দ্র৷ ফরসা রং, সরু ঠোঁট, ছোট ইঞ্চি দুয়েকের কপাল৷ চোখ দুটো বড়সড়৷ কিছু একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার আছে মেয়েটার মধ্যে৷ ভালো লাগে, কেমন যেন ভয়-মেশানো ভালো লাগা৷
অনিন্দ্র কিছু বলতে যাচ্ছিল৷ এমন সময় একটা আলোর ঝলকানিতে ভরে যায় চতুর্দিক৷ কাছেই কোথাও বাজ পড়েছে, মেয়েটার চোখে-মুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে৷ আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বাজের শব্দ শোনা যাবে৷ এই ধরনের স্কিতজোফ্রেনিকরা সাধারণত বাজ-টাজ পড়লে ভীষণ ভয় পায়৷ একটা বুদ্ধি খেলে যায় অনিন্দ্রর মাথায়৷ সুযোগ বুঝে মেয়েটার কাছে এগিয়ে আসে৷
বাজের শব্দে মাটি কেঁপে ওঠে৷ মেয়েটা ভয় পেয়ে একহাতে জড়িয়ে ধরে অনিন্দ্রকে৷ শরীরের ছোঁয়ায় অনিন্দ্র কিছু অনুভব করার চেষ্টা করে৷ দুটো হাত রাখে মেয়েটার কোমরের কাছে, নাঃ, শক্ত কিছুর ছোঁয়া লাগে না৷ মেয়েটার শরীরে কোথাও ছুরি গোঁজা নেই৷ একটু নিশ্চিন্ত হয় সে৷ মায়া লাগে মেয়েটার জন্যে৷
বাজের শব্দটা মিলিয়ে যেতে আস্তে আস্তে হাতের বাঁধন আলগা করে নেয় মেয়েটা৷ কয়েকটা লজ্জার রেখা ফুটে ওঠে মুখে৷ একবার গলাখাঁকারি দিয়ে অনিন্দ্র বলে, ‘বাজ পড়লে ভয় লাগে, তাই না?’
‘তুমি আমাদের বাড়ি দিয়ে আসবে?’ মাথা নামিয়েই প্রশ্ন করে মেয়েটা৷ অসহায় লাগে অনিন্দ্রর৷ মেয়েটা বাড়ি যেতে চাইছে, কিন্তু ঠিকানা বলতে পারছে না৷ তার কাছে মোবাইল ফোন জাতীয় কিছুও নেই যে সেখান থেকে কিছু জানা যাবে৷ সাত-পাঁচ ভেবে সে ঠিক করল, বৃষ্টিটা একটু কমলে মেয়েটাকে একেবারে থানায় পৌঁছে দিয়ে যাবে৷ তাতে পুলিশের ঝামেলা হয় হোক, ক্রায়িং বেবি থাক বা না থাক, এত রাতে রাস্তায় এই বয়সের একটা মেয়ে একেবারেই সেফ নয়৷
—‘বৃষ্টিটা কমুক একটু, তারপর বেরোই আমরা?’
উপরে-নীচে মাথা নেড়ে সায় দেয় পিয়ালি৷ পুতুলটাকে কার্নিসের নীচের উঁচু পাঁচিলটার উপর শুইয়ে দেয়, তারপর এগিয়ে এসে অনিন্দ্রর হাতটা তুলে ধরে, ‘তোমার হাতে কাটল কী করে? আমার নখ লেগে?’
উপরে-নীচে মাথা নাড়ায় অনিন্দ্র৷ পিয়ালির চোখ-মুখে একটা বিষণ্ণ ছায়া নেমে আসে৷ যেন নখটা তার নিজের হাতেই লেগেছে৷
—‘ভুল হয়ে গেছে, সরি…’
একহাতে নিজের একটা কান ধরে শব্দটা উচ্চারণ করেছে মেয়েটা৷ অনিন্দ্রর মনটা নরম হয়ে এসেছে এতক্ষণে, সে পিয়ালির মাথার চুল এলোমেলো করে দেয় ‘আমাকেই খুনি ভেবেছিলে, তা-ই না?’
—‘না তো৷ তুমি কী করে হবে?’ কান থেকে হাত নামিয়ে অবাক চোখে বলে মেয়েটা৷ অনিন্দ্রর হাতটা তুলে নিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে বেরিয়ে আসা রক্তের দিকে৷
—‘কেন হব না?’
—‘খুনি তো মেয়ে৷’
—‘মেয়ে৷ তুমি জানলে কী করে?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে অনিন্দ্র৷
—‘আমি দেখেছি৷’
—‘দেখেছ৷’
—‘হ্যাঁ, এই যেমন তোমাকে দেখছি৷’
—‘মানে! তুমি জানো, খুনগুলো কে করেছে?’ অনিন্দ্রর গলা কেঁপে যায়৷
—‘হ্যাঁ৷’
—‘কে?’
—‘আমি৷’
মেয়েটা এখনও একইভাবে চেয়ে আছে রক্তের দিকে৷ তাও, অনিন্দ্র বুঝতে পারে শেষ শব্দটা বলার সময় পিয়ালির গলার মধ্যে কিছু একটা পালটে গেছে৷ শিশুসুলভ আলগা ভাবটা মুছে গিয়ে একটা গাম্ভীর্য ফুটে উঠছে মুখে৷
—‘ইয়ারকি হচ্ছে আমার সঙ্গে?’ ধমকে ওঠে অনিন্দ্র৷
হাতটা নামিয়ে রেখে বৃষ্টির দিকে ফিরে তাকায় মেয়েটা, কপালে একটা হাত ঘষতে ঘষতে বলে, —‘আপনার কাছে সিগারেট হবে একটা?’ আবার সেই বদলে যাওয়া গলা মেয়েটার৷ যেন বাজের ঝলকানির সঙ্গে সঙ্গে কোনও ব্ল্যাক মাজিকের মন্ত্রে পালটে গেছে মানুষটা৷ অনিন্দ্র বুঝে উঠতে পারে না৷ অবাক গলায় বলে, ‘হঠাৎ করে কী হল তোমার?’
ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো জ্বলন্ত চোখে অনিন্দ্রর দিকে চায় অচেনা মেয়েটা, ধারালো ছুরির মতো গলা শোনা যায়— ‘আর ইউ ডিফ ম্যান? সিগারেট, একটা সিগারেট চেয়েছি আমি৷’
এই প্রথম ভয় লাগে অনিন্দ্রর, মেয়েটার চাহনি আমূল বদলে গেছে, এখন সেই ডাগর হরিণের চোখদুটো বিড়ালের চোখের মতো সরু হয়ে গেছে৷
তার দিকে তাকালেই বুকের ভিতরটা কেঁপে ওঠে৷ কণ্ঠস্বরে ঠান্ডা স্যাঁতসেঁতে ভাব৷ ব্যাগের ভিতর হাত চালিয়ে সিগারেটের প্যাকেট বের করে এনে মেয়েটার হাতে দিয়ে দেয় অনিন্দ্র৷ সিগারেটটা ঠোঁটে ধরতে লাইটার দিয়ে সেটা জ্বালিয়ে দেয়৷ তারপর ভয়ে ভয়ে একটু দূরে সরে দাঁড়ায়৷
ধোঁয়ার লম্বা রিং ছাড়ে মেয়েটা৷ মাথাটা ত্যারচা করে চারপাশে ঘুরিয়ে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলে, ‘শিট ম্যান৷ ফাঁদটা ভালোই পেতেছিলাম, আপনি চলে এসে সব মাটি হয়ে গেল৷’
—‘আমি… মানে…’
—‘হ্যাঁ, আপনার জায়গায় যদি কোনও মেয়েছেলে হত তাহলে এতক্ষণে…’
কিছু একটা ভেবে নেয় অনিন্দ্র, বলে, ‘তার মানে এতক্ষণ তুমি…’
—‘আমি না, পিয়ালি৷ আমাকে আপনি স্নেহা বলে ডাকতে পারেন৷ পিয়ালি একটা ন্যাকা মেয়েছেলে… নাটহেড…’
নিজে থেকেই কয়েকটা চাপা শব্দ বেরিয়ে আসে অনিন্দ্রর গলা থেকে—
—‘স্প্রিট পারসোনালিটি!’
—‘এগজাক্টলি৷ মেয়েটার ছোট থেকেই মাথায় গোলমাল আছে৷ মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে ওর গলাতেই ছুরি ঢুকিয়ে দিই শেষ করে৷’
অবাক হয়ে লক্ষ করে অনিন্দ্র৷ কয়েক মিনিটের ব্যবধানে যেন আমূল পালটে গেছে মানুষটা৷ একটু আগের নরম তুলোর মতো মেয়েটাকে এখন বন্য শ্বাপদের মতো হিংস্র মনে হচ্ছে৷
অনিন্দ্রর একবার মনে হয়, এই অবস্থায় দৌড়ে পালিয়ে যাবার থেকে ভালো কিছু আর হয় না৷ পরমুহূর্তে একটা অন্যরকম ভাবনা চেপে ধরে তাকে৷ মেয়েটা যদি বাকি খুনগুলো করেও থাকে তাহলেও এই মুহূর্তে তার কাছে অস্ত্র নেই৷ তা ছাড়া কথা শুনে মনে হয় সে কেবলমাত্র মহিলাদের খুন করে৷
পিয়ালির জন্য দুশ্চিন্তা শুরু হয় তার৷ মানসিক সমস্যায় ভুগছে অসহায় মেয়েটা৷ এরকম হতে থাকলে যে কোনওদিন নিজের একটা ক্ষতি করে ফেলতে পারে৷ হয়তো খুনের ব্যাপারটা কেউ জানে না৷ আরও ইনটেন্স ট্রিটমেন্ট দরকার৷ সত্যি যদি তার অলটার ইগো স্নেহাই ‘ক্রায়িং বেবি’ হয়ে থাকে তাহলে তার সম্পর্কে আরও কিছু না জেনে ফিরলে পুলিশের পক্ষে মেয়েটাকে আইডেন্টিফাই করা মুশকিল হবে৷
সে মনে মনে একটা প্ল্যান বের করার চেষ্টা করে৷ এই মুহূর্তে পিয়ালি নেই, আছে সিরিয়াল কিলার ‘ক্রায়িং বেবি’৷ সে যদি ধুরন্ধর খুনি হয় তাহলে পিয়ালির সম্পর্কে বেশি ইনফরমেশন জানাবে না অনিন্দ্রকে৷ ‘পিয়ালি জানে আপনার কথা?’
মেয়েটার মুখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে সে৷
সিগারেট-ধরা হাতেই কপাল থেকে চুল সরায় স্নেহা —‘জানে৷ কিন্তু আমার ব্যাপারে কাউকে বলবে না৷ পুতুলটাকে ও নিজের মেয়ে ভাবে, মাঝে মাঝে ওটাকে খুন করে দেবার ভয় দেখাই৷’ একটা শয়তানি হাসি হাসে মেয়েটা ‘ভালো কথা, তখন নম্বরটা ডায়াল করেছিলেন… কেটে দিলেন যে? পিয়ালিকেই খুনি সন্দেহ করেছিলেন, তা-ই না?’
—‘আমি যে নম্বরটা ডায়াল করেছিলাম, সেটা আপনি…’ প্রশ্ন করতে গিয়েও আটকে যায় অনিন্দ্র৷ ভীষণ কাছাকাছি সরে এসেছে স্নেহা, ডান হাতটা বুক ছুঁয়ে উঠে আসে গলার কাছে৷ অনিন্দ্র বাধা দিতে গিয়েও আটকে যায়৷ মেয়েটা তার গলার একটা বিশেষ জায়গা দু’আঙুলে চেপে ধরে বলে, ‘এটাকে বলে ল্যারিংকস, এর ঠিক উপরে এই জায়গাটা… বুঝতে পারছেন? এটা হল ফেরিংস, মানুষের গলার এই দুটো জায়গাকে জয়েন করে রাখে ট্রাকিয়া, গোদা বাংলায় যাকে বলে শ্বাসনালি৷ ভারি মজার জিনিস, জানেন?
নরম, সেন্সিটিভ, কিউট৷ ঠিক পিয়ালির মতো৷ অথচ এই ট্রাকিয়াকে ছুরি দিয়ে কাটা বেশ মুশকিল, কারণ এর চারপাশে গিজগিজ করে স্কিনটিস্যু, কার্টিলেজ এসব৷ এবার হাতে জোর থাকলে আর ছুরিতে ধার থাকলে যদি দুটোকে একসঙ্গে চিরে দেওয়া যায় তবে আরও এক মজার কাণ্ড ঘটে৷ নিজের গলার রক্ত নিজের শ্বাসনালিতে ঢুকে চোকড হয়ে যান আপনি৷ ভেবে দেখুন আপনি প্রাণপণে নিঃশ্বাস নিতে চাইছেন, ভাবছেন এইবার আপনার বিশ্বস্ত শ্বাসনালি অক্সিজেন এনে দেবে আপনার বুকে৷ অথচ সে তুলে আনে কেবল রক্ত… যেন আপনার শ্বাসনালি উন্মাদ হয়ে গেছে…’, খিলখিলে একটা হাসি ছড়িয়ে পড়ে রাস্তার উপরে৷
এতক্ষণে বৃষ্টি ধরে এসেছে৷ সামনের জলে-ভেজা রাস্তাটা চোখে পড়ছে৷ রাস্তার ওপাশে সোডিয়াম ভেপারের হলুদ আলোটা নিশ্চিন্তে জ্বলছে৷ মিহি ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে গা ছুঁয়ে৷ কাছেই কোনও বাড়ির রেডিয়ো থেকে ভেসে আসছে রবীন্দ্রসংগীতের সুর৷
—‘আজ সন্ধেটা বেশ, তা-ই না?’ সিগারেটটা ফেলে দিয়ে বলে মেয়েটা৷ অনিন্দ্র উত্তর দেয় না৷ ভেজা আকাশের দিকে চেয়ে থাকে মেয়েটা৷ একসময় বলে—‘বললেন না তো কাকে ফোন করছিলেন, পুলিশে?’
—‘নাঃ, পুলিশের নম্বরটা মনে নেই৷ রেডিয়োতে ঘোষণা করছিল আপনার কথা, ওদের হেল্পলাইনেই করছিলাম৷’
—‘আমার কথা রেডিয়োতে বলছে?’ স্নেহার গলায় উচ্ছ্বাস—‘কই, চালান তো দেখি একবার…’
অনিন্দ্র আবার চালিয়ে দেয় ফ্রিকোয়েন্সিটা৷ এখন সেই ঘোষক ছেলেটা একটা কবিতা আবৃত্তি করে শোনাচ্ছে,
কেউ যে কোথাও নেই;
সকলে গিয়েছে মরে;
সকলে গিয়েছে চলে;
উঠান রয়েছে শুধু একা,
শিশুরা কাঁদে না কেউ;
রুগিরা হাঁপায় না তো;
বুড়োরা কয় না কথা—
থুবড়ো ব্যথার কথা যত,
এখানে সকাল নাই;
এখানে দুপুর নাই;
এখানে জনতা নাই;
এখানে সমাজ নাই;
নাইকো মূর্খ ধাঁধা কিছু,
আকাশে চাঁদের আলো;
উঠোনে চাঁদের আলো;
নীলাভ চাঁদের আলো
এমন চাঁদের আলো আজ৷
মন দিয়ে কবিতাটা শোনে স্নেহা৷ তারপর কী যেন ভেবে বলে, ‘চলুন, আমরা একটু হাঁটি৷’ অনিন্দ্রকে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার হাত ধরে একটা টান দেয৷
—‘আরে চলুন না, ভয়ের কিচ্ছু নেই৷’
পাঁচিলের উপর থেকে পুতুলটা এনে অনিদ্রের হাতে ধরিয়ে দেয় ‘এটা রাখুন, পিয়ালি আবার এলে ওকে শান্ত করতে পারবেন না, এটা না থাকলে৷’
—‘আপনিই তাহলে ক্রায়িং বেবি?’ কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে অনিন্দ্র৷ ‘ক্রায়িং বেবি? সেটা কী?’
অনিন্দ্র ভেবে দ্যাখে সিরিয়াল কিলারের নামটা তার নিজের দেওয়া নয়, সুতরাং সে নামটা যে তার চেনা হবে তা না-ও হতে পারে৷
মন্ত্রমুগ্ধের মতো বেরিয়ে আসে অনিন্দ্র৷ এতক্ষণের বৃষ্টিতে গোড়ালি অবধি জল জমেছে রাস্তায়৷ দুটো মানুষের পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে তার উপর৷ অঝোর বৃষ্টি ঝরিয়ে আকাশ এখন পরিষ্কার৷ গোল পূর্ণিমার চাঁদ ফুটে উঠেছে একপাশে৷ জ্যোৎস্না ছড়িয়ে আছে রাস্তার উপর৷ একটু আগের কবিতাটার মতোই একটা রাত আজ৷
—‘আপনার ট্রিগারটা কী?’ অনিন্দ্র হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করে৷ ‘ট্রিগার?’
—‘মানে যাদের এরকম স্প্রিট পার্সোনালিটি থাকে, তাদের একটা পার্সোনালিটি থেকে আর একটায় যাবার কিছু কারণ থাকে৷ সেটা আপনার ক্ষেত্রে ঠিক কী?’
—‘কেন? আপনি পিয়ালিকে মিস করছেন, তাই না?’ স্নেহার গলায় ছদ্মকৌতুক৷
—‘তা খানিকটা…’
আচমকাই অনিন্দ্রর দিকে ঘুরে দাঁড়ায় স্নেহা, গম্ভীর কিন্তু মিহি ব্যঙ্গ মাখা গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘আর আমাকে ভয় লাগছে না?’
—‘আপনার যদি আমাকে খুন করার হত তাহলে এতক্ষণ অপেক্ষা করতেন না, তাছাড়া আজ রাতে ছুরিটা হারিয়ে ফেলেছেন কোনওভাবে৷ তাই না?’
অল্প হেসে ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার হাঁটতে থাকে মেয়েটা— ‘আপনি বিয়ে করেছেন? মানে বউ আছে বাড়িতে?’
—‘আসলে এমন কিছু হাতি-ঘোড়া চাকরি করি না, একটু গুছিয়ে নিয়ে… কেন বলুন তো?’
—‘না, ভাবছিলাম পিয়ালিকে নিয়ে এত সহানুভুতি…’ মিহি হেসে ওঠে মেয়েটা
—‘সহানুভূতি জিনিসটা একদম পছন্দ নয় আমার, জানেন?’
অনিন্দ্রর মুখে একটা মিশ্র অভিব্যক্তি খেলে যায়, মেয়েটা আগের মতোই হাসতে হাসতে বলে, ‘ভয়ের কিছু নেই৷ আপনাকে নিয়ে আমার আগ্রহ নেই তেমন৷’
—‘আচ্ছা, এত রাতে পিয়ালি রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল কেন বলুন তো?’
—‘ও একটা অ্যাসাইলামে থাকে৷ সপ্তাখানেক হল অ্যাসাইলামের পিছনের দিকের সিঁড়িতে ভাঙাভাঙির কিছু কাজ হচ্ছে৷ রাত হলে সেখান থেকে নেমে রাস্তায় বেরিয়ে আসে৷’
মনে মনে হিসেব করে অনিন্দ্র৷ এমন একটা অ্যাসাইলাম যার সিঁড়িতে ভাঙাভাঙির কিছু হচ্ছে৷ অবশ্য ক্রায়িং বেবি যদি ধুরন্ধর খুনে হয় তাহলে ভাঙা সিঁড়ির ব্যাপারটা মিথ্যে৷ আপাতত তার কোনও কথাকেই বিশ্বাস করা যায় না৷ পিয়ালি কোথায় থাকে সেটা একমাত্র পিয়ালির থেকেই জানা সম্ভব৷ কিন্তু পিয়ালিকে আবার ফিরিয়ে আনতে গেলে ট্রিগারটা জানতে হবে৷ কী করে পার্সোনালিটি চেঞ্জ হয় মেয়েটার?
মাথা হাতড়ে উত্তর খুঁজতে থাকে অনিন্দ্র৷ এ ধরনের মানসিক রোগীদের পার্সোনালিটিগুলো ইমোশনাল স্ট্রেস থেকে জন্মায়৷ এমন একটা কিছু যদি করা যায়, যাতে পিয়ালির সত্তাটা উত্তেজিত হয়ে ওঠে….
বিদ্যুৎ খেলে যায় অনিন্দ্রর মাথায়৷ পিয়ালির মেয়ে মিনি৷ এখনও তার হাতেই আছে পুতুলটা৷ খানিকটা দূরে গিয়ে সেটা মাটির উপরে আছড়ে ফেলে অনিন্দ্র৷ পরমুহূর্তেই পাশে পড়ে-থাকা একটা পাথর তুলে নিয়ে আঘাত করে পুতুলের মাথার উপরে৷
—‘একী! এটা কী করছেন আপনি৷’ আহত বাঘের মতো হিংস্র চিৎকার করে ওঠে স্নেহা৷ অনিন্দ্র উত্তর দেয় না৷ আবার আঘাত করে৷
—‘স্টপ ইট…’ মেয়েটার চিৎকারে আকাশ কেঁপে ওঠে৷
—‘পারবেন না, নখ দিয়ে আমার ল্যারিংকস ছিঁড়তে পারবেন না৷ তার জন্যে ছুরি দরকার…’
দুটো হাত তুলে অনিন্দ্রর দিকে ছুটে আসতে যায় মেয়েটি, কিন্তু কয়েক পা এসেই দু’হাতে মুখ ঢেকে মাটির উপরে আছড়ে পড়ে৷ হিংস্র চিৎকারের শব্দটা মুহূর্তে করুণ আর্তনাদে পরিণত হয়৷
ছেঁড়া পর্দার মতো কয়েক খণ্ড বাতাস বয়ে যায়৷
মেয়েটা মুখ তোলে৷ আবার সেই নরম শিশুর মতো দৃষ্টি৷ মাটিতে পড়ে-থাকা পুতুল আর অনিন্দ্রর হাতে ধরা পাথরটা দেখেই তার শরীরে একটা ধাক্কা লাগে৷ মুখে একটা শব্দ করতে করতে হামাগুড়ি দিয়ে এসেই পুতুলটাকে ছিনিয়ে নেয়, ‘এ কী করছিলে তুমি৷ মিনি, মিনি, চোখ খোল…’
পুতুলের গাল ধরে বারবার তাকে জাগানোর চেষ্টা করে পিয়ালি৷ অনিন্দ্র দ্রুতগতিতে উঠে পড়ে মাটি থেকে৷ এগিয়ে এসে পিয়ালির দুটো কাঁধ চেপে ধরে— ‘পিয়ালি আমার কথা শোনো… তোমার পুরো নাম কী?’
—‘মিনি চোখ খুলছে না…’ কান্নাভেজা গলায় বলে পিয়ালি৷
—‘খুলবে, তার আগে তোমাকে বলতেই হবে, নিজের সম্পর্কে যা মনে আছে, সব বলো আমাকে, প্লিজ৷’
—‘মিনি… মিনি…’
—‘যদি আমাকে না বলো তাহলে ওই মেয়েটা মেরে ফেলবে মিনিকে…’
—‘কে মেরে ফেলবে আমার মিনিকে?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে পিয়ালি৷ কয়েক সেকেন্ডের জন্য কী বলবে, ভেবে পায় না অনিন্দ্র৷ পুতুলটা আবার কাঁদতে শুরু করেছে৷ সম্ভবত ওর শরীরে কোথাও একটা সুইচ আছে৷ তাতে চাপ পড়লেই কাঁদতে থাকে পুতুলটা৷
পিয়ালির মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে— ‘এই তো চোখ খুলেছে মিনি৷’ খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে সে৷
—‘কারও নাম মনে পড়ছে না? কে থাকে তোমার কাছে?’ দু’হাতে পিয়ালির দুটো গালে হাত রাখে অনিন্দ্র— ‘মনে করো, প্লিজ মনে করো৷’
—‘মনে… আমার মনে…’ অনিন্দ্রর মনে হয় পিয়ালি তার স্মৃতি হাতড়ে কিছু একটা তুলে আনার চেষ্টা করছে৷ সে উদগ্রীব চোখে তাকিয়ে থাকে নিষ্পাপ মুখের দিকে৷ আচমকাই অনিন্দ্রর খুব কাছে সরে আসে মেয়েটা, পুতুলটা অনিন্দ্রর হাতে দিয়ে, ঝিরঝিরে হাওয়ার মতো সুরেলা গলায় বলে, ‘মনে করতে পারলে আমাকে বাড়ি নিয়ে যাবেন আপনি?’
—‘হ্যাঁ… কিন্তু তার আগে তোমার বাড়িটা…’
—‘আমার বাড়ি না৷ আপনার বাড়ি…’
উত্তর দিতে গিয়েও থেমে যায় অনিন্দ্র৷ অসংগতিটা ধরা পড়েছে তার কানে, অস্ফুটে উচ্চারণ করে, ‘স্নেহা, তুমি…’
মেয়েটার মুখে আবার সেই হাসিটা ফিরে আসে— ‘ও কিছু বলবে না, ও আমাকে ভয় পায়৷’
অনিন্দ্র বুঝল, একটা বড়সড় ভুল করে ফেলেছে সে৷ স্নেহা বিষধর সাপের মতো হিসহিসে গলায় বলে, ‘এই ভুলটা আর করবেন না৷ আমার আপনাকে খুন করতে ইচ্ছা করছে না৷ ইচ্ছাটা জাগিয়ে তুলবেন না৷’
—‘আপনি আমাকে খুন করতে পারবেন না৷ আপনার কাছে ছুরি নেই৷’
—‘তা-ই নাকি?’ ছোবল মারার মতো অনিন্দ্রর হাত থেকে পুতুলটা ছিনিয়ে নেয় সে, সেটা সামনে তুলে ধরে বলে, ‘এর মাথাটা ঘুরিয়ে ছিঁড়ে ফেলুন, দেখুন কী আছে ভিতরে?’
—‘মানে এতক্ষণ আমি…’ বাক্যটা শেষ করে না অনিন্দ্র৷
—‘আজ্ঞে হ্যাঁ, ছুরিটা আপনিই বইছিলেন৷’ রাস্তার পাশে একটা পাঁচিল ঘেঁষে দাঁড়ায় স্নেহা৷ ভেজা চুলগুলো বাঁধতে থাকে৷ কয়েকটা ভাবনা দ্রুত খেলতে থাকে অনিন্দ্রর মাথায়৷ হয় স্নেহাই ক্রায়িং বেবি, না হয় সে ডিলিউশনাল৷ যদি সে ক্রায়িং বেবি না হয় তাহলে পুলিশে খবর দিলে পিয়ালি স্বাভাবিক মানসিক রোগী থেকে হিংস্র মানসিক রোগী হিসেবে চিহ্নিত হবে৷ এ ধরনের রোগীদেরকে অনেক সময় লোবোটোমি করে জড়পদার্থ করে দেওয়া হয়৷ পিয়ালির সঙ্গে সেটা কিছুতেই হতে দেবে না সে৷ আর যদি স্নেহা সত্যি ক্রায়িং বেবি হয় তাহলে আজ তাকে ছেড়ে দিলে আরও কয়েকটা নিরপরাধ মানুষের প্রাণ যাবে৷
সত্যিটা জানার একটাই উপায় আছে৷ পুতুলের মাথাটা খুলে দেখা যায়৷ কিন্তু পিয়ালি আবার ফিরে এলে পুতুলের মাথা ছেঁড়া দেখে কী করবে ঠিক নেই৷
অনিন্দ্রর অসহায় লাগে৷ ফোনের দিকে না তাকিয়েই নম্বরটা ডায়াল করতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয়৷ নাঃ, পিয়ালিকে নিয়ে এতটা রিস্ক সে নিতে পারবে না৷
স্নেহার চুল বাঁধা হয়ে গিয়েছিল, সে ছলনার হাসি হেসে বলল, ‘একটা ব্যাপার ভেবে মজা লাগছে, জানেন?’
—‘কী?’
—‘মানে আমার আর পিয়ালির চেহারায় কোনও পার্থক্য নেই৷ গলার স্বর, হাতের ছোঁয়া সব একই রকম৷ আপনি ওঁর দিকে অমন হাঁ করে চেয়েছিলেন৷ অথচ আমি এতক্ষণ ধরে চুল বাঁধলাম, একবার ফিরেও তাকালেন না৷’
—‘আপনার দিকে তাকালে কেন জানি না ভয় করছে খুব৷’
—‘স্টপ ইট, ম্যান৷ স্বীকার করুন, আপনাদের পুরুষদের ন্যাকা-ন্যাকা আতুপুতু টাইপের অসহায় মেয়েই ভালো লাগে৷ ওইটাই আপনাদের দুর্বলতা৷ ঠিক যেমন মেয়েদের দুর্বলতা শিশুর কান্না শুনে ছুটে আসা…’
—‘আপনি নাকি বাচ্চাদের কান্নার আওয়াজ করতে পারেন… একটু করে দেখাবেন?’ স্নেহা ক্রায়িং বেবি কি না জানার এইটাই একমাত্র উপায়৷
—‘আপনি জানলেন কী করে?’
—‘রেডিয়োতেই বলছিল…’
রেডিয়োর ব্যাপারটা শুনে আবার খুশি হয় স্নেহা৷ থমকে দাঁড়ায়৷ দু-হাতে মুখ ঢেকে ফ্যালে৷ কয়েক সেকেন্ড পরেই স্নেহার হাতের ফাঁক থেকে অবিকল শিশুর কান্নার মতো একটা শব্দ বেরিয়ে আসে৷ অনিন্দ্র থ হয়ে যায়৷ দূর থেকে এ আওয়াজ শুনলে মনেই হবে না একটা পূর্ণবয়স্ক মানুষের গলা থেকে বেরোচ্ছে শব্দটা৷
মুখ ঢেকেই এবার হাসতে থাকে স্নেহা৷ অনিন্দ্রর হাতটা এই সুযোগে চলে গেছে ফোনের উপরে৷ নম্বরটা ফুটেই আছে স্ক্রিনের উপরে৷ সে ডায়াল বাটানটা টিপে দেয়৷
—‘খুব ছোট থেকে পারি এটা৷ একজনের থেকে শিখেছিলাম৷’
আবার ফোনটা কেটে দেয় অনিন্দ্র— ‘কার থেকে?’
সদ্য-ভেজা মার্কারি ভেপারের আলো ছড়িয়ে আছে রাস্তার উপরে৷ আলো-আঁধারি হয়ে আছে চতুর্দিক৷ তার ভিতর দিয়েই হাঁটতে থাকে দুটো মানুষ৷ স্নেহা ধীরে ধীরে বলে,
—‘পিয়ালি ছোট থেকেই অ্যাসাইলামে৷ তো অনেক বছর আগে আমরা যে অ্যাসাইলামে থাকতাম সেখানে একজন রোগী এসেছিল, বুঝলেন? পিয়ালির মতোই নাটহেড৷ ভালোনাম জানি না৷ তবে ডাকনাম ছিল লিলি৷ পিয়ালির সঙ্গেই কথা বলত বেশি৷ আমি এলেই অ্যাভয়েড করত৷’
—‘অ্যাভয়েড করত কেন?’
অনিন্দ্রর দিকে আরও কিছুটা সরে এসে হাঁটতে থাকে স্নেহা, ‘লিলি বলত ওর নাকি খুন করতে ইচ্ছা করে, বিশেষ করে মানুষের মধ্যে সিমপ্যাথি জিনিসটা দেখলেই নাকি হিংসা হত ওর৷ মায়ের কাছ থেকেও হয়তো কিছুটা সিমপ্যাথি চেয়েছিল, পায়নি, তাই… বলত আমার সঙ্গে কথা বললে ওর খুন করার ইচ্ছাটা বেড়ে যায়৷’
অনিন্দ্রর মনে পড়ে রেডিয়োতে বলছিল, এই ধরনের খুনিরা ছেলেবেলার কোনও সাপ্রেসড ইমোশন থেকে খুন করে৷
—‘ওর বাবা-মা-র ডিভোর্স হয়ে গেছিল৷ তো লিলি ওর বাবার কাছে থাকত৷ আর এই বাবাটাই অ্যাবিউজ করত ওকে৷ পঙ্গু করে রাখার জন্য কী সব ইনজেকশন দিত৷’
—‘পঙ্গু করে রাখার ইঞ্জেকশন?’
একটু থমকায় স্নেহা৷ বলে, ‘আমি ঠিক জানি না কীসের ইঞ্জেকশন৷ পিয়ালি জানে৷ আমাকে খুলে বলেনি৷ শুধু এরকম বাচ্চাদের মতো হাসতে পারত ও৷ এভাবে হাসলে নাকি ওর বাবা খুশি হত৷ আমি ওর কাছ থেকেই শিখে নিই৷’
—‘তারপর লিলি গেল কোথায়?’
—‘বছর দুয়েক পর ওকে অন্য অ্যাসাইলামে নিয়ে যাওয়া হয়৷’
—‘কেন?’
স্নেহার গলা এবার ক্লান্ত শোনাচ্ছে, কিছু কি বদল আসছে ওঁর মধ্যে? — ‘লিলি এমনিতে শান্ত ছিল৷ একদিন হঠাৎ করেই একটা মজার কাণ্ড করে ফ্যালে৷ সেদিন ওকে ওর মা দেখতে এসেছিল৷ মাকে দেখলে সেদিন লিলির মনটা ডিস্টার্বড থাকত৷ সেদিন একটু বেশি হয়েছিল৷ সারারাত ও কাঁদছিল….’
স্নেহাকে উদাস দেখায়৷ যেন নিজেরই কোনও যন্ত্রণাময় স্মৃতি মনে করছে— ‘সে রাতে আমি ওর সঙ্গে ছিলাম৷ ও একসময় কাঁদতে কাঁদতে করিডোরে বেরিয়ে যায়৷ প্রথমে স্বাভাবিক ভাবেই কাঁদছিল৷ হঠাৎ খেয়াল করলাম, কান্নাটা বদলে গেছে৷ একটা শিশুর মতো কাঁদছে ও৷ আমি তো অবাক… একটু পরে বুঝলাম ওর উদ্দেশ্য৷ একজন নার্স সেই আওয়াজ শুনতে পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে৷ অ্যাসাইলামে অত ছোট বাচ্চা ছিল না৷ ফলে কাজটা কোনও রোগী করছে বলে সন্দেহ করেনি সেই নার্স৷ বাইরে আসতেই লিলি ওর ল্যারিংসে কাঁটা চামচ ঢুকিয়ে খুন করে৷
নার্সের গলা চিরে বেরিয়ে-আসা রক্ত মাখতে মাখতে ওর কান্না হাসিতে বদলে যায়… এবার গেস করুন দেখি ওকে কাঁটা চামচটা কে দিয়েছিল?’
—‘আপনি?’
উত্তেজনার স্রোত ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে অনিন্দ্রর সমস্ত শরীরে৷ এই লিলিই যে ক্রাইং বেবি তাতে সন্দেহ নেই৷ উত্তেজনার ভিতর থেকেই উত্তরটা খেলে যায় তার মাথায় লিলি আর কেউ নয়৷ পিয়ালি ও স্নেহারই আর একটা পার্সোনালিটি… দূরে একটা ছায়া দেখা গেছে এতক্ষণে৷ একটা ভিখারিজাতীয় মহিলা রাস্তা পার হচ্ছে৷ সেটা দেখেই স্নেহার চোখে ঝিলিক খেলে যায়, ‘গুড বাই৷ উই হ্যাড আ গ্রেট টাইম, ম্যান৷ নাউ আই হ্যাভ ওয়ার্ক টু ডু৷’
ছুটে সেদিকে এগিয়ে যায় স্নেহা৷ অনিন্দ্র তাকে বাধা দিতে যায়, কিন্তু তার আগেই তার পকেটে ফোনটা ভাইব্রেট করে ওঠে৷ দ্রুত সেটা কানে চেপে ধরে৷
—‘হেল্লো৷ রেডিয়ো হেল্পলাইন৷’
গলাটা চিনতে পারে অনিন্দ্র৷ রেডিয়োর ঘোষক সেই ছেলেটা৷ তিনবার নম্বর ডায়াল করেও কেটে দিয়েছে ও৷ তাই ওরা কল ব্যাক করেছে৷
অনিন্দ্র আমতা আমতা করে ‘আসলে ওই ক্রায়িং বেবির ব্যাপারটা… আমি এক্ষুনি নর্থ কলকাতার কপার লেনে দাঁড়িয়ে ওইরকম একটা কান্না শুনেছি…. একটি মেয়ে আমার সঙ্গে ছিল, মনে হচ্ছে, ও বিপদে পড়তে চলেছে… প্লিজ, একটা কিছু…’
—‘মেয়ে? আপনার বাড়িতেই…’
অনিন্দ্র কথা শেষ হতে দেয় না— ‘চিনি না মেয়েটিকে৷ ওর মাথার ঠিক নেই, কোনওভাবে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে…’
—‘বাচ্চার কান্না শুনতে পেয়েছেন আপনারা, তা-ই তো?’
অনিন্দ্র কয়েক সেকেন্ড ভেবে নেয়, উত্তরটা যদি ‘না’ দেয় তাহলে এরা গুরুত্ব দেবে না ব্যাপারটাকে৷
—‘হ্যাঁ, শুনেছি৷ প্লিজ তাড়াতাড়ি করুন…’
—‘আপনি শিয়োর? বাড়িতে বাচ্চা নেই আপনার?’
—‘আমি বাড়িতে নেই৷ রাস্তার উপরেই…’
ওদিক থেকে হো হো করে হসে ওঠে ছেলেটা— ‘ওঃ আপনি মনে হয় ঘোষণাটা শুনেই রেডিয়ো বন্ধ করে দিয়েছেন৷ অনুষ্ঠানের শেষ দিকটা আর শোনেননি৷ ইট ওয়াজ আ প্ল্যাংক৷ আ প্যাকটিক্যাল জোক৷’
—‘মানে?’ অনিন্দ্র অবাক গলায় প্রশ্ন করে৷
—‘ইয়েস৷ দেয়ার ইজ নো ক্রায়িং বেবি৷ আমরা আসলে একটা সোশ্যাল সার্ভে করছিলাম৷ মানে মানুষের মনে যদি কোনও স্পেসিফিক ভয় আগে থেকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তাহলে সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষও হ্যালুসিনেট করতে থাকে৷ ইউ ওন্ট বিলিভ বাট আপনি আমাদের সিক্সটিন্থ কলার, যিনি আউট অফ নাথিং বাচ্চার কান্না শুনতে পেয়েছেন…’
‘প্যাংক৷’ অনিন্দ্রর শব্দটাকে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগে৷ আর কোনও কথা না বাড়িয়ে ফোনটা কেটে দেয় সে৷ ক্রায়িং বেবি বলে কেউ না থাক, স্নেহাকে ছেড়ে দেওয়া যায় না৷ অনিন্দ্র ভেবে দ্যাখে এতক্ষণে স্নেহা একবারও বলেনি সে ক্রায়িং বেবি৷ হয়তো সে সত্যি রাত হলে ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে বেরিয়ে খুন করে৷
কয়েকটা প্রশ্ন এখনও অস্পষ্ট অনিন্দ্রর কাছে৷ সেগুলো আপাতত সরিয়ে রেখেই সে সামনে দৌড়াতে থাকে৷ একটা খুনিকে কিছুতেই হাতে পেয়ে ছেড়ে দেওয়া যায় না৷
—‘স্নেহা…’
মেয়েটা এগিয়ে গেছিল৷ সে পেছন ঘোরে না৷
—‘পিয়ালি…’
মেয়েটা থেমে যায়৷ ঘুরে তাকায় পিছনে৷ অনিন্দ্র একদৌড়ে এগিয়ে যায় তার দিকে৷ তাকে সামনে পেয়ে নরম হাসি খেলে যায় মেয়েটার ক্লান্ত মুখে— ‘তুমি… তুমি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিলে না তো…’
—‘দেব৷ আমাকে ক্ষমা করে দিও পিয়ালি৷’
—‘ক্ষমা৷ কিন্তু আমি তো…’
সে আর কিছু বলার আগেই তার হাত থেকে পুতুলটা ছিনিয়ে নেয় অনিন্দ্র৷ তারপর একটানে মুচড়ে ছিঁড়ে ফেলে সেটার মাথা৷ পিয়ালি সন্তানহারা মায়ের মতো ডুকরে চিৎকার করে ওঠে৷ সেদিকে কান দেয় না অনিন্দ্র৷ সে স্থির চোখে চেয়ে দেখে পুতুলের ভিতরটা খালি৷ ছুরির কোনও চিহ্ন নেই সেখানে৷
—‘তুমি… তুমি খুন করলে ওকে৷’
বিড়ালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে পিয়ালি৷ নখের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে অনিন্দ্রকে৷
—‘আমি… আমি তোমাকে…’ দুটো সপাটে চড় গালে পড়ে তার৷ আর কিছু বলে ওঠার আগেই পুতুলের মাথা আর দেহটা বুকে আগলে ধরে কাঁদতে কাঁদতে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যায় পিয়ালি৷ আর্ত চিৎকারের শব্দ মিলিয়ে আসে৷
অনিন্দ্রর হুঁশ ফিরতে কয়েক মিনিট সময় লাগে৷ উঠে দাঁড়াতেই তার বুকের ভিতরে একরাশ যন্ত্রণার ঢেউ আছড়ে পড়ে৷ স্নেহা, পিয়ালি কেউ খুনি নয়৷ সম্ভবত লিলি বলেও কেউ ছিল না৷
চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে তার৷ যে করেই হোক খুঁজে বের করতে হবে পিয়ালিকে৷ এত রাতে একটা মেয়ে এভাবে রাস্তায় ঘুরে বেড়ালে…
মেয়েটাকে কি ভালোবেসে ফেলেছে ও?
—‘পিয়ালি… প্লিজ আমার কথাটা বোঝার চেষ্টা করো৷’ চিৎকার করে ওঠে অনিন্দ্র৷ বাতাস ঢিমে তালে বইতে থাকে৷ কোনও উত্তর আসে না৷ পরের আধ ঘণ্টা উত্তর কলকাতার অলিতে-গলিতে ছুটে বেড়াতে থাকে অনিন্দ্র৷ কপার লেনের আশপাশের কানাগলিগুলো হানাবাড়ির মতো হাঁ করে আছে৷ ব্ল্যাকহোলের মতো গিলে খেয়েছে পিয়ালিকে৷
ঘণ্টাখানেক পর অনিন্দ্র ক্লান্ত হয়ে একটা পাঁচিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে৷ ফোনটা বের করে একবার দ্যাখে৷ কিছু একটা খটকা লাগে তার৷ কিন্তু সেটা ভাবার আগেই একটা চাপা শব্দ কানে আসে৷
কান্নার আওয়াজ— একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ৷ একটু আগে স্নেহা যেমন করে হেসেছিল৷
—‘পিয়ালি…’ প্রায় ছুটে সেদিকে এগিয়ে যায় অনিন্দ্র৷ খটকাটা তার মাথা থেকে উবে গেছে৷
অন্ধকারের বুক থেকে ভেসে আসছে কান্নাটা৷
—‘পিয়ালি আমাকে ক্ষমা করে দাও… আমি তোমাকে সন্দেহ…’
সামনে এগোতে গিয়েও থমকে যায় অনিন্দ্র৷ পিছনে একটা পায়ের আওয়াজ শুনতে পেয়েছে৷ পিয়ালি যদি সামনে থেকে থাকে তাহলে পেছনে কে?
সে পেছনে ঘোরে৷ পিয়ালি দাঁড়িয়ে আছে৷
অবাক হয়ে তার দিকে তাকায় অনিন্দ্র— ‘তুমি এখানে৷ তাহলে…’
মুখ ফিরিয়ে সামনের অন্ধকারের দিকে ফেরে অনিন্দ্র৷ কাঁপাকাঁপা আঙুলে অন্ধকারের ভিতরের দিকে নির্দেশ করে পিয়ালি, একটা শব্দ বেরিয়ে আসে তার মুখ থেকে,
‘ওই যে-লিলি!’
কান খাড়া করে অনিন্দ্র শোনে, সামনে থেকে একটা চাপা গলার স্বর ভেসে আসছে, চিনতে পারে সে, একটু আগের শোনা সেই কবিতার কয়েকটা লাইন— ‘হেঁটেছি অনেক পথ; আমার ফুরালো পথ; এখানে সকল পথ, তোমার পায়ের পথে গিয়েছে নীলাভ ঘাসে মুছে৷’
কবিতাটা শেষ হতেই দুটো শক্ত হাতের ধাক্কায় রাস্তার উপরে আছড়ে পড়ে অনিন্দ্র৷ সামনে তাকিয়ে দেখে একটা ছায়ায় ঢাকা মূর্তি এগিয়ে আসছে তার দিকে৷ মূর্তির একহাতে ধারালো ছুরি৷ অন্য হাতে একটা ইঞ্চি পাঁচেকের পুতুল৷
‘লীলাময় গুহ৷ আমার মায়ের দেওয়া নাম৷ বাবা ডাকত লিলি৷’
গলাটা চেনে অনিন্দ্র৷ হঠাৎ করে খটকাটা ভেসে ওঠে তার চোখের সামনে৷ যে ফোনটা তার কাছে এসেছিল, সেটা কোনও রেডিয়ো স্টেশনের রেজিস্টারড নম্বর নয়৷ পারসোনাল নম্বর৷
মানুষটার মুখটা এখনও ঢেকে আছে অন্ধকারে৷ শুধু গলাটা চেনা লাগছে, ভীষণ চেনা লাগছে৷ কবিতার লাইনগুলো মনে পড়ে যায়৷ হ্যাঁ, এই গলাতেই শুনেছিল কবিতাটা৷
তুমি যে রয়েছ কাছে; ঘাসে যে তোমার ছায়া; তোমার হাতের ছায়া; তোমার শাড়ির ছায়া ঘাসে, আকাশে চাঁদের আলো; উঠোনে চাঁদের আলো; নীলাভ চাঁদের আলো; এমন চাঁদের আলো আজ৷
—‘এই কবিতাটা শুনলেই আমার নিজের মা-বাপের কথা মনে পড়ে, জানেন? বাপটা বেওড়া ছিল৷ মেয়ের শখ ছিল তার৷ কিন্তু হয় ছেলে৷ যত দিন যায়, তার মেয়ে-সন্তানের শখ বেড়ে উঠতে থাকে৷ পাগলা হয়ে যায় শালা৷ ছেলেটাকেই অ্যাবিউজ করে কয়েকবার৷ অ্যাবিউজ বোঝেন তো আপনি? মানে…’
ছেলেটা বলে চলেছে কথাগুলো৷ এই মুহূর্তে তার হাত ঘোরাফেরা করছে অনিন্দ্রর বুকে, কোমরে৷ ছুরিটা উঠে এল ছেলেটার হাতে ধরা পুতুলটার গলার কাছে৷ পুতুলের মাথাটা খসে পড়ল ধড় থেকে৷
‘হারামিটা আমার বডিতে মেয়েছেলের মাল ফুটিয়ে তুলতে হরমোনাল ইঞ্জেকশন দিত রোজ৷ ওই ইঞ্জেকশনগুলো আমার নার্ভকে শেষ করে দিত৷ গলাটা মেয়েলি হয়ে যেত আমার, শরীরটাও৷ কষ্ট হত ভীষণ… ভীষণ.. একটু পরে আপনার যেমন হবে… মা কে বলতাম, আমাকে এর হাত থেকে বাঁচাও, কিন্তু মা-ও শালা জানত একবার এইসব খবর বাজারে এলে বাবার জেল হাজত হয়ে যাবে৷ মান-সম্মান সব ভোগে যাবে… শেষে একদিন সবাই জানল… ততদিনে আমিও শালা বেওড়া হয়ে গিয়েছি…’
‘কিন্তু আমি কী করেছি আপনার?’ অনিন্দ্র চিৎকার করে উঠল৷ ‘করবি৷ আজ না হোক কাল৷ কারও না কারও বাপ তো হবি, তা-ই না? ওই যে বললাম— ‘ঘাসে যে তোমার ছায়া; তোমার হাতের ছায়া; তোমার শাড়ির ছায়া ঘাসে’…’
‘কিন্তু… আমি…’
একটা সরু ছুরির ফলা অনিন্দ্রর গলাটা চিরে দেয়৷ বগবগিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে সেখান থেকে৷ রক্তাক্ত অসহায় চোখে মৃত্যুর আগে শেষ একবার পিয়ালির দিকে তাকায়৷ এদিকে ভ্রূক্ষেপই নেই পিয়ালির৷ মেয়েটা আবার সেই আগের লালাবাই গেয়ে কাঁদতে কাঁদতে পুতুলের মাথাটা একমনে জোড়ার চেষ্টা করছে৷ সেটা জুড়বে না আর৷
মিনিট দশেক পর কপার লেনের লাগোয়া কানাগলিতে পড়ে থাকে অনিন্দ্রর নিথর দেহটা৷ বৃষ্টির জমা জলে শরবতের মতো মিশতে থাকে রক্তের স্রোত৷ তার থেকে একটু দূরে পড়ে থাকে একটা মাথাকাটা পুতুলের দেহ৷
কাছেই কোনও বাড়ির দোতলায় একটা শিশুর কান্না শোনা যায়৷ কেন কাঁদছে? কে জানে…
শিশুরা অকারণেই কাঁদে৷