শিশুবোধক জৌন শিক্ষা, সহজ পাঠ
বিধানসভায় আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, বিদ্যালয়ে যৌন শিক্ষা প্রবর্তনের কথা তিনি বলেননি। তিনি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ শিক্ষাই চালু করতে চান।
এ সম্পর্কে নিযুক্ত এক উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটির সঙ্গে আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর যে-সব কথোপকথন হতে পারত তা শুনলেই পরিষ্কার বোঝা যাবে তার মতলব কী ছিল?
শ্রী স্বাস্থ্যমন্ত্রী : আশা করি আপনাকে আমাদের মুশকিলটা যে কোথায়, তা বোঝাতে পেরেছি। বিদ্যালয়ে যৌ— না না যৌন শিক্ষা নয়, ইয়ে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ শিক্ষা অবিলম্বে চালু করতেই হবে। না হলে স্বাস্থ্য দফতর ভেঙে পড়বে। আমাদের গাইনি এবং মেটারনিটি ওয়ার্ড সমূহ ওভার-টাইম খেটেও চাহিদা মেটাতে পারছে না। আমি অনেক ভেবে দেখেছি, দেশের এই সমস্যার সমাধান করতে গেলে অর্থাৎ হাসপাতালের গাইনি এবং মেটারনিটি ওয়ারডের উপর যে অতিরিক্ত মানুষিক চাপ পড়ছে তা কমাতে গেলে, শিশুদিগকে কনফিডেনসে নিতেই হবে। তাদের বোঝাতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ তাদের ভবিষ্যতের পক্ষে কত জরুরি। ভবিষ্যতে যদি ভালোভাবে থাকতে চাও তবে ছেলেপুলে আই মিন জনসংখ্যা আর বাড়িও না, এই কথাটাই আমি সুকুমারমতি বালক-বালিকাদের মনে গোড়া থেকে গেঁথে দিতে চাই।
শ্রী বিশেষজ্ঞ কমিটি : উত্তম প্রস্তাব স্যর! কথায় বলে, কাঁচায় না নোয়ালে বাঁশ, পাকলে করে ট্যাশ ট্যাশ।
শ্রী স্বাস্থ্যমন্ত্রী : ব্যাপারটা খুবই ডেলিকেট। নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ শিক্ষার উপযোগী সিলেবাসটা এমনভাবে করতে হবে, যাতে সাপ মরবে অথচ লাঠি ভাঙবে না। আসল ব্যাপারটা সুকুমারমতি বালক-বালিকাদের মনে গেঁথেও দেওয়া যাবে অথচ তার জন্য বিধানসভায় প্রশ্নও উঠবে না।
শ্রী বিশেষজ্ঞ কমিটি : করা যাবে স্যর। সত্যি বলতে কি, কাজ আমরা অনেকটা এগিয়েই রেখেছি স্যর।
শ্রী স্বাস্থ্যমন্ত্রী : কাজ এগিয়ে রেখেছি মানে?
শ্রী বিশেষজ্ঞ কমিটি : আমরা স্যর, এই বিষয়ে একটা মডেল পাঠ্য বই-এর খসড়া করেই এনেছি স্যর। বলেন তো একটু পড়ে শোনাই।
শ্রী স্বাস্থ্যমন্ত্রী : একেবারে পাঠ্য বই-এর খসড়া অব্দি করে এনেছেন। বেশ বেশ। পড়ুন তাহলে।
শ্রী বিশেষজ্ঞ কমিটি : প্রথমেই বই-এর নাম— শিশুবোধক জৌন শিক্ষা, সহজ পাঠ। শ্রী স্বাস্থ্যমন্ত্রী : কি বললেন, যৌন শিক্ষা! আমার সঙ্গে ইয়ার্কি দিচ্ছেন না কি? যৌন শিক্ষা যৌন শিক্ষার সহজ পাঠ, কে চাইছে মশায়? আমি বার বার বলেছি যৌন শিক্ষা আমি দিতে চাই না, পাবলিকের আপত্তি আছে। আমি চাই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ শিক্ষা। আমি তারই পাঠ্য বই চাই।
শ্রী বিশেষজ্ঞ কমিটি : স্যর বৃথাই উত্তেজিত হচ্ছেন। এ জৌন অন্ত্যস্থ যৌন নয় স্যর। এ স্যর বর্গীর জ-এর জৌন। এতে সেক্স নেই স্যর, ক্লিন জৌন।
শ্রী স্বাস্থ্যমন্ত্রী : বর্গীয় জ-এর জৌন! কথাটা শুনেছি বলে তো মনে পড়ে না। এ জৌন পেলেন কোথায়?
শ্রী বিশেষজ্ঞ কমিটি : কোথাও পাইনি স্যর। বানিয়ে নিয়েছি। জনসংখ্যার জন থেকে জৌন করেছি। যেমন ক্যাচি তেমন শুনতেও ভালো। বাপমায়ের সামনেও অনায়াসে উচ্চারণ করা যায়। আবার ওর মধ্যে কেমন যেন একটা নন-সেক্স অ্যাপীলও আছে। আজকের জগতে শব্দই ব্ৰহ্ম। একটা লাগদার আওয়াজ চালু করে দিতে পারলেই সমস্যাকে কোণঠাসা করা সহজ হয়। তাই স্যর শব্দটা আবিষ্কার করতে হল।
শ্রী স্বাস্থ্যমন্ত্রী : কিন্তু কথাটার মানে কি দাঁড়াবে?
শ্রী বিশেষজ্ঞ কমিটি : আপনি মন্ত্রী, যা আপনি করতে চাইবেন স্যর, তাই দাঁড়াবে। যেখানে লাগাতে চাইবেন স্যর, কথাটা সেখানেই লেগে থাকবে। ইচ্ছে করলে স্যর, জাতীয় সঙ্গীতেও জুড়ে দেওয়া যাবে। যেমন ধরুন, জনগণমন একেবারে সোজাসুজি না বলে যদি জিভে একটু ঢেউ খেলিয়ে খেলিয়ে জৌন-গৌণ-মৌন বলে তারপর অধিনায়ক জয় হে বলা যায়, তাহলেই দেখুন স্যর, কথাটা ছড়িয়ে দেবার দিক থেকে আমরা কতটা এগিয়ে থাকব।
শ্রী স্বাস্থ্যমন্ত্রী : তাই তো, এদিকটা তো ভেবে দেখিনি। পড়ুন, বইটা পড়ুন শুনি।
শ্রী বিশেষজ্ঞ কমিটি : সরলমতি শিশু ও বালক-বালিকাগণ। তোমরা বড় হয়ে কার মত হতে চাও? রাজেশ খান্না, না ডিম্পল? বিনোদ না রেখা? জীনত আমন, জয়া ভাদুড়ি না অমিতাভ বচ্চন, শত্রুঘ্ন সিন্হা? না কি পরভীন বাবি না কি মুমু? না কি সঞ্জীব, না কি নীতু? একটা কথা তোমরা আশা করি ভালোই জান যে তোমাদের মধ্যে যারা কেবলমাত্র স্ত্রীং আছ, কেবল তারাই ডিম্পল বা রেখা বা জীনত বা জয়া বা পরভীন বা মুমু বা নীতুর মতো হতে পারবে। এবং তোমাদের মধ্যে যারা কেবলমাত্র পুং আছ, শুধু তারাই রাজেশ বা বিনোদ বা অমিতাভ বা সঞ্জীব বা শত্রুর মত হতে পারবে। যারা স্ত্রীং আছ তারা যে কেন পুংদের মত হতে পারবে না বা যারা পুং আছ তারা যে কেন স্ত্রীংদের মত হতে পারবে না, সে-কথা বড় হলে জানবে। এখন তা বুঝিয়ে বলা যাবে না, একটু অসুবিধে আছে। এমন কি আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রীকেও তা জিজ্ঞেস করতে যেয়ো না, বিধানসভায় তিনি বিপদে পড়ে যাবেন। কাজেই যারা স্ত্রীং আছ তারা ডিম্পল জয়ার মত হতে চাও, না জীনত মুমুদের মত হতে চাও, সেইটে বরং ঠিক করে ফেল। জানো তো জয়া ডিম্পল ওরা বোকার মতো এই অল্প বয়সেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফাঁদে পা দিয়ে ফেলায় ওদের পাবলিক অ্যাপীল কত কমে গিয়েছে। অন্যদিকে জীনতকে দেখ নীতু, মুমুকেও দেখ। ওরা বিয়েও করেনি, জনসংখ্যাও বাড়ায়নি, তাই তাদের নিয়ে কত টানাটানি! কত সুখেই না আছে! অতএব শিশুগণ, তোমরা যদি সুখের জীবন চাও তো ইত্যাদি ইত্যাদি।
শ্রী স্বাস্থ্যমন্ত্রী : অতি চমৎকার হয়েছে। শুধু যেখানে যেখানে পুং এবং স্ত্রীং আছে সেখানে সেখানে চকোর আর চাঁদ এই দুটো প্রতীক বসিয়ে সেক্সের গন্ধটা আরও মেরে দিতে চাই। আপত্তি নেই তো?
শ্রী বিশেষজ্ঞ কমিটি : কিছুমাত্র না, কিছুমাত্র না।
২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪