2 of 8

শিশুপাল

শিশুপাল

মহাভারতবিদিত রাজা শিশুপালের শত অপরাধ শ্রীকৃষ্ণ মার্জনা করেছিলেন। অবশেষে অপরাধ সংখ্যা শতাধিক হয়ে যাওয়ায় পাণ্ডবদের রাজসূয় যজ্ঞের সময় শ্রীকৃষ্ণ শিশুপালকে হত্যা করেন।

মহাভারতের পাঠক এ কাহিনী জানেন। মহাভারত থেকে জ্ঞানগম্যির দূরত্ব অতিশয় বিস্তর, শিশুপালের শতোত্তীর্ণ দোষের উপাখ্যান এখানে বেমানান। রাজা শিশুপাল নন, প্রকৃতই শিশুর পাল (যষ্ঠী তৎপুরুষে শিশুপাল) নিয়ে এবার আলোচনা।

মুখবন্ধ বেশি না বাড়িয়ে আমার এই শিশুপাল কথামালা সরাসরি শিশুপালন দিয়ে আরম্ভ করছি।

নবীন জননীরা অনেকেই তাঁদের শিশুটিকে নিয়ে খুব বাড়াবাড়ি করেন। মাতৃদেবীর অননুমোদিত কোনও খাবারই শিশুদের স্পর্শ করতে দেওয়া হয় না। মায়েরা কেউ কেউ এত খুঁতখুঁতে হন যে তাঁদের নয়নের মণিটিকে সদাসর্বদা ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখার চেষ্টা করেন। কেউ শিশুটিকে কোনও খাবার দিতে পারবে না, স্পর্শ করতে পারবে না—এমন কী কোলে নিতে গেলেও মায়ের আপত্তি।

এই রকম এক শিশুর মা, যিনি তাঁর সন্তানটিকে সব সময়ে সুরক্ষার কাচের বাক্সের মধ্যে মানুষ করছেন, একদিন তাঁর মনে হল বাচ্চাটির বোধহয় দাঁত উঠছে। বছরখানেক বয়েস হতে চলেছে বাচ্চার, দু’-একটা করে ধারালো দুধ দাঁত এখন তো উঠবেই।

মাতৃদেবী একদিন তাঁর বয়স্কা প্রতিবেশিনীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মাসিমা, আমার ছেলের তো দাঁত ওঠার বয়েস হল, আমার মনে হচ্ছে, ওর দাঁত উঠেছে, কিন্তু কী করে জানা যায় বলুন তো?’ মাসিমা সরলভাবে বললেন, ‘দাঁত উঠেছে কিনা জানা আর তেমন কঠিন কী? তুমি ওর মুখের মধ্যে আঙুল দিয়ে মাড়ির মধ্যে লাগিয়ে দ্যাখো, দাঁত উঠলে বেশ বুঝতে পারবে’।

এই পর্যন্ত উপদেশদানের পরে সাবেকি সরলমনা মাসিমার হঠাৎ ভ্রুকুঞ্চিতা, উদ্বিগ্না ছেলের মায়ের দিকে নজর পড়ল যে ভাবতেই পারে না যে, তার খোকার মুখে আঙুল দেওয়া সম্ভব।

মুহূর্তের মধ্যে মাসিমা নিজেকে সংশোধন করে নিলেন, বললেন, ‘তবে তোমার খোকার মুখে ঢোকানোর আগে তুমি তোমার আঙুলটা গরম জলে ফুটিয়ে নিয়ো। সাবধানের মার নেই। কখন কীসে যে কী হয় তাতো বলা যায় না।’

এ গল্প ঠিক শিশুকে নিয়ে নয়, শিশুর মাকে নিয়ে। আসল শিশু, যে এর চেয়ে বেশ বড় এবং জীবন্ত ও চলন্ত এবার তার কথা বলি।

অনেকদিন আগে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে ব্যাপারটা দেখেছিলাম। রবিবারের এক সকালে বন্ধুর বাড়িতে গেছি আড্ডা দিতে, দেখি বন্ধু মাথা গুঁজে শুকনো মুখে চৌকো ঘর কাটা একটা খাতায় কী সব অঙ্ক করছেন, আর মধ্যে মধ্যে ঘাড় চুলকোচ্ছেন। বন্ধুর সামনের চেয়ারে বসে আছে তাঁর শিশুপুত্রটি। এগুলো তারই অঙ্ক, খুব কঠিন হওয়ার কথা নয়, কিন্তু সংখ্যায় অনেক; তা ছাড়া নতুন যুগের নতুন রীতির অঙ্ক, আমাদের সনাতন কায়দায় সেগুলো কষা গ্রাহ্য নয়।

বন্ধুবর আমাকে দেখে একটু মাথা উঁচু করে ক্ষীণ হেসে বসতে বললেন। কিন্তু তাঁর পুত্রটি আমাকে দেখে মোটেই খুশি হয়নি মনে হল, বাবার হোমওয়ার্ক করতে বাধা হবে, সম্ভবত এই ভেবে সে বেশ গম্ভীর।

এরই মধ্যে আরেকটি সমবয়সি ছেলে জানলা দিয়ে উঁকি দিল। বন্ধুর বাড়িটা একতলায়, রাস্তা থেকে জানলা দিয়ে কথা বলা যায়। বাইরের ছেলেটি জানলা বেয়ে উঠে বন্ধু-পুত্রকে একটা রবারের বল দেখিয়ে বলল, ‘কী রে আপেল, খেলতে যাবি না? দেরি হয়ে যাচ্ছে যে।’

আপেল অর্থাৎ বন্ধুর শিশুপুত্রটি রীতিমতো বয়স্ক চালে জবাব দিল, ‘আমার দেরি হবে। বাবার হোমওয়ার্ক কষে দেয়া এখনও শেষ হয়নি। আমি একটু চোখের আড়াল হলেই বাবা সব ফেলে রাখবে। বাবা যা ফাঁকিবাজ। আর তখন ক্লাসে মার খেতে হবে আমাকে।’

এই শিশুটি যেন ঠিক শিশু নয়, শিশুর গল্পে একে মানায় না। প্রকৃত শিশুর কাহিনী কিন্তু আসলে। তার বাবা-মাকে জড়িয়ে, সে উপাখ্যানে শিশুটির ভূমিকা গৌণ।

নিতান্ত প্যারাম্বুলেটরশায়ী দুটি অবোলা শিশুর দুটি ভিন্ন কাহিনী আছে। প্রথম গল্পটি যে ভদ্রলোক আমাকে বলেছিলেন তাঁর এ ধরনের গল্প বলার অভ্যাস আছে তাই বিশ্বাসযোগ্য নয় কিন্তু তিনি হলফ করে বলেছেন যে, তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন এবং স্বকর্ণে শুনেছেন।

ঘটনাটা ঘটেছিল লেকের এক প্রান্তে। একটি প্যারাম্বুলেটর এক ভদ্রলোক দ্রুত চালিয়ে নিয়ে চলেছেন, তাঁর পিছনে ছুটতে ছুটতে আসছেন তাঁর স্ত্রী। কিছুক্ষণ ছোটার পরে ভদ্রমহিলা স্বামীকে ধরে ফেললেন, হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, ‘এ কী করছ। এ তো আমাদের বাচ্চা নয়। আমাদের বাচ্চা তো ওই গাছতলায় প্যারাম্বুলেটরে ঘুমোচ্ছে। এ তো অন্যদের বাচ্চা।’

ভদ্রলোক তখনও দ্রুতবেগে প্যারাম্বুলেটর ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন, যেতে যেতেই জবাব দিলেন, ‘তা হোক। এ প্যারাম্বুলেটরটা আমাদেরটার চেয়ে অনেক ভাল।’

পরের গল্পটি কোথায় যেন পড়েছিলাম। স্বামী-স্ত্রী মধ্যাহ্ন ভোজনে গিয়েছিলেন। সেখানে পানাহার সেরে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরছেন।

বাড়ির খুব কাছে একটা পার্ক। সেখানে পার্কের গেটের পাশে অনেকগুলো প্যারাম্বুলেটর; গাডিগুলো দাঁড় করিয়ে আয়ারা বাড়ি ফেরার মুখে নিজেদের মধ্যে জটলা করছে। গল্পগুজব করছে।

হঠাৎ স্ত্রী একটা প্যারাম্বুলেটরের পাশে দাঁড়িয়ে স্বামীকে বললেন, ‘এই তো এটা আমাদের বাচ্চা।’ স্ত্রীর কথা শুনে স্বামী অবাক হয়ে বললেন, ‘কী করে বুঝলে?’ নির্বিকারভাবে স্ত্রী জবাব দিলেন, ‘আয়াটাকে দেখে চিনতে পারলাম।’

শৈশবের সঙ্গে সারল্যের নাকি একটা সম্পর্ক আছে। কথায় বলে, শিশুর মতো সরল। এ কথাটা কিন্তু সব সময় মানা যায় না।

যাঁরা শিশুদের খুব সরল মনে করেন, যাঁরা মনে করেন শিশুরা কিছু বোঝে না, তাঁরা সম্ভবত খুব অভিজ্ঞ ব্যক্তি নন, বরং বলা চলে এই ধরনের চিন্তাকারীরা নিজেরাই শিশু।।

আসল শিশুর কথা বলি। তার দিদি জামাইবাবু এসেছে সাতদিনের ছুটিতে বেড়াতে। সে হাজার রকম উৎপাত-আবদার করে সেই দম্পতির জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। দিদির যথেষ্ট অভ্যাস আছে ভাইয়ের অত্যাচারের ব্যাপারটা, মাত্র অল্প কিছুকাল আগেই তার বিয়ে হয়েছে। কিন্তু জামাইবাবু বেচারি একদিন আর সহ্য করতে পারলেন না। ক্ষুদ্র শ্যালকের কানটি একটু মলে দিলেন।

এর পরের ঘটনা অবিশ্বাস্য। ক্ষুদ্র শ্যালকটি আর কিছুই করল না। কিন্তু কয়েক দিন আগে বাড়িতে ম্যালেরিয়া হয়েছিল দু’-একজনের, কিছু কুইনিন রয়ে গেছে, সেই সাদা কুইনিনের বড়িগুলো গোপনে সযত্নে গুঁড়ো করে দিদির ফেস পাউডারের সঙ্গে মিশিয়ে রেখে দিল।

এ রকম তিক্তস্বাদ সেই নবীন জামাইবাবু তাঁর জীবনে আর কখনও পাবেন কি না, জীবনে আর কখনও তিনি কোনও শিশুকে কান মলতে বা অন্যভাবে শিক্ষা দিতে যাবেন কি না, তা বলা কঠিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *