3 of 3

শিশুদের জন্য লোভের জিভ

বিয়ের জন্য আগের মতোই মেয়েদের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১৮ বছর এবং ছেলেদের ২১ বছর বয়স হওয়ার শর্ত রেখে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন’ করার প্রস্তাবে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। তবে ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’ আদালতের নির্দেশনা নিয়ে এবং বাবা-মায়ের সমর্থনে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদেরও বিয়ের সুযোগ দিচ্ছে এই আইন। ‘অপ্রাপ্তবয়স্কের’ সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, “বিবাহের জন্য ২১ বছর পূর্ণ করেননি এমন কোনো ছেলে এবং ১৮ বছর পূর্ণ করেননি এমন কোনো মেয়ে”।

এই আইনটি খুব সভ্য আইন হতে পারতো যদি ওই বিশেষ প্রেক্ষাপটের ব্যাপারটি না থাকতো। বিশেষ প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদ বলেন, “অবিবাহিত মাতা, কিন্তু তার বাচ্চা আছে- এ রকম কেইস যদি হয়, এসব ক্ষেত্রে তাকে প্রোটেকশন দেওয়ার জন্য এই বিধান করা হয়েছে। কত ধরনের সমস্যা দেখা দেয়, এজন্য বিয়েগুলো হয়ে যায়। ওটাকে লিগালাইজ করার জন্য এই প্রক্রিয়া। আমাদের দেশে তো ১০-১১ বছরেও পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়। এ সমস্যাগুলো আছে তো, এটার জন্য এই ব্যবস্থা। ”

মন্ত্রিপরিষদ বলতে চাইছেন, অপ্রাপ্তবয়স্ক যে মেয়েরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে, তাদের বিয়ে, এই আইনটি থাকলে অবৈধ বলে গণ্য হবে না। এই আইনটি বাল্যবিবাহকে ছলে কৌশলে বৈধ করছে, কিন্তু এটি বাল্যবিবাহ কী করে রোধ করবে, তা আমার বোধগম্য নয়। আইনটিতে বিশেষ প্রেক্ষাপটের উল্লেখ আছে, কিন্তু কোনো বয়স নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি। ৫০ বছর বয়সী কোনো পুরুষ ৬ বছর বয়সী কোনো মেয়েকে বিয়ে করলেও সেই বিয়েকে এই আইন বৈধ ঘোষণা করতে পারে। আদালতের অনুমতি না নিয়ে অপ্রাপ্তবয়স্করা বিয়ে করলে সামান্য জেল-জরিমানা ছাড়া শাস্তি এমন কিছু নয়।

মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর থেকে কমানো যায় কি না- তা নিয়ে ২০১৩ সালে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে প্রথম আলোচনা উঠলে বিভিন্ন মহল থেকে এর বিরোধিতা করা হয়। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটি আইনের খসড়া তৈরি করে, যাতে ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে’ মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৬ বছর করার প্রস্তাব করা হয়। মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সে সময় ‘বিশেষ পরিস্থিতির’ ব্যাখ্যায় বলেন, “মেয়ে প্রেমঘটিত কারণে ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেলে বা মেয়ে ছেলের বাড়িতে চলে যাওয়ার পর নিজের বাড়িতে ফিরে আসতে অস্বীকৃতি জানালে বা বিয়ের আগে গর্ভবতী হলে- এরকম পরিস্থিতিতে ১৬ বছর করা যায় কি না, তা সরকার চিন্তা-ভাবনা করছে। ” এ নিয়ে সিদ্ধান্তে আসার আগে মাতৃমৃত্যু রোধ ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় ক্ষমতাসীন দলের দুই সংসদ সদস্যও বিয়ের বয়স কমানোর প্রস্তাবে তাদের আপত্তির কথা তুলে ধরে বলেছিলেন, কোনো ধরনের শর্ত রেখেও মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮-এর নিচে আনা উচিত হবে না। এক অনুষ্ঠানে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বাংলাদেশ সরকারকে সতর্ক করে বলেছিলেন, মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানো হলে তা ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে উৎসাহিত করবে। সেইভ দ্য চিলড্রেনের এক প্রতিবেদনে মেয়ে শিশুদের সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহকে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

এত বাধা এসেছে, তারপরও মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮-এর নিচে করার জন্য বাংলাদেশ অস্থির হয়ে উঠেছে। আমি আশঙ্কা করছিলাম ১৮-কে আচমকা একদিন ১৬ করে ফেলবে বাংলাদেশ। কিন্তু এখন এমন একটি আইন করা হয়েছে যেটি আরো ভয়ঙ্কর। যে কোনো বয়সী মেয়েরই বিয়ে হতে পারবে এই আইনে। বাংলাদেশের মতো দেশে ‘আদালতের অনুমতি’ নিতান্তই বাক্যালংকারের জন্য ব্যবহৃত হয়।

মানুষ যত সভ্য হয়, মেয়েদের বিরুদ্ধে বর্বরতা তত কমিয়ে ফেলে। যে দেশে মেয়েরা বাল্যবিবাহের শিকার, সে দেশে মেয়েদের বিয়ের বয়স বাড়ানোটা সে দেশের সভ্য হওয়ার লক্ষণ। বাংলাদেশেও তাই করা হয়েছিল, কিন্তু এখন আবার কমানো হচ্ছে সেই বয়স। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহ যেসব দেশে ঘটছে, যেসব অনুন্নত বর্বর দেশগুলোতে, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশে প্রতি তিনটে বিয়ের একটি বিয়েই বাল্যবিবাহ। শতকরা ৬৮ ভাগ মেয়ের বাল্যবিবাহ হচ্ছে। বাংলাদেশের চেয়ে বেশি বাল্যবিবাহ ঘটে মাত্র তিনটে দেশে। আফ্রিকার নাইজের, চাদ আর মালিতে।

আমরা সকলেই জানি, আঠারো বছরের কম বয়সী ছেলেমেয়েরা প্রাপ্তবয়স্ক নয়, তারা শিশু। বাংলাদেশও আঠারো বছরের কম বয়সী ছেলেমেয়েদের প্রাপ্তবয়স্ক বলে গণ্য করে না। তাহলে জেনেবুঝে বাংলাদেশ কেন শিশুদের বিয়ে বৈধ করছে! কচি কুমারী মেয়েকে যেন আইনের কোনো ঝামেলা ছাড়াই পুরুষেরা ভোগ করতে পারে বা ধর্ষণ করতে পারে তার ব্যবস্থা করছে?

এ কথা কে না জানে যে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিয়ে হলে সামাজিক বা অর্থনৈতিক কোনও উপকার তো হয়ই না, বরং অপকার হয়! অল্প বয়সী মেয়েরা স্বামীর অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয় অতি সহজেই। অশিক্ষিত থেকে যায় জীবনভর, কারণ বিয়ের পর ইস্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিতে তারা বাধ্য হয়। যৌনরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকাটাও বেশি। গর্ভবতী হওয়ার জন্য শরীর এবং মন প্রস্তুত হওয়ার আগেই তাদের গর্ভবতী হতে হয়। অল্প বয়সে গর্ভবতী হওয়া এবং সন্তান প্রসবের কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার মেয়ের মৃত্যু ঘটে। সত্যি কথা বলতে কী, কোনও মেয়ের বাল্যবিবাহ হওয়া মানে তার মৃত্যুদণ্ড হওয়া।

এই আইনের ভুক্তভোগী হবে মেয়েরাই। শিশুর জন্য লোভের জিভ দিন দিন লম্বা হবে পুরুষের। শিশুধর্ষকদের হাত থেকে মেয়েদের রেহাই নেই। শিশু পাচারকারীর হাত থেকেই রেহাই নেই। এই আইনের মাধ্যমে সরকার আসলে ধর্ষণকে বৈধ করবার ব্যবস্থা করছে। দরিদ্র মেয়েরা এমনিতে নানা নির্যাতনের শিকার, প্রায় সমস্ত অধিকার থেকেই বঞ্চিত, তাদের নির্যাতনকে এখন আইনি বৈধতা দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। যে বয়সটায় একটা মেয়ে খুব অসহায়, সেই বয়সটায় তার বিয়েটা বৈধ করা হচ্ছে। এ অনেকটা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মতো। বিনা অপরাধে যাবজ্জীবন। অথবা অপরাধ একটিই, মেয়ে হিসেবে জন্ম নেওয়ার অপরাধ। পতিতালয় থেকে অসহায় মেয়েরা যেমন বেরোতে পারে না, নারী-পুরুষের বৈষম্যের সংসার থেকেও তেমনি বেরোতে পারে না। সে কারণে একটি মেয়ের শিক্ষিত আর স্বনির্ভর হওয়াটা খুব জরুরি। শিক্ষিত এবং স্বনির্ভর মেয়েরা অশিক্ষিত এবং পরনির্ভর মেয়েদের চেয়ে সামাজিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে, মানসিকভাবে, শারীরিকভাবে অনেক বেশি ভালো অবস্থায় আছে। একটা মেয়ের অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় বিয়ে হওয়া মানে, তার স্বাস্থ্য, তার শিক্ষা, তার সম্ভাবনা সব নষ্ট করে দেওয়া। জেনেশুনে বাংলাদেশ সরকার কার বা কাদের স্বার্থে এই আইনটি তৈরি করতে চাইছে?

বাংলাদেশে আঠারো বছর বয়স ছিল মেয়েদের জন্য বিয়ের ন্যূনতম বয়স। তারপরও আইনটিকে না মেনে অসাধু লোকেরা নিজেদের শিশুকন্যাকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিল। এই সমস্যার সমাধান কিন্তু বিয়ের বয়স আঠারো থেকে কমিয়ে এনে হয় না। এর সমাধান হয় ওই অসাধু লোকদের সাধু বানানোয়। এর সমাধান হয় মেয়েদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ব্যাপারে দেশব্যাপী মানুষকে সচেতন করিয়ে। যখন মানুষকে সচেতন করার কাজটি পরিশ্রমের বলে মনে হয়, তখনই সরকার দুষ্ট লোকদের তুষ্ট করতে মন্দ কাজটি করে।

একটা সমাজ কতটা সভ্য, তা নির্ভর করে ওই সমাজে মেয়েদের অবস্থাটা কেমন, তার ওপর। বাংলাদেশে একগাদা আইন রাখা আছে মেয়েদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের সমাজ নারী-বিদ্বেষী সমাজ, এই সমাজ মেয়েদের যৌন বস্তু, পুরুষের দাসী আর সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র ছাড়া আর কিছু মনে করে না। এই নারী-বিদ্বেষী মানসিকতা যখন পরিবর্তনের প্রয়োজন, যখন নারী পুরুষের সকল বৈষম্য দূর করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া উচিত, তখনই সরকার কি না হায়েনার মুখে হরিণ ছুড়ে দেওয়ার মতো শিশুধর্ষকদের বিকৃত যৌনলালসা মেটাতে শিশুদের বিয়ে বৈধ করছে।

ঋতুস্রাব শুরু হয়ে গেলে বা গায়ে গতরে বাড়লেই যে মেয়েরা বিয়ের জন্য মানসিকভাবে এবং শারীরিকভাবে প্রস্তুত হয়ে গেলো, তা নয়। ঠিক যেমন ছেলেদের দাড়িগোঁফ গজালেই বিয়ে করার যোগ্য হয়ে ওঠে না। বিয়ে শুধুই দৈহিক সম্পর্ক নয়, বিয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। বিয়ে খুব বড় দায়িত্ব পালন, বিশেষ করে সন্তানের।

শৈশব যাপনের অধিকার প্রত্যেক শিশুরই আছে। মেয়েদের শৈশব আর কৈশোরকে ছিনিয়ে নিয়ে হুটহাট যৌবন দিয়ে দেওয়া হচ্ছে, অচিরে মেয়েরা বার্ধক্যকে বরণ করে নিতে বাধ্য হচ্ছে। মেয়েদের জীবনকে এভাবে নষ্ট করে দেওয়ার কোনও অধিকার কোনও সরকারের নেই।

শিশু-সঙ্গমে আর শিশু-ধর্ষণে মূলত কোনও পার্থক্য নেই। শরীরে যৌনতার বোধ শুরু না হতেই, নিতান্তই কৌতূহলে বা বাধ্য হয়ে শিশুরা সঙ্গমে রাজি হতেই পারে, কিন্তু সে রাজি হওয়া সত্যিকার রাজি হওয়া নয়।

সমাজের বেশির ভাগ মেয়েরা সুখী নয়, অথচ সুখী হওয়ার ভান করে। অথবা দুঃখকেই, না পাওয়াকেই, পরাধীনতাকেই সুখ বলে, পাওয়া বলে, স্বাধীনতা বলে ভাবে। ভাবতে শিখেছে ছোটবেলা থেকেই। নতুন করে এর বিপরীত কিছু শেখা সম্ভবত অধিকাংশ মেয়ের পক্ষেই আর সম্ভব নয়। পুরুষ যা শিখেছে ছোটবেলা থেকে তা হলো, তারা প্রভু, তারা জানে বেশি, বোঝে বেশি, তাদের জন্য সমাজ, তাদের জন্য জগৎ, তারা শাসন করবে, তারা ভোগ করবে। এই শিক্ষাটা না শিখতে এবং এর বিপরীত কিছু শিখতে অধিকাংশ পুরুষই রাজি নয়।

জাতি হিসেবে সভ্য হতে চাইলে শিশুর প্রতি পুরুষের লোভের জিভকে সংযত করার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের দায়িত্ব এই জিভকে সংযত করার জন্য উৎসাহ দেওয়া। কিছুতেই ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’ জিভ অসংযত করা যেতে পারে বলে অসংযত করায় উৎসাহ দেওয়া নয়।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০১ ডিসেম্বর, ২০১৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *