শিশুচরিত

শিশুচরিত।

 ১৭৪২ শকাব্দঃ অর্থাৎ সন ১২২৭ সালের ১২ই আশ্বিন মঙ্গলবার দিবা দ্বিপ্রহরের সময় জ্যেষ্ঠাগ্রজ ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় ভূমিষ্ঠ হন। তীর্থক্ষেত্র হইতে সমাগত পিতামহ রামজয় বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়, নাড়ীচ্ছেদনের পূর্বে আল্‌তায় এই ভূমিষ্ঠ বালকের জিহ্বা‌র নিয়ে কয়েকটী কথা লিখিয়া, তাঁহার পত্নী দুর্গাদেবীকে বলেন, লেখার নিমিত্ত শিশুটা কিয়ৎক্ষণ মাতৃদুগ্ধ পান করিতে পায় নাই; বিশেষতঃ কোমল জিহ্বা‌য় আমার কঠোর হস্ত দেওয়ায়, এই বালক কিছুদিন তোত্লা‌ হইবে। এই বালক ক্ষণজন্মা, অদ্বিতীয় পুরুষ ও পরম দয়ালু হইবে এবং ইহার কীর্ত্তি দিগন্তব্যাপিনী হইবে। এই বালক জন্মগ্রহণ করায়, আমার বংশের চিরস্থায়ী কীর্ত্তি থাকিবে। ইহাকে দেখিয়া আমি চরিতার্থ হইলাম। এই বালককে অপর কেহ যেন মন্ত্র না দেয়; অন্য হইতে আমিই ইহার অভীষ্টদেব হইলাম। এ বালক সাক্ষাৎ ঈশ্বরতুল্য, অতএব ইহার নাম অদ্য হইতে আমি ঈশ্বরচন্দ্র রাখিলাম। আজ রামজয় তীর্থক্ষেত্রের সেই স্বপ্নকে সত্য জ্ঞান করিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র যৎকালে গর্ভে ছিলেন, তৎকালে জননী ভগবতী দেবী দশমাস উন্মত্তার ন্যায় ছিলেন। পিতামহী দুর্গাদেবী, বধূর রোগোপশমের জন্য কতই প্রতীকার করিয়াছিলেন, কিন্তু কিছুতেই উপশম হয় নাই। তৎকালে কোন কোন বৃদ্ধ স্ত্রীলোক, পিতামহী ও মাতামহীকে বলিতেন, ভূতে পাইয়াছে; আবার কেহ কেহ বলিতেন, ডাইনি পাইয়াছে। এই সকলের রোজা আনাইয়া দেখান হয়, কিন্তু কিছুতেই উপশম হয় নাই। অবশেষে উদয়গঞ্জনিবাসী পণ্ডিতপ্রবর ভবানন্দ শিরোমণি ভট্টাচার্য্য মহাশয়কে দেখান হয়। তিনি এ প্রদেশের মধ্যে চিকিৎসা ও গণিতশাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন; রোগের তথ্যানুসন্ধানবিষয়ে তাহার বিশিষ্টরূপ ক্ষমতা ছিল। ইনি রোগনির্ণয়ের পূর্বে রোগীর কোষ্ঠী গণনা করিতেন। ইনি পিতামহীকে বলেন, আমি তোমার বধূমাতার রোগনির্ণয় করিলাম, এক্ষণে ইহাঁর কোষ্ঠী দেখিতে ইচ্ছা করি। চিকিৎসক ভট্টাচার্য মহাশয় উক্তরূপ কথা বলিলে, দুর্গাদেবী তাঁহার কোষ্ঠী দেখিতে দিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে ভবানন্দ গণনা করিয়া বলিলেন, ইহার কোন রোগ নাই; ঈশ্বরানুগৃহীত কোন মহাপুরুষ ইহাঁর গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহার তেজঃপ্রভাবে এরূপ হইতেছে, কোনরূপ ঔষধ সেবন করাইবেন না। গর্ভস্থ বালক ভূমিষ্ঠ হইলেই ইনি রোগমুক্তা হইবেন। ভবানন্দ ভট্টাচার্য্য় মহাশয় যাহা বলিয়াছিলেন, তাহাই ঘটিল। প্রসবের পরক্ষণেই তাঁহার আর কোন উন্মাদ-চিহ্ন লক্ষিত হইল না। একারণ, পিতামহী সর্ব্বদা ভবানন্দ ভট্টাচার্য্য়ের গণনার ভূয়সী প্রশংসা করিতেন।

 জ্যেষ্ঠাগ্রজ ভূমিষ্ঠ হইবার কিয়ৎক্ষণ পূর্ব্বে, পিতৃদেব দ্রব্যাদি ক্রয় করিবার জন্য অতি সন্নিহিত কুমারগঞ্জের হাটে গিয়াছিলেন। তথা হইতে বাটীতে আসিতেছেন দেখিয়া, পিতামহ রামজয় কিছু অগ্রসর হইয়া বলিলেন, ঠাকুরদাস! অদ্য আমাদের একটী এঁড়ে বাছুর হইয়াছে। তৎকালে আমাদের একটী গাভীও গর্ভিণী হইয়াছিল। পিতৃদেব মনে করিলেন, গর্ভবর্তী গাভীটি প্রসব হইয়াছে; কিন্তু বাটী প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, গাভী প্রসব হয় নাই। তখন পিতামহ ঈষৎ হাস্যবদনে সূতিকাগৃহে প্রবেশ করিয়া, অগ্রজকে দেখাইয়া বলিলেন, এ ছেলে এঁড়ের মত বড় একগুঁয়ে হইবে, একারণ এঁড়ে বাছুর বলিলাম। ইহার দ্বারা পরে দেশের বিশেষরূপ উপকার হইবে। তুমি ইহাকে সামান্য এঁড়ে জ্ঞান করিবে না, এ নিজের জিদ্‌ বজায় রাখিবে, এবং সর্ব্বত্র জয়ী হইবে; আজ আমার স্বপ্নদর্শন সত্য হইল। কিয়ৎক্ষণ পরে গ্রহবিপ্র-শ্রেষ্ঠ কেনারাম আচার্য্য় আসিয়া, বালকের ঠিকুজী প্রস্তুত করিলেন। আচার্য্য়, গণনার দ্বারা ব্যক্ত করিলেন, এই বালক ক্ষণজন্মা; উচ্চগ্রহ সকল প্রত্যক্ষ পরিদৃশ্যমান হইতেছে, এরূপ ফল কাহারও কোষ্ঠীতে অদ্যাপি দেখিতে পাই নাই। এ বালক জগদ্বিখ্যাত, নৃপতুল্য ও দয়াময় হইবে, এবং দীর্ঘায়ু হইয়া নিরন্তর ধন ও বিদ্যাদান করিয়া, সাধারণের কষ্ট নিবারণ করিবে। এই বৃত্তান্ত পিতামহী, মাতামহী ও পিতৃদেবের প্রমুখাৎ যেরূপ অবগত হইয়াছিলাম, তাহা অবিকল লিখিলাম।

 দাদার জন্মগ্রহণের পর অবধি পিতৃদেবের অবস্থার ক্রমশঃ উন্নতি হইতে লাগিল। পঞ্চমবৎসর বয়সের সময় দাদার বিদ্যারম্ভ হয়। তৎকালে বীরসিংহগ্রামের সনাতন বিশ্বাস পাঠশালার সরকার ছিলেন। সনাতন, ছোট ছোট বালকগণকে শিক্ষা দিবার সময় বিলক্ষণ প্রহার করিতেন, তজ্জন্য শিশুগণ সর্ব্বদা শঙ্কিত হইয়া পাঠশালায় যাইতে ইচ্ছা করিত না; একারণ পিতৃদেব, বীরসিংহনিবাসী কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়কে শিক্ষক মনোনীত করিলেন। কালীকান্ত, ভঙ্গকুলীন ছিলেন; সুতরাং বহুবিবাহ করিতে আলস্য করেন নাই। তিনি ভদ্রেশ্বরের নিকট গোরুটিগ্রামেই প্রায় অবস্থিতি করিতেন, অপরাপর শ্বশুরভবনেও টাকা আদায় করিবার জন্য মধ্যে মধ্যে পরিভ্রমণ করিতেন। পিতৃদেব, ভদ্রেশ্বর ও শ্রীরামপুর যাইয়া অনুসন্ধান দ্বারা জানিলেন যে, কালীকান্ত সর্ব্বদা গোরুটিতে থাকেন। তথায় যাইয়া তাঁহাকে অনেক উপদেশ দিয়া, সমভিব্যাহারে করিয়া বীরসিংহায় আনিলেন এবং কয়েক দিন পরে পাঠশালা স্থাপন করিয়া দিলেন। কালীকান্ত অত্যন্ত ভদ্রলোক ছিলেন। শিশুগণকে শিক্ষা দিবার বিশেষরূপ প্রণালী জানিতেন এবং শিশুগণকে আন্তরিক যত্ন ও স্নেহ করিতেন; একারণ, ছোট ছোট বালকগণ তাঁহার নিকট সর্ব্বদা অবস্থিতি করিতে ইচ্ছা করিত। এতদ্ভিন্ন তিনি সকলের সহিত সৌজন্য প্রকাশ করিতেন। স্থানীয় লোকগণ কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়কে আন্তরিক ভক্তি ও শ্রদ্ধা করিত, এবং সকলেই তাঁহাকে গুরুমহাশয় বলিত। কালীকান্তের নিকট অগ্রজ মহাশয় কিঞ্চিদ্ন‌ তিন বৎসর ক্রমাগত শিক্ষা করিয়া, বাঙ্গালা-ভাষা ও স্যাখতি অঙ্ক কষিতে শিখিলেন। ঐ সময়েই তাঁহার হস্তাক্ষর ভাল হইয়াছিল। এই সময়ে অগ্রজ মহাশয়, প্লীহা ও উদরাময়ে অত্যন্ত কষ্টভোগ করেন। বীরসিংহায় কোন প্রকারে আরোগ্য লাভ করিতে পারেন নাই; এজন্য;’জননীর মাতুল পাতুলনিবাসী রাধামোন বিদ্যাভূষণ স্বীয় আবাসে অগ্রজ, মধ্যম ভ্রাতা ও জননীদেবীকে সমভিব্যাহারে লইয়া যান। তথায় খানাকুল কৃষ্ণনগরের সন্নিহিত কোঠারা গ্রামে যে সকল চিকিৎসাব্যবসায়ী বৈদ্য বাস করিতেন, তন্মধ্যে উৎকৃষ্ট চিকিৎসককে আনাইয়া শাস্ত্রমত চিকিৎসা করান হয়। রাধামোহন বিদ্যাভূষণের যত্নে ও কবিরাজ রামলোচনের সুচিকিৎসায়, অগ্রজ মহাশয় সে যাত্রা রক্ষা পান। বাল্যকাল্লে অগ্রজ মহাশয় জননীদেবীর সহিত মধ্যে মধ্যে পাতুলগ্রামে যাইতেন। রাধামোহন বিদ্যাভূষণ ও তাঁহার ভ্রাতৃবর্গ অগ্রজকে আন্তরিক ভাল বাসিতেন; তজ্জ‌ন্য অগ্রজ মহাশয় যাবজ্জীবন রাধামোহনের পরিবারসমূহকে যথেষ্ট স্নেহ ও শ্রদ্ধা করিয়া, মাসিক-ব্যয়-নির্ব্বা‌হার্থে বন্দোবস্ত করিয়াছিলেন।

 প্রায় ছয় মাস পাতুলগ্রামে অবস্থিতি করিয়া, সম্পূর্ণরূপ আরোগ্যলাভপূর্বক, বীরসিংহায় আসিয়া তিনি পুনর্ব্বা‌র পাঠশালায় অধ্যয়নার্থ নিযুক্ত হন।

 বাল্যকালে অগ্রজ অত্যন্ত দুরন্ত ছিলেন। ৫/৬/৭/৮ বৎসর বয়ঃক্রমকালে প্রত্যুষে কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের পাঠশালায়, যাইবার সময়, প্রতিবেশী অনুগত মথুরামোহন মণ্ডলের মাতা পার্ব্বতী ও পত্নী সুভদ্রাকে বিরুক্ত করিবার মানসে, প্রায় প্রত্যহ তাহাদের দ্বারে মলমূত্র ত্যাগ করিতেন। মথুরের পত্নী সুভদ্রা ও জননী পার্ব্বতী ঐ বিষ্ঠা প্রত্যহ স্বহস্তে পরিষ্কার করিতেন। যদি কোন দিন মথুরের পত্নী সুভদ্রা বিরক্ত হইয়া বলিত, দুষ্ট বামুন প্রত্যহই তুমি পাঠশালা যাইবার সময় আমার দ্বারে মল ত্যাগ করিবে? অতঃপর এরূপ গর্হি‌ত কার্য্য করিলে গুরুমহাশয় ও তোমার পিতামহীকে বলিয়া তোমাকে শাসন করাইব। ইহা শুনিয়া সুভদ্রার শ্বশ্রূ, বৌকে এই বলিয়া উপদেশ দিতেন যে, এই ছেলেটী সহজ নহে; ইহার পিতামহ ১২ বৎসর বিবাগী হইয়া তীর্থক্ষেত্রে জপ তপ করিয়া দিনপাত করিতেন। তিনি সাক্ষাৎ ঋষিতুল্য ছিলেন। তাঁহার মুখে শুনিয়াছি, এই বালক অদ্বিতীয়-শক্তিসম্পন্ন হইবে। অতএব তুমি বিরক্ত হইও না; আমি স্বয়ং ইহাঁর মলমূত্র পরিষ্কার করিব। ভবিষ্যতে ঐ বালক যে কে, তাহা জানিতে পরিবে।

 বাল্যকালে অগ্রজ মহাশয় শস্যক্ষেত্রের নিকট দিয়া যাইবার সময়, ধানের শীষ লইয়া চর্ব্ব‌ণ করিতে করিতে যাইতেন। একবার যবের ক্ষেত্রের এক শীষ লইয়া, চর্ব্ব‌ণ করিতে করিতে যবের সুঙা গলায় লাগিয়া মৃতকল্প হন। পিতামহী অনেক কষ্টে গলায় অঙ্গুলি দিয়া, যবের শীষ নির্গত করেন, তাহাতেই রক্ষা পান।

 কালীকান্ত নানাপ্রকার কৌশল ও স্নেহ করিয়া শিখাইতে কিছুমাত্র ত্রুটি করেন নাই। তিনি আপনি সন্তান অপেক্ষাও অগ্রজ মহাশয়কে ভালবাসিতেন। গুরুমহাশয় অপরাহ্নে অপরাপর ছাত্রগণকে অবকাশ দিতেন; কেবল অগ্রজ মহাশয়কে তাঁহার নিকটে রাখিয়া, সন্ধ্যার পর নামতা ও ধারাপাতাদি শিক্ষা দিতেন। অধিক রাত্রি হইলে, প্রত্যহ স্বয়ং ক্রোড়ে করিয়া বাটীতে আনিয়া, পিতামহীর নিকট পহুছাইয়া দিতেন। গুরুমহাশয় একদিবস সন্ধ্যার সময় পিতৃদেবকে বলিলেন, “আপনার পুত্র অদ্বিতীয় বুদ্ধিমান, শ্রুতিধর বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। পাঠশালায় যাহা শিখিতে হয়, তৎসমস্তই ইহার শিক্ষা হইয়াছে। ঈশ্বরকে এখান হইতে কলিকাতায় লইয়া যাওয়া অত্যন্ত আবশ্যক হইয়াছে। আপনি নিকটে রাখিয়া ইংরাজী শিক্ষা দিলে ভাল হয়। এ ছেলে সামান্য ছেলে নয়, বড় বড় ছেলেদের অপেক্ষা ইহার শিক্ষা অতি উত্তম হইয়াছে। আর হস্তাক্ষর যেরূপ হইয়াছে, তাহাতে পুঁথি লিখিতে পরিবে।” তৎকালে বাঙ্গালা ছাপাখানা প্রায় ছিল না। যাহাদের হস্তাক্ষর ভাল হইত, তাহারা সংস্কৃত পুস্তক হাতে লিখিত। হস্তাক্ষর ভাল হইলে, তাহারা সাধারণের নিকট সম্মানিত হইত। একারণ অনেকে হস্তাক্ষর ভাল করিবার জন্য বিশেষ যত্ন পাইত। তৎকালে এপ্রদেশে সম্বন্ধ করিতে আসিলে, অগ্রে পাত্রের হস্তাক্ষর দেখিত, তৎপরে সম্বন্ধের স্থিরীকরণের ইচ্ছা করিত। অগ্রজকে কলিকাতা লইয়া যাইবার নাম শুনিয়া, জননীদেবী। উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন। তৎকালে এপ্রদেশের কাহারও লেখাপড়া শিক্ষার জন্য কলিকাতা যাইবার রীতি ছিল না। ব্রাহ্মণতনয়গণ কেহ কেহ বাল্যকালে টোলে পড়িত। অধিক বয়স হইলে বিদেশের টোলে অধ্যয়নার্থে যাত্রা করিত, কেহ কেহ। জমিদারী সেরেস্তায় কাগজপত্র লিখিতে শিক্ষা করিত।

 পিতৃদেব ইং ১৮২৯ ও বাঙ্গালা ১২৩৫ সালের কার্ত্তিকমাসে গুরুমহাশয় কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় ও অগ্রজকে সমভিব্যাহারে লইয়া, কলিকাতা যাত্রা করিলেন।

 কলিকাতা, বীরসিংহ হইতে প্রায় ২৬ ক্রোশ পূর্ব্বে‌। তৎকালে এখান হইতে কলিকাতা যাইবার ভাল পথ ছিল না; বিশেষতঃ পথে অত্যন্ত দস্য‌ুভয় ছিল। প্রায় মধ্যে মধ্যে অনেকেই ঠেঙ্গাড়ের হাতে পড়িয়া প্রাণ হারাইত – বিশেষ সতর্কতাপূর্বক যাইতে হইত। ঘাঁটাল হইয়া রূপনারায়ণ নদী দিয়া জলপথে নৌকারোহণে কলিকাতা যাইবার উপায় ছিল বটে, কিন্তু দস্য‌ুভয়প্রযুক্ত নৌকায় যাইতে কেহ সাধ্যমতে ইচ্ছা করিত না; সুতরাং পদব্রজেই যাইতে হইল। অগ্রজ মহাশয় সমস্ত পথ চলিতে পরিবেন না বলিয়া, আনন্দরাম গুটিকে সমভিব্যাহারে লাইলেন। যখন চলিতে অক্ষম হইবেন, তখন মধ্যে মধ্যে ঐ বাহক, ক্রোড়ে বা স্কন্ধে করিয়া লইয়া যাইবে। প্রথম দিবস বাটী ছয় ক্রোশ অন্তর পাতুলগ্রামে রাধামোহন বিদ্যাভূষণের বাটীতে উপস্থিত হইলেন। পরদিবস সমস্ত দিনের পর সন্ধ্যার সময়, তথা তইতে দশ ক্রোশ অন্তর সন্ধিপুর গ্রামে রাজচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাটীতে পঁহুছিলেন। পরদিবস প্রাতে শ্য‌াখালা-গ্রামের প্রান্তভাগে যে বাঁধা রাজপথ শালিকা পর্য্যন্ত গিয়াছে, সেই পথ দিয়া গমনকালে অগ্রজমহাশয় পথে মাইলষ্টোন দেখিয়া বলিলেন, “বাবা! এখানে হলুদ বাটবার শিল মাটিতে পোঁতা রহিয়াছে কেন? আর ইহাতে কি লেখার মত চিহ্ন রহিয়াছে?” তাহাতে পিতৃদেব বলিলেন, “ইহাকে মাইল-ষ্টোন বলে। ইহাতে ইংরাজী-ভাষায় নম্বর লেখা আছে। এক মাইল (বাঙ্গালা অৰ্দ্ধ-ক্রোশ) অন্তর এক একটী এইরূপ পাথর পোঁতা আছে।” শ্য‌াখালা হইতে শালিকার ঘাট পর্যন্ত ঐ রূপ পাথরে ইংরাজী অঙ্ক দেখিয়া, অগ্রজ মহাশয় ইংরাজী এক সংখ্যা হইতে দশ পর্য্যন্ত চিনিলেন। কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় ও পিতৃদেব, মধ্যে জগদীশপুরে যে স্থানে মাইল-ষ্টোন ছিল, সেই স্থান দেখান নাই; ইহার কারণ, অক্ষর চিনিতে পারিয়াছেন কি না, জানিবার অভিপ্রায়ে উভয়ে যুক্তি করিয়াছিলেন। অগ্রজ বলিলেন, “ইহার পূর্ব্বে‌ তবে একটা পাথর আমরা দেখিতে বিস্মৃত হইয়াছি।” তখন কালীকান্ত বলিলেন, “ঈশ্বর! তোমাকে ঠকাইবার জন্য আমরা এরূপ করিয়াছি। তুমি যে বলিতে পারিলে, তাহাতে আমরা পরম আহ্লা‌দিত হইলাম।” শ্য‌াখালা গ্রাম হইতে শালিকার গঙ্গার ঘাট দশ ক্রোশ। সন্ধ্যার সময় তথায় উপস্থিত হইলেন, এবং গঙ্গা পার হইয়া বড়বাজারের বাবু জগদ্দুর্লভ সিংহের বাটীতে উপস্থিত হইলেন। পরদিন প্রাতে পিতৃদেব, জগদ্দুর্লভ বাবুর এক ইংরাজী বিল ঠিক দিতেছিলেন; তথায় অগ্রজ মহাশয় বসিয়া বলিলেন, “বাবা, আমি ইহা ঠিক দিতে পারি। তাহা শুনিয়া উক্ত সিংহ মহাশয় বলিলেন, “ঈশ্বর! তুমি ইংরাজী অঙ্ক কেমন করিয়া জানিলে?” তাহাতে তিনি বলিলেন, “কেন, বাবা ও কালীকান্ত খুড়া শ্য‌াখালা হইতে শালিকার ঘাট পর্য্য‌ন্ত পাথরে অঙ্কিত মাইল-ষ্টোন দেখাইয়াছেন। তাহাতেই ইংরাজী অঙ্কের এক সংখ্যা হইতে ১০ সংখ্যা পর্য্য‌ন্ত শিখিয়াছি। সেই জন্য ঠিক দিতে পারিব সাহস করিয়াছি।” সিংহ মহাশয়, কয়েকটা বিল ঠিক দিবার জন্য দাদাকে দিলেন। ঐ বিলে দাদার ঠিক দেওয়া নির্ভু‌ল হইয়াছে দেখিয়া, কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায় তাঁহাকে ক্রোড়ে করিয়া মুখচুম্বনপূর্ব্ব‌ক বলিলেন, “তুমি চিরজীবী হও, আমি যে তোমার প্রতি আন্তরিক যত্নের সহিত পরিশ্রম করিয়াছি, তাঁহা অদ্য আমার সার্থক হইল।” উপস্থিত সকলে বলিলেন, “বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়! আপনার এই বুদ্ধিমান পুত্রটিকে ভালরূপ লেখাপড়া শিক্ষা দেওয়া আবশ্যক।” তাহাতে পিতৃদেব বলিলেন, “ইহাকে হিন্দু কলেজে পড়িতে দিব মনে মনে স্থির করিয়াছি।” তাহা শুনিয়া, উপস্থিত সকলে বলিলেন, “আপনি মাসিক ১০৲ টাকা বেতন পাইয়া থাকেন, তাহাতে হিন্দু কলেজে কেমন করিয়া অধ্যয়ন করাইবেন?” এই কথা শুনিয়া, তিনি তাঁহাদিগকে উত্তর করিলেন, “ছেলের কলেজের মাসিক বেতন ৫৲ টাকা দিব, আর বাটীর খরচ ৫৲ টাকা পাঠাইব।” ইহা শুনিয়া কেহ কেহ বলিলেন, “চোরবাগানের ইংরাজী স্কুলে নিযুক্ত করিলে, সামান্য বেতন লাগিবে।” এই বিষয়ে মাসাবধি আন্দোলন চলিতে লাগিল। জগদ্দুর্লভ সিংহের ভগিনী রাইমণি দাসী ও তাঁহার পরিবারগণ জ্যেষ্ঠাগ্রজ মহাশয়কে অতি শিশু দেখিয়া, অত্যন্ত ভাল বাসিতেন। পিতৃদেব চাকরি উপলক্ষে প্রাতঃকাল হইতে বেলা নয়টা পর্য্যন্ত কার্য্য সমাধা করিয়া বাসায় আসিয়া, পাকাদিকার্য্য সম্পন্ন করিয়া, উভয়ে ভোজন করিতেন। আফিস হইতে বাসায় আসিয়া রাত্রি দশটার সময় পুনর্ব্বা‌র পাকাদিকার্য্য সমাধা করিয়া, উভয়ে নিদ্রা যাইতেন। প্রাতঃকাল হইলে অষ্টমবর্ষীয় বালক অগ্রজ মহাশয়, প্রায় সমস্ত দিন ঐ দয়াময়ী স্ত্রীলোকদ্বয়ের দয়ার উপর নির্ভর করিয়া, বিদেশে অবস্থিতি করিতেন। তাঁহারা স্নেহপূর্বক খাবার দিতেন ও কথাবার্ত্তায় ভুলাইয়া রাখিতেন। দাদা যখন জননী প্রভৃতির জন্য ভাবনা করিতেন, তখন ঐ স্ত্রীলোকদ্বয়, ভুলাইয়া ও কত প্রকার গল্প করিয়া সান্ত্ব‌না করিতেন এবং দেশের জন্য বা জননীর জন্য ভাবিতে দিতেন না। উক্ত রাইমণি দাসী ও জগদ্দুর্লভ সিংহের পত্নীর দয়াগুণেই শৈশবকালে অগ্রজ মহাশয় বিস্তর উপকার পাইয়াছিলেন। তাঁহারা এরূপ দয়াদাক্ষিণ্য প্রকাশ না করিলে, দাদা কলিকাতায় অবস্থিতি করিতে পারিতেন না। অদ্যাপি ঐ দয়াময়ীদের নাম স্মরণ হইলে, দাদার চক্ষে জল আসিত।

 জগদ্দুর্লভ বাবুর বাটীর সন্নিহিত বাবু শিবচন্দ্র মল্লিকের বাটীতে এক পাঠশালা ছিল। তথায় রামলোচন সরকারের নিকট শিক্ষা করিবার জন্য দাদাকে নিযুক্ত করেন। কার্ত্তিক, অগ্রহায়ণ দুই মাস কাল তাঁহার নিকট লেখাপড়া শিক্ষা করেন। দাদা প্রত্যহ পিতৃদেবকে বলিতেন, “বীরসিংহায় কালীকান্ত খুড়ার পাঠশালে যেরূপ উপদেশ ও শিক্ষা পাইয়াছি, তদপেক্ষা ইহাঁর নিকট অতিরিক্ত কিছুই শিক্ষা করিবার আশা নাই। এই পাঠশালে যাইয়া কেবল বসিয়া থাকিতে হয়। এখানে সরকার মহাশয় আমায় নূতন কিছুই শিখান নাই, যাহা দেশে শিখিয়াছি, এখানেও সেই সেই বিষয় বলিয়া দিয়া থাকেন। অতএব যাঁহার নিকট নূতন বিষয় শিখিতে পারি, আমাকে সেইরূপ গুরুমহাশয়ের নিকট নিযুক্ত করুন, নচেৎ বিদেশে থাকিবার আবশ্যক কি?” ইহার কয়েক দিন পরে, অগ্রজ মহাশয় উদরাময়ে আক্রান্ত হইয়া, সর্ব্বদা অসাবধান হইয়া শয্যায় মলমূত্র ত্যাগ করিতে লাগিলেন। অন্য কেহ অভিভাবক না থাকায়, পিতৃদেবকেই ঐ বিষ্ঠা স্বহস্তে পরিষ্কার করিতে হইত। এক এক দিন এরূপ হইত যে, সিঁড়িতে মলত্যাগ করিলে, সমস্ত সিঁড়িতে তরল মল গড়াইয়া পড়িত। পিতৃদেব স্বহস্তে ঐ বিষ্ঠা পরিষ্কার করিতেন। ত্ব‌ৎকালে যদিও অগ্রজ মহাশয় বালক ছিলেন, তথাপি মনে করিতেন যে, বাবা এত কেন করেন। কয়েক দিন পরে পিতামহী, পৌত্রের এরূপ পীড়ার সংবাদ পাইয়া, অনতিবিলম্বে কলিকাতায় যাইয়া, তথা হইতে পৌত্রকে দেশে আনয়ন করিলেন। দেশে তিন চারি মাস অবস্থিতি করিয়া, রোগ হইতে মুক্ত হইলেন। পুনর্ব্বা‌র জ্যৈষ্ঠমাসে পিতৃদেব দেশে আসিয়া, দাদাকে সমভিব্যাহারে লইয়া কলিকাতা যাত্রা করিলেন। ঐ সময় অগ্রজকে পিতৃদেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন ঈশ্বর! এবার বরাবর বাট হইতে কলিকাতায় চলিয়া যাইতে পরিবে কি না? যদি চলিতে না পার, তাহা হইলে একজন লোক সঙ্গে লইব। সে মধ্যে মধ্যে তোমাকে কোলে করিবে।” তাহাতে দাদা উত্তর করিলেন যে, “এবার চলিয়া যাইতে পারিব; সঙ্গে লোক লইবার আবশ্যক নাই।” পরদিন রবিবার প্রাতে ভোজনান্তে পিতার সহিত ছয় ক্রোশ পথ গমন করিয়া, পাতুলগ্রামে রাধামোহন বিদ্যাভুষণের ভবনে অবস্থিতি করিলেন। তৎপরদিবস তথা হইতে প্রায় আট ক্রোশ অন্তরস্থিত তারকেশ্বরের সন্নিহিত রামনগর গ্রামে কনিষ্ঠা পিতৃঘসার বাটী যাত্রা করিলেন। রাজবলহাটের দোকানে উপস্থিত হইয়া উভয়ে ফলাহার করিলেন। তথা হইতে উঠিবার সময় দাদা বলিলেন, “বাবা, আমি আর চলিতে পারিব না।” পিতা কতই বুঝাইলেন; তাহাতে দাদা বলিলেন, “দেখুন পা ফুলিয়া গিয়াছে; আর পা ফেলিতে পারিব না।” পিতা বলিলেন, “খানিক চল, আগে যাইয়া তরমুজ কিনিয়া দিব”; এই বলিয়া ভুলাইতে আরম্ভ করিলেন, কিন্তু তিনি কিছুতেই এক পাও চলিলেন না। পিতৃদেব বলিলেন, “যদি চলিতে না পরিবে, তবে লোক সঙ্গে লইতে কেন নিবারণ করিলে?” এই বলিয়া প্রহার করিলেন। প্রহার খাইয়া দাদা রোদন করিতে লাগিলেন। “তবে তুই এখানে থাক্‌, আমি চলিলাম,” এই বলিয়া পিতা কিয়দ্দ‌ূর যাইয়া দেখিলেন, দাদা সেই স্থানেই বসিয়া আছেন, এক পাও চলেন নাই; কি করেন অগত্যা ফিরিয়া আসিয়া দাদাকে স্কন্ধে লইয়া চলিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে বলিলেন, “এবার খানিক চল, আগের দোকানে তরমুজ কিনিয়া দিব।” পিতৃদেব অতি খর্ব্বকায় ও ক্ষীণজীবী ছিলেন; সুতরাং অষ্টমবর্ষীয় বালককে স্কন্ধে করিয়া অধিক দূর গমন করা সহজ ব্যাপার নহে; একারণ কিয়দ্দূর যাইয়া স্কন্ধ হইতে নামাইলেন। তথায় তরমুজ খাওয়াইলেও চলিতে অসমর্থ হইলেন। সুতরাং পিতা কখন কাঁধে, কখন ক্রোড়ে করিয়া চলিলেন। অনন্তর তাহারা সন্ধ্যার সময় রামনগরের রামতারক মুখোপাধ্যায়ের বাটীতে উপস্থিত হইলেন। দাদার পদদ্বয়ের বেদন ভাল হইবার জন্য পিতৃষ্ব‌সা অন্নপূর্ণা দেবী উষ্ণ তৈল দিয়া, পদদ্বয় মর্দ্দ‌ন করিয়া দিলেন। পরদিন তথায় অবস্থিতি করিলেন। একদিবস তথায় থাকায়, পায়ের বেদনার হ্রাস হইল। সুতরাং অক্লেশে পরদিন বৈাস্তবাটীর পথে গমন করিলেন, এবং তথা হইতে নৌকারোহণে সন্ধ্যার সময় কলিকাতায় বড়বাজারের বাসায় উপস্থিত হইলেন।

 কয়েকদিন পরে পিতা স্থির করিলেন যে, আমাদের বংশের পূর্ব-পুরুষগণ সকলেই সংস্কৃত অধ্যয়ন করিয়া বিদ্যা‌দান করিয়াছেন; কেবল আমাকে দুর্ভাগ্য-প্রযুক্ত বাল্যকাল হইতে সংসার-প্রতিপালন-জন্য আশু অর্থকরী ইংরাজী বিদ্যা শিক্ষা করিতে হইয়াছে। ঈশ্বর সংস্কৃত অধ্যয়ন করিলে, দেশে টোল করিয়া দিব। জগদ্দুর্ল্ল‌ভ সিংহের বাটীতে অনেক পণ্ডিত বাৰ্ষিক আদায় করিতে আসিতেন; তন্মধ্যে পটলডাঙ্গাস্থ গবর্ণমেণ্ট সংস্কৃত-কলেজের ব্যাকরণের ৩য় শ্রেণীর পণ্ডিত গঙ্গাধর তর্কবাগীশ মহাশয়ের সহিত পিতৃদেবের আলাপ ছিল। তাঁহাকে পরামর্শ জিজ্ঞাসায় তিনি উপদেশ দিলেন যে, কলেজে প্রবিষ্ট করিয়া দিলে ৫/৬ মাস পরে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলে, আপাততঃ মাসে মাসে ৫৲ টাকা বৃত্তি পাইবে, দেশের টোলে পড়িতে দিলে সংক্ষিপ্তসার অধ্যয়ন করিতে দীর্ঘকাল লাগিবে। কলেজে মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ অধ্যয়ন করিয়া, তিন বৎসরের মধ্যে ব্যাকরণে বুৎপত্তি জন্মিলে, কাব্যের শ্রেণীতে প্রবিষ্ট হইতে পরিবে। দ্বিতীয়তঃ তৎকালে পাতুলগ্রামনিবাসী রাধামোহন বিদ্যাভূষণের পিতৃব্যপুত্র মধুসূদন বাচস্পতি, সংস্কৃত-কলেজে অধ্যয়ন করিতেন এবং বৃত্তি পাইতেন। পিতৃদেব উক্ত বাচস্পতিকে পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিলে, তিনিও পরামর্শ দেন যে, ঈশ্বরকে সংস্কৃত-কলেজে ভর্ত্তি করিয়া দাও। পিতৃদেব তাঁহাদের উপদেশের অনুবর্ত্তী হইয়া, দাদাকে ইংরাজী বিদ্যালয়ে নিযুক্ত না করিয়া, সংস্কৃত-কলেজেই প্রবেশ করাইয়া দেওয়া সর্ব্ব‌তোভাবে শ্রেয়োজ্ঞান করিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *