শিশিরকুমারের স্মৃতি-২
গত বছর আমার পুরনো জার্নালের পাতা থেকে শিশিরকুমার ভাদুড়ি সম্পর্কে উদ্ধার করে প্রকাশ করেছিলাম। এই জার্নাল লেখা হয়েছিল প্রায় পনেরো বছর আগে। তখনও শিশিরকুমার জীবিত। এই লেখা প্রকাশিত হওয়ার পরে আমি বহুজনের কাছ থেকে অনুরুদ্ধ হয়েছিলাম শিশিরকুমার সম্বন্ধে ওই স্মৃতিচারণার আরও কিছু অংশ সাধারণ্যে প্রকাশ করার জন্য। সেই উদ্দেশ্যেই এই লেখার আরও খানিকটা প্রকাশ করছি। বাংলা রঙ্গালয়ের শতবর্ষ পূর্তিতে এই ধরনের আলোচনার কিছু স্থান থাকতে পারে বলেও মনে হয়।
শিশিরবাবুকে কংগ্রেস যে সংবর্ধনা দিয়েছিল সেটার কথা মনে পড়ছে। আমি পরে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, ‘কংগ্রেসের সংবর্ধনায় হঠাৎ যে গেলেন?’ বললেন, ‘সতীশ (ঘোষ) চিঠি লিখে বলেছিল please don’t say no. এতদিনের বন্ধু না বলতে পারিনি।’ বিরাট প্যান্ডেল— প্রায় হাজার পাঁচেক লোক। অহীনবাবু ছিলেন সভাপতি। ভাষণ দিতে উঠে বলেছিলেন— ‘যাঁরা ইতিহাস জানেন তাঁরা সাল তারিখ দিয়ে বলতে পারবেন আচার্য শিশিরকুমার কবে প্রথম বঙ্গ রঙ্গমঞ্চে অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু যাঁরা সেদিন উপস্থিত ছিলেন তাঁরা সেই আবির্ভাবের— হ্যাঁ আবির্ভাবই বলব— সেই আবির্ভারের গুরুত্ব অনুভব করতে পেরেছিলেন।… আচার্য শিশিরকুমার রঙ্গমঞ্চের পিতা— আমি অবশ্য আমাদের সময়কার রঙ্গমঞ্চের কথা বলছি— এ যুগের বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের তিনি পিতামহ।’ ভাষণের শেষে পা জড়িয়ে ধরেছিলেন থিয়েটারের আবেগপ্রবণ দৃশ্যের সাদৃশ্যে। অহীনবাবুর সেদিনের বক্তৃতা ও ইদানীং-এর লেখাগুলোর মিল পাই না। সেদিন সংবর্ধনার উত্তর দিতে উঠলেন শিশিরকুমার। ভাবাবেগে তিলমাত্র বিচলিত না। বলেছিলেন, ‘আজ এখানে যে সম্মান দেওয়া হল— তা একটি দলের দেওয়া সম্মান। সেই দল রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। কিন্তু দলের বদল হয়— রাষ্ট্রের বদল হয় না। অতএব এ সম্মান দলের বলেই গ্রহণ করলাম— জাতির বলে নয়। আর তিরিশ বছর ধরে নাট্যশালার সেবা করে এসেছি বলেই তো এই সম্মান— অতএব আমাকে সম্মানিত করে নাট্যশালাকে সম্মানিত করা হল। নাট্যশালাকে সম্মান দিয়ে এই দল নিজেকেই সম্মানিত করল।’
সত্যি জাতি হিসেবে আমরা শিশিরকুমারকে কতখানি সম্মান দিয়েছি? দেনার দায়ে শ্রীরঙ্গম উঠে গেছে। মূর্খ ও অর্ধশিক্ষিতদের অপবাদ ও নিন্দাবাদে তিনি অভিষিক্ত হয়েছেন। কত কম লেখা হয়েছে তাঁর ওপর অথচ তাঁর মৃত্যু হলে কতবড় ইতিহাসের অপমৃত্যু হবে।
শিশিরকুমারের আবির্ভাবকে বুঝতেন রবীন্দ্রনাথ। মৃত্যুর আগে শেষ যখন দেখা হয় তখন বলেছিলেন, ‘শিশির আমার বইগুলো তুমি অন্তত একবার কোরো। অন্তত ওই রক্তকরবী— মুক্তধারা।’ শিশিরবাবু দুঃখ করতেন সেগুলো করা হল না বলে। রক্তকরবী করার জন্য একসময় প্রায় সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ হয়েছিল শিশিরকুমারের থিয়েটারে। কিন্তু নন্দিনী পছন্দ হয় না রবীন্দ্রনাথের। প্রভাদেবী এবং আরও যাঁরা ছিলেন সবাই মোটা হয়ে গেছেন তখন। রবীন্দ্রনাথ কেবলই বলেন, মোটা মেয়ে দিয়ে আমার নন্দিনী হবে না। হঠাৎ কী মনে হল বিশ্বনাথ ভাদুড়িকে ধরলেন। বলেন, ‘এই তো, একে দিয়ে চমৎকার নন্দিনী হয়।’ শিশিরবাবু যত বলেন— ‘সে কী করে হয়— বাংলা পেশাদার থিয়েটারে ওটা চলে না।’ রবীন্দ্রনাথ তত বলেন, ‘কেন হবে না? শেক্সপিয়রের যুগে তো হত, বার্বেজ-এর সময় হত। ইতিহাস টেনে আনলেন রবীন্দ্রনাথ— দেশ-বিদেশের নাট্যাভিনয়ের আলোচনা করে দেখাতে লাগলেন স্ত্রী-ভূমিকা স্ত্রীলোক দিয়েই করাতে হবে— এ ধারণাটা স্থূল। রঙ্গমঞ্চ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ে… ‘বাগানকে যে অবিকল বাগান আঁকিয়াই খাড়া করিতে হইবে এবং স্ত্রী চরিত্র অকৃত্রিম স্ত্রীলোককে দিয়াই অভিনয় করাইতে হইবে এইরূপ অত্যন্ত স্থূল বিলাতি বর্বরতা পরিহার করিবার সময় আসিয়াছে।’
যাই হোক, বাংলাদেশের পেশাদার রঙ্গমঞ্চে ওই ব্যাপারটা সম্ভব ছিল না। তাই সে যাত্রা নন্দিনীর সমস্যা মিটল না। শিশিরকুমার তখন মাঝে মাঝে রক্তকরবী পরিকল্পনা করতেন। লাল আলো অনেকটা ব্যবহারের ইচ্ছা ছিল— আর রক্তকরবীর কোনও একটা সাজেশন রাখার ইচ্ছে ছিল সেট-এ। রাজার ভূমিকায় অভিনয় করতেন নিজে, যদি শেষ পর্যন্ত মঞ্চস্থ হত। আর মুক্তধারায় রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন উনি ধনঞ্জয় বৈরাগী করেন। তাতে শিশিরবাবু বলেছিলেন, ‘গুরুদেব আমি তো গান জানি না, গাইব কী করে?’ রবীন্দ্রনাথ শিশিরকুমারকে উত্তর দিয়েছিলেন— ‘তুমি যদি আমার ধনঞ্জয় করো— তাহলে গাইতে হবে না— তুমি আবৃত্তি করে বলে দিও, তাহলেই হবে। দরকারে হয়ত একটু-আধটু বদলে নিও।’
এই প্রয়োজনমতো পরিবর্তনের স্বাধীনতা রবীন্দ্রনাথ শিশিরকুমারকে দিয়েছেন প্রচুর। শিশিরকুমার বলতেন, ‘শরৎদার (শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়) এ সব বিষয়ে বাছবিচার ছিল খুব বেশি— কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অত্যন্ত উদার।’ ‘সীতা’ দেখার পর থেকেই রবীন্দ্রনাথ বলতেন— ‘ও নাটকটি নাটকই নয়— তোমায় আমি নাটক লিখে দেব।’ সেইমতো চিরকুমার সভা নাকি প্রথমে শিশিরবাবুর জন্যেই তিনি লিখেছিলেন। ইতিমধ্যেই, রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ হয়েছিলেন। শিশিরবাবুও যোগাযোগ করেননি রোগশয্যায়। ফোন করেছেন, শুনেছেন কবি অসুস্থ। এবং এই সময়েই আর্ট থিয়েটার নাটক চেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দিয়েছেন। পরে অভিনয় দেখে তাঁর ভাল লেগেছিল এমন কথা চালু আছে। অহীনবাবুর চন্দ্রবাবু আমি দেখেছি। ওরকম অভিনয় কেন রুচিশীল লোকের ভাল লাগে না। যাই হোক, পরে শিশিরবাবুকে ডেকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে, ‘শিশির তুমি আগে কেন এলে না— তুমি আমার নাটক করো।’ রবীন্দ্রনাথ এবার দিলেন ‘গোড়ায় গলদ’। শিশিরবাবু বললেন কিছুদিন পরে যে, অমুক অমুক জায়গায় বদলাতে হবে। রবীন্দ্রনাথ সমস্ত রাত্তির জেগে বদল করলেন। পরের দিন সকালে পাণ্ডুলিপিখানি শিশিরবাবুর হাতে দিয়ে বললেন, ‘আমার এই শরীরে আর খাটতে পারব না। আর দরকার হলে তুমি বদলে নিও।’ তারপর শিশিরবাবু যখন উঠছেন তখন বললেন— ‘দেখি, দাও তো, নামটা বদলে দিই।’ শিশিরবাবু বললেন— ‘সে কি, আবার নাম বদলাবেন কেন— ওই নামে বিজ্ঞাপন হয়ে গেছে।’ রবীন্দ্রনাথ বললেন— ‘তা হোক, নাম দিলাম ”শেষরক্ষা”।’ একটু মুচকি হেসে বললেন— ‘গোড়ায় একটু গলদ ছিল— তা শেষরক্ষা তো হল।’
রবীন্দ্রনাথ প্রায়ই শিশিরবাবুকে বলতেন— ‘শিশির, তোমার ওসব কাজ নয়। পেশাদার থিয়েটার অন্য লোক চালাবে। তুমি একদল সেরা ছেলেমেয়ে নেবে— একটা আলাদা স্টেজ থাকবে— সেখানে তুমি এক্সপেরিমেন্ট করবে।’
একদল লোক আছে যারা বলে যে শিশিরকুমার কাউকে কিছু দিয়ে গেলেন না। কী উদ্ভট কথাটা। শিল্পবিদ্যা কাউকে দেওয়া যায় না। এটা কি সারা জীবন টাকা জমানোর মতো যে, শেষকালে টাকাটা দিয়ে গেলাম? যে শিল্পী হবে, শিল্প তাকে অর্জন করতে হবে। শিল্পের জাজিমে কেউ তাকে হাতে ধরে বসিয়ে দেবে না, এমনকি শিশিরকুমারও না। তাছাড়া গোটা বাংলা থিয়েটারটাই তো শিশিরকুমারের তৈরি করা। আর অভিনেতা? মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, যোগেশ চৌধুরি এঁরা বন্ধুস্থানীয় ছিলেন তাঁর— কিন্তু অভিনয় শিক্ষা তো শিশিরকুমারের কাছেই। প্রভাদেবীর মতন অভিনেত্রী, পৃথিবীতে বিরল, তিনিও তো শিশিরবাবুরই সৃষ্টি। বিশ্বনাথ ভাদুড়ি, শৈলেন চৌধুরি, কানু বন্দ্যোপাধ্যায় কত ভাল ভাল অভিনেতার নাম করব। শিশিরবাবুর অভিনয় দেখে প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে প্রভাবিত হননি এরকম অভিনেতা বাংলাদেশে নেই। অভিনয় কেমন করে করতে হবে এই ব্যাপারটা তিনি হয়ত হাতে ধরে সকলকে শেখাননি, কিন্তু অভিনয়ের এমন একটা আদর্শ তৈরি করেছেন যা সমস্ত বাংলা স্টেজ জ্ঞানে বা অজ্ঞানে অনুসরণ করেছে। আর প্রযোজনা করা ব্যাপারটা তো তাঁর। আগে নাট্যকলার সব বিভাগে নজর দিয়ে অভিনয় হত না। শিশিরবাবুই বাংলা রঙ্গমঞ্চের প্রথম প্রয়োগকর্তা। শিশিরকুমার নিজে কোনও বড় অভিনেতার কাছ থেকে প্রত্যক্ষ শিক্ষা পাননি। তবে কয়েকজনের অভিনয় দেখেই অভিনয় করতে শিখেছেন এ কথা স্বীকার করতেন। আধুনিক মঞ্চেরও অনেক রথী- মহারথীও শিশির ভাদুড়ির কাছ থেকেই অভিনয় শিখেছেন— কেউ দেখে— কেউ হাতে-কলমে কাজ করে— কেউ বা নকল করে। কিন্তু তাঁদের অনেকেই এত ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স-এ ভোগেন যে শিশির ভাদুড়িকে অস্বীকার করতে পারলে যেন বেঁচে যান।
একদিন শিশিরকুমারকে প্রশ্ন করেছিলাম— ‘আপনার পূর্বসূরি হিসেবে কাদের কথা মনে করেন?’ বললেন— ‘আমার অভিনয়ে বড় প্রভাব হল গিরিশবাবুর। তাছাড়া আরও অনেকে আছেন, যেমন অর্ধেন্দুশেখর, রবীন্দ্রনাথ। গিরিশবাবুকে যে আমি গুরু বলি তার কারণ এই নয় যে তিনি হাতে ধরে একটি লাইনও আমাকে শিখিয়েছেন। কারণ এই যে, তাঁর অভিনয় দেখে দেখেই আমি শিখেছি অভিনয় কাকে বলে।’ শিশিরবাবু নিয়মিত থিয়েটার দেখতেন— এবং ভাল ভাল অভিনেতার অভিনয় দেখা তাঁকে সাহায্য করেছিল।
তাঁর শিক্ষার মূলে আর একটি জিনিস ছিল। সেটা হল নির্ভরযোগ্য ভাল সমালোচকের সামনে অভিনয় করা। এ ছাড়া পার্সিভাল ইত্যাদির অধ্যাপনাও কাজ করেছিল। ছাত্রাবস্থায় প্রায় দশ বছর ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট শিশিরকুমার পেয়েছিলেন যথা ইচ্ছা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্যে। সেটাই তাঁর ওয়ার্কশপ পিরিয়ড। সেখানে গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, বিনয় সরকারের মতো লোকেরা যেভাবে অভিনয়ের সমালোচনা করতেন তা শিশিরবাবুকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। এসব কথা উনি প্রায়ই বলতেন। বলতেন, ভাল সমালোচনা ভাল অভিনয়ের পক্ষে অপরিহার্য।
গিরিশবাবুকে শিশিরকুমার গুরু বলে শ্রদ্ধা করলেও ভারতবর্ষের সব থেকে বড় অভিনেতা বলতেন অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফিকে। বলতেন, ‘পৃথিবীর সব জায়গায় অভিনয় দেখিনি— যত জায়গায় দেখেছি, never seen an actor who could change his voice— অর্ধেন্দুশেখর পারতেন। একই নাটকে দুটো চরিত্র বিভিন্ন গলার করতেন। ‘প্রতাপাদিত্য’ নাটকে বিক্রমাদিত্য আর রডা একই সঙ্গে করতেন— দুটো আলাদা মানুষ— হাঁটাচলা, এমনকি কণ্ঠস্বর অবধি আলাদা। গুণ ছিল যে কোনও পার্ট করতেন তাইতে ডুবে যেতে পারতেন। আর অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল অভিনয়। গিরিশবাবুর যেন সমস্ত পার্ট মানাত না।’ প্রশ্ন করেছি রবীন্দ্রনাথের অভিনয় কেমন ছিল? বলেছেন— ‘He was a great actor— no doubt a great actor— কিন্তু লিমিটেশনস ছিল। দেহকে গোপন করতে জানতেন না। তাছাড়া যখনই কোনও মহৎ ইমোশনের প্রকাশ থাকত চরিত্রের মধ্যে তখনই সেই ফাঁক দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বেরিয়ে পড়তেন। অত বড় জিনিয়াসের পক্ষে আত্মগোপন করা শক্ত ছিল।’ আমি বলেছিলাম, ‘কবির ব্যক্তিত্ব— সাবজেকটিভ— অভিনেতার অবজেকটিভিটি বোধহয় ছাপিয়ে যেত।’ বলতেন— ‘তাই হবে! আর একটা কথা। উনি আর কারও নাটকে কখনও অভিনয় করেননি— এটাও একটা লিমিটেশন। কেননা, অন্য ধরনের পার্টে কীরকম সাকসেসফুল হতেন বলা শক্ত।’ প্রথম প্রশ্ন করলাম— ‘চেহারা কেমন ছিল?’ বললেন— ‘অপূর্ব। ওইতেই Half the show was done। অপূর্ব স্বাস্থ্য। আর সব থেকে সুন্দর ছিল মুখ— টেরিবলি এক্সপ্রেসিভ।’ জিজ্ঞেস করলাম— ‘গলা?’ উত্তর দিলেন, ‘বিউটিফুল— অমন গলার মোচড়, যাকে বলে মডুলেশন সে গিরিশবাবু ছাড়া আর কারও শুনিনি। তবে খুব সরু হাইপিচড গলা— আর যৌবনে সুরেলা অভিনয় করতেন— পরে সে দোষ কেটে যায়।’
অবনীন্দ্রনাথকে শিশিরবাবু অভিনেতা হিসেবে আরও বড় মনে করতেন। অবনীন্দ্রনাথের ওই অর্ধেন্দুশেখরের মতো গুণ ছিল— যে কোনও চরিত্রকে রূপ দিতে পারতেন। Give him any part and he will do it। ঠাকুরবাড়ির আর একজন ভাল অভিনেতা দীনেন্দ্রনাথ। আমার বিশেষ বন্ধু ছিলেন। দীনুদা বলে ডাকতাম। তপতীর সময় সমস্ত গান শিখিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গান আমার স্টেজে থাকলে উনিই শেখাতেন। আগে কত বলেছি, ‘কেন বিশ্বভারতীতে পড়ে আছেন— চলে আসুন আমার স্টেজে।’ তখন আসেননি। বলতেন— ‘যত অসুবিধেই হোক সূর্যের কাছাকাছি আছি।’ পরে বিশ্বভারতীর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু তখন আমার থিয়েটারের এমন অবস্থা নয় যে দীনুদাকে রাখতে পারি। এইখানে একটু ক্ষোভের সঙ্গে বলেন— ‘কিন্তু এই সকল গানের ভাণ্ডারী সকল সুরের কাণ্ডারীকে রবীন্দ্রনাথ জীর্ণ বসনের মতো পরিত্যাগ করেছিলেন।’
শিশিরবাবু একদিন যোগেশের সম্পর্কে বলেছিলেন। যে দৃশ্যটিতে যোগেশ পরিবারের সকলকে প্রশ্ন করে বেনামি করার বিষয়ে— এবং সকলে যোগেশের সম্মানের চেয়ে টাকা উদ্ধারটাই বড় করে দেখে তখন উনি কী ধরনের অভিনয় করেন সেইটে বোঝাচ্ছিলেন। বললেন— ‘ব্যাঙ্ক ফেল হল বলে মদ খেতে আরম্ভ করল এটাকে গুরুত্ব দিলে ট্রাজিক ডিগনিটিই থাকে না— তাই ওই সিনটা আমি দ্রুত শেষ করি। বরং এই দৃশ্যটার যে অভিমান, সেটার ভেতরে মধ্যবিত্ত পরিবারের, একান্নবর্তী পরিবারের ছবিটা আছে— অধঃপতনে যাওয়ার ট্রাজিক হওয়ার পয়েন্ট যোগেশের এইখানটায় সব থেকে বেশি। ওই যে একটা অভিমান কেউ তাকে বুঝল না, সংসারে তার মূল্য পেলে না— এ এক নিদারুণ অভিমান।’
শিশিরকুমারের সঙ্গে তাঁর পরিবারের সম্পর্কটা কী, খুব জানতে ইচ্ছে করত। শিশিরবাবু বড় চাপা। নিজের কথা একেবারেই বলতে চান না। অনেক সময় আমাকে বলেছেন অনেক কথা— কিন্তু বলেই বলেছেন this is strictly between you and me। আমারও ইচ্ছে করে না বলতে। তাছাড়া সব থেকে বড় পরিচয় তো রয়েইছে— তাঁর অভিনয়। চরিত্রটি কেন করছেন— কোন অ্যাসপেক্টটিতে এমফসিস দিচ্ছেন— সেইগুলো ভাবলেই শিশিরকুমারের ব্যক্তিত্বের খানিকটা ইশারা হয়ত পাওয়া যেতে পারে। সেদিন যেমন হাসতে হাসতে একটা কথা বললেন। আগের দিন বেলেঘাটায় ‘মাইকেল মধুসূদন’ অভিনয় ছিল। পরের দিন গিয়েছি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘মাইকেল কেমন হল?’ বললেন, ‘অভিনয় খুব জমেছিল— ভেরি সাকসেসফুল প্লে।’ তারপর গালভরা হাসির সঙ্গে বললেন, ‘আরে বাপু কেন হবে না। Take away the Michael from that play Michael Madhusudan, and that is Sisir Kumar Bhaduri। নিজের জীবনের যত দুঃখ যত খেদ সব মাইকেলের মুখ দিয়ে বলেছি।’ যে কথাটা অসংখ্যবার মনে মনে ভেবেছি সেই কথাটা যে এত অসঙ্কোচে এমন নির্মম হাসির সঙ্গে উনি বলতে পারেন ভাবিনি।
আসলে সমস্ত অভিনয়েই মানুষ নিজেকে সাবলিমেট করে হয়ত। ‘সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল’— এ কথার যে বেদনা তা শুধু যোগেশের পার্টিকুলার নয়। জীবনের যত অচরিতার্থতার বেদনা সব যেন ওই লাইনটিতে এসে জড়ো হয়।
যোগেশ নিয়ে শিশিরকুমারের সঙ্গে যে কত গল্প হয়েছে তার ঠিক নেই। একদিন শিশিরকুমার যোগেশ সম্পর্কে তাঁর ব্যাখ্যা করছিলেন। অপরেশবাবু ‘রঙ্গালয়ে ত্রিশ বৎসর’ বইটাতে গিরিশবাবুর যোগেশ অভিনয়ের একটা ব্যাখ্যা করেছেন। সেটা পড়ে মনে হয়েছিল শিশিরবাবুর যোগেশ অনেকটা গিরিশবাবুর ধারণায় গড়ে উঠেছে। গিরিশবাবুর যোগেশের খানকয়েক ছবি দেখেও একথা মনে উঁকি দিত। শিশিরবাবুর ব্যাখ্যা শুনে একথা আরও মনে হল। ওঁকে বলতে উনি বললেন— ‘হ্যাঁ সেই ব্যাখ্যাই আমার অনেক দিক থেকে ঠিক মনে হয়। আর ”রঙ্গালয়ে ত্রিশ বৎসর” বইটা খুব ভাল। নাট্য-সাংবাদিকতা ওইরকমই হওয়া উচিত।’ বইটা নিয়ে কথা হতে হতে বললাম, ‘প্রথম যোগেশ তো অমৃত মিত্র।’
—’হ্যাঁ, তারপর আরও কয়েকজন করেন— তারপর গিরিশবাবু—’
—’আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন— অমৃতবাবুর পরেই গিরিশবাবু। মাঝখানে আর কেউ করেননি।’ কথাটা বলেই ভয় লাগল। এরকম শুধরে দেওয়াটায় হয়ত অভ্যস্ত নন। শান্ত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইলেন। তখন পুরো গল্পটা বললাম। মিনার্ভায় গিরিশবাবু যোগ দিয়েছেন। নব পর্যায়ে ‘প্রফুল্ল’ হবে। তাই দেখে স্টারও দিল ‘প্রফুল্ল’। তার আগেই স্টারে ‘প্রফুল্ল’ শিখিয়ে এসেছেন গিরিশবাবু। যোগেশ অমৃত মিত্র। এখানে ট্রাজেডিয়ান মহেন্দ্রলাল (বসু)-কে যোগেশ শেখাচ্ছিলেন। একদিন রিহার্সালে মহেন্দ্রলাল বললেন— ‘দেখুন আপনি যেমনটি শেখাচ্ছেন সব পারছি। কিন্তু ওই যে সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল— ও আপনি যেমন বলছেন আমার কিছুতেই হচ্ছে না। বুড়ো বয়সে কি অমৃতের কাছে হেরে যাব? আপনার পার্ট আপনিই করুন।’ তখন বাধ্য হয়ে গিরিশবাবু করলেন। শিশিরবাবু এতক্ষণ শুনছিলেন, এবারে লাফিয়ে উঠলেন— ‘বলবে না? ওই সাজানো বাগান যে শুনেছে সেই বলবে। এই আমি প্রত্যেকবার বলি— আর ভাবি আর বলব না, ছেড়ে দেব।’ চুপ করে গেলেন আবেগে। আমি স্তম্ভিত। বললাম— ‘আপনি দেখেছেন যোগেশ?’ বললেন— ‘একবার? অন্তত দশবার। ওঃ— সে কী ওয়ান্ডারফুল অভিনয় সৌমিত্র, যে না দেখেছে সে ভাবতেও পারবে না। কী কণ্ঠস্বর! ওই ওঁর এক বিরাট অ্যাডভানটেজ ছিল। ওরকম গলা কখনও শুনিনি’। আমার কাছে শিশিরকুমারের যোগেশ বিস্ময়। মনে হয় মানুষে এরকম অভিনয় করে কী করে! সেই শিশিরকুমার গিরিশবাবুর যোগেশ বলতে উচ্ছ্বাস করছেন। গিরিশবাবুর অভিনয় সম্পর্কে শিশিরবাবু আর কটা কথা বলেছিলেন যা গভীরভাবে মনে আছে, কারণ শিশিরবাবুর অভিনয় দেখতে দেখতে চিরকাল ওই কথাটাই মনে হত। বলেছিলেন— ‘অর্ধেন্দুশেখর অভিনেতা হিসেবে অতুলনীয় ছিলেন, কিন্তু শিল্পী হিসেবে গিরিশবাবু মাঝে মাঝে যেন স্টেজের সঙ্গে অন্য জগতের একটা যোগস্থাপন করে ফেলতেন। তখন আর তা যেন অভিনয় থাকত না।’ একমাত্র শিশিরকুমারের থিয়েটার থেকে ফিরেই মনে হত একটা স্পিরিচুয়্যাল এক্সপিরিয়েন্স হল। অভিনয় কেমন করে তার সীমাকে অতিক্রম করে— কেমন করে sublime হয়ে যায় শিশিরকুমারের অভিনয় দেখেই বুঝেছি। আবেগগুলো নিয়ে যেমন খুশি মথিত করেছেন দেখেছি সমস্ত আবেগ জমাট বেঁধে গেছে।
শুধুমাত্র শিশিরকুমার দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে এপিক রচনা চলতে পারে। সেকথা শিশিরবাবুকে কোনওদিন মুখ ফুটে বলা যায়নি। ইচ্ছে হলেও কোনওদিন ওঁকে বলতে পারিনি যে, ‘আপনি পৃথিবীর একটি মহত্তম সৃষ্টি থেকে বঞ্চিত— কারণ আপনি শিশিরকুমারের অভিনয় দেখেননি।’ শুধু ওঁর মুখ থেকে শুনেছি গিরিশবাবুকে কেমন দেখেছেন উনি, কেমন দেখেছেন রবীন্দ্রনাথকে, অর্ধেন্দুশেখরকে, অবনীন্দ্রনাথকে। বোধহয় দ্য ভিঞ্চির কথাটাই সত্যি—
The Sun has never seen its shadow!