শিল-কটাও

শিল-কটাও

‘শিইল কটাও শিইল কটাও’ ডাক দিতে দিতে খর চৈত্রের দুপুরে কেউ হেঁটে যাচ্ছে। আর পিছন পিছন দৌড়ে গিয়ে তাকে ডাকছে এক বালিকা। না, বালিকা নয় তো! কিশোরী। কই কিশোরী কোথায়, সে তো পূর্ণ যুবতী! যুবতী? মনে তো হচ্ছে চুলে পাক ধরা এক প্রৌঢ়া। সে যেই হোক, বালিকা, কিশোরী, যুবতী কিংবা প্রৌঢ়া তার তো ওই শিলকাটাইওয়ালার সঙ্গে দরকার আছে।

ও শিলকাটাইওয়ালা, শিল কাটতে কত নেবে?

শিলকাটাইওয়ালা তার ঘাড়ের ওপর লম্বালম্বি ফেলে রাখা গামছাটা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলে, খুকু তুমি আমাকে পাঁচসিকে দিয়ো, তা হলেই হবে।

সে বলে, না গো আমি ক্লাস টেনে পড়ি। আমাকে কি আর খুকু বলা যায়?

শিলকাটাইওয়ালা বলে, ও মা, তাই তো! আমি খেয়ালই করিনি। বেশ দু’টাকা দিয়ে আমাকে। কিন্তু দু’টাকা দেওয়ার জন্য সে যখন নিজের হাতটা সামনে বাড়ায়, শিলকাটাইওয়ালা অবাক হয়ে বলে, এ কী তোমার হাতে শাঁখা-পলা। তুমি বললানি তো তোমার বিয়ে হয়ে গেছে!

সে লাজুক হেসে বলে, বলিনি বুঝি! আমার বর কিন্তু খুব ভাল জানো তো। তুমি চাইলে তোমাকে আরও টাকা দেবে।

শিলকাটাইওয়ালা বলে, বেশ তবে পাঁচ টাকাই দিয়ে আমাকে। আমার জেনানার তবিয়ত ভাল নেই। দাওয়াই খরিদ করব।

সে বলে, সে কোরো। কিন্তু আমার কাজটা তাড়াতাড়ি করে দাও। আমার ক্লাস আছে।

শিলকাটাইওয়ালা অবাক চোখে তাকায় তার পিছন পিছন দৌড়ে আসা খুকুর দিকে। দেখে, খুকুর চোখে চশমা, কপালের বাঁ দিকে চুলগুলো সব পাকা। মুখ নামিয়ে নেয় আবার। বিড়বিড় করে বলে, তা হলে মাইজি পনেরো টাকাই লাগবে।

চায়ের কাপটা ঠক করে নেমে এল টেবিলে। কেয়া মৈত্রর চোখ থেকে বিদায় নিল তন্দ্রা। দুপুর এবং স্বপ্নের রেশ সঙ্গে নিয়ে। উনি তাকিয়ে দেখলেন শিখা বেরিয়ে যাচ্ছে ঘর থেকে। পিছন থেকে ডেকে বললেন, শিখা আজকের ইংরেজি কাগজটা আমি দেখিনি। একটু দিয়ে যাস তো!

শিখা মুখ পুরো না ঘুরিয়েই বলল, ইংরেজি কাগজটা বিন্তির আন্টি একটু নিয়ে গেছে। কী সব চাকরির অ্যাডভার্টাইজ বেরিয়েছে। আপনি বাংলাটাই দেখুন না। একই তো খবর।

তুই জানিস, কোনটায় কী খবর থাকে? মাথা গরম হয়ে গেল কেয়ার।

না, আমাদের অত কাগজ-ফাগজ পড়ার সময় নেই। দিন-রাত কাজ করেই বলে সামাল দিতে পারি না! শিখা দপদপ করে পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ওর মায়ের সঙ্গে শিখা সেই কোন ছোটবেলা থেকে লোকের বাড়ি কাজে যেত। তখনও এই বাড়িতে আসেননি কেয়া। কেয়া এখানে আসার কিছুদিন পরেই টিবি ধরা পড়ল শিখার মায়ের। তখন থেকেই শিখা ওঁর কাছে থাকত বলা চলে। অনেক চেষ্টা-চরিত্র করেও যখন শিখার মাকে বাঁচানো গেল না, শিখাকে প্রায় পুষ্যিই নিলেন কেয়া মৈত্র। ওঁর ছেলে তখন কানপুরে, ছুটি-ছাটায় বাড়িতে আসে। বছরের অন্য সময়টা শুধু কেয়া আর শিখা। আস্তে আস্তে শিখাই হয়ে উঠল এই বাড়ির ম্যানেজার। কী বাজার হবে, কোত্থেকে বাজার হবে, জামাকাপড় কোনটা কবে লন্ড্রিতে যাবে, কোন ঘরের কোন জানলায় কী রঙের পরদা টাঙানো থাকবে, সমস্ত দায়িত্ব শিখার ওপর ছেড়ে দিয়ে নিজের পড়াশোনা আর ছাত্র-ছাত্রীদের জগতে অন্তরীণ হয়ে গেলেন কেয়া মৈত্র।

শিখা সেই সমস্ত দায়িত্ব খুব নিপুণভাবে পালন করত বলতেই হবে। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে ও একটা কাজ করত, যার খবর বহুদিন পর্যন্ত কেয়া জানতেন না। প্রেম করত রমেনের সঙ্গে। এই রমেন ছেলেটি ছিল এক্কেবারে মার্কামারা। এই অঞ্চলে প্রোমোটারির রমরমা শুরু হওয়ার আগে বড় বড় মাঠের ধারে অন্ধকার নামলেই যে তাস-জুয়া-মদ-গাঁজার আড্ডা শুরু হত, রমেনই ছিল তার হোতা। নানাবিধ কেপমারির অভিযোগে দু’-তিনবার জেলও খেটে এসেছিল ওই বয়সেই। কিন্তু এসব তথ্য পাড়ার বিভিন্ন লোক মারফত যতদিনে কেয়ার কানে পৌছোল, ততদিনে শিখা আর রমেন বিয়ে করে ফেলেছে গোপনে।

তুই রেজিষ্ট্রির কাগজপত্র আমাকে দেখা, আমি ডির্ভোসের ব্যবস্থা করছি, কেয়া বলেছিলেন শিখাকে। শিখা অনেক কান্নাকাটির পর মুখ তুলে বলেছিল, আমার পেটে বাচ্চা এসে গেছে গো মাসিমা।

কেয়া পরে জেনেছিলেন কথাটা মিথ্যে। রমেনই শিখিয়ে দিয়েছিল শিখাকে, সিমপ্যাথি আদায়ের জন্য। ততদিনে শিখার প্রতি ওঁর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে রমেন ওঁরই বাড়ির একতলায় একটি ঘরে বসবাস করতে শুরু করেছে শিখার সঙ্গে। কেয়ার দেওয়া টাকায় একটা ট্র্যাভেলসের ব্যাবসা শুরু করেছে আর শিখার মেয়ে বিন্তি এই পৃথিবীর সদস্যপদ পাওয়ার জন্য জোরে জোরে হাত-পা ছুড়ছে শিখার পেটে।

বাবান ওর স্ত্রী মালবিকাকে নিয়ে এই সময় এসেছিল ভারতে। ওরা অবশ্য তখনও স্বামী-স্ত্রী হয়নি, তবে একসঙ্গে থাকে। মালবিকার বাবা-মা কোঙ্কনি হলেও পাঁচ বছর বয়স থেকেই ও আমেরিকায়। ভদ্র এবং বুদ্ধিমতী মেয়ে। অন্যের ব্যাপারে নাক গলায় না এবং নিজের ব্যাপারেও অন্যের দখলদারি পছন্দ করে না। কেয়া একদিন রাতে বাবানকে মালবিকার সামনেই জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাদের কি ভারতে সেটল করার কোনও প্ল্যান আছে?

বাবান একটু চুপ করে থেকে বলেছিল, মালবিকার ফ্যামিলির সিক্সটি পারসেন্ট লোকই স্টেটসে আর আমার থাকার মধ্যে তুমি। আমার মনে হয় ইন্ডিয়ায় ফেরার চেয়ে তোমাকে ওখানে নিয়ে যাওয়াটাই ভাল হবে।

যদি অবশ্য তোমার মা যেতে চান, মালবিকা চুলে চিরুনি চালাতে চালাতে বলেছিল।

কেয়া ভয়ংকর উপভোগ করেছিলেন মালবিকার সেই ফোড়ন। বলেছিলেন, আমি আমেরিকায় যাব না বাবান। মানে, যেতে চাই না আর কী!

এখানেই থাকবে তা হলে সারাজীবন?

সারাজীবন তো এখানেই আছি বাবান।

তুমি ইংলিশ পড়িয়েছ এতদিন ধরে। আমি ভেবেছিলাম তোমার আমেরিকায় ভাল লাগবে।

আমি যে-ইংরেজি পড়িয়েছি, সেটা আটলান্টিকের এপারের ইংরেজি, বাবান। আমার বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছে হলে আমি ইংল্যান্ডে যাব।

আমার মনে হয়, তুমি ফালতু কথা বাড়াচ্ছ, মালবিকা বাবানকে বলল।

আমারও তাই মনে হয়। তবে কী জানো মালবিকা, যে-কোনও সম্পর্ক যত পুরনো হয় সেখানে তত ফালতু কথা চলে আসে। তোমার আর বাবানের সম্পর্কটা নতুন তো, তাই সেখানে হয়তো শুধুই টু দ্য পয়েন্ট কথাবার্তা। আমার আর বাবানের সম্পর্কটা সেই ওর জন্মের সময় থেকে। তাই আমাদের কথাবার্তায় দুটো-চারটে ফালতু ইমোশন এদিক-ওদিক থেকে উড়তে উড়তে চলে আসে, আটকানো যায় না।

মালবিকা তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনাদের কথাবার্তার ভিতরে কথা বলে আমি যদি আপনাকে হার্ট করে থাকি, আয়্যাম সরি। আমার একটু কাজ আছে আমি ঘরে যাচ্ছি। বলেই বাবানের দিকে তাকিয়ে যে-ইশারা করল তার একটাই মানে, ফ্রি হলে চলে এসো।

মালবিকা ওভাবে চলে যাওয়ায় বাবান খুবই অসন্তুষ্ট, তা কেয়া বুঝতে পারছিলেন। তবু সেটাকে পাত্তা না দিয়ে বললেন, আমার বাড়ির একতলাটা আমি যদি শিখা আর রমেনকে লিখে দিই, তোর কোনও আপত্তি আছে?

তোমার বাড়ি, তুমি যাকে ইচ্ছে লিখে দেবে। এতে আমার আপত্তি করার জায়গা কোথায়? বাবানের গলায় ঝাঁঝ।

দোতলাটা তোদেরই থাকবে, কেয়া শান্ত গলায় বললেন।

আই ডোন্ট থিঙ্ক উই নিড ইট। আমরা এখানে আসব ক’বার? তুমি আছ তাই, আদারওয়াইজ মালবিকা কলকাতার পলিউশন একেবারে সহ্য করতে পারে না। আমারও ইদানীং কষ্ট হয়, বাবান উঠে দাঁড়াল।

বাইরে থেকে একটা ভারী সুন্দর বাতাস কেয়ার ঘরে ভেসে এল। বাবান বেরিয়ে যেতে যেতেও একমুহূর্ত দাঁড়াল সেই বাতাসটা গায়ে মেখে নেওয়ার জন্য। কেয়ার মনে হল, ওকে বলেন ঘরে ঢুকে বন্ধ জানলায় লেগে থাকা এসি-র নীচে বস। এই হাওয়া গায়ে লাগাস না। বড় পলিউশন। বলতে পারলেন না। ছেলে তো!

ছেলেকে তবু যা-ও বলা যায়, বাইরের কাউকে কড়া কথা বলতে আরও কষ্ট হয় কেয়ার। কিন্তু দিন-দিন রমেন যা আরম্ভ করেছে, তাতে মুখ বুজে থাকাও সমস্যা। শিখাকে প্রায় হাতে করে মানুষ করেছেন কেয়া। কিন্তু সেও রমেনের উসকানিতে পালটে যাচ্ছে দিন-দিন। বাবান আর মালবিকা যখন এসেছিল তখন রমেন দোকান-বাজার করে, ফাইফরমাশ খেটে পরিষেবার প্রতিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু বাড়ির একতলাটা সম্প্রদানকারক হয়ে যাওয়ার পরই ওর আসল মূর্তি প্রকাশ পেতে শুরু করল আবার।

আমার কাছে ভাল পার্টি ছিল, পুরো বাড়িটাই প্রোমোটিং-এর জন্য নিতে চাইছিল। আমি তো ভেবেছি আমার অংশটা দিয়ে দেব, রমেন একদিন সন্ধ্যায় বলল।

রমেনের মুখে ‘আমার অংশ’ শুনে বেশ মজা লাগল কেয়ার। উনি বললেন, তা আমি মরে যাওয়ার পর তুমি তোমার অংশটা দিয়ো না, যাকে দিতে চাও।

রমেন বলল, শুধু আমার অংশটা দিলেই তো হবে না, প্রজেক্টের জন্য পুরো বাড়িটাই লাগবে!

পুরো পৃথিবীটাও লাগতে পারে। কিন্তু সে ব্যাপারে আমি কী করতে পারি রমেন?

দেখুন মাসিমা, আপনার ছেলে তো আপনার কেয়ার নিতে আসবে না আর। আপনার শেষ দিনগুলো আমাদের ওপর নির্ভর করেই চলতে হবে। তাই বলছিলাম, আপনি ফ্ল্যাটে মত দিয়ে দিন। আপনার নামে একটা ছ’শো- সাড়ে ছ’শো স্কোয়ার ফিট ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আপনি মারা গেলে সেটা আপনি যাকে দিতে চাইবেন, সে-ই পাবে।

আমি দোতলাটা একটা সংস্থাকে লিখে দিয়েছি। তারাই এখানে অফিস করবে, নিজেদের কাজ চালাবে। তোমার চিন্তার কিছু নেই, কেয়া কাউকে কিছু না দিয়েও বললেন।

চিন্তার কিছু নেই মানে? দোতলায় ওসব সংস্থা-ফংস্থা ক্যাওস করবে আর আমরা একতলায় থাকব? ও সব চলবে না।

কী চলবে, কী চলবে না সেটা তুমি ঠিক করবে? কেয়া রেগে গেলেন।

কী করব না করব সেটা দেখতেই পাবেন। একতলাটা আমাদের লিখে দিয়ে আপনি কিছু কৃতার্থ করেননি, শিখা হোল লাইফ সার্ভিস দিয়েছে আপনাকে, রমেন আগুনচোখে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

তারপর থেকে সেই আগুন অশান্তি হয়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। নীচে মদের আড্ডা, জুয়োর আড্ডা বসতে শুরু করল নিয়মিত। সেই হুল্লোড়ে দোতলায় টেকা দায় হয়ে উঠল। কেয়া আস্তে আস্তে খুঁটি সাজাতে শুরু করলেন। সংস্থিতা যে-এনজিও-তে কাজ করে তাদের দোতলাটা এমনিই দিয়ে দেবেন ভাবছিলেন। কিন্তু সংস্থিতা বলল যে, ওদের অনেক পয়সা, বিদেশ থেকেও ফান্ডিং আসে, বাড়ি বিক্রির টাকাটা বিভিন্ন মিশনে, আশ্রমে ভাগ করে দিয়ে যেতে। তাই করলেন। করতে করতে ভাবলেন, কী অদ্ভুত মেয়ে এই সংস্থিতা। ওদের এনজিও একটা বাড়ি খুঁজছে। সেই বাড়িটা যদি ও বিনাপয়সায় কিংবা খুব কমে জোগাড় করে দিতে পারত, ওর প্রোমোশন অনিবার্য ছিল। অথচ মেয়েটা পুরো অন্য বুদ্ধি দিল। আর একজনের বুদ্ধিও এই সময় খুব কাজে লাগল কেয়ার। সে ওঁরই ছাত্রী শ্রীপর্ণা। শ্রীপর্ণার দাদা পুলিশে বড় পোস্টে আছেন। শ্রীপর্ণার কথামতো কেয়া সেই ভদ্রলোককে ফোনে সব জানাতেই ম্যাজিক। রমেনকে দু’দিনের জন্য তুলে নিয়ে গেল লোকাল থানা থেকে। শিখা, যে পারতপক্ষে এড়িয়ে চলা শুরু করেছিল কেয়াকে, এসে একেবারে পায়ে পড়ে গেল ওদের মেয়ে বিন্তিকে নিয়ে। কেয়া বাধ্য হয়ে আবার একটা ফোন করলেন থানায়।

ফিরে আসার পর রমেন ঘাপটি মেরে রইল ক’দিন। তারপরই আবার নীচ থেকে হুংকার শুনতে শুরু করলেন কেয়া। মরার সাতদিন বাকি নেই, বুড়ির দেমাক তবু মরে না’, ‘যখন শ্বাস উঠবে তখন মুখে জল কে দেয় দেখব’ ইত্যাদি নানাবিধ মধুর বিশেষণ। কেয়া একদিন শিখাকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা শিখা আমি কি তোদের কোনও ক্ষতি করেছি?

শিখা কিছুক্ষণ গুম হয়ে বলল, আমি অনেক বোঝাই মাসিমা, কিন্তু রাস্তার লোফারকে যখন বড়লোক হওয়ার নেশায় পেয়ে বসে, সে কিছু বোঝে বলুন? বেশি বলতে গেলে এমন মার মারে যে, দু’দিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারি না।

রমেন তোকে মারে?

এই দ্যাখো না, বলে শিখা ওর ব্লাউজের বোতাম খুলে বুকের কালশিটে, পিঠে খুন্তির ছ্যাঁকা দেখাতে বসে।

পুলিশে রিপোর্ট করে দেব আবার? বল, কেয়া উদ্বেগের গলায় বলেন।

পুলিশ দু’দিন রেখে ছেড়ে দেবে, তখন আরও মারবে, একবারে যখন ছেড়ে যেতে পারব না তখন কী লাভ?

মার খাবি তবু ছেড়ে যেতে পারবি না কেন?

কীভাবে যাব মাসিমা? বিন্তি ছোট, আবার একটা আসছে, এখন যাওয়া যায়?

আবার আসছে? সে কী রে! ক’মাস? আমি জানি না তো কিছু।

আপনার কাছে আর আসা হয় কই এখন? তবে যদি অনুমতি করেন, তা হলে সকাল-বিকেলের চা আমিই আপনাকে দিয়ে যাব, আগে যেমন দিতাম।

কেয়ার জন্য হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা করে দেওয়ার সময় সংস্থিতা বারবার করে বলেছিল, আপনি চা-ও খাবেন না ওদের হাতে, ওরা চায়ে বিষ মিশিয়ে দেবে। আমি একটা সব সময়ের লোক দেখছি আপনার জন্য, যতদিন না পাই ওই হোম-ডেলিভারির লোকই ফ্লাস্কে আপনাকে চা দিয়ে আসবে। কেয়া মেনে নিয়েছিলেন সংস্থিতার কথা। কিন্তু ওই ফ্লাস্কের চা মুখে তুলতে ওঁর ভীষণ অসুবিধে হচ্ছিল। শিখা বুঝত ব্যাপারটা, কারণ ও ছোটবেলা থেকে কেয়ার চা বানিয়ে এসেছে। ও জানত পৃথিবীতে একমাত্র এই একটি নেশার কাছে কেয়া মৈত্র অসহায়।

কেয়া রাজি হয়ে গেলেন। বললেন, দিস তা হলে।

শিখা হাসিমুখে উঠে যেতে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল কেয়াকে, এই মাকড়ি দুটো দেখুন মাসিমা।

কেয়া এতক্ষণ খেয়াল করেননি, এবার খেয়াল করে দেখলেন শিখার দু’কানে দুটো সলিড সোনার দুল। উনি হাত দিয়ে একবার স্পর্শ করে বললেন, বাহ্‌ বেশ হয়েছে তো রে!

শিখা গদগদ গলায় বলল, বাচ্চা পেটে আসতেই দিয়েছে। তবে বলেছে, এবার যদি ছেলে না হয় তো মাকড়িসুদ্ধ কান ছিঁড়ে নেবে, বলেই শিখা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।

কেয়া চুপ করে গেলেন। শেক্সপিয়রের নাটকে যেমন কবর খুঁড়তে খুঁড়তেও দিনমজুররা হালকা চালে হাসি-ঠাট্টা করত, শিখার বুকের কালশিটে আর পিঠের ছ্যাকার ভিতরেও সেরকম অনেক সুরের সোহাগ স্তরে স্তরে লগ্ন হয়ে আছে। ভেবে আমোদ পেলেন কেয়া। গুনগুন করে উঠলেন একটু।

কিন্তু সব শুনে সংস্থিতা একটুও আমোদ পেল না। বলল, আপনার সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ যে-কুকুরটা দিনরাত্তির ঘুমোয় তার কী যেন নাম?

কে ভুলু? কেয়া শুধোলেন।

হ্যাঁ, আপনি শিখার দেওয়া চা খেতে হলে আগে দু’চামচ ভুলুকে খাওয়াবেন, তারপর নিজে খাবেন।

কিন্তু তার জন্য তো ভুলুকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে হবে।

তুলবেন। কিন্তু ম্যাম, টেস্ট না করিয়ে ওই চা খাবেন না, খবরদার!

তথাস্তু, কেয়া ফোন রেখে দিলেন।

বলাই বাহুল্য, সংস্থিতার পরামর্শ একদিনের জন্যও মানেননি কেয়া। কিন্তু আজ দুপুরের চটকাটা ভাঙতেই শিখাকে যেমন দেখলেন, তাতে মনটা তিতকুটে হয়ে গেল। মানুষ কতটা নীচে নামতে পারে! একটা বিশ্বাস বরাবর কাজ করত ওঁর মনে। বাবান তখন খুব ছোট, কেয়া আর অরুণাংশু ওকে নিয়ে বেলুড়মঠে গেছেন। ফেরার সময় পথে গাড়িটা থামিয়ে ওঁরা একটু চা খেতে নেমেছেন, একদল হিজড়ে এসে ঘিরে ধরল ওঁদের। তাদের আবদার বাবানকে কোলে নিয়ে খেলাবে, নাচাবে… অরুণাংশু প্রথমে হাতের ইশারায়, চোখের ইশারায়, পরে ইংরেজিতে বারবার বলল, ওদের টাকা দিয়ে দাও, যা চাইছে দিয়ে দাও, বাবানকে দিয়ো না। কেয়ার একটাই উত্তর ছিল, দেখিই না বাবানকে নিয়ে ওরা কী করে!

সেই প্রায়ান্ধকার, নির্জন রাস্তায় বাবানকে কোলে করে কত নাচল-গাইল ওরা। কতরকমের কর্কশ-মধুরতায় ভরিয়ে তুলল চারপাশ। আলিসার ভিতর থেকে তুমুল স্পর্ধায় যেমন বাইরে বেরিয়ে আসে বটগাছ, ওই না-পুরুষ, না-নারী মানুষদের কোলে-পিঠে তেমনই ঝলমলিয়ে উঠল বাবান। পূর্ণতাকে অপূর্ণতার কোলে দুলিয়ে দেওয়ার যে-চিরকালীন সংকল্প খেলা করত কেয়ার মনে, তা একটা রূপ পরিগ্রহ করল।

কিন্তু আজ ওই কাপ ঠক করে নামানোর শব্দে সেই রূপের গায়ে যেন টোল পড়ল কোথাও। কেয়ার মনে হল, বহুদিন শিল না কোটালে যেমন তাতে মশলা বাটা যায় না, সম্পর্ককেও কোটাতে হয়। আদান-প্রদান, ভালবাসা দিয়ে। শিখার সঙ্গে কোনও কারণে উনি সেটা পারেননি। ওঁর ব্যর্থতা। শিখাও পারেনি। পরিস্থিতির ব্যর্থতা। বাড়ির একতলা লিখে দিয়েও কেয়া শিখার মা হতে পারেননি, শিখাও মেয়ে হতে পারল না। কেয়া চায়ে প্রথম চুমুক দেওয়ার আগে ল্যান্ডিং-এ শোওয়া ভুলুর দিকে তাকালেন। তারপর ভাবলেন, ভুলু ভুলুর বিশ্বাস নিয়ে ঘুমিয়ে আছে, ঘুমোক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *