শিল্প-সাহিত্যে গণরূপ
জীবন আছে অথচ প্রয়োজন নেই, এমন হতেই পারে না। আমি আছি বলেই আমার ভুবন আছে। আমার জীবন সেই ভুবনের সঙ্গে একই নাড়িতে যুক্ত, একই সূত্রে গাঁথা। আমার জীবনের তুচ্ছ উচ্চ সর্বপ্রকার প্রাত্যহিক কিংবা মৌর্তিক প্রয়োজন আমার ভুবনই মিটায়। আমি আছি তাই আমার পেটের ভাত, পরনের কাপড়, রোগের প্রতিষেধক, শোকের প্রবোধ, দেহের পুষ্টি ও মনের তুষ্টির দরকার। রুচি বদলের জন্যে আমি বন্ধনে মুক্তি, যন্ত্রণায় আনন্দ, সমস্যায় সমাধান যেমন সন্ধান করি; তেমনি কখনো কখনো মুক্তি এড়িয়ে বন্ধনকে, আনন্দকে হেলা করে যন্ত্রণাকে, সম্পদ ছেড়ে সংকটকে বরণ করে জীবনের অন্য স্বাদ খুঁজি।
জীবন আমার কাছে কখনো দায়িত্ব, আর কখনো বিলাস, কখনো দায়, কখনো সম্পদ, সকালে আনন্দ আবার সন্ধ্যায় যন্ত্রণা, কখনো খেলনা কখনো ঐশ্বর্য, কখনো বোঝা, কখনো পাথেয়, কখনো বেদনা, কখনো বা আকুতি, কখনো প্রাণময়, কখনো মনোময়, কখনো রূঢ়িক, কখনো সামাজিক, কখনো বৈষয়িক, আবার কখনো বা দার্শনিক। সবটা মিলে জীবন এক অনন্য অনুপম দুর্লভ ঐশ্বর্য। এই জীবনের স্বাদ যে একবার সচেতনভাবে পায়, সে আনন্দলোকেরই সন্ধান পায়। জীবন-ধনে যে ধনী, তার কাছে নিখিল জগৎ রূপবান হয়ে অপরূপ হয়ে আবির্ভূত হয়। সেই রূপসী ধরণীর অনুরাগে তার স্বভাবে আসে কমনীয়তা, তার হৃদয়ে জাগে ঔদার্য, প্রীতির সঞ্চয়ে ভরে উঠে তার বুক। চিত্তলোকে তার গড়ে উঠে মাধুর্যের মৌচাক। তখন সে প্রীতি ও শুভেচ্ছার পুঁজি নিয়োগ করে। তার ভুবনে। বিনিময়ে পায় মানুষের প্রীতি ও শুভেচ্ছা। জীবনে এর চেয়ে বড় সম্পদ, এর চেয়ে কেজো পাথেয় আর নেই। মানব জমিন আবাদ করলে যে ফসল মেলে, তা কখনো নিঃশেষ হয় না–বন্ধ্যা হয় না।
মন-প্রাণের এমনিধারা অনুশীলনের নামই সংস্কৃতিচর্যা, আর এ স্তরে উত্তরণই সংস্কৃতি। এমনি করে সংস্কৃতিবান হলেই মানুষ হয় প্রীতিপরায়ণ, সংবেদনশীল, পরিণামদর্শী ও কল্যাণপ্রবণ। কেননা, সে বোঝে–নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না, একে নষ্ট করলে সবাই দুঃখ পায়। এমন মানুষ অনুকম্পা বশে উদার হয় না, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধে মহৎ হয়। তেমন মানুষ বাদশা কিংবা ফকির হতে পারে, চালু অর্থে মূর্খ কিংবা জ্ঞানী হতে পারে, নিরক্ষর কিংবা বিদ্বান হতে পারে। কিন্তু তাতে তার মানবিক চেতনায়, তার প্রীতিশীলতায়, তার হিতবুদ্ধিতে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে না। অবশ্য তা ব্যক্ত হওয়া কিংবা অব্যক্ত থাকা, তার সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা নির্ভর করে তার সামাজিক, শৈক্ষিক, আর্থিক ও ধার্মিক প্রতিবেশের উপর। কিন্তু তাতে তার অন্তর্নিহিত মনুষ্যত্বের ঔজ্জল্য কমে না, বরং অবরুদ্ধ আবেগের বেদনায় তপ্ত কাঞ্চনের মতো–কষিত সুবর্ণের মতো তার রূপ, তার লাবণ্য বাড়ে।
এমন মানুষ যখন লোকসেবায় নামে তখন সে বুদ্ধ-যীশু-কবীর-নানক-চৈতন্য-বায়যিদ হয়, যখন নৃপ হয় তখন ইউসুফ-রাম-নওশেরোয়া হয়। যখন লিখিয়ে হয় তখন শেপীয়র ভল্টসয়ার গ্যটে-টলস্টয়-লা-রবীন্দ্রনাথ হয়। যখন গাইয়ে-বাজিয়ে হয় তখন তানসেন-হরি বৈজু-বিটোফন হয়। যখন আঁকিয়ে-বানিয়ে হয় তখন ভিঞ্চি-এ্যাঞ্জেলো-পিকাসো হয়– তখন আমরা পাই অজন্তা ইলোরা-এথেন্স-আগ্রার ভাস্কর্য, স্থাপত্য ও আলেখ্য। যখন দার্শনিক হয় তখন তার মধ্যে প্ল্যাটো এ্যারিস্টোটল-রুশদ-হেগেল-নীৎসে-সার্জেকে পাই। যখন সমাজতাত্ত্বিক হয় তখন সেন্ট অগাস্টাইন খলদুন-মার্কসকে পাই। যখন বিজ্ঞানী হয় তখন ডারউইন-ফ্রয়েডকে পাই। যখন বিপ্লবী হয় তখন লেনিন-মাও-গুয়েভারাকে দেখি। এ যুগে যন্ত্র-প্রভাবে মানুষের জীবিকা ও জীবন-পদ্ধতি পালটে গেছে। তাই যুগ-প্রয়োজনে গণচেতনা, গণসাহিত্য ও গণতন্ত্রের কথাই প্রাত্যহিক জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে প্রায় সর্বক্ষণ শুনতে হয় আমাদের।
যন্ত্রায়ত জীবিকার ফলে উদ্ভূত জীবন-প্রতিবেশে আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ আজ আর আগের মতো আসমানের দিকে তাকিয়ে থাকে না। সে এখন দৈব-নির্ভর নয়, রোদ-বৃষ্টি-রোগ-অন্নের জন্যে ভাগ্যের উপর ভরসা রাখে না। সে বুঝেছে এতে প্রকৃতির প্রভাব যতটুকু, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি রয়েছে মানুষের হাত। মানুষের লোভ, স্বার্থপরতা ও অপ্রেম-অবিবেচনাই মানুষের দুর্ভোগ ও মৃত্যুর কারণ। কাজেই স্বায়ত্ত জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা, সুষ্ঠু বিন্যাস ও সুনিয়ন্ত্রণের কথাই সে সর্বক্ষণ ভাবছে, না-ভেবে পারছে না। তার অন্ন চাই, আনন্দ চাই, ওষুধ চাই, প্রবোধ চাই। প্রাচুর্যহীন কাড়াকাড়ির যুগে তাই মানুষকে শোষণ, পীড়ন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। তারা অক্ষম বলেই তাদের সৈনাপত্য নিয়েছে সংবেদনশীল মানববাদী লোকসেবক, লেখক, গায়ক, দার্শনিক, ঐতিহাসিক প্রভৃতি সবাই। এই লড়িয়ে লোকগুলোই স্ব স্ব ক্ষেত্রে লড়াই করে যাচ্ছে মানুষের মুক্তির জন্যে। তারা মুক্তি কামনা করে শোষণ থেকে, অশিক্ষা থেকে, দৈন্য থেকে, বিশ্বাস থেকে, সংস্কার থেকে, পীড়ন থেকে, অন্ধকার থেকে, অজ্ঞতা থেকে, অমঙ্গল থেকে, হীনমন্যতা থেকে।
এদের মধ্যে যারা লিখিয়ে তারা গণসাহিত্যিক, যারা নেতৃত্ব দেয় তারা গণনেতা, যারা আঁকে তারা গণশিল্পী, যারা চিন্তাবিদ তারা মানববাদী, যারা ঐতিহাসিক তারা সমাজতাত্ত্বিক। এ সংগ্রাম চলছে লেখা ও রেখার, কথা ও সুরের মাধ্যমে। তারা লিন্দু শোষক ও পীড়কদের মনের কাছে, মস্তিস্কের কাছে, বিবেকের কাছে এ আবেদনই জানাতে চাচ্ছে যে–পরিণামদর্শী হও, বিবেকবান হও এবং সংবেদনশীল হও, আর আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই যৌথ জীবনের সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি সমভাবে ভাগ করে নিতে এগিয়ে এসে, নইলে নিষ্কৃতি নেই তোমার–যারে তুমি নীচে ফেল, সে তোমারে টানিছে যে নীচে। সমস্বার্থের ভিত্তিতে সহযোগিতা ও সহঅবস্থানে রাজি হতেই হবে। এরই নাম গণসাহিত্য, গণসংগীত ও গণশিল্প। কাজেই গণশিল্প-সাহিত্য, শোষিত-পীড়িত অন্ধ-অশিক্ষিত চাষী-মজুরের জন্যে নয়, পীড়ক-শোষক লিন্দু বেনে বড় লোকের উদ্দেশ্যেই রচিত।
আমার লেখায় ও রেখায়, আমার কথায় ও সুরে আমার জীবনের চাহিদার দাবি; আমার ভাত-কাপড়ের, আমার তেল-নুন-লাকড়ির, আমার ওষুধ-পথ্যের অভাবের কথাই অভিব্যিক্ত পাবে। কেননা এ অভাব আমাকে সর্বক্ষণ ঘিরে রয়েছে, আমার জাগ্রত মুহূর্তগুলো বিষিয়ে তুলেছে; আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। যন্ত্রণার প্রকাশপথ রুদ্ধ করা সহজও নয়, স্বাভাবিকও নয়। এই যন্ত্রণার অভিব্যক্তি ও তার নিরসনের আবেদন ও আকুতিই গণশিল্প-সাহিত্য বা সঙ্গীত। অভাবজীর্ণ পাঁজর থেকে এ ছাড়া আর কী আশা করা যায়! আজো তকদির-বাদী ও নিয়ন্ত্রিত জীবনে যারা আস্থা রাখে আর যারা অন্যের শোণিত পানে পুষ্ট, অথচ যাদের সংবেদনশীলতা কিংবা পরিণামদর্শিতা নেই, কেবল তাদের মুখেই আমরা শুনতে পাই আদ্যিকালের ফুল-পাখি ও প্রেম-প্রকৃতির মহিমা কীর্তন।
এ শতক মানুষের মুক্তির বাণী বয়ে নিয়ে এসেছে। অজ্ঞতা থেকে, দাসত্ব থেকে, পরাধীনতা থেকে, দারিদ্র্য থেকে, লিপ্সা থেকে, অমানুষিকতা থেকে প্রত্যহ মুক্তি আসছে কারো-না-কারো, কোথাও-না-কোথাও। অতএব শতাব্দীর আহ্বান ব্যর্থ যাবে না। আলো ঝলমল আনন্দঘন সুপ্রভাত আসন্ন। সামনে নতুন দিন।