শিল্পী

শিল্পী

অবনীশ ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। অয়েল পেন্টিং। একজন মাঝবয়সী পুরুষ ভদ্রলোকের পোর্ট্রেট। অবনীশের স্টুডিওর এক কোণায় আরও আট-দশটা ছবির পিছনে দাঁড় করানো ছিল। অবনীশের আঁকা প্রথম অয়েল পোর্ট্রেট। গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে সে দু বছর হল পাশ করে বেরিয়েছে। ছাত্র অবস্থায় অবিশ্যি সে আরও পোর্ট্রেট করেছে। এবং তাতে বেশ নামও হয়েছিল। অবনীশের ইচ্ছা সে ছবি আঁকাকেই পেশা হিসেবে নেবে। কিন্তু কীভাবে শুরু করবে সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।

অবনীশের বাড়িতে তার বাবা মা আছেন। একটি বোন ছিল, তার সম্প্রতি বিয়ে হয়েছে। বাবা হিমাংশু বোস ব্যারিস্টার এবং ভালো প্র্যাকটিস। ছেলেকে তিনি চিরকালই উৎসাহ দিয়ে এসেছেন। তিনি একদিন অবনীশকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই তো আর্টিস্ট হবি?’

‘তাই তো ইচ্ছে আছে’, বলল অবনীশ।

‘তোর আঁকার সরঞ্জাম সব রয়েছে?’

‘কিছু ক্যানভাস, একটা ইজেল, আর কিছু রং কিনতে পারলে ভালো হত।’

‘বেশ তো—কিনবি’খন। কত লাগবে বলিস। আমি টাকা দিয়ে দেব।’

সে সব সরঞ্জাম কেনা হয়ে গেছে, কিন্তু অবনীশ এখনও ছবি আঁকতে শুরু করেনি। ইজেলে সাদা ক্যানভাস খাটানো রয়েছে, তাতেই ছবি ফুটে উঠবে, কিন্তু কবে বা কী ছবি তা অবনীশ এখনও ভেবে পায়নি।

অম্বিকা সেনগুপ্তর পোর্ট্রেট আঁকার আইডিয়াটা নিখিলই দেয়। নিখিল অবনীশের অনেকদিনের বন্ধু, যদিও সে আর্টিস্ট নয়। তারা দুজনে একসঙ্গে স্কুলে পড়েছে। তারপর দুজনের পথ আলাদা হয়ে গেলেও বন্ধুত্ব রয়েই গেছে। নিখিলের বাবা রজনী দত্ত ডাক্তার। নিখিল একদিন এসে সাদা ক্যানভাস দেখে বলল, ‘কিরে, এখনও আঁকা আরম্ভ করিসনি?’

অবনীশ মাথা চুলকে বলল, ‘কী আঁকব সেটা ঠিক করলে তবে তো আঁকা শুরু হবে।’

‘কেন? পোর্ট্রেট। তোর যেটা স্পেশালিটি।’

‘কার পোর্ট্রেট? রাস্তা থেকে লোক ধরে এনে তো পোর্ট্রেট করা যায় না। আর আজকাল ফোটোগ্রাফির যুগে অয়েল পোর্ট্রেট করানোর রেওয়াজ প্রায় উঠেই গেছে।’

‘আমাকে দুদিন ভাববার সময় দে।’

দুদিন বাদে নিখিল এসে অবনীশকে জিজ্ঞেস করল, ‘অম্বিকা সেনগুপ্তর নাম শুনেছিস?’

অবনীশ শোনেনি।

‘স্টিফেন অ্যান্ড গিলফোর্ড কোম্পানির একজন চাঁই। বাবার বিশেষ বন্ধু। একদিন ক্লাবে নাকি আক্ষেপ করে বাবাকে বলেছিলেন, ‘পুরোন রেওয়াজ সব উঠে যাচ্ছে—এটা অত্যন্ত আপসোসের ব্যাপার। বাবার একটা পোর্ট্রেট আছে আমাদের ড্রইং রুমে—পঞ্চাশ বছর আগে বিখ্যাত প্রবোধ চৌধুরীর করা। চমৎকার। ফোটোতে ওই আভিজাত্যই নেই।’ বাবা তাতে বললেন, ‘তুমি একটা নিজের পোর্ট্রেট করাও না। বাধাটা কোথায়?’ সেনগুপ্ত নাকি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, ‘সেরকম আর্টিস্ট কোথায়?’

এ গল্প নিখিল গতকাল বাবার মুখে শোনার পরেই তার মাথায় বুদ্ধিটা খেলে।

‘পোর্ট্রেট তুই খুব ভালো পারবি—একেবারে ভেটারেন আর্টিস্টের মতো। আমি বাবাকে তোর কথা বলেছি। বাবা বলেছেন সেনগুপ্তকে বলবেন।’

তিন দিন বাদে নিখিল আবার অবনীশের কাছে এল। বলল, ‘তোর ডাক পড়েছে।’

‘কোথায়?’

‘সাত নম্বর রয়েড স্ট্রিট। অম্বিকা সেনগুপ্তর বাড়ি।’

‘কবে, কখন যেতে হবে?’

‘রবিবার সকাল নটায়।’

দুরু দুরু বুকে যথাসময়ে অবনীশ গিয়ে হাজির হল সাত নম্বর রয়েড স্ট্রিটে। বেয়ারা বসবার ঘরে বসালো অবনীশকে। তিন মিনিটের মধ্যেই আসল লোকের আবিভাব। সত্যিই ছবি আঁকার মতো চেহারা।

‘তুমি অয়েল পোর্ট্রেট করো?’ ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন।

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘তোমার খুব প্রশংসা করছে আমার বন্ধু ডাক্তার রজনী দত্তর ছেলে। ক’দিন নাও তুমি একটা পোর্ট্রেট করতে?’

‘দিন দশেকের বেশি লাগে না।’

‘তাহলে কালই শুরু করে দাও। আমার আবার কলকাতার পাট গুটিয়ে দিল্লির আপিসে চলে যেতে হতে পারে। আমার এখানেই আসবে। সকাল আটটা থেকে ন’টা পর্যন্ত টাইম দেবো তোমায়। তোমার রেট কত?’

‘আমি তো প্রোফেশনাল কাজ শুরুই করিনি; কাজেই যা ভালো বোঝেন তাই দেবেন।’

‘শ পাঁচেক?’

‘ঠিক আছে।’

‘আরেকটা কথা—তিন দিনের দিন যদি দেখি ছবি আমার পছন্দ হচ্ছে না, তাহলে সেইখানেই থামতে হবে। তোমার এক্সপেনসেস আমি দিয়ে দেবো। তবে স্বভাবতই পুরো পারিশ্রমিক পাবে না।’

এতেও অবনীশ বলল, ‘ঠিক আছে।’

পরের দিনই কাজ শুরু হয়ে গেল। অবনীশকে একটা রিকশা ভাড়া করতে হয়েছিল সরঞ্জাম আনবার জন্য। অম্বিকা সেনগুপ্ত ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় ঠিক আটটার সময় হাজির হলেন বৈঠকখানায়।

‘কোথায় বসাবে আমাকে?’ ভদ্রলোক এসেই জিজ্ঞেস করলেন।

‘আজ্ঞে এই উত্তরের জানালাটার পাশে হলে ভালো হয়। নর্থ লাইটটা পোর্ট্রেটের পক্ষে সবচেয়ে ভালো লাইট।’

‘হাতে বই-টই কিছু লাগে না? পাশে টেবিল থাকবে না?’

‘আজকাল ওসব উঠে গেছে। আমি আপনার যাকে বলে আবক্ষ পোর্ট্রেট করব। আপনি এই চেয়ারটায় বসবেন। দাঁড়াবার দরকার নেই।’

‘বাঃ—এতো তেমন কঠিন ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে না।’

তিন দিনেই দেখা গেল ছবিতে মিস্টার সেনগুপ্তকে চেনা যাচ্ছে। ভদ্রলোক কাজ দেখে অবনীশের পিঠে দুটো মৃদু চাপড় মেরে বললেন, ‘এক্সেলেন্ট! ক্যারি অন। ‘ অবনীশের কাঁধ থেকে একটা বোঝা নেমে গেল।

কিন্তু তার পরের দিনই এক দুঃসংবাদ। ‘তোমাকে আর তিন দিনের বেশি সময় দিতে পারছি না, অবনীশ।’ বললেন অম্বিকা সেনগুপ্ত। ‘আমাকে বুধবার—অর্থাৎ আজ থেকে চারদিন পরে—দিল্লি চলে যেতে হচ্ছে। তলপি-তলপা গুটিয়ে। ক’দিনের জন্য তা বলতে পারব না। বছর দু-এক তো বটেই। আমাকে মাঝে মাঝে আসতে হতে পারে। কিন্তু তার মধ্যে তোমায় সময় দিতে পারব না।’

অবনীশের মনটা ভেঙে গেল। সে নিজেও বুঝতে পারছিল যে কাজটা খুব ভালো এগোচ্ছে। তিন দিনে যে ছবি শেষ হবে না তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

‘তাহলে আপনি কি অসমাপ্ত ছবিই সঙ্গে নিয়ে যাবেন?’

‘সে আর কী করে হয়। যতদূর করতে পার সেই অবস্থাতেই তোমার কাছে থাকবে ছবিটা। অবিশ্যি তোমার পারিশ্রমিক তুমি পাবে।’

তিন দিনে মনের জোরের সঙ্গে হাতের জোর মিলিয়ে অবনীশ ছবির বারো আনা শেষ করে ফেলল। অম্বিকা সেনগুপ্ত এবার দেখে বললেন, ‘ব্রিলিয়ান্ট, ব্রিলিয়ান্ট! তোমার ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল, অবনীশ। আমি টাকা সঙ্গেই এনেছি। এই নাও তোমার পারিশ্রমিক।’

অবনীশ দেখল মিস্টার সেনগুপ্ত তাকে পাঁচশোর জায়গায় সাতটা করকরে একশো টাকার নোট দিয়েছেন।

অম্বিকা সেনগুপ্তর পোর্ট্রেটের পর্ব এখানেই শেষ হল।

এবার অবনীশ তার পেশাদারী শিল্পীজীবনের জন্য তৈরি হল। ছবি এঁকে রোজগার তাকে করতেই হবে। বাপের অনুগ্রহে আর কতদিন চলে? কী ঢঙে ছবি আঁকবে সে; সাবেকী না আধুনিক—সেই নিয়ে তার মনে প্রশ্ন জেগেছে, যদিও তার উত্তর সে এখনও খুঁজে পায়নি।

অম্বিকাবাবুর চলে যাবার মাসখানেক পরে চিত্রকূট গ্যালারিতে আধুনিক ভারতীয় শিল্পীদের একটা প্রদর্শনী হল। অবনীশ গেল দেখতে, এবং দেখে সে হতবাক হয়ে গেল। যে ছবির না আছে মাথা না আছে মুণ্ডু, তার দাম আকাশছোঁয়া। আর সেই দামে লোকে সে ছবি কিনছে বাড়িতে টাঙিয়ে রাখার জন্য। চল্লিশটার মধ্যে উনিশটা ছবির ফ্রেমে লাল গোল কাগজ আঁটা। তার মানে ছবি বিক্রি হয়ে গেছে, অথচ আজ সবে প্রদর্শনীর চতুর্থ দিন।

মিনিট পনেরো থেকে অবনীশ গ্যালারি থেকে বেরিয়ে এল। সে মনস্থির করে ফেলেছে। চুলোয় যাক মডার্ন আর্ট। সে তার নিজের ঢঙেই ছবি আঁকবে—সে ছবি লোকে নিক বা না নিক।

ছ’মাসে অবনীশ বত্রিশখানা ছবি আঁকল। কিছু প্রাকৃতিক দৃশ্য আঁকার জন্য তাকে বাইরেও যেতে হয়েছিল—পুরী, ঘাটশিলা, গ্যাংটক। সে বুঝেছে ল্যান্ডস্কেপেও তার হাত খারাপ নয়।

নিখিল এল একদিন ছবি দেখতে। দেখে-টেখে বলল, ‘দুর্দান্ত হয়েছে তোর ছবি। তবে ভয় হয়ে কী জানিস?—আজকাল ছবির চেহারা আর লোকের রুচি এত পালটে গেছে যে তোর ছবি বাজারে চলবে কি না তাই ভাবছি। তুই এগজিবিশন করবি তো?’

‘ইচ্ছে তো আছে। ছবি বিক্রি না হলে রোজগার হবে কী করে?’

‘একটা গ্যালারির নাম হয়তো তুই শুনেছিস—রূপম্‌। তার মালিক পুরুষোওম মেহ্‌রা বাবার পেশেন্ট। খুব কঠিন ব্যারাম থেকে বাবা ওকে সারিয়ে তুলেছিলেন। মেহ্‌রা মোটামুটি সেকেলে লোক, যদিও ছবি যা দেখায় সবই মডার্ন। আমি ওকে ফোন করে রাখছি। তুই তোর গোটা দু-এক ছবি নিয়ে গিয়ে ওকে দেখা। ভদ্রলোক হয়তো প্রদর্শনী করতে রাজিও হয়ে যেতে পারেন।’

অবনীশ নিখিলের কথা মতো মেহ্‌রার সঙ্গে টেলিফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে তিনটে বাছাই ছবি সঙ্গে নিয়ে ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করল।

মিঃ মেহ্‌রা ছবিগুলোর দিকে মিনিটখানেক তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘এতো দেখছি সবই চিনতে পারছি—মানুষের মতো মানুষ। বাড়ির মতো বাড়ি। গাছের মত গাছ। আজকাল তো আর কেউ এমন আঁকে না।’

অবনীশ মৃদুস্বরে বলল, ‘আজ্ঞে, আমি একমই আঁকতে ভালোবাসি।’

মেহ্‌রা বললেন, ‘দেখেন অবনীশবাবু—আমি আপনাকে ফ্র্যাঙ্কলি বলছি, আমরা নাম-করা আর্টিস্টের ছাড়া কারও ছবি এগজিবিট করি না। ছবি বিক্রি হবে এই গ্যারান্টি আমাদের চাই, কারণ কি ছবি বিক্রির তিন ভাগের এক ভাগ টাকা আমরা কমিশন নিই; এ থেকে আমাদের ব্যবসা চলে। শুধু আমাদের নয়—অল কমার্শিয়াল গ্যালারিজ।‘

‘আর যদি ছবি বিক্রি না হয়?’

‘তাহলে আমাদের লোকসান। বিক্রি হবে জেনেই তো আমরা ওয়েল-নোন আর্টিস্ট ছাড়া কারুর ছবি দেখাই না।’

‘তাহলে আমার ছবি আপনি দেখাবেন না? নৈরাশ্যের সুরে বলল অবনীশ।

মিঃ মেহ্‌রা অবনীশের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মৃদু হেসে বললেন, ‘আপনি অন্য কেউ হলে আপনাকে রিফিউজ করে দিতাম, কিন্তু ডক্টর দত্তর ছেলে আমাকে রিকুয়েস্ট করেছে বলে আমি আপনাকে ফিরিয়ে দিতে পারছি না। তাছাড়া এরকম ছবির মার্কেট আছে কি না সেটাও দেখা যাবে। তবে আপনাকে কিন্তু আমাদের টার্মস মেনে নিতে হবে।’

‘নিশ্চয়ই।’

এই ঘটনার এক মাস পর অবনীশের প্রদর্শনী শুরু হল রূপম্‌ গ্যালারিতে। দশ দিন চলবে, বত্রিশখানা ছবি। তার মধ্যে অম্বিকা সেনগুপ্তর পোর্ট্রেটটাও ছিল, তবে সেটা নট ফর সেল। তার জীবনের প্রথম পেশাদারী কাজ অবনীশ হাতছাড়া করবে না।

প্রদর্শনীতে প্রথম তিন দিন বিশেষ লোক হয়নি। তারপর থেকে দর্শকের সংখ্যা ক্রমে বাড়তে লাগল। অবনীশ অবাক হয়ে দেখল যে তার ছবি বিক্রিও হচ্ছে। প্রথমবার বলে সে ছবির দাম বেশ কমই রেখেছিল, তাও চোদ্দখানা ছবি বিক্রি হয়ে কমিশন বাদে তার হাতে এল সাড়ে চার হাজার টাকা। মিঃ মেহ্‌রাও তাকে কনগ্র্যাচুলেট করলেন এবং কথা দিলেন যে ভবিষ্যতেও রূপম্‌ অবনীশের ছবির এগজিবিশন করবে।

কিন্তু একটা ব্যাপারে অবনীশকে চোট পেতে হল। সেটা হল বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তার প্রদর্শনীর সমালোচনা। বেশির ভাগ সমালোচকই বলেছে যে অবনীশের মস্ত দোষ হল সে সময়ের সঙ্গে তাল রেখে চলছে না। একজন বলেছে, ‘আজ যদি কোনও লেখক বঙ্কিমচন্দ্রের ঢঙে উপন্যাস লেখে তাহলে কি সেটা একটা প্রশংসনীয় ব্যাপার হবে?’

এইসব সমালোচকের নাম অনেকেই জানে না। যার নাম জানে, এবং যার সমালোচনা সকলেই পড়ে সে হল ‘কৃষ্টি’ সাপ্তাহিকের সমালোচক আনন্দ বর্ধন। অবনীশ জানে যে নামটা ছদ্মনাম, কিন্তু এই নামের পিছনে আসল ব্যক্তিটি কে সেটা সে জানে না। এঁর সমালোচনার শিরোনাম হল ‘মান্ধাতার আমল।’ তীরের মতো চোখা চোখা শব্দের ব্যবহারে সমালোচক অবনীশের প্রদর্শনীকে ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছেন। ‘যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে আর্টের চেহারাও যে আমূল পালটেছে, সে খবর যে এই শিল্পী রাখেন না সেটা এঁর ছবিগুলির দিকে এক ঝলক দৃষ্টি দিলেই বোঝা যায়,’ লিখছেন আনন্দ বর্ধন। ‘ক্যানভাস ও তেল রং আজকাল দুর্মূল্য। তাদের এই অপব্যবহার কোনও মতেই বরদাস্ত করা যায় না। প্রদর্শনীর কথা চিন্তা না করে শিল্পী যদি আজকের শিল্পরীতির সঙ্গে পরিচিত হবার প্রয়াস করেন তাহলে হয়তো এঁর একটা ভবিষ্যৎ গড়ে উঠতে পারে, কারণ রং তুলির ব্যবহার যে উনি একেবারে জানেন না তা নয়।’

এই সমালোচনা শুধু অবনীশ নয়, তার বাবা এবং তার বন্ধু নিখিলও পড়ল। বাবা বললেন, ‘শিল্পীকে গালমন্দ করাটা, সমালোচকদের একটা হ্যাবিট, কারণ পাঠক প্রশংসার চেয়ে নিন্দাটা বেশি উপভোগ করে। তুই নিরুদ্যম হোস না।’

নিখিল বলল, ‘এই আনন্দ বর্ধন ছদ্মনামের আড়ালে কে লুকিয়ে রয়েছে সেটা বার করে সেই ব্যক্তিকে ধোলাই দিতে হবে।’

অবনীশ কিন্তু সমস্যায় পড়ে গেল। সে অনুভব করল আনন্দ বর্ধনের বাক্যবাণ অনবরত তার মনে বিঁধছে। সে অত্যন্ত গভীর ভাবে চিন্তা করতে লাগল তার আঁকার ঢং পালটিয়ে সে আধুনিকের দলে চলে আসবে কি না। বার বার সমালোচকের তিরস্কার ও বিদ্রুপ সে সহ্য করতে পারবে না। মডার্ন আর্ট জিনিসটা কী ও কেন, সেটা সে এতদিন জানার চেষ্টা করেনি, এবার করবে।

প্রদর্শনীর পর ছ’টা মাস অবনীশ ছবিই আঁকল না; তার বদলে রোজ ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে গিয়ে মর্ডান আর্ট সম্বন্ধে যত বই পাওয়া যায়, সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল এবং পড়ল। তার ফলে সে জানল যে বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই প্রধানত ফ্রান্সে কিছু শিল্পীর প্রভাবে আর্টের জগতে এক বিপ্লব ঘটে। তার ফলে ছবির চেহারা একেবারে বদলে যায়, এবং বিপ্লবের প্রভাব ক্রমে সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। এই সব বইয়ে তার নিজের ঢং-এর একটি ছবিও খুঁজে পেল না অবনীশ।

এর পরে অবনীশ লাইব্রেরিতে যাওয়া বন্ধ করে ড্রইং-এর খাতায় প্যাস্টেল দিয়ে নতুন রীতিতে ছবি আঁকার চেষ্টা আরম্ভ করল। এভাবে প্রায় ত্রিশখানা খাতা ছবিতে ভরে গেল। ইজেলে সাদা ক্যানভাস খাটানো রয়েছে, কিন্তু তাতে একটা আঁচড়ও পড়েনি।

নিখিল একদিন এসে বলল, ‘কিরে, তুই কি ছবি আঁকা ছেড়ে দিলি নাকি?’

অবনীশ বলতে বাধ্য হল যে সে তার ছবির ভোল পালটে আজকের দিনের শিল্পীদের দলে আসার চেষ্টা করছে।

‘মডার্ন আর্ট তো খুব সোজা,’ বলল নিখিল, ‘একটা ক্যানভাস খাটিয়ে তাতে কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং এঁকে ভরিয়ে দে—ব্যাস্‌। হয়তো হাজার টাকায় বিক্রিও হয়ে যেতে পারে সেই ছবি।’

অবনীশ তার বন্ধুর কথা খুব পছন্দ করল না। সে বুঝেছে মডার্ন আর্ট অত সোজা নয়। সেটা ঠিক ভাবে করতে গেলে শিল্পীর দেশ বিদেশের সাবেকী আর্ট ও লোকশিল্পের সঙ্গে পরিচয় থাকা চাই। সে পরিচয়ের জন্য সময় লাগে, অধ্যবসায় লাগে। তা হোক—অবনীশ বুঝেছে যে তাকে এই পথেই যেতে হবে। আনন্দ বর্ধনকে বলতে হবে—হ্যাঁ, অবনীশ বোস সার্থক শিল্পী। তার ছবিকে আর অবজ্ঞা করা চলে না।

দু বছর ধরে অবনীশ আধুনিক ছবি আঁকল। একবার ইজেলে ক্যানভাস খাটিয়ে অয়েল পেন্টিং। এই সময়ের মধ্যে স্বভাবতই তার কোনও রোজগার হয়নি। বাবা আবার তাকে সাহায্য করলেন। বললেন, ‘তোর ছবি এখন আর বুঝতে পারছি না, কিন্তু এটা বুঝেছি যে তুই একটা তাগিদ অনুভব করছিস। তুই যদ্দিন আবার এগজিবিশন না করছিস, তদ্দিন কী খরচ লাগছে না-লাগছে সেটা আমাকে জানাতে দ্বিধা করিস না’ অবনী বুঝল এমন বাপ না থাকলে তার শিল্পী জীবন এখানেই শেষ হয়ে যেত।

আজকাল অবনীশের এক-একটা ছবি আঁকতে বেশ সময় লাগে। একটু বড় ক্যানভাস হলে দু মাসও লেগে যায়। তাই দু বছরে তার ছবির সংখ্যা হল মাত্র বাইশ।

এই সময় একদিন মেহ্‌রার কাছ থেকে একটা ফোন এল। ‘কী খবর, অবনীশবাবু? আপনি কি ছবি আঁকা স্টপ করে দিয়েছেন?’ অবনীশ বলল সে এখনও নিয়মিত ছবি আঁকছে। ‘তাহলে একদিন আপনার বাড়ি গিয়ে দেখি আপনার নতুন ছবি।’

মেহরা এলেন এক রবিবার সকালে। অবনীশ তাঁকে তার স্টুডিওতে নিয়ে গেল।

‘এ আপনার কাজ?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন মিঃ মেহ্‌রা।

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘আপনি স্টাইল একদম চেঞ্জ করে ফেলেছেন?’

‘কেমন লাগছে বলুন।’

‘আমি তো নিজে আর্ট বুঝি না। তবে দ্য কালারস আর ভেরি গুড। আজকাল বড় খদ্দেররা এরকম জিনিসই চায়। এগুলোর সঙ্গে তাদের মডার্ন ফার্নিচার খুব ভালো ম্যাচ করে।’

সব ছবির উপর মেহ্‌রা একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। কিছু বেশ বড় ছবিও ছিল। এই বাইশটাতেই যে রূপম্‌ ভরে যাবে তাতে সন্দেহ নেই।

অবনীশের প্রদর্শনীর দিন ঠিক হয়ে গেল। এবারও দশ দিনের মেয়াদ। এই দশদিনে বাইশটার মধ্যে সতেরখানা ছবিই বিক্রি হয়ে গেল। বেপরোয়া হয়ে অবনীশ ছবিগুলোর দাম বেশ চড়াই রেখেছিল; সেই দাম দিতেও লোকে দ্বিধা করল না। যা টাকা এলো, তাতে অবনীশের দু বছরের সংস্থান হয়ে গেল।

আর সমালোচনা? অবনীশ দেখল তার বাবাই ঠিক বলেছিলেন। ‘পথে এসো বাবা!’ লিখেছেন আনন্দ বর্ধন। ‘তবে এই নতুন পথে চলাটা শিল্পীর পক্ষে এখনও সহজ হয়নি। এইভাবে আরও পাঁচ বছর লেগে থাকলে হয়তো অবনীশ বোস শিল্পী আখ্যা পেতে পারেন।’

অবনীশ পত্রিকাটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। সেই সঙ্গে এই ছদ্মনামধারী ব্যক্তিটির আসল পরিচয়টা জানবার আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। নিখিল বলল, ‘‘কৃষ্টি’-র একজনের সঙ্গে আমার আলাপ ছিল। সে যদি এখনও থেকে থাকে, তাহলে তাকে ভজিয়ে ছদ্মনামের পেছনে লোকটা কে সেটা হয়তো জানা যেতে পারে।’

এর মাসখানেক পরে একদিন সকালে অবনীশ তার স্টুডিওতে কাজ করছে, এমন সময় চাকর গোবিন্দ এসে ঘরে ঢুকল।

‘কী ব্যাপার, গোবিন্দ?’ জিজ্ঞেস করল অবনীশ।

‘আজ্ঞে একটি বাবু আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।’

কে এলো আবার? খদ্দের নাকি? ইতিমধ্যে অবনীশের বাড়িতে লোক এসে তার ছবি কিনে নিয়ে গেছে। গুজরাটি ভদ্রলোক।

‘নাম বলেছেন?’

‘আজ্ঞে, না, বললেন জরুরি দরকার।’

‘বসবার ঘরে বসাও, আমি আসছি।’

এপ্রন খুলে নিয়ে একটা ন্যাকড়ায় হাতের রংটা মুছে অবনীশ বৈঠকখানায় গিয়ে হাজির হল। সোফা থেকে একজন চশমা পরা বছর পঁয়ত্রিশের ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন।

নমস্কার করে ভদ্রলোক বললেন, ‘আমার পরিচয় দিলে হয়তো আপনি চিনবেন। আমার নাম হিমাংশু সেনগুপ্ত। আমি অম্বিকা সেনগুপ্তর বড় ছেলে।’

‘আপনার বাবার মৃত্যু সংবাদ সেদিন কাগজে পড়লাম।’

‘আপনি আমার বাবার একটা অয়েল পোর্ট্রেট করেছিলেন।’

‘হ্যাঁ—কিন্তু সে সময় তো আপনাকে দেখিনি।’

‘আমি তখন দিল্লি ছিলাম। আমিও ফিরলাম আর বাবাও গেলেন।’

‘আই সী।’

‘এই পোর্ট্রেটটা নিয়েই একটু কথা বলতে এসেছি।’

‘কী ব্যাপার?’

‘কাল সন্ধ্যায় বাবার স্মৃতিসভা আছে শিশির মঞ্চে। অনেক খুঁজেও বাবার এমন একটাও ফোটো পাইনি যেটা এনলার্জ করে সভায় রাখা যেতে পারে। তাই ভাবছিলাম আপনি যদি একদিনের জন্য আপনার ওই ক্যানভাসটা ধার দেন।’

‘নিশ্চয়ই’, বলল অবনীশ। ‘এ নিয়ে কোনও প্রশ্নই উঠতে পারে না। আপনি কি ওটা এখনই নিয়ে যেতে চান?’

‘হাতের কাছে আছে কি? আমার ঠিক একদিনের জন্য দরকার।’

‘আপনি পাঁচ মিনিট বসুন। আমি নিয়ে আসছি।’

অবনীশ জানত ছবিটা কোথায় আছে। সেটা বার করে আবার ধুলো ঝেড়ে একটা খবরের কাগজে মুড়ে এনে হিমাংশু সেনগুপ্তর হাতে দিল। ভদ্রলোক সেটা নিয়ে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেলেন।

অবনীশ স্টুডিওতে ফিরে যাচ্ছিল, এমন সময় নিখিল এসে ঘরে ঢুকল।

‘কাকে বেরোতে দেখলাম রে?’ প্রশ্ন করল নিখিল।

অবনীশ একটু ম্লান হাসি হেসে বলল, ‘আমার প্রথম অয়েল পোর্ট্রেটের সাবজেক্টের ছেলে। অর্থাৎ অম্বিকা সেনগুপ্তর ছেলে।’

‘বটে? নাম বলেছে?’

‘হ্যাঁ। হিমাংশু।’

‘ছবিটা নিল কেন?’

‘ওঁর বাবার স্মৃতিসভা আছে, ভালো ফোটোগ্রাফ পায়নি, তাই ও পোর্ট্রেটটা রাখবে।’

‘তুই খুব ভুল করেছিস।’

‘কিসে?’

‘ছবিটা দিয়ে।’

‘কেন?’

‘ও-ই বলেছিল মান্ধাতার আমল।’

‘অ্যাঁ!’

‘ইয়েস স্যার। আনন্দ বর্ধন হিমাংশু সেনগুপ্তর ছদ্মনাম।’

অবনীশের মুখ থেকে অবাক ভাবটা কেটে গিয়ে একটা বিশেষ ধরনের হাসি ফুটে উঠল। তারপর চাপা স্বরে কথাটা বেরোল—

‘পথে এসো বাবা, পথে এসো!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *