শিল্পী

শিল্পী

অবনীশ ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। অয়েল পেন্টিং। একজন মাঝবয়সী পুরুষ ভদ্রলোকের পোর্ট্রেট। অবনীশের স্টুডিওর এক কোণায় আরও আট-দশটা ছবির পিছনে দাঁড় করানো ছিল। অবনীশের আঁকা প্রথম অয়েল পোর্ট্রেট। গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে সে দু বছর হল পাশ করে বেরিয়েছে। ছাত্র অবস্থায় অবিশ্যি সে আরও পোর্ট্রেট করেছে। এবং তাতে বেশ নামও হয়েছিল। অবনীশের ইচ্ছা সে ছবি আঁকাকেই পেশা হিসেবে নেবে। কিন্তু কীভাবে শুরু করবে সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।

অবনীশের বাড়িতে তার বাবা মা আছেন। একটি বোন ছিল, তার সম্প্রতি বিয়ে হয়েছে। বাবা হিমাংশু বোস ব্যারিস্টার এবং ভালো প্র্যাকটিস। ছেলেকে তিনি চিরকালই উৎসাহ দিয়ে এসেছেন। তিনি একদিন অবনীশকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই তো আর্টিস্ট হবি?’

‘তাই তো ইচ্ছে আছে’, বলল অবনীশ।

‘তোর আঁকার সরঞ্জাম সব রয়েছে?’

‘কিছু ক্যানভাস, একটা ইজেল, আর কিছু রং কিনতে পারলে ভালো হত।’

‘বেশ তো—কিনবি’খন। কত লাগবে বলিস। আমি টাকা দিয়ে দেব।’

সে সব সরঞ্জাম কেনা হয়ে গেছে, কিন্তু অবনীশ এখনও ছবি আঁকতে শুরু করেনি। ইজেলে সাদা ক্যানভাস খাটানো রয়েছে, তাতেই ছবি ফুটে উঠবে, কিন্তু কবে বা কী ছবি তা অবনীশ এখনও ভেবে পায়নি।

অম্বিকা সেনগুপ্তর পোর্ট্রেট আঁকার আইডিয়াটা নিখিলই দেয়। নিখিল অবনীশের অনেকদিনের বন্ধু, যদিও সে আর্টিস্ট নয়। তারা দুজনে একসঙ্গে স্কুলে পড়েছে। তারপর দুজনের পথ আলাদা হয়ে গেলেও বন্ধুত্ব রয়েই গেছে। নিখিলের বাবা রজনী দত্ত ডাক্তার। নিখিল একদিন এসে সাদা ক্যানভাস দেখে বলল, ‘কিরে, এখনও আঁকা আরম্ভ করিসনি?’

অবনীশ মাথা চুলকে বলল, ‘কী আঁকব সেটা ঠিক করলে তবে তো আঁকা শুরু হবে।’

‘কেন? পোর্ট্রেট। তোর যেটা স্পেশালিটি।’

‘কার পোর্ট্রেট? রাস্তা থেকে লোক ধরে এনে তো পোর্ট্রেট করা যায় না। আর আজকাল ফোটোগ্রাফির যুগে অয়েল পোর্ট্রেট করানোর রেওয়াজ প্রায় উঠেই গেছে।’

‘আমাকে দুদিন ভাববার সময় দে।’

দুদিন বাদে নিখিল এসে অবনীশকে জিজ্ঞেস করল, ‘অম্বিকা সেনগুপ্তর নাম শুনেছিস?’

অবনীশ শোনেনি।

‘স্টিফেন অ্যান্ড গিলফোর্ড কোম্পানির একজন চাঁই। বাবার বিশেষ বন্ধু। একদিন ক্লাবে নাকি আক্ষেপ করে বাবাকে বলেছিলেন, ‘পুরোন রেওয়াজ সব উঠে যাচ্ছে—এটা অত্যন্ত আপসোসের ব্যাপার। বাবার একটা পোর্ট্রেট আছে আমাদের ড্রইং রুমে—পঞ্চাশ বছর আগে বিখ্যাত প্রবোধ চৌধুরীর করা। চমৎকার। ফোটোতে ওই আভিজাত্যই নেই।’ বাবা তাতে বললেন, ‘তুমি একটা নিজের পোর্ট্রেট করাও না। বাধাটা কোথায়?’ সেনগুপ্ত নাকি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, ‘সেরকম আর্টিস্ট কোথায়?’

এ গল্প নিখিল গতকাল বাবার মুখে শোনার পরেই তার মাথায় বুদ্ধিটা খেলে।

‘পোর্ট্রেট তুই খুব ভালো পারবি—একেবারে ভেটারেন আর্টিস্টের মতো। আমি বাবাকে তোর কথা বলেছি। বাবা বলেছেন সেনগুপ্তকে বলবেন।’

তিন দিন বাদে নিখিল আবার অবনীশের কাছে এল। বলল, ‘তোর ডাক পড়েছে।’

‘কোথায়?’

‘সাত নম্বর রয়েড স্ট্রিট। অম্বিকা সেনগুপ্তর বাড়ি।’

‘কবে, কখন যেতে হবে?’

‘রবিবার সকাল নটায়।’

দুরু দুরু বুকে যথাসময়ে অবনীশ গিয়ে হাজির হল সাত নম্বর রয়েড স্ট্রিটে। বেয়ারা বসবার ঘরে বসালো অবনীশকে। তিন মিনিটের মধ্যেই আসল লোকের আবিভাব। সত্যিই ছবি আঁকার মতো চেহারা।

‘তুমি অয়েল পোর্ট্রেট করো?’ ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন।

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘তোমার খুব প্রশংসা করছে আমার বন্ধু ডাক্তার রজনী দত্তর ছেলে। ক’দিন নাও তুমি একটা পোর্ট্রেট করতে?’

‘দিন দশেকের বেশি লাগে না।’

‘তাহলে কালই শুরু করে দাও। আমার আবার কলকাতার পাট গুটিয়ে দিল্লির আপিসে চলে যেতে হতে পারে। আমার এখানেই আসবে। সকাল আটটা থেকে ন’টা পর্যন্ত টাইম দেবো তোমায়। তোমার রেট কত?’

‘আমি তো প্রোফেশনাল কাজ শুরুই করিনি; কাজেই যা ভালো বোঝেন তাই দেবেন।’

‘শ পাঁচেক?’

‘ঠিক আছে।’

‘আরেকটা কথা—তিন দিনের দিন যদি দেখি ছবি আমার পছন্দ হচ্ছে না, তাহলে সেইখানেই থামতে হবে। তোমার এক্সপেনসেস আমি দিয়ে দেবো। তবে স্বভাবতই পুরো পারিশ্রমিক পাবে না।’

এতেও অবনীশ বলল, ‘ঠিক আছে।’

পরের দিনই কাজ শুরু হয়ে গেল। অবনীশকে একটা রিকশা ভাড়া করতে হয়েছিল সরঞ্জাম আনবার জন্য। অম্বিকা সেনগুপ্ত ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় ঠিক আটটার সময় হাজির হলেন বৈঠকখানায়।

‘কোথায় বসাবে আমাকে?’ ভদ্রলোক এসেই জিজ্ঞেস করলেন।

‘আজ্ঞে এই উত্তরের জানালাটার পাশে হলে ভালো হয়। নর্থ লাইটটা পোর্ট্রেটের পক্ষে সবচেয়ে ভালো লাইট।’

‘হাতে বই-টই কিছু লাগে না? পাশে টেবিল থাকবে না?’

‘আজকাল ওসব উঠে গেছে। আমি আপনার যাকে বলে আবক্ষ পোর্ট্রেট করব। আপনি এই চেয়ারটায় বসবেন। দাঁড়াবার দরকার নেই।’

‘বাঃ—এতো তেমন কঠিন ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে না।’

তিন দিনেই দেখা গেল ছবিতে মিস্টার সেনগুপ্তকে চেনা যাচ্ছে। ভদ্রলোক কাজ দেখে অবনীশের পিঠে দুটো মৃদু চাপড় মেরে বললেন, ‘এক্সেলেন্ট! ক্যারি অন। ‘ অবনীশের কাঁধ থেকে একটা বোঝা নেমে গেল।

কিন্তু তার পরের দিনই এক দুঃসংবাদ। ‘তোমাকে আর তিন দিনের বেশি সময় দিতে পারছি না, অবনীশ।’ বললেন অম্বিকা সেনগুপ্ত। ‘আমাকে বুধবার—অর্থাৎ আজ থেকে চারদিন পরে—দিল্লি চলে যেতে হচ্ছে। তলপি-তলপা গুটিয়ে। ক’দিনের জন্য তা বলতে পারব না। বছর দু-এক তো বটেই। আমাকে মাঝে মাঝে আসতে হতে পারে। কিন্তু তার মধ্যে তোমায় সময় দিতে পারব না।’

অবনীশের মনটা ভেঙে গেল। সে নিজেও বুঝতে পারছিল যে কাজটা খুব ভালো এগোচ্ছে। তিন দিনে যে ছবি শেষ হবে না তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

‘তাহলে আপনি কি অসমাপ্ত ছবিই সঙ্গে নিয়ে যাবেন?’

‘সে আর কী করে হয়। যতদূর করতে পার সেই অবস্থাতেই তোমার কাছে থাকবে ছবিটা। অবিশ্যি তোমার পারিশ্রমিক তুমি পাবে।’

তিন দিনে মনের জোরের সঙ্গে হাতের জোর মিলিয়ে অবনীশ ছবির বারো আনা শেষ করে ফেলল। অম্বিকা সেনগুপ্ত এবার দেখে বললেন, ‘ব্রিলিয়ান্ট, ব্রিলিয়ান্ট! তোমার ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল, অবনীশ। আমি টাকা সঙ্গেই এনেছি। এই নাও তোমার পারিশ্রমিক।’

অবনীশ দেখল মিস্টার সেনগুপ্ত তাকে পাঁচশোর জায়গায় সাতটা করকরে একশো টাকার নোট দিয়েছেন।

অম্বিকা সেনগুপ্তর পোর্ট্রেটের পর্ব এখানেই শেষ হল।

এবার অবনীশ তার পেশাদারী শিল্পীজীবনের জন্য তৈরি হল। ছবি এঁকে রোজগার তাকে করতেই হবে। বাপের অনুগ্রহে আর কতদিন চলে? কী ঢঙে ছবি আঁকবে সে; সাবেকী না আধুনিক—সেই নিয়ে তার মনে প্রশ্ন জেগেছে, যদিও তার উত্তর সে এখনও খুঁজে পায়নি।

অম্বিকাবাবুর চলে যাবার মাসখানেক পরে চিত্রকূট গ্যালারিতে আধুনিক ভারতীয় শিল্পীদের একটা প্রদর্শনী হল। অবনীশ গেল দেখতে, এবং দেখে সে হতবাক হয়ে গেল। যে ছবির না আছে মাথা না আছে মুণ্ডু, তার দাম আকাশছোঁয়া। আর সেই দামে লোকে সে ছবি কিনছে বাড়িতে টাঙিয়ে রাখার জন্য। চল্লিশটার মধ্যে উনিশটা ছবির ফ্রেমে লাল গোল কাগজ আঁটা। তার মানে ছবি বিক্রি হয়ে গেছে, অথচ আজ সবে প্রদর্শনীর চতুর্থ দিন।

মিনিট পনেরো থেকে অবনীশ গ্যালারি থেকে বেরিয়ে এল। সে মনস্থির করে ফেলেছে। চুলোয় যাক মডার্ন আর্ট। সে তার নিজের ঢঙেই ছবি আঁকবে—সে ছবি লোকে নিক বা না নিক।

ছ’মাসে অবনীশ বত্রিশখানা ছবি আঁকল। কিছু প্রাকৃতিক দৃশ্য আঁকার জন্য তাকে বাইরেও যেতে হয়েছিল—পুরী, ঘাটশিলা, গ্যাংটক। সে বুঝেছে ল্যান্ডস্কেপেও তার হাত খারাপ নয়।

নিখিল এল একদিন ছবি দেখতে। দেখে-টেখে বলল, ‘দুর্দান্ত হয়েছে তোর ছবি। তবে ভয় হয়ে কী জানিস?—আজকাল ছবির চেহারা আর লোকের রুচি এত পালটে গেছে যে তোর ছবি বাজারে চলবে কি না তাই ভাবছি। তুই এগজিবিশন করবি তো?’

‘ইচ্ছে তো আছে। ছবি বিক্রি না হলে রোজগার হবে কী করে?’

‘একটা গ্যালারির নাম হয়তো তুই শুনেছিস—রূপম্‌। তার মালিক পুরুষোওম মেহ্‌রা বাবার পেশেন্ট। খুব কঠিন ব্যারাম থেকে বাবা ওকে সারিয়ে তুলেছিলেন। মেহ্‌রা মোটামুটি সেকেলে লোক, যদিও ছবি যা দেখায় সবই মডার্ন। আমি ওকে ফোন করে রাখছি। তুই তোর গোটা দু-এক ছবি নিয়ে গিয়ে ওকে দেখা। ভদ্রলোক হয়তো প্রদর্শনী করতে রাজিও হয়ে যেতে পারেন।’

অবনীশ নিখিলের কথা মতো মেহ্‌রার সঙ্গে টেলিফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে তিনটে বাছাই ছবি সঙ্গে নিয়ে ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করল।

মিঃ মেহ্‌রা ছবিগুলোর দিকে মিনিটখানেক তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘এতো দেখছি সবই চিনতে পারছি—মানুষের মতো মানুষ। বাড়ির মতো বাড়ি। গাছের মত গাছ। আজকাল তো আর কেউ এমন আঁকে না।’

অবনীশ মৃদুস্বরে বলল, ‘আজ্ঞে, আমি একমই আঁকতে ভালোবাসি।’

মেহ্‌রা বললেন, ‘দেখেন অবনীশবাবু—আমি আপনাকে ফ্র্যাঙ্কলি বলছি, আমরা নাম-করা আর্টিস্টের ছাড়া কারও ছবি এগজিবিট করি না। ছবি বিক্রি হবে এই গ্যারান্টি আমাদের চাই, কারণ কি ছবি বিক্রির তিন ভাগের এক ভাগ টাকা আমরা কমিশন নিই; এ থেকে আমাদের ব্যবসা চলে। শুধু আমাদের নয়—অল কমার্শিয়াল গ্যালারিজ।‘

‘আর যদি ছবি বিক্রি না হয়?’

‘তাহলে আমাদের লোকসান। বিক্রি হবে জেনেই তো আমরা ওয়েল-নোন আর্টিস্ট ছাড়া কারুর ছবি দেখাই না।’

‘তাহলে আমার ছবি আপনি দেখাবেন না? নৈরাশ্যের সুরে বলল অবনীশ।

মিঃ মেহ্‌রা অবনীশের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মৃদু হেসে বললেন, ‘আপনি অন্য কেউ হলে আপনাকে রিফিউজ করে দিতাম, কিন্তু ডক্টর দত্তর ছেলে আমাকে রিকুয়েস্ট করেছে বলে আমি আপনাকে ফিরিয়ে দিতে পারছি না। তাছাড়া এরকম ছবির মার্কেট আছে কি না সেটাও দেখা যাবে। তবে আপনাকে কিন্তু আমাদের টার্মস মেনে নিতে হবে।’

‘নিশ্চয়ই।’

এই ঘটনার এক মাস পর অবনীশের প্রদর্শনী শুরু হল রূপম্‌ গ্যালারিতে। দশ দিন চলবে, বত্রিশখানা ছবি। তার মধ্যে অম্বিকা সেনগুপ্তর পোর্ট্রেটটাও ছিল, তবে সেটা নট ফর সেল। তার জীবনের প্রথম পেশাদারী কাজ অবনীশ হাতছাড়া করবে না।

প্রদর্শনীতে প্রথম তিন দিন বিশেষ লোক হয়নি। তারপর থেকে দর্শকের সংখ্যা ক্রমে বাড়তে লাগল। অবনীশ অবাক হয়ে দেখল যে তার ছবি বিক্রিও হচ্ছে। প্রথমবার বলে সে ছবির দাম বেশ কমই রেখেছিল, তাও চোদ্দখানা ছবি বিক্রি হয়ে কমিশন বাদে তার হাতে এল সাড়ে চার হাজার টাকা। মিঃ মেহ্‌রাও তাকে কনগ্র্যাচুলেট করলেন এবং কথা দিলেন যে ভবিষ্যতেও রূপম্‌ অবনীশের ছবির এগজিবিশন করবে।

কিন্তু একটা ব্যাপারে অবনীশকে চোট পেতে হল। সেটা হল বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তার প্রদর্শনীর সমালোচনা। বেশির ভাগ সমালোচকই বলেছে যে অবনীশের মস্ত দোষ হল সে সময়ের সঙ্গে তাল রেখে চলছে না। একজন বলেছে, ‘আজ যদি কোনও লেখক বঙ্কিমচন্দ্রের ঢঙে উপন্যাস লেখে তাহলে কি সেটা একটা প্রশংসনীয় ব্যাপার হবে?’

এইসব সমালোচকের নাম অনেকেই জানে না। যার নাম জানে, এবং যার সমালোচনা সকলেই পড়ে সে হল ‘কৃষ্টি’ সাপ্তাহিকের সমালোচক আনন্দ বর্ধন। অবনীশ জানে যে নামটা ছদ্মনাম, কিন্তু এই নামের পিছনে আসল ব্যক্তিটি কে সেটা সে জানে না। এঁর সমালোচনার শিরোনাম হল ‘মান্ধাতার আমল।’ তীরের মতো চোখা চোখা শব্দের ব্যবহারে সমালোচক অবনীশের প্রদর্শনীকে ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছেন। ‘যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে আর্টের চেহারাও যে আমূল পালটেছে, সে খবর যে এই শিল্পী রাখেন না সেটা এঁর ছবিগুলির দিকে এক ঝলক দৃষ্টি দিলেই বোঝা যায়,’ লিখছেন আনন্দ বর্ধন। ‘ক্যানভাস ও তেল রং আজকাল দুর্মূল্য। তাদের এই অপব্যবহার কোনও মতেই বরদাস্ত করা যায় না। প্রদর্শনীর কথা চিন্তা না করে শিল্পী যদি আজকের শিল্পরীতির সঙ্গে পরিচিত হবার প্রয়াস করেন তাহলে হয়তো এঁর একটা ভবিষ্যৎ গড়ে উঠতে পারে, কারণ রং তুলির ব্যবহার যে উনি একেবারে জানেন না তা নয়।’

এই সমালোচনা শুধু অবনীশ নয়, তার বাবা এবং তার বন্ধু নিখিলও পড়ল। বাবা বললেন, ‘শিল্পীকে গালমন্দ করাটা, সমালোচকদের একটা হ্যাবিট, কারণ পাঠক প্রশংসার চেয়ে নিন্দাটা বেশি উপভোগ করে। তুই নিরুদ্যম হোস না।’

নিখিল বলল, ‘এই আনন্দ বর্ধন ছদ্মনামের আড়ালে কে লুকিয়ে রয়েছে সেটা বার করে সেই ব্যক্তিকে ধোলাই দিতে হবে।’

অবনীশ কিন্তু সমস্যায় পড়ে গেল। সে অনুভব করল আনন্দ বর্ধনের বাক্যবাণ অনবরত তার মনে বিঁধছে। সে অত্যন্ত গভীর ভাবে চিন্তা করতে লাগল তার আঁকার ঢং পালটিয়ে সে আধুনিকের দলে চলে আসবে কি না। বার বার সমালোচকের তিরস্কার ও বিদ্রুপ সে সহ্য করতে পারবে না। মডার্ন আর্ট জিনিসটা কী ও কেন, সেটা সে এতদিন জানার চেষ্টা করেনি, এবার করবে।

প্রদর্শনীর পর ছ’টা মাস অবনীশ ছবিই আঁকল না; তার বদলে রোজ ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে গিয়ে মর্ডান আর্ট সম্বন্ধে যত বই পাওয়া যায়, সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল এবং পড়ল। তার ফলে সে জানল যে বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই প্রধানত ফ্রান্সে কিছু শিল্পীর প্রভাবে আর্টের জগতে এক বিপ্লব ঘটে। তার ফলে ছবির চেহারা একেবারে বদলে যায়, এবং বিপ্লবের প্রভাব ক্রমে সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। এই সব বইয়ে তার নিজের ঢং-এর একটি ছবিও খুঁজে পেল না অবনীশ।

এর পরে অবনীশ লাইব্রেরিতে যাওয়া বন্ধ করে ড্রইং-এর খাতায় প্যাস্টেল দিয়ে নতুন রীতিতে ছবি আঁকার চেষ্টা আরম্ভ করল। এভাবে প্রায় ত্রিশখানা খাতা ছবিতে ভরে গেল। ইজেলে সাদা ক্যানভাস খাটানো রয়েছে, কিন্তু তাতে একটা আঁচড়ও পড়েনি।

নিখিল একদিন এসে বলল, ‘কিরে, তুই কি ছবি আঁকা ছেড়ে দিলি নাকি?’

অবনীশ বলতে বাধ্য হল যে সে তার ছবির ভোল পালটে আজকের দিনের শিল্পীদের দলে আসার চেষ্টা করছে।

‘মডার্ন আর্ট তো খুব সোজা,’ বলল নিখিল, ‘একটা ক্যানভাস খাটিয়ে তাতে কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং এঁকে ভরিয়ে দে—ব্যাস্‌। হয়তো হাজার টাকায় বিক্রিও হয়ে যেতে পারে সেই ছবি।’

অবনীশ তার বন্ধুর কথা খুব পছন্দ করল না। সে বুঝেছে মডার্ন আর্ট অত সোজা নয়। সেটা ঠিক ভাবে করতে গেলে শিল্পীর দেশ বিদেশের সাবেকী আর্ট ও লোকশিল্পের সঙ্গে পরিচয় থাকা চাই। সে পরিচয়ের জন্য সময় লাগে, অধ্যবসায় লাগে। তা হোক—অবনীশ বুঝেছে যে তাকে এই পথেই যেতে হবে। আনন্দ বর্ধনকে বলতে হবে—হ্যাঁ, অবনীশ বোস সার্থক শিল্পী। তার ছবিকে আর অবজ্ঞা করা চলে না।

দু বছর ধরে অবনীশ আধুনিক ছবি আঁকল। একবার ইজেলে ক্যানভাস খাটিয়ে অয়েল পেন্টিং। এই সময়ের মধ্যে স্বভাবতই তার কোনও রোজগার হয়নি। বাবা আবার তাকে সাহায্য করলেন। বললেন, ‘তোর ছবি এখন আর বুঝতে পারছি না, কিন্তু এটা বুঝেছি যে তুই একটা তাগিদ অনুভব করছিস। তুই যদ্দিন আবার এগজিবিশন না করছিস, তদ্দিন কী খরচ লাগছে না-লাগছে সেটা আমাকে জানাতে দ্বিধা করিস না’ অবনী বুঝল এমন বাপ না থাকলে তার শিল্পী জীবন এখানেই শেষ হয়ে যেত।

আজকাল অবনীশের এক-একটা ছবি আঁকতে বেশ সময় লাগে। একটু বড় ক্যানভাস হলে দু মাসও লেগে যায়। তাই দু বছরে তার ছবির সংখ্যা হল মাত্র বাইশ।

এই সময় একদিন মেহ্‌রার কাছ থেকে একটা ফোন এল। ‘কী খবর, অবনীশবাবু? আপনি কি ছবি আঁকা স্টপ করে দিয়েছেন?’ অবনীশ বলল সে এখনও নিয়মিত ছবি আঁকছে। ‘তাহলে একদিন আপনার বাড়ি গিয়ে দেখি আপনার নতুন ছবি।’

মেহরা এলেন এক রবিবার সকালে। অবনীশ তাঁকে তার স্টুডিওতে নিয়ে গেল।

‘এ আপনার কাজ?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন মিঃ মেহ্‌রা।

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘আপনি স্টাইল একদম চেঞ্জ করে ফেলেছেন?’

‘কেমন লাগছে বলুন।’

‘আমি তো নিজে আর্ট বুঝি না। তবে দ্য কালারস আর ভেরি গুড। আজকাল বড় খদ্দেররা এরকম জিনিসই চায়। এগুলোর সঙ্গে তাদের মডার্ন ফার্নিচার খুব ভালো ম্যাচ করে।’

সব ছবির উপর মেহ্‌রা একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। কিছু বেশ বড় ছবিও ছিল। এই বাইশটাতেই যে রূপম্‌ ভরে যাবে তাতে সন্দেহ নেই।

অবনীশের প্রদর্শনীর দিন ঠিক হয়ে গেল। এবারও দশ দিনের মেয়াদ। এই দশদিনে বাইশটার মধ্যে সতেরখানা ছবিই বিক্রি হয়ে গেল। বেপরোয়া হয়ে অবনীশ ছবিগুলোর দাম বেশ চড়াই রেখেছিল; সেই দাম দিতেও লোকে দ্বিধা করল না। যা টাকা এলো, তাতে অবনীশের দু বছরের সংস্থান হয়ে গেল।

আর সমালোচনা? অবনীশ দেখল তার বাবাই ঠিক বলেছিলেন। ‘পথে এসো বাবা!’ লিখেছেন আনন্দ বর্ধন। ‘তবে এই নতুন পথে চলাটা শিল্পীর পক্ষে এখনও সহজ হয়নি। এইভাবে আরও পাঁচ বছর লেগে থাকলে হয়তো অবনীশ বোস শিল্পী আখ্যা পেতে পারেন।’

অবনীশ পত্রিকাটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। সেই সঙ্গে এই ছদ্মনামধারী ব্যক্তিটির আসল পরিচয়টা জানবার আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। নিখিল বলল, ‘‘কৃষ্টি’-র একজনের সঙ্গে আমার আলাপ ছিল। সে যদি এখনও থেকে থাকে, তাহলে তাকে ভজিয়ে ছদ্মনামের পেছনে লোকটা কে সেটা হয়তো জানা যেতে পারে।’

এর মাসখানেক পরে একদিন সকালে অবনীশ তার স্টুডিওতে কাজ করছে, এমন সময় চাকর গোবিন্দ এসে ঘরে ঢুকল।

‘কী ব্যাপার, গোবিন্দ?’ জিজ্ঞেস করল অবনীশ।

‘আজ্ঞে একটি বাবু আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।’

কে এলো আবার? খদ্দের নাকি? ইতিমধ্যে অবনীশের বাড়িতে লোক এসে তার ছবি কিনে নিয়ে গেছে। গুজরাটি ভদ্রলোক।

‘নাম বলেছেন?’

‘আজ্ঞে, না, বললেন জরুরি দরকার।’

‘বসবার ঘরে বসাও, আমি আসছি।’

এপ্রন খুলে নিয়ে একটা ন্যাকড়ায় হাতের রংটা মুছে অবনীশ বৈঠকখানায় গিয়ে হাজির হল। সোফা থেকে একজন চশমা পরা বছর পঁয়ত্রিশের ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন।

নমস্কার করে ভদ্রলোক বললেন, ‘আমার পরিচয় দিলে হয়তো আপনি চিনবেন। আমার নাম হিমাংশু সেনগুপ্ত। আমি অম্বিকা সেনগুপ্তর বড় ছেলে।’

‘আপনার বাবার মৃত্যু সংবাদ সেদিন কাগজে পড়লাম।’

‘আপনি আমার বাবার একটা অয়েল পোর্ট্রেট করেছিলেন।’

‘হ্যাঁ—কিন্তু সে সময় তো আপনাকে দেখিনি।’

‘আমি তখন দিল্লি ছিলাম। আমিও ফিরলাম আর বাবাও গেলেন।’

‘আই সী।’

‘এই পোর্ট্রেটটা নিয়েই একটু কথা বলতে এসেছি।’

‘কী ব্যাপার?’

‘কাল সন্ধ্যায় বাবার স্মৃতিসভা আছে শিশির মঞ্চে। অনেক খুঁজেও বাবার এমন একটাও ফোটো পাইনি যেটা এনলার্জ করে সভায় রাখা যেতে পারে। তাই ভাবছিলাম আপনি যদি একদিনের জন্য আপনার ওই ক্যানভাসটা ধার দেন।’

‘নিশ্চয়ই’, বলল অবনীশ। ‘এ নিয়ে কোনও প্রশ্নই উঠতে পারে না। আপনি কি ওটা এখনই নিয়ে যেতে চান?’

‘হাতের কাছে আছে কি? আমার ঠিক একদিনের জন্য দরকার।’

‘আপনি পাঁচ মিনিট বসুন। আমি নিয়ে আসছি।’

অবনীশ জানত ছবিটা কোথায় আছে। সেটা বার করে আবার ধুলো ঝেড়ে একটা খবরের কাগজে মুড়ে এনে হিমাংশু সেনগুপ্তর হাতে দিল। ভদ্রলোক সেটা নিয়ে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেলেন।

অবনীশ স্টুডিওতে ফিরে যাচ্ছিল, এমন সময় নিখিল এসে ঘরে ঢুকল।

‘কাকে বেরোতে দেখলাম রে?’ প্রশ্ন করল নিখিল।

অবনীশ একটু ম্লান হাসি হেসে বলল, ‘আমার প্রথম অয়েল পোর্ট্রেটের সাবজেক্টের ছেলে। অর্থাৎ অম্বিকা সেনগুপ্তর ছেলে।’

‘বটে? নাম বলেছে?’

‘হ্যাঁ। হিমাংশু।’

‘ছবিটা নিল কেন?’

‘ওঁর বাবার স্মৃতিসভা আছে, ভালো ফোটোগ্রাফ পায়নি, তাই ও পোর্ট্রেটটা রাখবে।’

‘তুই খুব ভুল করেছিস।’

‘কিসে?’

‘ছবিটা দিয়ে।’

‘কেন?’

‘ও-ই বলেছিল মান্ধাতার আমল।’

‘অ্যাঁ!’

‘ইয়েস স্যার। আনন্দ বর্ধন হিমাংশু সেনগুপ্তর ছদ্মনাম।’

অবনীশের মুখ থেকে অবাক ভাবটা কেটে গিয়ে একটা বিশেষ ধরনের হাসি ফুটে উঠল। তারপর চাপা স্বরে কথাটা বেরোল—

‘পথে এসো বাবা, পথে এসো!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শিল্পী
2 of 3

শিল্পী

শিল্পী

দুপুরে খাওয়া-দাওয়া হয়েছে প্রচুর, তারপর একটু ঘুম দিলে মন্দ হয় না। কিন্তু তার উপায় নেই।

বাইরে কোথাও বেড়াতে এলে সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত পিকনিকের মেজাজ, এর মধ্যে ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করার মানে হয় না।

স্থান মধ্যপ্রদেশ, চতুর্দিকে জঙ্গল ও ছোট-ছোট পাহাড়, তার মাঝখানে এই সুদৃশ্য অতিথিভবন, অনেকগুলি ঘর। সামনে অনেকখানি ফুলের বাগান আর প্রকৃতির সুষমা দেখলে বোঝাই যায় না যে এর কাছাকাছি রয়েছে মস্ত ইস্পাত কারখানা, কয়লাখনি ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। অতিথিভবনটি ওইরকমই কোনও সংস্থার। আরামের উপকরণের কোনও অভাব নেই। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, দুপুর দুটোয় কিংবা রাত এগারোটাতেও চা চাইলে পাওয়া যায়।

সত্যি, এটাতেই বেশি আশ্চর্য হয়েছেন সুকুমার চৌধুরী। তাঁর দারুণ চায়ের নেশা। দিনে দশ বারো কাপ তো লাগেই। তিনি মদ্যপান করেন না। সন্ধের পর অন্যরা যখন মদের বোতল নিয়ে বসে, সুকুমার চৌধুরীর জন্য চা আসে ঘনঘন।

বহু জায়গায়, অনেকরকম ডাকবাংলো ও অতিথিভবনে তিনি থেকেছেন। সব জায়গাতেই নিয়মকানুনের কড়াকড়ি। সকালে চা দিলে বেলা দশটার পর আর পাওয়া যাবে না। দুপুরে প্রশ্নই নেই। রাত নটার মধ্যে খাওয়াদাওয়া সেরে নিতে হবে, নইলে বন্ধ হয়ে যাবে রান্নাঘর। ঠান্ডা খাবার চাপা দেওয়া থাকবে টেবিলে, পরিচারকদের ডিউটি অফ হয়ে যাবে!

এখানে কাল রাত্তিরে সবাই আড্ডা থামিয়ে খেতে বসেছিল রাত পৌনে একটায়, তখনও সব গরম-গরম। পরিচারকরা খাতির করে বলেছিল, আর-একটু মাংস নিন, পাঁপড়ভাজা এনে দেব স্যার?

অন্য কোথাও এরকম ব্যবহার অকল্পনীয়। অবশ্য এই অতিথিশালার ম্যানেজার বাঙালি, দুজন পরিচারকও বাংলায় কথা বলে। কিন্তু বাঙালিরা খুব অতিথিপরায়ণ নাকি? খোদ পশ্চিম বাংলার গেস্ট হাউস, ট্যুরিস্ট লজগুলোতে অনেক সময় এক গেলাস জল চাইলেও দু-ঘণ্টা লেগে যায়। মশারির দড়ি থাকে না।

প্রবাসে বাঙালির স্বভাবও বদলে যায়।

এত বড়-বড় সংস্থায় কাজ করে অনেক বাঙালি, সব মিলিয়ে বাঙালির সংখ্যা সাড়ে আটশো। সুতরাং বাঙালিদের নিজস্ব ক্লাব থাকবেই এবং দুর্গাপুজোও হবে। এখনও দলাদলিতে দু-ভাগ হয়নি।

বছরে একবার সাংস্কৃতিক উৎসবও হয়, সবাই আজকাল যাকে বলে কালচারাল ফাংশান। কলকাতা থেকে নাচ-গান-বাজনার শিল্পীদের আনানো হয়, এবং আবৃত্তিকার, দু-একজন সাহিত্যিক।

যাওয়া-আসার জন্য অনেকটা সময় লাগে, ট্রেন ছাড়া গতি নেই। তবু কলকাতার শিল্পীমহলে জানাজানি হয়ে গেছে যে মধ্যপ্রদেশের ওই বাঙালি ক্লাবের আমন্ত্রণে খাতিরত্ন পাওয়া যায় খুব, বেড়াবারও সুযোগ অনেক। তাই প্রায় সকলেই আগ্রহের সঙ্গে রাজি হয়।

সুতরাং এবারে যে এগারোজন এসেছেন, তাঁরা সারাদিন পিকনিকের মেজাজে থাকলেও কেউ কারুর আত্মীয় নন, কলকাতায় সারাবছর হয়তো অনেকের সঙ্গে দেখাই হয় না। কিন্তু এখানে এসে প্রথম দিন থেকেই ভাব জমে যায়।

প্রীতম অনেক ছায়াছবি ও টিভি ধারাবাহিকের ব্যস্ত নায়ক, কিন্তু এখানে ছুটির আনন্দে হইহই করছে সবসময়। কখনও সে নদীতে স্নান করতে যাচ্ছে, কখনও ব্যাডমিন্টন খেলছে বাগানে, কখনও মেতে যাচ্ছে তাস খেলায়। সে যে খালি গলায় এত ভালো লোকসঙ্গীত গাইতে পারে, তা কারুর জানা ছিল না। নীপা নাম্নী গায়িকাটির হাসির গল্পের স্টক অফুরন্ত। সে পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মদ্যপানও করতে পারে।

ঔপন্যাসিক সুকুমার চৌধুরী এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক, তিনিই দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানের মূল সভাপতি। ধীর, স্থির মানুষ, বেশি কথা বলেন না, কিন্তু চায়ের কাপ নিয়ে আড্ডায় বসে থাকেন শেষপর্যন্ত। তিনি মদ্যপান না করলেও সেটা পুষিয়ে দিয়েছে কবি অরিন্দম সেনগুপ্ত। সকাল দশটা বাজতে-না-বাজতেই সে বিয়ারের বোতলে চুমুক দেয়। বাঙালি লেখকদের মধ্যে গদ্যকারদের তুলনায় কবিদেরই মদের প্রতি আসক্তি বোধহয় বেশি।

সুকুমার চৌধুরী সিগারেটটা শেষ করে একটুখানি শুতে যাবেন ভেবেছিলেন, অরিন্দম তাঁকে ডেকে নিয়ে গেল আবৃত্তিকার সুরঞ্জনের ঘরে। সেখানে জমিয়ে তাস খেলা চলছে।

সুরঞ্জন সুকুমারকে বলল, স্যার, আপনি ভালো ব্রিজ খেলেন শুনেছি। বসুন না আমাদের সঙ্গে। সুকুমারের ব্রিজ খেলার দুর্বলতা আছে। তিনি আপত্তি করলেন না।

অরিন্দম নিজে অবশ্য তাস খেলে না। ভাত খাওয়ার পরেও তার হাতে তৃতীয় বিয়ারের বোতল। সে বলল, সুকুমারদা তো তাসখেলা শিখছেন প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাছে, তাই না?

সুকুমার বললেন, প্রেমেনদা দারুণ তাস খেলতেন। কিন্তু বুদ্ধদেব বসু তাস খেলা দু-চক্ষে দেখতে পারতেন না। জীবনানন্দ দাশও না। কবিরা তাস খেলে না। খানিকক্ষণ পরেই আর দুটি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এ-ঘরে ঢুকে পড়ল নীপা।

রীতিমতন ধমকের সুরে সে বলল, এত চমৎকার দিনটায় আপনারা ঘরে বসে-বসে শুধু তাস খেলছেন। চলুন, বেড়াতে চলুন!

প্রীতম বলল, এই রোদ্দুরের মধ্যে কোথায় বেড়াতে যাব? নী

পা বলল, শীতকালের রোদ্দুর কী মিষ্টি! উঠুন, উঠুন!

অরিন্দম বলল, শীতকালে বেড়াতে হয় সন্ধেবেলা। চাদর মুড়ি দিয়ে তোমার কাঁধে হাত রেখে বেড়াব!

নীপা বলল, সন্ধেবেলা তো ফাংশান!

প্রীতম বলল, ফাংশান আর কতক্ষণ? এই, কেউ বেশি গান গাইবে না, বড়জোর দু-তিনখানা। সুকুমারদা, আপনি প্লিজ লম্বা বক্তৃতা দেবেন না!

সুকুমার বললেন, আমি জীবনে কখনও দশ মিনিটের বেশি বলি না। তোমরা অরিন্দমকে সামলাও। ও এখন দারুণ পপুলার, শ্রোতারা অনুরোধ করবে, ও দশ-বারোটা কবিতা পড়ে যাবে!

অরিন্দম হাসতে-হাসতে বলল, যদি ততক্ষণ আমার জ্ঞান থাকে। তা ছাড়া, আমি আজ পড়বই না। কাল দেখা যাবে। আজ তোমরা তাড়াতাড়ি ফাংশান শেষ করবে। তারপর আমরা জঙ্গলে বেড়াতে যাব!

প্রীতম বলল, তখন, জঙ্গলে, কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা! নীপা, আমার সঙ্গে হারিয়ে যেতে রাজি আছ?

নীপা বলল, ইস! এই জঙ্গলে ভাল্লুক আছে শুনেছি। তার পরেও অবশ্য বেড়াতে যাওয়া হল না। শুরু হয়ে গেল গল্প।

একটু পরে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল বিশ্বজিৎ। সে এখানকার বাঙালি ক্লাবের সেক্রেটারি। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, সুন্দর চেহারা, খুবই সপ্রতিভ। সে যেমন সকলের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দেখাশুনো করছে, তেমনই ব্যবস্থা করছে অনুষ্ঠানের, আবার ফাঁকে-ফাঁকে অফিসেও ঘুরে আসছে।

বিশ্বজিৎ হাত জোড় করে বলল, আপনাদের কারুর কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো? বিশেষ করে অরিন্দমের দিকে চেয়ে বলল, দাদা, যখন যা লাগবে চেয়ে নেবেন!

নীপা বলল, ওকে দিনের বেলা অত বিয়ার খেতে দেবেন না। রাত্তিরে তো আছেই।

অরিন্দম বলল, চোপ! আমি কতটা কী খাব, তাতে তোর কী রে?

নীপা বলল, বিশ্বজিৎ, আমরা জঙ্গলে বেড়াতে যাব না!

বিশ্বজিৎ বলল, নিশ্চয়ই। কাল ফাংশান হয়ে যাক, পরশু সবাই মিলে—এ সি বাস ব্যবস্থা করে রেখেছি।

প্রীতম বলল, পরশু থাকতে হবে? আমি পারব না।

বিশ্বজিৎ বলল, তার আগে ছাড়ছিই না।

একটু থেমে, মুখটা কাচুমাচু করে বিশ্বজিৎ বলল, সবাইকে একটা অনুরোধ করব? আজ বিকেল সাড়ে পাঁচটার সময় আমাদের এম ডি আপনাদের সঙ্গে আলাপ করতে আসবেন। একসঙ্গে চা। খেতে চান। সেই সময়টায় আপনারা সবাই থাকবেন? বেশিক্ষণ না, আধঘণ্টা।

প্রীতম বলল, সাড়ে পাঁচটা তো চা খাবারই সময়। ঠিক আছে, সবাই থাকব।

বিশ্বজিৎ অরিন্দমকে বলল, দাদা, সেই সময়টা যদি বিয়ারের বোতলটা নীচে নামিয়ে রাখেন! বুঝতেই তো পারছেন, এম ডি আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা! ফিনান্সটাও ওঁর হাতে। উনি ওকে না করলে এই ফাংশান করাই যেত না। উনি খুব ব্যস্ত লোক, তবু বলেছেন আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করতে চান!

নীপা বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি তখন অরিন্দমের কাছ থেকে বিয়ারের বোতল সরিয়ে রাখব।

বোঝাই গেল, বিশ্বজিৎ চায়, এম ডি-কে যেন সবাই খাতির করে। সৌজন্য দেখায়।

সাড়ে পাঁচটার অনেক আগেই ডাইনিং হলে পাতা হল পরপর পাঁচটা টেবিল। তার ওপরে ধপধপে চাদর। পরিচারকরা সবাই ফিটফাট পোশাক পরেছে। ম্যানেজার মহাদেব নিজের হাতে সাজাচ্ছে চেয়ার।

টেবিলের ওপর রাখা হতে লাগল প্লেট ভরতি-ভরতি কাজুবাদাম, নানারকম কেক পেস্ট্রি, সন্দেশ, চানাচুর।

অতিথিরা সবাই এসে বসেছে চেয়ারে, মেয়েরা এর মধ্যে নতুনভাবে সেজেগুঁজে নিয়েছে। অরিন্দমের চোখ লাল, কিন্তু হাতে বিয়ারের বোতল নেই, আছে জ্বলন্ত সিগারেট। টেবিলে অ্যাশট্রে নেই।

বিশ্বজিৎ নিজে একটা অ্যাশট্রে তার সামনে এনে বলল, এই সিগারেটটা শেষ করে নিন, তারপর খানিকক্ষণ মানে, এম ডি সাহেব ধোঁয়া সহ্য করতে পারেন না।

সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল, পৌনে ছটা, এম ডি-র দেখা নেই। সবচেয়ে বেশি ছটফট করছেন সুকুমার চৌধুরী। টেবিলে চায়ের সব সরঞ্জাম প্রস্তুত, অথচ তিনি চা খেতে পারছেন না। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।

এক-একটা গাড়ি এসে থামছে বাইরে, অমনি ছুটে যাচ্ছে বিশ্বজিৎ। কোনওটাই সেই মহামান্য ব্যক্তিটির নয়।

এবার সবাই ছটফট করতে শুরু করেছে। এম ডি কখন আসবেন, সেজন্য সবাইকে চুপ করে বসে থাকতে হবে?

ঠিক ছটায় সময় এম ডি-র সচিব টেলিফোনে জানালেন, তাঁর প্রভু বিশেষ কাজে আটকে গেছেন, আসতে পারছেন না। অতিথিরা যেন চা খেয়ে নেন। অরিন্দম আপন মনে বলে উঠল, ধুর শালা!

আবৃত্তিকার সুরঞ্জন বিশ্বজিৎকে বলল, দেখুন, এখানে অনেকেই রয়েছেন, বিশেষত সুকুমার চৌধুরী অত্যন্ত বিখ্যাত মানুষ তাঁকে এভাবে এতক্ষণ বসিয়ে রাখাটা কি ঠিক?

সুকুমার চৌধুরী অপমানিত বোধ করছেন, মুখে কিছু বললেন না। প্রীতম এমন মুখের ভাব করল, যেন সে-ও কম বিখ্যাত নয়!

বিশ্বজিৎ ওদের কাছে এসে হাত জোড় করে কাতরভাবে বলল, কিছু মনে করবেন না, আমাকে যত ইচ্ছে গালাগালি দেবেন, মানে, উনি খুবই ব্যস্ত, উনি নিজেই বলেছিলেন—

প্রীতম গম্ভীরভাবে জিগ্যেস করল, এম ডি-র নামটা কী?

বিশ্বজিৎ বলল, এ এন ব্যানার্জি, উনি বাঙালি বলেই বিশেষ করে…

অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা সাড়ে ছটায়। স্টেজ সাজানো হয়ে গেছে, দর্শকও এসে গেছে অনেক। এরা চা খেয়ে নিল তাড়াতাড়ি।

তবু অনুষ্ঠান শুরু হল না। ওই এম ডি-ই সভাপতি, তিনি এসে প্রদীপ জ্বালবেন, উদ্বোধনী ভাষণ দেবেন।

আবার অপেক্ষা। তিনি আসছেন না। কোনও খবর নেই। সামনের সারিতে বসে অরিন্দম বলল, এখনও আরম্ভ হচ্ছেনা, কত রাতে শেষ হবে, অ্যাঁ? আমি কিন্তু আবার মাল খাওয়া শুরু করব।

উৎকণ্ঠিতভাবে ছুটোছুটি করছে বিশ্বজিৎ, শ্রোতারাও অনেকে চঞ্চল। মঞ্চে এখনও পরদা ফেলা। তার আড়ালে শোনা যাচ্ছে ফিসফাস।

সুরঞ্জন সুকুমার চৌধুরীকে বলল, এইসব ধ্যাড়ধ্যেড়ে গোবিন্দপুরে এম ডি-রাই রাজা। এরা শিল্পীদের সম্মান দিতে জানে না। কিন্তু আসলে তো এই লোকটি একজন চাকরিজীবী, যত বড়ই চাকরি হোক। সমাজে ওদের কে চেনে?

সুকুমার গম্ভীরভাবে বললেন, আজকাল তো ওদের হাতেই সব ক্ষমতা।

সুরঞ্জন বলল, ক্ষমতা মানে টাকার ক্ষমতা। রিটায়ার করার পর এঁদের কে পুঁছবে? আপনাকে বহুকাল মানুষ মনে রাখবে। এইসব এম ডি ফেম ডি-দের কোনও রাইট নেই আমাদের এইভাবে বসিয়ে রাখার। চলুন, আমরা উঠে যাই।

প্রীতম বলল, আমরা তো বিশ্বজিতের মুখ চেয়েই এসেছি। এত কম টাকায় আমি কোথাও যাই না।

নীপা বলল, আমার রবীন্দ্রসদনে প্রোগ্রাম ছিল, সেটা ছেড়ে চলে এসেছি–

স্টেজের পাশ থেকে লাফিয়ে নেমে বিশ্বজিৎ সুকুমার চৌধুরীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে ফিসফিস করে বলল, দাদা, আমাদের এম ডি আসতে পারছেন না, আরও দেরি হবে। আপনিই উদ্বোধনটা করে দেবেন?

সুকুমার কঠিন গলায় বললেন, না। আমি অন্য কারুর প্রক্সি দিই না।

ঠিক বুঝতে না পেরে বিশ্বজিৎ আবার বলল, আপনি প্রদীপটা জ্বেলে দিন, তারপর প্রোগ্রাম শুরু করে দেব।

সুকুমার বলল, অন্য কারুর উদ্বোধন করার কথা ছিল, তার বদলে সুকুমার চৌধুরী কখনও যায় না।

সুকুমারকে কিছুতেই রাজি করানো গেল না। অগত্যা দর্শকদের মধ্য থেকে তুলে নেওয়া হল এক ডিভিশনাল ম্যানেজার আগরওয়ালকে। তিনিই উদ্বোধন করলেন। ভদ্রলোক ভাঙা-ভাঙা বাংলা জানেন, বাংলার সংস্কৃতির প্রভূত প্রশংসা করে শরৎচন্দ্র বিষয়ে বলতে লাগলেন অনেকখানি। তারপর স্থানীয় শিল্পীদের সমবেত গান ও আবৃত্তি দিয়ে শুরু হল অনুষ্ঠান।

কলকাতার শিল্পীদের মেজাজ বিগড়ে আছে। সবাই ঠিক করেছিল খুব সংক্ষেপে সেরে দেবে। কিন্তু শ্রোতাদের সামনে ফাঁকি দিতে পারল না।

নীপা গান গাইল সাতখানা। প্রীতম নানারকম অভিনয় করে দেখাল আধঘণ্টা ধরে। এমনকি অরিন্দমও কবিতা পড়ল অনেকগুলো। শুধু সুকুমার চৌধুরী বক্তৃতা দিলেন ঠিক নমিনিট।

পৌনে নটা বেজে গেল। এরপর আছে এখানকার বেঙ্গলি ক্লাবের একটা থিয়েটার। সেটা না দেখলেও চলবে।

কলকাতা শিল্পীরা মঞ্চ থেকে নেমে এগিয়ে যাচ্ছে অতিথি ভবনের দিকে। এই সময় এক সঙ্গে দুটো গাড়ি এসে থামল, অমনি হুড়োহুড়ি পড়ে গেল স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে।

নিশ্চিত কোনও ভি আই পি এসেছে।

অরিন্দম বলল, এখন যদি ওই শালা এম ডি-টা এসে থাকে, আমি কিন্তু ওর সঙ্গে দেখা করতে রাজি নই।

সুরঞ্জন হাসতে-হাসতে বলল, অরিন্দম অনেকক্ষণ ধৈর্য ধরে থেকেছে। এখন ওকে অবশ্যই বোতল দেওয়া উচিত।

সুকুমার বললেন, আমি স্নান করতে যাব। রাত্তিরে আর-একবার স্নান করা আমার অভ্যেস।

প্রীতম তিনটি মেয়ের দিকে তাকাল, দুষ্টুমির স্বরে বলল, এই অন্ধকারে বেড়াতে যাবে নাকি। যদি ভাল্লুক আসে, আমি হিন্দি ফিল্মের হিরোদের মতন ফাইট করব।

পরিচারকরা দৌড়োদৌড়ি করে খাবার ঘরের টেবিলগুলো আবার সাজাচ্ছে। বিশ্বজিৎ বলল, সুকুমারদা, এম ডি এসে গেছেন। তিনি আপনাদের সঙ্গে চা খাবেন বলছেন।

কয়েকজন একসঙ্গে বলে উঠল, এখন চা?

বিশ্বজিৎ অপরাধীর মতন বলল, উনি অ্যালকোহল টাচ করেন না। বেশিক্ষণ লাগবে না। ওঁর সঙ্গে এককাপ চা খাবেন, তারপর আমাদের আড্ডা তো আছেই।

সুকুমার বললেন, আমি এককাপ চা খাব ঠিকই, কিন্তু নিজের ঘরে বসে।

বিশ্বজিৎ তাঁর হাত জড়িয়ে ধরে বলল, সুকুমারদা, প্লিজ, প্লিজ!

নীপা, শান্তা, বিশাখারা একেবারেই রাজি নয়। সুরঞ্জন বলল, বিশ্বজিৎ এটা বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। আমাদের মানসম্মান নেই?

বিশ্বজিৎ বারবার বলতে লাগল, প্লিজ, প্লিজ, দশ মিনিটের জন্য।

প্রীতমই বিশ্বজিতের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে এগিয়ে এল।

সে দু-হাত তুলে বলল, আর মাত্র দশ-পনেরো মিনিট আমরা অপেক্ষা করতে পারব না? বিশ্বজিৎ বেচারা ফলস পজিশানে পড়ে যাবে।

সুরঞ্জন বলল, দশ-পনেরো মিনিটের প্রশ্ননয়। একজন বুরোক্রাটের এরকম অপমানজনক ব্যবহার শিল্পীরা কেন সহ্য করবে? লোকটা আবার বাঙালি? ছিঃ!

প্রীতম বলল, বিশ্বজিৎও তো বুরোক্রাট। ও যে কত ভালো ব্যবহার করছে। আমার বিশেষ অনুরোধ, আসুন আমরা একটুখানি বসে যাই।

প্রীতমের এতখানি আগ্রহ দেখে অন্যরা আর আপত্তি করতে পারল না।

অরিন্দম বলল, আমি বসব, কিন্তু চা খাব না।

সবাই গিয়ে বসল, আগেকার যে-যার চেয়ারে। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকলেন এম ডি। তাঁকে দেখে বাঙালি বলে মনেই হয় না। দীর্ঘকায়, মুখে ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি, রং খুব ফরসা, নিখুঁত সুট পরা। ভুরু তোলা অহঙ্কারী ভাব। স্ত্রীটিও খুব রূপসী, সম্ভবত পাঞ্জাবি, স্কার্ট পরা।

নমস্কার করতে-করতে ঢুকলেন দুজনে। এম ডি ইংরিজিতে বলতে লাগলেন, আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি, ঠিক সময় আসতে পারিনি, দিল্লি থেকে হঠাৎ একজন মিনিস্টার এসে পড়েছিলেন—

অন্য কেউ কোনও সাড়া শব্দ করল না। বিশ্বজিৎ একে-একে পরিচয় করিয়ে দিল সকলের সঙ্গে।

এম ডি নমস্কার করতে-করতে ইংরেজিতে দু-একটা ভদ্রতার কথা বলতে লাগলেন। পেছনে পেছনে তাঁর স্ত্রী। তাঁর ঠোঁটে স্থায়ী হাসি আঁকা।

পরিচারকরা কাপে চা ঢালছে। সুরঞ্জন ফিসফিস করে নীপাকে বলল, নামেই বাঙালি, বাংলা ফাংলা বোধহয় ভুলে গেছে।

নীপা বলল, বড় অফিসার হলেই ইংরিজি বলতে হয়। নিজের মায়ের সঙ্গে কী ভাষায় কথা বলে?

সুরঞ্জন বলল, বউ নিশ্চয়ই বাংলা জানে না।

অরিন্দম বেশ জোরে-জোরেই বলল, না, না, আমি চা খাব না।

তারপর সে টেবিল থেকে উঠে গিয়ে ওপরে ওঠার সিঁড়িতে গিয়ে বসল, একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলল।

বিশ্বজিৎ চোখ দিয়ে আপত্তি জানাচ্ছে, অরিন্দম তা গ্রাহ্য করল না। কেউ কোনও কথা বলছে না। এম ডি-র স্ত্রী নীপাদের সঙ্গে ভাব করতে এল, কিন্তু তাঁর কথা শুনলেই বোঝা যায়, তিনি এইসব বাঙালি শিল্পীদের কারুরই নাম জানেন না।

হঠাৎ অরিন্দম বলে উঠল, আপনার নাম এ এন ব্যানার্জি-মানে পুরো নামটা কী বলুন তো?

এম ডি উত্তর দেওয়ার আগেই বিশ্বজিৎ জানাল, অমরনাথ, অমরনাথ ব্যানার্জি।

অরিন্দম বলল, অমরনাথ? আপনাকে চেনা-চেনা লাগছে। আগে কলকাতা ছিলেন?

এম ডি সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকালেন।

এবার সুদর্শন বিস্ময়ের সঙ্গে বলে উঠলেন, অমরনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। হ্যাঁ, আমারও চেনা লাগছে। আমি আপনাকে দেখেছি। আপনার ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি ছিল না তখন, অনেক দিন আগে। আমার যদি ভুল না হয়, আপনি কি গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয় করতেন?

এবারেও অমরনাথ কিছু বলার আগেই বিশ্বজিৎ বলল, না, না, স্যার অনেকদিন ইংল্যান্ডে ছিলেন। তারপর হাঙ্গেরিতে।

তাকে থামিয়ে দিয়ে অমরনাথ এই প্রথম পরিষ্কার বাংলায় বললেন, হ্যাঁ, আমি কিছুদিন বহুরূপীতে অভিনয় করেছি।

অরিন্দম বলল, অফ কোর্স, বিসর্জন নাটকে। আমি দেখেছি। আমার মনে আছে।

সুরঞ্জন বলল, আমি বহুরূপীর বিসর্জন দেখেছি বহরমপুরে। তাতেও আপনি অভিনয় করেছিলেন না?

এবার অমরনাথের মুখে একটা ফ্যাকাসে হাসি ফুটে উঠল। মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, সেসব কবেকার কথা। আপনারা মনে রেখেছেন?

সুরঞ্জন বলল, বেশ ভালোই মনে আছে। নতুন অভিনেতা হিসেব অমরনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের খুব নাম হয়েছিল। তারপর হঠাৎ অন্য একজন জয় সিংহ করতে লাগল। আপনি কোথায় চলে গেলেন!

সুকুমার চৌধুরী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন অমরনাথের মুখের দিকে।

কয়েক মিনিটের মধ্যে কী দারুণ বদলে গেছে ওই মুখখানি।

একটু আগে ছিল একজন অতি সার্থক, খুব ক্ষমতাসম্পন্ন একজন মানুষের অহঙ্কারী মুখ। এখন যেন তার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে এক গ্রুপ থিয়েটারের তরুণ অভিনেতা। বহরমপুরে নিশ্চয়ই ট্রেনের ভিড়ে ঠাসা সেকেন্ড ক্লাস কামরায় গিয়েছিল। সাধারণ হোটেলে থাকত অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে এক ঘরে।

সুরঞ্জন জিগ্যেস করল, তার মানে একসময় আপনি আমাদের মতনই একজন স্ট্রাগলিং শিল্পী ছিলেন। অভিনয় ছেড়ে দিলেন কেন হঠাৎ?

অমরনাথ বললেন, হয়তো নিয়তি।

সুরঞ্জন আবার বলল, সেই যে জীবন ছিল, আর এখনকার এই যে ব্যস্ত জীবন, এর মধ্যে কোনটা ভালো বলুন তো!

অমরনাথ মুখ নীচু করে বললেন, কী জানি!

সিঁড়ির দিক থেকে অরিন্দম চেঁচিয়ে বলল, তুমি তো আমাদেরই বয়েসি হবে। ওহে অমরনাথ, সেই বিসর্জন নাটকের কিছু এখনও মনে আছে তোমার? এরপর কী বলো তো—

অরিন্দম আবৃত্তি করতে লাগল।

নহি কি রে আমি তোর পিতার অধিক
পিতৃবিহীনের পিতা বলে? এই দুঃখ,
এত করে স্মরণ করাতে হল! কৃপা–
ভিক্ষা সহ্য হয়, ভালোবাসা ভিক্ষা করে
যে অভাগ্য, ভিক্ষুকের অধম ভিক্ষুক
সে যে! বৎস, তবু নিরুত্তর? …

উঠে দাঁড়ালেন অমরনাথ। রুমাল দিয়ে মুছলেন কপাল, তারপর বলতে লাগলেন উদাত্ত স্বরে :

পিতা, এ বিদীর্ণ বুকে
আর হানিয়ো না বজ্র। রাজরক্ত চাহে
দেবী, তাই তারে এনে দিব! যাহা চাহে
সব দিব! সব ঋণ শোধ করে দিয়ে
যাব। তাই হবে। তাই হবে!

বিশ্বজিৎ, মহাদেব ও অন্যান্য স্থানীয় কর্মীরা হতবাক।

এখানকার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, গম্ভীর এম ডি নাটরেক সংলাপ বলছেন? বাংলায়? তাঁর স্ত্রীরও চোখ বড়-বড় হয়ে গেছে।

অমরনাথ চেয়ার ছেড়ে সোজা চলে গেলেন অরিন্দমের কাছে। সিঁড়িতে অরিন্দমের পাশে বসে পড়ে লাজুক গলায় বললেন, আপনার একটা সিগারেট দিন। একসময় খুব খেতাম, অনেকদিন পর আবার ইচ্ছে করছে—

তারপর বিশ্বজিতের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বললেন, বিশ্বজিৎ, এঁদের জন্য ড্রিংকসের ব্যবস্থা করোনি? আনতে বলো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *