6 of 8

শিলিগুড়ি

শিলিগুড়ি

শিলিগুড়ি আমার চেনা জায়গা। এই শহরের সঙ্গে আমার নাড়ির যোগ আছে। আজ থেকে প্রায় ৫৫ বছর আগে দেশভাগ দাঙ্গার দুর্দিনে আমার ছেলেবেলার মানুষেরা কৈশোরের সহচর-সহচরিরা অনেকেই পূর্ববঙ্গের আমাদের প্রত্যন্ত মহকুমা শহর থেকে পাহাড়তলির এই শহরে মাথা গোঁজার জন্য আসে।

আমি জন্মেছিলাম, বড় হয়েছিলাম, ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইল শহরে। টাঙ্গাইল থেকে যমুনা নদী পার হয়ে সিরাজগঞ্জের রেল ধরে আমাদের পূর্ববঙ্গ থেকে আসতে হত। সিরাজগঞ্জের রেললাইন ঈশ্বরদি পৌঁছে একদিকে রানাঘাট, নৈহাটি, কলকাতার দিকে চলে গেছে, আর অন্যটি উত্তরবঙ্গের দিকে। ছিন্নমূল উদ্বাস্তু মানুষেরা অনেকেই ঈশ্বরদি থেকে উত্তরবঙ্গের দিকে প্রধানত জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, কোচবিহারে এসে আশ্রয় নেয়। বলা বাহুল্য, এইসব অঞ্চলের বিশেষ করে শিলিগুড়ির বর্তমান মানুষজনের একটা বেশ বড় অংশ টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীর দুই তীরের উদ্বাস্তু সম্প্রদায়। শিলিগুড়ির বর্তমান প্রজন্ম সেই জীবনের কথা স্বাভাবিক কারণেই জানে না।

সে যাই হোক, ছোট বয়সে কত লোকের কাছে যে শুনেছি যে তারা শিলিগুড়ি চলে যাচ্ছে। অবশ্য এখানে শিলিগুড়ি মানে শিলিগুড়ি এবং তার কাছাকাছি অঞ্চল। এখনও শিলিগুড়ি এলে ভিড়ের মধ্যে চেনা মুখ খুঁজি, ৫০ বছর আগের মুখগুলি মেলাতে পারি না। শতাব্দীর ঘূর্ণিঝড়ে ঝরা পাতার মতো সেইসব মানুষেরা কবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, থাকলেও এতদিন পরে সেদিনের সেই মানুষটিকে আর চেনা সম্ভব নয়।

কিন্তু একটা নাড়ির টান, একটা মায়ার বন্ধন কোথায় থেকে যায়। মাঝে মাঝে কোনও মানুষের উচ্চারণ শুনে মাঝে মাঝে কোথাও ভাত-মাছ খেতে গিয়ে আমার শৈশবের স্মৃতি ফিরে আসে।

শিলিগুড়ি বইমেলার কর্মকর্তারা যখন আমাকে অনুরোধ করলেন বইমেলা উদ্বোধন করতে আসার জন্য, এই নাড়ির টানেই আমি সেই অনুরোধে সায় দিয়েছিলাম। এসে ভালই হল, ভালই লাগল। অন্য দশ জায়গায় যেমন বইমেলা হয় এখানেও প্রায় একই রকম ভিড়ের চেহারা। বইয়ের দোকানের চেহারায় বিশেষ কোনও পার্থক্য নেই। তবে এখানে কর্মকর্তাদের মধ্যে লক্ষ করলাম বেশ একটা ভাল বোঝাবুঝির সম্পর্ক রয়েছে। সাধারণ বইমেলা জাতীয় অনুষ্ঠানে নানা ধরনের ঝগড়া, ঝামেলা দেখা দেয়, নানারকম স্বার্থ কাজ করে, রাজনৈতিক জটিলতাও কখনও কখনও সৃষ্টি হয়। এবার কলকাতা বইমেলাই হাইকোর্টের ডকে উঠেছে। বইমেলা বন্ধ হচ্ছে না, কিন্তু যথেষ্ট তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে। সেটা বোধহয় শিলিগুড়ির বইমেলায় কখনও হবে না। তবে একটা কথা জানলাম, এখানে দুটো বইমেলা হয়। একটি সরকারি প্রসাদপুষ্ট, যার জন-আকর্ষণ ক্ষমতা খুবই কম। অন্যটি এই বইমেলা যা গত দুই দশক ধরে চমৎকার চলে আসছে। এই শীতের রাতেও বেশ ভিড় হচ্ছে। খোলা আকাশের নীচে, ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে উত্তুরে হাওয়া অগ্রাহ্য করে আবালবৃদ্ধবনিতা বক্তৃতা শুনছে, গান শুনছে, কবিতা শুনছে, বই দেখছে, বই কিনছে। মায়েরা তাদের শিশুপুত্র-কন্যার হাত ধরে মেলায় এসেছে। মায়ের হাত ধরে শিশুরা বইয়ের স্টলে স্টলে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

এ বছর মার্কিন দেশে একটা নতুন শব্দের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। শব্দটা হল ‘সকার মম’, সকার মানে ফুটবল, মম মানে মা। যুগ্ম শব্দটির অর্থ হল ফুটবল জননী। মার্কিনি তরুণী মায়েরা তাদের শিশুদের ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে ফুটবলের মাঠে নিয়ে যাচ্ছেন ফুটবল খেলা শেখাতে। অথচ কয়েক বছর আগে মার্কিন দেশে ফুটবল খেলা ছিলই না। মার্কিনিরা এখন খুব আশান্বিত যে, যেভাবে মায়েরা শিশুদের মাঠে নিয়ে যাচ্ছে তার ফল এক দশকের মধ্যেই পাওয়া যাবে। আমেরিকান ফুটবল দল এমন দুর্ধর্ষ হয়ে উঠবে যা এখন কল্পনাও করা যায় না।

বইমেলায় শিশুর হাত ধরে মাকে দেখে আমারও মনে হয় ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং অন্যান্য আকর্ষণ সত্ত্বেও এই বইমেলাগুলি বইকে ওই শিশুদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলবে। আমি বইমেলা জননীদের নমস্কার জানাই, তারা নিজেদের অজ্ঞাতে সামাজিক কল্যাণের কাজ করছেন।

এবার দু’-একটা হালকা কথা বলি। শিলিগুড়ি বইমেলা শুরু হয়েছিল ১৯৮০ সালে। সেই অর্থে ২৩ বছর আগে। কিন্তু এরা নাম দিয়েছেন ২০তম উত্তরবঙ্গ বইমেলা। আমি কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম অরক্ষণীয়া কন্যার মতো বয়স কমিয়েছেন কেন? আপনাদের কল্পনাদুহিতা এই বইমেলা সালঙ্কারা সুন্দরী, তার বয়স কমানোর প্রয়োজন নেই। তাকে যে কেউ বরণ করে নেবে। এই বইমেলাতে কলকাতার অনেক প্রকাশক এসেছেন। আমি অন্তত চারজন প্রকাশককে দেখতে পেলাম। দে’জ, সাহিত্যম, উজ্জ্বল, পত্ৰভারতী। অন্যান্য প্রকাশকরা এলেও ভাল করতেন। বহু লোক বহু দোকানে বহু রকম বই খুঁজছেন। কলকাতা বইমেলায় গতবার এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তিনি দোকানে দোকানে একটি অসম্ভব বইয়ের খোঁজ করছেন, বইটির নাম ‘পিপীলিকার যৌন জীবন’। আমাকে দেখে তিনি কেমন যেন চিনতে পারলেন। বললেন দাদা, সেই বইটাতো এবারো প্রকাশিত হয়নি। সে বই হয়তো কোনওদিনই প্রকাশিত হবে না। কিন্তু যে বই কলকাতায় প্রকাশিত হয়, সেসব ভাল বইয়ের চাহিদা আছে সুদূর উত্তরের এই মেলাতে, সেগুলি যাতে আসে সে ব্যাপারে কর্মকর্তাদের সচেষ্ট হতে হবে। কলকাতার নামী-দামি প্রকাশকদের আকর্ষণ করতে হবে। ইংরেজির ২০০৩ সালে এই আমার প্রথম বইমেলা দর্শন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *