শিরকুণ্ডা মন্দিরের সাধু – ঋতা বসু
গাজিয়াবাদ থেকে মসুরিতে বদলির খবরে শ্যামবাবু খুবই খুশি হয়েছিলেন। আধা-শহর এই জায়গাটায় দু’বছরেই তিনি হাঁফিয়ে উঠেছিলেন। শ্যামলবাবু ব্যাঙ্কে কাজ করছেন আজ পঁচিশ বছর। প্রমোশন পেয়ে গাজিয়াবাদে ব্রাঞ্চ ম্যানেজার হয়ে এসেছিলেন। জায়গাটা প্রথম থেকেই তাঁর ঘোরতর অপছন্দ। কলকারখানায় ভরতি—ধোঁয়া, ধুলো। সেইজন্য দু’বছরের মাথায় মসুরিতে বদলির অর্ডারটা পেয়ে শ্যামলবাবু বেজায় খুশি হলেন।
মসুরিতে পা দিয়ে খুশির ভাবটা আরও বেড়ে গেল। বেশ জমজমাট জায়গা। ব্যাঙ্কেরই আর-একজন কর্মী মি.ভুটিয়া সহাস্য বদনে অভ্যর্থনা জানালেন। গাড়োয়ালের লোকজনের প্রতি শ্যামলবাবুর বিশেষ দুর্বলতা আছে। এঁরা সাধারণত সৎ, সাদাসিধে ও ধর্মভীরু হন।
ব্যাঙ্কের ওপরেই থাকার জায়গা। বাইরে থেকে ভালই লাগল। একপাশে পাহাড়। বাড়ির সামনে দিয়ে বাজার যাওয়ার রাস্তা নীচে নেমে গিয়েছে। অনেকখানি খোলা জায়গা সামনে। আশপাশে বাড়িঘর বিশেষ নেই। সামনের খোলা জায়গায় পায়চারি করতে করতে শ্যামলবাবু ভাবলেন― ভালই হয়েছে কাছে-পিঠে লোকজন না থাকায়। অফিস থেকে ফিরে তিনি হয় বইটই পড়েন, নয়তো প্রিয় খেলা ওয়ার্ড-পাল নিয়ে বসে যান। আধচেনা লোকের “এই যে দাদা” করে খেজুরে গল্প তাঁর বেজায় অপছন্দ।
এই খুশির ভাবটা অবশ্য বেশিক্ষণ বজায় রইল না। বাড়ির ভেতর পা দিতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে লাগল। দরজা-জানালা খুলে দেওয়া সত্ত্বেও গন্ধটা রয়েই গেল। গন্ধটা বাড়ির মধ্যে থেকেই আসছে অথচ উৎসটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। শ্যামলবাবু জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখে রুম ফ্রেশনার স্প্রে করে আপাতত গন্ধের হাত থেকে রেহাই পেলেন।
পরদিন রবিবার। ছুটির দিন। মি.ভুটিয়া বলে গেলেন মসুরি থেকে ঘণ্টা দুয়েকের রাস্তা শিরকুণ্ডা দেবীর মন্দিরে নিয়ে যাবেন। ধনোল্টি হয়ে মন্দিরে যেতে হয়। ধনোল্টি জায়গাটা নাকি খুব সুন্দর। চারিদিকে পাইন বন। মসুরির চেয়ে ঠান্ডা এবং বেশ নির্জন। শিরকুণ্ডা দেবীর মন্দিরে দু’ কিলোমিটার খাড়াই রাস্তা ধরে পাহাড়ের ওপরে উঠতে হয়। সবসুদ্ধ হাইট প্রায় দশ হাজার ফিট। শিবের প্রলয় নৃত্যকালে সতীর মস্তক নাকি এখানেই ভূপতিত হয়েছিল। সেইজন্য সিদ্ধপীঠ হিসেবে এর স্থানমাহাত্ম্য অসাধারণ। বহুদূর থেকে সারাবছরই ভক্তসমাগম ঘটে। মি.ভুটিয়া নানাভাবেই দেবীমাহাত্ম্য বর্ণনা করতে লাগলেন। শ্যামলবাবুর অবশ্য দেবদ্বিজে তেমন ভক্তি নেই। ছুটির দিন বেড়াতে যাওয়ার মন নিয়েই বেড়াতে যাবেন ঠিক করলেন।
পরদিন সকাল আটটার মধ্যেই শ্যামলবাবু বেড়াবার জন্য তৈরি হয়ে নিলেন। মি. ভুটিয়া আসামাত্রই ধনোল্টির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লেন। বাইরের আবহাওয়া বেশ আরামদায়ক, সবচেয়ে যেটা আশ্চর্যের ব্যাপার, বাইরে এসে শ্যামলবাবু বুঝতে পারলেন― বাড়ির মধ্যে তাঁর একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। বাড়ির মধ্যের গন্ধটাই মনে হচ্ছে অস্বস্তির কারণ। শ্যামলবাবু ঠিক করলেন ফিরে গিয়ে কার্পেটটা তুলে ফেলতে হবে। অনেক সময়ে পুরনো কার্পেট থেকে একটা গন্ধ উঠে আসে। কিন্তু এই গটা ঠিক যেন পরিচিত নয়। সারারাত্রি উনি ভাল করে ঘুমোতে পারেননি। নতুন জায়গা বলে খাপ খাইয়ে নিতে একটু অসুবিধে হচ্ছে― এই বলে মনকে প্রবোধ দিয়েছেন।
এখন গাড়িতে করে যেতে যেতে ভাবলেন, বয়স হচ্ছে―অসুখ-বিসুখ হয় না বলে ডাক্তারও ইদানীংকালে দেখানো হয়নি। হার্টটা একটু চেক-আপ করালেও হয়। মি. ভুটিয়াকে শ্যামলবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “মসুরিতে ভাল হার্টের ডাক্তার আছে নাকি জানাশোনা?”
মি, ভুটিয়া বললেন, “ডাক্তার তো অনেক আছে, তবে দেরাদুনে ভা, নাগাল খুবই নামকরা। তা হঠাৎ হার্টের ডাক্তারের খোঁজ করছেন কেন? আপনার কি কোনও প্রবলেম আছে? দেখুন মি, সরকার, আপনার সেরকম মনে হলে পাহাড়ে ওঠা ঠিক হবে না। রাস্তা কিন্তু প্রচণ্ড খাড়াই।”
শ্যামলবাবু হেসে উড়িয়ে দিলেন, “আরে না না, সেসব কিছু না। নতুন জায়গায় এলাম, তাই জেনে রাখছি কখন কী দরকার পড়ে।”
পাহাড়ি পথ দিয়ে গাড়ি চলেছে। সুন্দর শান্ত পরিবেশ। শ্যামলবাবু যত বাইরে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করছেন, ঘুরেফিরে নিজের বাড়িটার ছবি মনে ভেসে উঠছে। লালচে কার্গেট পাতা বসার ঘর, তারপর শোয়ার ঘর। শোয়ার ঘরের লাগোয়া বাথরুম। বাথরুমের দেওয়াল পাথরের। পাথরের নকশা জুড়ে একটা অদ্ভুত ছবি তৈরি হয়েছে দেওয়ালের গায়ে। প্রথমটা কীসের ছবি শ্যামলবাবু ঠিক ধরতে পারেননি। পরে ভাল করে তাকিয়ে দেখেছেন, পুজোয় যেমন ধুনুচি ব্যবহার হয় অনেকটা যেন সেইরকম। উনি একটু অবাকই হয়েছিলেন ছবিটা দেখে। পাথরের গ্রেনে এই জাতীয় নকশা আগে কখনও চোখে পড়েনি। শোয়ার ঘরের অন্যদিকে রান্নাঘর। পুরো বাড়িটাই ছায়া ছায়া। ঠিক যেমন আর পাঁচটা পাহাড়ি অঞ্চলের বাড়ি হয় তেমনই। শুধু ওই অদ্ভুত অপরিচিত গন্ধটা একেবারেই নতুন।
অন্যমনস্ক ভাবটা কাটিয়ে শ্যামলবাবু জোর করে মি. ভূটিয়ার সঙ্গে গল্পগুজবে মন দিলেন।
ধনোল্টির রেস্টহাউসে বসে কফি খেতে খেতে মি.ভুটিয়াকে ধন্যবাদ জানালেন শ্যামলবাবু, এই সুন্দর জায়গাটিতে নিয়ে আসার জন্য। পাইন বনের মধ্যে দিয়ে শন শন শব্দে হাওয়া বইছে। চারদিক একেবারে নিস্তব্ধ, নির্জন। পাহাড়ের একটা নিজস্ব গন্ধ আছে। খানিকক্ষণ শাস নিলেই মনে হয় যেন দশ বছর আয় বেড়ে গেল।
মি. ভুটির তাড়ায় চটপট কফি শেষ করে শিরকুণ্ডা দেবীর মন্দিরের উদ্দেশে রওনা দিলেন।
পাহাড়চূড়ায় মন্দির! নীচে দোকানপাট। পাহাড়ের নীচে গাড়ি রেখে দু’জনে মিলে ধীরে ধীরে চড়াই ভেঙে চলা শুরু করলেন। নানা বয়সের স্ত্রী-পুরুষ-শিশুর দলও উঠছে, আবার নামছেও। শ্যামলবাবু এমনিতে বেশ শক্ত সবল! অসুখবিসুখে খুব একটা ভোগেন না। কিন্তু রাস্তা যে এতটা খাড়া, এটা আগে ধারণা করতে পারেননি। মি. ভুটিয়া পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষ। তিনি বেশ তরতর এগিয়ে যাচ্ছেন দেখে শ্যামলবাবু বললেন, “আমি একটু বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে এগোব, আপনি আমার জন্য অপেক্ষা করবেন না। একেবারে চুড়োয় গিয়ে দেখা হবে।” মি. ভুটিয়া উদ্বিগ্ন মুখ করে কাছে এগিয়ে আসতেই শ্যামলবাবু একটু জোর করেই বললেন, “আমি কিন্তু একা হাঁটতেই পছন্দ করি মি.ভুটিয়া।”
হার্টের ডাক্তারের কথা জিজ্ঞেস করা যে কত বড় ভুল হয়েছে, শ্যামলবাবু তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারলেন। কিন্তু হাপরের মতো হাঁফাতে হাঁফাতে মি. ভূটিয়ার সঙ্গে ওঠার চেয়ে নিজের মনে বিশ্রাম নিয়ে ধীরেসুস্থে যাওয়াটাই শ্যামলবাবুর পছন্দ। আর এ তো অফিসে যাওয়ার মতো ব্যাপার নয় যে, নির্দিষ্ট সময়েই পৌঁছতে হবে। উনি যাবেন ওঁর খুশিমতো, ইচ্ছে না হলে পুরোটা উঠবেনই না। অগত্যা মি. ভূটিয়া এগিয়ে গেলেন।
অজগর সাপের মতো রাস্তাটা পাহাড়টাকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠে গিয়েছে। মাঝে মাঝে তীর্থযাত্রীদের বসবার জায়গা আছে সিমেন্টে বাঁধানো। শ্যামলবাবু চারদিকের শোভা উপভোগ করতে করতে ধীরে ধীরে এগোতে লাগলেন।
হঠাৎ তিনি দেখেন, স্থানীয় দুটি ছেলে রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পায়ে হাঁটা শুড়িপথ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। শ্যামলবাবুর মনেও হঠাৎ ছেলেমানুষি অ্যাডভেঞ্চারের শখ জেগে উঠল। উনি ভাবলেন শর্টকাট রাস্তা ধরে গিয়ে মি. ভুটিয়াকে চমকে দেবেন। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে খানিকটা পথ গিয়ে একটা বাঁকের মুখে শ্যামলবাবু ছেলে দুটিকে হারিয়ে ফেললেন। তাতে উনি অবশ্য দমে গেলেন না। ঝকঝকে রোদুর, চারদিকে লোকজনের ওঠানামার শব্দ, পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। উনি আপনমনে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এগোতে লাগলেন।
হঠাৎ খেয়াল হতে দেখলেন জঙ্গলটা অপেক্ষাকৃত ঘন আর চারদিক একেবারে নিস্তব্ধ। পায়ে-চলা পথটাও আর দেখা যাচ্ছে না। শ্যামলবাবু ভয় না-পেয়ে মাথা ঠান্ডা রেখে মূল রাস্তাটা কতদূর তা বুঝবার চেষ্টা করতে লাগলেন। পেছনে খড়মড় আওয়াজ হতে চমকে সরে দাঁড়াতেই পাথরের আড়াল থেকে একটা লোক বেরিয়ে এল। শ্যামলবাবু সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে লোকটির দিকে তাকালেন। মাথায় জটা। এই ঠান্ডাতেও গায়ে কিছু নেই। একটা লালচে রঙের কাপড় লুঙি করে পরা। হাতে একটা ধুনুচি। লোকটি একদৃষ্টিতে শ্যামলবাবুর দিকে চেয়ে আছে। শ্যামলবাবু ঠিক ভয় পাননি। এই রোগা লোকটি কীই বা করতে পারে! কিন্তু এর মতলবটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
শ্যামলবাবু কিছু বোঝার আগেই লোকটি ধুনুচিটা মাটিতে নামিয়ে খপ করে শ্যামলবাবুর হাতটা ধরে কবজিতে একটা লাল সুতো জড়িয়ে দিল। তারপর ধুনুচিটার দিকে হাত দেখিয়ে বলল, “মায়ের নামে এখানে কিছু দিয়ে যা। তোর সামনে খুব বিপদ।”
শেষ কথাটা শুনে শ্যামলবাবুর আপাদমস্তক জ্বলে উঠল। সেই চির পরিচিত কায়দা। ভয় দেখিয়ে ভিক্ষে আদায়। উনি হাত থেকে লাল সুতোটা ছিঁড়ে ফেলে এগোবার চেষ্টা করতেই লোকটি বলল, “পুজো না দিয়ে চলে যাচ্ছিস, তোর ভাল হবে না।”
শামলবাবুর আর এক মুহূর্তও এই লোকটির সামনে থাকতে ইচ্ছে করছিল না। ছুটির দিনের আমেজটাই নষ্ট হওয়ার জোগাড়। তাড়াহুড়ো করে যেতে গিয়ে ধুনুচিটায় পা লেগে উলটে গেল। শহুরে অভ্যাসমতো “সরি” বলে উনি ধুনুচিটা সোজা করে রেখে এগিয়ে গেলেন। হাতে একটু ছাইয়ের মতো লেগে গেল। পকেট থেকে রুমাল বার করে মুছতে মুছতে দেখেন লোকটি জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। শ্যামলবাবু আর বিশেষ পাত্তা না দিয়ে আন্দাজে পাকদণ্ডীর রাস্তাটার খোঁজে এগিয়ে গেলেন। রুমালটা হাতেই ধবা রইল।
পুরো ঘটনাটাই এত আকস্মিক যে, এই ঠান্ডা আবহাওয়াতেও শ্যামলবাবুর কপালে বিনবিন করে ঘাম দেখা দিল। গলাটাও শুকনো লাগছে। হনহন করে খানিকটা হাঁটতেই রাস্তাটা দেখা গেল। লোকজনের গলার আওয়াজ, পাখির ডাক সবই শোনা গেল। নিশ্চিন্ত মানে শ্যামলবাবু পথের ধারে একটা পাথরের ওপর বসে রুমালটা দিয়ে মুখ মুছতে গিয়েই টের পেলেন, বাড়ির মধ্যের যে গন্ধটা গতকাল থেকে তার অস্বস্তির কারণ, সেটাই তীব্রভাবে রুমালের মধ্যে এসে গিয়েছে। পরিষ্কার রুমাল নিয়ে বেরিয়েছিলেন। খানিকটা আগে শুধু ধুনুচির ছাই মুছেছেন। মাঝখানে ব্যবহার করার প্রয়োজনই হয়নি। রাগ, অস্বস্তি সব মিলিয়ে শ্যামলবাবুর একটা অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগল। পাহাড়চূড়ায় উঠে মন্দির দেখার ইচ্ছেটাও চলে গেল। পথের ধারে সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে মি. ভুটিয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। মনে মনে ঠিক করলেন জীবনে কোনও তীর্থস্থানের ত্রিসীমানায় যাবেন না। যত আধপাগল লোকের ভিড়। অযথা লোকের মনে ভীতি উৎপাদন করে এরা।
এইসব ভাবতে ভাবতে কখন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছেন, বুঝতে পারেননি। সংবিৎ ফিরল মি. ভুটিয়ার ডাকে। লজ্জিত হয়ে ধড়মড় করে উঠে বসতেই মি. ভুটিয়া বললেন, “আমার মনে হয় আপনার শরীর ভাল নেই মি. সরকার। আজই একবার ডাক্তার দেখিয়ে নিন।”
শ্যামলবাবু একেবারে উড়িয়ে দিলেন সে-কথা। বললেন, “জাস্ট পাহাড়ে চড়ার অনভ্যাসের জন্য এটা হয়েছে, বুঝলেন, বসে থাকতে ভালই লাগছিল, গতকাল ভাল ঘুমই হয়নি, কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই। এতই সিম্পল ব্যাপার, এর মধ্যে ডাক্তার কী করবে?”।
মি. ভুটিয়া পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও আর বিশেষ চাপাচাপি করলেন না।
ফেরার পথে শ্যামলবাবু মি. ভুটিয়ার চোখ এড়িয়ে রুমালটা জানালা দিয়ে ফেলে দিলেন। ওই গন্ধওয়ালা রুমাল নিয়ে বাড়ি যাওয়ার কোনও বাসনা তাঁর নেই।
বাড়ির কাছে শ্যামলবাবুকে নামিয়ে মি. ভুটিয়া আর দাঁড়ালেন না। আর-একবার শরীরের প্রতি খেয়াল রাখবার কথা মনে করিয়ে বিদায় নিলেন।
সারাদিন ঘোরাঘুরি হওয়ায় শ্যামলবাবুও আর রাত না করে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লেন। পরদিন অফিস। নতুন জায়গা। একটু আগেও যাওয়া উচিত প্রথম দিন।
মাথার কাছের আলোটা নেভাতেই বাথরুমের ধুনুচিটার ছবি চোখের সামনে ফুটে উঠল। জঙ্গলের লোকটার হাতেও অনেকটা এই ধরনের জিনিস ছিল। রাত্রিবেলা ছবিটা কি একটু বেশি গাঢ় দেখাচ্ছিল? হয়তো আলো পড়ে সকালের চেয়ে রাত্রে বেশি চোখে পড়ছে। এইরকম সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন খেয়াল নেই। ঘুম ভেঙে গেল তীব্র গন্ধে। এইরকম অভিজ্ঞতা শ্যামলবাবুর জীবনে হয়নি। উনি জোর করে ঘুমোবার চেষ্টা করতে লাগলেন। উপুড় হয়ে বালিশে মুখটা চেপে ধরলেন। গন্ধটা সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। এত জমাট জ্যান্ত অস্তিত্ব যে, মনে হয় গন্ধের যেন হাত-পা আছে। এবং সেই হাত দিয়ে পিঠের ওপর বসে যেন মুখটা ঠেসে ধরেছে বালিশে। শ্যামলবাবু অসহায়ভাবে হাত-পা নাড়বার চেষ্টা করলেন। বিছানা থেকে উঠে বাইরে আসার চেষ্টাও করলেন কিন্তু এক ইঞ্চিও নড়তে পারলেন না। গন্ধটা ভারী হয়ে তাঁর সমস্ত শরীরটাকে যেন চেপে পিষে ফেলতে লাগল।
পরদিন মি. ভুটিয়া অফিসে এসে খবর শুনে আফসোস করে বললেন, “ওঁর কথা শুনে আমার ছেড়ে দেওয়াটা ঠিক হয়নি। হি ওয়াজ নট ওয়েল। জোর করেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে হয়তো হার্ট অ্যাটাকের মতো দুর্ঘটনাটা এড়ানো যেত।”
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০০২
অলংকরণ : সুব্রত চৌধুরী