শিবেশ্বর মহাপাত্র

শিবেশ্বর মহাপাত্র

সেটা ১৯৫৮-৫৯ সাল হবে। সকাল ছ’টা-সাড়ে ছ’টার সময় একটা ঝোলায় পাঁউরুটি, কলা আর কাচের বোতলে জল নিয়ে সেজেগুজে রওনা হয়েছি ইডেনে। তখন থাকি উত্তর কলকাতার একটা সরু আর জটিল গলিতে, ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে। বাড়িটা এতই পুরনো আর ঝুরঝুরে যে কর্পোরেশন একাধিক বার বিপজ্জনক বাড়ি হিসেবে নোটিস দিয়েছে। কিন্তু হোস্টেলের ইনচার্জ শিবেশ্বর মহাপাত্র সেই সব নোটিসকে পাত্তা দেননি। হোস্টেলের একটা অংশে একতলা, দোতলা আর তিনতলা মিলিয়ে অন্তত পাঁচ-সাতখানা ঘর নিয়ে তাঁর বাস। অনেক ছেলেপুলে ছিল তাঁর। আর বাড়ি ছাড়তে হলে আমরা ছত্রিশ জন বোর্ডার কোথায় যাব, তাও ভাবনার বিষয়।

যা বলছিলাম, সকালে টেস্ট ম্যাচ দেখতে বেরোচ্ছি। শিবেশ্বরবাবুর সঙ্গে দেখা। পরনে আধময়লা ধুতি, ঊর্ধ্বাঙ্গে সেই ধুতিরই খুঁট জড়ানো, খালি পা, এইটেই মার্কামারা পোশাক। ওই চেহারা আর পোশাকেই তিনি অলিগলি পেরিয়ে দোকান-বাজার করতেন। শুধু ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নিতে যাওয়ার সময় পরনে বাড়িতে কাচা, ইস্তিরিহীন পাঞ্জাবি আর খাটো ধুতি এবং তত্‌সহ পায়ে একজোড়া চপ্পলও থাকত।

আমাকে দেখেই ধমকের সুরে বললেন, ‘এত সকালে কোথায় যাচ্ছ? সঙ্গে ব্যাগ কেন?’ হোস্টেলে সবে ভর্তি হয়েছি, শিবেশ্বরবাবুকে ঠিকমত মাপজোক করা হয়নি তখনও। তাই ভালমানুষের মতোই বললাম, ‘টেস্ট ম্যাচ দেখতে যাচ্ছি স্যর, ইডেনে।’ খেঁকিয়ে উঠে বললেন, ‘কী ম্যাচ?’ আমি বিনয়ের সঙ্গেই বললাম, ‘স্যর, আজ ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ইন্ডিয়ার ক্রিকেটের টেস্ট ম্যাচ।’

ক্রিকেট খেলা যে কারও কাছে এত ঘৃণ্য ও অস্পৃশ্য ব্যাপার হতে পারে, তা আমার জানা ছিল না। হঠাৎ যেন আগ্নেয়গিরির লাভা বেরিয়ে আসতে লাগল, ‘কী? ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে যাচ্ছ? অ্যাঁ! ক্রিকেট ম্যাচ! তোমাদের জেনারেশনটাই তো অধঃপাতে গেছে দেখছি! তোমাদের লজ্জা হয় না? নিজের কত বড় সর্বনাশ করছ, সেটা জানো? ভদ্রলোকের ছেলেরা, ভাল ছেলেরা ফুটবল-ক্রিকেট দেখতে যায়? ছি ছি, তোমাদের ছাত্র বলে পরিচয় দিতেই যে লজ্জা করে!’

এ রকম ভয়ংকর প্রতিক্রিয়ায় ভারী থতমত খেয়ে গেছি। ছেলেবেলা থেকেই ক্রিকেট, ফুটবল খেলে বড় হয়েছি। আমার পিতৃদেব স্বয়ং খুবই ভাল ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিস খেলতেন। এই সব নির্দোষ খেলার মধ্যে কোন অধঃপতনের সম্ভাবনা নিহিত রয়েছে, বুঝতে পারলাম না। উনি অবশ্য আমাকে তীব্র ভর্ত্‌সনা করেই হনহন করে  চলে গেলেন। আমিও যথারীতি মাঠে চলে গেলাম। পরে শুনেছি, উনি সিনেমা-থিয়েটারেরও ঘোর বিরোধী।

কিন্তু ওঁকে ভয় পাওয়ারও তেমন কারণ ছিল না। কারণ উনি খুব অন্যমনস্ক এবং দিশাহীন মানুষ। রোগা, শ্যামবর্ণ, টেকো, অতি সাধারণ চেহারায় ওই আধময়লা ধুতির খুঁট জড়ানো পোশাকে কেউ তাঁকে অধ্যাপক বা বিশিষ্ট ভদ্রলোক বলে বুঝতেই পারত না। কত বার ভিজিটর এসে তাঁকে সামনে পেয়ে দারোয়ান মনে করে জিজ্ঞেস করেছে, ‘এই যে দারোয়ানজি, অমুক কি হোস্টেলে আছে?’ এতে শিবেশ্বরবাবু বিন্দুমাত্র বিচলিত বা অসন্তুষ্ট হতেন না। ঠান্ডা গলাতেই বলতেন, ‘আছে বোধহয়, ভিতরে গিয়ে খোঁজ করুন।’

এক দিন ইলিশ মাছ রান্না হয়েছে। কিন্তু রান্নাটা মোটেই ভাল হয়নি। খুন্তির ওপর এক টুকরো মাছ চাপিয়ে নিয়ে আমরা দল বেঁধে শিবেশ্বরবাবুর বাড়িতে হানা দিলাম। ওঁর বাড়ির মহিলারা বাইরের লোকেদের সামনে বেরোতেন না। ছোট মেয়েটি পাছে কারও নজরে পড়ে, সেই ভয়ে স্কুলে অবধি দেননি। সেই মেয়েটি পরদার ফাঁক দিয়ে শুধু গলির দৃশ্য দেখত। আমরা কড়া নাড়তেই সেই মেয়েটি এসে দরজা খুলেই আমাদের দেখে হরিণ-পায়ে ভিতরে পালিয়ে গেল। মস্ত ঘোমটায় আবক্ষ ঢেকে স্যরের গৃহিণী এসে নীরবে আমাদের নালিশ শুনলেন। জবাবে ক্ষীণকণ্ঠে কী বললেন, বোঝাই গেল না। ঘণ্টাখানেক বাদে ব্যস্তসমস্ত শিবেশ্বর এসে সব মাছ ওঁর বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে বললেন। বিকল্প হিসেবে ছোট ছোট মাটির খুরিতে মিষ্টি দই, যার দাম এক বা দু’আনা হবে বড়জোর।

একটু কিপটে ছিলেন, বায়ুগ্রস্তও। কিন্তু সংস্কৃত, পালি ও প্রাকৃতে ও রকম অসাধারণ পণ্ডিতও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল না কেউ। ওই সব বিষয়ে যে কোনও প্রশ্ন করলেই জলের মতো বুঝিয়ে দিতে পারতেন।

কিন্তু বাড়ির অবরোধে জোর করে মেয়েদের আটকে রাখলে তার ফল খুব ভাল হওয়ার নয়। শিবেশ্বরবাবুর বড় মেয়ে এক দিন তার পছন্দের একটি যুবকের সঙ্গে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। থানাপুলিশ নিয়ে তুমুল অশান্তি করেছিলেন শিবেশ্বর। লাভ কিছু হয়নি। আবার কিছু দিনের মধ্যেই ঘটনাটি ভুলে একেবারে আগের মতো নির্বিকার হয়ে গেলেন। বুঝতে পারতাম, তিনি একটা যুগের চৌকাঠে থেমে আছেন। ওই চৌকাঠ কিছুতেই পেরোতে চাইছেন না। চারদিককার যে চলমান সমাজ ও সভ্যতা, মানুষের নানা আচার-আচরণের পরিবর্তন, এগুলো প্রাণপণে প্রত্যাখ্যান করার চেষ্টা করছেন। আবার মজা হল, অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটলেও তাঁর একটা তাত্‌ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হত বটে, কিন্তু আবার নির্বিকার হয়ে যেতে একটুও সময় লাগত না।

ওই যে আধময়লা ধুতির খুঁট গায়ে জড়িয়ে বেড়াতেন, এতে মর্যাদাহানি হচ্ছে, বুঝতেই পারতেন না। পাড়ায় কেউ কখনও বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করত না। তিনি অবশ্য প্রত্যাশীও ছিলেন না। আমাদের ওই এঁদো গলিতে একটা গ্যাসলাইট ছিল, প্রত্যেক সন্ধেতেই জ্বলত। তখনও কলকাতায় কিছু বিরল জায়গায় গ্যাসবাতি জ্বলত। পৌরাণিক ওই বাতিটার দিকে চাইলেই আমার মনে হত, এ যেন শিবেশ্বর মহাপাত্র, ওর দিন শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু বুঝতে চাইছে না।

আমি সে বার এম এ পরীক্ষায় ড্রপ দেব শুনে এমন উত্তেজিত হয়ে পড়লেন, মনে হল মেরেই বসবেন বুঝি। ‘ড্রপ দেবে? ড্রপ দেবে? ইয়ার্কি নাকি? বাপের পয়সার শ্রাদ্ধ করছ! ছি ছি!’

পর দিন বিনয়ের সঙ্গে বললাম, ‘স্যর আর এক বছর হোস্টেলে থাকতে দেবেন? আর কোথাও সিট পাচ্ছি না। ’

এক বার তাকালেন মুখের দিকে, তার পর বললেন, ‘তা হলে আর যাবেই বা কোথায়? থাকো। ’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *