শিবাইচণ্ডীর বিষ্টু মশাল

শিবাইচণ্ডীর বিষ্টু মশাল

শিবাইচণ্ডীর বিষ্টু মশাল কখনও ভূতে বিশ্বাস করতেন না। তাঁর মতো জেদি, সাহসী পুরুষ সেকালে খুব কমই ছিল। একদিন সন্ধেবেলা বিষ্টু মশাল ভিন গাঁ থেকে ফিরছেন, হঠাৎ মনে হল কে যেন তাঁর পেছন পেছন আসছে। বিষ্টু মশাল থমকে দাঁড়ালেন। পিছু ফিরে দেখলেন কেউ তো নেই। তাই একটু থেমে আবার চলা শুরু করলেন। চলা শুরু করামাত্রই আবার সেই পায়ের শব্দ। আগেই বলেছি, বিষ্টু মশাল ভূতে বিশ্বাস করেন না, তাই ব্যাপারটা তাঁর কাছে ভারী অদ্ভুত লাগল। এমন সময় হঠাৎ কাঁধের ওপর কার যেন একটা দীর্ঘশ্বাস অনুভব করলেন তিনি। বিষ্টু মশাল চমকে উঠলেন। পুরোপুরি ভয় না পেলেও বুকটা কেঁপে উঠল তাঁর। কেমন যেন ভয় ভয় করল। মন বলল, তবে কি সত্যিই ভূত আছে?

যাই হোক, বিষ্টু মশাল বাড়ি ফিরে গুম হয়ে রইলেন। মুখ-হাত ধুয়ে খেয়ে শুয়ে পড়লেন। বাড়িতে শুধু কর্তা আর গিন্নি। ছেলেপুলে নেই, তাই দু’জনেরই সংসার। গিন্নি বললেন, “কী হল তোমার? হঠাৎ এত চুপচাপ যে?” বিষ্টু মশাল সাড়া দিলেন না।

“যে কাজে গিয়েছিলে সে কাজ হয়নি বুঝি?”

“না, ঠিক তা নয়। তবে…।”

“তবে কী?”

বিষ্টু মশাল তখন সব কথাই খুলে বললেন গিন্নিকে।

গিন্নি সব শুনে ভয়ে চোখ দুটো কপালে উঠিয়ে বললেন, “বলো কী গো? তুমি তো তা হলে ভূতের পাল্লায় পড়েছিলে!”

বিষ্টু মশাল একটুও আতঙ্কিত না হয়ে বললেন, “থামো তো। যত্তসব। ভূত আবার কী? ভূত বলে কিছু আছে? মানুষ মরে গেলে দেহটা পুঁতে অথবা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তারপরে আর কিছুই থাকে না।”

“সে কী! মানুষ তো মরেই ভূত হয়।”

“তা যদি হত তা হলে পৃথিবীতে মানুষ বাস করতে পারত না। যত মানুষ এ যাবৎ মরেছে, সবাই ভূত হয়ে মানুষকে তাড়াত।”

“আহা, সব মানুষ ভূত হবে কেন? যারা অপঘাতে মরে, তারাই ভূত হয়।’ “তারও সংখ্যা কি কম? জলে ডুবে, গলায় দড়ি দিয়ে, আগুনে পুড়ে, পথ দুর্ঘটনায় কম লোক মরেছে?”

গিন্নি , এর পরে আর কথা নয়। রাতও হয়েছে অনেক। তাই কর্তা-গিন্নি দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়লেন।

বললেন“অতশত জানি না বাপু, আমার কিন্তু ওসবে বড় ভয়।”

পরদিন সকালে বিষ্টু মশাল গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে বসে তামাক খেতে খেতে তাঁর বন্ধুবান্ধবদের বললেন কথাটা। সবাই শুনে বললেন, “তা তেনারা সব আছেন বইকী! না হলে মনের মধ্যে ভয় ভাবটা আসবে কেন? দেবতা অপদেবতা সবই আছেন। তুমি বিশ্বাস করো না, সে-কথা আলাদা। এই যে এত লোককে ভূতে ধরছে, এ সবই কি মিথ্যে?”

বিষ্টু মশাল কোনও কথা না বলে সোজা চলে এলেন পঞ্চা পণ্ডিতের কাছে। তারপর পাঁজি-পুঁথি দেখে জেনে নিলেন অমাবস্যাটা কবে এবং মনে মনে ঠিক করলেন ওইদিন ভরা অমাবস্যায় ‘ভিন গাঁয়ে যাচ্ছি’ বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভোজঙ্গার ডাঙালে বসে সারাটি রাত কাটাবেন। ভোজঙ্গার ডাঙাল হচ্ছে এই অঞ্চলের শ্মশান। একটি খালের ধারে ডাঙালে যেখানে শবদাহ করা হয় সেই জায়গাটা ভূতের উপদ্রবের জন্য এমনই কুখ্যাত যে, সন্ধের পর চোর ডাকাতরাও সেখানে যেতে ভয় পায়। বিষ্টু মশাল ঠিক করলেন, এই শ্মশানে বসেই তিনি ভূত দেখবেন। অবশ্য ভূত যদি সত্যিই থাকে। সেইসঙ্গে গত সন্ধ্যার সেই পায়ের শব্দ বা দীর্ঘশ্বাস পড়াটা যে মনের ভুল, সেটাও তিনি প্রমাণ করবেন।

মাঝে মাত্র কয়েকটি দিন।

তারপর মঙ্গলবারের ঘোর অমাবস্যায় নানারকম ভাবনাচিন্তা এবং পরিকল্পনা করে বিষ্টু মশাল ভরদুপুরে গিন্নির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোলেন ভিন গাঁয়ে তাঁর এক আত্মীয়র সঙ্গে দেখা করবেন বলে। আসবার সময় গিন্নিকে বলে এলেন রাত্রে বোধ হয় বাড়ি ফেরা হবে না, তাই যেন কোনওরকম চিন্তাভাবনা না করেন।

গিন্নি তো অতশত বুঝলেন না, তাই কর্তাকে নির্ভাবনায় বিদায় দিলেন।

বিষ্টু মশালও ধীর পদক্ষেপে পাশের গ্রামে তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলেন। তারপর সন্ধে পর্যন্ত বেশ চুটিয়ে গল্প করে যখন বিদায় নিতে চাইলেন তখন তো তাঁরা কিছুতেই ছাড়বেন না। সবাই বললেন, “না না। আজ আর যাওয়া নয়। এখানেই খেয়েদেয়ে বিশ্রাম করুন, কাল সকালে যাওয়ার কথা চিন্তা করবেন। এই রাতদুপুরে দু’ মাইল পথ একা যাওয়া কি মুখের কথা?”

বিষ্টু মশাল তো থাকবেন বলে আসেননি। তিনি এসেছেন সময় কাটাতে। তাই বললেন, “না গো না। আমার কি হুট করতেই কোথাও গিয়ে থাকা চলে? ঘরের মানুষটা ভাববে কী? বলা নেই কওয়া নেই মন গেল তাই চলে এসেছি। যেতে আমাকে হবেই।”

এই কথার পর কথা চলে না। সবাই বলল, “তা বেশ করেছেন। সাবধানে যাবেন তা হলে। এই রাত-বিরেতে কী করে আপনাকে ছাড়ি বলুন দেখি? পথে কোনও বিপদ হলে কাকে কী বলব?”

বিষ্টু মশাল বললেন, “কিচ্ছু হবে না গো, কিচ্ছু হবে না। আজ তা হলে আসি।” বলে পথে নামলেন বিষ্টু মশাল।

অমাবস্যার রাত, তায় গ্রামের অন্ধকার। একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার যাকে বলে! কোনও কিছুতেই দিশা চলে না। একহাত দূরে কী আছে, দেখা যায় না তাও।

সেই অন্ধকারে টর্চের আলোয় পথ দেখে বিষ্টু মশাল চললেন গ্রামের দিকে। কিছু পথ এসেই তিনি হাজির হলেন ভোজঙ্গার ডাঙালে। একবার একটু ভয় ভয় করল। তবে সে ভয়টা কিন্তু ভূতের নয়। সাপের। বিষ্টু মশাল সাপকে বড় ভয় করেন। তবুও তাঁর জেদ, ভূতের দেখা তাঁকে পেতেই হবে। সারারাত বসে থেকেও তিনি দেখবেন ভূত কী এবং সত্যিই ভূত বলে কিছু আছে কিনা।

বিষ্টু মশাল শ্মশানযাত্রীদের বসবার জায়গায় এসে বসলেন। বসে একটা বিড়ি ধরালেন। চারদিকে বনবাদাড়। নিশাচর পশুপক্ষীদের ডানা ঝাপটানির শব্দ আর কর্কশ ডাক ছাড়া কিছুই নেই। বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর হঠাৎ একসময় শুনতে পেলেন ‘হ্যাঃ’ করে একটা দীর্ঘশ্বাস এবং করুণ একটা আক্ষেপোক্তি। তারপর আর কিছুই নেই। বিষ্টু মশাল তবুও বসে রইলেন। কেমন যেন ঘুম আসতে লাগল তাঁর। এমন সময় হঠাৎ মনে হল কেউ যেন কোদাল দিয়ে কুপিয়ে একটা শ’ খুঁড়ছে। কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলেন না তিনি। হঠাৎ একটা মেটে কলসি শ’-এর পাশ দিয়ে গড়গড় করে গড়িয়ে পড়ল জলে।

বিষ্টু মশাল সেইদিকে তাকিয়ে দেখলেন একবার। তারপর বললেন, “কে বাবা তুমি, এসব করছ? পারলে একটা শরীর নিয়ে দেখা দাও। আমি যে অবিশ্বাসী মানুষ। লোককে গিয়ে যেন বলতে পারি স্বচক্ষে ভূত দেখেছি।”

বিষ্টু মশালের সে-কথার উত্তরও দিল না কেউ।

খানিক বাদে কাঠ কাটার মতো একটা ঠক ঠক শব্দ বিষ্টু মশালের কানে এল। বিষ্টু মশাল শব্দটা যেদিক থেকে আসছে সেইদিকে তাকিয়ে রইলেন। এমন সময় দেখলেন একজন লোক ভারী একটা কাঠের বোঝা মাথা থেকে নামিয়ে ধপাস করে একটা শ’-এর ওপরে ফেলল। তারপর একের পর এক কাঠ রেখে সাজাতে লাগল একটা চিতা।

বিষ্টু মশাল হেঁকে বললেন, “কে গো! কে তুমি?”

লোকটি নিরুত্তর। সে বিষ্টু মশালের দিকে একবার তাকিয়ে খালে নেমে সেই মেটে কলসিটাকে জলপূর্ণ করে তুলে নিয়ে এল।

বিষ্টু মশাল বললেন, “এই অন্ধকারে একা একা শ’ খুঁড়ছ, কাঠ বইছ, চিতা সাজাচ্ছ, জল তুলছ, বলি কার জন্য হে?”

এইবার উত্তর দিল লোকটি। বলল, “সে যার হোক একজনের জন্য। কিন্তু আপনি এখানে এই রাতদুপুরে একা বসে কী করছেন? ভূতের ভয় নেই?”

“তোমার আছে? আমি তো ভূত দেখব বলেই বসে আছি।”

“আর ভূত দেখে না। যান, ঘরে যান। ঘরে গিয়ে ঘুমোন গে যান। রাত হয়েছে।”

বিষ্টু মশাল বললেন, “তা ভূত যখন দেখলুম না তখন ঘরে যাব নিশ্চয়ই। কিন্তু শ্মশানে তো মড়া নেই, কাঠ সাজাচ্ছ কার জন্য?”

লোকটি হেসে কিছু না বলেই অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

বিষ্টু মশালের শিরদাঁড়া বেয়ে কেমন যেন হিমস্রোত নেমে এল একটা। এক প্রচণ্ড ভয় তাঁকে যেন পেয়ে বসল হঠাৎ। খুব শীত করতে লাগল। সারা গায়ে অসহ্য যন্ত্রণা। সে কী কষ্ট!

বিষ্টু মশাল আর থাকতে পারলেন না। কোনওরকমে টলতে টলতে বাড়ি চলে এলেন।

এত রাতে বিষ্টু মশালকে ফিরে আসতে দেখে গিন্নি তো অবাক! বললেন, ব্যাপার! তুমি ফিরে এলে যে? তোমার তো থাকবার কথা ছিল।”

“হ্যাঁ, হঠাৎ শরীরটা খুব খারাপ করল কিনা, তাই চলে এলাম। মনে হচ্ছে জ্বর আসবে।”

গিন্নি গায়ে হাত দিয়েই বললেন, “জ্বর আসবে কীগো? জ্বরে যে গা পুড়ে যাচ্ছে। একবার ডাকব নাকি হরি ডাক্তারকে?”

“কাল যা হয় কোরো। আজ রাতে তো নয়, এত ভয় পাচ্ছ কেন? কথায় আছে যেমন তেমন জ্বর, দু’দিন উপোস কর। দু’একদিন উপবাসে থাকলে জ্বর এমনিই ছেড়ে যাবে।” তো দূরের কথা, আরও বাড়তে লাগল। রাতটা কোনওরকমে

কিন্তু না। জ্বর ছাড়া জ্বর এত বেশি হল যে, জ্বরের সঙ্গে শুরু হল কাঁপুনি।

কাটলেও সকালে খবর পেয়ে হরি ডাক্তার এসে ম্যালেরিয়ার ওষুধ দিলেন, কিন্তু জ্বর কমল না। দুপুরের পর থেকে শুরু হল ভুল বকা।

গিন্নি তো কান্নাকাটি করে লোকজন জড়ো করলেন। সবাই বলল, “ওঝা বদ্যি করো। এ জ্বর ডাক্তারি ওষুধে সারবে না।”

কিন্তু দুঃখের কথা এই যে, এই গ্রামের ধারেকাছেও তখন কোনও ওঝা বদ্যি ছিল না। তবে যেখানে যিনি আছেন তাঁর কাছেই খবর পাঠানো হল। অবশেষে সারাদিনের পর অনেক রাতে একজন ওঝা এসে উপস্থিত হলেন।

“এটা কি বিষ্টু মশালের বাড়ি? শুনলাম তেনাকে নাকি ভূতে ধরেছে?”

বিষ্টু মশালের বাড়িতে তখন অনেক লোকজন। বললেন, “আপনি কোথা থেকে আসছেন?”

“কাল উনি যেখানে গিয়েছিলেন আমি সেখান থেকেই আসছি। শুনলাম আপনারা ওঝার খোঁজ করছেন? তা আমি কি একটু ওঁকে দেখতে পারি?”

“নিশ্চয়ই পারেন। আসুন আসুন, ভেতরে আসুন। জ্বরের ঘোরে উনি ভুল বকছেন আর এমন এমন সব কথা বলছেন যাতে বোঝাই যাচ্ছে ওঁকে ভূতে ধরেছে।”

যিনি এলেন তিনি নীরবে ঘরের মধ্যে ঢুকে বিষ্টু মশালের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর সবাইকে ঘরের বাইরে যেতে বলে রোগীর আপাদমস্তক একবার দেখে মৃদুস্বরে ডাক দিলেন, “বিষ্টুবাবু!”

বিষ্টু মশাল ঘোরের মধ্যে ছিলেন। এবার অল্প করে তাকালেন তাঁর দিকে। তাকিয়েই শিউরে উঠলেন। ভয়ে তাঁর চোখমুখের চেহারাই অন্যরকম হয়ে গেল। আতঙ্কিত হয়ে বললেন, “কে! কে তুমি?”

“আমাকে চিনতে পারছ না?”

“তুমি! তুমি তো সেই। তুমি এখানে কেন?”

“তুমি যে আমাকে দেখতে চেয়েছিলে, তাই তো তোমার কাছে এসেছি।”

“তুমি চলে যাও এখান থেকে।”

তাই কি হয়? আমি যে তোমাকে নিতে এসেছি। কাল অত করে তোমার জন্য শ’ খুঁড়লাম, কাঠ কেটে চিতা সাজালাম, কলসিতে জল ভরে রাখলাম, সে তো তোমারই জন্য। এখন থেকে আমরা দু’ বন্ধুতে একসঙ্গে ঘুরে বেড়াব, কেউ কাউকে আর অবিশ্বাস করব না।”

“না না না। তুমি চলে যাও। আমি তোমাকে সহ্য করতে পারছি না।”

কিন্তু কাল যখন সামনে এসে দাঁড়ায় তখন কি সে সহজে যায়? বিষ্টু মশাল দেখলেন গত রাতে শ্মশানে দেখা সেই লোকটি কেমন যেন ঘোলাটে চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটির মুখ কী ভয়ানক!

হঠাৎ দেখলেন তার চেহারাটার কেমন যেন পরিবর্তন হচ্ছে। গায়ের মাংসগুলো গলে গলে খসে পড়ছে। দেখতে দেখতে লোকটির চেহারা একটি কঙ্কালে পরিণত হল, আর সেই কঙ্কালের চোখ দুটো দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে পড়তে লাগল। সেইসঙ্গে কী ভয়ানক ফ্যাঁসফেঁসে গলার হাসি। বিষ্টু মশাল ভয়ে দু’ চোখ বুজে আর্তনাদ করে উঠলেন।

বাইরে যাঁরা অপেক্ষা করছিলেন তাঁরা সবাই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন। কিন্তু এ কী! ঘরের ভেতর কেউ তো নেই! কোথায় গেলেন গুনিন? সেই ভিন গাঁয়ের আগন্তুক? তবে বিষ্টু মশাল আছেন। প্রাণহীন দেহ নিয়ে নিথর হয়ে শুয়ে আছেন অন্তিম শয়ানে।

ভোজঙ্গার ডাঙালে সেই রাতেই সৎকার হল তাঁর। অবশ্য তাঁর চিতা তো একদিন আগেই সাজানো ছিল। কলসি ভর্তি জলটাও রাখা ছিল একপাশে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *