শিবদাস ভাদুড়ি
বাংলায় sport বলতে বুঝায় খেলা বা ক্রীড়াকৌতুক। এখানে জ্ঞানীরা ও-ব্যাপারটাতে মোটেই আমল দেন না বা দিতেন না এবং জাতীয় জীবনে তার বিশেষ প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করতেন না। কিন্তু ইউরোপীয়দের, বিশেষ করে ইংরেজদের কথা স্বতন্ত্র। পুরুষোচিত দেহগঠনের তথা জাতিগঠনের উপযোগী ক্রীড়াকৌতুকের অসামান্য সাফল্য তারা প্রকৃষ্টভাবে প্রমাণিত করেছে। ইংরেজরা বলে, আমরা ওয়াটার্লুর যুদ্ধে জিতেছি ইংল্যান্ডের ক্রীড়াক্ষেত্রেই। তারা জানে, পঙ্গু দেহে সক্রিয় মস্তিষ্কের চেয়ে সক্ষম দেহে সবল মস্তিষ্কের কার্যকারিতা হচ্ছে বেশি। তারা বড়-বড় পণ্ডিত, বৈজ্ঞানিক, সাহিত্যিক ও শিল্পীর সঙ্গে ডন ব্র্যাডমান প্রমুখ খেলোয়াড়দেরও স্যার উপাধিতে ভূষিত করতে ইতস্তত করে না।
ক্রীড়াক্ষেত্রে মোহনবাগানের অবদান ভারতবর্ষে অমর হয়ে থাকবে। শিবদাস ছিলেন সেই মোহনবাগানের অতুলনীয় মুকুটমণি। প্রায় চল্লিশ বছর আগে মোহনবাগান ফুটবল খেলার মাঠে বিখ্যাত একটি ইংরেজ খেলোয়াড়ের দলকে পর্যুদস্ত করে যখন শিল্ড লাভ করেছিল, তখন সারা দেশে যে বিস্ময়, আনন্দ ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল, এ যুগের বালক ও যুবকদের কথা ছেড়ে দিই, প্রৌঢ়রাও তা উপলব্ধি করতে পারবেন না। ও ঘটনাটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রায় পলাশীর যুদ্ধের প্রতিশোধের মতো। কলকাতার পথে পথে সেদিন যেসব স্মরণীয় দৃশ্য দেখেছি, তা দেখতে পাইনি ভারতের প্রথম স্বাধীনতা দিবসেও।
অতিবৃদ্ধ গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দেহ তাঁর রোগে পঙ্গু। তিনি কারবার করেন সাহিত্য ও শিল্প নিয়ে, খেলার মাঠে কোনওদিন পদার্পণ করেছেন বলে শুনিনি। এই অভাবিত সংবাদ শুনে উচ্ছ্বসিত ভাষায় বলে উঠলেন, ‘বাঃ! আমাদের আজ বড় আনন্দের দিন! বাংলাদেশের ছেলেদের উপর কিছু ভরসা হচ্ছে! এও যে দেখব তা ভাবিনি।…মনে করে দেখ দেখি, যে লাল মুখ দেখলে আমরা ভয়ে আঁৎকে উঠি, বরাবর মনে করে থাকি আমরা চেষ্টা করলে তাদের চেয়ে intellectually বড় হলেও হতে পারি, কিন্তু বাহুবলে তাদের কাছে কস্মিনকালে শিখ-গোর্খা যেতে পারে—সেইজাতের মিলিটারি দলকে খেলায় পরাজিত করা কম কাজ নাকি? একটা ভয়—একটা সঙ্কোচ যেটা শুধু ঝগড়া ছায়া—সেটা দূর হয়েছে। এখন আমরা মনে করতে পারি যে বাহুবলে আমরা তাদের সামনে এগিয়ে যেতে পারি—প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে চেষ্টা করে তাদের পরাজিত করতে পারি। বা, খুব বাহাদুর! বাংলাদেশকে এই খেলায় জিতিয়ে দশ বছর এগিয়ে দিয়েছে।’
সেই বিখ্যাত খেলায় নেমেছিলেন মোহনবাগানের এগারো জন খেলোয়াড় এবং প্রত্যেকেরই ক্রীড়ানৈপুণ্য হয়েছিল চমৎকার। কিন্তু তাঁদের ভিতরে শিবদাস বিরাজ করেছিলেন মধ্যমণির মতো। মোহনবাগানকে বিজয়-গৌরবে গরীয়ান করেছিল শিবদাসের প্রতিভাই।
আমি তখন গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলের ছাত্র। মার্কাস স্কোয়ারে গিয়ে প্রতিদিন ক্রিকেট-ফুটবল-হকি খেলারও চর্চা করি কিছু কিছু। আমার তখনকার সমসাময়িক খেলোয়াড়দের মধ্যে ডোঙাবাবু, হাবুলবাবু ও স্বর্গীয় সুকুল পরে মোহনবাগানের দলে যোগ দিয়েও যশস্বী হয়েছিলেন (শেষোক্ত দুইজন তো শিল্ড-বিজয়ী দলের মধ্যেও ছিলেন)। আর্ট স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার আগে প্রত্যহই গড়ের মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলা দেখে আসতুম। সেই সময়ে আমার চোখের সামনেই মোহনবাগান প্রথম ট্রেডস কাপ লাভ করে বিখ্যাত হয়ে ওঠে! তখনকার দিনে ওই প্রতিযোগিতার গৌরব ছিল আজকের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু মোহনবাগান উপর-উপরি তিন-তিনবার ট্রেডস কাপ জিতে চ্যাম্পিয়ান আখ্যা লাভ করে। তখন তার প্রধান প্রতিযোগী ছিল মিলিটারি মেডিক্যাল ও ন্যাশন্যাল স্পোর্টিং-এর দল। প্রথমোক্ত দলটিতে খেলত অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা এবং তাদের উইলিয়মস নামে এক দীর্ঘদেহ যুবকের নিপুণ খেলা এখনও আমার মনে আছে। শেষোক্ত দলটির সব খেলোয়াড়ই ছিলেন বাঙালি এবং তাদের গোলরক্ষক বাঁকাবাবু তখন খুব নামজাদা। ন্যাশনাল এর আর এক খেলোয়াড় ছিলেন ক্ষেত্রবাবু। ছোটখাটো বেঁটে মানুষটি, কিন্তু তার অগ্রগতি রোধ করা ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার। স্মরণ আছে, এক বৎসর ন্যাশনাল-এর বিরুদ্ধে উপর-উপরি তিনদিন খেলে মোহনবাগান জয়ী হতে পেরেছিল।
কেবল তিনবার ট্রেডস কাপ জয় করার জন্যে নয়, আর এক বিশেষ কারণে মোহনবাগানের নাম ফিরতে লাগল লোকের মুখে মুখে। ইংল্যান্ডের অসামরিক দলের মধ্যে তখন সমধিক প্রসিদ্ধ ছিল ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাব। তাকে যে নিম্নতর কোনও দেশীয় দল হারিয়ে দিতে পারে এটা ছিল একেবারেই কল্পনার অতীত। কিন্তু মোহনবাগানের দলে একজন বাইরের খেলোয়াড় আছে, এই অজুহাতে কর্তৃপক্ষ সে খেলাটি নাকচ করে দেন।
মোহনবাগানের এইসব বিজয়-যাত্রার অধিনায়ক রূপে অতুলনীয় খ্যাতি অর্জন করলেন শিবদাস ভাদুড়ি।
সাধারণত তিনি লেফট লাইনে খেলতেন। একহারা ছিপছিপে দেহ, বিপুল-বপু ইংরেজ প্রতিযোগীদের পাশে কী নগণ্যই দেখাত। কিন্তু বলের উপরে যেমন তাঁর অসামান্য দখল ছিল, তেমনি তাঁর গতিও ছিল অত্যন্ত দ্রুত। প্রতিযোগীদের অনায়াসেই এড়িয়ে একেবারে কর্নারের কাছে গিয়ে তিনি সেন্টার করতেন, নয় বলটিকে এক পদাঘাতে প্রেরণ করতেন গোলপোস্টের দিকে। লাইন থেকে তার মতো আর কোনও খেলোয়াড়কে আজ পর্যন্ত এত বেশি গোল দিতে দেখিনি—অধিকাংশ খেলাতে গোল দেওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করতেন তিনিই। হয় নিজে গোল দিয়েছেন, নয় সুগম করে দিয়েছেন গোল দেওয়ার পথ। তাঁর আর একটি অদ্ভুত অভ্যাস ছিল। বেগে ছুটতে ছুটতে এগিয়ে গিয়ে গোলের দিকে বল মেরেই তিনি প্রায়ই হতেন ভূতলশায়ী। হয়তো অতিরিক্ত দ্রুতগতির টাল তিনি সামলাতে পারতেন না।
আর একটি ব্যাপার লক্ষ করেছি। লেফট ইনে অর্থাৎ ঠিক পাশেই তাঁর দাদা বিজয়দাস ভাদুড়ি না থাকলে শিবদাসের খেলা তেমন খুলত না। দাদার সঙ্গে তাঁর ঠিক মনের মিল ছিল বলেই তাঁরা দুজনেই বুঝতেন দুজনের খেলার ধরন ও কৌশল। সামনে বাধা পেলেই দুই ভাই এমন কায়দায় পরস্পরের সঙ্গে বল বিনিময় করতেন যে, প্রতিপক্ষেরা দেখত দুই চোখে অন্ধকার। বিজয়দাসও একজন সুচতুর ভালো খেলোয়াড় ছিলেন।
১৯১১ খ্রিস্টাদের শিল্ড ফাইনালের ছবি আজও চোখের সামনে ভাসছে। কিন্তু কী অবিশ্বাস্য কষ্ট স্বীকার করেই যে সে খেলা খেলতে হয়েছে! জানতুম মোহনবাগানের নামেই মাঠে জনতার সৃষ্টি হয় এবং শিল্ডের চরম খেলায় সেই জনতা যে বহুগুণ বেড়ে উঠবে, এটাও আমার অজানা ছিল না। বেশ সকাল-সকালই মাঠে গিয়ে হাজির হলুম। কিন্তু দেখলুম এক কল্পনাতীত, অসম্ভব দৃশ্য! সমস্ত গড়ের মাঠটা পরিণত হয়েছে জনতাসাগরে, তেমন বিপুল জনতা জীবনে আর কখনও চোখে দেখিনি। খেলার মাঠের দিকেও অগ্রসর হওয়ার কোনও উপায়ই নেই। তখন তো গ্যালারি ছিল না, লোকে খেলা দেখত ভাড়া দিয়ে ছয় ফুট থেকে বারো-চোদ্দো ফুট উঁচু মাচানের উপর চড়ে। নিতান্ত পলকা, বিপজ্জনক মাচান, প্রায়ই মানুষের ভার সইতে না পেরে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ত—কারুর মাথা ফাটত, কারুর হাত-পা ভাঙত। কিন্তু সে-সব মাচানেও আর তিলধারণের ঠাঁই নেই, দ্বিগুণ ভাড়ার লোভ দেখিয়েও একটুখানি পা রাখবার জায়গা সংগ্রহ করতে পারলুম না।
ইডেন গার্ডেনে ফিরে গিয়ে ম্লানমুখে জনকোলাহল শ্রবণ করছি, এমন সময়ে এক পরিচিত ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা, তিনি ওই বাগানের রক্ষক। আমার দুঃখের কথা শুনে তিনি তখনই একখানা লম্বা মই আনিয়ে বললেন, ‘দক্ষিণ দিকের একটা দেবদারু গাছে চড়ে খেলা দেখুন।’ অন্য কোনও উপায় না দেখে তাই করতে হল।
প্রায় আড়াই তলা উঁচু একটা ডালের উপরে বসে সানন্দে দেখলুম, জনতার ফ্রেমে বাঁধানো গোটা খেলার মাঠটি চোখের সামনে পড়ে রয়েছে। বাইরের মাঠও মানুষের মাথায় মাথায় কালো হয়ে উঠেছে, কিন্তু তখনও জনতার পর জনতার স্রোত। দেখতে দেখতে দুই পক্ষের খেলোয়াড়দের আবির্ভাব, রেফারির বংশীধ্বনি এবং খেলা হল শুরু।
মোহনবাগানের প্রতিযোগী ইস্ট ইয়র্কের দল ঠিক বিজেতার মতোই প্রবল বিক্রমে খেলতে লাগল, বাঙালিরাও বাধা দিতে লাগল প্রাণপণে। বল একবার ছুটে যায় ওদিকে, আবার ছুটে আসে এদিকে। অবশেষে মোহনবাগানের গোল থেকে বেশ খানিকটা দূরে ইস্ট ইয়র্ক পেলে একটি ফ্রি-কিক। কিন্তু কী দুর্বিপাক! গোলরক্ষক হীরালালকে এড়িয়ে বল সাঁৎ করে ঢুকে গেল মোহনবাগানের গোলপোস্টের ভিতরে। বাঙালি দর্শকরা বজ্রাহত! ইংরেজরা প্রচণ্ড আনন্দে উন্মত্ত—চিৎকার করতে করতে কেউ লাফায়, কেউ শূন্যে টুপি ছোড়ে, কেউ পায়রা উড়িয়ে দেয়। কালা আদমির কাছে পরাজয়! কবি হেমচন্দ্রের ভাষায়—’নেভার নেভার!’
কিন্তু তারপরেই পাওয়া গেল শিবদাসের অপূর্ব প্রতিভার আশ্চর্য পরিচয়। তিনি যেন মরিয়া, তিনি যেন ‘একাই একশো! তাঁর স্থান যে লেফট লাইনে এ কথা আর তার মনে রইল না। কখনও পুরোভাগে, কখনও এদিকে, কখনও কখনও সেদিকে এবং বলও ছুটছে তাঁর সঙ্গে-সঙ্গে। সর্বত্রই শিবদাস। সে যেন ইস্ট ইয়র্ক বনাম শিবদাসের খেলা। আচম্বিতে শিবদাসের পদ ত্যাগ করে একটি বল উল্কাবেগে ছুটে গেল ইস্ট ইয়র্কের গোলের দিকে এবং তখনকার সর্বশ্রেষ্ঠ গোলকিপার ক্রেসি তাকে স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারলেন না।
গোল! গো-ল! গোও-ল! বিশাল জনসাগরের সেই গগনভেদী কোলাহল গঙ্গার ওপার থেকেও শোনা গিয়েছিল! আমার পাশের গাছের একটা উঁচু লম্বা ডালে মাথার উপরকার আর একটা ডাল ধরে শাখামৃগের মতো সারি সারি বসে ছিল দশ-বারোজন লোক। উত্তেজনায় আত্মবিস্মৃত হয়ে উপরকার ডাল ছেড়ে তারা দুই হাতে তালি দিতে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে ঝুপঝুপ করে মাটির উপরে গিয়ে অবতীর্ণ হল সশব্দে। তাদের আর্তনাদ শুনতে-শুনতে সভয়ে আমি কোঁচা খুলে গাছের গুঁড়ির সঙ্গে নিজের দেহকে বেঁধে ফেললুম। কী জানি বাবা, বলা তো যায় না, আমারও যদি দৈবাৎ হাততালি দেওয়ার শখ হয়!
মায়াবী শিবদাসের ইন্দ্রজাল তখনও শ্রান্ত হয়নি, তখনও তিনি বল নিয়ে দুর্বার গতিতে ছুটোছুটি করছেন এখানে-ওখানে, যেখানে-সেখানে। রীতিমতো মস্তিষ্ক চালনার সঙ্গে সঙ্গে পদচালনা না করলে সেরকম খেলা কেউ খেলতে পারে না। প্রতিপক্ষের দশাসই চেহারাগুলো কিছুতেই তাঁর ক্ষিপ্রগামী ছিপছিপে দেহের নাগাল ধরতে পারছে না—যেন আলেয়া। আবার তিনি হলেন গোলের নিকটবর্তী। একজন প্রতিযোগী বাঘের মতো তাঁর সামনে এসে পড়ল, কিন্তু তিনি টুক করে বলটি তুলে দিলেন নিজেদের সেন্টার ফরোয়ার্ড অভিলাষের পায়ের উপরে এবং অভিলাষও কিছুমাত্র ভুল করলেন না।
আবার ইংরেজদের কানে ভয়াবহ সেই হাজার-হাজার কণ্ঠের আকাশ ফাটানো জয়ধ্বনি করতালি! নর্তন ও কুর্দন। সাহেবদের আসনে সমাধির স্তব্ধতা।
বাজল খেলাশেষের বাঁশি। বাঙালির প্রথম শিল্ড অধিকার। পুরুষোচিত ক্রীড়াক্ষেত্রে কালোর কাছে গোরার প্রথম পরাজয়। তার পরের দৃশ্য বর্ণনাতীত। বাড়ি ফিরেছিলুম সারা শহর মাড়িয়ে, অনেক রাতে।
খেলার মাঠে সেদিন শিবদাসের যে ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলুম তার তুলনা পাইনি অদ্যাবধি। অবশ্য তার পরে তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিখত হওয়ার ও আলাপ করবার সুযোগ পেয়েছিলুম বটে, কিন্তু ক্রীড়কের বিশেষত্ব ক্রীড়ানৈপুণ্যে; তাই তাঁর মুখের ভাষা লিপিবদ্ধ না করলেও ক্ষতি নেই।