শিক্ষা-সংকট

শিক্ষা-সঙ্কট

বড়বাজার হইতে ঠিক দুপুরে পিকেটিং সারিয়া আসিয়া ভিক্টোরিয়া গার্লস্ স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্রী সুচারু শুনিল, তাহার বিবাহ। এই লইয়া একটা প্রোটেস্ট মীটিংয়ের যোগাড়- যন্ত্র করিবার কিংবা তাড়াতাড়ি জেলে ঢুকিয়া পড়িবার পূর্বেই সে বধূবেশে বি-এন-ডব্লিউ- আরে’র একটি স্টেশনে, সুদূর বেহারে, তাহার স্বামীর ঘরে আসিয়া হাজির হইল। ব্যাপারটির আকস্মিকতা সম্বন্ধে বন্ধুকে লেখা তাহার নিজের একখানি পত্র হইতে উদ্ধৃতি করিয়া দিলাম :

“ভাই, চোখে দেখতে দিলে না, কানে শুনতে দিলে না, একেবারে ঘাড়ে হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ল। যখন বুঝলাম, এ প্রভাতফেরিও নয়, বড়বাজারও নয়, পুলিসও নয়, তখন টু লেট, সময় উতরে গেছে; দেখি, গাড়ি থেকে নেমে মূর্তিমতী সিভিল ডিওবিডিয়িন্সের মতো পিছনে পিছনে স্বামীর ঘরে ঢুকছি!”

প্রথমবারে অতটা বোঝা যায় নাই। বিয়ে উপলক্ষে অত্মীয়কুটুম্বে বাড়িটা গমগম করিতেছিল; তিন চারিটা দিন গোলমালে এক রকম কাটিয়া গেল। অবস্থাটা টের পাওয়া গেল ঘর করিতে আসিয়া, প্রাণটা যেন হাঁপাইয়া উঠিতে লাগিল।

জায়গাটি অজ পাড়াগাঁ। চারিদিকে টানা মাঠ, মাঝখানটিতে স্টেশন আর গোটাকতক কোয়ার্টার্স। তারের বেড়ার বাহিরে এখানে ওখানে ছড়ানো দুই-চারিটা দরিদ্র চালাঘর – থাকে দশাই, নবাবজান, বুধনী, তেতলী, দুখিয়ার মা। কেহ কুলীর কাজ করে, কেহ ইঞ্জিনের ছাই বাছিয়া বাবুদের কয়লা যোগায়, কেহ মালগুদাম ঝাঁট দিয়া ধান-গম বাছিয়া দিন গুজরান করে।

বাঙালির মধ্যে বড়বাবু, মালবাবু আর পোস্টমাস্টারবাবু—এই তিন ঘর। আর এক ঘর আছে, তবে ঠিক প্রতিবেশী বলা চলে না, মাইল দুয়েক দূরে সূরষপুরার করালীবাবু, তামাকের ব্যবসা করেন, আর কিছু জমিজমাও আছে। সংক্ষেপে ‘তামাকবাবু’ নামে পরিচিত। উৎসবে-ব্যসনে সব কয়টি একত্র হয়।

বড়বাবু গান্ধীজীর উপরে মর্মান্তিক চটা। তাহার উপর আবার দৈব উপহাসের মতো এক গান্ধী-শিষ্যা এক-রকম ঘাড়ে আসিয়া পড়ায় বিদ্বেষটা ইদানীং আরও বাড়িয়া গিয়াছে যেন। নিজের সহযোগীদের একত্র করিয়া বলেন, ‘গবর্মেন্ট তো ব্যতিব্যস্ত হবেই, তোমাদের নিজেদের কথাই ভেবে দেখ না গো। জানো, দিনে রেতে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সাতখানি গাড়ি আসবে, সাতখানি যাবে; বেশ নিশ্চিন্দি আছ; হঠাৎ খবর এল, স্পেশ্যাল গুড্‌স রান করছে, কেমন সামাল সামাল পড়ে যায়? মনে হয় না, এ আবার কোথা থেকে এক উপদ্রব এসে জুটল রে বাবা? লাটসাহেব থেকে গ্রামের চৌকিদারটি পর্যন্ত লাইন-বাঁধা, হাজার রকম কাজ, সেইগুলোকে গাড়ি বলে ধরে নাও, দিব্যি গতায়াত চলছে; মাঝখান থেকে তোমার গান্ধী বলে বসলেন, আমি এর মধ্যে আমার খদ্দরের মালগাড়ি এনে ফেলব।”

সমস্ত আন্দোলনটি এক কথায় পরিষ্কার হইয়া যায়। নীরব প্রশংসায় কেহ ঘাড় নীচু করিয়া টেবিলে আঁচড় কাটিতে থাকে; কেহ কেহ বা পরস্পরের মুখের দিকে চায়; কেহ বলে, “অথচ এই সহজ কথাটা কেউ বোঝে না, দেখুন তো!”

কথাগুলা অন্দরমহল পর্যন্ত পৌঁছায়। বড়বাবু যখন বলতে আরম্ভ করেন, “বুঝলে গা?”

সুচারুর কানেও ওঠে। আগে চুপ করিয়া থাকিত; এখন বলে, “আমার সামনে বলতেন, তবে তো—”

স্বামী একেবারে স্তম্ভিত হইয়া পড়ে, বলে, “তুমি কি বড়বাবুর সঙ্গে কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে নাকি?”

বড়বাজারের ভূতপূর্ব ভলান্টিয়ার সোজা জবাব দেয়, “কেন, বড়বাবু পীর নাকি?”

.

ঠিক কোমর বাঁধিয়া সামনা-সামনি ঝগড়া এখনও হয় নাই, তবে এক সময় যে না হইতে পারে, এ কথা জোর করিয়া বলা যায় না। কারণ অন্তরীক্ষ হইতে যুযুধান দুই পক্ষই বাক্যবাণ মোচন করিতেছেন, এবং সেগুলি নিয়তই লক্ষ্যস্থানে পৌঁছিয়া প্রতিপক্ষকে জর্জরিত করিতেছে।

স্বামী বলে, “তুমি বুধনী আর দুখিয়ার মাকে চরকা দিয়েছ বুঝি? কেন এসব বাই বল দিকিন? বড়বাবু এই সবগুলো যখন বাক্যি ধরেন, আমার তো লজ্জায় মাথা কাটা যায়। বলছিলেন, আর কেন বৃথা খেটে মরি মালবাবু? গিন্নিরা স্বরাজ উইন করলে অন্তত মোটা পেনশন একটা তো পাবই। বলে, সতীর পুণ্যে পতির স্বর্গলাভ—”  

সুচারু হাসিয়া বলে, “আমার নাম করে বল, বলছিল—পতিদের নিতান্ত সেই রকম অধঃপতন না হলে এ রকম ভরসার কথা মনে উদয় হয় না; দ্রৌপদী, সতীর যখন বিবস্ত্ৰা হবার উপক্রম, তাঁর পাঁচটি পতিদেবতা নিশ্চয় নিশ্চিন্ত মনে বসে এই রকম স্বর্গবাসের কোনো মহৎ কল্পনায় বিভোর ছিলেন। ভাগ্যিস বেচারীর তাঁদের আশা ছেড়ে দিয়ে নিজের ওপরই নির্ভর করবার সুবুদ্ধিটা যুগিয়ে গিয়েছিল! কথাগুলো বলতে পারবে তো?”

স্বামীর এখানেও মাথা কাটা যায়। লজ্জিত ভাবে বলে, “হ্যাঃ, আমি তাঁকে বলতে গেলাম! একজন বয়োজ্যেষ্ঠ মুরুব্বী লোক—”

কিন্তু কথাগুলো পৌঁছায় অন্য সূত্র দিয়া, আরও সালঙ্কারে এবং টীকা-টিপ্পনী সমন্বিত হইয়া।

দুপুরবেলা যখন কর্তারা স্টেশনে, মালবাবুর বাড়িতে মেয়েদের তখন জমাট মজলিস বসে। বড়বাবুর স্ত্রী, কন্যা, বিধবা ভগিনী কিরণলেখা, পোস্টমাস্টারের খুড়ী আর দুই পক্ষ, স্বয়ং গৃহকর্ত্রী,—এঁরা নিয়মিত সভ্যা। ক্যাজুয়েল ভিজিটার বা আগন্তুকদের মধ্যে তেতরী, দুখিয়ার মা, সুনরী, বুধনী। কখনও কখনও তামাকবাবুর বলদে-টানা শাম্পেনি আসিয়া হাজির হয়; দুই কন্যা নামিয়া পিছনের পা-দানির দুই পাশে সতর্কভাবে দাঁড়ায়, গাড়োয়ান গিয়া বলদের জোয়াল চাপিয়া ধরে, তারপর হুঁকা হাতে মাঝে মাঝে দুই একটি টান দিতে দিতে আর অস্বাভাবিক ভাবে হাঁপাইতে হাঁপাইতে নামেন তামাক-গিন্নি। হিন্দুস্থানীরা বলে— তামাকু-মাইজী। বাবুরা আখ্যা দিয়াছেন—টোব্যাকো কুইন। সুবিপুল শরীর, যেমন দীর্ঘে, তেমনই আড়ে; হিন্দুস্থানীদের বারোহাতি শাড়ি না হইলে কুলায় না। নামিয়াই মালবাবুর স্ত্রীকে বলেন, “কই গো মালিনীদিদি, আমার ছিলিমটা আগে ভরিয়ে দাও ভাই। এইটুকু আসতেই হাঁপিয়ে মলাম, বিপর্যয় মোটা হওয়া যে কি বিপত্তি!”

তাহার পর কন্যার দিকে চাহিয়া রাগিয়া বলেন, “তবুও তোর বাপ বলবে—আরও দুখানা লুচি বাড়াও, আধখানা হয়ে গেছ! মিথ্যেরও তো একটা সীমে আছে?”

ভারমুক্ত স্প্রিংয়ের শাম্পেনি তখনও দুলিয়া দুলিয়া সায় দিতে থাকে।

মজলিসটা মুখ্যত তাসের; গৌণত নানা প্রসঙ্গের আলোচনা হয়, হাতের কাছে যাহা কিছু পাওয়া যায়। বলাই বাহুল্য যে, সে-রকম মুখরোচক প্রসঙ্গ জুটিলে গৌণটাই মুখ্য হইয়া দাঁড়ায়। তাসের মতোই ভাঁজিয়া ভাঁজিয়া ফাঁটিয়া ফাঁটিয়া সবার মধ্যে চারাইয়া দেওয়া হয়, তাহার পর সবাই নিজের শক্তিসামর্থ্য অনুযায়ী গুছাইয়া-গাছাইয়া তাসের সঙ্গে সঙ্গেই নিজেদের মন্তব্য দিতে থাকে মাথা দুলাইয়া, পানের রসের সঙ্গে, গুল-দোক্তা-জর্দার ঝাঁঝের সঙ্গে মিলাইয়া মিলাইয়া।

কোনোদিন প্রসঙ্গটা হয়ত ঠাট্টার সঙ্গে হাজির হইল। মালবাবুর স্ত্রী বলিলেন, “কি গো বড়গিন্নি, কথায় কথায় এত ভুল আজ? গোলামকে আর দুটো ক্ষেপ হাতে রাখতে পারলে না?”

বড়গিন্নি এক টিপ গুল ঠোঁটের নীচে টিপিয়া লইয়া বলিলেন, “গোলামকে হাতে রাখতে হলে বিবির সেপাই হতে হয়, তা তো আর বাপ-মায়ে করে নি দিদি।”

শরটির লক্ষ্য কোথায় সবাই বুঝিল। কেহ মুখ টিপিয়া হাসিল, কেহ শুধু মাথা নাড়িল, কেহ চিন্তিতভাবে তাস দিয়া শুধু বলিল, “তা বটে।”

বড়গিন্নি বলিলেন, “কালকে সেই কথাই ও বলছিল কিনা, তুই একটা সামান্য বুকিং ক্লার্ক, তোর পাস-করা বউয়ের কি দরকার বাপু! আবার ভলেন্টিয়ার! সামলা এখন!

কিরণ বলিল, “মেয়েটি কিন্তু বড় ভালো বাপু! যাই বল। আমি দুদিন গিয়েছিলাম কিনা, সর্বদাই হাসি, খুব আমুদে; তার মাঝে স্বদেশীর কথাও হয়! তা এমন গুছিয়ে বলতে পারে, যে, আমাদেরই মনে হয়—”

ভাজ জুড়িয়া দিলেন, “কাছা-কোচা এঁটে বেরিয়ে পড়ি।”

পোস্টমাস্টারের দ্বিতীয় পক্ষ হাসিয়া বলিল, “দাদাকে বন্দুক-তলোয়ার কিনে দিতে বলতে হবে, না, যা একজোড়া বাণ আছে তাইতেই চলবে?”

কিরণ ফিরিয়া চাহিল, হাসিয়া বলিল, “মরণ আর কি! তা না চলে, যাদের অস্ত্রে রোজ শান পড়ছে তাদের নিয়ে গেলেই হবে।”

মালবাবুর স্ত্রী বলিলেন, “তা তাকে নিয়ে আসিস না বাপু ডেকে। আহা, পাসের পড়া মেয়ে বলেই যে লোক মন্দ হবে তার কি মানে আছে, শহরে তো ও-রোগ এখনও ঘরে- ঘরে।”

কোনোদিন তেতরীর মেয়ের নবীনতম দাম্পত্য-বন্ধনের কথা ওঠে।

“শুনেছ গা তামাক-গিন্নি, লছমিনিয়ার এ বরের সঙ্গেও বনল না?”

তামাক-গিন্নি হুঁকা হইতে মুখ ছিনাইয়া লইয়া বলেন, “ঝাঁটা মার দেশের মাথায়।” ছোটদের মধ্যে কেহ বলে, “এ দেশ না হলে কিন্তু তোমার হুঁকো-তামাক বন্ধ হয় ঠানদিদি।”

ঠানদিদি হাসিয়া বলেন, “তা মিছে নয় ভাই। রেণুর বিয়েতে তিনটি দিন ঠিক ছিলাম মেমারিতে, ঠিক তিনটি দিন গোনাগুনতি; পেট ফুলে যাই আর কি! হুঁকো-তামাক নেই, সে আবার দেশ, ম্যাগ্‌গে! নাঃ, সে বিষয়ে এ দেশের যশ গাইতে হয় বই কি।”

হুঁকায় দরদভরা জোর টান পড়ে।

যেদিন অন্য বিষয় না থাকে, ঝোঁক পড়ে বাড়ির কর্তাদের উপর। এ প্রসঙ্গে সবাই এমন সহজ গভীর অভিজ্ঞতা প্রকাশ করে যে, প্রসঙ্গটি বেশ অল্পের মধ্যেই পুষ্ট হইয়া শাখা- প্রশাখায় বিস্তারিত হইয়া উঠে।

আসিবার অল্পদিনের মধ্যেই কিরণরেখা সুচারুকে টানিয়া আনিয়া মজলিসে হাজির করিল, এবং অবিলম্বেই এই জমায়েতটুকুর মধ্যে তাহার একটি বিশিষ্ট জায়গা মিলিয়া গেল। আর, ইহার মধ্যবর্তিতায় সাধারণভাবে পুরুষ-মহলের সঙ্গে এবং বিশেষভাবে বড়বাবুর সঙ্গে দিনের পর দিন তাহার বোঝাপড়া চলিতে লাগিল।

কেহ শুধু বার্তাবাহিকারই কাজ করে, ওদিককার খবর এদিকে, আর এদিককার খবর ওদিকে হাজির করিয়াই খালাস। এ দলে আছেন বড়গিন্নি, মালবাবুর স্ত্রী, পোস্টমাস্টারের প্রথম পক্ষ! কতক, বিশেষ করিয়া নবীনদের মধ্যে, সুচারুর দলভুক্ত হইয়া পড়িয়াছে এবং নতুন দীক্ষার উৎসাহে গুরুকেও টপকাইয়া গিয়াছে। এদলে নবীনা না হইলেও আছেন তামাক-গিন্নি। পরোক্ষ-আগত পুরুষদের কথায় সুচারু যখন জবাব দিতে থাকে, তখন ইহারা প্রচণ্ড বিক্রমে যোগান দেয়—মূল গায়েনের চেয়ে দোয়ারদের সুর চড়া হইয়া উঠে। তামাকগিন্নি হুঁকায় ঘন ঘন টান দিতে দিতে বলেন, “তা হক কথা কইতে কখনও ডরাই না বাপু! কেন, পুরুষদের কি একটা করে লেজ আছে যে সব তাতে তাঁরাই সর্বেসর্বা হবেন? “ পুরুষদের পক্ষও যে অবলম্বন করিবার লোক নাই এমন নয়, পোস্টমাস্টারের খুড়ী আছেন। মজলিস ত্যাগ করিয়া সুচারু উঠিয়া গেলে দুয়ারের দিকে লক্ষ্য করিয়া সংক্ষেপে মন্তব্য করেন, “গলায় দড়ি।”

গলায় দড়ি, কিন্তু কাহার? সুচারুর, না, পুরুষমাত্রেরই? তাহাদের একমাত্র উকিল, পুরাতনের জীর্ণাবশেষ ভীমরতিগ্রস্ত এই সত্তর বৎসরের বৃদ্ধার অভিমতটা চব্বিশ ঘণ্টাও টিকে না। পরের দিন সুচারু মাথার পাকা চুল তুলিয়া দিতে দিতে যখন হাসিয়া প্রশ্ন করে,

“হ্যাঁ রাঙা-ঠাকুমা, আমার নাকি কাল গলায় দড়ির ব্যবস্থা হয়েছে?”

তিনি আকাশ থেকে পড়েন, বলেন, “বালাই ষাট, কে অমন কথা বলে র‍্যা, জিবের একটু আড় নেই? বালাই ষাট, সিঁথির সিঁদুর বজায় থাক, নাতি-নাতকুড় নিয়ে ঘর—”

হাসির হররায় আশীর্বাদের স্রোত চাপা পড়ে। কিরণলেখা বলে, “আপাতত নাতি- নাতকুড়দের ঠাকুরদার সঙ্গেই ঘর-করা মুশকিল হয়ে পড়েছে রাঙা-ঠাকুমা। এ বলে, চরকা কাট; ও বলে, টিকিট কাটবে কে?”

ঠাকুরমা বলেন, “তা তো ঠিকই বলে বাছা, টিকিট না কাটলে—”

ঠিক তালের মাথায় সুচারু বাধা দেয়, মুখটা হঠাৎ ঠাকুরমার মুখের সামনে আনিয়া বলে, “শরীর তো তোমাদেরই রাঙা-ঠাকুমা, এখনও এত কাঁচা চুল মাথায়। হ্যাঁ রাঙা-ঠাকুমা, কে ঠিক বলে বল তো? না, আমি বলেই যে আমার মুখ চেয়ে বলবে, তা বলো না কিন্তু।”

ওদিকে আঙুলগুলো আরও মোলায়েমভাবে চলিতে থাকে। ঠাকুরমা একটু ফাঁপরে পড়িয়া যান, খোশামোদ আর নগদ আরামের মোহ কাটাইয়া উঠিতে না পারিয়া বলেন, “বলছিলাম, তা আর কি এমন অন্যায় কথা বলিস ভাই!”

আবার হাসির লহর উঠে। কালা মানুষ আবার যাহাতে চটিয়া না যান, তাহার জন্য তাড়াতাড়ি একটা মনগড়া কারণ খুঁজিয়া বলিতে হয়।

কথাগুলো রাত্রে বড়বাবুর কানে উঠে মন্তব্য সমেত। বড়গিন্নি হাসিয়া বলেন, “খুব উকিল পেয়েছ যা হোক।”

বড়বাবু ভারি হইয়া উঠেন। বলেন, “একটা বুড়ো-হাবড়ার কাছে আর বাহাদুরি কি? পড়েন একদিন শর্মার মুখের সামনে, ভলেন্টিয়ারি ঘুচিয়ে দিই, শুধু কথার তোড়ে যত সব—”

বড়গিন্নি প্রবল বেগে মাথা নাড়িয়া বলেন, “সে পারবে না বাবু, কেন মিছে বড়াই কর?”

বড়বাবু কপালে চোখ তুলিয়া বলেন, আমি বড়াই করছি? ওই এক-ফোঁটা একটা কনে-বউ, ওর কাছে আমি মুখে হারব? তুমি যে অবাক করলে!”

এই সময় বরাবর ওদিকেও প্রায় এই ধরণেরই আলাপ চলিতে থাকে। স্বামী হীরু স্টেশন-মজলিসের রিপোর্ট দাখিল করিয়া বলে, “বড়বাবুর মুখের কাছে তো পারবার জো নেই, বললেন—”

বধূ সুচারু বলে, “একপাল মেনিমুখো পুরুষের সামনে ও-রকম সবারই কথা ফোটে। পড়তেন আমার সামনে—”

স্বামী বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে তাকাইয়া বলে, “বল কি তুমি?”

স্ত্রী বলে, “কেন বড়বাবু কি পীর, না পয়গম্বর—শুনি?”

সাক্ষাৎকারের এ রকম প্রবল বাসনার জন্যই হউক বা যে জন্যই হউক রহস্যপ্রিয় বিধাতা-পুরুষ একটু সুযোগ করিয়ে দিলেন। তবে ঠিক সুযোগই বলা যায় কি?

.

গান্ধী-আরুইন চুক্তি স্বাক্ষরিত হইয়া দেশে শান্তি স্থাপিত হইয়াছে—অসহযোগ আন্দোলন কিছুদিন মুলতুবী রহিল।

দেশের নারীদের মধ্যে কেহ কেহ স্বরাজ-রণে নারীশক্তির প্রকৃত পরিচয় পাইয়া, এই অবসরে জাতির মধ্যে তাঁহাদের স্থানটা কোথায় সেই সম্বন্ধে একটা মীমাংসা করিয়া লইতে চান। যেখানে তাঁহার স্ত্রী, সেখানে আসলে তাঁহারা কি? চরণাশ্রিতা দাসী, না তুল্যপদস্থা না অভিভাবিকা? যদি অভিভাবিকা নয়, তো কেন নয়? কোন স্বার্থান্বেষী ধূর্ত, কোন প্রবঞ্চক দায়ী তাহার জন্য?

স্বরাজ-সেনার অনেককে না পাইলেও এ বাহিনীর তেমন ক্ষতি হয় নাই; কেননা এই গৃহযুদ্ধে কায়মনোবাক্যে আত্মনিয়োগ করিবার মতো কর্মীর মোটেই অভাব হয় নাই।

কেহ কেহ বলিতেছেন, কেন, আর স্ত্রী হওয়াই বা কিসের জন্য? ঢের হইয়াছে; একেবারে গোড়ায় কোপ দিয়া আলাদা হও। পুরুষের বুজরুকি এতদিনেও চিনিলে না?

যাঁহারা সাময়িক ইতিহাসের খবর রাখেন, তাঁহাদের ‘উগ্রশক্তি’ কাগজখানার অভিযানের কথা মনে থাকিতে পারে; নেহাতই উগ্ৰশক্তি বলিয়া নিজের উত্তাপে দগ্ধ হইয়া যায় নাই।

এই সবের প্রতিধ্বনি সুচারুর বন্ধুর চিঠিতে খানিকটা শব্দিত হইয়া উঠিয়াছে। লেখা আছে—”আমার তো দৃঢ় প্রতিজ্ঞা : ও-জাতকে আজীবন এড়িয়ে চলব। তোমার জন্যে দুঃখ হয়। কিন্তু যা হয়ে গেছে তার তো আর চারা নেই; এখন যাতে মানুষটির মাথায় পুরুষের সেই চিরন্তন বর্বর ধারণাগুলি বাসা বেঁধে তাকে অত্যাচারী, অসহিষ্ণু, দাম্ভিক, আত্মম্ভরী, অবিনয়ী, কঠোর—অর্থাৎ পুরুষ বলতে পৃথিবী যা এতদিন বুঝে এসেছে তাই না করে তোলে, সেদিকে নজর রাখতে হবে। এর জন্যে উপযুক্ত শিক্ষা চাই। ওদের কর্মজীবনের মধ্য থেকে, ওদের চিন্তার মধ্য থেকে, এক কথায় ওদের নিজেদের মধ্যে থেকে মাঝে মাঝে ওদের টেনে বার করে আনতে হবে। পুরুষের Czar যুগ নষ্ট হয়েছে, এ কথা ওদের ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়ার ভার আমাদের ওপর; আমরা যদি এতে অপারগ কি পশ্চাৎপদ হই তো আমাদের ধিক—-শতাধিক—সহস্র ধিক।”

পুরুষের সংসর্গই হানিকারক, অন্তত সুচারুর যে অধঃপতন ঘটিয়াছে এ কথা অস্বীকার করা যায় না। সে শত্রুপক্ষের প্রতিনিধি তাহার স্বামীকে পত্রখানি দেখাইয়াছে; এবং এইখানি উপলক্ষ্য করিয়া নিতান্ত লঘুভাবে তাহাদের যে একচোট রহস্যালাপ হইয়া গিয়াছে, তাহা শুনিলে নিতান্ত সহিষ্ণু নবীনারও সোজা মাথা হেঁট হয়। তবুও শিক্ষার—বিশেষ করিয়া এখানের লোকগুলির শিক্ষার প্রয়োজনটা সে অস্বীকার করে না। ইহারা যাহাতে নবযুগের নারীকে পুরুষের পাশে তাহার ন্যায্য আসনটি অধিকার করিতে দেখিয়া ক্ষুব্ধ বা বিস্মিত না হয়, সেই শিক্ষাদানের চেষ্টা তাহার নিজের গৃহে তো চলিলই, তাহা ছাড়া মজলিসেও এমন প্রোপাগান্ডা আরম্ভ করিয়া দিল যে, প্রায় সকল সভ্যাই আত্ম-প্রতিষ্ঠা এবং স্বামী-সংস্কারে বদ্ধপরিকর হইয়া উঠিল। তবে সুখের বিষয় গৃহে কোনো রকম অশান্তির সৃষ্টি হইল না। সুচারুর লেখা একখানি চিঠি হইতে তুলিয়া বলিতে গেলে—”এখানকার অধিকাংশ স্বামীই এমন সিভিল আর ওবিডিয়েন্ট যে অল্প চেষ্টাতেই কাজ হাসিল হয়েছে। দু- একজন তো চাওয়ার অধিকই দিয়ে বসে আছে। আহা, বেচারী সব! এরা যুদ্ধের উপযোগীই নয়।”

তামাক-গিন্নির তো এক রকম স্বরাজ ছিলই, এখন একেবারে পূর্ণ-কর্তৃত্ব। পোস্টমাস্টারবাবুর দ্বিতীয় পক্ষের শেষ রিপোর্ট—”কাল রাত্রে খোকা উঠলে ও-ই ঘাড়ে করে বাইরে নিয়ে গেল, ধোয়ালে, মোছালে, ঘুম পাড়ালে; করবে নাই বা কেন, বল? এতদিন ভুল করে একাই তো করে এসেছি।”

এমন কি, বৃদ্ধ মালবাবুর পর্যন্ত সুমতি হইয়াছে। অজীর্ণরোগী বলিয়া তিনি বরাবরই সকালে বেড়াইতে যান; আজকাল দুই পকেটে আলু পটল লইয়া বাহির হন, একখানি ছুরির সাহায্যে কুটনা কুটিয়া নিজের অভিনব কর্তব্যরাশির প্রথম দফা সাঙ্গ করিয়া বাড়ি ফিরেন।

সুচারু হাসে। ভাবে, দলপতিকে ছাড়াইয়া দল অনেক সময় আগাইয়া চলে; তাহারা নিজেরাই কি গান্ধীজীর নরম ভাব লইয়া সব সময় কাজ করিতে পারিত?

বাকি কেবল বড়বাবু। তা তিনি এখন কয়েকদিন যাবৎ উপস্থিত নাই। প্রতি বৎসর এই সময়টা সপ্তাহ কয়েকের ছুটি লইয়া দেশে যান, ক্ষেতের ধান চালের বিলি করিয়া আসিতে। এবারেও গিয়াছেন। অনা পুরুষগুলিকে যে রেটে তালিম দেওয়া হইয়াছে, তাহাতে তামাক-গিন্নি, পোস্টমাস্টারের দ্বিতীয়া প্রভৃতি মনে করিয়াছিল, বড়বাবুকে লইয়া বেশি বেগ পাইতে হইবে না। তাহার পর সব পুরুষগুলির মানসিক উৎকর্ষের জন্য একটা ক্লাব-গোছের প্রতিষ্ঠিত হইবে। শেষে তাহাদের সঙ্কীর্ণতা একেবারেই লোপ পাইলে স্ত্রীরাও গিয়া যোগদান করিবে—এই ছিল খসড়া।

বড় ভুল বুঝিয়াছিল। বড়বাবু আসিয়া ব্যাপারটা বুঝিবার পর প্রথমেই একসেট নূতন নাম সৃষ্টি করিলেন। হীরু হইল হীরামন বিবি, পোস্টমাস্টারবাবু হইলেন মেজগিন্নি, বৃদ্ধ মালবাবু হইলেন আঁবুইমা। বাহিরে সমস্ত দিন ঠাট্টা-তামাসায় জর্জরিত হইয়া হীরু আসিয়া বলিল, “না বাপু, ওসব স্বাধীনতা-ফাধীনতা আমার দ্বারা হবে না, দিব্যি তো ছিলাম!”

অন্য স্বামীগুলিও উল্টা গাহিতে আরম্ভ করিয়াছে। পোস্টমাস্টারের দ্বিতীয়া আসিয়া মুখ অন্ধকার করিয়া বসিয়া থাকে; বিনা কারণেই বাপের ধাঁচ পাওয়ার অপরাধে শিশুটিকে পিটিয়া দেয় এবং সুবিধা পাইলেই বড়গিন্নিকে লক্ষ্য করিয়া বলে, “বড়দিদির ঢিলেপনাতেই সব মাটি হল।”

তামাক-গিন্নি অন্তরীক্ষ হইতে একেবারে বড়বাবুকেই লক্ষ্য করিয়া বলেন, “ঠিক তো, তুমি মাতব্বর, পরিবারকে পায়ে থেঁতলাতে চাও থেঁতলাও, অপর সবাইকে উস্কে দেওয়া কেন? খুনসুড়ি!”

এর উপর তিন-চারদিনের মধ্যে আবার এও শোনা গেল যে, বড়বাবু পাশের জংশন-স্টেশনের থিয়েটার-পার্টিকে দিয়া অমৃতলাল বসুর ‘তাজ্জব ব্যাপার’ পালা করাইবার উদ্যোগ করাইতেছেন।

প্রমাণ পাওয়া গেল, এখানকার দুই-একজন পার্টও লইয়াছেন। দুপুরবেলা মাঝে মাঝে স্টেশন হইতে যে অট্টহাস্যের রোল শোনা যায়, সেটা রিহার্সালেরই।

বড়বাবুর পিট-চাপড়ানিতে স্পর্ধাটা বাড়িয়াই চলিয়াছে। মালবাবু নাকি রাত্রে বাড়িতে আসিয়া পার্ট মুখস্থ করেন শোবার ঘরে। স্ত্রী সবার সামনে নাক সিঁটকাইয়া বলিল, “কি গেরো বল দিকিন? রাত একটা পর্যন্ত কানের কাছে মেয়েলী টোনে ভেংচি কাটা!”

.

সেদিন রাত আটটা পর্যন্ত মেয়েদের জমায়েত পুরোদমেই চলিয়াছে। সাতটার গাড়িতে পাশের স্টেশন হইতে বুকিং-ক্লার্কের মেয়েরা আসিয়াছেন অনেকগুলি। দুপুরবেলা তামাক- গিন্নি আসিয়াছিলেন, আটক পড়িয়া গেলেন।

আজ আবার বেটাছেলেরা সব সাতটার গাড়িতে জংশন-স্টেশনে গেল, নিশ্চয়ই পুরা রিহার্সালের জন্য। এমন কিছু সুখের কথা নয়, কিন্তু আজ অন্তত মজলিসটা জমিবার পক্ষে খুব সুবিধা হইয়াছে।

সকলে প্রাণ খুলিয়া তাস-লুডো হাসি-ঠাট্টায় মাতিয়া উঠিয়াছে। স্টেশনের চার্জে মার্কারবাবু, সে এই সময়টা সিদ্ধিতে বুঁদ হইয়া থাকে; আর তাহা ছাড়া খোট্টা বলিয়া বাঙালি মেয়েদের কাছে আমলই পায় না। বেটাছেলেরা সাড়ে নয়টার গাড়িতে ফিরিতেই পারে না। সব আহার সারিয়া গিয়াছে, ফিরিতে সেই বারোটা।

একচোট হাসি-হল্লার পর ঘরটা একটু ঠাণ্ডা হইয়াছে। বুকিং-ক্লার্কের শালী মাথার কাপড়টা নামাইয়া দিয়া চুলের গোড়াটা কষিয়া দিতে দিতে বলিল, “যাই হোক বাপু, এ রকম থিয়েটার করে মেয়েদের অপদস্থ করতে যাওয়া বড়বাবুর ঠিক হচ্ছে না। আমাদের বেনারস হলে কেউ সইত না।”

কথাটা এমন কোমল স্থানে স্পর্শ করিল যে, মজলিসে অঙ্গসঞ্চালনের জন্য যে আওয়াজটুকু হইতেছিল, সেটুকু পর্যন্ত বন্ধ হইয়া গেল। শুধু পোস্টমাস্টারের প্রথম পক্ষ ভিতরে ভিতরে একটু খুশিই হইয়াছিলেন, প্রসঙ্গটিকে চালু করিবার জন্য প্রশ্ন করিলেন,

“আচ্ছা, তাজ্জব ব্যাপারটা হচ্ছে কি?”

তামাক-গিন্নির বড়মেয়ে রেণুবালার নূতন বিবাহ হইয়াছে। বিহারের পাড়াগাঁ হইতে বাহির হইয়া সে আজকাল নভেল-নাটকের একেবারে সপ্তম স্বর্গে বিচরণ করিতেছে, আর সেটা জানাইবার আগ্রহটাও খুব। বলিল, “তুমি হাসালে দেখছি বড় বউদি, অমৃতলাল হলেন রসরাজ, ‘তাজ্জব ব্যাপার’ তাঁর একখানা নামজাদা বই, আর তুমি বলে বসলে কিনা— কোনদিন হয়ত বলবে, প্রসুনকুমারের ‘প্রাণের বেসাতি’ও পড় নি, মনুজবাবুর ‘তরুণীর করুণা’ নাটকখানার নামই—”  

বাধা দিয়া পোস্টমাস্টারের গৃহিণী বলিলেন, “ক্ষ্যামা দে ভাই, আমরা আদার ব্যাপারী, জাহাজের খবর রাখি না। আসল কথাটা জানিস তো বল।”

বুকিং-ক্লার্কের শালী বলিল, “তাতে পুরুষেরা কুটনো কুটবে, বাটনা বাটবে, সংসারের সব পাট করবে; আর মেয়েরা পাস দিচ্ছে, রাজনীতি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছে—”

তেতরীর মা কলিকা সাজিয়া হুঁকায় বসাইয়া দিল; দুইটা টান দিয়া তামাক-গিন্নি বলিলেন, “অতটা আবার ঠিক নয়; ও যেন পুরুষকে ছাপিয়ে যাওয়া, কি বলিস নতুন বউ?”

সুচারু ভারিক্কে হইয়া বলিল, “তা বইকি; তার থেকে বরং মিলে-মিশে একসঙ্গে বসে তামাক খাওয়া ভালো।”

সকলে হাসিয়া উঠিল। তামাক-গিন্নিও হুঁকা মুখে করিয়া যোগ দিলেন, বলিলেন, “তোরা কেউ ধরলিও না, স্বাদও বুঝলি না; খালি ঠাট্টা করেই কাটালি।”

একটু চুপচাপ গেল। তার পরে কিরণলেখা চিন্তিতভাবে বলিল, “আচ্ছা, বেটাছেলে সাজলে দেখায় কেমন মেয়েদের? বোধ হয়—”

তাহার ভাজ বলিলেন, “একবার দেখই না সেজে। দোব এনে ভাইয়ের জামা কাপড়? ভাইয়ের মত চেহারাও আছে, এমন কি গলার আওয়াজটাও।”

পোস্টমাস্টারের প্রথমা বলিল, “তাহলে দিদিরও মাঝখান থেকে অনেক দিন আগের তোমার যুবো ভাইটিকে একটু দেখা হয়ে যায়।”

বড়গিন্নি একটু অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন, “পোড়া কপাল!”

কিন্তু কয়েকটি তরুণ-মুখে কৌতুক উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতে লাগিল। কি যেন সব মনে মনে আঁচিতেছে, অথচ মুখ ফুটিয়া বলিতে রা সরে না।

তামাক-গিন্নির মেজমেয়ে বলিল, ‘নতুন বউদি তো বেটাছেলে সেজেছিলেন তাঁদের স্কুলের থিয়েটারে, সেদিন বললেন আমায়—”

সুচারু লজ্জিতভাবে হাসিয়া বলিল, “হ্যাঁ, তোমার কান ধরে বলতে গিয়েছিলাম!” কয়েকজন ধরিয়া বসিল, “তা হলে সাজতেই হবে। কি সেজেছিলে বল, ছাড়া হচ্ছে না।”

প্রবীণারা বলিল, “সাজ না বাপু, একটু রঙ্গ দেখি; আর কেউ তো বেটাছেলে নেই আজ যে–”

সবচেয়ে মর্মে গিয়া পৌঁছিল পোস্টমাস্টারের দ্বিতীয়ার কথাটা। অন্ধকারপানা মুখটা আরও ভার করিয়া সে বলিল, “উচিতই তো। ওরা যেমন তোমাদের নিয়ে নকল করছে, সারারাত কানের কাছে ভেংচি কাটছে, তোমরাও তার পাল্টা জবাব দাও; নাই জানুক, নাই দেখুক, নিজেদের মনে একটা তৃপ্তি হবে তো।”

বক্তার মুখের গাঢ় অন্ধকার অন্য সকলের মুখেও একটু ছায়াপাত করিল। নবীনাদের জিদ আরও বাড়িয়া গেল : হ্যাঁ, পাল্টা জবাব দেওয়া চাইই। ওদিকে সঙ্গেসঙ্গে সুচারুর নিজের মধ্যেও স্কুলের কৌতুকময়ী ছাত্রীটি উঁকি মারিতেছে; সে বলিল, “হ্যাঁ, রঙ্গ যে বলছ, রঙ্গ কি একা-একাই হয় নাকি?”

আবার একচোট চুপচাপ। সব পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিল। তামাক-গিন্নি বুকিং-ক্লার্কের শালীকে বলিলেন, “তাহলে আপনিও সাজুন; বেনারসের মেয়ে, তায় স্কুলে পড়া—না, আমরা কোনো ওজর শুনছি না।”

সে নিমরাজী হওয়ার সঙ্কুচিত ভাব দেখাইয়া বলিল, “আমি শুধু মেয়ে-থিয়েটার দেখেছি মাত্র।”

সমস্বরে মত প্রকাশ হইল, “তার মানে—করেছেনও, কিচ্ছু শোনা হবে না, নিন।” তামাক-গিন্নি হুঁকায় ঘন ঘন টান দিতেছিলেন, বলিলেন, “হ্যাঁ, ‘শিকারী বেড়ালের গোঁফ দেখেই চেনা গেছে।”

আবার একটা হাসির তোড় উঠিল। থামিলে বুকিং-ক্লার্কের শালী বলিল, “তাহলে আপনাকেও বাদ দিচ্ছি না।”

তামাক-গিন্নি হুঁকা হইতে মুখ সরাইয়া সাশ্চর্যে বলিলেন, “আমায়!”

কিরণলেখা জোর দিল, “হ্যাঁ ঠানদি, তুমি তো হুঁকা হাতে আদ্দেক পথ এগিয়েই রয়েছ; কোনো পুরুষের বরং তামাক-মাইজী সাজতে হলে ভাবনার কথা।”

হাসি-কলরব বাড়িয়া চলিল। সুচারুর মনে একটা প্লট জমিয়া উঠিতেছিল, বলিল, “ঠানদি যদি নামেন তো একটা জিনিস সবাইকে দেখিয়ে দিই; আমাদের কলেজে হয়েছিল। ঠানদি না হলে কিন্তু হবে না। মাড়োয়ারি সাজা আর কারও দ্বারা হবে না, নেকিরাম মাড়োয়াড়ি—ইয়া ভুঁড়ি, ব্যবসা করেন আর কঙ্কড় খান—সে এক রকম গাঁজার মতন জিনিস।”

সকলে এমন তুমুল গোলমাল করিয়া তামাক-গিন্নিকে ধরিয়া বসিল যে, তিনি রাজী হইয়া কোনো রকমে পরিত্রাণ পাইবার মাত্র অবসর পাইলেন।

স্ফূর্তির ঘূর্ণি হাওয়া একে একে সকলকেই নিজ গহ্বরে টানিতে লাগিল।

সুচারু কিরণলেখার দিকে একটা অর্থপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিল, “মেইন পার্ট আর একটি মাত্র বাকি রইল।”

কিরণলেখা সত্রাসে হাতমুখ নাড়িয়া বলিল, “না, আমি পারব না, দোহাই। আমি আর সব পারি, শুধু বেটাছেলে সাজা আমার দ্বারা—”

তামাক-গিন্নি কৃত্রিম রোষে ঝাঁজিয়া উঠিলেন, “তবে রে! আর আমি বুঝি কিছুই পারি না, পারি এক বেটাছেলে সেজে নাচতে আর গাঁজা খেতে?”

সুচারু বলিল, “না, তোমায় সাজতেই হবে কিরণঠাকুরঝি! এইবার ঠিক হয়েছে। ওঁরা দুজনে সাজবেন পিকেটার, দুটো খদ্দরের টুপি হলে ভালো হয়; আমি হব দারো―। না, সে আর এখন বলছি না; তুমি হবে স্টেশনমাস্টার কিরণ-ঠাকুরঝি, দাদার পোশাকও রয়েছে; একজন পয়েন্টসম্যান চাই, তুমি হও মেজদি।”

তামাক-গিন্নির মেজমেয়ে উল্লাসে হাততালি দিয়া উঠিল, “উঃ, কি মজাই হবে! শিগগির সাজো নতুন বউদি। উঃ, যদি দাড়ি-গোঁফ পরচুলো থাকত!”

বড়গিন্নি বলিলেন, “সে দুঃখই বা থাকে কেন? ও তো কলকাতা থেকে জংশন- ইস্টিশানের থিয়েটারের জন্যে দাড়িগোঁফ সাজগোজ মেলাই কি সব এনেছে, আর পয়েন্টসম্যান সাজার জন্যে পানি পাঁড়ে বুধনের জামা আর পাগড়িটা আনিয়ে নিচ্ছি, সে এতক্ষণ রহড়িয়ায় তাড়ি গিলতে গেছে।”

বাকি কথাগুলা একচোট হট্টগোলের মধ্যে চাপা পড়িয়া গেল। থামলে সুচারু হাসিয়া বলিল, “তা হলে তো সোনায় সোহাগা। আমরা তা হলে তোমার বাসা থেকেই সেজে আসছি। কিরণঠাকুরঝি, জানো তো কোথায় সাজগুলো আছে? আমায় কিন্তু আলাদা ঘর দিতে হবে সাজতে বাপু, কারুর সামনে আমি সাজতে পারি না। হ্যাঁ, ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিই, স্টেশনে নেকিরাম মাড়োয়ারির বিলিতি কাপড়ের গাঁটরি এসেছে, পিকেটারদের কাছে খবরটা পৌঁছে গেছে, ঠিক দলবল নিয়ে হাজির। (কিরণলেখার দিকে চাহিয়া) এদিকে স্টেশনমাস্টার বক্কেশ্বরবাবু আঁকাবাঁকা চালে নধর বপুখানি দোলাতে দোলাতে—”

কিরণলেখা হাসিয়া চোখ রাঙাইয়া বলিল, “আচ্ছা থাম, আর ব্যাখ্যানায় কাজ নেই।”

.

জংশন-স্টেশনে এস্ট্যাবলিশমেন্ট-ক্লার্ক রমণীবাবুর বাসায় রিহার্সাল খুব জমিয়া উঠিয়াছে। রাত্রি সাড়ে নয়টা বাজে, ডাউন ট্রেন খুলিবার সময় হইয়াছে। আমাদের বড়বাবু পকেট হইতে ঘড়িটা বাহির করিয়া বলিলেন, “যাই, আমি একবার ফোন করে দেখে আসি, যে ব্যাটা মার্কার ওদিকে ধাতস্থ আছে কিনা, গাড়িটা যাচ্ছে—। একবার গার্ড বনোয়ারিলালকেও বলে আসি, আমরা এখানে, সেখানে সব ঠিকঠাক করে রেখে এসেছি—”

একটি যুবক উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “আপনি বসুন, আমি খোঁজ নিয়ে আসছি, গার্ড সাহেবকে বলে দোব।”

বড়বাবু বলিলেন, “না, মার্কার যদি বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে তো এই ট্রেনে চলেই যাব। ট্রেনখানা যাচ্ছে, ওদিক থেকেও ফিফটি-নাইন আপ গুডস্ আসার সময় হল, শেষে একটা কাণ্ড! আর আমি না থাকলে তো ক্ষতি হবে না, যাদের পার্ট আছে তারা তো রইলই। মার্কারবাবু যদি ঠিক থাকে, চলে আসছি।”

টেলিগ্রাফ অফিসে প্রবেশ করিতেই তারাবাবু একটা কাগজ বাড়াইয়া দিয়া বলিল, “এই যে, আপনাকেই খুঁজছিলাম, একটা প্রাইভেট মেসেজ এইমাত্র এল।”

বড়বাবু ভয়ত্রস্তভাবে কাগজটা হাতে লইলেন। মার্কার যদুনন্দন লিখিতেছে—”Tell Bara Babu come sharp at once Daroga entered house.” উদ্দেশ্য—বড়বাবুকে অতি শীঘ্র আসিতে বল, বাড়িতে দারোগা প্রবেশ করিয়াছে।

এই সময় দ্বিতীয় ঘণ্টা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি হুইস্ দিল। বড়বাবু কাগজটা মুঠোর মধ্যে মুড়িয়া ছুটিয়া গিয়া উঠিয়া পড়িলেন!

পথের সময়টুকু দুশ্চিন্তার মধ্যে কখন কাটিয়া গেল টেরও পাইলেন না। গাড়ি হইতে নামিয়া সটান স্টেশন-ঘরে গিয়া দেখেন, যদুনন্দন ভয়ে আর সিদ্ধির নেশায় একেবারে জবুথবু হইয়া বসিয়া আছে। যাইতেই হাত-পা নাড়িয়া বলিল, “হামার জরু কহলা ভেজী হ্যায়, বড়বাবু, আপকা ঘরমে এয়সা এক দারোগা! হামকো নেই বোলানেসে হাম কেঁও যায়গা? হাম কেয়া কিয়া হ্যায়?”

যদুনন্দন যে বীর নয়, এ জ্ঞান যদিও বড়বাবুর তখনও ছিল, তথাপি অনেকক্ষণ পরে একজনকে সামনে পাইয়া হাত দুইখানা যদুনন্দনের মুখের কাছে নাড়িয়া খিঁচাইয়া বাংলাতেই বলিয়া উঠিলেন, “সব পাস করা ভলেন্টিয়ার বউ রাখ, চরখা কাট, হতভাগা আমায় সুদ্ধু জের-বার করলে রে!”

হন হন করিয়া বাহির হইয়া গেলেন।

.

বড়বাবুর ঘরের দরজা ও বারান্দার দিকের জানালা বন্ধ করিয়া সুচারু সাজিতেছিল। নিশ্চয়ই নিঃশব্দে খানাতল্লাশি চলিতেছে। দরজায় আস্তে আস্তে দুইটি ঘা পড়িল, এবং কম্পিতস্বরে আওয়াজ হইল, “হুজুর, দারোগাসাহেব!”

সুচারু পায়ে পট্টি বাঁধিতেছিল, একটু মৃদু হাস্য করিয়া স্বর যথাসম্ভব পুরুষ করিয়া বলিল, “সবুর করো, দিক করো মৎ।”

মুহূর্তের বিরাম, তাহার পর আরও মগ্নসুরে মিনতি হইল, “হুজুর মেহেরবানি করকে, হাম ঘরকা মালিক হ্যায়, ভলেন্টিয়ার তো হীরুবাবুকা ঘরমে—”

পট্টিতে গেরো দিতে দিতে সুচারু বলিল, “আঃ, জ্বালালে কালামুখী! তোমায় না বললাম কিরণঠাকুরঝি, আমার শেষ না হলে আমায় ডেকো না, আর এই পট্টি বাঁধা এক হ্যাঙ্গাম!”

দুয়ার খুলিয়া মর্দানা-কায়দায় বুকে হাত জড়াইয়া বলিল, “দেখা চিনতে পারতা হ্যায়? গোঁফ দেখকে ডরতা? ও কি, তুই যে নির্বাক হয়ে গেলি কিরণঠাকুরঝি! দেখ কাণ্ড ছুঁড়ীর!” বড়বাবুর বিস্ময়ে নিশ্বাস রোধ হইয়া আসিতেছিল। অস্ফুটস্বরে বলিলেন, “এ কি ব্যাপার?”

সুচারু হাফপ্যান্টের কোমরবন্ধটা কষিয়া দিতে দিতে হো-হো করিয়া হাসিয়া বলিল, “চমৎকার! তোর দাদা সামনে পড়লেও ঠিক অমনই হতভম্ব হয়ে গিয়ে ওই কথাই জিজ্ঞেস করত, আর চেহারাও তো ঠিক করেছিস, মায় মাথায় টাকটি পর্যন্ত। কই, পরচুলার সঙ্গে টাক তো দেখলাম না পুঁটুলির মধ্যে? পেলি কোথায়? একেবারে অবিকল দাদাটি। দেখিস, বউদিদি না ভুল করে—”

বড়বাবু হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিলেন, “আপনি না হীরুবাবুর স্ত্রী?”

সুচারু আরও সজোরে হাসিয়া উঠিল। বলিল, “আজ্ঞে হ্যাঁ, হীরুবাবুর ইস্তিরি, দস্তুরিভুক, মাস্টারমশাই।” সঙ্গে সঙ্গে বড়বাবুর কাঁধের উপর একটা প্রচণ্ড চড় বসাইয়া বলিল, “ব্রেভো! তুই ভাই, সিনেমাতে যা, লুফে নেবে, টকিতেও তুই মাত করে দিবি। উঃ, আমারই সন্দেহ ধরিয়ে দিচ্ছিস, তা অন্যের আর কথা কি! নাঃ, আমি আর লোভ সামলাতে পারছি না, তোর দাদাকে তো কখনও সামনে পাব না, তোর ওপর দিয়েই গায়ের ঝাল মিটিয়ে নিই, জয়চন্দ্র যেমন নকল পৃথ্বীরাজের ওপর দিয়ে আশ মিটিয়ে নিয়েছিল, আয়—”

বিমূঢ় অসহায় বড়বাবুর আর বাক্যস্ফূর্তি হইতেছিল না। “আয়” বলিতে এক পা পিছনে বাড়াইলেন। সুচারু তাঁহার হাতটা ধরিয়া হিড়হিড় করিয়া ভিতরে টানিয়া আনিয়া জোর করিয়া সামনের চৌকিটার উপর বসাইয়া দিয়া বলিল, “দারোগাকা হুকুম নেহি মানতা? বস এমনই করে। মনে কর, তুই যেন তোর দাদা, আর আমি যে দারোগা তাও একটু ভুলে যা। এইবার শোন,—দেখুন মশাই, আপনার অত্র স্টেশনের জীবগুলি হচ্ছেন কুয়োর ব্যাং, আর আপনি হচ্ছেন আবার ধেড়ো ব্যাং। ধেড়ে ব্যাং কথাটার ওপর যদি আপনার আপত্তি থাকে তো বুড়ে তোতা বলতেও রাজী আছি, তা নিজে ডানার ব্যবহার ভুলে থাকেন, নতুন বুলি না শিখতে পারেন, আমার স্বামী দেবতাটিকে অমন করে—না ভাই, উঠিস নি, আমার দিব্যি, বলে নি দু কথা আরাম করে। এই যে ঠানদি। ওঃ, মাইরি, তোমায় যা মানিয়েছে!”

“কি বকছিস নিজের মনে? আমি বলি বুঝি পার্ট আওড়াচ্ছে!” তামাক-গিন্নি প্রবেশ করিতেছিলেন, চৌকির দিকে নজর পড়ায় হকচকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িলেন। মাড়োয়ারি বেটাছেলের মতো কাপড়-পরা, বিশাল ভুঁড়ির বড়বাবুর কামিজটা সাঁটিয়া রহিয়াছে; মাথায় লম্বা খানিকটা পাকানো কাপড়ের লিকলিকে পাগড়ি জড়ানো।

সুচারু প্রবলবেগে হাসিয়া উঠিয়া বলিল, “এস এস। উঃ, একেবারে মাড়োয়ারি, আমাদের স্কুলেও এমনটি দাঁড় করাতে পারি নি। আরে, অমন করে দাঁড়িয়ে রইলে যে! ও যে কিরণঠাকুরঝি পোড়ারমুখী; তোমাকেও ধোঁকা দিয়েছে! তুমি কিন্তু মাইরি, ওঃ, পেটে খিল ধরিয়ে দিলে!”

তামাক-গিন্নি আগাইয়া আসিয়া নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন, “সত্যি, ধোঁকা হয়েছিল,—সেই টাক, সেই গোঁফ।” তাহার পর সন্দেহের ভাবটা কাটিয়া যাওয়ায় তিনি ও সুচারুর হাসিতে যোগ দিলেন। হাসির ঝাঁকানিতে জামাটির স্থানে স্থানে ছিঁড়িয়া ফাটিয়া যাইতে লাগিল। অনেকক্ষণ পর একটু সামলাইয়া লইয়া বড়বাবুর দিকে চাহিয়া বলিলেন, “তা, নে ওঠ, বনমানুষের মতো বসে রইলি কেন? আবাগীর রঙ্গ এক রকম নয় তো! চল, ওদেরও এতক্ষণ হয়ে গেছে।”

ডাক দিলেন, “তোদের হল র‍্যা? আয়, একবার দারোগা আর ইস্টিশন মাস্টার দেখে যা।”

হাসি চলিল।

“আর নেকীরাম মাড়োয়ারিও।” বলিয়া সুচারু হাসির চোটে পেট চাপিয়া প্ৰায় লুটাইয়া পড়িতে লাগিল।

পিকেটার বেশে বুকিং-ক্লার্কের স্ত্রী আর শালী ছুটিয়া আসিল, মালকোঁচা-মারা, গায়ে বড়বাবুর সাদা পাঞ্জাবি; তাহাদের পিছনে পিছনে পোস্টমাস্টারের দ্বিতীয়া, গায়ে বুধন পানিপাঁড়ের নীল কুর্তা, মাথায় হলদে রঙের পাগড়ি।

একেবারে চরম হওয়ার জন্যই হউক, বা যে জন্যই হউক, বড়বাবু সম্পূৰ্ণ শক্তি দিয়া মনের ভাব গুছাইয়া লইয়া বলিয়া উঠিলেন, “ব্যাপার কি এ! বড়গিন্নি কোথায়?”

হাসির একটা তুমুল কোরাস উঠিল; তাহার মধ্যে “কর্তার বড়গিন্নিকে চাই”, “পোড়ারমুখীর বুঝি মাথা বিগড়ে গেছে,”

“টাকে জল চাপড়া” গোছের কতকগুলা ভাঙা ভাঙা কথাও শুনা যাইতে লাগিল।

এমন সময় মালকোঁচার উপর প্যান্টালুনটা টানিতে টানিতে কিরণলেখা “আ মরণ! কিসের এত গোল?” বলিয়া ভিড় ঠেলিয়া সামনে আসিয়া দাঁড়াইল, এবং সঙ্গে সঙ্গে চৌকির উপর নজর পড়ায় “ও বাবা গো, দাদা যে!” বলিয়া দুই হাতে প্যান্টালুন টানিয়া ধরিয়া স্যাক-সের মতো খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে পড়ি-তো-মরি গোছের দৌড় দিয়া বাহির হইয়া গেল।

নাটকের বাকি চরিত্রবৃন্দ একবার চৌকির মূর্তিটির দিকে এবং পরক্ষণেই পরস্পরের রক্তহীন শুকনা মুখের দিকে চাহিল—মুহূর্তমাত্র, তাহার পর সেই অদ্ভুত পরিচ্ছদে লদগদ করিতে করিতে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হইয়া ছুট—কেহ খাইল দেওয়ালে ধাক্কা, কেহ চেয়ারে হোঁচট। তামাক-গিন্নি কোয়ার্টার্সের ছোট আধ-ভেজানো দুয়ারের মধ্যে আটকাইয়া গিয়া জালের মধ্যে মাছের মতো একটু ছটফট করিলেন, তাহার পর পিছনের মাছেদের ধাক্কা খাইয়া দুয়ার ঝনঝনাইয়া বাহির হইয়া গেলেন।

.

বন্ধুর চিঠি আসিয়াছে, লিখিয়াছে—”ভাই সুচু, তোমার পত্র পড়ে সুখী হলাম যে, তোমার শিক্ষার ওষুধ ওঁদের রুগ্ন নাড়ীর মধ্যে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ঘনিষ্ঠ পরিচয়ে বোঝা যায়, পুরুষ আর যাই হোক একেবারেই যে অ-বশ্য, তা নয়। জার্মানি থেকে ফিরে এলেও সম্প্রতি সুকোমলবাবুর মধ্যে যে রকম নমনশীলতার পরিচয় পাচ্ছি, তাতে এই ধারণাটাই মনে ক্রমে বদ্ধমূল হয়ে উঠছে। আমার মনে হয়, পুরুষ আর নারী আমরা পরস্পরকে সাধারণত দূর থেকে এক ছদ্মবেশে দেখা দিয়ে থাকি, কত সুখের বিষয় হত—যদি আমরা সামনা-সামনি মুখোমুখি হয়ে পরস্পরের সত্যদৃষ্টির সামনে দাঁড়াতে পারতাম! তা হলে দেখা যেত—” ইত্যাদি।

সুচারু খালি পত্রের প্রথমাংশের উত্তর দিয়াছে—”ভাই, দৈবদুর্বিপাকে শিক্ষা-ঔষধের মাত্রা হঠাৎ একটু চড়া হয়ে পড়ায় আপাতত ডাক্তার রোগী উভয়পক্ষই একটু সঙ্কটাপন্ন বোধ হয় শীঘ্রই কলকাতায় আসছি, সব কথা সামনেই হবে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *