শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অসাম্য

শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অসাম্য 

গত কয়েক দশকে মার্কিন শিক্ষার্থীদের জীবনে যে পরিবর্তন এসেছে তার বর্ণনা করতে গিয়ে একজন মার্কিন অধ্যাপক একটি ছোট অথচ গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের উল্লেখ করেছেন।’ তিনি লিখেছেন যে, বিশ বা ত্রিশ বছর আগে একজন ছাত্র যখন তার বান্ধবীর সাথে সম্পর্কের শুরু করত, তখন সে প্রথমেই তাকে বলত, “আমি তোমাকে ভালবাসি”। আজকের ছাত্রছাত্রীরা যখন একত্রে বসবাস শুরু করে তখনও ভালবাসার নাম করে না। কিন্তু তারা যখন একত্র বাসের শেষে একে অপরের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চায়, কেবল তখনই বলে, “আমি তোমাকে ভালবাসি”। তবে সেটা সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য। এক সময়ে প্রেমিক প্রেমিকারা “আমি তোমায় ভালবাসি” কথাটা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত; আজ একই বাক্য শুনলে তারা আঁৎকে ওঠে। আজকের তরুণ তরুণীদের ব্যক্তিগত জীবনে যে নীরব বিপ্লব এসেছে তার চেয়েও অনেক বেশি অতলস্পর্শী রূপান্তর ঘটেছে শিক্ষা ও অর্থের সম্পর্কে। মানুষের ইতিহাসে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যা চর্চা ছিল একটি পবিত্ৰ সাধনা। এতে লোভ লালসার কোন স্থান ছিল না। আজকে শিক্ষা একটি বিপণনযোগ্য পণ্য যা লাভ লোকসানের বেনিয়া তাড়নায় নিয়ন্ত্রিত হয়। অবশ্য শিক্ষা ও অর্থের এই টানাপড়েন নতুন কিছুই নয়। শিক্ষার আদর্শ ও লক্ষ্য নিয়ে বিতর্ক চলছে কমপক্ষে দু’হাজার বছর ধরে। বিদ্যার ক্ষেত্রে আজকে যে বৈপ্লবিক উত্তরণ ঘটছে তা ভালভাবে বুঝতে হলে আমাদের শুরু করতে হবে শিক্ষা সম্পর্কে অতি পুরানো বিতর্ক নিয়ে। 

শিক্ষার আদর্শ ও লক্ষ্য নিয়ে আনুষ্ঠানিক বিতর্ক প্রথমে শুরু হয়েছিল প্রাচীন গ্রীসে। শিক্ষার লক্ষ্য নিয়ে প্রাচীন গ্রীসে তিন ধরনের মতবাদ দেখা যায়। এক ঘরানার দার্শনিকগণ মনে করতেন, শিক্ষা অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার নয়, শিক্ষার লক্ষ্য হল জ্ঞান-অর্জন। কাজেই অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা দান অসমীচীন। আরেক ঘরানার দার্শনিকগণ বিশ্বাস করতেন যে, বিদ্যা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ আয় বাড়িয়ে দেয়; কাজেই অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা দেওয়া ন্যায়সঙ্গত। তৃতীয় মতবাদের প্রবক্তারা মনে করতেন যে, বিদ্যার জন্য অর্থের প্রয়োজন রয়েছে, তবু বিদ্যাকে অর্থের দাসে পরিণত করা মোটেও বাঞ্ছনীয় হবে না। 

প্রথম মতবাদের প্রধান প্রবক্তা ছিলেন সক্রেটিস। সক্রেটিসের মতে শিক্ষার মূল লক্ষ্য আত্মার বিকাশ, অর্থ উপার্জন নয়। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, অর্থের বিনিময়ে বিদ্যা বিক্রয় পাপ। তাই তিনি বলেছেন: “হে এন্টিফন, আমাদের মধ্যে অনেকে বিশ্বাস করে যে সৌন্দর্য অথবা জ্ঞান সম্মানজনক বা অসম্মানজনকভাবে বিতরণ করা সম্ভব। যদি কোন ব্যক্তি তাঁর দৈহিক সৌন্দর্য অর্থের বিনিময়ে ক্রয়েচ্ছু কোন ব্যক্তির কাছে বিক্রয় করে তবে আমরা তাকে দেহব্যবসায়ী বলে থাকি। অথচ এক ব্যক্তি যদি অপর ব্যক্তিকে সম্মানিত মনে করেন এবং তাঁর উপযুক্ত গুণগ্রাহী হন তবে তাঁদের মধ্যে যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তাঁকে আমরা বিজ্ঞ মনে করে থাকি। একইভাবে যাঁরা তাঁদের জ্ঞান অর্থের বিনিময়ে ইচ্ছুক ক্রেতাদের কাছে বিক্রয় করে থাকেন তাঁদের লোকেরা সফিস্ট বলে। তাঁরা হচ্ছেন জ্ঞান জগতের গণিকা। কিন্তু যদি উপযুক্ত কোন ব্যক্তির সাথে অপর ব্যক্তির বন্ধুত্ব হয় এবং ঐ ব্যক্তি যদি বন্ধুকে তাঁর জ্ঞান প্রদান করেন তবে আমরা তাকে উত্তম ও সম্মানিত নাগরিক গণ্য করে থাকি।” সক্রেটিসের মতে যে সব শিক্ষক অর্থ উপার্জনের জন্য পড়িয়ে থাকে তারা জ্ঞানের জগতে বারবনিতা। শিক্ষার উদ্দেশ্য অর্থ কামাই নয়। তাই তাঁর মতে পণ্ডিতদের জীবনে দারিদ্র্য হল অত্যন্ত প্রত্যাশিত। 

সক্রেটিসের এ মতবাদ প্রত্যাখ্যান করেন সফিস্ট দার্শনিক ঘরানার নেতা প্রোটাগোরাস। সফিস্ট শব্দের উৎপত্তি হয়েছে গ্রীক শব্দ সফিস্টাই (sophistai) হতে। এর শাব্দিক অর্থ হল জ্ঞানের শিক্ষক। প্রোটাগোরাস বিশ্বাস করতেন, বিদ্যার মূল লক্ষ্য হল বাস্তব জীবনে সাফল্যের জন্য শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা। তাই তিনি বিদ্যার্থীদের গার্হস্থ্য ও পারিবারিক ব্যবস্থাপনা, ভাবের কার্যকর প্রকাশ, রাষ্ট্রের কার্যাবলী সম্যকভাবে উপলব্ধি ও পরিচালনা এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিষয়াবলীর বিজ্ঞ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে শিক্ষা দিতেন। যেহেতু ব্যবহারিক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের জন্য মুনাফাজনক ছিল সেহেতু শিক্ষাদানের জন্য তিনি অত্যন্ত চড়া মজুরি দাবি করতেন। প্রতি ছাত্রের শিক্ষার জন্য তিনি প্রায় দশ হাজার দ্রাকমা গ্রহণ করতেন। দ্রাকমা হল রৌপ্যমুদ্রা। প্রাচীন এথেন্সে প্রতি দ্ৰাকমাতে এক বুশেল গম পাওয়া যেত। বর্তমান বাজার দরে দশ হাজার দ্রাকমা কমপক্ষে পঁচিশ হাজার ডলার হবে। আজকের নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলেও এত টাকা লাগে না। পড়ানোর জন্য এত চড়া মজুরি আদায় করাকে প্রোটাগোরাস মোটেও অন্যায় মনে করতেন না। 

তৃতীয় মতবাদের প্রবক্তা ছিলেন এরিস্টিপাস। শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি সক্রেটিসের সাথে একমত ছিলেন না। অন্যদিকে তিনি প্রোটাগোরাসের সাথেও একমত নন। তিনি বলতেন যে, বিদ্যার উদ্দেশ্য দারিদ্র্যও নয়, ঐশ্বর্যও নয়। বিদ্যা আমাদের শিক্ষা দেবে কিভাবে এদের সমন্বয় করতে হবে। বিদ্যা শিক্ষা করে শিক্ষার্থীদের ঐশ্বর্যের দাস হলে চলবে না, বরং ঐশ্বর্যের প্রভু হতে হবে। সক্রেটিস অর্থের বিনিময়ে শিক্ষাকে দেহব্যবসায়ের সাথে তুলনা করতেন। এরিস্টিপাস অবশ্য দেহব্যবসাকেও খারাপ বলে স্বীকার করতেন না। একজন বারবনিতার সাথে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে এক বন্ধু তাঁকে বিদ্রূপ করাতে এরিস্টিপাস নাকি বলেছিলেন যে, অন্যের ব্যবহৃত বাড়ি বা অন্যের ব্যবহৃত জাহাজ ব্যবহারে যদি আপত্তি না থাকে তবে অন্যের ব্যবহৃত রমণীর (বারবনিতা) সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে গ্লানি থাকবে কেন? 

প্রাচীন গ্রীসের অনুরূপ বিতর্ক প্রাচীন চীনেও দেখা যায়। কনফুসিয়াস ও তাঁর শিষ্যরা অর্থের বিনিময়ে পড়াতেন। কনফুসিয়াস মনে করতেন যে, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হল, ভবিষ্যতের আমলাদের (ম্যান্ডারিনদের) প্রশিক্ষণ প্রদান। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ম্যান্ডারিনদের দ্বারা দেশ পরিচালিত হলে সমাজে সুখ ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। পক্ষান্তরে দার্শনিক লাও জু বিদ্যার সুফল সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন। তিনি মনে করতেন যে, জ্ঞানের প্রসারের সাথে সাথে বদমাশদের সংখ্যা বাড়ছে বৈ কমছে না। বিদ্যা জ্ঞান নয়। লাও জু মনে করতেন যে, বিদ্বানরা দেশ চালাতে গেলে সর্বনাশ হবে। শাসকদের বিদ্যা কম থাকলে দেশ ভালভাবে চলবে। শুধু বিদ্যা লাভ করলেই চলবে না, প্রকৃতিকে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। তাই তাঁর মতে শিক্ষকদের শিক্ষা নয়, হৃদয়ে নীরবতা হল জ্ঞানের প্রথম সোপান। বিদ্যার উদ্দেশ্য পার্থিব সাফল্য নয় অথবা সাফল্যের সাথে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিচালনা নয়। বিদ্যার উদ্দেশ্য হল ব্যক্তিসত্তার বিকাশ। 

প্রাচীন ভারতে মনুস্মৃতিতে তিন ধরনের শিক্ষকের উল্লেখ রয়েছে।o সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে উপাধ্যায়। বাংলার বিশিষ্ট ব্রাহ্মণরা এই উপাধ্যায় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। বর্ধমান জেলার চট্ট বা চাটুতি গ্রামের উপাধ্যায়রা হলেন চট্টোপাধ্যায়, বর্ধমান জেলার গাঙ্গুল (বা গঙ্গুর) গ্রামের উপাধ্যায়রা পরবর্তীতে পরিচিত হলেন গাঙ্গুলী বা গঙ্গোপাধ্যায়, বন্দ্য গ্রামের উপাধ্যায়রা হলেন বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখটী গ্রামের উপাধ্যায়রা হলেন মুখোপাধ্যায়। মনুস্মৃতি অনুসারে উপাধ্যায়ের দুটি বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমত, এরা জীবিকা অর্জনের জন্য পড়িয়ে থাকেন। দ্বিতীয়ত, এরা সম্পূর্ণ বেদ পড়াতে পারেন না; বেদের অংশ অথবা বেদ পাঠের সহায়ক গ্রন্থসমূহ পড়িয়ে থাকেন। উপাধ্যায়গণ জীবিকার জন্য পড়ালেও তাঁরা শুধু উচ্চবর্ণের লোকদেরই পড়াতে পারেন। অর্থের বিনিময়ে নিম্নবর্ণের ছাত্রদের পড়ালে পাপ হবে। মনুস্মৃতি অনুসারে দ্বিতীয় পর্যায়ের শিক্ষকরা হলেন আচার্য। মনুস্মৃতির দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১৪০ নং শ্লোকে আচার্যের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আচার্য হলেন সেই দ্বিজ ব্যক্তিত্ব যিনি বেদের সাথে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেন ও অনুষ্ঠান সংক্রান্ত এবং আনুষ্ঠানিক গ্রন্থাদিসহ বেদ পড়ান। তিনি সাধারণত বেতন অথবা উপহার গ্রহণ করেন। আচার্য কর্তৃক উপহার গ্রহণকে লঘু অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়। অর্থের বিনিময়ে যাঁরা বেদ পড়েন বা পড়ান তাঁদের কেউই দেবতার প্রসাদ পাওয়ার যোগ্য নন। তবে শিক্ষা সমাপ্তিতে শিক্ষার্থীরা আচার্যকে উপহার দিতে পারেন। সর্বোচ্চ পর্যায়ের শিক্ষক হলেন গুরু। যে পুরোহিত আচার অনুষ্ঠান পালন করেন এবং শিশুর অন্নপ্রাশন করেন তিনি হলেন গুরু। গুরু হচ্ছেন মাতা ও পিতার মতই শ্রদ্ধেয়। গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা দেখালেই চূড়ান্ত সত্য জানা সম্ভব। প্রাচীন কালে শিষ্যরা গুরুগৃহে বাস করতেন। গুরুর পক্ষে শিষ্যদের ভরণপোষণ সম্ভব না হলে শিষ্যরা ভিক্ষা করতেন। তাছাড়া যেখানে শিষ্যরা গুরুর আশ্রমে বাস করতেন সেখানে তাঁরা কৃষি ও অন্যান্য পণ্য উৎপাদনের জন্য শারীরিক পরিশ্রম করতেন। কাজেই প্রাচীন ভারতে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল আধ্যাত্মিক, পার্থিব নয়। শিক্ষা সীমিত ছিল শুধু উচ্চবর্ণের লোকদের ধর্মশাস্ত্র শিক্ষার মধ্যে। গুরুগণ শিষ্যদের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করতে পারেন না। এই ঐতিহ্য দক্ষিণ এশীয় সঙ্গীত জগতে বর্তমান শতাব্দীতেও চালু ছিল। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানকে মাইহারের রাজা তাঁর সঙ্গীতগুরু হিসাবে বরণ করতে চান। কিন্তু আলাউদ্দিন খানের গুরু তাঁকে আদেশ দিয়েছিলেন যে, সঙ্গীত শিখিয়ে অর্থ উপার্জন করা যাবে না। তাই বাধ্য হয়ে মাইহারের মন্দিরের ট্রাস্ট থেকে ওস্তাদ আলাউদ্দিনকে বৃত্তি দেওয়া হয়। তিনি রাজাকে সঙ্গীত শেখান, কিন্তু রাজার কর্মচারী হিসাবে নয়। প্রাচীন যুগের মতই মধ্যযুগেও শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল আধ্যাত্মিক। মধ্যযুগীয় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষকরা বেতন নিলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা সচ্ছল ছিলেন না। মুসলিম-বিশ্বে উচ্চশিক্ষার মূল লক্ষ্য ছিল ইসলামী আইনে দক্ষতা অর্জন। মধ্যযুগে মুসলিম মাদ্রাসাসমূহ প্রধানত পরিচালিত হত ওয়াকফ সম্পত্তির আয় থেকে। বিশেষ বিশেষ বিষয় পড়ানোর জন্য অনেক মাদ্রাসাতে ওয়াকফ সম্পত্তি থেকে মুদাররিস-এর পদ সৃষ্টি করা হত। মধ্যযুগের শিক্ষকরা শিক্ষকতাকে বৃত্তি রূপে গ্রহণ করলেও শিক্ষা ধর্মের জগতেই সীমাবদ্ধ ছিল। 

প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, পৃথিবীর সর্বত্র অধিকাংশ দার্শনিকই শিক্ষাকে অর্থ উপার্জনের একটি নিছক নিমিত্ত হিসাবে মেনে নেননি। বরং তাঁরা অর্থের প্রতি আকর্ষণকে হেয় গণ্য করেছেন। তাই একজন দার্শনিক যথার্থই বলেছেন: “The advantage of classical education is that it enables you to despise the wealth which it prevents you from achieving.” (ধ্রুপদী শিক্ষার একটি সুবিধা হল যে এ শিক্ষা শুধু বিত্ত অর্জনের পথে একটি প্রতিবন্ধকই নয়, এ শিক্ষা বিত্তকে ঘৃণা করতেও শেখায়।) অধিকাংশ দার্শনিকই তাই স্বেচ্ছায় দারিদ্র্যকে বরণ করে নিয়েছেন। প্রাচীন গ্রীসের দার্শনিকগণ দারিদ্র্যকে শুধু সহ্যই করেননি, অনেকে বিত্তের অভাব নিয়ে গর্ববোধ করতেন। গ্রীসের একনায়ক ডায়নোসিয়াস দার্শনিক এরিস্টিপাসকে প্রশ্ন করেছিলেন, দার্শনিকগণ কেন বিত্তবানদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ায়, অথচ ঐশ্বর্যশালীরা দার্শনিকদের খুঁজে বেড়ায় না। দার্শনিক এরিস্টিপাস জবাব দিয়েছিলেন, “দার্শনিকগণ জানে তারা কি চায়, অথচ ধনীরা তা জানে না।” দার্শনিক এন্টিফেনিস ছেঁড়া কাপড় পরতেন। সক্রেটিস তাঁকে ঠাট্টা করে বলতেন, এন্টিফেনিসের পোষাকের প্রতিটি ছিদ্রে তাঁর দম্ভ দেখা যায়। 

অবশ্য সকল দার্শনিকই দারিদ্র্যের নন্দিত পথ বেছে নেননি। এঁদের অনেকেই নিজের বিদ্যাকে অর্থ উপার্জনের জন্য ব্যবহার করেছেন। এ প্রসঙ্গে প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক থ্যালিসের অভিজ্ঞতা স্মরণ করা যেতে পারে। থ্যালিস তাঁর বিদ্যা প্রয়োগ করে ফসল উৎপাদন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারতেন। একবার আবহাওয়া দেখে তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, ঐ বছর জলপাইয়ের ফলন খুব ভাল হবে। গ্রীসে জলপাই প্রধানত ব্যবহৃত হয় তেল উৎপাদনের জন্য। থ্যালিস তাঁর শহরের সবগুলি তেলের ঘানি বায়না দিয়ে রাখেন। যখন জলপাই ঘরে তোলা হল সবাই ছুটলেন তেলের ঘানি ভাড়া নেওয়ার জন্য। কিন্তু থ্যালিস সব তেলের ঘানিতেই বায়না দিয়ে রেখেছেন। কাজেই থ্যালিসকে অতিরিক্ত মুনাফা দিয়ে তেলের ঘানি ভাড়া নিতে হয় অন্যদের। ফলে থ্যালিস রাতারাতি বড়লোক হয়ে যান। 

প্রাচীন ও মধ্যযুগে বিদ্যা ছিল উচ্চবিত্তের অতি স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ কেননা পার্থিব স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য বিদ্যা প্রয়োগের সুযোগ ছিল সীমিত। গত কয়েক শ’ বছর ধরে অভাবিতপূর্ব কারিগরী পরিবর্তন মানুষের উৎপাদনশীলতা অতি নাটকীয়ভাবে বাড়িয়ে দেয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কারিগরী পরিবর্তনের প্রথম পর্যায়ে বিস্মিত হয়ে কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস লিখেছিলেন’ : 

It has been the first to show what man’s activity can bring about. It has accomplished wonders far surpassing Egyptian Pyramids, Roman aqueducts and Gothic cathedrals, it has conducted expeditions that put in the shade all former Exoduses of nations and Crusades. 

(পুঁজিবাদ প্রথম দেখিয়েছে মানুষের কার্যকলাপ কত বড় মাপের পরিবর্তন আনতে পারে। এর বিস্ময়কর কীর্তি মিশরের পিরামিড, রোমের পানির অবকাঠামো ও গথিক উপাসনালয়কে হার মানিয়ে দিয়েছে, এর অভিযানসমূহ প্রাচীন কালে জাতিসমূহের অভিবাসন ও ক্রুসেডসমূহকে ম্লান করে দিয়েছে।) 

গত দেড় শ বছরে যে সব কারিগরী পরিবর্তন ঘটেছে উনিশ শতকে মার্কস ও এঙ্গেলসের কাছে তা ছিল অকল্পনীয়। উদাহরণস্বরূপ কম্পিউটার প্রযুক্তির বিকাশের কথা স্মরণ করা যায়। গত চল্লিশ বছরে কম্পিউটার প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে কম্পিউটারের দাম যে হারে কমেছে সে হারে উড়োজাহাজের প্রযুক্তি পরিবর্তিত হলে একটি বোয়িং ৭৬৭ উড়োজাহাজ মাত্র ৫০০ ডলারে বিক্রয় সম্ভব হত এবং কম্পিউটারের প্রযুক্তিতে যে হারে উৎপাদনশীলতা বেড়েছে সে হারে উড়োজাহাজের প্রযুক্তি পরিবর্তন হলে ২০ লিটার তেলে ২০ মিনিটে একটি উড়োজাহাজ পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে পারত। উড়োজাহাজের ক্ষেত্রে এত দ্রুত কারিগরী পরিবর্তন হয়নি, কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে যে হবে না তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না। দ্রুত কারিগরী পরিবর্তনের ফলে আজকের বিশ্বে জ্ঞানই হল উন্নয়নের চাবিকাঠি এবং জ্ঞানই হল উন্নয়ন। বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদন ১৯৯৮/৯৯ থেকে প্রতিভাত হয় যে, আজকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য উৎপাদনে যত শ্রমিক নিয়োজিত তার চেয়ে অনেক বেশি লোক কাজ করছে জ্ঞানের উৎপাদনে ও বিতরণে।o এ শতাব্দীর শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ছিল তিন লাখের কম, আজকে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে এক কোটি চল্লিশ লক্ষের বেশি ছাত্রছাত্রী অধ্যয়নরত।[১০] 

গত দু’শ বছর ধরে অভূতপূর্ব কারিগরী পরিবর্তনের ফলে জ্ঞানের জগতে একটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণ দেখা দিয়েছে। এর দুটি ফলশ্রুতি দেখা যাচ্ছে। প্রথমত, বিদ্যার বিষয়বস্তুতে একটি বড় পরিবর্তন এসেছে। প্রাচীন বিশ্বে জ্ঞান ( knowledge) এবং নৈপুণ্য (techne) এর মধ্যে তফাৎ করা হতো। জ্ঞানের মত নৈপুণ্যও অর্জন করতে হয়। কিন্তু নৈপুণ্য জ্ঞান নয়। নৈপুণ্য সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা সম্ভব। একই নৈপুণ্য সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়—ভিন্ন ভিন্ন পেশার চাহিদা অনুসারে নৈপুণ্য গড়ে ওঠে। জ্ঞানের সাথে জড়িয়ে আছে মূল্যবোধ আর জীবন-জিজ্ঞাসা। কিন্তু নৈপুণ্য মূল্যবোধ-নিরপেক্ষ। দার্শনিকদের কাছে নৈপুণ্য হেয় মনে হলেও, আধুনিক বাজারে নৈপুণ্যের চাহিদা আছে, জ্ঞানের নেই। তাই আধুনিক বিশ্বে নৈপুণ্য জ্ঞানের বিকল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন কারিগরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাজের অভিজ্ঞতা তাই জ্ঞানের স্থান দখল করেছে, শিক্ষানবিসের কর্মসূচী পাঠ্যপুস্তকে রূপান্তরিত হয়েছে, পেশা সংক্রান্ত গোপন জ্ঞান ব্যবসায়ের পদ্ধতি হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা ফলিত জ্ঞান হিসাবে স্বীকৃত হচ্ছে। জ্ঞানের সাথে অর্থের সম্পর্ক ছিল ক্ষীণ, নৈপুণ্যের সাথে আয়ের প্রশ্ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে আছে। বিদ্যার আধ্যাত্মিক ভিত্তি যত দুর্বল হচ্ছে ততই তার বস্তুবাদী ভিত্তি হয়ে উঠছে সুদৃঢ়। 

দ্বিতীয়ত, আজকের বিশ্বে শিক্ষার চাহিদা মানুষের জীবন সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসা দ্বারা নির্ণীত হয় না। নির্ধারিত হয় বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে। শিক্ষা একটি বিনিয়োগ যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ব্যয় রয়েছে। মুনাফার হার আকর্ষণীয় হলেই বিনিয়োগকারীরা শিক্ষার বিশেষ শাখায় আকৃষ্ট হয়। যেখানে মুনাফা বেশি সেখানেই বিনিয়োগ বেশি হয়। অবশ্য মানবিক পুঁজির এ সরলীকৃত ব্যাখ্যা সম্পর্কে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। শুধু পয়সা খরচ করলেই বিদ্যা অর্জন সম্ভব হয় না, এর জন্য প্রয়োজন সহজাত যোগ্যতা ও পরিশ্রম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী প্রদানের পদ্ধতিতে সহজাত যোগ্যতার বাছাই সম্ভব হয়। কাজেই অনেক অর্থনীতিবিদ্ বিদ্যাকে বিনিয়োগ হিসাবে গণ্য না করে যোগ্যতার বাছাই (screening) এবং যোগ্যতার সংকেত প্রক্রিয়া (signalling device) হিসাবে গণ্য করে থাকে। তবে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রকৃত মুনাফা যাই হোক না কেন, এধরনের শিক্ষার চাহিদা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। 

প্রাচীন ও মধ্যযুগে শিক্ষা আর অর্থের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। তাই শিক্ষার সাথে অর্থনৈতিক অসাম্যের কোন প্রত্যক্ষ সহগমন ছিল না। যখন বিদ্যা ও অর্থের সম্পর্ক ছিল দুর্বল তখন শিক্ষকদের নিষ্কর্মা মনে করা হত। এক সময়ে তাই শিক্ষকদের ঠাট্টা করে বলা হত: “Those who can, do. Those who cannot teach. Those who cannot teach, teach the teachers” (যারা পারে, করে। যারা পারে না, তারা শেখায়। যারা শেখাতে পারে না, তারা শিক্ষকদের শেখায়।) আজকের বিশ্বে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। যারা উৎপাদনে নৈপুণ্য প্রয়োগ করছে তাদের চেয়ে বেশি বেতন না দিলে উপযুক্ত শিক্ষকই পাওয়া যাবে না। আজকের উপযুক্ত শিক্ষকদের সমস্যা তাই আয়ের নয়, তাদের সমস্যা হল আয়করের। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আয়ের দিক থেকে প্রতিভাবান শিক্ষকরা চলচ্চিত্রের তারকা বা ফুটবল খেলোয়াড়দের খুব বেশি পেছনে নেই। এঁদের অনেকেই আবার শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে শুধু নিজেরাই বড়লোক হচ্ছেন না, তাঁদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আয়ও বাড়িয়ে দিচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লর্ড কেইনস ও এম, আই, টি’র স্যামুয়েলসনের নাম স্মরণ করা যেতে পারে। এঁরা শুধু পণ্ডিতই নন, এঁরা প্রচুর অর্থ কামাই করেছেন। 

ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতারা কল্পনা করেছিলেন যে, শিক্ষার প্রসারের সাথে সাথে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে “নতুন মানুষের” আবির্ভাব ঘটবে এবং রাষ্ট্রের সহায়তায় দরিদ্ররা শিক্ষা লাভ করলে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমে যাবে। এ দুটো কল্পনার একটিও বাস্তবায়িত হয়নি। শিক্ষা মানুষের খাসলত মোটেও পরিবর্তন করতে পারেনি। “নতুন মানুষের” স্বপ্ন তাই আজও স্বপ্নই রয়ে গেছে। উপরন্তু সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতে রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী বিশেষ শ্রেণীর উদ্ভবের ফলে অর্থনৈতিক অসাম্যও তিরোহিত হয়নি। জর্জ অরওয়েলের ভাষায় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় “All animals are equal but some animals are more equal than others.” (সকল জন্তুই হল সমান, তবে কোন কোন জন্তু অন্যদের তুলনায় অধিকতর সমান।) পক্ষান্তরে সমাজতন্ত্রের দ্রবীভবনের সাথে সাথে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শিক্ষাভিত্তিক অর্থনৈতিক অসাম্য বেড়ে চলছে। 

একজন অর্থনীতিবিদ্ আজকের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে “বাজিমাৎ সমাজ” (winner—take-all-society) হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।১২ বাজিতে যেমন বিজেতা সম্পূৰ্ণ বাজিকৃত অর্থ পেয়ে যান তেমনি আজকে যাঁরা প্রতিভাবান তাঁরাই সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছেন। অথচ যাঁরা প্রতিভাবান নন, তাঁরা কিছুই পান না। আশির দশকের প্রথম দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০০টি বড় কোম্পানীর প্রধান নির্বাহীরা গড়ে শ্রমিকদের চেয়ে ৩৫ গুণ বেশি বেতন পেতেন। আশির দশকের শেষ দিকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা সাধারণ শ্রমিকদের গড় বেতনের ১৫৭ গুণ বেশি পারিশ্রমিক পাচ্ছেন। ১৯৮৪ হতে ১৯৯২ সময়কালে ফ্রান্স, ইটালি ও যুক্তরাজ্যে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের বেতন তিন গুণ বেড়েছে; জার্মানিতে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। [১৩] 

অধ্যাপক রবার্ট বি রিখ (Robert B. Reich) শিক্ষার প্রসারের সাথে সাথে আশির দশকে শিল্পোন্নত দেশসমূহে যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দেখা দিয়েছে তার বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছেন।” তাঁর হিসাব অনুসারে যে সব শ্রমিক মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেছে তাদের প্রকৃত আয় ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৭ সময় কালে ১২ শতাংশ কমেছে। যারা মাধ্যমিক শিক্ষার সুযোগ পায়নি তাদের আয় ১৮ শতাংশ কমেছে। অথচ যারা কলেজে শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে তাদের আয় সামান্য বেড়েছে। ১৯৮০ সালে একজন স্নাতকের আয় যারা কলেজে পড়ার সুযোগ পায়নি তাদের তুলনায় ৮০ শতাংশ বেশি ছিল। ১৯৯০ সালে এ প্রভেদ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও এ ধরনের প্রবণতা দেখা গেছে। শিল্পোন্নত দেশসমূহের মধ্যে একমাত্র জাপানে এ বৈষম্য এত প্রকট নয়। 

ব্যক্তির জীবনে অসাম্যের যে প্রক্রিয়া ক্রিয়াশীল, তা বিভিন্ন দেশের মধ্যেও বৈষম্য বাড়িয়ে তুলছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজকের বিশ্বায়িত অর্থব্যবস্থায় পুঁজিবাদী সমাজ থেকে জ্ঞানভিত্তিক সমাজে উত্তরণ ঘটছে। ইতিহাসের এক পর্যায়ে প্রাকৃতিক সম্পদ ছিল রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সম্পদ। কারিগরী পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক সম্পদের গুরুত্ব কমে গেছে। ১৯৭৫ হতে ১৯৯৫ সালের মধ্যে প্রাকৃতিক সম্পদের দাম প্রায় ৬০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। কিছুদিন আগেও পুঁজির অভাব ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। বিশ্বায়িত অর্থনীতিতে পুঁজি আজ অত্যন্ত সচল। লাভজনক প্রকল্পের জন্য পুঁজি আজকে বড় সমস্যা নয়। আজকের সবচেয়ে বড় সম্পদ হল জনশক্তির শিক্ষাগত যোগ্যতা। বিশ্ব ব্যাংকের একটি সমীক্ষা হতে দেখা যায় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনশক্তির নৈপুণ্যে ও জ্ঞানে বিনিয়োগ মোট সম্পদের ৬০ শতাংশ, মাত্র ৪০ শতাংশ সম্পদ হল প্রাকৃতিক সম্পদ। জাপানে মানব সম্পদে বিনিয়োগ মোট সম্পদের ৮০ শতাংশ। অস্ট্রেলিয়া ও ক্যানাডা – যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য রয়েছে— সেখানে অবশ্য এখন মানব সম্পদে বিনিয়োগ মোট সম্পদের মাত্র ২০ শতাংশ।[১৫] 

জ্ঞানভিত্তিক সমাজের (knowledge society) উদ্ভব উন্নয়নশীল দেশসমূহের জন্য একদিকে খুশির খবর অন্যদিকে তা অত্যন্ত বিপজ্জনক। খুশির খবর এ জন্য যে বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশে প্রাকৃতিক সম্পদ ও ভৌত পুঁজির অপ্রতুলতা রয়েছে। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় প্রাকৃতিক সম্পদ ও ভৌত পুঁজি ছিল সীমিত কিন্তু জ্ঞানভিত্তিক সমাজে জ্ঞানের অসীম ব্যবহার সম্ভব। টমাস জেফারসন যথার্থই বলেছেন[১৬[: 

He who receives an idea from me receives instruction himself without lessening mine, as he who lights his taper at mine, receives light without darkening me. 

(কেউ যদি আমার কাছ থেকে নতুন ধারণা পায় সে আমাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে নিজে শিক্ষা লাভ করে, যেমনি কেউ যদি তার মোমবাতি আমারটিতে জ্বালায় তবে সে আমাকে আঁধারে নিমজ্জিত না করে নিজে আলো লাভ করে।) 

দ্বিতীয়ত, পুঁজি বা প্রাকৃতিক সম্পদের মত জ্ঞান কুক্ষিগত করে রাখা সম্ভব নয়। নতুন ধারণা অনেক সহজে অনুকরণ করা সম্ভব। কাজেই উন্নয়নের সম্ভাবনা উজ্জ্বলতর হয়েছে। তবে এ সম্ভাবনা নিজে নিজে বাস্তবায়িত হবে না। তার জন্য প্রয়োজন হবে পরিকল্পিত ভিত্তিতে মানব সম্পদের উন্নয়ন। 

অবশ্য সাফল্যের সম্ভাবনা যেমন বেড়েছে তেমনি বিপদের আশঙ্কাও বেড়েছে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজে উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশের ব্যবধান স্থিতিশীল থাকবে না। বৈপ্লবিক কারিগরী পরিবর্তনের ফলে যে সব দেশ নতুন জ্ঞান অর্জন করতে পারবে না তারা উন্নত দেশসমূহের তুলনায় ক্রমেই পিছিয়ে পড়বে। দুটি কারণে উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশসমূহের মধ্যে ব্যবধান বাড়তেই থাকবে। প্রথমত, জ্ঞানভিত্তিক বিশ্বায়িত অর্থনীতিতে অদক্ষ শ্রমিকের মজুরি কমবে। উন্নয়নশীল দেশসমূহ যদি দ্রুত অদক্ষ জনশক্তিকে দক্ষ শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অসাম্য জনশক্তিতে রূপান্তর না করতে পারে তবে উন্নত দেশসমূহের তুলনায় উন্নয়নশীল বিশ্বে মজুরি কমতে থাকবে। দ্বিতীয়ত, কাঁচামালের মূল্য কমে যাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশসমূহের রপ্তানির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হল কাঁচামাল। তাই তাদের আয় কমে যাবে। উন্নয়নশীল দেশসমূহের আজ তাই হয় এগিয়ে যেতে হবে অথবা পিছিয়ে পড়তে হবে। কিন্তু যেখানে অবস্থান করছে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই। আজকের উন্নয়নশীল দেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল উন্নত দেশের সাথে জ্ঞানের ফারাক (knowledge gap) হ্রাস করা। 

জ্ঞানভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশসমূহকে তিন ধরনের জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে ঔপনিবেশিক শোষণের ফলে উন্নয়নশীল দেশসমূহে বদ্ধ ধারণা জন্মেছে যে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হল হার-জিতের খেলা (zero sum game), এ খেলাতে শিল্পোন্নত দেশসমূহ জিতছে আর উন্নয়নশীল দেশসমূহ হারছে। তাই উন্নয়নশীল দেশসমূহ আত্মরক্ষার জন্য সংরক্ষণবাদী অন্তর্মুখী রুদ্ধদ্বার অর্থনীতি গড়ে তুলেছিল। জ্ঞানভিত্তিক বিশ্বায়িত অর্থ ব্যবস্থায় রুদ্ধদ্বার অর্থনীতি বাইরের দুনিয়ার জ্ঞান ও প্রযুক্তির আলোকে অনুন্নয়নের কৃষ্ণ গহ্বর উদ্ভাসিত করার সুযোগ দিচ্ছে না। কাজেই বিশ্বায়িত অর্থ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করতে হলে বহির্মুখী ও উন্মুক্ত অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এ কাজ খুব সোজা নয়। শুধু অর্থের বরাদ্দ বাড়িয়ে শিক্ষার উন্নয়ন সম্ভব নয়। অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষা খাতে ব্যয় এবং মানব সম্পদের দ্রুত উন্নয়নের জন্য অনুকূল ও উদ্দীপক অর্থনৈতিক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। তৃতীয়ত, যারা যোগ্যতর তাদের জন্য উচ্চতর আয় নিশ্চিত করতে হবে। যারা ভাল তাদের পুরস্কৃত করতে হবে এবং যারা খারাপ তাদের শাস্তি দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে নিউইয়র্ক শহরের একজন বিখ্যাত গণিত শিক্ষকের উপদেশ উন্নয়নশীল দেশসমূহের মনে রাখতে হবে। নিউইয়র্ক শহরের একজন গণিত শিক্ষক ছিলেন যাঁর ছাত্ররা সব সময়েই পরীক্ষাতে খুব ভাল করত। অথচ একই স্কুলে একজন কনিষ্ঠ শিক্ষকের ছাত্ররা তাঁর আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও খুব খারাপ করছিল। কনিষ্ঠ শিক্ষক বিখ্যাত শিক্ষকের কাছে জানতে চাইলেন, তাঁর ছাত্ররা এত ভাল কিভাবে করে। বিখ্যাত শিক্ষক জবাব দিলেন, “আমি সব সময়েই ছাত্রদের পিঠ চাপড়াই।” কনিষ্ঠ শিক্ষক আবার জিজ্ঞেস করলেন, “পিঠ চাপড়ালেই কি ছাত্ররা ভাল করবে?” বিখ্যাত শিক্ষক জবাব দিলেন, “পিঠ চাপড়ানোর কায়দা জানা চাই। যারা ক্লাসে ভাল করে অঙ্ক করবে তাদের আস্তে আস্তে পিঠ চাপড়াবে, আর যারা খারাপ করে তাদের জোরে জোরে পিঠ চাপড়াবে।” উন্নয়নশীল দেশসমূহকেও ভাল আর খারাপের মধ্যে তফাৎ করতে হবে। এ ধরনের নীতি অনুসরণ করলে উৎপাদনশীলতা বাড়বে। এতে ভাল ও খারাপ –সকল ধরনের নাগরিকরাই উপকৃত হবে। কিন্তু সাথে সাথে ভাল ও খারাপের মধ্যে অর্থনৈতিক অসাম্যও বেড়ে যাবে। যে অর্থব্যবস্থায় বিদ্যা বিপণনযোগ্য পণ্য সেখানে শিক্ষার মাধ্যমে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না। 

.

তথ্যসূত্র 

১. Bloom, Allan, The Closing of the American Mind (New York: Simon and Schuster, 1987), p. 122 

২. Durant, Will, The Life of Greece (New York: Simon and Schuster, 1966), p. 363 

৩. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৫ 

8. Durant, Will, Our Oriental Heritage (New York: Simon and Schuster, 1966), pp. 31-32 

৫. Doniger, Wendy and Smith, Brian K., tr., The Laws of Manu (New Delhi: Penguin Books India, 1991), pp. 31-32 

৬. S, Laurence J. Peter, Peter’s Quotations (New York: Quill, 1977), p. 172 

৭. Marx, Karl and Engels, Frederich, Selected Works, vol. I (Moscow: Foreign Languages Publishing House, 1962), p. 97 

৮. World Bank, World Development Report, 1998/99 (New York: Oxford University Press, 1999), p. 23 

৯. প্রাগুক্ত 

১০. Clotfelter, Charles T., “The Familiar but Curious Economics of Higher Education: Introduction to a Symposium”, The Journal of Economic Perspectives, Winter, 1999, p. 1. 

১১. Drucker, Peter F., Post-capitalist Society (New York: Harper Business, 1994), pp. 57-58 

১২. Thurow, Lester, The Future of Capitalism (London : Nicholas Brealey Publishing, 1996), p. 21. 

১৩. Thurow, Lester, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২১ 

১৪. Reich, Robert. B, The Work of Nations (New York: Vintage Books, 1992). pp. 208-224 

১৫. Thurow, Lester, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৮৮-২৮৯ 

১৬. World Bank, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৬ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *