শিক্ষার হের-ফের
লেখাপড়া করলেই বা জানলেই লোক শিক্ষিত হয় না। কাজেই লেখাপড়া জানা আর শিক্ষিত হওয়া এক কথা নয়। অর্জিত বিদ্যার ও জ্ঞানের প্রয়োজনীয় অংশ বোধ-বুদ্ধির আয়ত্তে এনে জীবনচর্চার অন্তর্গত করে নিতে না জানলে বা না নিলে মানুষ শিক্ষিত হয় না। এজন্যে আগ্রহ ও আকাঙ্ক্ষা থাকা আবশ্যক।
শিক্ষা মানুষের রুচি করে পরিশ্রুত, বুদ্ধি করে তীক্ষ্ণ, মন করে পরিচ্ছন্ন, মনন করে মার্জিত ও বিন্যস্ত। অতএব শিক্ষা পরিশীলন ও পরিশ্রুতির মাধ্যম ও বাহন। লেখাপড়াই তাই মন-বুদ্ধি আত্মার পরিমার্জনা ও বিকাশের উৎকৃষ্ট পন্থা বলে বিবেচিত। কিন্তু তা কোনো দেশেই বিশেষ করে আমাদের বেলায় আশানুরূপ ফলপ্রসূ হয়নি।
তার কারণ যে-বিদ্যা অর্জনের জন্যে আমাদের মানসিক ও পরিবেশিক প্রস্তুতি নেই, সে বিদ্যা আকস্মিকভাবে আমাদের ঘাড়ে এসে চেপে বসেছে। ফলে আমাদের অর্জিত বিদ্যা, লব্ধ জ্ঞান আর লালিত বিশ্বাস নীলনদের প্রবাহের মতো তিনটে পৃথক ধারায় আমাদের মন ও মননের ক্ষেত্রে জীবনরস সিঞ্চিত করে।
সন্তানদের লোকে স্থূল-কলেজে পাঠায় বিদ্যার্জনের জন্যে, জ্ঞান বা শিক্ষা লাভের জন্যে নয়। এ-বিদ্যা যে বিদেশী-বিজাতি-বিধর্মীর সরকারি বিদ্যা এবং তা যে কেবল অর্থোপার্জনের জন্যে প্রয়োজন, জীবনের আর কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োগের জন্যে নয়–এ চেতনাও জিইয়ে রাখার চেষ্টা থাকে অভিভাবকদের এবং সতর্কতা থাকে বিদ্যার্থীর।
ফাঁক-ফুকুরে যদি জ্ঞানের ছিটেফোঁটা চিত্তলোকে প্রতিষ্ঠা পায়, তা হলেও তা জীবনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে মনে হয় না, কেবল কেতাব লেখার আর কথা বলার ক্ষেত্রেই সীমিত থাকে তার উপযোগ।
লালিত বিশ্বাস-সংস্কারই আমাদের জীবনযাত্রার ভিত্তি জীবন যাপনের দিশারী। বিশ্বাস সংস্কারের নিয়ন্ত্রণেই আমাদের জীবন চালিত। কেননা এগুলোই আমাদের আচরণীয় ধর্মবিধির উৎস। অতএব বিদ্যা ও জ্ঞান আমাদের বহিরঙ্গের আভরণ ও আবরণ আর বিশ্বাস-সংস্কার আমাদের অন্তরঙ্গ সম্পদ। ফলে আমরা স্থূল-কলেজে যা পড়ি তা দুর্লভ সম্পদরূপে মন-বুদ্ধির স্পর্শ বাঁচিয়ে রক্ষা করি, অথবা বিস্মৃত হয়ে দায়মুক্ত হই। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের চিন্তায়, কর্মে কিংবা অনুভবের পরিসরে তা ছায়াও ফেলতে পারে না। যেমন স্বধর্মের কথা ছাড়া অন্য ধর্মের কথা যতই ভালো হোক, তা যে আমার জন্যে নয়–এ সচেতনতা আমাকে গোড়াতেই বিরূপ করে রাখে। তাই তেমন কথা শ্রুতিমধুর ও যুক্তিগ্রাহ্য হলেও হৃদয়ভেদ্য হয় না।
এজন্যেই রসায়নশাস্ত্রের অধ্যাপকও পড়া-পানিতে খুঁজে পান রোগের ও দুর্ভাগ্যের নিদান, পদার্থবিজ্ঞানী ঝাড়ফুকে লাভ করেন বৈদ্যুতিক সেকের ফল। উদ্ভিদবিজ্ঞানীর কাছেও বেলপাতার মর্যাদা আলাদা। জীববিজ্ঞানীও হুতোম, পেঁচা কিংবা টিকটিকির দৈব-প্রতীকতায় আস্থা রাখেন। এমনি করে নৃতত্ত্ববিদ কিংবা সমাজবিজ্ঞানী, ভূতাত্ত্বিক কিংবা জ্যোতির্বিদ কেউই অধীত বিদ্যাকে জীবনে অধিগত বোধে পরিণত করেন না। জর্ডন-জমজম কিংবা গঙ্গার পানি, বার-তিথি-নক্ষত্র, হাঁচিকাশি-হোঁচট, জীন-পরী-অপ্সরা, ভূত-প্রেত-দৈত্য অথবা পৌরাণিক সৃষ্টিতত্ত্ব ও দৈব-কাহিনী তাঁদের কাছে তাঁদের অধীত বিদ্যা ও পরীক্ষালব্ধ জ্ঞানের চেয়ে বেশি সত্য ও বাস্তব।
তাই নিজের সন্তানই যখন পিছু ডাক দেয়, তখন সে আর আত্মজ থাকে না, মুহূর্তের জন্যে হয়ে উঠে দৈব-প্রতীক, তেমনি হাঁচি কিংবা কাশিও থাকে না নিছক দৈহিক প্রক্রিয়া বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে হয়ে ওঠে দৈব-ইশারা। সেরূপ কাক, হুতোম পেচক কিংবা টিকটিকির ডাক হয়ে যায় দৈববাণী।
এ কারণে অধীত বিদ্যা, লব্ধ জ্ঞান, আর লালিত বিশ্বাসের টানাপড়েনে স্থিতধী বুদ্ধিমান মানুষের জীবনেও ঘোচে না কর্মে ও চিন্তায় অসঙ্গতি, ভাব ও অনুভবের জটিলতা।
এই অসমন্বিত বিদ্যা ও বিশ্বাস লেখাপড়া-জানা মানুষকে সুস্থ হতে দেয় না। মানুষ হয় বিশ্বাসের দ্বারা চালিত হোক, অথবা জ্ঞানকেই পাথেয় করুক–এই দুটোর অসমন্বিত মিশ্রণে মানুষ তার চরিত্রের ও চিন্তার স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলে।
এর জন্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গলদও অনেকখানি দায়ী। আমরা বিজ্ঞানের বই ও দীনিয়াত একই ছাত্রের জন্যে একই সঙ্গে পাঠ্য করি। ফলে সে বিজ্ঞানের বইতে সৃষ্টিতত্ত্ব কিংবা প্রাণিতত্ত্ব পায় এক রকম, দীনিয়াতে পড়ে অন্য রকম। বদ্ধমনের ছাত্র দীনিয়াতকেই জানে জীবনের সত্য বলে, আর বিজ্ঞানকে গ্রহণ করে পরীক্ষা পাসের বিদ্যারূপে। এ অসঙ্গতি তার জীবনে কখনো ঘোচে না। যে-ছেলে সমাজবিজ্ঞানে মানুষ, ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের উদ্ভবতত্ত্ব পড়ে ও মুখস্থ করে এবং প্রশ্নহীনচিত্তে যান্ত্রিক-নৈপুণ্যে পরীক্ষার খাতায় পুনরাবৃত্তি করে পরীক্ষককে চমকে দিয়ে আশি-নব্বই নম্বর পায়, সে হয়তো ব্যক্তিগত জীবনে দেও-দানু-ভূত-প্রেত প্রভৃতির ভয়ে অস্থির কিংবা তাবিজ কবচ মাধ্যমে দৈবানুগ্রহ লাভে তৎপর।
আবার যে-ছাত্র মুক্তমনের কিন্তু দুর্বলচিত্ত তারও জ্ঞানে-বিশ্বাসে দ্বন্দ্ব কখনো ঘোচে না। তার অবস্থা আরো শোচনীয়। কেননা, তার জীবনে অসঙ্গতি আরো প্রবল ও প্রকট। সে কখনো সন্দেহ তাড়িত, কখনো বা বিশ্বাস-চালিত। সে ঘরেও সুস্থ থাকে না, ঘাটেও পায় না স্বস্তি। এমনি লোকের যৌবন ও বার্ধক্য দ্বৈতসত্তায় হয় বিকৃত, প্রৌঢ়ত্ব থাকে পীড়িত।
যারা ধর্ম ও বিজ্ঞানের যুক্তি ও বিশ্বাসের সমন্বয় চান, তাঁরা চাঁদ-সূর্যের অদ্বয়রূপে উপস্থিতিই কামনা করেন। পরস্পর বিপরীত সত্যে আস্থা স্থাপন, কেবল যে চরিত্রহীনতার পরিচায়ক তা নয়, কোনো সত্যকেই গ্রহণ না-করার নামান্তর মাত্র। সামাজিক মানুষের জীবনে মূল্যবোধ জাগে যুক্তি অথবা বিশ্বাস থেকে। মূলত উপযোগ-চেতনাই মূল্যবোধের উৎস হলেও যুক্তি ও বিশ্বাসই তার বাহ্য অবলম্বন।
কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে অন্ধ। বলতে গেলে যুক্তির অনুপস্থিতিই বিশ্বাসের জন্মদাতা। যুক্তি দিয়ে তাই বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করা চলে না। বিশ্বাসের ভিত্তিতে যুক্তির অবতারণাও তেমনি বিড়ম্বনাকে বরণ করা ছাড়া কিছুই নয়।
আজকাল একশ্রেণীর জননেতা, শিক্ষাবিদ ও সমাজকল্যাণকামী মনীষী শিক্ষার ক্ষেত্রে ধর্ম ও বিজ্ঞানের যুক্তি ও নীতিবোধের সমন্বয় ও সহ-অবস্থান কামনা করছেন। নতুন ও পুরোনোর, কল্পনার ও বাস্তবের, যুক্তির ও বিশ্বাসের অথবা দুই বিপরীত কোটির সত্যের সমন্বয় সাধন করে নতুনে ও পুরাতনে, সত্যে ও স্বপ্নে সঙ্গতি স্থাপনে তারা আগ্রহী। তাই পুরোনো ধর্ম ও পুরোনো নীতিবোধের সঙ্গে আধুনিক জীবন-চেতনার মেলবন্ধনের উপায় হিসেবে তারা বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মশিক্ষা দানেও উদ্যোগী। কিন্তু এর পরিণাম যে শুভ হবে না–অন্তত যে হয়নি তার প্রমাণ পাদ্রি স্থূল ও নিউস্কিম মাদ্রাসা।
অবশ্য উক্ত শ্রেণীর চিন্তাবিদদের সদিচ্ছা প্রশ্নাতীত। তবে তাঁরা বিভ্রান্ত এ-ই যা। য়ুরোপে যারা বৈজ্ঞানিক সত্যর আবিষ্কারক ও দার্শনিক সত্যের প্রবর্তক তাঁরা হয় নাস্তিক নয়তো সংশয়বাদী। আমরা গ্রন্থের মাধ্যমে তাঁদের বাণীই শুনি এবং চোখ মেলে দেখি তাঁদেরই কৃতি। অথচ সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকাই যুবরাপীয় সাধারণ মানুষের দিকে–যেন এরাই এ কৃতিত্বের দাবীদার। এবং দেখি যে, এরা জীবনে পুরোনো বিশ্বাস-সংস্কার ও ধর্ম ছাড়েনি। কাজেই আমরাই বা ছাড়ি কেন? মনে ভাবি, বিজ্ঞানে-বিশ্বাসে বুঝি বিরোধ নেই। দুটোর সমন্বয়েই যেন সম্ভব হয়েছে য়ুরোপের প্রগতি ও ঐশ্বর্য, প্রাপ্তি ও প্রতিষ্ঠা। এমনি একটা ভুল অথচ দৃঢ়মূল ধারণার বশেই আমাদের শিক্ষাবিদদের এই সৎ-প্রয়াস। বহতা নদীর দুইকূল রক্ষা করা যায় না এবং দুই নৌকায় পা রাখাও বিপদসঙ্কুল–এই আপ্ত বাক্যদ্বয়ে আজো আস্থা রাখা নিরাপদ। তাই বিশ্বাস অথবা বিজ্ঞান–দুটোর একটা ছাড়তেই হবে। নইলে মানুষের চারিত্রিক বিকৃতি বাড়বে বই কমবে না।
অবশ্য এককালে বিশ্বাসই মানুষের চিন্তা ও কর্ম নিয়ন্ত্রণ করেছে। মানুষ দুঃখে-বিপদে প্রবোধ ও শক্তি পেয়েছে সে-পথেই। তখন কিন্তু জ্ঞানের প্রসার হয়নি, তখন বিজ্ঞানও হয়নি জীবন-যাত্রার অবলম্বন। বিশ্বাসই ছিল মানুষের অভয় শরণ। আজ যুক্তি ও বিজ্ঞানের মোকাবিলায় বিশ্বাস দেউলে। বিশ্বাসের মহিমা কীর্তনে আজ আর কী ফল! চালু ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে দিয়ে নিজেকে প্রতারিত করা অসুস্থ মনেরই পরিচায়ক মাত্র।
যারা মানুষের নৈতিক জীবনের মানোন্নয়ন-বাঞ্ছয় ধর্মশিক্ষা কামনা করেন, তাঁদেরকে এ আশ্বাসটুকু হয়তো সঙ্গত কারণেই দেয়া যায় যে, যুক্তিবোধ ও বিজ্ঞান-চেতনার মাধ্যমেও জীবন ও সমাজ সম্বন্ধে নতুন নীতিবোধ জাগানো সম্ভব এবং নৈতিক জীবনও উন্নততর করা দুঃসাধ্য হবে না। কেননা মানুষের মানবিক গুণের বিকাশ ত্বরান্বিত হয় সাহিত্য-দর্শন-ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান পাঠে। যুক্তিপ্রবণতার উদ্ভব ও বৃদ্ধি এতেই হয়। আর বিজ্ঞান করে যুক্তিনিষ্ঠ ও সত্যসন্ধ।
কিন্তু এতেও মাকড়সার জালের মতো এক সূক্ষ্ম বাধা মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে। আজকাল সরকার, শিক্ষক ও অভিভাবক সবাই বৃত্তিমূলক বিদ্যার অনুরাগী ও পক্ষপাতী। তারা জনগণকে ও ছাত্রকে বৃত্তিমূলক বিদ্যার উপযোগ সম্বন্ধে সচেতন করিয়ে দেয়ার প্রয়াসী। পেশাগত লক্ষ্য স্থির করেই পড়–এ-ই হচ্ছে তাদের স্লোগান। শুনে শুনে ছাত্রছাত্রীরাও লেখাপড়াকে পেশা শিক্ষা বলেই মনে করে। বিদ্যার্জন যেন ভাবী পেশারই Training। ফলে লেখাপড়া করে বিদ্যার্জন করে শিক্ষিত হও, মানুষ হও এমন কথা আজকালকার ছেলেমেয়রা শুনতেই পায় না। মানবিক বৃত্তির পরিশীলন, পরিশ্রুতি ও বিকাশের জন্যেই বিদ্যার্জন এবং বিদ্যার্জনেই যে বিদ্যাচর্চার শেষ –এর বৈষয়িক গুরুত্ব থাকলেও তা যে ছাত্রছাত্রীদের অমন করে জানিয়ে দিতে নেই, এ যুগে সে কথা কেউ স্বীকারই করেন না। ফলে লেখাপড়া শিখে লোক যন্ত্রীই হচ্ছে, মানুষ হয়ে ওঠার প্রেরণা পাচ্ছে না। তাই সমাজে এখন লেখাপড়া-জানা যুবকেরা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, উকিল-অধ্যাপক বা সরকারি-সওদাগরী কর্মচারী হয়। সততায়, প্রতিবানতায়, পরার্থপরতায়, উদারতায়, মানবিকতায় ও বিচারশীলতায় মানুষ হয় কৃচিৎ। এর পরিণাম যে সমাজের পক্ষে শুভ হচ্ছে না, তা বোধ হয় বলার অপেক্ষা রাখে না। বিদ্যাকে এভাবে বিষয়বৃত্তির অনুগত করে সীমিত লক্ষ্যে নিবদ্ধ রাখা আর মানবমনীষা ও মানবিক বৃত্তিতে জৈবিকতার সংকীর্ণ সীমায় নিয়ন্ত্রিত করা একই কথা। এতে প্রাণ বাঁচে কিন্তু মন নিশ্চিতই মরে এবং প্রাণ থাকলে প্রাণী হয়, কিন্তু মন না থাকলে মানুষ হয় না।