শিক্ষাবিস্তার ও ধর্মপ্রচার
জনশিক্ষা প্রসারে ওমর বিশেষ জোর দেন; এ বিষয়ে উদ্যম ছিল অপরিসীম। সারা আরবে ও বিজিত দেশসমূহে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা হয়। ছাত্রদিগকে লিখন-পঠন, প্রাথমিক গণিত, কোরআন পাঠ, নীতি শিক্ষামূলক কবিতা ও আরবী সুবচন শিক্ষা দেওয়া হতো। যে-সব সাহাবা হাদীসে ও কোরআন পাঠে দক্ষ, তাঁরাই জনশিক্ষা নিয়োজিত হতেন। শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন দেওয়া হতো। ওমরের এ বিষয়ে একটি সুন্দর ব্যবস্থা এই যে, তিনি শিক্ষকদের জন্যে একটি পৃথক বৃত্তি-তালিকা প্রস্তুত করান ও নিয়মিত বৃত্তিদানের নির্দেশ দেন। মদীনায় শিক্ষকরা মাস প্রতি পনের দিরহাম বেতন লাভ করতেন। সমকালীন অর্থনৈতিক অবস্থানুসারে এ হার স্বল্প ছিল না।
ইসলামে শিক্ষা ও ধর্ম অভিন্ন। শিক্ষা প্রসারের সঙ্গে ধর্মশিক্ষাদান ও ধর্মপ্রচার সমানভাবে চলতো। খলিফা হিসেবে ওমরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি হচ্ছে, ইসলামের প্রসার ও জনগণকে ধর্মীয় শিক্ষাদান। ইসলামের বিস্তৃতি, কোরআন-হাদীস শিক্ষার ব্যবস্থা এবং শরিয়ত শিক্ষা বাধ্যকরণের উদ্দেশ্যে ওমর একটি পৃথক বিভাগ খোলেন। এ কথা এখানে অবশ্যই বিশদ হওয়া দরকার যে, ইসলাম প্রচার অর্থে মুসলিমেতর লেখকদের প্রচারিত তথাকথিত এক হাতে কোরআন ও আর এক হাতে তরবারি নিয়ে নয়। এরূপ বিকৃত পন্থা অবলম্বন খলিফাদের স্বপ্নেরও অগোচর ছিল, কারণ কোরআনের এই মহাশিক্ষা কোন প্রকৃত মুসলিমই বিস্মৃত হতে পারেন না: লা ইব্রাহা ফিদ্দীন-ধর্মে বলপ্রয়োগ নেই (২ : ২৫৬)। পূর্বেই উক্ত হয়েছে যে, খলিফা ওমর আপন ব্যক্তিগত খাদিম খ্রিস্টান আতিককে বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও ইসলাম গ্রহণে রাযী করতে অক্ষম হয়ে কোরআনের এই বাণীর মধ্যেই শান্তি খুঁজেছেন, কিন্তু বলপ্রয়োগ করেন নি। তাঁর প্রধান কার্যকরী অস্ত্র ছিল, কাজে ও কর্মে ইসলাম আদর্শিক জীবন অনুশীলন করে মানুষকে ইসলামের শিক্ষা ও সৌন্দর্যে আকৃষ্ট করা। ওমরের খেলাফতকালে দেশে দেশে ইসলামের বিকিরণ হয়েছিল আলোকধারার মতো কিন্তু তা সম্ভব হয়েছিল খলিফার শিক্ষায় ও নিয়মানুবর্তিতায়। মুসলিমদের জীবন আপন ধর্মের উজ্জ্বল ও বাস্তব আদর্শে রূপায়িত হয়ে উঠেছিল। তা না হলে মরুচর যাযাবর ক্ষুদ্র জাতি পৃথিবী-জয়ে সাহসী হতো না। যখনই বিদেশীরা মুসলিমদের সংস্পর্শে এসেছে, তখনই তারা মুসলিমদের দেখেছে, সত্য ন্যায়, অকপটতা, সাধুতা ও শুচি-শুভ্র সরল জীবনের মূর্ত প্রতীকরূপে এবং বিস্ময়ে, ভক্তিতে আপ্লুত হয়ে প্রাণের আবেগে ইসলাম গ্রহণ করে জীবন ধন্য মনে করেছে। পাঠকের স্মরণ হতে পারে, সিরিয়া অভিযানকালে রোমক-দূত জর্জ আবু ওবায়দার সেনাবাহিনীর সঙ্গে পরিচিত হয়েই কিভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, নিজের জাতি, সমাজ ও পরিবার স্বেচ্ছায় বিসর্জন করে।
যখনই ওমর কোনও নতুন দেশ অভিযানে সেনাবাহিনী পাঠিয়েছেন, তখনই সিপাহসালারকে নির্দেশ দিয়েছেন, প্রথমে শান্তির পথে ইসলামের মহিমা প্রচার করে ইসলাম গ্রহণে আহ্বান জানাতে। পারস্য বিজয়ী সা’দ-বিন্-ওক্কাসকে ওমর যে পত্র লেখেন তাতে এই কথাগুলি পরিষ্কার ছিল: আমি তোমায় আদেশ দিচ্ছি যখন বিপক্ষদের সাক্ষাৎ পাবে, তখন যুদ্ধের পূর্বে তাদের ইসলামে আহ্বান জানাবে। কাজী আবু ইউসুফ বলেন, যখনই ওমর সেনা সংগ্রহ করতেন, তখনই এমন সালার নিযুক্ত করতেন, যিনি কোরআনে এবং শরিয়তী আইনে পারঙ্গম।
ইসলাম বিস্তৃতির দ্বিতীয় কারণ ছিল, মুসলিম সেনাদের সর্বত্র নিরঙ্কুশ বিজয়লাভ সমকালীন পৃথিবীখ্যাত মহাপ্রতাপশালী সুবিশাল রোমক সাম্রাজ্য ও পারস্য সাম্রাজ্য মাত্র কয়েক হাজার মরুচারী আরবের পদভারে বাদামের খোসার মত গুঁড়িয়ে গেছে। ভোজবাজীর মতো এ অসাধ্য সাধন দেখে বিমুগ্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন স্থানীয় অধিবাসীরা বিস্ময় মেনেছে, আর ভেবেছে, নিশ্চয়ই ঈশ্বর মুসলিমদের সহায়। পারস্যের খসরু যখন চীনা সম্রাটের সাহায্য ভিক্ষা করেন, তখন চীনা সম্রাট মুসলিমদের সম্বন্ধে সম্যক সন্ধান নিয়ে জওয়াব দিয়েছিলেন, এমন মানুষদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা পাগলামি মাত্র। আবু রিজা ফারসীর পিতামহ বলেছিলেন: আমি কাদিসিয়ার যুদ্ধে উপস্থিত ছিলেম এবং তখন অগ্নিপূজকও বিপক্ষে ছিলেন। আরবরা যখন তীর নিক্ষেপ আরম্ভ করে, তখন সেগুলি ছুঁচ ভেবে হেসেছিলাম। কিন্তু সে ছুঁচগুলিই আমাদের সাম্রাজ্য ছিন্নভিন্ন করেছিল। মিসর অভিযানকালে আলেকজান্দ্রিয়ার বিশপ কদের উপদেশ দেন: রোমক সাম্রাজ্য খতম হয়ে গেছে; যাও মুসলিমদের সঙ্গে যোগ দাও।
আরো একটি কারণে ইসলামের বিস্তৃতি সুগম ও ত্বরান্বিত হয়েছিল। সিরিয়া ও ইরাকে বহু আরব গোত্র বসতি স্থাপন করেছিল ও স্থানীয় খ্রিস্টানধর্ম গ্রহণ করেছিল। যখন তাদেরই স্বজাতি একজন আরব নবীরূপে উদিত হলেন, তখন তারা স্বাজাত্যপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েও ইসলাম গ্রহণে আগ্রহী হয়েছিল। আবার অনেক ক্ষেত্রে কোনও প্রভাবশালী ব্যক্তি বা ধর্মনেতা ইসলাম গ্রহণ করলে তার অনুগামীরাও একযোগে মুসলিম হয়ে যেতো। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, দামেশক বিজয়ের পর তত্রস্থ বিশপ আরফুন খালিদের হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তার অনুগামীরাও মুসলিম হয়ে যায়।
এ-সব ব্যবস্থায় ওমরের খেলাফতকালে ইসলাম দ্রুত প্রসার লাভ করে। আফসোস এই যে, ঐতিহাসিকদের দৃষ্টি ত এদিকে ততদূর আকৃষ্ট হয় নি, তার দরুন ওমরের সময়ে নও-মুসলিমদের তায়দাদ্ কোনখানে উঠেছিল, সঠিকভাবে তা নির্ণয় করা কঠিন .কিন্তু নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে যে, ওমরের আমলে উপরে বর্ণিত নও-মুসলিম ব্যতীত আরও বহুস্থানের বাসিন্দা স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছিল। ১৬ই হিজরীতে জালুলা অধিকৃত হলে তথাকার জমিদার ও সামন্তগণ ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তাঁদের অনুগামীরাও তাঁদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে। কাদিসিয়ার যুদ্ধজয়ের পর খসরু পারভেজের দাইলামাইত নামক চার হাজার সুশিক্ষিত দেহরক্ষী ইসলাম গ্রহণ করে। তুস্তারের বাসিন্দারা ইসলাম গ্রহণ করলে সিয়াবজাহ্, জা ও আন্দঘার নামীয় সিন্ধুদেশাগত গোত্রগুলিও ইসলাম গ্রহণ করেছিল। মিসরের বড় বড় শহরের বাসিন্দারা পাইকারী হারে ইসলাম গ্রহণ করে। ফুস্তাতের বিভিন্ন পল্লীতে বানু-নবাহ্, বানু-আরজাক ও রুবিল নামক গ্রীক গোত্রীয়রা এবং অন্য একটি মহল্লায় সমস্ত অগ্নিপূজকরা ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এ-ভাবে বিভিন্ন দেশের নও-মুসলিমদের সংখ্যা কম হিসাবে ধরলেও দশ লক্ষের উর্ধ্বে ছিল।
ইসলামের সীমান্ত বর্ধিত করেই ওমর ক্ষান্ত হন নি। ইসলামের শ্রেষ্ঠ স্তম্ভ দুটি- কোরআন ও হাদীস-ওমরের হাতে সংরক্ষিত হয় এবং এ দুটির শিক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা অনুসৃত হয়। শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ সত্যই বলেছেন: ইসলাম জগতের যে কেউ আজ কোরআন শরীফ পাঠ করে সেই ফারুক-ই আযমের নিকট কৃতজ্ঞতা-পাশে আবদ্ধ হয়।
এ কথায় আজ সন্দেহের অবকাশ নাই যে, ওমরের উদ্যমেই কোরআনের নির্ভুল সংগৃহীত হয় এবং সারা ইসলাম জগতে তার বহুল প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। রসূলুল্লাহর জীবদ্দশায় কোরআন শরীফ সামগ্রিকভাবে লিখিত হয়েছিল বিভিন্ন ও সুরায় প্রত্যেক সূরা গ্রথিত হয়েছিল যথাযথ সন্নিবেশিত আয়াত সমূহে। কিন্তু একখানি গ্রন্থে লিখিত তার রূপ ছিল না। হাড়ে, খেজুর পাতায় ও পাথরের বিভিন্ন অংশে লিখিত হয়ে বিভিন্ন সাহাবার হেফাযতে ছিল। আবার প্রত্যেক সাহাবা কিছু কিছু নির্ভুল মুখস্থ করলেও অনেকের সমগ্র অংশ কণ্ঠস্থ ছিল না। আবুবকরের খেলাফত আমলে জাল পয়গম্বর মুসায়লামার সঙ্গে যুদ্ধে বেশ কিছু সংখ্যক সাহাবা শাহাদত লাভ করেন। অথচ তাঁদের অনেকেরই সমগ্র কোরআন অথবা অংশ বিশেষ নির্ভুল কণ্ঠস্থ ছিল। তার দরুন ওমর কোরআনের নিরাপত্তার জন্যে উদ্বিগ্ন হন। তিনি আবুবকরকে বলেন, যাঁদের বুকে কোরআন হেফাযতে ছিল, তাঁরা যদি এ ভাবে শহীদ হন, তা হলে কোরআন লোপ পাবে; অতএব কোরআন সংগ্রহ ও সংরক্ষণের আশু ব্যবস্থা করা উচিত। আবুবকর প্রথমে অনিচ্ছুক হন, এই সঙ্কোচ করে যে, রসূলুল্লাহ্ যা করেন নি, কিভাবে তাঁর দ্বারা তা সম্ভব। কিন্তু ওমরের বারবার তাগিদে আবুবকর সম্মত হন। কোরআন লেখার প্রধান দায়িত্ব পড়ে যায়েদ-বিন্ সাবিতের উপর। বিভিন্ন স্থানে সাহাবাদের থেকে কোরানের সূরা ও আয়াত সংগ্রহের ভার তাঁর উপর ন্যস্ত হয়। প্রকাশ্যে ঘোষণাও করা হয় যে, যার হেফাযতে বিশ্বনবীর সময় থেকে কোরআনের কিছু অংশ রক্ষিত আছে, তা উপস্থিত করতে। কোন অংশ উপস্থিত করার সময় এটাই প্রমাণ দিতে হতো, অন্তত দুজন সাক্ষীর দ্বারা যে, অংশটি রসূলে করীমের সময় তারা লিখিত প্রত্যক্ষ করেছে। এ-ভাবে সব সূরা সংগৃহীত হলে, একটি কমিটি গঠিত হয়, একখণ্ডে কোরআন নির্ভুলভাবে লিখিত রাখার কাজ তদারক করতে। সা’দ-বিন্-আসের আবৃত্তি অনুযায়ী যায়েদ লিপিবদ্ধ করতেন। কমিটির উপর আরও নির্দেশ ছিল, উচ্চারণ সম্বন্ধে মতদ্বৈত হলে মুদার গোত্রীয়দের উচ্চারণ-বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করা হবে, কারণ, কোরআন তাদের ভাষাতেই নাযেল হয়েছিল। এ-ভাবে অতীব সাবধানতা-সহকারে কোরআন সংগৃহীত হয়ে নির্ভুলভাবে লিখিত হলে ওমর নির্দেশ দেন, নির্ভুল সংস্করণ বহুলভাবে প্রচার ও শত শত লোককে সমগ্র কোরআনে হাফেজ করে তুলতে। যাতে কোরআন পাঠে ভুল না হয়, তার জন্যে নির্দেশ দেন, যে স্বরচিহ্নগুলি (যথা জবর, জের, পেশ ইত্যাদি) এবং শব্দের অবিকৃত গঠন যেন রক্ষা করা হয়। সকল শিক্ষায়তনে কোরআনে শিক্ষা অবশ্য-পাঠ্য বিষয় ধার্য হয়। বেদুঈনদের কোরআন পাঠ শিক্ষা অবশ্য কর্তব্য হিসেবে গণ্য হয় এবং কিছু অংশও কণ্ঠস্থ না করা দণ্ডনীয় হয়। প্রত্যেককেই অন্তত পাঁচটি সূরা-বাকারা, নিসা, মায়দা ও হজ ও নুর অবশ্যই মুখস্থ করতে হতো। আবু সুফিয়ান বেদুঈনদের, আবুদরদা দামেশকে, ইবাদা হিমস্ নগরে এবং মুয়ায প্যালেস্টাইনে ওমর কর্তৃক কোরআন-শিক্ষক নিযুক্ত হন। কোরআনে সঠিক জ্ঞান লাভ ও ধর্ম অনুধাবনের উদ্দেশ্যে আরবী ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষা ও বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। আরও নিয়ম করা হয়েছিল যে, যাঁর শব্দ-বিজ্ঞানে ব্যুৎপত্তি নেই, তাঁর কোরআন শিক্ষা দান করা উচিত নয়।
কোরআনের পরেই আসে হাদীস প্রসঙ্গ। হাদীস প্রচারে ওমর বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করেন এবং সুদক্ষ সাহাবা ব্যতীত অন্যের পক্ষে হাদীস বর্ণনা অনুচিত হিসেবে অভিমত প্রকাশ করেন। শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ বলেন: ফারুক ই-আযম আবদুল্লাহ বিন্- মাসুদকে কুফায়, মকাল-বিন্-ইয়াসার ও অন্য দুজনকে বসরায় এবং ইবাদা ও আবু দরদাকে সিরিয়ায় প্রেরণ করেন এবং আমীর মুআবীয়কে নির্দেশ দেন যে, উপরোক্ত সাহাবাগণ ব্যতীত অন্য কেউ যেন হাদীস বর্ণনা না করে। হাদীস কথনে ওমর এতোখানি সতর্ক ছিলেন যে, তাঁর বরাতী হাদীসের সংখ্যা মাত্র সত্তরটি। এ বিষয়ে শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্র অভিমত উল্লেখযোগ্য: ওমর প্রকাশ্য ভাষণে হাদীস উল্লেখ করতেন বর্ণনাকারীর নাম না নিয়ে, যাতে বর্ণনাটি সন্দেহাতীত হয়। অনেকে মনে করেন, আবুবকর ছয়টি ও ওমর সত্তরটি সুনির্ভর হাদীস বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তাঁরা লক্ষ্য করেন যে, ওমর সমগ্র হাদীসশাস্ত্রকে সুদৃঢ় করেছিলেন।
ওমর সেই শ্রেণীর হাদীসসমূহের প্রসার ও প্রচারণার দিকে বেশি জোর দিয়েছিলেন, যেগুলি নামায, নীতি ও সামাজিক ক্রিয়া-কর্মের বিষয়ীভূত এবং যেগুলির এ-সব বিষয়ের সম্বন্ধে কোন ইঙ্গিত নেই, সেগুলির সম্বন্ধে তিনি ততো মনোযোগী ছিলেন না। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, যে-সব হাদীস আঁ-হযরতের রেসালত সম্পর্কিত ও ইসলাম প্রচারণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেগুলির সঙ্গে তাঁর নিজস্ব মানবীয় জীবন-সম্পর্কিত হাদীসসমূহ যেন মিশ্রিত হয়ে না যায়। শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ বলেন: গভীর পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, ফারুক-ই-আযম তীক্ষ্ণ দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছিলেন মানুষের নৈতিক ক্রমোন্নতি ও শরীয়ত বা আইন সম্পর্কিত হাদীস সমূহ ও অন্যগুলির পার্থক্য নির্ণয় করায়। অতএব যে-সব হাদীস রসূলুল্লাহ্র নিছক ব্যক্তিগত জীবন, পোশাক ও অভ্যাস সম্পর্কিত সেগুলির তিনি খুবই কম উল্লেখ করেছেন। এর কারণ ছিল দুটি-প্রথমত সেগুলির আইন ও বাধ্যতামূলকতার ততো মূল্য নেই। আর দ্বিতীয়ত সেগুলির প্রসার ও প্রচারণার দিকে সমান জোর দিলে সেগুলি ও ধর্মীয় বিধি-বিধান সম্পর্কিত হাদীসসমূহ একাকার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিত। ওমর আরও সালাত সম্পর্কিত হাদীসসমূহ কোনও বাঁধা- ধরা বিধান হিসেবে প্রচারণার ইচ্ছা প্রকাশ করেন নি। তাঁর যুক্তি ছিল ওয়ালীউল্লাহ্ মতে: “ওমর সম্যক জ্ঞাত ছিলেন যে, নামায আদায়কারীর আন্তরিকতা ও নম্রতার উপরেই তাঁর সাধনা-আরাধনা গৃহীত হওয়া না হওয়া নির্ভর করে, শুধু সালাতের কথার উপর নয়।”
ওমরের আর একটি মহৎ কাজ হাদীস মূল্যায়ন-শাস্ত্রের উদ্ভাবন। তিনি জানতেন যে, কোনও যুগেই মানুষ স্বাভাবিক দুর্বলতা পরিহার করতে পারে না এবং তার দরুন ভক্তির আতিশয্যে রসুলুল্লাহ্ নামাঙ্কিত যে কোন হাদীস মানুষ সহজে বিশ্বাস করে নেয়, তার সত্যাসত্যের যাচাই না করে। এজন্যে হাদীসের মূল্যাবধারণে তিনি সর্বদাই ভ্রমে পতিত না হওয়ার দিকে তীক্ষ্ণ লক্ষ্য রাখতেন এবং তার ফলেই পরবর্তীকালে হাদীস যাচাইয়ের নীতিটি এমন একটি সুশৃঙ্খল টেক্টিকে রূপায়িত হয়েছে যা বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারে এক অভিনব সংযোজন। হাদীসের বিশুদ্ধতা রক্ষার্থে ওমরের উৎকণ্ঠা সম্বন্ধে আলোচনাকালে বিখ্যাত জ্ঞানী ও সমালোচক মুহাদ্দিস যাহাবী ‘তাযকিরাতুল হুফ্ফাযে’ লিখেছেন:
পাছে লোকে রসূলুল্লাহ থেকে সরাসরি হাদীস কথনে ভুল করে বসে এবং পাছে হাদীস নিয়ে এমন মত্ত হয়ে পড়ে যাতে কোরআন পাঠে গালতি আসে, এজন্যে ওমর সাহাবাদেরকে নিষেধ করেন রসূলুল্লাহ্ থেকে সরাসরি হাদীস উল্লেখ না করতে। কারযা- বিন্-ক্কাব বলেছেন: আমরা যখন ইরাকে রওয়ানা হই, তখন ওমর আমাদের সঙ্গে কিছু দূর সহগামী হন এবং আমায় জিজ্ঞাসা করেন, কেন আমি আসছি বলতে পার? আমি উত্তর দিলেম, আমাদের সম্মান দেখাতে। ওমর বললেন, তা সত্যি তবে আরও কারণ আছে। তোমরা যেখানে যাচ্ছো সেখানে লোকে মৌমাছির মতো কোরআন পাঠে ভিড় জমিয়েছে। তাদের যেন হাদীসের মায়ায় জড়িও না; হাদীস ও কোরআন একাকার করে ফেলো না এবং তা হলে আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। কারযা ইরাকে হাজির হলে লোকে তাঁকে হাদীস বলতে অনুরোধ করলো। তিনি বললেন, ওমর হাদীস বলতে নিষেধ করেছেন। আবুসালমা বলেন, পরবর্তীকালে আমরা আবু হোরায়রাকে জিজ্ঞাসা করি, এখন যত হাদীস বর্ণনা করেন, ওমরের আমলে কি সেরূপ করতেন? আবু হোরায়রা উত্তর দেন, তা হলে তো ওমর বেত্রাঘাত করতেন। আবদুল্লাহ্-বিন্-মাসুদ, আবু দুর্দা ও আবু মাসুদ-আনসারীকে ওমর জেলে পাঠিয়েছিলেন রসূলুল্লাহ্ বরাত দিয়ে খুব বেশি হাদীস বর্ণনার জন্যে।
বিখ্যাত মুহাদ্দিসে ঐতিহাসিক বালাজুরি বলেছেন: শরীয়তের কোনও বিধান সম্বন্ধে লোকে ওমরকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেছিলেন: আমার যদি কখনো মিথ্যা বলার ভয় না থাকতো তা হলে এ সম্বন্ধে একটি হাদীস বর্ণনা করতেম। বহু হাদীসবেত্তা বারবার বলেছেন, ওমর খুব কমই হাদীস উল্লেখ করতেন এবং সময়ে সময়ে এভাবেও বলতেন না-”রসূলুল্লাহ্ বলেছিলেন….।” বস্তুত হাদীস কথনে এতোখানি সাবধানতা এবং সত্যাসত্য নির্ণয়ে এরকম উচ্চমান নির্ধারণের ফলে ওমরের আমলে খুব কমই হাদীস উল্লেখিত হতো এবং সেগুলিতে সন্দেহের লেশমাত্রও থাকতো না। পরবর্তীকালে হাদীস বর্ণণের মাত্রা খুবই বৃদ্ধি পায় এবং তার ফলে সঠিকতা ও বিশ্বস্ততার মান অনেক নিম্নস্তরে নেমে যায়। এ সম্বন্ধে শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ উক্তি প্রণিধানযোগ্য: যদিও সাহাবারা সকলে সত্যাশ্রয়ী তাঁদের উক্তি গ্রহণযোগ্য এবং বাধ্যতামূলক তবুও ফারুকের আমলে হাদীস ও ফিকাহ্ যে পর্যায়ে ছিল এবং পরবর্তীকালে যা হয়েছিল, তার মধ্যে পার্থক্যটা আসমান জমীনের মতোই।
ফিকাহশাস্ত্রের সৃষ্টি ওমরেরই অবদান। এ বিষয়ে ওমরের সূক্ষ্মদর্শিতা ও শ্রেষ্ঠতা সম্বন্ধে সাহাবামণ্ডলী একমত। দারিমী তাঁর মসনদে লিখেছেন: হোদায়ফা-বিন্-আল- য়্যম বলেছেন, যিনি ইমাম ও কোরআনে যাঁর সম্যক অধিকার আছে তাঁরই বিধান দেওয়া সাজে। তাঁর মতে এরূপ ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসিত হলে তিনি নির্দ্বিধায় ওমর-বিন্ – খাত্তাবের নামোচ্চারণ করেছিলেন। আবদুল্লাহ্ বিন্-মাসুদের মতে সারা আরববাসীর জ্ঞান পাল্লার একদিকে ও ওমরের জ্ঞান অন্যদিকে স্থাপিত হলে ওমরের দিকই ভারী হবে। আবদুল্লাহ্ আরো বলেছেন ওমরের সাহচর্যে এক ঘণ্টা যাপন করা এক বছরের এবাদতের চেয়েও উত্তম। নিযামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তী আবু ইসহাক শিরাজী ফকীহ্ বা আইন-বেত্তাদের সম্বন্ধে পুস্তকে সাহাবী ও তাঁদের উত্তরাধিকারীদের বয়ানমতে ওমরের মীমাংসার উল্লেখ করে লিখেছেন: অতি-বর্ণনার ভয় না থাকলে আমি ওমরের এতো মীমাংসা ও সে-সব থেকে উৎপাদ্য আইনকানুনের নযীর দিতে পারতাম; যার বহর দেখে বিদ্যুৎকুল বিস্ময় মানতেন। ইমাম মুহম্মদ তাঁর ‘কিতাবুল আসিরে’ বলেছেন: রসূলুল্লাহ্ (আল্লাহ্র শান্তি ও আশিসরাশি তাঁর উপর বর্ষিত হোক) ফিকাহ্ আলোচনা করতেন আলী, ওবাই ও আবু মুসা আশারীর সঙ্গে একত্রে: আবার ওমর, যায়েদ-বিন্- সাবিত ও আবদুল্লাহ-বিন্-মাসুদের সঙ্গে একত্রে। বস্তুত এই ছয়জন ছিলেন ফিকাহ্ শাস্ত্রের ছয়টি স্তম্ভ।
শরীয়তের প্রশ্নে হাদীস থেকে সাধারণত স্পষ্ট নির্ভুল বিধান মেলে। তবুও যুগধর্মে এমন অনেক প্রশ্নের উদ্ভব হয়, যার কোন পরিষ্কার বিধান হাদীসে পাওয়া যায় না, কিন্তু সে সবের ব্যাখ্যা থেকে একটা মীমাংসায় উপস্থিত হতে হয়, কিংবা পরস্পরবিরোধী হাদীস থাকলে সে সব জ্ঞান ও যুক্তির আলোকে ব্যাখ্যা ও অনুধাবন করে একটা মীমাংসা করতে হয়। ওমরের কৃতিত্ব ও পারঙ্গমতা ছিল এখানে এবং ইসলামের আদি স্তর থেকেই ওমর ফিকাহ্ শাস্ত্রের বিশেষ অধ্যয়ন ও অনুধ্যান করেছিলেন। তার দরুন আবদুল্লাহ-বিন্-মাসুদ, আবুমুসা আশারী ও যায়েদ-বিন্-সাবিত নির্দ্বিধায় ওমরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করতেন। আইনের কূটতর্ক উপস্থিত হলে ওমর নিজের মতামত লিপিবদ্ধ করতেন, তারপর গভীর ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচনা করে সে মত দূরীভূত বা পরিবর্তন করতেন। কিতিল্লানী বুখারী শরীফের তফসীর প্রণয়নকালে প্রসঙ্গক্রমে বলেছেন যে, পিতামহের ওয়ারিসী স্বত্ব সম্বন্ধে ওমর অন্যূন দুইশত মত প্রকাশ করেছিলেন। ফিকাহশাস্ত্রে ও সমসাময়িক আরবী ইতিহাসে ওমরের যে-সব মীমাংসার উল্লেখ আছে, সে-সবের প্রশ্নাবলীর উদ্ভব হয়েছিল বিভিন্ন দেশ থেকে। তাঁর আইন ঘটিত মীমাংসার সংখ্যা ছিল কয়েক হাজার। তার মধ্যে কেবল ফিকাহ্র প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে ছিল প্রায় এক হাজার এবং চার মযহাবের স্রষ্টাগণ অকুণ্ঠভাবে সে-সব অনুসরণ করেছেন। শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ বলেন: এই চার মযহাবের আইন-বেত্তাগণ ফারুক-ই- আযমের ফিকাহ্ সংক্রান্ত প্রশ্নগুলির মীমাংসা নির্দ্বিধায় অনুসরণ করেছেন এবং সেগুলির সমষ্টি হবে এক হাজার। এখানে আরও উল্লেখযোগ্য যে, ওমর যে-সব বিষয়ের প্রশ্ন রসূলুল্লাহ্ রেসালত সংশ্লিষ্ট নয় বলে বিবেচনা করেছেন সে-সব ক্ষেত্রে নির্দ্বিধায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন খোদ রসূলুল্লাহ্ সাক্ষাতে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, বদরযুদ্ধে ধৃত বন্দীদের প্রতি ব্যবহার বিষয়ে এবং হোদায়বিয়ার সন্ধিকালে অসম শর্তগুলির বিরুদ্ধে ওমর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। হাদীসের এই বিভিন্ন রূপের পার্থক্য অনুধাবন করে ওমর ইসলাম-সম্পর্কিত নয় এমন সব বিষয়ের মীমাংসা করেছেন নিজের জ্ঞান বিবেকের উপর নির্ভর করে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, আবুবকরের সময় পর্যন্ত দাসীরা সন্তান জন্মদানের পরও মুক্তি লাভ করতো না এবং যথেচ্ছভাবে বিকিকিনি হতো। ওমর এ প্রথা একেবারে রহিত করেন। তাবুক অভিযানকালে রসূলুল্লাহ্ জিয়া ধার্য করেছিলেন মাথাপিছু এক দীনার হারে, কিন্তু ওমর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন হার ধার্য করেন। রসূলুল্লাহ্ সময় পর্যন্ত পানদোষের কোন নির্দিষ্ট শাস্তি ছিল না, কিন্তু ওমর আশিটি বেত্রাঘাতের আদেশ জারী করেন। এখানেই স্পষ্ট হওয়া দরকার যে, এ-সব ব্যাপারে রসূলুল্লাহ্ কথায় বা কাজে যদি এতোটুকু বিধির ইঙ্গিত থাকতো, তা হলে তাঁর অতি প্রিয় ও পরমভক্ত সহচর ওমর কখনও পরিবর্তনের কল্পনাও করতে পারতেন না; আর যদিও করতেন তা হলে ধর্মভীরু সাহাবাগোষ্ঠী তাঁকে খলিফা হিসেবে একদিনও সহ্য করতেন না।
আইনশাস্ত্রের উন্নতি ও সর্ববিষয়ে মীমাংসাকরণের সদিচ্ছা থেকেই ‘কিয়াসের জন্ম। বলা বাহুল্য, কিয়াস মুসলিম আইনশাস্ত্রের চতুর্থতম স্তম্ভ। কিয়াসের লক্ষ্য হচ্ছে, দৃষ্টান্ত থেকে তুলনামূলক বিচার করে যুক্তি নির্ভর আইন-সূত্র উদ্ভাবন করা। চার মযহাবের স্রষ্টা মহামনীষী ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফী ও ইমাম আমদ এবনে হাম্বলের দৃষ্টান্ত থেকে অনুমেয় সিদ্ধান্তে উপস্থিত হওয়ার উপযোগিতা স্বীকার করতেন এবং তার দরুন তাঁদের বহু আইন-নীতি কিয়াস থেকে উদ্ভুত। কিন্তু মুসলিম আইন শাস্ত্রের এই অন্যতম স্তম্ভের জন্মদাতা ছিলেন মহৎ ওমর।
একটা সাধারণ ধারণা আছে, কিয়াসের উদ্ভাবক ছিলেন মুয়ায-বিন্-জবাল। তাঁরা বলেন, রসূলুল্লাহ্ যখন মুয়াযকে ইয়ামন পাঠান, তখন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তিনি অভিযোগসমূহের কিভাবে ফয়সালা করবেন। মুয়ায উত্তর দেন, কোরআনের বিধি- বিধান অনুযায়ী ফয়সালা করবেন; সেখানে নির্দেশ না পাওয়া না গেলে হাদীস থেকে এবং কোরআন ও হাদীসের কোন নির্দেশ না পেলে তিনি নিজের বিচার-শক্তি প্ৰয়োগ করবেন। এটি ইতিহাদ অর্থাৎ নিজের বিচার-শক্তি খাটানো, কিয়াস নয়। মুসলিম আইন-তত্ত্বের ক্রমবিকাশ পর্যালোচনা করলে লক্ষ্য করা যায়, আবুবকরের সময় পর্যন্ত কোরআন ও হাদীস এবং এ দুটি থেকে আলোক না মিললে ইজ্জ্মার উপর নির্ভর করে বিষয়াদির মীমাংসা করা হতো। তখনও কিয়াস চিন্তার বিষয়ীভূত হয় নি। ওমর আবু মুসা আশারীকে বিচার-সংক্রান্ত যে ইতিহাস-বিশ্রুত ফরমান পাঠিয়েছিলেন তার এই কথাগুলি এক্ষেত্রে পুনরায় স্মরনীয়: “যখন কোন বিষয়ের মীমাংসার নির্দেশ কোরআন ও হাদীসে পাওয়া না যায় এবং তোমার মনে সন্দেহ জাগে তখন বিষয়টি বারবার চিন্তা করবে। আর অনুরূপ বিষয়ে পূর্বের কোন নজীর থাকলে তাই প্রয়োগ করবে।” এর মধ্যেই কিয়াসের জন্ম-সূত্র নিহিত, কারণ কিয়াসের লক্ষ্য হলো: কোরআন সুন্নাহ বা ইজ্জ্মায় রয়েছে, এমন কোন পূর্ব-ঘটনা বা বিষয়ের সঙ্গে নতুন ঘটনার সামঞ্জস্য আছে কিনা বিচার করে দেখা এবং থাকলে সেই বিধান প্রবর্তন করা। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, সুন্নায় আছে, কোন ব্যক্তি অপরের জিনিস জোরপূর্বক ব্যবহার করলে জিনিস কিংবা তার মূল্য ফেরত দিতে বাধ্য। এখন একজন অন্যের লোহা নিয়ে অস্ত্র তৈরী করে ফেললো। জিনিসটি নষ্ট হয়নি, কিন্তু রূপ পরিবর্তন হয়ে গেছে। কিয়াসের বিধান হলো, এক্ষেত্রেও মূল্য ফেরত দিতে হবে। আসলে কিয়াসের বীজ নিহিত আছে কোরআনের বাণীতে। বহু জাতির উত্থান-পতনের এবং নিষেধ অমান্য করায় শাস্তির উল্লেখ আছে কোরআনে এবং বিধর্মী ও অন্যায়কারীদের তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। এখানে কিয়াসের নির্দেশ হলো, তোমরা যদি এমনই করো, তা হলে তোমাদেরও অনুরূপ শাস্তি হবে। বস্তুত শরীয়তের উৎসসমূহের মধ্যে কিয়াসের স্থান চতুর্থ হলেও ইতিহাদের প্রধান পন্থা হিসেবে তার প্রভাব-পরিসর অতি প্রশস্ত। জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে যুগে যুগে কিয়াসের প্রয়োজন অনুভূত হয় এবং তার দ্বারা ইসলামী আইনশাস্ত্রে নতুন নতুন ধারা-উপধারা সংযোজিত হচ্ছে। সংক্ষেপে বলা যায়, কিয়াস ইসলামের সঞ্জীবনী শক্তি আর এই শক্তির স্রষ্টা হিসেবে ফারুক-ই আযমের নাম প্রথমে গ্রহণীয়। খুম্স্ বা মালে-গণিমাতের পঞ্চমাংশে রসূলুল্লাহ্র ওয়ারিসানের একক অধিকার নেই, এটি ওমরের কিয়াসমতের নির্দেশ। ফিকের বাগিচায় রসূলুল্লাহ্ ওয়ারিসানের খাসস্বত্ব নেই, এটিও ওমরের কিয়াসমতে হুকুম। এ সিদ্ধান্তের সমর্থন মেলে কোরআনের এ মহাবাণী থেকে যা কিছু আল্লাহ্ রসূলকে দান করেছেন নগরবাসীদের অধিকার থেকে, তাতে স্বত্ব আছে আল্লাহ্র রসূলের, আত্মীয়-স্বজনের, অভাবগ্রস্ত ও মুসলিমদের (৫৯ : ৭)। আর এ রকম সিদ্ধান্তের মৌল ভিত্তি হলো এই সর্বজন মতগ্রাহ্য চিরন্তন নীতি যদি কোনও ব্যক্তি পয়গম্বর, ইমাম, আমীর বা সুলতানের পদাধিকার বলে কোন সম্পত্তি অর্জন করেন, তবে সে সম্পত্তি তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয় না এবং তাঁর ওয়ারিসান দাবী করতে পারে। এ-দৃষ্টান্ত থেকে সহজেই প্রতীয়মান হয়, যে-সব প্রশ্ন বহু বিতর্ক সাপেক্ষ এবং সাহাবাগণও যার মীমাংসায় দ্বিধাগ্রস্ত সে সব কি সুন্দর ও ন্যায়ানুগতভাবে মীমাংসিত হয়েছে ওমরের হাতে। তাঁর মীমাংসাসমূহ এক দিকে কোরআন ও হাদীসের অনুবর্তী, অন্যদিকে রাষ্ট্রনীতি ও সভ্যতার প্রগতির পথে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ