শিকার – মিজানুর রহমান কল্লোল

শিকার

উন্মাদ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ কবিরের সাথে আমার দীর্ঘদিন দেখা হয় না। এক সময় প্রতিদিন দেখা হত। আমি হাসপাতালের ডিউটি সেরে দুপুরে আরামবাগে তাঁর অফিসে যেতাম। প্রায় ঘণ্টাদুয়েক আড্ডা দিতাম। দুনিয়ার হাবিজাবি বিষয় নিয়ে আলোচনা হত। সেই সঙ্গে মুখে চলত একটু পরপর চা, সিগারেট আর চানাচুর। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লেখক মোকারম হোসেন তখন শিশু একাডেমিতে চাকরি করত। সে একফাঁকে এসে যোগ দিত আমাদের সাথে। তিনজনের আড্ডার মধ্যে উন্মাদ অফিস থেকে সম্পাদক আহসান হাবীব ফোন করে বলতেন, খুব জরুরি, এখনই সবাইকে উন্মাদ অফিসে যেতে হবে। আমি ও মোকারম সাজ্জাদ কবিরের মোটর সাইকেলের পেছনে চেপে বসতাম। একটানে ধানমণ্ডির অফিসে চলে যেতাম। গিয়ে দেখতাম হাসান খুরশীদ রুমী যথারীতি নানরুটি আর কাবাব নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। আমরা খাবারের ওপর হামলে পড়তাম। এরপর আবার আড়া। আবার চা, সিগারেট আর চানাচুর। এভাবেই চলছিল দিন। এরপর হঠাৎ একদিন আমরা প্রাত্যহিক রুটিন পরিবর্তন করে ফেলি। আমি বিকালে পুরান ঢাকার একটি চেম্বারে বসা শুরু করলাম। হাসান খুরশীদ রুমী তাঁদের বাড়ির কাজ শুরু করার অজুহাতে উন্মাদে আসা বাদ দিলেন। মোকারম প্রতি মাসে একটি করে বই লিখতে লাগল। আর সাজ্জাদ কবির ভাই একটি নোটিশ টানিয়ে তাঁর অফিসটাকে আড়ামুক্ত এলাকা ঘোষণা করলেন। উন্মাদ অফিসটাও ধানমণ্ডি এলাকা থেকে চলে গেল মিরপুরে। আমাদের কোথাও আড্ডা বলতে আর কিছুই থাকল না। তাই একদিন সাজ্জাদ কবির ভাই যখন ফোন করে তার অফিসে কফি খাওয়ার দাওয়াত দিলেন এবং বললেন যে কফি খেয়েই একসাথে উন্মাদ অফিসে যাওয়া হবে, আমি আর দেরি করতে পারলাম না। ন্যাশনাল হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই একটা রিকশা নিয়ে ছুটলাম আরামবাগ। রিকশায় বসে মোকারমকে ফোন করলাম। কিন্তু তার মোবাইল বন্ধ পেলাম। যতবার ফোন করি ততবার এক মহিলার বিরক্তিকর কণ্ঠ-দুঃখিত, আপনার কাঙ্ক্ষিত নম্বরটি এই মুহূর্তে বন্ধ রয়েছে…

রিকশাওয়ালাকে অতিরিক্ত দশ টাকা বকশিশ দিয়ে আরামবাগে দেওয়ানবাগ হুজুরের বাবে রহমতের গলির সামনে নেমে পড়লাম। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দ্রুত ঢুকে পড়লাম গলিতে। এই গলির শেষমাথায় সাজ্জাদ ভাইয়ের সৃতি প্রেস।

অনেকে বিভিন্ন সময়ে জানতে চেয়েছে স্মৃতি না হয়ে সৃতি কেন? সাজ্জাদ ভাই উত্তরে বলেছেন, আমার ইচ্ছা। কিন্তু পরে শুনেছি সৃতি হলো গতিময় পথ।

নিজের প্রেসের ভেতরে সুন্দর করে সাজানো ছোটখাট একটা অফিস। কাঁচের টেবিলের ওপাশটায় তিনি বসে থাকেন। এপাশে তিনটে চেয়ার আর দুটো সোফা। পাশে ছোট্ট একটা রুম। ওখানে বসে তাঁর ছোট ভাই আসরার মাসুদ প্রগতি পাবলিশার্সের কাজ করে। সব মুখস্থ আমার।

কিন্তু এখন গিয়ে দেখি অফিসটা ওখানে নেই! নেই প্রেসের কোন চিহ্ন!

১৪৫/৩ নম্বরটিই আমি খুঁজে পেলাম না।

একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, সৃতি প্রেসটা কই?

সে বলল, ওটা তো এক বছর আগেই এখান থেকে চলে গেছে।

কোথায় গেছে?

জানি না।

জানেন না মানে? ঘটনাবহুল প্রেস!

লোকটা সরু চোখে আমার দিকে তাকাল। ঘটনাবহুল? কীসের ঘটনাবহুল?

আমি উত্তর না দিয়ে সামনে এগোলাম। পকেট থেকে মোবাইল বের করে কল দিলাম সাজ্জাদ ভাইয়ের নম্বরে। নম্বরটি বন্ধ।

আবার কল দিলাম। বন্ধ।

আবার–আবার-বারবার—

বন্ধ। বন্ধ।

মেজাজ খারাপ হতে লাগল।

কোন মানে হয়?

সাজ্জাদ ভাই তার প্রেস এখান থেকে সরিয়ে নিয়েছেন সেটা আমাকে জানাবেন না? ওদিকে তিনি মোবাইলও বন্ধ রেখেছেন।

জুলাইয়ের তীব্র গরম। মাথার ওপর গনগন করছে সূর্য। এক ফোঁটা বাতাস নেই কোথাও। কোন গাছের পাতাই নড়ছে না। ঘেমে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে শার্ট।

একটা চায়ের দোকানের সামনে লোকজন ভিড় করে চা খাচ্ছে। এই গরমে সবাইকে এভাবে চা খেতে দেখে আরও গরম লাগল আমার। সেই সাথে মেজাজও চড়তে থাকল।

হঠাৎ সেই ভিড়ের ভেতর থেকে একজন যুবক বেরিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। আমার কাঁধে টোকা দিয়ে বলল, এই, তুই রাজেশ না?

আমি বললাম, হ্যাঁ, আমি রাজেশ। কিন্তু তুই কে? আমাকে তুই করে বলাতে আমিও ইচ্ছা করেই তাকে তুই করে বললাম।  

আমি এমনই।

যে আমাকে যা দেয়, আমি সেটাই তাকে ফিরিয়ে দিই। আমাকে আপনি করে বললে আমিও তাকে সম্মান করে আপনি সম্বোধন করি। আমাকে তুমি করে বললে আমিও। বিগলিত হয়ে তুমি বলি। আর কেউ তুই বললে তাকেও তুই। এর যেমন ভাল দিক আছে, খারাপ দিকও আছে। একবার মতিঝিল এজিবি কলোনির এক বাসার পেছনে দাঁড়িয়ে দেয়ালে প্রস্রাব করছিলাম, হঠাৎ শুনি পেছনে কেউ বলছে, এই, ছেলে, কী করিস এখানে?

আমি মাথা না ঘুরিয়েই বললাম, কানা নাকি? দেখস না কী করি? আয়। লাইনে দাঁড়া।

কী? কী বললি, বদমাশ ছেলে?

তাকিয়ে দেখি মুনিয়ার বাবা।

আমি প্যান্টের চেইন না আটকিয়েই ঝেড়ে দৌড় দিলাম। মুনিয়ার সাথে আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছিল।

এরপর ওখানেই পরিসমাপ্তি।

মুনিয়া স্রেফ আমাকে জানিয়ে দিয়েছিল, কোন কুকুর স্বভাবের লোকের সাথে বাবা আমাকে বিয়ে দেবেন না।

আমি আর কথা বলারই সুযোগ পাইনি।

যুবক আবার টোকা দিল আমার কাঁধে।

আমি ঠিকই চিনেছি। তুই রাজেশ। তোকে রাজ বলে ডাকতাম। কতদিন পর দেখা।

আমি এক পা পিছিয়ে গিয়ে বললাম, কিন্তু তুই কে?

আমাকে চিনিস নাই? আমি অভিজিৎ।

অভিজিৎ? আমি ঠিক চিনতে পারলাম না তাকে।

হ্যাঁ, অভিজিৎ।

সে হাসল। আমি স্মৃতি হাতড়ালাম।

বরিশাল মেডিকেলে আমার সাথে অভিজিৎ নামে কেউ পড়ত না। আমাদের আগের ব্যাচে এক অভিজিন্দা ছিলেন, কিন্তু এর সাথে তার চেহারার মিল নেই।

আমার চেহারা বোধহয় পড়তে পারল সে। একটু হেসে বলল, নন্দিতাকে ভুলে গেছিস তুই? অবশ্য ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। সে তো আজকের কথা নয়!

বিদ্যুৎ চমকের মত আমার মনে পড়ে গেল। আমি চিৎকার করে তাকে জড়িয়ে ধরতে গেলাম। সে পেছনে সরে গেল।

আমি একটু ধাতস্থ হয়ে বললাম, নন্দিতা কেমন আছে রে?

সে বলল, খুব ভাল আছে। কাল ওর বিয়ে। নন্দিতাকে কথা দিয়েছিলাম ওর বিয়েতে তোকে হাজির করব। যে কষ্ট ওকে দিয়েছিলি, মেয়েরা সহজে কষ্টের কথা ভোলে না।

আমি একটু থমকে গেলাম। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললাম, অভিজিৎ, ওটা ছিল একটা অ্যাকসিডেন্ট।

এতদিন পর আমি ব্যাখ্যা শুনতে আসিনি। নন্দিতাকে কথা দিয়েছিলাম, ব্যস, আমি কথা রক্ষা করছি। তোর হাসপাতালেই যেতাম। কিন্তু তোর সাথে এখানেই দেখা হয়ে গেল।

তুই জানিস আমি কোন্ হাসপাতালে?

না জানার কী আছে? তুই এত বিখ্যাত হয়ে গেছিস!

আমি অভিজিৎকে দেখছি। একসাথে স্কুলে পড়তাম আমরা। খুব ছটফটে ছিল সে। ভাল ফুটবল খেলত। ম্যাট্রিক পাশ করার পর সে হঠাৎ করে সায়েন্স ছেড়ে আর্টস নেয়। তাই তার সাথে আমার আর দেখা হত না।

কিন্তু আমার সাথে দেখা হত নন্দিতার। প্রায় নিয়মিত। আমি তখন ইন্টারমিডিয়েট সেকেণ্ড ইয়ারে।

একদিন ক্লাস ছিল না। আমি কলেজের পেছনের খেজুর বাগানে একটি খেজুর গাছের গোড়ায় বসে ছবি আঁকছিলাম। হঠাৎ মেয়ে কণ্ঠের হাসি শুনে চমকে তাকাই। তেরো-চোদ্দ বছরের একটি মেয়ে। অদ্ভুত সুন্দরী।  

কার ছবি আঁকছেন?

অ্যাঁ! কারও না। এমনি এক মেয়ের ছবি।

আমি নন্দিতা। হাঁটু মুড়ে বসতে-বসতে বলল সে। অভিজিৎ সমদ্দার আমার দাদা।

ওহ, তুমি অভিজিতের বোন? আমি কিছুটা বিস্ময় নিয়ে তাকালাম। কেননা অভিজিতের এমন সুন্দরী একটা বোন রয়েছে, কখনও বলেনি সে। আমি চোখ সরাতে পারলাম না।

ক্লাস নাইনে পড়ে নন্দিতা। ঠিক যেন একটা পরী। খুব অল্পদিনের মধ্যেই ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। আমাদের নিয়মিত দেখা হতে লাগল ওই খেজুর বাগানে। ক্রমেই ও সুন্দরী থেকে আরও সুন্দরী হয়ে উঠল। একদিন। নন্দিতা বলল তার কেমন বমি-বমি লাগছে। আমি ভয়ে পালালাম। সেই শেষ দেখা।

বিয়ে কবে বললি? কাল? কীভাবে যাব? এত অল্প সময়ে! তা ছাড়া ছুটি নেয়া…অনেক ঝামেলার ব্যাপার।

তুই ইচ্ছা করলে পারবি। তুই-ই পারিস। আগেও পেরেছিস।

কিন্তু…

কীসের কিন্তু? কোন কিন্তু না। নন্দিতার বিয়ে বলে কথা। তুই না থাকলে হয়?

এতদিন পর-

নন্দিতা খুব করে বলছিল তোর কথা। মেয়ে মানুষের মন তো, কখন কী আবদার করে বলা মুশকিল। পুরানো প্রেম-ভুলতে পারে না।

এসব বলে লজ্জা দিস না। জাস্ট একটা অ্যাকসিডেন্ট।

অ্যাকসিডেন্ট না কী ছিল সে প্রসঙ্গ থাক। আমি যদি তোকে তখন পেতাম, স্রেফ পুঁতে ফেলতাম। বাদ দে সেসব। তাতুয়াকান্দা, গ্রামের নাম। নাম শুনেছিস তো?

না।

নারায়ণগঞ্জের মধ্যে। আড়াইহাজারে।

ও।

গুলিস্তান থেকে বাসে উঠবি। আড়াইহাজার নেমে খানাকান্দা যাবি।

তুই না বললি তাতুয়া—

তাতুয়াকান্দা।

হুম। ওদিকটায় যাইনি কখনও।

খুব সুন্দর জায়গা। গেলে ভাল লাগবে। অনেকদিন পর নন্দিতাকে দেখবি। আরও ভাল লাগবে। এ কী! তুই তো লজ্জায় মুখ লাল করে ফেলছিস। তুই যদি একবার আমাকে আভাস দিতি নন্দিতাকে তোর ভাল লাগে, আমিই তোর সাথে ওর বিয়ের ব্যবস্থা করে দিতাম। আমার কাছে ধর্মটা কোন ব্যাপার না। কিন্তু বোনটা আমার অনেক কষ্ট পেয়েছিল! একমাত্র বোন। খুব আদরের।

প্লিজ, অভিজিৎ।

হ্যাঁ, যা বলছিলাম। আড়াইহাজার থেকে টেম্পোতে যাবি খানাকান্দা। খানাকান্দা বাজারে নন্দিতা স্টোরে যাবি। ওখানে দোকানের পরিমল তোকে মোটর সাইকেলে করে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাবে। ওকে বলে রাখব। তাতুয়াকান্দা ওখান থেকে কাছেই।

আচ্ছা।

মিস করিস না। চলে আয়। খুব ভাল লাগবে।

আসব।

আমি যাই। আরও কয়েক জায়গায় দাওয়াত দিতে হবে।

আচ্ছা।

চলে গেল অভিজিৎ।

আমি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট খেলাম। রিকশা ঠিক করতে যাব এমন সময় বেজে উঠল মোবাইল। দেখি সাজ্জাদ ভাইয়ের ফোন। প্রথমে ভাবলাম ধরব না। কিন্তু পরে। ধরলাম।

হ্যালো, রাজেশ?

জি।

এলেন না তো?

আমি এক ঘণ্টা আগেই এসেছি। আপনার অফিসটা নেই। ফোনও বন্ধ। চলে যাচ্ছি। বাই।

কেন, কী হলো? সাজ্জাদ ভাই বললেন, আমার অফিসে আসলে নেটওয়ার্কের সমস্যা। আমিও ট্রাই করে যাচ্ছিলাম আপনাকে। আসুন, অনেকদিন গল্প হয় না। আপনি ঠিক কোথায় আছেন, বলুন তো? আমি নিজে আসছি।

আমি আমার অবস্থান জানালাম।

সাজ্জাদ ভাই পাঁচ মিনিটের মধ্যে এসে আমাকে নিয়ে গেলেন।

উনি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, ওখানে। আপনার যাওয়া ঠিক হবে না।

আমি জানতে চাইলাম, কেন?

উনি বললেন, প্রথমত জায়গার নামটাই আমার পছন্দ হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, ওই ছেলের সাথে আপনার এতদিন পর দেখা হলো আর দুম করে আপনাকে তার বোনের বিয়ের দাওয়াত দিল, বলল, আপনার কাছেই যাচ্ছিল। নাহ্, আপনি যাবেন না। মতলব ভাল না।

কীভাবে বুঝলেন?

আমি এসব বুঝি। অভিজ্ঞতা। আহসান ভাইকে জিজ্ঞেস করবেন, তিনিও আমার কথার বাইরে যান না।

.

কিন্তু আমি তার কথার বাইরে গেলাম। রাতে শুয়ে-শুয়ে বারবার চোখে ভাসল নন্দিতার ছবি। কী টলমলে চেহারা। টিকালো নাক, টানা চোখ। গোলাপের মত ঠোঁট। আহ! আমাকে নন্দিতার কাছে যেতেই হবে। কতদিন তাকে দেখিনি!

এখন কেমন দেখতে হয়েছে সে? অভিজিৎ বলল আরও সুন্দর হয়েছে। সুন্দর হবারই কথা। আমার সাথে তার যখন সম্পর্ক ছিল তখন সে ক্লাস নাইনে পড়ে। দশ-বারো বছর আগের কথা সেটা। এখন তো পূর্ণ যৌবনা সে। চাকবুম চাকবুম।

খুব সকালেই রওনা দিলাম আমি। এই সকালেও গুলিস্তানে গিজগিজ করছে লোকজন। ফেরিওয়ালারাও যথারীতি তৎপর।

ভাল একটা সিট নিয়ে বসে পড়লাম। বাস ছাড়ল। জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছি। খুব ভাল লাগছে। ঢাকা থেকে যত দূরে সরে যাই, তত ভাল লাগে সবকিছু। সবসময়ই আমার এমন অনুভূতি হয়।

বাসে আড়াইহাজারে নেমে টেম্পোতে খানাকান্দা গেলাম। এক ভ্যানওয়ালা জিজ্ঞেস করল, স্যর কি লালুর কান্দি যাবেন? নাকি ডোমারচর?

বললাম, তাতুয়াকান্দা।

সে বলল, তা হলে ভ্যানে ওঠেন। আমার বাড়ি কাকাইল মোড়া।

আমি বললাম, আমি আসলে এদিকের কিছুই চিনি না। এই প্রথম এসেছি। তবে সমস্যা নেই। আমাকে নিয়ে যাওয়ার লোক আছে। এখানে নন্দিতা স্টোরটা কোনদিকে বলতে পারো?

পারুম না কেন? ওই যে মাঠের ওই পাশে একটা স্বর্ণবন্ধক দোকান আছে, তার ওপাশে। উনার ভাইটারে তো আমিই এই ভ্যানে করে শ্মশানে নিয়ে গিয়েছিলাম।

কী জন্য?

কী জন্য মানে? পোড়াইতে। অ্যাক্সিডেন্টে যা-তা অবস্থা হয়েছিল।

আমি সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। নন্দিতার ভাই?

জি। উনার ভাই।

অভিজিৎ?

জি। ওটাই তার নাম ছিল। একটাই তো ভাই।

কী বলছ?

আপনি চিনতেন?

আমি তার উত্তর না দিয়ে বললাম, কবের ঘটনা?

ভ্যানওয়ালা উত্তর দিল, এই ধরেন বছর তিনেক আগে।

অভিজিৎ?

জি। একটাই তার ভাই।

আমি দাঁড়ানো থেকে বসে পড়লাম।

ভ্যানওয়ালা বলল, স্যর কি অসুস্থ?

ঘামছি আমি। সেই সাথে মনের মধ্যে বয়ে যেতে লাগল দুশ্চিন্তার স্রোত। গতকাল আমাকে নন্দিতার বিয়ের দাওয়াত দিতে গিয়েছিল অভিজিৎ। অথচ তিন বছর আগে সে মরে গেছে! আমি পুরো ব্যাপারটা স্বপ্ন দেখিনি তো? তা কীভাবে সম্ভব? সাজ্জাদ ভাইয়ের অফিসে কাল আড্ডা দিয়েছি। এখানে আসার ব্যাপারে উনি নিষেধ করছিলেন। তা ছাড়া অভিজিৎ ঠিকানা না দিলে আমার জানার কথা নয় যে এখানে ওদের বাড়ি।

স্যর কি অসুস্থ? ভ্যানওয়ালা আবার জিজ্ঞেস করল।

না, হঠাৎ মাথা ঘুরে উঠেছিল। এখন ঠিক আছি, আমি উঠে দাঁড়ালাম। তখনও দুর্বল লাগছে।

স্যর, ওই দোকানের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। কিছু। কিনবেন? নাকি এমনি?

এমনি।

ওহ। এখানে নতুন কেউ এলে ওই দোকানের কথা জানতে চায়।

কেন?

অনেক জিনিস পাওয়া যায় তো, তাই। এখানকার সবচেয়ে বড় দোকান।

দোকানটা কে চালায়?

আগে অভিজিই চালাইত। সে মরার পর তার এক ভাগ্নে চালায়।

পরিমল?

স্যর তো চিনেন দেখছি।

একটু পর দেখলাম একটা রোগা-পাতলা ছেলে ধীর গতিতে একটা মোটর সাইকেল চালিয়ে আমাদের দিকে আসছে। আমার কাছে এসে থামল।

স্যর, আপনি রাজেশ স্যর? ছেলেটি বলল।

হ্যাঁ, মাথা কঁকালাম আমি। তুমি পরিমল?

পরিমল বাবু অসুস্থ। আমাকে পাঠালেন আপনাকে নিতে। পেছনে ওঠেন, স্যর। আমি নিয়ে যাচ্ছি।

আমি মোটর সাইকেলের পেছনে উঠে বসলাম। ভ্যানওয়ালা এগিয়ে এসে বলল, স্যরকে কই নেন?

ছেলেটি বলল, কোথায় নিই, তোর কী? কথা কম কস, রমজান। একেবারে চোখ গালাইয়ে দিমু।

.

গ্রামের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। রাস্তার দুপাশে বাঁশ ঝাড়। মানুষজন খুব একটা চোখে পড়ল না। আস্তে-আস্তে মোটর সাইকেল চালাতে লাগল ছেলেটা। হঠাৎ বলল, এ দিকটায় শেয়ালের উৎপাত খুব বেশি।

আমি বললাম, শেয়াল তো এখন কোথাও তেমন দেখা যায় না।

ছেলেটি বলল, আশপাশের গ্রামগুলোতে গত কয়েকদিন ধরে শেয়ালের উৎপাত এমন বেড়েছে যে বলার নয়। সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই আক্রমণ করছে। লালুর কান্দি, ডোমারচর নয়নাবাদ, উলুকান্দি, পাঁচগাঁও…

আমি এসব নামও শুনিনি।

রাতেই ঘটনা ঘটে। রাতে বাড়ি থেকে না বেরোনোই ভাল।

এদিকে স্বাস্থ্য কেন্দ্র নেই?

আছে। একজন মেডিক্যাল অফিসার কী করবে?

.

বেশ পুরানো দোতলা একটি বাড়ির সামনে এসে ছেলেটি মোটর সাইকেল থামাল।

বাড়ির চারপাশ গাছগাছালিতে ভরা। অনেকদিন পরিষ্কার করা হয় না। গেটের সামনের ছোট্ট পাকা জায়গাটায় শেওলা জমে পিচ্ছিল হয়ে আছে। এটা একটা বিয়ে বাড়ি মনেই হচ্ছে। না। আশপাশেও কোন বাড়িঘর দেখছি না। দু-তিনটা ঘর পড়ে আছে, সেগুলো ছনের এবং ভাঙা।

ছেলেটি যেন আমার মনের কথা টের পেল। বলল, এসব জায়গা বাবুজিদের।

বাবুজি? আমি প্রশ্ন করলাম।

অভিজিৎ বাবুদের। সে আঙুল উঁচিয়ে আশপাশটা দেখাল। এসব জমিজমা সবই বাবুদের।

ওহ।

ভেঙে যাওয়া ঘরগুলোতে গরু-বাছুর থাকত।

আচ্ছা।

ঝড়ে ভেঙে গেছে। পরে আর ঠিক করা হয়নি।

ওহ।

চলুন ভেতরে যাই।

চলল।

ছোট্ট লোহার গেট তালা মারা। কোমর থেকে চাবির গোছা বের করে তালা খুলতে লাগল ছেলেটি।

আমার নাম দয়াল, তালা খুলতে-খুলতে বলল সে। আমার মোবাইল নম্বর রাইখে দিয়েন। যে কোন দরকারে ফোন করবেন।

বাড়িতে কেউ নেই?

থাকবে না কেন? আছে। দিদি গেছে তার পিসী বাড়ি। ওখানেই তাকে সাজাইব। লগ্ন ছাড়া কি বিয়ে হয়? লগ্ন রাত দুইটায়। তখন বিয়ে হইব। সন্ধ্যার পরেই চইলা আইব সবাই। আর বড় বাবু গেছে দই আনতে। একটু পরেই চইলা আইব।

বড় বাবু মানে? নন্দিতার বাবা?

উফ। শালার ইন্দুরে কামড় দিছে। আমার কথার উত্তর না দিয়ে ডান হাতের বুড়ো আঙুল মুখের মধ্যে নিয়ে চুষতে লাগল দয়াল। সাবধানে থাইকেন। ঘরে ইন্দুর আছে। একবার এক বাচ্চারে খাইয়া ফেলাইছিল।

শুনে আমি থমকে গেলাম। আরও থমকে গেলাম কী নির্বিকারভাবে বলে যাচ্ছে ছেলেটি।

পুরা শরীর তখনও খায় নাই। অর্ধেকটা সবে খাইছে। নাড়িভুড়ি বেরোয়ে গেছিল। এই ধরেন গত বছরের ঘটনা। সবাই জানে।

আরেকটু হলেই আমি বমি করে ফেলছিলাম।

ছেলেটি গেট খুলে আমাকে ভেতরে নিল। তারপর দরজার তালা খুলল। পুরানো ভাপসা গন্ধ ঝাঁপটা মারল নাকে। জুতা খুইলা ঘরে ঢোকেন। ছেলেটি নিজের পায়ের স্যাণ্ডেল দেয়ালের এক পাশে রেখে বলল।

আমি জুতো-মোজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম।

চমৎকার সাজানো ঘর। একেবারে ঝকঝকে-তকতকে। বিশাল নকশাওয়ালা পালঙ্ক। পুরু গদি। টানটান করে ওপরে চাদর বিছানো। পাশাপাশি দুটো বালিশ। পুরানো আমলের সোফা। সামনে টি টেবিল। সবকিছুই পরিষ্কার। তবু কেমন। একটা গন্ধ যেন।  

আপনি এ ঘরেই শোবেন। বলল ছেলেটি। টর্চ আছে। সাথে? না থাকলে ওই টেবিলের ড্রয়ারে পাবেন। হাত দিয়ে কোনার একটি পড়ার টেবিল দেখাল সে। পল্লী বিদ্যুৎ। দুই ঘণ্টা কারেন্ট থাকে, আবার দুই ঘণ্টা থাকে না। টেবিল ল্যাম্প আছে, জ্বালাইয়ে নিয়েন। আমি সামনের, ওই ভাঙা ঘরে থাকব। কোন দরকারে মোবাইলে কল দিয়েন। এত দূরে, ডাকলেও শুনব না। দোতলায় যাইয়েন না। দোতলায় দিদির ঘর। আপনি আইবেন বলে বড় বাবু এই ঘর ছাড়ছে। উনি থাকবেন চিলেকোঠার ঘরে। এক নাগাড়ে বলে গেল ছেলেটি।

এই যে আপনার ব্যাগ রাখলাম।

আমার ব্যাগ একটা চেয়ারের উপর রাখল সে।

বাথরুম ওইটা দেইখা নেন, ছেলেটি বলল। শ্যাম্পু, সাবান সব আছে। গ্রাম হইলে কী হইব, পানি গরম করার ব্যবস্থা আছে। স্নান সাইরা খাইয়া-দাইয়া ঘুম দেন। ক্লান্ত লাগতাছে আপনারে। তা ছাড়া রাত জাগন লাগব। রাতেই তো বিয়া। আসেন, আপনের খাবার টেবিল দেখাইয়ে দিই।

আমাকে পাশের রুমে নিয়ে গেল সে।

বিশাল ডাইনিং টেবিল। প্রায় অর্ধেকটাই পূর্ণ হয়ে আছে। খাবারে। সব ঢাকনা দেয়া।

টাটকা রান্না করা। ভোরবেলায় রান্না করেছি, ছেলেটি বলল। যা মন চায় নিয়ে খাবেন। একটা বাটিতে শুয়োরের কলিজা আছে। আপনি মুসলমান। ওইটা খাবেন না জানি। তবু রাখছি যদি টেস্ট করেন। তবে ইলিশ মাছটা খাইয়েন। কোন ভেজাল নাই। ঘি দিয়া ভাজছি। পুরা আস্তা ইলিশ। হেভি টেস্ট পাবেন। মুরগির মাংসের তিনটা পদ আছে। পরে বইলেন কোনটা ভাল লাগছে। ছাগলের মাংসটা ফাটাফাটি রানছি। খাইয়েন।

আমি কখনওই খাবার রসিক নই, তাই কিছু বললাম না। শুধু শুনে গেলাম।

ছেলেটি যাওয়ার আগে তার মোবাইল নম্বর আমাকে দিয়ে গেল। বলে গেল, যে কোন দরকারে আমারে ফোন কইরেন। আমার নাম দয়াল।

আমি দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে কাপড়-চোপড় ছাড়লাম। দুপুর দুটো বেজে গেছে। ভাবলাম গোসল করে ফ্রেশ হয়ে তারপর লাঞ্চ করব। বাথরুমে ঢুকলাম। শাওয়ার ছেড়ে মনের সুখে গোসল করলাম। ঠাণ্ডা পানির পরশে দেহমন। জুড়িয়ে গেল। তরতাজা হয়ে উঠল শরীর।

গুনগুন করে গান গাইতে-গাইতে বাথরুম থেকে বেরোলাম। এবং বিছানার দিকে চোখ পড়তেই জমে গেলাম। আমার হাত থেকে ভেজা কাপড়গুলো মেঝেতে পড়ে গেল। বিছানায় দুপা তুলে বসে আছে অভিজিৎ!

মনে হলো আমার গলার কাছে হৃৎপিণ্ডটা উঠে এসেছে। ধকধক করছে। নিজেই শুনতে পাচ্ছি নিজের হৃৎপিণ্ডের ধুকধুকানি শব্দ।

কী রে? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? মনে হয় ভূত দেখছিস! হাসল অভিজিৎ। বিছানা থেকে নামল। এই প্রথম খেয়াল করলাম সে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে হাঁটে।

তুই-তুই কোত্থেকে এলি? আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম।

কোত্থেকে এলাম মানে? আমি দোতলায় ঘুমোচ্ছিলাম। তুই এসে ডাকলিও না। পথে কোন সমস্যা হয়নি তো? এখানে, আসতে কোন অসুবিধা

না, না, কোন সমস্যাই হয়নি। বরং সবাই খুব হেলপফুল।।

তুই খেয়ে রেস্ট নে। একটা ঘুম দে। ভাল লাগবে।

আয়, তুইও খা আমার সাথে। একসাথে খেতে-খেতে গল্প করি।

না রে। উপোস রয়েছি। একমাত্র বোনের বিয়ে। বড় ভাই হিসাবে কত দায়িত্ব থাকে। হাসল অভিজিৎ। কেন জানি আমার সেই হাসি ভাল লাগল না।

কাপড়গুলো বারান্দায় গিয়ে একটা দড়িতে মেলোম। আকাশে মেঘ জমছে। এত বড় বাড়িতে মাত্র দুজন প্রাণী থাকে। অভিজিৎ ও নন্দিতা। অভিজিতের বাবা কি এই বাড়িতে থাকেন না, নাকি আগেই মারা গেছেন। মাথার মধ্যে নানা প্রশ্ন খেলছে। গতকাল অভিজিতের দাওয়াত দেয়া থেকে শুরু করে এখানে আসা-ভ্যানওয়ালার কথাগুলো-ভ্যানওয়ালা কি মিথ্যে বলেছে আমাকে? মজা করেছে? করতেও পারে। গ্রামের এসব অশিক্ষিত মানুষ উল্টোপাল্টা কথা বলে খুব মজা পায়।

ভ্যানওয়ালার কথা মনে পড়তেই নিজের প্রতি রাগ হলো খুব। আমি কি তবে তার কথা বিশ্বাস করে ফেলেছি? কী হাস্যকর! জলজ্যান্ত একজন মানুষকে কেউ মৃত বলল, আর আমার মত উচ্চশিক্ষিত একজন মানুষ সেটাকে বিশ্বাস করে কত কী ভাবতে শুরু করেছি।.ভ্যানওয়ালা বলেছিল তার ভ্যানে করে অভিজিতের লাশ পোড়াতে নিয়ে যাচ্ছিল শ্মশানে। সে বলল, আর আমিও বিশ্বাস করলাম। কী সব ফালতু কথা। হাস্যকর।

কাপড় মেলে এসে দেখি অভিজিৎ সেভাবেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। এক পায়ে ভর দিয়ে।

নন্দিতা একেবারে সেজেগুজেই আসবে, পায়ের ভর বদল করে বলল সে। ওর জন্য অপেক্ষা করে লাভ নেই। তুই খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে নিস। সন্ধ্যায় উঠলেই হবে।

বর কী করে? প্রশ্ন করলাম আমি।

দাঁত বের করে হাসল অভিজিৎ। তার হাসিটা যে এত বিশ্রী লাগে দেখতে-আমার জানা ছিল না।

বায়ো মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, বলল অভিজিৎ। ছেলেটা ভালই। আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই। নন্দিতাই পছন্দ করেছে। কপালে ডাক্তার জুটল না তো, তাতে কী? ওই লাইনেরই ইঞ্জিনিয়ার ধরেছে।

আমি কিছু বললাম না।

অভিজিৎ বলল, তোর বউ কী করে?

আমি বললাম, আমি তো বিয়েই করিনি। বউ আসবে কোত্থেকে?

অভিজিৎ বলল, তা হলে তো আরও ভাল হলো। ওই ছেলে না এলে তোর হাতেই নন্দিতাকে তুলে দেয়া যাবে। অবশ্য তুই যে মানের লুচ্চা, নন্দিতা রাজি হবে বলে মনে হয় না।

আমি বললাম, দেখ, অভিজিৎ, এভাবে বারবার আমাকে

হা-হা করে হাসল অভিজিৎ, কেন জানি না শিউরে উঠলাম আমি।

একাই খেলাম আমি। চমৎকার সব রান্না। অভিজিৎ খেল না। দোতলায় চলে গেল।

খেয়ে-দেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। প্রায় সাড়ে তিনটা বাজে। মোবাইল বের করলাম। এখন পর্যন্ত একটাও কল আসেনি। দেখলাম স্ক্রিনে ইমার্জেন্সি লেখা। অর্থাৎ নেটওয়ার্ক নেই। বুঝলাম এদিকটায় মোবাইলের টাওয়ার নেই। কয়েকবার অফ-অন করলাম মোবাইল। লাভ হলো না। বালিশের নিচে মোবাইল রেখে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম।

হঠাৎ করেই আমার ঘুম ভেঙে গেল।

ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলাম।

প্রচণ্ড পিপাসায় বুক ফেটে যাচ্ছে।

ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত নটা বেজে গেছে!

এতক্ষণ আমি ঘুমিয়েছি!

কেউ ডাকল না আমাকে?

কোলাহলের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। মনে হলো ঘরের বাইরে। একসঙ্গে অনেক মানুষ কথা বলছে। ঘরের বাইরে নাকি দোতলায়? মনে হচ্ছে তর্ক-বিতর্ক চলছে কিছু নিয়ে। আসলেই? নাকি কল্পনা? আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। মুহূর্তে সব শব্দ থেমে গেল। ঘরে অল্প পাওয়ারের বাতি জ্বলছে।

আমি টেবিলের কাছে গিয়ে জগ থেকে পানি ঢেলে খেলাম। কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে।

জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকালাম। নিকষ অন্ধকার।

এটা একটা বিয়ে বাড়ি, সেটা মনেই হচ্ছে না।

কোন আয়োজন নেই, কোন অতিথি নেই, এমনকী এখন পর্যন্ত নন্দিতারও কোন দেখা নেই।

অভিজিৎ বলেছে, লগ্ন রাত দুটোয়। আসলেই কি তাই?

আমি অবশ্য এসব লগ্নের বিষয় জানি না। বুঝিও না। নিজের ধর্মেরই খোঁজ রাখি না-আবার অন্যের ধর্ম!

আবার কোলাহলের শব্দ শুনলাম। কান খাড়া করলাম। আমি। মনে হলো কারা যেন ধাক্কাধাক্কি করছে। প্লেট ভাঙার শব্দ হলো। চেয়ার আছড়ে পড়ল কোথাও। কেউ একজন আউ করে উঠল। আমি ঘরের ভেতর চোখ বুলালাম। সব কেমন স্থির। খুব বেশি স্থির। আমি পা টিপেটিপে দোতলার সিঁড়ির কাছে গেলাম। দোতলায় নন্দিতার ঘর।

একটু ইতস্তত করলাম আমি। তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলাম। কতদিন নন্দিতাকে দেখিনি।

দোতলায় উঠে বড় ধরনের ধাক্কা খেলাম। নিচ থেকে আসা আবছা আলোয় দেখলাম দরজায় বড়সড় একটা তালা মারা। দুপুরে অভিজিৎ বলছিল সে এ ঘরেই ছিল, তা হলে কি তালা মেরে বাইরে গিয়েছে? আমার ঘরে ডিম লাইটটাও কি জেলে রেখে গেছে সে? আমি তালার গায়ে হাত রাখলাম। মনে হলো ধুলো পড়ে আছে।

মনের অজান্তে আমি জোরে চিৎকার দিলাম, অভিজিৎ!

সারা বাড়িতে প্রতিধ্বনি তুলল আমার ডাক।

আমি আবার চিৎকার দিলাম, অভিজিৎ!!

দেয়ালে-দেয়ালে বাড়ি খেল সেই শব্দ।

আমি দ্রুত নিচে নেমে এলাম। ভয় পেয়েছি আমি!

তাড়াতাড়ি প্যান্ট-শার্ট পরে নিলাম।

দ্রুত জুতো জোড়া পরে দরজার ছিটকিনির দিকে হাত বাড়ালাম। ছিটকিনি খোলা। খোলাই তো থাকবে। দয়াল আমাকে এখানে রেখে চলে যাবার পর আমি তো ছিটকিনি আটকাইনি।

আমি দরজা টান দিয়ে খুললাম। বাইরের ঠাণ্ডা বাতাস ঝাঁপটা মারল আমার মুখে। ছোট্ট লোহার গেট। ওটা টান দিলাম। বন্ধ। দয়াল কি বাইরে থেকে আমাকে আটকে দিয়ে গেছে? আমি পাগলের মত লোহার গেটটি টানতে লাগলাম। পাল্লা নড়াতে পারলাম না এক চুলও। দৌড়ে ঘরে ঢুকলাম। বালিশের নিচ থেকে মোবাইল বের করলাম। দয়ালকে রিং করলাম। রিং যাচ্ছে না। নেটওয়ার্ক নেই। আবার দৌড়ে এসে দরজার বাইরের গেট টানাটানি করলাম। আবার ঘরে ঢুকলাম। এবার জানালার গ্রিল ধরে টানতে লাগলাম যদি খুলে আসে! হাত ব্যথা করে ফেললাম, তবু নড়াতে পারলাম না, এমন মজবুত।

জানালায় মুখ নিয়ে চিৎকার করলাম, বাইরে কি কেউ আছেন?

কোন উত্তর এল না।

শুধু বাতাসের শোঁ-শোঁ শব্দ।

ক্রমেই বাড়তে লাগল বাতাস। জানালার পর্দা উড়ে যেতে চাইল। ঝড় শুরু হয়েছে!

আমি জানালা বন্ধ করে দিলাম।

কড়াৎ করে কাছেই কোথাও বাজ পড়ল। আমি কেঁপে উঠলাম। উঠে দ্রুত ঘরের সব লাইট জ্বেলে দিলাম। উজ্জ্বল আলোয় ঘরটা ভরে উঠল। এতে ভয় কিছুটা কমলেও বুকের ধুকপুকানি টের পাচ্ছি। ঘরের চারপাশে চোখ বুলাতে লাগলাম অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ে কিনা। না, তেমন কিছুই নেই। নিজেকে বুঝ দেয়ার চেষ্টা করলাম আসলে যা দেখেছি সব স্বপ্ন। অথবা সবই স্বাভাবিক। অযথা আমি ভয় পাচ্ছি।

বাইরে প্রচণ্ড বাতাস। গাছের ডাল বাড়ি খাচ্ছে জানালায়। এমন ঝড় হতে থাকলে যে কোন সময় কারেন্ট চলে যেতে পারে। আমি টেবিলের কাছে গিয়ে মোমবাতি আছে কিনা খুঁজতে লাগলাম। ম্যাচ আমার পকেটেই আছে।

টেবিলে কোন মোমবাতি নেই।

টান দিয়ে ড্রয়ার খুললাম। পুরানো কলম। একটা ভাঙা পেন্সিল। নিচের ড্রয়ার খুললাম। চার-পাঁচটা পুরানো ছেঁড়া বই। আতিপাতি করে খুঁজলাম। কোথাও কোন মোমবাতি নেই। অথবা বিকল্প কিছু।

ধীরে-ধীরে ঝড়ের গতি বাড়ছে।

আলোও কেঁপে-কেঁপে উঠল কয়েকবার। হঠাৎ দপ করে নিভে গেল।

গাঢ় অন্ধকারে ভরে গেল রুম।

শুধু ঝড়ের শব্দ।

হঠাৎ আমার পায়ের ওপর দিয়ে কী যেন চলে গেল। আমি ভয়ে চিৎকার দিলাম। বুঝলাম ওটা ইঁদুর। দ্রুত পকেট হাতড়ালাম। ম্যাচ খুঁজে পেলাম না। শার্টের পকেট, প্যান্টের পকেট বারবার হাতড়াতে লাগলাম। কোথাও ম্যাচ নেই। আসার সময় সম্ভবত কোথাও পড়ে গেছে।

মোবাইলটা হাতে নিলাম। বাটনে চাপ দিতে অল্প আলো জ্বলল। মোবাইলের টর্চ জ্বালানো ঠিক হবে না, দ্রুত চার্জ চলে এমন অবস্থা হবে, আগেই চার্জ দিয়ে রাখতাম।

মোবাইলের আলোয়, খাটে বসে রইলাম। অভিশাপ দিলাম ভাগ্যকে। সাজ্জাদ ভাইয়ের কথা শোনা উচিত ছিল। মনে হচ্ছে রাতে আর কারেন্ট আসবে না। মোবাইলের চার্জটুকু শেষ হয়ে গেলে কী হবে?

নাহ্, মিছেমিছি ভাবছি। নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম। কিছুই হয়নি, বেশি-বেশি চিন্তা করছি আমি। হয়তো নন্দিতা সত্যিই তার পিসীর বাড়িতে-হয়তো ওখানেই বিয়ের আয়োজন হচ্ছে, হয়তো ধর্মীয়ভাবে ঝামেলা হতে পারে মনে করে অভিজিৎ আমাকে না ডেকেই সেখানে চলে গেছে। আর অভিজিতের সাথে আমার সত্যিই দেখা হয়েছে, এখানে উল্টোপাল্টা কিছু ভাবার সুযোগ নেই। আর যদি উল্টোপাল্টা কিছু হত, দয়াল নিশ্চয়ই আমাকে এখানে আনত না। আর ওই ভ্যানওয়ালা যা বলেছে, নিশ্চয়ই তার মাথার ঠিক নেই। গ্রামের দিকে এ ধরনের অনেক লোক আছে, খুব উল্টোপাল্টা বলে। নতুন লোক দেখলে এ ধরনের কথা বলে মজা পায়।

মোবাইলের আলো আস্তে-আস্তে ক্ষীণ হয়ে আসছে। বুঝতে পারছি বেশি চার্জ নেই। বাইরে কি ঝড় থেমে গেছে? আর কোন শব্দ পাচ্ছি না। শুধু টিপটিপ একটু বৃষ্টির আওয়াজ। গেটে মনে হলো ঠকঠক শব্দ হলো। কান খাড়া করলাম। না, আর কোন শব্দ নেই। শেয়াল বা কুকুর হতে পারে। আবার কোথাও কোলাহলের শব্দ পেলাম, চিৎকার, চেঁচামেচি। আবার নিশ্চুপ।

বিছানা থেকে উঠলাম। মোবাইলটা মনে হয় আর কিছুক্ষণ পরেই বন্ধ হয়ে যাবে।

টেবিলে গিয়ে বসলাম।

এক কোনায় পুরানো খবরের কাগজ। কিছুটা দোমড়ানো।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও খুললাম। যদি কিছুটা সময় কাটানো যায়।

দেখি প্রথম পৃষ্ঠায় পুড়ে যাওয়া এক গাড়ির ছবি। নিচে বড় হেডলাইন-মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় বালু ব্যবসায়ীর মৃত্যু।  

পড়তে লাগলাম খবরটা।

গতকাল আনুমানিক রাত একটার দিকে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার খানাকান্দা ইউনিয়নের তাতুয়াকান্দা গ্রামের বিশিষ্ট বালু ব্যবসায়ী শ্রী অরিন্দম দাসের পুত্র শ্রী অভিজিৎ দাস এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। উল্লেখ্য তিনি তার বোনকে নিয়ে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন। গাড়িটি তিনি নিজেই ড্রাইভ করছিলেন। গাড়ি যোগার দিয়া নামে এক গ্রামের পথ দিয়ে যাওয়ার সময় পেছন থেকে বালুবাহী একটি ট্রাক ধাক্কা মারে, গাড়িটি উল্টে গভীর খাদে পড়ে যায় ও গাড়িটিতে আগুন ধরে যায়। অভিজিতের লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হলেও তার বোনের লাশ পুড়ে গাড়ির সিটের সাথে লেগে থাকে। তার বোনের নাম নন্দিতা রানি দাস। পুলিশ বলছে

আর পড়তে পারলাম না। মোবাইলের আলো নিভে গেল।

কত রাত এখন? একটা নাকি দুটো?

কোথাও কোন শব্দ নেই।

শুধু বাইরে দুএক ফোঁটা বৃষ্টির শব্দ।

অসহায়ের মত অপেক্ষা করতে লাগলাম।

আমি জানি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই অভিজিৎ আসবে…

এবার একা নয়!

আমার কাছ থেকে যে কষ্ট পেয়েছিল নন্দিতা, তার শোধ কি তুলবে না?

মিজানুর রহমান কল্লোল

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *