শিকার – মনোজ সেন
আমি ঘরে ঢুকতেই বুঝতে পারলুম কিছু একটা হয়েছে। সবার মুখ থমথম করছে, বড়বাবুর তে বিশেষ করে। কি হল রে, বাবা! আমি কি কোন অপরাধ করলুম? এমন জরুরী তলব, আর এখানে এসে এই অবস্থা! দরজার পাশেই কার্তিক দাঁড়িয়েছিল। জিজ্ঞেস করলুম, ‘কি হয়েছে রে, কেতো?
কার্তিক বলল, বড়বাবু ডেকেছে। যা বলবার, উনিই বলবে।’ তারপর গলা চড়িয়ে বলল, ‘বড়বাবু, বিদ্যেসাগর এসেছে।’
এখানে আমাকে সবাই বিদ্যেসাগর বলে ডাকে, কারণ আমি অপরাধের মধ্যে এম. এ-টা পাশ করে বসে আছি। বাকী সবাই তো নাম সই করতে গেলে তিনটে কলম ভেঙে-টেঙে একাকার করে। অবশ্য, বড়বাবু ছাড়া। তাঁর কথা আলাদা। দেবতা বলে যদি কেউ থাকে তো এই বড়বাবু। এঁর সঠিক নাম কি, কোথায় থাকেন তা আমরা কেউ-ই জানি না। আমাদের জানবার কথাও নয়। তবে যেখানেই থাকুন, সেটা যে স্বর্গ তাতে সন্দেহ নেই। দেবতাদের তো অসংখ্য নাম থাকে, এঁরও আছে। এসব নিয়ে মাথা আমরা ঘামাইনে, ঘামালে মাথাটা খোয়া যাবার সম্ভাবনাই বেশি। তবে এটুকু জানি, এরকম মানুষ ভূভারতে আর নেই। আমাদের সবাইকে উনি কেবল জীবন দিয়েছেন বললে কম বলা হয়, বলা উচিত বাঁচার মত করে বাঁচতে শিখিয়েছেন।
এই তো আমি। বি, এ পাশ করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলুম। একটা কুলীর কাজ পেলে বর্তে যাই, তাও জুটছিল না। বিধবা মা আর ছোট বোনটাকে নিয়ে গড়পারের ভাড়া বাড়ি থেকে উৎখাত হয়ে ভাসতে ভাসতে শেষ পর্যন্ত রাসবিহারীর ফুটপাথে। চোখের সামনে তখন অনন্ত অন্ধকার। সংসারটা, ভাল বাংলায় যাকে বলে, ক্লেদাক্ত পঙ্কিলে ডুবে যাচ্ছে। তখন গিয়েছিলুম লেক গার্ডেন্স লেভেল ক্রসিং-এ রেল-এ মাথা দিতে। এই কার্তিক আর দেবেন আমায় তুলে এনেছিল। বড়বাবু আশ্রয় দিয়েছিলেন। সে আজ বছর ছয়েক আগেকার কথা। বোনের ভাল বিয়ে দিলুম। মা মারা গেলে ধুমধাম করে শ্রাদ্ধ করলুম। এখন ভাবছি, সল্ট লেকে জমি কিনে একটা বাড়ি করব। তাই বলছিলুম, বড়বাবু মানুষ নন, দেবতা। দেবতা।
কার্তিকের গলা শুনে বড়বাবু ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। বললেন, ‘কে রে, পূর্ণেন্দু? এদিকে আয়। খবর শুনেছিস?’
বড়বাবুর গলা শুনে বুঝলুম যে আমি কোন দোষ করিনি। বাব্বা, বাঁচলুম! যা ভয় পেয়েছিলুম। হাত কচলাতে কচলাতে বললুম, ‘আজ্ঞে না তো। কী খবর, বড়বাবু?’
বড়বাবু ঘরের একপাশে একটা গোলটেবিলের ওপাশে বসেছিলেন। বাকী সবাই দাঁড়িয়েছিল। ওঁর সামনে বসা! টেবিলের ওপর একগ্লাস নীট হুইস্কি আর একটা বোতল রাখা ছিল। বড়বাবু এক চুমুক খেয়ে বললেন, ‘হায়দার মরে গেছে।’
হায়দার! আমরা যাকে গোরিলা বলে ডাকতুম! সে কি? সে ছিল বড়বাবুর পার্সোনাল বডিগার্ড। আমি ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলুম, “কি হয়েছিল?’
‘বদন ঘোষ রোডের একটা বাড়ির ছাদ থেকে কেউ ওকে ঠেলে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল। ঘাড় মটকে মরে গেছে। আর ঠেলে ফেলাই বা বলি কি করে? ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। রাস্তার ঠিক মাঝখানে লাশ পড়ে ছিল।’
কি সর্বনাশ! ও ওখানে কি করছিল?’
‘পরে বলছি। আচ্ছা, তোমরা এবার যাও। আমি পূর্ণেন্দুর সঙ্গে কিছু কথা বলব।’
বড়বাবুর আদেশ শুনে সবাই নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। দাঁড়িয়ে রইলুম শুধু আমি। বড়বাবু এক হাত তুলে চোখের কালো চশমাটা ঠিক করে নিলেন। উনি চব্বিশ ঘণ্টা কালো চশমা পরে থাকেন। কেন, কে জানে! শুনেছি ওঁর একটা চোখ নাকি পাথরের। হতেও পারে। সে খবরে আমাদের কি দরকার? বড়বাবু সম্পর্কে বেশি কৌতূহল একদম ভাল জিনিস নয়।
বড়বাবু বললেন, ‘বদন ঘোষ রোড তুই চিনিস? ভবানীপুরে? সে যাকগে, না চিনলে চিনিয়ে দেওয়া যাবে’ খন। ওখানে রাজমোহন সিংহরায়দের বাড়ি আছে। পুরোন দিনের জমিদারবাড়ির মতন। বাড়ির ভেতর মন্দির-টন্দির আছে। রোজ পুজোআচ্চা হয়। হায়দারকে ওখানেই পাঠিয়েছিলুম। কী যে হল! সে যাকগে। এবার কাজের কথা বলি। মন দিয়ে শুনবি।
‘বদন ঘোষ রোডের বাড়িটাকে লোকে বলে রাজমোহনের রাজবাড়ি। রাজমোহনের বিহারে না কোথায় মস্ত জমিদারী ছিল। ভদ্রলোক প্রায় একশ বছর আগে এই বাড়িটা বানিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে, ওঁর ছেলেপুলেরা কলকাতাতেই থাকতেন, এখান থেকেই জমিদারী চালাতেন। প্রচুর পয়সা ছিল একসময় প্রচুর ফুর্তিফাতাও করে নিয়েছেন। সে যাকগে। ওসব কোন কাজের কথা নয়।
‘এখন এই বাড়ির মালিক একটা মেয়ে। তার নাম তিলোত্তমা রায়চৌধুরী। এ হচ্ছে এখন সিংহরায়দের শেষ বংশধর। ওর ভাই রত্নাকর সিংহরায় বছরখানেক হল মরে গেছে। সে বিয়ে-থা করেনি, ছেলেপুলে নেই। কাজেই এখন সব সম্পত্তির মালিকানা বর্তেছে এই তিলোত্তমার ওপর। ওর বাবা রমাকান্ত অনেকদিন আগেই গেছে।
‘মেয়েটি বিধবা। বিয়ে হয়েছিল বছর দশেক আগে কোন এক রায়চৌধুরীর সঙ্গে। একটা বাচ্চা হয়েছিল। সেটা বছর তিনেক বয়েসে মারা যায়। তার পরের বছর রায়চৌধুরীও মারা যায়। তখন মেয়েটি বাপের বাড়ি চলে আসে। এখানে এসে কেবল পুজোআচ্চা ধর্মকর্ম নিয়েই আছে। এটা, তা প্রায়, গত পাঁচ বছর ধরে চলছে।
‘সিংহরায়দের টাকাপয়সা এখন আর তেমন কিছু নেই। ফোঁপরা হয়ে গেছে। কিন্তু ঠাঁট এখনও বজায় আছে। আর এটা চালিয়ে যাচ্ছে ওদের ম্যানেজার দুগাশঙ্কর উপাধ্যায়। নামে হিন্দুস্থানী, বাঙালী হয়ে গেছে। বুড়ো হাড়বজ্জাত, ঘুঘু নাম্বার ওয়ান। ঘুষ খায় না, মেয়েছেলের লোভ নেই, মাল, খায় না—একেবারে থার্ড ক্লাস। আমি লোকটাকে বাজানোর জন্যে বছর দুয়েক আগে জীতেনকে পাঠিয়েছিলুম। তুই তো জীতেনকে জানিস, কথা বলায় এক্সপার্ট। ইচ্ছে করলে আইনস্টাইনকেও বুঝিয়ে আসতে পারে যে সূর্য পশ্চিম দিকে ওঠে। সেই জীতেন মুখ খুলতে না খুলতেই সেই হারামজাদা বুড়ো একেবারে পুলিশে ফোন করে দিয়ে বসে আছে! জীতেন কোনরকমে ওখান থেকে কেটে বেরিয়ে এসে বাঁচে।
‘এখন তোর মনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে সিংহরায়রা যদি ফোঁপরাই হয়ে গিয়ে থাকবে, তাহলে ওদিকে আমার নজর কেন? তার কারণ আছে। ওদের একটা জিনিস আছে যেটা বলা যায় অমূল্য। সেটা ওদের গৃহদেবতা একটা বিষ্ণুমূর্তি। এই মূর্তিটা থাকে বাড়ির ভেতরে, কখনো বাইরে আসে না। বাইরের মন্দিরের যে, বিষ্ণুমূর্তি সেটা এই মূর্তিটার হুবহু নকল। কিন্তু নকলই। বাইরেরটা পাথরের, আসলটা অষ্টধাতুর। বাইরের মূর্তিটার যেসব গয়নাগাঁটি আছে সেগুলো সব ঝুটো, আসলটার যে কি আর বলে দিতে হয় না। তার চেয়েও বড় হচ্ছে, মূর্তিটার বুকে একটা প্রকাণ্ড পদ্মরাগমণি ফিট করা আছে, সেটাকে বলে কৌস্তুভমণি। আমার নজর এই মূর্তিটার দিকে। আখতারুজুমান এই খবরটা দিয়েছিল বছর তিনেক আগে। সেই সময় রত্নাকর সিংহরায় নাকি গোপনে এক জার্মান সাহেবের সঙ্গে দর কষাকষি করছিল ওটা বেচে দেবার জন্যে। সেটা আখতার জানতে পারে। তখন সে আমার কাছে আসে। আজ রত্নাকর বা আখতার কেউই বেঁচে নেই। আমি ছাড়া এটার খবর আর বোধ হয় কেউ জানেও না। তবে আমার বিশ্বাস মূর্তিটা বের করে দিতে পারলে ঘরে বিশ লাখ টাকা উঠবে। মিনিমাম। চেপেচুপে ধরতে পারলে চল্লিশ পর্যন্ত উঠতে পারে।
‘আমি হায়দারকে পাঠিয়েছিলাম মালটা ওঠানোর জন্যে। ও বাড়ির একটা ঠিকে ঝি-কে তুলে এনে কড়কাতেই সে বলে দিলে যে মাল কোথায় আছে। দোতলার ওপর কতামশাই-এর ঘর, সেখানে দেওয়ালের মধ্যে গাঁথা সিন্দুকের মত মন্দির। বন্ধ করলে সিন্দুক, খুললে মন্দির। সেখানেই গৃহদেবতার অবস্থান। তুই তো জানিস, হায়দার ছিল কলকাতা কেন সারা দেশের পয়লা নম্বরের গব্বাবাজ, যাকে ইংরিজীতে বলে ক্যাট-বার্গলার। অত বড় শরীরটা নিয়ে যে কোন বাড়ির খাড়া দেওয়াল বেয়ে টিকটিকির মত উঠে যেতে পারত, দশতলার ওপরে কার্নিস বেয়ে হাঁটাচলা করত যেন ময়দানে হাওয়া খাচ্ছে। তার পক্ষে দোতলার ওপরে একটা ঘরে ঢুকে ঘুমের ওষুধ স্প্রে করে একটা সিন্দুক ভেঙে মাল বের করে আনা কোন ব্যাপারই ছিল না। অথচ কিসের থেকে কি হয়ে গেল। ও বাড়ির যে তিনটে দরোয়ান আছে তাদের সাধ্যি নেই হায়দারকে কাবু করে। তার মানে, অনেকগুলো লোক ওখানে হায়দারের জন্যে অপেক্ষা করে ছিল। ও ঢুকতেই সবাই মিলে ওকে কজা করে ছাদে নিয়ে গিয়ে নিচে ছুঁড়ে দেয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, লোকগুলো জানল কি করে যে সেইদিনই হায়দার যাবে?
আমি ভয়ে ভয়ে বললুম, ঠিকে ঝি-টা…
বড়বাবু হাত নেড়ে বললেন, না, না, সেটাকে তো মেরে লেকের জলে ফেলে দিয়েছিলুম। ওসব সাক্ষী রাখতে আছে কখনও? খবর অন্য কেউ দিয়েছে। সে যাকগে, সে ব্যাপারে তোর মাথা ঘামানোর দরকার নেই। এখন তোকে কি করতে হবে বলি, শোন। তানুক কাকে বলে জানিস?’
আমি মিনমিন করে বললুম, “আজ্ঞে, সুন্দরী তরুণী বিধবা।’
‘হ্যাঁ। তোকে সেই তানুক পটাতে হবে। এই কর্মে তুই এক্সপার্ট। যেখানে যতবার তোকে মেয়েছেলে জপাতে পাঠিয়েছি ততবার তুই সাকসেসফুল। তোর ওই ফিল্মস্টার মার্কা চেহারা আর সাহিত্য-টাহিত্য নিয়ে কবি-কবি কথাবার্তা যে এমন কাজে লাগবে, কে ভেবেছিল। সে যাকগে। এখন ওই তিলোত্তমাকে গাঁথা দরকার। কারণ, তামশাই-এর ঘরে এখন তিলোত্তমা শোয়, একা। আর ওই সিন্দুকের চাবি থাকে তিলোত্তমার আঁচলে। ওই ঘরে নানা জায়গায়, খাটের পাশে, টেবিলের নিচে, আলমারির কোণায়, সুইচবোর্ডের পেছনে অ্যালার্ম বেলের সুইচ রাখা আছে। এক সেকেন্ড সময় পেলেও ওই সুইচ টিপে দেওয়া সম্ভব। কাজেই তিলোত্তমাকে একেবারে পেড়ে ফেলতে না পারলে চাবিটা হস্তগত করা কঠিন হবে। তাছাড়া, আর একবার একটা গব্ববাজ পাঠাব, তারও উপায় নেই। ওই শালা উপাধ্যায় সব কটা জানলার বাইরে বিচ্ছিরি গ্রীল লাগিয়েছে আর এমন ভাবে আলো লাগিয়েছে যে ওই ঘরের জানলা দুটোর ওপর গ্রীল ভাঙার কলম নিয়ে বসলে তাকে সবাই দেখতে পাবে। আসল কথা, চাবিটি পেতে হলে ঘরের ভেতর ঢুকতে হবে এবং তিলোত্তমাকে অসহায় করে ফেলতে হবে। এখন এটাই হল তোর টাস্ক। এবার বল, কোন প্রশ্ন আছে?
আমি বললুম, তিলোত্তমার বয়েস কত?
‘সাতাশ আটাশ।
‘কত বছর বয়েসে বিয়ে হয়েছিল?
‘আঠার বছরে। স্বামী মারা যায় বাইশ বছরে।’
‘স্বামী কিরকম লোক ছিল?’
‘শুনেছি এক নম্বরের দুশ্চরিত্র লোক ছিল। নেশাভাঙ, মেয়েমানুষ—সব দোষই ছিল।’
‘মূর্তিটা কত বড়?
‘খুব বড় কিছু নয়। ফুটখানেক উঁচু হবে। একাই নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারবি।’
‘কতদিন সময় দেবেন?’
‘তা নে না তুই যত সময় দরকার। আমার কোন তাড়া নেই।’
আমি চুপ করে আছি দেখে বড়বাবু বললেন, ব্যস? আর কোন প্রশ্ন নেই?’
আমি মাথা নাড়লুম। বললুম, ‘না।’
‘তুই একটা কথা খেয়াল করেছিস? এই মেয়েটা কিন্তু ভীষণ ভক্তিমতী, ধর্মপরায়ণ আর শুচিবায়ুগ্রস্ত।’
‘তাতে কিছু যায় আসে না। ওসব বাইরের স্নায়বিক বিকার, ভেতরে সব সমান। এতদিনে এটুকু জ্ঞান আমার হয়েছে যে দুনিয়ায় এমন মেয়ে নেই যে প্রলোভন প্রতিরোধ করতে পারে। কেউ হয়তো বেশি দিন আটকে রাখতে পারে, কেউ কম দিন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লোভের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিতে হবেই।’
বড়বাবু দুটো সোনা-বাঁধান দাঁত বের করে একটা নিঃশব্দ হাসি হাসতে হাসতে বললেন, ‘পাজি ছেলে! যা, তৈরি হতে শুরু কর।’
তৈরি হতে মাস চারেক সময় লাগল। প্রথমে প্ল্যানটা ঠিক করা হল। তিলোত্তমা দুঃখী মানুষ, কতটুকুই বা সুখের মুখ দেখেছে। অতএব, আর একজন দুঃখী লোকের প্রতি তার সহানুভূতি চট করে জাগবে, এটাই স্বাভাবিক। এবার সেই সহানুভূতির রূস্তা ধরে তার কাছে এগোতে হবে। আস্তে আস্তে, দুঃখী দুঃখী ভাবে, ভবিষ্যতের সুখের একটা আবছা ছবি আঁকতে আঁকতে। ধীরে ধীরে সেই অলীক ছবিটাকে একটা সত্যিকারের রূপ দিতে হবে।
অতএব, প্রথমেই চুল আর দাড়ি কাটা বন্ধ করে দেওয়া গেল। যখন সেগুলো বেশ বড় হয়ে উঠল, তখন রোজ শ্যাম্পু করে করে যতদূর সম্ভব রুক্ষ রুক্ষ করে তোলা হল। মাসদুয়েক খাওয়াদাওয়া প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হল। কাজ শুরু করার দুদিন আগে থেকে কুমোরবাড়ির মাটি ঘসে ঘসে চুল দাড়ি এলোমেলো উস্কোখুস্কো করে ফেলা হল। তারপর ছেঁড়া প্যান্টি আর শার্ট জোগাড় হল।
আমার চেহারা দেখে তো মল্লিকা হেসে অস্থির। বললে, ‘বাপরে বাপ, পারও তুমি। এমন পোশাকে আর এই চেহারা নিয়ে কোথায় যে যাচ্ছ, তুমিই জান। সে সব তো আবার জিজ্ঞেস করা বারণ। তবে, এতদিন ধরে যখন ঘসামাজা চলেছে, তখন এবার বেশ বড়সড় কিছু হবে বলে মনে হচ্ছে। কি গো, তাই না?’
আমি বললুম, ‘বলেছি তো, এসব কথা জিজ্ঞেস করা বারণ। তবে, এবার দাঁওটা যদি লাগে, তবে তোমার কপাল খুলে যাবে। এই বলে দিলুম।‘
‘বটে? কি হবে আমার?’
দিগঙ্গনা অ্যাপার্টমেন্টের তিনতলার ফ্ল্যাটটা তোমায় দিয়ে দেব। আমি চলে যাব সল্ট লেকে।’
ওঃ, এই?
‘কেন, পছন্দ হল না? বারশো স্কোয়ার ফুট, দুটো বেডরুম।’
‘দুটো বেডরুম! তবে আর কি। কী হবে আমার দুটো বেডরুম দিয়ে? আচ্ছা, তুমি আমায় বিয়ে করতে পার না?’
‘বিয়ে? তোমাকে? আমি? আমি সশব্দে হেসে ফেললুম। পাগল হয়েছ? ফিল্মে নামিয়ে দিয়েছি। ভাল খাচ্ছো-দাচ্ছো। ব্যস! ঐ পর্যন্ত। তার বেশি আর হাত বাড়িও না।’
মল্লিকা ধপ করে খাটের ওপর বসে পড়ল। বলল, ‘আমি জানতুম! আসলে, তুমি একটা অমানুষ! তোমার বাইরেটা যেমন সুন্দর, ভেতরটা তেমনি কুচ্ছিৎ।’
আমি হাসতে হাসতে বললুম, ‘তাহলে বিয়ে করতে চাওয়া কেন? বিয়ে করলে তো ভেতর বাহির সব সমান। তখন সেটা সইতে পারবে? তার চেয়ে এখন বাইরেটা নিয়ে আছ, সেটা নিয়েই থাক। কুচ্ছিৎ যেটা, সেটা ভেতরেই থাক।’
বড়বাবুর সঙ্গে গাড়ি করে গিয়ে রাজমোহনের রাজবাড়ি দেখে এলুম। রাজবাড়ি কিছু নয়। তবে, বেশ বড় বাড়ি। চারদিকে আট ফুট উচু পাঁচিল। পাঁচিলের মাঝখানে বশীর মত দেখতে লোহার শিক লাগানো চওড়া গেট। গেটের পর মাৰ্বল পাথর বসানো উঠোন, তার একপাশে মন্দির, অন্যপাশে বোধ হয় অফিস ঘর। গেটের দুপাশে দরোয়ানের বসবার সিমেন্টের চেয়ার, ওপরে সিমেন্টের লাল সবুজ রঙ করা ছাতা। উঠোনের পেছনে টানা লম্বা দোতলা বাড়ি। সামনে কারুকার্য করা লোহার রেলিঙ বসানো বারান্দা, ওপরে সবুজ রঙ করা কাঠের ঝিলমিল। পেছনে সার সার দরজা। কটা ঘর বলা শক্ত। একতলায় বাড়ির মাঝখানে বারান্দায় ওঠার শ্বেতপাথরের সিঁড়ি। দোতলায় ওঠার সিঁড়িটা রাস্তা থেকে দেখা যায় না।’
বড়বাবু বললেন, ‘গেটের ঠিক সামনে দোতলায় যে ঘরটা দেখছিস, ওটাই কতমিশাই-এর ঘর। তিলোত্তমা ওখানেই শোয়। আর একতলার একদম ডানদিকে ঘরটা হারামজাদা উপাধ্যায়ের।
আমি জিজ্ঞেস করলুম, হায়দারের লাশ কোথায় পড়ে ছিল?
‘এই যে, যেখানে আমরা গাড়ি রেখেছি, ঠিক সেইখানে।’
ওই বাড়ির ছাদ থেকে হায়দারকে এত দূরে ছুঁড়ে ফেলেছিল? এ তো দশ বারজন তাগড়া লোকের কাজ।’
‘হ্যাঁ, তাই বটে। খবরটা যে কে ওগরালো! সে যাকগে, লোক লাগিয়েছি, দু-একদিনের মধ্যেই বের করব। তুই তোর কাজ শুরু করে দে, এ নিয়ে ভাবিসনি। যত তাড়াতাড়ি পারিস, তিলোত্তমাকে ওড়ানোর চেষ্টা কর।’ বলে বড়বাবু দুটো সোনা বাঁধানো দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসতে লাগলেন।
সারারাত ফুটপাথে শুয়ে রইলুম। ভোরবেলা একটা রোগাপটকা দরোয়ান গেট খুলে দিল। তখন দেখি দু-চারজন বুড়োবুড়ী ফুল-টুল হাতে ভেতরে যাচ্ছে। আমিও তাদের সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে ঢুকলুম মাথা নিচু করে। মন্দিরটা দেখলুম খুব বড় নয় আর নেহাত ছোটও নয়। মূল বিগ্রহের ঘরের সামনে একটা বড়সড় চৌকো বারান্দা আছে শ্বেতপাথরে মোড়া। তার চারকোণে চারটে কারুকার্য করা থামের ওপর একটা ছাদও আছে। আমি সিড়ি বেয়ে সেই বারান্দায় উঠে একটা থামে ঠেসান দিয়ে মাটিতে বসে উদাস দৃষ্টিতে বিগ্রহের দিকে চেয়ে রইলাম। আর কোনদিকে তাকালুম না। কে এল, কে গেল সেদিকে কোন খেয়ালই নেই। পুরুতমশাই পুজো করলেন, কি সব জলটল ছেটালেন, ভক্তেরা প্রসাদ নিল। আমি কিন্তু বসেই রইলুম। সন্ধেবেলা দরোয়ান এসে আমাকে বাইরে চলে যেতে বলল। আমি বেরিয়ে গেলুম। প্রথম দিন কেউ আমাকে লক্ষ্যই করল না।
দ্বিতীয় দিন লক্ষ্য করলেন পুরুতমশাই। টের পেলুম, পুজো করছেন, ঘুরছেন ফিরছেন আর বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছেন। আমার কিন্তু কোনদিকে খেয়াল নেই। দৃষ্টি বিগ্রহের দিকে।
তৃতীয় দিন বিকেলবেলা পুরুতমশাই আমার সামনে এসে বসলেন। নানা প্রশ্ন, আমি কে, কোথায় থাকি, এখানে বসে আছি কেন, ইত্যাদি। আমি কোনটারই জবাব দিলুম না। শেষে খুব করুণ সুরে শুধু বললুম, ‘আমি এখানে বসে থাকলে যদি আপনার কোন অসুবিধে না হয়, তাহলে বসে থাকতে দিন। আমার কথা শুনে পুরুতমশাই অত্যন্ত লজ্জিত হলেন।
চতুর্থ দিন দুপুরবেলা একটি দরোয়ান এসে আমার সামনে দাঁড়াল। বলল, আমার সঙ্গে আসুন, ম্যানেজারবাবু ডাকছেন।’ আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে কম্পিতপদে উঠোন পার হয়ে অফিসঘরে গেলুম।
দুগাশঙ্কর উপাধ্যায়কে দেখে মনে হল ম্যানেজার না হয়ে সংস্কৃতের পণ্ডিত হলে মানাত ভাল। ফস টকটকে রঙ, পাকা ভুরু, পাকা গোঁফ, মাথায় সামান্য কটি পাকা চুলে ঘেরা প্রকাণ্ড টাক। পরনে সাদা পাঞ্জাবি আর ধুতি। অফিসঘরের একপাশে একটি অতি প্রাচীন টেবিলের উল্টোদিকে এক অতি প্রাচীন চেয়ারে পিঠ সোজা করে বসেছিলেন। প্রশ্ন করলেন, তুমি বাঙালী?
আমি নিঃশব্দে ওপরে নিচে মাথা নাড়লুম।
‘তুমি রোজ এখানে এসে বসে থাক কেন? কে তুমি? কি চাও?
আমি ক্ষীণকণ্ঠে বললুম, আমার নাম পূর্ণেন্দু ভট্টাচার্য। আমি’ এই পর্যন্ত বলে মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে মেঝের ওপর পড়ে গেলুম।
আমি কম্পিত কণ্ঠে বললুম, আমি এই সব খাবার খাব? অফিসঘরের একটা চেয়ারে আমি তখন বসে, চুলদাড়ি তখনও ভিজে, আমার সামনে টেবিলের ওপর ভাত আর পঞ্চব্যঞ্জন। আমার সামনে দাঁড়িয়ে উপাধ্যায় আর কয়েকজন কর্মচারী।
উপাধ্যায় বললেন, ‘হ্যাঁ। সব খাবে। ডাক্তারবাবু বললেন, তিন-চারদিন নাকি তোমার খাওয়া হয়নি।’
আমি নিঃশব্দে কিছুক্ষণ কাঁদলুম, তারপর মাছ তরকারি সরিয়ে রেখে শুধু নুন দিয়ে খানিকটা ভাত খেয়ে উঠে পড়লুম। উপাধ্যায়ের দিকে তাকিয়ে বললুম, ধন্যবাদ। তবে, ভবিষ্যতে দয়া করে এটা করবেন না। আমি এখানে খেতে আসি না, আসি শান্তির খোঁজে। যদি মনে করেন, আমার মত হতভাগার এখানে এলে কোন অসুবিধে আছে, দরোয়ানকে বলে আমাকে বারণ করে দেবেন।’ বলে ক্লান্ত পায়ে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলুম।
উপাধ্যায় খুব একটা বিচলিত হয়েছেন বলে মনে হল না। কঠিন কণ্ঠে বললেন, এখানেই শান্তি পাবে এরকম কথা তোমার মনে হল কেন?”
আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে বললুম, শান্তি পাব কি পাব না, তা তো জানি না। তবে খুঁজতে দোষ কি? বহু জায়গায়ই তো খুঁজলুম, পাইনি তো। তবে হ্যা, আপনাদের পুরুতমশাইয়ের সংস্কৃত উচ্চারণ বড় খারাপ, খুব কানে লাগে।’ বলে আবার ফিরে গিয়ে মন্দিরের বারান্দায় বসলুম।
ডাক এল সেদিন বিকেলবেলা। একটি কাজের মেয়ে এসে বলল, “দিদিমণি তোমাকে ডাকতেছেন।’ বুঝলুম, সময় হয়েছে নিকট এবার।
আমাকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হল, সেটা মূল বাড়িটার একতলায় একটা অফিসঘর। মান্ধাতার আমলের মোটা মোটা ফার্নিচার দিয়ে সাজান। এটাই ছিল কামশাইদের পাসোনাল অফিস। ঘরটার একপাশে একটা অতিকায় সেক্রেটারিয়েট টেবিল। তারই সামনে দাঁড়িয়েছিল তিলোত্তমা। আমার শিকার। পাশে উপাধ্যায়, আষাঢ়ের মত গম্ভীর মুখে।
শিকারটিকে দেখে বড়ই খুশি হওয়া গেল। হাঁ, শিকার হয় তো এমনি। সুন্দরী তো বটেই, কিন্তু কী ব্যক্তিত্ব। কেবল শুভ্রবসনে বা গায়ের রঙে নয়, তপঃক্লিষ্ট মুখ, ঘনকৃষ্ণ চোখ বা রক্তিম অধরোষ্ঠ ঘিরে জ্বলজ্বল করছে একটা শান্ত, দৃঢ় এবং দুর্ভেদ্য জ্যোতি। দীর্ঘ শরীরে সামান্য মেদের ছোঁয়া লেগেছে কিন্তু তাতে ক্ষতি হয়নি। এমন শিকার না হলে খেলায় আনন্দ কোথায়? বড়বাবুর অত হাসির কারণটা বুঝলুম। তাঁর প্রিয় শিষ্য আমি ওই প্রস্তর-কঠিন সৌন্দর্যটা ছিড়ে টুকরো টুকরো করছি, সে দৃশ্য কল্পনা করেই ওঁর অত পুলক হয়েছিল।
তিলোত্তমা অনুচ্চ গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল, “খাবার দেওয়া হয়েছিল, খাওনি কেন?
আমি মাথা নিচু করে যথাসাধ্য ক্ষীণ কণ্ঠে বললুম, ‘এসব খাবার আমার পক্ষে খাওয়া সম্ভব নয়।’
তিলোত্তমা একটু ইতস্তত করে বলল, তোমার নাম শুনলুম পূর্ণেন্দু ভট্টাচার্য, ব্রাহ্মণ। দেখে তো ভদ্রসন্তান বলে মনে হচ্ছে। পুরুতমশাইয়ের উচ্চারণে ভুল ধরেছ, তার মানে লেখাপড়াও কিছু জাননা। কতদূর পড়াশুনো করেছ?
আমি পূর্ববৎ বললুম, এম. এ পাশ করেছি। ইকনমিকসে আর সংস্কৃতে।’
আমার কথা শুনে তিলোত্তমা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। বুঝলুম শকটা লেগেছে। তারপর বলল, “তুমি, মানে, আপনি ইকনমিকসে এম. এ পাশ করে এমন পাগলের মত চেহারা করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেন? তার ওপর তিনদিন খাননি। এখানেই বা এসে পড়ে থাকছেন কেন?
আমি একটা খুব ম্লান হাসি হাসলুম। বললুম, আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তর, আমার পাগল হয়ে যেতে আর বেশি বাকী নেই। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর, আমি সাত দিন খাইনি। আর তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, আমার মত অভাগা বিশ্বস্রষ্টার মন্দিরে আসে একটু শান্তির জন্যে। অথচ, যেখানেই যাই সেখানেই বড় গোলমাল, বড় ঠেলাঠেলি, বড় নোংরামি। এই একটা মন্দির যেখানে চেঁচামেচি নেই, দর কষাকষি নেই। তপোবনের মত এ জায়গাটা গম্ভীর, সংযত আর উদার। তাই এখানে আসি।’
চট করে চোখ তুলে দেখে নিলুম তিলোত্তমার মুখের রেখাগুলো নরম হয়ে এসেছে। হতেই হবে। আবার একটু চুপ করে থেকে বলল, “কি হয়েছে আপনার?
আমি আবার সেই পাণ্ডুর হাসিটি দিলুম। বললুম, ‘আপনি সেসব শুনে কি করবেন? সারাজীবন সুখে আর প্রাচুর্যের মধ্যে কাটিয়েছেন। আর আমার কপালে রুক্ষকেশী অলক্ষ্মী অচঞ্চলা হয়ে বসেছেন। এখন শুধু দিন গুনছি কবে তিনি মরণফাঁসিটি টানবেন। সেদিন বাঁচব।’
মুক্তোর মত দাঁত বের করে হাসল তিলোত্তমা। বলল, ‘আপনি ভাবছেন আপনার চেয়ে দুঃখী এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই, তাই না? আপনার এই ধারণা কিন্তু ভুল। আপনি বলুন আপনার কথা, আমি শুনব।’
তারপর অনেক অনুরোধ-উপরোধ ইত্যাদির পর আমার জীবনকাহিনীটি বললুম। আহা, কী কাহিনী। হিন্দি সিনেমাওলারা পেলে লুফে নিত। গল্পটা এরকম। আমার বাবা ছিলেন গরীব স্কুলটিচার, সংস্কৃতের সেকেন্ড পণ্ডিত। আমরা থাকতুম গড়পারে, একটা ভাঙা বাড়ির একতলায় দুটো ঘর নিয়ে। আঠার বছর বয়েসে যখন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করলুম তখন বাবা মারা গেলেন। বাড়িওলা শ্রাদ্ধের পরদিন আমাদের ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। এ পর্যন্ত সত্যি ঘটনা। তারপর আমি মা আর ছোটবোনকে নিয়ে গিয়ে উঠলুম মধ্য কলকাতার এক বস্তিতে। সারাদিন কখনও কুলিগিরি করে, কখনও ছোট ছোট মাল বিক্রি করে অতি কষ্টে সংসার চালাতে চালাতেও রাস্তার আলোয় পড়াশুনো করে বি, এ পাশ করলুম। তখন একটা চাকরি পেলুম একটা ওষুধের কারখানায়, কেরানীর কাজ, অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে। পাঁচশো টাকা মাইনে—এত টাকা জীবনে কখনো দেখিনি। উত্তরপাড়ায় একটা দু কামরার ঘর ভাড়া করে সেখানে সবাই মিলে উঠে গেলুম। মা জোর করে ধরে বিয়ে দিয়ে দিলেন। বৌ অত্যন্ত গরীরঘরের মেয়ে, বিধবার গলার কাঁটা, দেখতেও আহামরি কিছু নয়। তারপর কয়েকটা মাস কাটল স্বপ্নের মত, সুখ আর আনন্দ যেন উপচে পড়তে লাগল। আমার ভাগ্য-অলক্ষ্মী আড়ালে হাসলেন। আঘাতটা এল হঠাৎ। আমাদের কারখানায় একদিন সন্ধেবেলায় ডাকাত পড়ল, আমাদের অ্যাকাউন্ট্যান্ট খুন হলেন, তিন লাখ টাকা লুঠ হল। পুলিশ এসে আমাকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেল। আমার অপরাধ আমি তখন পাশের ঘরে ওভারটাইম করছিলুম। মামলা শুরু হল, পুলিশ প্রমাণ করল যে আমি ডাকাতদলের গুপ্তচর। আমার আট বছর জেল হয়ে গেল। আমি জেল থেকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে সংস্কৃত আর ইকনমিকসে এম, এ পাশ করলুম। ভাল ব্যবহারের জন্যে আমার দু বছরের সাজা মকুব হল। ছাড়া পেলুম দিন দশেক আগে। উত্তরপাড়ায় গিয়ে শুনলুম, আমার মা না খেতে পেয়ে রক্তবমি করে মরে গেছে, আঠার বছরের বোনটা গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। আমার একটা ছেলে হয়েছিল, সে পাঁচ বছর বয়েসে রাস্তায় খেলতে গিয়ে লরির তলায় চাপা পড়ে। তখন আমার স্ত্রী বদ্ধ উন্মাদ অবস্থায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। দুদিন বাদে গঙ্গায় তার মৃতদেহ ভাসতে দেখা যায়। ফলে, আজ আমি এই পৃথিবীতে সম্পূর্ণ একা, অসহ্য যন্ত্রণার স্মৃতি বুকে নিয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করছি। আমার জীবন শেষ হয়ে গিয়েছে।
এহেন গল্প শুনলে চোখে জল আসবে না, পৃথিবীতে এরকম মেয়ে বোধ হয় কেউ নেই। তিলোত্তমারও তাই হল। কেবল উপাধ্যায়ের ভাবলেশহীন মুখ দেখে মনে হল না যে তাঁর কিছুমাত্র মানসিক বিকার ঘটেছে।
সজল কণ্ঠে তিলোত্তমা বলল, আপনার ধারণা জীবন শেষ হয়ে গেছে, তাই না? না, জীবন শেষ হয় না। প্রত্যেকদিন সকালে আমাদের নতুন জীবনের শুরু হয়। আপনারও হয়। এবং হবে। জ্যাঠামশাই, মন্দির ট্রাস্টের একটা পোেস্ট তো খালি আছে, পূর্ণেন্দুবাবুকে ওই কাজটা দিন না। উনি চাকরিও করবেন, মন্দিরের দেখাশুনোও করবেন।’
উপাধ্যায় কঠিন গলায় বললেন, ‘অজ্ঞাতকুলশীলস্য বাসদেয়ং ন কস্যচিৎ। অজ্ঞাতকুলশীল ব্যক্তিকে কখনো আশ্রয় দেবে না। তার ওপর…’।
আমি কথাটা শেষ করে দিলুম, জেল খাটা আসামী। আশ্রয় তো দূরস্থান, তার মুখদর্শনও পাপ। দিদিমণি, আপনার চাকরি আপনারই থাক। আর, ওর যদি আপত্তি থাকে তাহলে কাল থেকে আমাকে আর দেখতেও পাবেন না। কেবল আপনার কাছে দুটো সহানুভূতির কথা শুনে গেলুম, এ স্মৃতিটি মৃত্যু পর্যন্ত মনে থাকবে। এবার তাহলে অনুমতি দিন।’
না, দাঁড়ান।’ বলল তিলোত্তমা, যাবেন না। জ্যাঠামশাই, ওর যদি কোন অসদুদ্দেশ্য থাকত তাহলে জেল খাটার অংশটুকু তো না বললেই পারতেন, তাই না? আর, অজ্ঞাতকুলশীল হবেন কেন? ওঁর গড়পারের বাড়ির ঠিকানা আর অফিসের ঠিকানায় খোঁজ নিয়ে দেখুন যে উনি যা যা বলেছেন তার মধ্যে কোন ফাঁকি আছে কি না।’
যাক, বাঁচা গেল। গড়পারের ঠিকানায় তো কোন অসুবিধেই নেই। আর আশা করি জয়গোপাল মেডিসিন ম্যানুফ্যাকচারিং ওয়ার্কস-এর প্রকাশ মহাজন আর অতুল সারদানা সব কিছু ঠিক ঠিক বলবে। আসলে ফ্যাক্টরিটা বড়বাবুরই, হেরোইন আর কোকেনের বড়ি তৈরি করার গোপন জায়গা।
আমার বাসস্থান ঠিক হল উপাধ্যায়ের পাশের ঘরে। আমি স্নান করে দাড়ি কামিয়ে একটা হাতকাটা গেঞ্জি আর পাজামা পরে খাটে শুয়েছিলুম খাওয়াদাওয়ার পর। তিন দিন উপবাসের পর ভোজনটি মন্দ হল না। হঠাৎ দুজনের পায়ের আওয়াজ শুনলুম। তাড়াতাড়ি একটা সঞ্চয়িতা খুলে মুখের সামনে ধরলুম। গভীর মনোযোগ। দরজা খোলাই ছিল। পর্দা সরিয়ে প্রথমে ঘরে ঢুকলেন উপাধ্যায়, তাঁর পেছনে তিলোত্তমা। আমি যেন হঠাৎ টের পেলুম, এইরকম ভাব করে বইটা তক্তপোশের ওপর ফেলে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালুম।
তিলোত্তমা একনজরে বইটা দেখল, তারপর আমার দিকে তাকাল। এক মুহূর্তের জন্যে হলেও ওর চোখদুটো বিস্ফারিত হয়ে উঠল। সে চোখে বিস্ময় এবং আরও একটা কিছু। বিকেলবেলার নোংরা, ছেড়া জামাকাপড় পরা, উস্কোখুস্কো চুলদাড়িওলা, পাগলের মত চেহারার লোকটার ভেতর থেকে যে এরকম একটা কিছু বেরিয়ে আসতে পারে, সেটা যে সে ভাবতেই পারেনি, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আমাদের দুজনের চোখ সেই এক মুহূর্তের জন্যে আটকে গেল। তারপরেই চোখ নামিয়ে তিলোত্তমা জিজ্ঞেস করল, আপনার কোন অসুবিধে হচ্ছে না তো? আমি যেন ওর গলায় একটা অতি ক্ষীণ কম্পন শুনতে পেলুম।
আমি প্রবল বিনয়ের সঙ্গে বললুম, না দিদিমণি। কিচ্ছু না। উপাধ্যায়মশাই ভাঁড়ার থেকে জামাকাপড় দিয়েছেন, খাওয়াও খুব ভাল হয়েছে। আমি কাল থেকে কাজ শুরু করব।’
‘ভাল।’ বলে হঠাৎ ঘুরে তিলোত্তমা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পেছনে পেছনে আষাঢ়ের মত মুখ করে গেলেন উপাধ্যায়।
পায়ের শব্দ শুনে বুঝলুম দুজনে গিয়ে ঢুকলেন পাশের ঘরে। দেওয়ালে কান লাগিয়ে শুনলুম তিলোত্তমা বলছে, ‘আপনি মিছিমিছি ভয় পাচ্ছেন, জ্যাঠামশাই। আমি তো লোকটির কোন বদ মতলব দেখতে পাচ্ছি না। যা হোক, আপনি খোঁজখবর তো নিন। আর তাছাড়া, ভুলে যাচ্ছেন কেন যে, আমার কোন বিপদ হতে পারে না।’
উপাধ্যায় বললেন, তোমার এই অদ্ভুত ধারণাটা আমি ভুলে যাবারই চেষ্টা করি, মা।’
তিলোত্তমা হেসে উঠল। সেই হাসির শব্দ বুকে নিয়ে আমি খুশি-খুশি মনে ঘুমোতে গেলুম। কেবল একটা কথা খচখচ করতে লাগল। তিলোত্তমার কোন ক্ষতি হতে পারে না কেন? এ কথার অর্থ কি?
এরপর দুদিন আমি শুধু অফিস আর ঘর, ঘর আর অফিস করলুম। দ্বিতীয় দিনে দেখি উপাধ্যায়ের মুখের মেঘ খানিকটা কেটেছে। সেদিন রাত্রে আবার পাশের ঘরে কথোপকথন শুনলুম। উপাধ্যায় বলছিলেন, ‘ছেলেটি সত্যি কথাই বলেছে, মা। তবু বলব, আমাদের সাবধানে থাকা দরকার। জেলে কতরকম লোকের সংস্পর্শে এসেছে তার তো ঠিক নেই।’
তিলোত্তমা আবার হেসে উঠল। বলল, ‘সীতার অগ্নিপরীক্ষার মত কোন ব্যাপার করবেন না কি? কী জানেন জ্যাঠামশাই, যারা আমাদের সহানুভূতি আর সমবেদনা পেলে সুস্থ সুন্দর মানুষ হয়ে উঠতে পারত, তাদেরই আমরা ঘৃণা করে দূরে সরিয়ে দি। তারা বেঁচে মরে থাকে।’
কিন্তু শুধু সহানুভূতি আর সমবেদনায় তো আমার কাজ চলবে না। ডাইরেক্ট অ্যাকশন চাই। এই দুদিনে সেই প্ল্যানটা ঠিক করে নেওয়া গেল। তিলোত্তমার প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার একটা সময়সূচি করে ফেললুম। দেখলুম সে খুব ভোরে ওঠে। সূর্য ওঠার একটু পরে সে স্নান করে নিচে নেমে আসে। আমাদের ঘরের পেছনে একটা বেশ বড় ফুলের বাগান আছে, সেখানে কিছুক্ষণ বেড়ায়, ফুল তোলে। পুরুতমশাই এলে যায় মন্দিরে। গেট খোলার আগে পুজো করে ফিরে আসে। তারপর ওপরে চলে যায়। কাগজপত্র সই করানোর জন্যে উপাধ্যায় ওপরে যায়। আর কারুর ওপরে যাবার অধিকার নেই। শুনলুম, সারাদিন তিলোত্তমা নাকি হয় পুজোআচ্চা করে নয়তো লাইব্রেরী ঘরে বসে পড়াশুনো করে। উপাধ্যায়ের আদেশে রাত নটার মধ্যে আমাদের শুয়ে পড়তে হয় কিন্তু দেখেছি অনেক রাতেও তিলোত্তমার ঘরে আলো জ্বলে।
সকাল থেকেই শুরু করা গেল প্ল্যানের প্রথম পর্ব। তিন-চার দিন বাদে একদিন ভোরবেলা সিন্ধু ভৈরবীতে বাঁধা একটা মীরার ভজন গাইতে শুরু করলুম। জানলারপদার্টা সামান্য ফাঁক করে রাখলুম তিলোমার ওপর গানের এফেক্টটা কি হয় দেখবার জন্যে। আমার গলা ভাল, বড়বাবুর কৃপায় ওস্তাদ বাদল মিঞাঁর কাছে রীতিমত তালিম নিয়েছি। দেখলুম, গান শুরু হতেই তিলোত্তমা একবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে নিল গানটা কোথেকে আসছে। তারপর যেন ওর বেড়ানোয় একটা ছন্দোপতন ঘটল। একটু ইতস্তত ঘুরল, দু-একটা ফুলগাছের সামনে দাঁড়াল, তারপর একটা বকুলগাছের নিচে একটা বেদীর ওপর মাথা নিচু করে বসে পড়ল। স্থির অকম্পিত দেহে আমার গান শুনতে লাগল। আর দেখলুম, ওর এমনিতে ফ্যাকাশে মুখে যেন রঙের ছোঁয়া লেগেছে। কান দুটো লাল হয়ে উঠেছে। একটু বাদে একটি কাজের মেয়ে এসে কি যেন বলল। বোধ হয় বলল যে পুরুতমশাই অপেক্ষা করছেন। তখন সে তাড়াতাড়ি উঠে ফুলের সাজিতে যেমন তেমন কতগুলো ফুল তুলে তাড়াতাড়ি বাগান ছেড়ে চলে গেল। আমি অবশ্য গানটা চালিয়েই গেলুম তারপরেও বেশ কিছুক্ষণ ধরে।
বুঝলুম, ওযুধ ধরতে শুরু করেছে। এরপর চার-পাঁচ দিন এই গানই চলল। কখনো আহীর ভৈরোঁ, কখনও ললিত, কখনও বা বিভাস। রোজই সেই এক দৃশ্য। বকুলগাছের নিচে শ্বেতপাথরের মূর্তির মত তিলোত্তমা। ভাগ্যিস রোজ এই সময়ে উপাধ্যায় গঙ্গাস্নানে যান। তিনি থাকলে যে কী হত কে জানে!
এরপর প্ল্যানের দ্বিতীয় পর্ব। দূরত্বটা সরিয়ে দিয়ে কাছাকাছি আসার প্রচেষ্টা। মালীদের সঙ্গে কথা বলাই ছিল। একদিন কাকভোরে উপাধ্যায় গঙ্গাস্নানে বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি একটা খাকি শর্টস পরে খালি গায়ে একটা কোদাল কাঁধে বাগানে বেরিয়ে গেলুম আর মাটি কোপান শুরু করলুম। যখন সূর্য উঠল, ততক্ষণে আমার সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজে চকচক করছে, সবকটা মা অবলীলায় খেলে বেড়াচ্ছে। তিলোত্তমার আসার পথের দিকে পেছন করে আমি একমনে মাটি কোপাতে লাগলুম। একটু বাদে শুকনো পাতার ওপর লঘু পায়ের শব্দ আর দামী সাবানের মৃদু সুবাসে বুঝতে পারলাম যে সে এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে। কয়েকটি রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত। তারপরেই আমি যেন হঠাৎ টের পেয়ে ঘুরে দাঁড়ালুম। দেখলুম, ফুলের সাজি হাতে বিস্ফারিত চোখে তিলোত্তমা আমার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটা ক্ষুধিত বাঘিনীর মত তার রক্তিম মুখ, নিষ্পলক দু চোখে চকচক করছে লোলুপ দৃষ্টি।
আমি খুব অল্প সময় সেই দৃশ্যটা উপভোগ করে বলে উঠলুম, “আরে দিদিমণি, আপনি কখন এলেন? দেখিনি তো!
আমার প্রশ্নের জবাব পেলুম না। তিলোত্তমা চটকা ভেঙে একটু কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘একি? এ আপনি কি করছেন? মালীরা নেই?
আমি আমার খ্যাতনামা রমণীমোহন হাসিটি হেসে বললুম, থাকবে না কেন? তবে ওদের আসতে একটু দেরি আছে, আমি ওদের কাজটা একটু এগিয়ে রাখছি। এতে স্বাস্থ্যও ভাল থাকবে, মনও ভাল থাকবে। জানেন, জেলে থাকার সময় আমি বাগান করা শিখি। আমি শান্তশিষ্ট হয়ে থাকতুম বলে বোধ হয় ওরা আমাকে কঠিন কাজ না দিয়ে বাগানের কাজ দিয়েছিল। আজ আমি এ কাজে কিন্তু এক্সপার্ট।’
‘আপনি জেলের কথা ভাবেন কেন? ও কথাটা ভুলে যান। মনে করুন, ও জীবনটা ফেলে এসেছেন চিরকালের জন্য। মন ভাল করতে বই পড়েন না কেন?
‘ভাল বই পাব কোথায়? এদিকে ধারে কাছে কোথাও তো লাইব্রেরী আছে বলে জানি না।’
‘লাইব্রেরী আছে। এ বাড়িতেই আছে। আমার ঠাকুদার আর বাবার কালেকশন। আমার পুজো হয়ে গেলে ওপরে যাব যখন, তখন আসবেন। আপনাকে দেখিয়ে দেব। আপনি যত খুশি বই ওখান থেকে নিয়ে পড়ন, কিন্তু এসব কাজ করবেন না।’
‘আপনি বারণ করলে কক্ষনো করব না, দিদিমণি। তবে আমার যে বাগান করতে খুব ভাল লাগে।’
‘বেশ, তাহলে করুন। আর শুনুন, আমাকে দিদিমণি বলে ডাকবেন না। ইয়ে, উত্তমাদি বলে ডাকবেন।’
আচ্ছা উত্তমাদি, তাই হবে।’
সেদিন সারাদিন আমি ওপরে যাবার কোন চেষ্টাই করলুম না। বিকেলের দিকে নামল তুমুল বৃষ্টি। কালিদাস বলেছেন, মেঘ দেখলে যিনি সুখী ব্যক্তি, তিনিও উদাস হয়ে পড়েন। কথাটা দেখলুম সত্যি। হঠাৎ উপাধ্যায়মশাই-এর কি যে হল, আমাকে ডেকে বললেন, এই যে পূর্ণেন্দু, শুনলুম তুমি নাকি খুব ভাল গান গাওঁ। তা একটা বর্ষার গান শোনাও না।’
আমি তৎক্ষণাৎ রাজী। বারান্দায় বসে ধরলুম মিঞা-কি-মলহার। পুরো খেয়াল। চোখ বুজে গান গাইছিলুম। মাঝে একবার চট করে চোখ খুলে দেখে নিলুম সামনের উঠোনে দোতলার দরজার আলো এসে পড়েছে আর তার মধ্যে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি নারীমূর্তির ছায়া। আর দেখার দরকার ছিল না। তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ করে ফেললুম। সে রাত্রে খুব তাড়াতাড়ি দোতলার আলো নিভে গেল।
তার পরদিন দেখি উপাধ্যায়ের মুড খুব ভাল। হেসে ছাড়া কথাই বলছেন না। অফিসের বাকী দুজন কেরানীকে আমার গানের খুব প্রশংসা করলেন। এর মধ্যে বিকেলবেলা তিলোত্তমার কাজের মেয়েটি অফিসঘরে এসে আমাকে বলল, তোমাকে দিদিমণি ডাকতেছেন গো। এখুনি একবার ওপরে যাও।’
আমি উঠে দাঁড়ালাম। তৎক্ষণাৎ ঘরের মধ্যে বজ্রনিঘোষ শুনলুম, ‘দাঁড়াও। আমিও তোমার সঙ্গে যাব।’ তাকিয়ে দেখি উপাধ্যায়ের মুখে আবার আষাঢ়ের মেঘ, তবে এবারেরটা আরও ঘন।
আমরা দুজনে একসঙ্গে দোতলায় উঠলাম। দেখি লম্বা বারান্দার একপ্রান্তে একটা দরজার সামনে তিলোত্তমা দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমাদের দেখে কুন্দদন্ত বিকশিত করে বলল, ‘এ কি জ্যাঠামশাই! আপনাকেও ডেকে নিয়ে এল নাকি?”
আষাঢ়ের মেঘের ভেতর থেকে গুরুগম্ভীর স্বর বেরুলো, না, আমি নিজেই এসেছি।’
‘আপনার কোন দরকার নেই, জ্যাঠামশাই, আপনি নিচে যান। আমি পূর্ণেন্দুবাবুকে ওপরে ডেকেছি বাবার লাইব্রেরীটা দেখাব বলে।’ বলে দরজাটা খুলে আমাকে বলল, “আসুন।’
উপাধ্যায় আর এগুতে গিয়েও এগোলেন না। একটা বাচ্চা ছেলের মত রাগী আর অভিমানী মুখ করে একজায়গায় দাঁড়িয়ে রইলেন।
লাইব্রেরীটা সত্যিই দেখবার মত। তিলোত্তমা চঞ্চল পায়ে ঘুরে ঘুরে দেখাতে লাগল। ওর গলার স্বরে, কথা বলার স্বভাবসিদ্ধ গাড়ীয়ের বদলে কোথায় যেন একটা চাপল্যের ছোঁয়া লাগল। এমনকি একটা বই আলমারি থেকে নামিয়ে সেটা খুলে আমাকে, দেখুন, দেখুন, এই লেখাটা দেখুন। বলে যখন ভাকল, আমি ওর ঘাড়ের ওপর দিয়ে বইটা দেখার ছলে ঘনিষ্ঠ হয়ে কাছে এগিয়ে গেলেও, সে সরে গেল না। আবার দেখলুম মুখে রক্তাভা, বুকের ঘনঘন ওঠাপড়া।
আমি বইটা হাতে নিয়ে বললুম, ‘চমৎকার। এটা আমি নি?
তিলোত্তমা ঘাড় কাত করল কিন্তু কোন শব্দ করল না। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম। দেখি উপাধ্যায় এক জায়গায়, একভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। উনি আমার হাতের বইটা আড়চোখে দেখলেন। তারপর আমরা দুজনে একসঙ্গে নিচে নেমে গেলুম।
বড়বাবু ঠিকই বলেছিলেন, তিলোত্তমার মত মেয়েকে ভাঙতে হলে তিন জায়গায় আঘাত হানা দরকার—শরীরে, মনে আর বুদ্ধিবৃত্তিতে। সে কর্মটি বেশ সুচারুরূপে করা গেছে বলেই মনে হচ্ছে। ওই শুভ্র, কঠিন আর পবিত্র অভ্রংলিহ মূর্তিটা দিব্যি নড়বড়ে হয়ে এসেছে। এবার একটা ঠেলা দিলেই হুড়মুড় করে মুখ থুবড়ে পড়বে, তাতে সন্দেহ নেই।
তবু, আরও কিছু সংবাদ সংগ্রহ করা দরকার। সাবধানের মার নেই। সেই কারণে, পরদিন সকালে বাগানে তিলোত্তমার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলুম, আপনি যে একেবারে একা দোতলায় থাকেন, আপনার ভয় করে না?
তিলোত্তমা হেসে উঠল। বলল, ‘ভয় করবে কেন? নিচেই তো আপনারা আছেন। তাছাড়া, আমার মনে হয় ঘরের মধ্যে একটি কাজের মেয়েকে নিয়ে শোয়ার চেয়ে একা শোয়া অনেক বেশি নিরাপদ।
তাহলেও, একটা দরোয়ান যদি বারান্দায় শুয়ে থাকত।’
‘কোন দরকার নেই। তাছাড়া, দোতলায় কেউ শুতে চায় না। ওদের নাকি ভয় করে।’
এবার আমার হাসির পালা। বললুম, খুব সাহস আপনার, না?
ছেলেমানুষের মত মাথা ঝাঁকিয়ে তিলোত্তমা বলল, ‘খুব।’ বলে এমনভাবে হাত নাড়ল যে সেই হাত আমার নগ্ন বুকের ওপর দিয়ে যেন ওর অজান্তেই বুলিয়ে গেল।
এরপর প্রায় এক মাস ধরে চলল আমার গান, সকালে একসঙ্গে বাগানে বেড়াননা, লাইব্রেরীর বই এনে পড়া। আমি দোতলায় যাই বিকেলবেলা যখন অনেক সময়ই তিলোত্তমা সেখানে থাকে না ধীরে ধীরে উপাধ্যায়ের মুখের মেঘ আবার কেটে যেতে লাগল, কারণ বাহ্যত তিলোত্তমা আর আমার মধ্যে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক আর সেই রকম দূরত্বই তিনি দেখতে লাগলেন। অথচ, তাঁর চোখের আড়ালে আমাদের ঘনিষ্ঠতা যে বেড়েই যাচ্ছে, সে কথা তিনি বুঝতেই পারলেন না। আমি ইতিমধ্যে তিলোমার ছোটবেলা থেকে বিয়ের আগের প্রায় সব ঘটনাই শুনে ফেলেছি। তার পরের কোন ঘটনা শুনিনি ঠিকই, কিন্তু এটুকু শুনেছি যে সে অংশটা নিষ্ঠুর দুঃখের। দুটি দুঃখী হৃদয় কাছাকাছি এসেছে। মাঝে মাঝে এই দুঃখেরও যে শেষ হতে পারে, ভবিষ্যতে যে সুখ থাকতে পারে, এহেন আভাস ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছে। এমন কি আমাকে পুনরায় বিবাহ করতে অনুরোধ করা হয়েছে এবং যে আমাকে বিয়ে করবে সে যে একটি অত্যন্ত ভাগ্যবতী মেয়ে সে কথাও বলা হয়েছে।
অবশেষে একদিন সকালে বাগানে বেড়ানোর সময় বললুম, আপনি কেবল আমাকে বলেন কেন? আপনারই কি জীবন শেষ হয়ে গেছে? কেন আপনি এই দুঃখের বোঝা বয়ে বেড়াবেন? কেন আপনি নতুন করে জীবন শুরু করছেন না?
তিলোত্তমা ফিকে হাসল। বলল, ‘দূর! আমি তো বুড়ী হয়ে গেছি।’
‘উত্তমাদি, আপনি বুড়ী? হায় ভগবান! আপনি আমার চেয়ে অনেক অনেক ছোট, কিন্তু কই আমি তো নিজেকে বুড়ো বলে ভাবি না। আপনাকে যখনই দেখি, কি মনে হয় জানেন? কাহারে হেরিলাম, সে কি স্বপ্ন, সে কি মায়া, একি অনিন্দ্যসুন্দর কায়া? আমার যদি সামর্থ্য থাকত, এই সম্পত্তি আর বৈধব্যের জাঁতাকল থেকে আমি আপনাকে জোর করে তুলে নিয়ে যেতুম। বাইরে, আলোয়, মুক্তিতে।
তিলোত্তমার মুখটা কেমন যেন হয়ে গেল। চাপাগলায় বলল, কে বলেছে তোমার সামর্থ্য নেই?” বলেই হঠাৎ দ্রুত চঞ্চল পায়ে মন্দিরের দিকে চলে গেল।
সে রাত্রে তুমুল বৃষ্টি নামল। ঘনঘন বাজ পড়ার শব্দে চারদিক যেন কেঁপে উঠতে লাগল। আমরা তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলুম। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লুম। একটু বাদে দেওয়ালে কান লাগিয়ে শুনি উপাধ্যায়মশাই-এর প্রবল নাক ডাকা শুরু হয়ে গেছে। বুঝলুম, আর দেরি করা ঠিক নয়। আজি রজনীতে হয়েছে সময়।
তৈরি হতে বেশিক্ষণ লাগল না। পাজামার তলায় এক পায়ের সঙ্গে ইলাস্টিক ব্যান্ড দিয়ে বেঁধে নিলুম একটা লিকলিকে ছুরি স্টিলেটো। অন্য পায়ে বাঁধলুম একটা ক্লিপ ড্যাগার। কোন হাতে কখন কোনটা লাগে বলা তো যায় না। পাঞ্জাবির এক পকেটে নিলুম একটা মুখ বাঁধার স্টিকিং প্লাস্টার আর বড় একখণ্ড কাপড়। অন্য পকেটে রইল হাত দেড়েক লম্বা সরু একটা নাইলনের দড়ি। তারপর লাইব্রেরী থেকে আনা যে বইটা তখন পড়ছিলাম সেটা হাতে নিয়ে ওপরে রওনা হলুম। একটা ব্যাপারে অন্তত নিশ্চিত ছিলুম যে আমার আজকের এই নৈশ-অভিসারের কথা কারুর পক্ষে জানা সম্ভব নয়।
দোতলায় উঠে দেখি তিলোমার ঘরে তখনও আলো জ্বলছে, দরজা বন্ধ। ভালই হল। আমি পা টিপে টিপে ওর ঘরটা পার হয়ে লাইব্রেরী ঘরের দরজাটা ইচ্ছে করে একটু শব্দ করে খুলে ভেতরে ঢুকলুম আর আলোটা জ্বালিয়ে দিলুম। তার একটু পরেই তিলোত্তমার ঘরের দরজা খোলার শব্দ পেলুম। তৎক্ষণাৎ আমি পেছন ফিরে বইটা আলমারিতে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লুম। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিলোত্তমা দরজায় এসে দাঁড়াল। আমাকে দেখে কম্পিত গলায় বলল, এ কি, তুমি? মানে, আপনি? এত রাতে?’
আমি নতমস্তকে বললুম, বইটা রাখতে এসেছিলুম উত্তমাদি। আমি কাল ভোরে এবাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি।’
তিলোত্তমা দু পা ভেতরে ঢুকে এল। বলল, “সে কি? কেন?
আমি ভীষণ পাপ করেছি, উত্তমাদি। যিনি আমাকে মৃত্যুর মুখ থেকে তুলে এনেছেন, আশ্রয় দিয়েছেন, সমবেদনা আর সহানুভূতি দিয়ে আমার দুঃখ মেটাবার চেষ্টা করেছেন, আমি, এই আমি তাঁর সম্পর্কে কুচিন্তা করেছি। এ বাড়িতে তারপর আমার আর থাকার অধিকার নেই। নরকেও স্থান হবে না আমার।’
তিলোত্তমা আরও দু পা এগিয়ে আমার বুকের সামনে এসে দাঁড়াল। মৃদু হেসে বলল, ‘কুচিন্তা করেছ? আমার সম্পর্কে? বল না, কি চিন্তা করেছ? বল না?’
না উত্তমাদি, সে আমি বলতে পারব না।’
‘উত্তমাদি নয়, বল তিলোত্তমা।
আমি তৎক্ষণাৎ প্রবল আলিঙ্গনে ওকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলুম, তিলোত্তমা, তিলোত্তমা…’
কিন্তু আমার মনে তখন একটা সমস্যা। এ অবস্থায় আমি এক্ষুনি তিলোত্তমাকে খুন করে ফেলতে পারি, একটা শব্দও করার সুযোেগ পাবে না। তারপর চাবিটা হস্তগত করা কোন ব্যাপারই নয়। সেটাই করব? না, আগে এমন সুন্দরী মেয়েটাকে উপভোগ করে নেব? তারপরে মারব? নাকি হাত-পা-মুখ বেঁধে ফেলে রেখে যাব যাতে সকালে এসে সবাই সে অবস্থায় ওকে দেখতে পায়? তখন মজাটা আরও জমবে। মনে হল, শেষ প্রস্তাবটাই সবচেয়ে ভাল—সবাই দেখুক পবিত্রতার কি হাল হতে পারে। তখন আমি দু হাতে ওকে কোলে তুলে নিয়ে শোবার ঘরের দিকে রওনা দিলুম।
তিলোত্তমা আমার হাতের ওপর নববধূর মত থরথর করে কাঁপতে লাগল আর বিড়বিড় করে কী সব যেন বলতে লাগল। ওসব আমি আজকাল আর শুনি না, সব মেয়েই দেখেছি এরকম সময়ে একই কথা বলে।
ওকে নিয়ে শোবার ঘরে এসে খাটের সামনে ওকে দাঁড় করিয়ে দিলুম। প্রথমেই শুইয়ে দিলে ব্যাপারটা রসিয়ে রসিয়ে খেলানো যাবে না। তারপর ওর বুকের আঁচলটা নামিয়ে দিয়ে একটা মুগ্ধ মুখভঙ্গি করে বললুম, তিলোত্তমা, তুমি সত্যিই তিলোত্তমা।’
এরকম একটা বোকা বোকা কথা শুনেও তিলোত্তমা রেগে গেল না। বরং লজ্জারুণ মুখ তুলে আধবোজা চোখে বলল, ‘দরজাটা। দরজাটা বন্ধ করে দাও, প্লীজ।’ বলে দরজার দিকে তাকিয়েই একটা আর্তনাদ করে উঠে তাড়াতাড়ি আঁচলটা বুকে তুলে দিল।
আমার প্রথমেই মনে হল বন্দুক হাতে উপাধ্যায় দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন। আমি একটু সামনে ঝুঁকে, যাতে চট করে পা থেকে একটা ছুরি খুলে নিতে পারি, দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়ালুম। হরি হরি। কোথায় উপাধ্যায়? দেখি বছর তিনেকের একটা ফর্সা গোলগাল মেয়ে ঘরে ঢুকছে। মেয়েটির নিস্পাপ মুখ, একমাথা কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, বড় বড় কালো চোখ আর পরনে একটি কুটোও নেই।
এ আবার কে রে বাবা? কার মেয়ে? আমি সহাস্যে তিলোত্তমার দিকে চেয়ে বললুম, ‘এ কে?’
তিলোত্তমা কিন্তু হাসল না। নিস্পলক বিস্ফারিত চোখে মেয়েটির দিকে চেয়ে বলল, ও শিখা, ও শিখা।
শিখা আবার কে? ওর নাম হওয়া উচিত ছিল ঝামেলা। দেখি, ওকে এখন তাড়ানো যায় কিনা। এই ভেবে আমি বাচ্চাটির কাছে গিয়ে নিচু হয়ে ওর মুখের কাছে মুখ এনে বললুম, ‘খুকি! এই বিত্তির মধ্যে নাংতু হয়ে ঘুরতে নেই। মাও তো মা, ঘরে যাও।’ বলতেই মেয়েটি হঠাৎ হাত বাড়িয়ে আমার চুলের মুঠি ধরে আমাকে পাশের দেওয়ালে আছড়ে ফেলল। ব্যাপারটা এমন আচম্বিতে হল যে আমার মুখ থেকে একটা শব্দও বেরুল না। আমার মাথা ঝনঝন করে উঠল, আমি স্তম্ভিত বিস্ময়ে অনড় হয়ে পড়ে রইলুম।
তখন শুনতে পেলুম তিলোত্তমার চাপাগলার হাহাকার, ‘তুই কেন এলি? আজ কেন এলি? তোর বাবা যখন আমায় গলা টিপে মারতে গিয়েছিল তখন আমি মনে মনে তোকে ডেকেছিলুম, তুই এসেছিলি। গুণ্ডাগুলো যখন আমায় ধরতে এসেছিল, তুই এসেছিলি। ওই দৈত্যটা যখন এসেছিল, তখনও এসেছিলি। কিন্তু আজ কেন? ও তো আমার কোন ক্ষতি করতে আসেনি। ও তো আমার কোন অনিষ্ট করতে চায় না। তবে কেন? তোর জন্যে কি আমি একটু সুখের মুখও দেখতে পাব না?
মেয়েটি তার নিস্পাপ বড় বড় চোখে তিলোত্তমার কথা শুনল, একটি শব্দও করল না। তারপর হঠাৎ আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার একটা ঠ্যাঙ ধরে অবলীলাক্রমে আমার বিশাল শরীরটা টানতে টানতে তিলোত্তমার পায়ের কাছে ফেলে দিল। বিনাবাক্যব্যয়ে আমার পাজামার দুটো পা আমার হাঁটুর ওপর তুলে দিল। ছুরিদুটো বেরিয়ে পড়ল। এইবার তিলোত্তমার দ্বিতীয়বার আর্তনাদ করার পালা। বাচ্চা মেয়েটা অতঃপর আমার পাঞ্জাবির দু পকেট থেকে অন্যান্য জিনিসপত্রগুলো বের করে তিলোত্তমার সামনে ফেলে দিল। তিলোত্তমা তখন একটা প্রবল কান্নায় খাটের ওপর ভেঙে পড়ল।
আমি দেখলুম এটাই শেষ সুযোগ। কোনরকমে একটু খাড়া হয়ে বসে বিদ্বেগে স্টিলেটোটা টেনে নিয়ে বাচ্চাটার গলা লক্ষ্য করে চালালুম। সেটা যেন আগে থেকেই তার জানা ছিল। সে চট করে আমার কজিটা ধরে এমন একটা মোচড় দিল যে আমি অসহ্য যন্ত্রণায় খাড়া হয়ে উঠলুম। কী কষ্টে যে চিৎকারটা আটকালুম সে শুধু আমিই জানি। কেবল আমার গলা থেকে একটা বিকৃত আওয়াজ বেরুল, এটা কে তিলোত্তমা, এটা কে?
ততক্ষণে বাচ্চাটা আমাকে দরজার দিকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। তারই মধ্যে শুনতে পেলুম আমার প্রশ্নের উত্তর, ‘ও আমার মেয়ে। শিখা।’
তিলোত্তমার মেয়ে? সে কোথায় ছিল এতদিন? আমার চিন্তা সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে। আমার নাক মুখ দিয়ে যেন আগুন বেরুচ্ছে। আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? দরজার সামনে দাঁড় করাল। বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আমার সঙ্গে অসহ্য যন্ত্রণা। আমি পালাতে চাই, এখান থেকে পালাতে চাই। হঠাৎ আমার পেছনে একটা প্রচণ্ড আঘাত লাগল। মনে হল যেন দশটা ঘোড়ার লাথি একসঙ্গে এসে পড়ল। আমি ছিটকে বারান্দা দিয়ে শূন্যে এসে পড়লুম। আমার তপ্ত শরীরে ঠাণ্ডা বৃষ্টির ধারা অমৃতরসের মত লাগল। হঠাৎ মনে পড়ল, তিলোত্তমার মেয়ে? বড়বাবু তো বলেছিলেন সে প্রায় সাত বছর আগে মরে গেছে। বড়বাবু তো মিথ্যে কথা বলেন না ।বড়বাবু দেবতা। নিচের জলে ভেজা পীচের রাস্তাটা বিদ্বেগে আমার দিকে উঠে আসছে। ওখানেই হায়দার পড়েছিল না? আমিও সশব্দে ওখানেই গিয়ে পড়লুম। মট করে আমার ঘাড়টা ভেঙে গেল।