শিউলি

শিউলি

মালপত্র গুছিয়ে রাখার পর হট কেসটাকে দেখিয়ে শৈবাল বললেন, দোয়েলকোয়েল, তোমরা আগে দাদুনকে খাইয়ে দিও। তারপর তোমরা দুজনে..

উনি কথাটা শেষ করার আগেই দোয়েল একটু হেসে বলল, তোমার ভয় নেই। তোমার বাবাকে আমরা না খাইয়ে রাখব না।

এবার উনি মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলেন, তোমরা দাদুনকে একলা রোখে কোথাও যাবে না। দাদনের সব কথা শুনবে।

কোয়েল সঙ্গে সঙ্গে দাদুনের গলা জড়িয়ে ধরে বেশ গম্ভীব হয়ে বলে, এই বুড়ো! শুনলে তো ছেলের কথা? আমাদের পারমিশান না নিয়ে তুমি কোথাও যেতে পারবে না।

দোয়েল বলে, তুই কিছু চিন্তা করিস না কোয়েল। পুরীতে তো দাদুন ছেলেকেও কাছে পাবে না, পুত্রবধূকেও কাছে পাবে না। আমরা যা বলব, বুড়োকে তাই শুনতে হবে।

ওদের কথায় শুধু শৈবাল আর বৃদ্ধ অনিলবাবু না, সামনের বার্থের বৃদ্ধা ও মধ্যবয়সী ভদ্রলোকও হাসেন।

শৈবাল ঐ ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করেন, আপনারাও কী পুরী যাচ্ছেন?

উনি পাশের বৃদ্ধাকে দেখিয়ে বলেন, আমার মামীমা যাচ্ছেন। আমি যাচ্ছি না।

শৈবাল বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে বলেন, মাসীমা, আপনিও মেয়ে দুটোর দিকে একটু খেয়াল রাখবেন।

দোয়েল সঙ্গে সঙ্গে বলে, দিদাকে কিছু করতে হবে না। আমরাই দিদাকে দেখব।

বৃদ্ধা এক গাল হাসি হেসে বলেন, আমার মত বুড়িকে দেখাশুনা করতে তোমাদের কষ্ট হবে না তো?

না, না, কিছু কষ্ট হবে না।

দোয়েল মুহূর্তের জন্য থেমে বলে, এই বুড়োকে যদি সামলাতে পারি, তাহলে আপনার মত সুন্দরী দিদাকে দেখাশুনা করতে আমাদের কোনো অসুবিধে হবে না।

বৃদ্ধা চাপা হাসি হেসে বলেন, আমাকে আর সুন্দরী বলো না। তোমাদের মত সুন্দরী তো চোখেই পড়ে না।

কোয়েল বলে, ও কথা বলবেন না দিদা। আপনাকে এই বয়সেই যখন এত সুন্দর দেখতে, তখন অল্প বয়সে যে কত সুন্দর ছিলেন, তা ভাবাই যায় না।

উনি চাপা হাসি হেসে বলেন, তোমরা যাই বলো না কেন, আমি অল্প বয়সেও তোমাদের মত সুন্দর ছিলাম না।

বৃদ্ধ অনিলবাবু একবার হাতের ঘড়ি দেখেই ছেলেকে বললেন, হ্যাঁরে খোকা, তুই এবার যা। বাড়িতে বৌমা একলা আছেন।

দোয়েল বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাবা, তুমি যাও। মায়ামাসী আজ কাজে আসবে না। মা অনেকক্ষণ একলা একলা আছে।

শৈবাল বাবাকে প্রণাম করার পর দুই মেয়েকে একটু আদর করে ট্রেন থেকে নামার আগে বলেন, তোমরা রোজ একবার করে ফোন করতে ভুলে যেও না যেন।

দোয়েল বলল, হা হা, রোজই ফোন করবো। সময় পেলে তুমিও ফোন করো

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই করব।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধার বোনপো মাসীকে প্রণাম করে বিদায় নিলেন।

দুপাঁচ মিনিট পরই ট্রেন ছাড়ল।

.

ট্রেন ছাড়ার পর পরই কোচ অ্যাটেনডান্ট চার্টের উপর চোখ বুলিয়েই অনিলবাবুকে জিজ্ঞেস করে, আপনি মিঃ ব্যানার্জী?

হ্যাঁ।

আর ওরা দুজনে মিস ডি ব্যানার্জী আর মিস কে ব্যানার্জী?

হ্যাঁ।

এবার কোচ অ্যাটেনড্যান্ট বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে বলে, আপনি মিসেস চৌধুরী?

বৃদ্ধা উত্তর দিলেন, হ্যাঁ।

কোচ অ্যাটেনডান্ট সঙ্গে সঙ্গে চলে যায়।

দোয়েল হট কেস খুলতে খুলতেই বলে, দাদুন, হাত ধুয়ে এসো। কোয়েল সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগ থেকে সাবান-তোয়ালে বের করে বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে দেয়।

অনিলবাবু বাথরুম থেকে ঘুরে আসতেই দোয়েল ওর হাতে লুচিআলুর দমের প্লেট তুলে দেয়।

দ্বিতীয় প্লেটটি ও মিসেস চৌধুরীর দিকে এগিয়ে ধরতেই উনি একটু হেসে বললেন, দিদি তোমরা খাও। আমি খেয়ে এসেছি।

কোয়েল বাড়ি থেকে যা খেয়ে এসেছেন, তা এতক্ষণে হজম হয়ে গেছে।

দোয়েল বলে, এই ছোট্ট ছোট্ট দুচারটে লুচি খেতে আপনার কোনো কষ্ট হবেনা। আমরা তিনজনে খাবো আর আপনি খাবেন না, তাই কখনো হয়?

কিন্তু…

না, না, দিদা, এক যাত্রায় পৃথক ফল হতে পারে না। নিন, নিন, ধরুন।

মিসেস চৌধুবী প্লেট হাতে নিতেই কোয়েল ওর দিকে তাকিয়ে বলে, দ্যাটস্ লাইক এ গুড গার্ল!

ওর কথা শুনে উনি না হেসে পারেন না।

খেতে খেতেই মিসেস চৌধুরী অনিলবাবুব দিকে তাকিয়ে বলেন, আপনার এই দুটি নাতনি কী যমজ?

হ্যাঁ।

কোয়েল সঙ্গে সঙ্গে পাশ ফিরে বলে, দাদুন, মিথ্যে কথা বলছ কেন?

ও মিসেস চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে, আমরা যমজ না। দিদি আমার থেকে সাত মিনিটের বড়।

মিসেস চৌধুরী চাপা হাসি হেসে বলেন, তাহলে তো তোমরা যমজ না!

লুচি-আলুর দমের পর্ব শেষ হতেই দোয়েল সবাইকে মিষ্টি দেয়।

মিষ্টি খেতে খেতেই মিসেস চৌধুরী দোয়েল-কোয়েলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, তোমরা বুঝি একটু রাত করে খাওয়া-দাওয়া করো?

কোয়েল সঙ্গে সঙ্গে বলে, হ্যাঁ

দোয়েল বলে, দশটা পর্যন্ত তো আমরা পড়াশুনাই করি। তারপর আমরা সবাই মিলে একটু আড্ডা দেবার পরই সবাই একসঙ্গে খেতে বসি।

তোমার দাদুনও অত রাত্রে খাওয়াদাওয়া করেন?

ও হাসতে হাসতে বলে, আমরা দুই বউ দুপাশে না বসলে তো বুড়ো যেতেই পারে না।

কোয়েল সঙ্গে সঙ্গে বলে, জানেন দিদা, এই বুড়ো যেমন আমাদের দুজনকে দুপাশে না নিয়ে ঘুমুতে পারে না, আমরা দুজনেও বুড়োকে কাছে না নিয়ে শুতে পারি না।

তোমাদের দাদুন সত্যি ভাগ্যবান।

এতক্ষণ চুপ করে থাকার পর অনিলবাবু মিসেস চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলেন, হ্যাঁ, সত্যি আমি ভাগ্যবান! শুধু এরা দুজনে না, আমার ছেলে আর পুত্রবধূও অসম্ভব ভালো।

দাদুনকে শুইয়ে দেবার পর দোয়েল-কোয়েল উপরের বার্থে যায়। দোয়েল বার্থের বাইরে মুখে নিয়ে মিসেস চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করে, দিদা, আপনি কোথায় উঠবেন?

আমি ববাবরই হালদার মশায়ের পুরী হোটেলে উঠি।

ও একটু উত্তেজিত হয়ে বলে, আমরাও তো পুরী হোটেলেই উঠব।

কোয়েল সঙ্গে সঙ্গে বলে, দিদা, আমরা পাশাপাশি ঘরে থাকব। আপনি পাশের ঘরে থাকলে খুব মজা হবে।

মিসেস চৌধুরী একটু হেসে বলেন, তোমাদের দুজনকে কাছে পেলে তো আমিও আনন্দে থাকব।

হ্যাঁ, ওরা পাশাপাশি ঘরেই থাকেন। এক সঙ্গে খাওয়াদাওয়া গল্পগুজব আর সমুদ্রের ধারে, জগন্নাথ মন্দিরের আশেপাশে ঘুরাঘুরি করে দুতিনটে দিন বেশ কেটে যায়।

সেদিন সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা। বাইরে না বেরিয়ে ঘরে বসেই ওরা সবাই গল্পগুজব করছিলেন। হঠাৎ কথায় কথায় মিসেস চৌধুরী অনিলবাবুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, দাদা, বৌদিকে সঙ্গে আনলেন না কেন?

উনি একটু ম্লান হাসি হেসে বললেন, সে বহুকাল আগেই মারা গিয়েছে।

উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, আমার ছেলে যখন মাত্র ছ’বছরের তখনই আমার স্ত্রী মারা যান।

কথাটা শুনেই মিসেস চৌধুরী অবাক হন। সঙ্গে সঙ্গেই উনি প্রশ্ন করেন, তখন ঐটুকু বাচ্চাকে কে দেখাশুনা করতেন?

অনিলবাবু জবাব দেবার আগেই দোয়েল বলে, দাদুনই তো বাবাকে মানুষ করেছেন।

ও প্রায় না থেমেই একটু হেসে বলে, বাবা তো আমাদের দুই বোনকে সব সময় বলেন, তোমাদের চাইতে তোমাদের দাদুনকে আমি হাজার গুণ বেশি ভালোবাসি।

মিসেস চৌধুরী একটু হেসে বলেন, এটা উনি মজা করে বলেন।

কোয়েল বলে, না, না, দিদা, বাবা সত্যি দাদুনকে অনেক বেশি ভালোবাসে।

দোয়েল ডান হাত দিয়ে দাদুনের গাল টিপে আদর করে মিসেস চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে একটু চাপা হাসি হেসে বলে, বাবা-মা যাকে ইচ্ছে ভালোবাসুক, আমরা এই বুড়োকে নিয়ে মহা সুখে আছি।

ওর কথা শুনে মিসেস চৌধুরী একটু হেসে বলেন, সে তো আমি নিজের চোখেই দেখছি।

উনি একটু থেমে অনিলবাবুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, আপনার স্ত্রী যখন মারা যান, তখন আপনার বয়স কত

ঠিক তিরিশ।

মাত্র তিরিশ?

হ্যাঁ।

ঐ বয়সে তো অনেকে বিয়েই করেন না।

মিসেস চৌধুরী প্রায় এক নিঃশ্বাসেই প্রশ্ন করেন, আপনি আবার বিয়ে করলেন না কেন?

অনিলবাবু একটু হেসে বলেন, মা জোর করে বিয়ে না দিলে আমি বিয়েই করতাম না। দ্বিতীয় বার বিয়ের কথা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না।

কোয়েল সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করে, দাদুন, তুমি বিয়ে করতে চাওনি কেন?

এমনি।

ইস! কি আমার সাধু?

দোয়েল গম্ভীর হয়ে বলে, দাদুন, আমরা কচি বাচ্চা না। আমরা মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে পড়ছি। আমাদের বোকা বানাবার চেষ্টা করো না। সত্যি করে বলল, কেন বিয়ে করতে চাওনি।

বৃদ্ধ হাসতে হাসতে বলেন, সত্যি বলছি বড় বউ, আমি এমনি বিয়ে করতে চাইনি।

কোয়েল ফৌজদারি উকিলের মতো জেরা করে, সত্যি করে বলো তো কোনো মেয়ের প্রেমে পড়েছিলে কিনা।

ওর প্রশ্ন শুনে শুধু অনিলবাবু না, মিসেস চৌধুরীও হো হো করে হেসে ওঠেন।

দাদুন, হাসি দিয়ে ছোট বউকে ভোলাতে পারবে না। আমার কথার জবাব দাও।

সত্যি বলছি ছোট বউ…

বৃদ্ধকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই দোয়েল বিদ্যুৎ গতিতে ওর দুটি হাত ওদের দুই বোনের মাথায় চেপে ধরে গম্ভীর হয়ে বলে, আমাদের মাথায় হাত দিয়ে মিথ্যে কথা বলবে না।

বৃদ্ধ একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু ম্লান হাসি হেসে বলেন, হ্যাঁ, বড় বউ, আমি সত্যি একটা মেয়েকে ভালোবাসতাম।

দোয়েল সঙ্গে সঙ্গে বলে, দ্যাটস্ লাইক এ গুড বয়।

কোয়েল বলল, তোমার মতো হ্যান্ডসাম ছেলে যৌবনে প্রেমে পড়েনি, তাই কখনো হয়?

ওদের কাণ্ডকারখানা দেখে মিসেস চৌধুরী শুধু হাসেন।

দোয়েল বৃদ্ধের মুখের সামনে মুখ নিয়ে প্রশ্ন করে, যে মেয়েটিকে ভালোবাসতে, তার নাম কি?

শিউলি।

কোয়েল চিৎকার করে বলে, হাউ রোমান্টিক!

দোয়েল আবার প্রশ্ন করে, উনি নিশ্চয়ই খুব সুন্দরী ছিলেন?

হ্যাঁ, বড় বউ, শিউলি খুবই সুন্দরী ছিল।

বৃদ্ধ অনিলবাবু মুহূর্তের জন্য থেমে একটু হেসে বলেন, ও লেখাপড়ায় যেমন ভালো ছিল, সেইরকমই ভালো গান গাইতে পারতো।

কোনোমতে হাসি চেপে কোয়েল জিজ্ঞেস করে, কিভাবে তোমাদের ভাব হল?

বৃদ্ধ চাপা হাসি হেসে বলেন, আমার বাবার মতো শিউলির বাবাও রেলের ডাক্তার ছিলেন। আমরা পাশাপাশি বাংলোয় থাকতাম।

প্রথম যখন আলাপ হয়, তখন তোমাদের বয়স কত?

গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করে দোয়েল।

আমাদের কারুরই বয়স বেশি ছিল না। বলতে পারো কিশোর-কিশোরীর প্রেম; কিন্তু দুজনেই দুজনকে খুব ভালোবাসতাম।

কোয়েল হাসতে হাসতে বলে, দাদুন, তুমি কি পাকাই ছিলে!

যাই বলো ছোট বউ, শিউলিকে দেখলে বা তার সঙ্গে মেলামেশা করলে তোমরাও তাকে না ভালোবেসে থাকতে পারতে না।

দোয়েল প্রশ্ন করে, শিউলিকে বিয়ে করলে না কেন?

আমার বাবা তখন কলকাতা থেকে ধানবাদ বদলি হয়ে গেছেন। আমি বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে পড়ছি। ঐ সময় হঠাৎ জানতে পারলাম, শিউলির বাবা-মা অ্যাকসিডেন্টে মারা গিয়েছেন।…

ও মাই গড!

দোয়েলের মুখ থেকে কথাটা বেরিয়ে যায়।

ঐ অ্যাকসিডেন্টের পরই শিউলি আর ওর দিদিকে বোধহয় কোনো আত্মীয় নিয়ে যায় কিন্তু আমরা ওদের ঠিকানা না জানায় কোনো চিঠিপত্রও লিখতে পারলাম না।

কিন্তু উনি তো তোমাদের ঠিকানা জানতেন!

দোয়েল মুহূর্তের জন্য না থেমেই বলেন, উনি তো তোমাকে চিঠি দিতে পারতেন।

বৃদ্ধ অনিলবাবু মান হাসি হেসে বলেন, বড় বউ, মিসফরচুন নেভার কামস্ অ্যালোন। ঠিক ঐ সময়ই আমার বাবা হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন আর আমিও সঙ্গে সঙ্গে লেখাপড়া ছেড়ে চাকরি করতে শুরু করলাম।

উনি একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, শিউলি নিশ্চয়ই আমাকে চিঠি দিয়েছিল কিন্তু ওর চিঠি আসার আগেই তো আমি বেনারস ছেড়ে চাকরি নিয়ে কটক চলে গেছি।

মিসেস চৌধুরী মুখ নীচু করে থাকেন। দোয়েল আর কোয়েলও কিছুক্ষণ কথা বলতে পারে না। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দোয়েল বলে, রিয়েলী ভেরি আনরচুনেট!

এতক্ষণ চুপ করে থাকার পর মিসেস চৌধুরী একটু হেসে অনিলবাবুকে বললেন, এত কাল যে কথা কাউকে বলতে পারেননি, তা এই দুই বউকে বলে দিলেন?

কী করব বলুন, এদের তো মিথ্যে কথা বলতে পারি না। ওরা দুজনেও তো আমার কাছে কোনো কিছু গোপনও করে না, মিথ্যেও বলে না।

না, না, আপনি ঠিকই করেছেন। এদের দুজনের চাইতে ভালো বন্ধু তো আপনার হতে পারে না।

কোয়েল হাসতে হাসতে বলে, জানেন দিদা, আমাদের তিনজনের একটা আলাদা জগৎ আছে। সেখানে আমাদের মা-বাবারও নো অ্যাডিমিশন!

মিসেস চৌধুরী হাসতে হাসতে বললেন, তোমাদের ঐ তিনজনের জগতে একটু ঠাঁই পাবো না?

দোয়েল সঙ্গে সঙ্গে বলে; আপনাকে ঠাঁই না দিলে কী আপনি আমাদের এইরকম সিক্রেট মিটিং-এ থাকতে পারতেন?

যাই হোক দিনগুলো বেশ কেটে যায়।

সেদিন সকালে মিসেস চৌধুরীর ঘরে বসে দোয়েল-কোয়েল গল্পগুজব করছিল। হঠাৎ একথা সেকথার পর দোয়েল বলল, দিদা, কলকাতায় ফিরে যাবার পর আমাদের ভুলে যাবেন না তো?

না, দিদি, তোমাদের কাউকেই ভুলতে পারবো না।

মিসেস চৌধুরী একটু ম্লান হাসি হেসে বলেন, দিদি, এ সংসারে কিছু কিছু মানুষকে সারা জীবনই একা থাকতে হয়। আমি এইরকমই এক অভাগিনী। আমি কারুর বাড়িতেই বিশেষ যাই না

কিন্তু দিদা…

ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই উনি বললেন, না, দিদি, আমাকে জোর করো না। আমি একা একা লুকিয়ে-চুরিয়ে চোখের জল ফেলেই বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চাই।

উনি দুহাত দিয়ে ওদের দুজনকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বললেন, তোমাদের সঙ্গে কটা দিন কাটিয়ে যে আনন্দ পেলাম, তা সারা জীবনেও পাইনি। তোমাদের কথা আমি কোনোদিন ভুলব না।

পরের দিন সকালে দাদুনকে সঙ্গে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়ে দোয়েল-কোয়েলের সঙ্গে ওদের এক বন্ধু ও তার মা বাবার সঙ্গে দেখা। ঐ বন্ধু জোর করে দোয়েল-কোয়েলকে ওদের হোটেলে নিয়ে গেল। বলল, সন্ধের আগেই ফিরে আসবে।

বিকেলবেলায় চা খেয়ে অনিলবাবু বারান্দায় বসে ছিলেন নাতনিদের পথ চেয়ে। হঠাৎ মিসেস চৌধুরী হাজির।

অনিলবাবু মুহূর্তের জন্য ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, বেড়াতে বেরুচ্ছেন?

আমি কলকাতা ফিরে যাচ্ছি।

আজই?

হ্যাঁ।

উনি মুহূর্তের জন্য থেমেই হঠাৎ নীচু হয়ে অনিলবাবুকে প্রণাম করেই ম্লান হাসি হেসে বললেন, আমাকে চিনতে পারলে না?

অনিলবাবু অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলেন, না, ঠিক…

আমি শিউলি।

তুমি, শিউলি?

হ্যাঁ।

মিসেস চৌধুরী আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে আঁচল দিয়ে মুখ চেপে ধরে ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *