শিউলি – ৪০

॥ ৪০ ॥

কিশোর মনে একটা আঘাত লাগল। সবচেয়ে কাছের মানুষটা কেমন ঝপ করে চলে গেল! বলা নেই কওয়া নেই। জয়ের মনটা কেমন যেন আকাশের মতো হয়ে গেল। অন্যমনস্ক সবসময়। একটা ভয় ঢুকেছে মনে। দাদি, ঠাকুমা, এঁদের তো বয়েস হয়েছে। তবে! তবে এঁরাও তো একে-একে চলে যাবেন। জয় বাগানের শিউলিগাছের তলায় দাঁড়িয়ে ছিল। সারা রাত ধরে যে-ফুল ফোটে, সারা সকাল সেই ফুল ঝরে যায়। গাছ! তোমার দুঃখ হয় না কোনও?

গাছ বলবে, কিসের দুঃখ। এই তো নিয়ম! পৃথিবীর যেমন নিয়ম, সেইরকমই তো হবে। জয় গাছের তলায় ঘাসের ওপর বসে পড়ল। সবে সকাল হচ্ছে। পরিষ্কার নীল আকাশ। চার্চের চুড়াটা ঝকঝক করছে। সেইদিকে তাকিয়ে জয় বসে আছে। জয়া দূর থেকে ভাইকে দেখছিল। তারও খুব দুঃখ হয়েছে। প্রকাশ করে না। তার এখন সবচেয়ে বড় চিন্তা, ভাইটাকে কেমন করে সামলানো যায়! ছেলেটা বড় নরম প্রকৃতির। কথায়-কথায় জল এসে যায় চোখে। সকলকে নিয়ে থাকতে ভালবাসে। সকলের জন্য বড় বেশি ভাবে।

জয়া এগিয়ে এসে বলল, “এই ওঠ। চল আমার সঙ্গে। অনেক কাজ আছে। আমি একা পারব না।”

“কী কাজ রে দিদি! এই সকালে এত কাজ তুই কোথায় পেলি?”

“দেখবি চল।”

এই বাড়ির একটা ঘরে শুধু বই থাকে। তিনপুরুষের যত বই সব সাজানো আছে পর-পর, খোলা র্যাকে। দেওয়াল চাপা পড়ে গেছে। সব বই। মাসখানেক হল, একটা কি একজোড়া জ্ঞানপাগল ইঁদুর এই ঘরে ঢুকেছে। ইঁদুর তো চোখ দিয়ে পড়ে না, দাঁত দিয়ে পড়ে। কেটে-কেটে পড়ে। কেটে পড়ে কেটে-পড়ে। কিছুতেই আর খুঁজে পাওয়া যায় না তাদের। এখানে-ওখানে জমে থাকা গ্রন্থচূর্ণ দেখে শিবশঙ্কর হায়-হায় করে ওঠেন। জ্ঞানের চানাচুর। সব গেল, বেদ, বেদান্ত, অ্যাস্ট্রোনমি, ফিলজফি, শেলি, বায়রন, কিট্স। উই আর ইঁদুরের দেখ ব্যবহার/ কাঠ কাটে, বস্ত্র কাটে, করে ছারখার॥

ইঁদুর বইয়ের কোন ধরে জ্ঞানের গভীরে কেটে-কেটে ঢুকতে চায়। বিশ্লেষণাত্মক লেখাপড়া। শিবশঙ্কর মাথা খাটিয়ে একটা লোশন বের করেছেন। বইয়ের চারপাশে মাখিয়ে দিলে ইঁদুরের কাছে জ্ঞান আর তেমন সুস্বাদু নাও লাগতে পারে। বইয়ের সংখ্যা তো কম নয়, আবার সব বইয়ে লাগাতে না পারলে বোঝা যাচ্ছে না, ফর্মুলাটা কার্যকর হল কি না। মূর্খ ইঁদুর বড় একটা দেখা যায় না। সকলেরই জ্ঞানের ক্ষুধা অসীম। শিবশঙ্কর বলেন, ভোরেসাস।

সিংজি চলে যাওয়ার পর লছমি এখন এই বাড়িরই এক মেয়ে। জয়ার সঙ্গে তার আর কোনও তফাত নেই। পরিষ্কার বাংলা বলে। মেয়েটা খুব ভাল। সবসময় নিজের ভাবে থাকে। শান্ত, ধীর। এই বয়েসেই অনেক হাতের কাজ জানে। একধরনের প্রতিভা। কেউ শেখায়নি। নিজে নিজেই সব বের করে মাথা খাটিয়ে। জয়াও অনেক কিছু জানে। তাই দু’জনে খুব মিলেছে। লছমি ভীষণ পরিচ্ছন্ন, আর খুব খাটতে পারে। এ সেই জালা থেকে বেরিয়ে আসা দৈত্যটার মতো। কাজ ছাড়া থাকতেই পারে না।

এই বইয়ে মেকআপ লাগাবার কাজে লছমিও লেগে গেছে। বেশিরভাগ বইই র্যাক থেকে নেমে এসেছে মেঝেতে। ঘরে আর পা রাখার জায়গা নেই। জনসভা নয়, বইসভা। অভিধান, বিশ্বকোষ, বেদান্ত ভাষ্য, এঁরা যেন সব প্রধান অতিথি, সভাপতি, বিশেষ অতিথি। ঘরে পা রেখেই মনে হল, সারারাত অনেক বক্তৃতার পর যেন কারও শোকে পাঁচ মিনিটের নীরবতা চলছে। বইয়ের আড়ালে কে যেন খুসখুস করছে। সামান্য নড়াচড়া। লছমি আগেই এসে বইয়ের আড়ালে কাজে বসে গেছে। শিবশঙ্কর যে ফর্মুলাটা তৈরি করেছেন তার একটা বিশেষ গন্ধ আছে। শিকার ধরার সময় বেড়ালের শরীর থেকে নাকি এইরকম একটা গন্ধ বের হয়। সেই গন্ধে ইদুর চম্পট দেয়। সেই গন্ধটাই ঘরে ছড়িয়ে আছে।

লছমির একটা সুন্দর নতুন নাম হয়েছে, ‘সাহারা’।

জয়া বলল, “সাহারা, তুই এসে গেছিস, আমাকে ডাকিসনি কেন?”

“দিদি, আমি তো সেই শেষ রাত থেকে এখানেই আছি।”

“কেন রে? তুই ঘুমোসনি?”

“ঘুমিয়ে তো ছিলুম দিদি, কে আমাকে ডেকে দিলে। সেই সাধু, যে রোজ আমার স্বপ্নে আসে। তার হাতে সাজিভরা ফুল। এক মাথা পাকা চুল। সাদা, লম্বা, দাড়ি গোঁফ। চোখে চকচকে হাসি। আর আমার ঘুম এল না।”

“আমাকেও ডাকবি তো!”

“তুমি কাল কত রাতে শুয়েছ বলো? ঠিকমতো না ঘুমোলে তোমার তো শরীর খারাপ হবে!”

“তোকে বলেছে।”

বইয়ের বাধা টপকে জয় আর জয়া সাহারার পাশে চলে গেল। সেই জায়গার মেঝেতে একটু ফাঁক আছে। নিয়মটা এই হয়েছে, যেসব বইয়ের কাজ হয়ে যাচ্ছে, সেগুলো চলে যাচ্ছে পেছন দিকে। আর তিনপাশে ছড়িয়ে আছে না-হওয়া বই। তার সংখ্যা কম নয়। যে-গতিতে কাজ হচ্ছে, দেখেশুনে মনে হচ্ছে, কমসে কম আরও পনেরো দিন লেগে যাবে শেষ করতে।

সাহারার পাশে বসে পড়ে জয়া বলল, “এইসব বই একা একজন পড়ে শেষ করতে পারবে!”।

জয় বলল, “স্বামীজি হলে পারতেন। শুধু পারতেন না, পাতার পর পাতা গড়গড় করে মুখস্থ বলতেন। কী করে এমন হয় রে দিদি! আমার কেন হয় না!”

“স্বামীজি এক-এক পাতা একনজরে পড়তেন। একটা অক্ষর, একটা লাইন নয়। তুই চেষ্টা কর, তোর সবটা না হলেও, কিছুটা তো হবে! সবাই কী আর স্বামীজি হতে পারেন? তুই চেষ্টা কর।”

সাহারা হাসতে-হাসতে বলল, “কোসিস করো ভাইয়া।”

এইসব কথা শুনলে জয়ের ভীষণ ভাল লাগে। এমন একজন হতে হবে, যার কথা সবাই মনে রাখবে। হ্যাঁ, একজন এসেছিল বটে, মানুষের মতো মানুষ! দাদি বলেন, ইচ্ছেটাই সব। মানুষ ইচ্ছে করেছিল বলেই চাঁদে যেতে পেরেছিল। ইচ্ছে করেছে বলেই আরও দূর কোনও গ্রহে চলে যাবে একদিন। ইচ্ছাই হল বিজ্ঞান। জয় যত না কাজ করে, তার চেয়ে বেশি পড়ে। জয়া এইটাই চায়। বই হল মনের দরজা আর জানলা। ওই পথ ধরে যদি বেরিয়ে যেতে পারে, মন মশগুল। জয়ের হাতের কাছে স্বামীজির একখণ্ড রচনাবলী। পাতা ওলটাতেই একটা জায়গা বেরিয়ে পড়ল, কে আন্ডারলাইন করে রেখেছেন, “পরোপকারই ধর্ম, পরপীড়নই পাপ। শক্তি ও সাহসিকতাই ধর্ম, দুর্বলতা ও কাপুরুষতাই পাপ। স্বাধীনতাই ধর্ম, পরাধীনতাই পাপ। অপরকে ভালবাসাই ধর্ম, অপরকে ঘৃণা করাই পাপ। ঈশ্বরে ও নিজ আত্মাতে বিশ্বাসই ধর্ম, সন্দেহই পাপ।

॥ ৪১ ॥

দেখতে-দেখতে পরীক্ষা এসে গেল। অ্যানুয়াল এগজামিনেশান। এ-বছর আবার শীতও পড়েছে সেই রকম জবরদস্ত। লেপের তলা থেকে হাত বের করতে ইচ্ছে করে না। দুপুরে রোদের তেমন তেজই নেই। রকে রোদ এসে পড়েছে। শিবশঙ্কর একটা ডেকচেয়ারে বসে আছেন। বহুকাল পরে আবার পড়ছেন, করবেটের সেই বিখ্যাত বই, ‘ম্যান ইটার্স অব কুমায়ুন’। মনটা যখন ‘দুঃখু দুঃখু’ হয়ে ওঠে তখন এই বইটা পড়েন। এই বইটাতে শিবশঙ্করের যৌবন আছে। তখন তরুণ এঞ্জিনিয়ার। দেরাদুনের জঙ্গলে ক্যাম্প করে আছেন। রেললাইন পাতা হচ্ছে। সঙ্গে আর-এক সাহেব, স্যামুয়েল। দু’জনেই সমবয়সী। স্কটল্যান্ডের ছেলে। খুব আমুদে ছিল। সে কেবল বলত, “শঙ্কর, ফাইন্ড অ্যান ইন্ডিয়ান যোগী, আই ওয়ান্ট টু মাস্টার ইন্ডিয়ান রোপ ট্রিক।”

রাতের বেলা দূর জঙ্গলে বাঘ ডাকত। স্যামুয়েল সঙ্গে-সঙ্গে রাইফেল তুলে নিত হাতে। বাঘ-ভাল্লুকের ভয় তার ছিল না। ভয় পেত গুবরে পোকা, বিটলসকে। ভোঁ করে উড়ে এলেই আপাদ মস্তক চাদর চাপা দিয়ে শুয়ে পড়ত, “শঙ্কর সেভ মি ফ্রম দ্যাট আগলি পেস্ট।” স্যামুয়েলের কথা খুব মনে পড়ে। ছেলেটা খুব সরল ছিল। বাড়ি থেকে চিঠি এলে পড়াত। কার সঙ্গে কী সম্পর্ক বুঝিয়ে দিত। মাকে খুব ভালবাসত। দিদির জন্যে মন কেমন করত। স্যামুয়েলের স্বভাবটা ছিল বাঙালি ছেলেদের মতো। যত বয়েস বাড়ছে ততই অতীত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আর একবার যদি কোনও অলৌকিক উপায়ে যৌবনটাকে ফিরে পাওয়া যেত! সন্ধ্যা নেমে আসছে কুমায়ুনের জঙ্গলে। গাছের মাথা থেকে অন্ধকার নেমে আসছে থরে-থরে। সূর্যাস্তের আলোয় নদীর জল লাল। তাঁবুর বাইরে আগুন জ্বালতে হবে। কাঠকুটো সংগ্রহ করে আনছে কর্মীরা। বাবুর্চি রান্নার আয়োজন করছে। লোহার লাইন, স্লিপার, গাডার ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। দেহাতে ফিরে যাচ্ছে মোষের দল। কোম্পানির ডাক্তার ডিসপেনসারি খুলে বসেছেন। সেখানে কিছু দেহাতি নারী-পুরুষও এসেছে চিকিৎসার জন্যে। এরই মাঝে স্যামুয়েল মাউথ অগান বাজাচ্ছে।

বইটা ভোলাই আছে। দু-এক পাতা হয়তো পড়েছেন। তাই যথেষ্ট। অতীতে ফিরে যাওয়ার পক্ষে সেইটাই যথেষ্ট। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধবে। শিবশঙ্কর চলে যাবেন মিশরে। পিরামিডের দেশ। সেখানে বিশ্ববিখ্যাত ফিল্ড মার্শাল রোমেলের যুদ্ধ দেখেছিলেন। প্রকৃতই ‘ডেজার্ট ফক্স’। যেমন সেই মানুষটির সাহস তেমনই তাঁর রণকৌশল। ইংরেজরাও তাঁকে শ্রদ্ধা করত। শিবশঙ্কর ছিলেন ব্যাকলাইনে, এঞ্জিনিয়ারিং কোরে। ফ্রন্টলাইন থেকে প্রতিদিনই খবর আসত রোমেলের বীরত্বের। ভাঙা ট্যাঙ্ক, হাল্কা ট্যাঙ্ক, কম ডিভিশান নিয়ে একের-পর-এক যুদ্ধ জয় করে চলেছেন। দুর্ধর্ষ তাঁর গতি। ক্ষুরধার তাঁর বুদ্ধি। প্রাইম মিনিস্টার চার্চিল তখন ইংল্যান্ডের হাল ধরেছেন। সার আর্চিবল্ড ওয়াভেল তখন মধ্যপ্রাচ্যের কমান্ডার জেনারেল। ইজিপ্টের পশ্চিমের ইতালীয় সৈন্যরা ইংরেজদের মার খেয়ে ছাতু। তাসের ঘরের মতো প্রতিরোধ ভেঙে চুরমার। ব্রিটিশ লেফটন্যান্ট জেনারেল সার রিচার্ড ও কোনার তখন দুর্বার। ঠিক দুটো মাস, ইতালিয়ানদের মারতে মারতে ও কোনার ইজিপ্টের ওপর দিয়ে ঝড়ের মতো বয়ে গেলেন। ঢুকে পড়লেন লিবিয়ায়, সিরেনাইকার ঘাড়ের ওপর দিয়ে বারদিয়ায়। বারদিয়া, টোবরুক, ডেরনা, বেনগাজি দখল করে নিলেন। ইতালির দশ ডিভিশান সৈন্য ছারখার। মুসোলিনির একলাখ তিরিশ হাজার কামান, চারশো ট্যাঙ্ক, দেড়শো এয়ারক্র্যাফ্ট খতম। পরাজিত, নীতিভ্রষ্ট কিছু ইতালীয় সৈন্যের শেষ আশ্রয়স্থল তখন ট্রিপোলি। মুসোলিনির তখন খুব অহঙ্কার হয়েছিল। হিটলারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গোটা দুনিয়ার জমিদারি ভাগাভাগি করবে। নাজিম আর ফ্যাসিজম এক হয়েছে। মুসোলিনি তখন হাউ-হাউ করে কাঁদতে শুরু করেছেন। উত্তর আফ্রিকার সাম্রাজ্য শেষ হয়ে গেল। মুসোলিনি চিৎকার করছেন, হিটলার, বাঁচাও বাঁচাও। শিবশঙ্কর তখন ইংলিশ গ্যারিসনের পেছনে এঞ্জিনিয়ারিং কোরে। সঙ্গে আর একজন বাঙালি ছিল সুশোভন মুখার্জি। শিবপুরের ছেলে। ছেলেটি একটু ভিতু ধরনের ছিল। গোলাগুলির শব্দে ভয় পেত। তার ওপর মরুভূমির উত্তাপ। একশো কুড়ি, তিরিশ কিছুই নয়। চোখ ঝলসানো রোদ। এতটুকু বাতাস নেই। মাইলের পর মাইল বালি। তার ওপর মাথায় হেলমেট। পরনে মোটা টিউনিক। গায়ের চামড়ায় ফোস্কা। কালচে-কালচে দাগ। পেটের গোলমাল। দুটো ফুসফুসেই বালি। মানুষ যে কত কষ্ট সহ্য করতে পারে!

ঠিক ওই সময় হিটলার রোমেলকে পাঠালেন। রোমেল এসেই ভেল্কি দেখালেন। সৈন্যবল, অস্ত্রবল, ট্যাঙ্কবল কিছুই নেই। যা ঝড়তিপড়তি ছিল তাই দিয়েই বেনগাজি দখল করে নিলেন। ব্রিটিশ সেকেন্ড আর্মার্ড ডিভিশান ছত্রখান। টোবরুকে অস্ট্রেলিয়ান নাইনথ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশান সম্পূর্ণ কোণঠাসা। সেকেণ্ড আর্মার্ড ডিভিশানের পেছনেই ছিলেন শিবশঙ্কর। রিট্রিট। তাঁর গ্যারিসন পালাচ্ছে। নাজিদের হাতে পড়ার ভয়ে সুশোভন মুকুজ্যে আত্মহত্যা করেছে। রাতে ডেজার্টের টেম্পারেচার নেমে যাচ্ছে শূন্যের নীচে। সঙ্গে কম্পাস নেই, অ্যামুনিশান নেই, র্যাশান নেই। এইভাবে পালাতে পালাতে শিবশঙ্কর একটা উট পেয়ে গেলেন। কীভাবে এল, কোথা থেকে এল জানেন না। পেটের নীচে হ্যাভারস্যাকে খাবার, একটা বাইনোকুলার। সেই উটের সাহায্যে তিনি ইন্ডিয়ান ফোর্থ আর্মার্ড ডিভিশানকে পেয়ে গেলেন অলৌকিকভাবে। এই উটটার কথা শিবশঙ্কর আজও ভুলতে পারেননি। দুটো চোখে করুণার দৃষ্টি। যেন তাকে উদ্ধার করার জন্যেই দিগন্ত থেকে ছুটে আসছে বেঁচে থাকার মতো রশদ নিয়ে।

জিম করবেট থেকে আফ্রিকার মরুভূমিতে। মন কত স্বাধীন! সময়, ভূগোল কিছুই মানে না। শিবশঙ্কর নিজের ঊরুতে একবার হাত বুলোলেন। গভীর একটা ক্ষত চিহ্ন। শার্পনেলের টুকরো ঢুকে গিয়েছিল। আর্মি হসপিটালে তিন মাস শুয়ে থাকতে হয়েছিল। তখন পেনিসিলিন আসেনি। ভরসা সালফার ড্রাগস। পা’টা হয়তো কাটাই যেত। এক ইতালিয়ান সার্জেন বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি ইংল্যান্ডে শিক্ষাপ্রাপ্ত। এনিমি নন। শিবশঙ্করের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল খুব।

অদূরেই জয় আর জয়া মাদুর পেতে একমনে অঙ্ক কষছে। শিবশঙ্করও লছমিকে ‘সাহারা’ বলে ডাকতে শুরু করেছেন। সাহারা মুহুয়াগাছের ছায়ায় বসে কবিরাজি ওষুধের গুলি পাকাচ্ছে। শিবশঙ্করের একটু তন্দ্রামতো আসছে। সেই তন্দ্রার ঘোরে দেখছেন। একটা বড় বইয়ের শেষ পাতাটা তিনি যেন পড়ছেন। বিহারে বাঙালির ইতিহাস। শেষ পাতায় দেখতে পাচ্ছেন কিছু ছবি। পাহাড় পাহাড়ের জায়গায়, নদী নদীর জায়গায়, কেবল বাঙালিদের বাড়িগুলিই ভেঙে পড়েছে। ধ্বংসস্তূপ। গোলাপবাগান শুকিয়ে ছার। ফোয়ারা জল ছুড়ছে না। দরজা, জানলা লোপাট। লোহার গেট অদৃশ্য। থাম, পিলার, আর্চ হেলে গেছে। হলঘরের কার্পেটে সাত পুরু ধুলো। গ্যারাজে মোটর গাড়ির কঙ্কাল। আস্তাবলে সাপ। দেওয়ালে পূর্বপুরুষের অয়েল পেন্টিং হেলে আছে। একটা ওয়াল ক্লকের খাঁচা। ডায়াল নেই। শুধু পেন্ডুলামটা ঝড়ের বেগে দুলছে।

শিবশঙ্কর নিদ্রিত অবস্থাতেই ফুঁপিয়ে উঠলেন চাপা কান্নায়। সাহারা ছুটে আসছে, “কী হল দাদি!”

॥ ৪২ ॥

প্রথমে শিবশঙ্কর বুঝতে পারছিলেন না তিনি কোথায় আছেন। একটা মেয়ের মুখ কুঁকে আছে তাঁর মুখের ওপর। ছোট্ট নাকে দুলছে ছোট্ট একটা নোলক। প্রথমেই দেখতে পেয়েছেন সাহারাকে। এপাশে জয়, ওপাশে জয়া। তিনজনেই একসঙ্গে প্রশ্ন করছে, “তোমার কী হয়েছে দাদি! তুমি অমন করছ কেন?”

শিবশঙ্কর পরিবেশে ফিরে এসেছেন। মুখে ফুটে উঠেছে হাসি। তিনজনকেই একসঙ্গে জড়িয়ে ধরে বললেন, “বয়েস! বয়েস হয়েছে আমার। তাই যৌবনের জন্যে কাঁদছি গো। অনেককাল আগে আমাদের আস্তাবলে একটা বৃদ্ধ ঘোড়া ছিল। সে দুপুরবেলা কাঁদত। দু’চোখ বেয়ে জল ঝরছে। বুঝতে পারতুম, কেন কাঁদছে! শক্ত মাটিতে টগবগ করে দৌড়তে পারে না বলে তার এই কান্না। শক্তি হারালে জীব জড় হয়ে যায়। এই দ্যাখ না, এই চেয়ারটার সঙ্গে আমার কোনও পার্থক্য আছে? আমিও পড়ে আছি, এও পড়ে আছে। দুটোই সমান। বই হাতে নিয়ে আমার যৌবনের কথা ভাবতে-ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছি। স্বপ্ন দেখছি, আমার সেই কুমায়ুনের জঙ্গল, আমার সেই ব্যায়াম করা ফৌজি শরীর। আমার ছেলে তখন তোমাদের মতোই কিশোর। আমার একটা মেয়ে ছিল। সে-কথা তো আমি ভুলেই গেছি। সে বেঁচে থাকলে তোমাদের বাবার একজন দিদি থাকত। সাত বছর যখন বয়েস, হিল-ডায়েরিয়ায় মারা গেল। কোনওভাবেই বাঁচানো গেল না। সেই দুঃখটাকে আমি কাজ দিয়ে চাপা দিয়ে রেখেছি। মনে পড়ে গেলেই কষ্ট হয়। কেন আমার কাছে এল, কেনই বা চলে গেল, কোথায়ই বা গেল! যখন ভাবি, তখন কোনও কূলকিনারা খুঁজে পাই না।”

শিবশঙ্করের একটা হাত সাহারা ধরেছে, আর একটা হাত জয়া।

“চলো, ওঠো। তোমাকে আর বসতে হবে না। আমাদের সঙ্গে বেড়াতে চলো। বিকেল হয়েছে। রোদ পড়ে এসেছে। আমরা সাঁকো পেরিয়ে সরলা নদীর দিকে চলে যাব। যাওয়ার পথে সিংজির বাড়িটা একবার দেখে যাব। তোমার তো আগে মন খারাপ হত না এমন।”

শিবশঙ্কর ডেকচেয়ার থেকে নিজেকে তুলতে তুলতে বললেন, “মন বড় ছটফটে মা, বর্তমানের সঙ্গে বেঁধে না রাখলেই অতীতে পালাতে চায়। অতীত যেন মধু।”

জয়া বলল, “কই আগে তো তোমার এমন মন খারাপ হত না, এখন হচ্ছে কেন?”

“তোদের হারাবার ভয়ে।”

“আমরা কোথায় হারিয়ে যাব দাদি! আমরা হারাব কেন?”

“উদয়ন বদলি হয়ে যাচ্ছে। তোরা মনে হয় লখনউ চলে যাবি দিদি। খুব শিগগির।”

“কে বলেছে তোমাকে? কই আমরা তো কিছু শুনিনি।”

উদয়ন এর আগে আমাকে একবার বলেছিল। কাল আবার বলল। অর্ডার নাকি এসে গেছে।’

“না, বাবাকে আমরা বলব, এই জায়গা ছেড়ে কোথাও যাওয়া হবে না। এখানে আমরা বড় হয়েছি। এই জায়গাকে আমরা ভালবাসি। এই নদী, পাহাড়, জঙ্গল, মাটি। আমরা যাব না।”

“এখানে শুধু তোরা বড় হয়েছিস? এখানে আমিও বড় হয়েছি। আমার বাবা এখানে প্রথম এসেছিলেন ডাক্তার হয়ে। এই জায়গায়, এই বাংলোতে। এটা ছিল একজন চিনা ম্যাজিশিয়ানের। তাঁর কাছ থেকে বাবা কিনেছিলেন। পরে এটাকে অদলবদল করেছিলেন। তারপর আমি এঞ্জিনিয়ার হয়ে ফিনিশিং টাচ দিয়েছি। এই বাড়িতে তোর বাবা বড় হয়েছে। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে।”

“আমরা কিছুতেই যাব না দাদি।”

“তা বললে কী হয় দিদি! তোদের বাবা ইণ্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিসের ডাক্তার। আমার বাবার খুব ইচ্ছে ছিল, নাতিকে বড় ডাক্তার করবেন। তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছে। তার সামনে পড়ে আছে বিরাট ভবিষ্যৎ। শুনছি ভিয়েনা যাবে হার্টের ওপর আরও জানতে, শিখতে। যদি অস্ট্রিয়ায় সেট্ল করে, তা হলে তোমাদেরও যেতে হবে। সে এক অসাধারণ দেশ। শিক্ষিতের দেশ। সুন্দরের দেশ। না ঘুরলে জীবনকে কি জানা যায় দিদি! আমিও কত ঘুরেছি। আমার বাবা তখন এখানেই একা একা কাটিয়েছেন। তাঁর মনটা ছিল ইংরেজদের মতো। বলতেন, এক জায়গায় পড়ে থাকলে মানুষ কূপমণ্ডুক হয়ে যায়। পৃথিবীকে দ্যাখো, জীবনকে গতিশীল করো। অভিজ্ঞতা অর্জন করো। সাহসী হও। যোদ্ধা হও। আমার ছেলেকেও তাই হতে হবে। তোমাদেরও সেই পথ। তখন ছিল ইংরেজ আমল। দেশটা ছিল এক শাসনে বাঁধা। এখন তো সব টুকরো টুকরো। মানুষও আর আগের মতো নেই। মানুষে মানুষে আর আগের ভালবাসা নেই। এই জায়গার অর্থনীতি দিন দিন মরে আসছে। সবাই খুব লাফিয়েছিল, সরলা নদীর ওপারে সোনা পাওয়া যাবে। সব মিথ্যে। ম্যানফ্রেড ছুটে এল। সেই যে গেল, আর পাত্তা নেই। এই জায়গায় বাঙালির আর ফিউচার নেই। দিন দিন ঘৃণা বাড়ছে। আমাদের সকলকেই একদিন যেতে হবে। উদয়নের সঙ্গে কাল অনেক রাত পর্যন্ত আমার ওইসব কথাই হচ্ছিল। যতদিন পারা যায় আমরা বুড়ো-বুড়ি এই বসবাস আগলে রাখি। তোমরা নতুন জায়গায় গিয়ে নতুন ভবিষ্যৎ তৈরি করো। আজ সকালে আর একটা খবর শুনে মন খারাপ হয়ে গেল, চার্চের বিদেশি ফাদার আর নানরা সব দেশে ফিরে যাচ্ছেন। রাজনৈতিক চাপে তাঁরা এখানে আর আগের মতো কাজ করতে পারছেন না।”

একটু পরে সবাই দল বেঁধে রাস্তায় নেমে পড়লেন। পথ সেই আগের মতোই আছে। পথের কোনও পরিবর্তন হয় না। চারপাশে শাল আর মহুয়া। পলাশে ফটাস-ফটাস ফুল ফুটেছে। কৃষ্ণচূড়া লাল। পশ্চিমে সূর্য ঢলেছে। রাস্তার ওপর দিয়ে পিছলে যাচ্ছে আলো। চার্চে নতুন রং পড়েছে, চূড়াটা ঝলমল করছে শেষ বেলার আলোয়। ঝকঝকে নতুন সাইকেলে চেপে চলেছেন নীল পোশাকপরা ডাকপিয়ন। কোথাও কোনও পরিবর্তন নেই। যা কিছু সব মনে। একজন নেই। যে নেই, সে না থাকায় মনে হচ্ছে জায়গাটাই নেই। সে হল খড়ক সিং। জায়গাটার আত্মাটাই যেন বেরিয়ে চলে গেছে। খোলসটা পড়ে আছে।

পথেই পড়ল শিরিনদের বাড়ি।

শিবশঙ্করই প্রথমে বললেন, “শিরিনের অনেকদিন কোনও খবর নেই, কেন বল তো?”

জয়া বলল, “স্কুলেও আসছে না অনেকদিন। অথচ সামনেই পরীক্ষা।”

“খবর নাওনি কেন?”

“পড়ার চাপে সময় পাইনি দাদি।”

“চলো একবার ঘুরে যাই।”

কাঠের গেট। গেট পেরোলেই ছোট্ট বাগান। নিজের খেয়ালেই ফুল আছে ফুটে। মাটি শুকনো খটখটে। ঝরা পাতা। কোথাও কোনও সাড়া শব্দ নেই। পাথর বাঁধানো পথ। সামনেই সাদা রক। তিন ধাপ সিঁড়ি দরজায় বিশাল এক তালা। জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই। খরগোশের খাঁচা শূন্য। বাড়িটা গোল হয়ে ঘুরে এলেন সবাই মিলে। পেছনে ইদারা। লম্বা লম্বা পেঁপে গাছ। ফলের ভারে নড়তে চড়তে পারছে না।

শিবশঙ্কর সব দেখেশুনে বললেন, “মনে হচ্ছে বেশ কিছুদিন ওরা এখানে নেই। রকের ওপর বাতাসের তৈরি বালির রেখা। গেল কোথায়! না বলে তো যায় না! কী জানি, কী আবার হল!”

হঠাৎ নিচু হয়ে কী একটা তুললেন, কাগজের মতো। দোমড়ানো মোচড়ানো। “দেখেছ! ভাঁজ করা একটা দু’টাকার নোট। মনে হচ্ছে, সবাই খুব তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে চলে গেছে।”

শিবশঙ্করকে খুব চিন্তিত দেখাল। কী হল শিরিনদের! দিনকাল মোটেই ভাল নয়! কে যে কখন কী করে ফেলে। গেট-খোলা। বাগানে যে কেউ ঢুকে পড়তে পারে। অবশ্য এদিকের মানুষ এখনও তেমন অসৎ হয়ে যায়নি। সবাই মনমরা হয়ে সরলা নদীর দিকে এগিয়ে চললেন। কিছু দূর গিয়ে শিবশঙ্কর বললেন, “আমরা খবর নিইনি বলে শিরিনের অভিমান হয়েছিল, সেই কারণে বিপদে পড়েও আমাদের কোনও খবর দেয়নি। যেভাবেই হোক খবরটা নিতে হবে। কাল সকালে পোস্টাপিসে গিয়ে মাস্টারবাবুকে জিজ্ঞেস করতে হবে। মনটা বড় উতলা হয়ে রইল। খুব অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে।”

কথায় কথায় তাঁরা খড়ক সিংয়ের বাগানের সামনে এসে পড়লেন। গেট ঠেলে ঢুকলেন সবাই। অনেক পাখি এসে নেমেছে। খোলা জায়গাটা তাদের কলরবে মুখর। বড় বড় গাছ বাতাসে মাথা দোলাচ্ছে। সিংজি অনেক খেটে বাগানটাকে তৈরি করেছিলেন। নানা দেশের গাছ লাগিয়েছিলেন। এপাশে-ওপাশে বেদি তৈরি করিয়েছিলেন বসার জন্য। এপাশে-ওপাশে সুন্দর সুন্দর সাদা ফেনসিং। মানুষটার যেমন উঁচু নজর ছিল, সেইরকম রুচি।

শিবশঙ্কর সকলকে নিয়ে বাগানের মাঝখানে একটা বেদিতে বসলেন। খুব হাওয়ার বিকেল। গাছের মাথায় ঝপঝপ শব্দ হচ্ছে। শিবশঙ্কর নাতি-নাতনিদের নিয়ে বেশ আরামে বসেছেন। সকলেই তাঁকে ঘিরে আছে। সাহারা তার মাথাটা শিবশঙ্করের পিঠে ঠেকিয়ে রেখেছে। জয় বাগানটায় একবার চক্কর মেরে এসে বলল, “দাদি, এই বাগানবাড়ির কী ব্যবস্থা হবে?”

“সেটাও তো চিন্তার। কেউই তো এল না দখল নিতে। জানো তো, এরই মধ্যে সত্যি মিথ্যে জানি না, একটা খবর পেলুম, খড়ক সিং সত্যিই নাকি রাজস্থানের একটা স্টেটের রাজা হতে পারত। সিংহাসনের উত্তরাধিকার তারই ওপর বর্তাত। রাজা হওয়ার ভয়ে সে একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। সে এক হইচই ব্যাপার। ইংরেজের পুলিশ। তারা তো ছেড়ে কথা কইবে না। তারা এসে খড়ক সিংয়ের পরের ভাইকে খুনের দায়ে গ্রেফতার করল। সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে মামলা টিকল না। রহস্য রহস্যই রয়ে গেল। সেই সময়কার কাগজপত্রে এই নিয়ে প্রচুর লেখালিখি হয়েছিল। খড়ক সিং আসলে কে, এই তথ্য একজন মাত্র জানতেন, তিনি বেনারসের এক সাধু। তিনি মৃত্যুর আগে রাজস্থানের সেই এস্টেটের ইংরেজ রেসিডেন্টকে জানিয়ে গিয়েছিলেন। তখন স্বাধীনতার আগে সেই এস্টেটের প্রাপ্য ভাগ সিংজিকে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। সিংজি নেননি। তবু সিংজির ভাই দাদার জন্য ধনদৌলতের একটা অংশ আলাদা করে রেখেছিলেন। সিংজির ভাই তো সিংজির মতোই সৎ হবেন। আমার ধারণা, এটা গল্পকথা নয়, সত্য ঘটনাই। এখন তো আর সেই রাজা নেই, থাকলে সব জানা যেত।”

সবাই অবাক হয়ে গল্প শুনছে।

শিবশঙ্কর সাহারাকে বললেন, “তোর এমন বরাত, তুই একটা রাজাকে পেয়েও হারালি। এখানে সিংজির নামে যতদিন না একটা কিছু করতে পারছি, ততদিন আমার শান্তি নেই।”

জয়া বলল, “বাবা চলে গেলে, তুমি একা-একা করবে কী করে!”

“এই কাজটার জন্য তোমার বাবাকে তো আটকে রাখা যাবে না। একাই তো অনেক কিছু করেছি, এটাও না হয় একাই করব। সঙ্গে চাবিটা এনেছ নাকি, তাহলে বাড়ির ভেতরটা একবার দেখে যাই।”

“চাবি যে আনিনি দাদি।”

“তা হলে চলো, সরলাতেই যাই। সন্ধের মুখে জায়গাটা বেশ ভালই লাগবে।”

সবাই হাঁটতে-হাঁটতে গল্প করতে করতে নদীর দিকে চললেন। শেষ দিনের আকাশটা কাচের মতো হয়ে উঠেছে।

॥ ৪৩ ॥

সবাই খেতে বসেছেন। টেবিলটা বিরাট। প্রাচীন আমলের। শিবশঙ্করের পিতা এক সাহেবের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন। অনেক কারুকার্য। খুব যত্নে থাকে এ বাড়ির সব কিছু। শিবশঙ্করের দু’পাশে জয় আর জয়া। বিপরীত দিকে উদয়ন, পাশে সাহারা। রাত ন’টা। বাড়িটা খালি-খালি লাগছে। সব বাঁধছাঁদা হয়ে গেছে। উদয়ন সঙ্গে বিশেষ কিছু নিচ্ছেন না। কিছু জামাকাপড়, চাদর, প্রয়োজনীয় বই। সবই কিনে নেবেন নতুন জায়গায় গিয়ে।

নানারকমের রান্না হয়েছে আজ। বিদায় ভোজ। কেউই তেমন প্রফুল্ল মনে খেতে পারছে না। চেষ্টা করছে। মজার-মজার কথা হচ্ছে। জোর করে সবাই হাসছে। মাঝে-মাঝে মিইয়ে যাচ্ছে। সব চুপচাপ। হঠাৎ যেই মনে পড়ছে বিষণ্ণ হলে তো চলবে না, সঙ্গে-সঙ্গে কথা। আবার হাসি। ভীষণ এক টানাপোড়েনে পড়েছে মন। তারই মধ্যে চলেছে খাওয়ার অভিনয়। শিবশঙ্কর একবার বললেন, “মাছের কালিয়াটা বড় জবরদস্ত বেঁধেছে আজ বউমা। তোমার কাছে কাঁচালঙ্কার আর্টটা আমাকে শিখতে হবে। তুমি একটা রান্নার বই লেখো, নাম দাও ‘সপ্তপদী’। ভূমিকাটা আমাকে লিখতে দিয়ো।”

ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘ফ্ল্যাট। শিবশঙ্করের কথাটা সেই রকম ফ্ল্যাট হয়ে হারিয়ে গেল, কারও মন স্পর্শ করল না। জয় বেড়ালটাকে দেখছে। ছেলেবেলা থেকে সে আর দিদি কোলেপিঠে করে মানুষ করেছিল। একপাশে চোখ মুদে নিশ্চিন্ত আরামে বসে আছে। ভেতরে আরাম যখন খুব জমে যাচ্ছে, আর রাখা যাচ্ছে না, তখন হাই তুলে বাইরে একটু ছেড়ে দিচ্ছে, প্রেশার কুকারের স্টিমের মতো। টেবিলে যারা বসেছে, তাদের কথা হল—ভাঙব তবু মচকাব না।

প্রথমে যে ভাঙল, সে সাহারা। খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। গিলতে পারছিল না। কান্নার দলা আটকাচ্ছিল গলার কাছে। হঠাৎ চেয়ার ঠেলে দুদ্দাড় করে ছুটে চলে গেল বাইরে। একেবারে বাগানে। সেখানে চাঁদের আলোর ফিনিক ফুটছে। একটা বেশ বড় আকারের ব্যাঙ বেড়ার ধারে থপাক-থপাক করে লাফিয়ে উঠছে মাঝে-মাঝে। শান্তিতে বসতে দিচ্ছে না সুস্বাদু কিছু পোকা। তা না হলে ধ্যানটা এতক্ষণে বেশ জমে যেত।

সাহারাকে ওইভাবে ছুটে যেতে দেখে জয় অনেকক্ষণ ধরেই ভাঙব-ভাঙব করছিল। সাহারাই পথ দেখাল। জয় শিবশঙ্করের পাশ থেকে কোনও কথা না বলে উঠে চলে গেল। শিবশঙ্কর বললেন, “এইবার একে-একে সব আপসেট হচ্ছে। আমার কিন্তু কিছু হচ্ছে না; কারণ আমার স্বভাবটা হল প্যাটন ট্যাঙ্কের মতো। উদয়ন, তোমার কিছু হচ্ছে!”

উদয়ন কোনও উত্তর দিতে পারলেন না। নীরবে উঠে চলে গেলেন। সঙ্গে-সঙ্গে জয়া। বিশাল টেবিলে একা শিবশঙ্কর। ঝলমল করছে আলো। সাদা পোর্সিলেনের নানা আকারের প্লেট। ফিনফিনে কাচের গেলাসে টলটলে জল। রান্নাঘর থেকে খাওয়ার ঘরে আসার দরজায় থমকে দাঁড়িয়ে জয়ের মা আর দিদা। দু’জনেরই হাতে খাবার প্লেট। একটা কিছু পরিবেশন করতে আসছিলেন তাঁরা। এতক্ষণে বেড়ালটা উঠে আড়মোড়া ভাঙছে। সে কিছু বুঝতে না পেরে মিউ করে একবার ডাকল। তারপরে টুক করে লাফিয়ে উঠল শিবশঙ্করের কোলে। তিন পাক ঘুরে লেজ গুটিয়ে বেশ জুতসই করে শুয়ে পড়ল। শোওয়ামাত্রই আদরের ঘড়ঘড় শব্দ। সাদা ধবধবে, ভীষণ লোমলা একটা কাবুলি বেড়াল।

শিবশঙ্কর নিজের মনেই বললেন, “যাদের মন নেই, পৃথিবীতে তারাই সুখী।”

সারা বাড়িতে একটা থমথমে পরিবেশ। কখনও একটা বাসন রাখার শব্দ। কখনও কল খোলার। কখনও সংক্ষিপ্ত আদেশ। বেড়ালটাকে খেতে দে। কুকুরটাকে বাগানে ঘুরিয়ে আন। শিবশঙ্কর ডেকচেয়ারে আধশোয়া হয়ে ভাবছেন, কাল থেকে নতুন আর একরকমের জীবন শুরু হবে। অকারণে কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না। এক-একটা পরিস্থিতিতে যে-কোনও কথাই খুব অবান্তর মনে হয়। সরলা স্টেশন ছুঁয়ে রাতের শেষ ট্রেন চলে যাচ্ছে। সেই হুহু করা শব্দটা শিবশঙ্কর শুনছেন। বয়েসের সঙ্গে-সঙ্গে মনের আঁটসাঁট ভাবটা নষ্ট হয়ে যায়। আজেবাজে চিন্তা আসে। যেখানে বসে আছেন সেইখান থেকে সরলা ডাকঘরের বাড়ির একটা অংশ দেখা যায়। বাইরের দেওয়ালে একটিমাত্র আলো জ্বলছে। সারা রাত জ্বলে থাকবে একা আলো। জ্বলে থাকাটাই তার কর্তব্য, যেমন শিবশঙ্করের বেঁচে থাকাটাই অবশিষ্ট কয়েক বছরের কর্তব্য।

ভেতরের ঘরে কেউ একজন ফুপিয়ে কাঁদছে। বোঝার চেষ্টা করলেন, কে? মনে হচ্ছে, জয়ার মা। মেয়েটা বড় ভাল। এক নম্বর মেয়ে। বড় স্নেহের পাত্রী। এত বছর সংসারে আছে। রাগতে তো জানেই না, সবসময় মুখে একটা হাসি। এই প্রথম শিবশঙ্কর তাকে কাঁদতে দেখছেন।

জয়, জয়া আর সাহারা রাতের অন্ধকারে অদ্ভুত একটা কাজে ব্যস্ত। পরিকল্পনাটা জয়ের। একটা কাগজে তারা লিখেছে:

প্রিয় শিউলি,

তোমাকে এনেছিল জয়া খড়ক সিংয়ের বাগান থেকে। সঙ্গে ছিল শিরিন। তুমি বড় হলে আমাদের চোখের সামনে। তুমি আমাদের আর-এক বোন। তুমি প্রতি শরতে সন্দর ফুল ফোটাবে। এখন যেমন ফোটাচ্ছ। রোজ সকালে, একটা, দুটো, অনেক অনেক, ফুল তুমি বিছিয়ে রাখবে তলায়, ঘাসের ওপর। আমরা থাকছি না। কালই চলে যাচ্ছি অনেক দূরে। তোমার কাছে আমাদের আর এক বোন সাহারা থাকছে। তুমি আমাদের দাদি আর দিদাকে দেখো। আমাদের আরও এক বোন শিরিন না বলে কোথায় চলে গেছে, যদি ফিরে আসে তার হাত ভরে দিয়ো ফুলে। চার্চের ফাদার আর সিস্টারদের দেখো। আর আঙ্কল ম্যানফ্রেড যদি ফিরে আসেন, তাঁকে বোলো, মোটর সাইকেল তো আছেই আমাদের ওখানে একবার যেতে। মানফ্রেড মারা গেছেন এ-কথা আমরা বিশ্বাস করি না।

তুমি ভাল থেকো। অনেক, অনেক বছর বেঁচো। তুমি হলে শিশিরের ফুল। আমরা যদি না আসি, তুমি আমাদের অপেক্ষায় থেকো। তোমাকে আমরা ভুলব না কোনওদিন।

ইতি তোমার

জয় ও জয়া।

এইবার কী হবে! জয়া একটা শিশির মধ্যে চিঠিটাকে গোল করে পাকিয়ে ঢুকিয়েছে। মুখটাকে ভাল করে বন্ধ করেছে ছিপি আর গালা দিয়ে। দুপুরবেলা তিনজনে মিলে বেশ গভীর একটা গর্ত খুঁড়ে রেখেছিল শিউলিতলায়। গর্ত থেকে যা মাটি উঠেছিল সারাদিনের রোদে শুকিয়ে বেশ ঝুরঝুরে হয়েছে। জয়া খুব সাবধানে বোতলটাকে সেই গর্তে শোওয়াল। বোতলের গলায় নিজের হাত থেকে খুলে একজোড়া চুড়ি পরিয়েছে। সাবধানে ঝুরো ব্যুরো মাটি ফেলছে তিনজনে। ঝুপঝাপ শব্দ। গর্তটা ভরে গেল। হাত দিয়ে চেপে-চেপে মাটি বসিয়ে জায়গাটা সমান করে তার ওপর ঘাস বিছিয়ে দিল।

জয়া সাহারাকে বলল, “কারওকে বলবি না এখানে কী আছে। তুই তো থাকবি, জায়গাটা পাহারা দিবি। বর্ষায় যদি দেবে যায়, আর একটু মাটি দিয়ে দিবি। লক্ষ্মী বোন আমার!”

রাতের অন্ধকার, তবু তারা টর্চ জ্বেলে বাগানটা একবার চক্কর মেরে এল। গন্ধরাজ গাছগুলো ফুলে-ফুলে সাদা হয়ে গেছে। গন্ধে চারপাশ আমোদিত। কাল রাতে তারা তো আর এখানে থাকবে না। তখন অনেক-অনেক দূরে। রাতের বাগানের রহস্যটা তাই শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছে।

তারা রকে উঠতে-উঠতে শুনল, দাদি বলছেন, “তোমরা এইবার শুয়ে পড়ো, কাল ভোর-ভোর উঠতে হবে। সকালেই ট্রেন। মনে আছে তো!”

উদয়নের ঘরের মেঝেতে সার-সার ব্যাগ আর সুটকেস। সব গোছগাছ করে সাজানো। প্রত্যেকটায় ক্যালেন্ডার থেকে সংখ্যা কেটে লাগানো হয়েছে, এক, দুই, তিন। নাম, ঠিকানা লেখা হয়েছে। উদয়ন নিজের খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন, পায়ের ওপর পা, কপালের ওপর ভাঁজ করা দুটো হাত। ওপরের ঠোঁট দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে আছেন। নিজের সঙ্গে যখন বোঝাপড়া চলে তখন এইটাই তাঁর চিরপরিচিত ভঙ্গি। এই সময় কেউ তাঁকে বিরক্ত করে না। উদয়ন মিতবাক স্বভাবের মানুষ। সবসময় নিজের ভাবেই মগ্ন থাকেন।

জয়, জয়া আর সাহারা দিদার খাটে। দিদাকে ঘিরে বসেছে। বেড়ালটাও আছে। নিশ্চিন্ত মনে গা চাটছে নানাভাবে, নানা কায়দায়। যেন একটু পরেই কোনও দূর দেশে বেড়াতে যাবে। জয়া তার নরম তুলতুলে গায়ে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, “তুই কোথাও বেড়াতে যাবি নাকি রে পুসি!”

পুসি তার ব্যস্ততা থামিয়ে জয়ার দিকে মুখ তুলে আধবোজা চোখে বললে, “মিউউ।” জয় দিদার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। উলটো হাতে গলাটা জড়িয়ে ধরে বলল, “একটা গল্প বলো না দিদা, সেই ছেলেবেলার গল্প, এক যে ছিল রাজা, আর এক যে ছিল রানি।”

দিদা বলছেন, “সে রাজ্য নেই, রাজা নেই, রানিও আর নেই। রাজপুত্র আর রাজকন্যা গেছে দূর বিদেশে লেখাপড়া করতে। তারা বলেছে, জ্ঞানের রাজ্য জয় করে, সেই রাজত্বের রাজসিংহাসনে বসবে। তারাও যুদ্ধ করবে। জ্ঞানের তরোয়াল দিয়ে অন্ধকার, অজ্ঞান, কুসংস্কার, অভাব, অত্যাচারের সঙ্গে লড়াই করবে। তাদের মহারাজাধিরাজ, মহাজ্ঞানেশ্বর, স্বামী বিবেকানন্দ। তিনি সেই রাজকুমারকে দুটো তরোয়াল ঘোরাতে শিখিয়েছেন, ত্যাগ আর বৈরাগ্য। দুটা ধবধবে সাদা ঘোড়া কিনে দিয়েছেন, একটার নাম কর্ম, আর একটার নাম ধর্ম। একটা ঝকঝকে রথ দিয়েছেন, সেই রথের নাম সংযম। সেই রথের সারথি এক উজ্জ্বল পুরুষ, তাঁর নাম বিবেক। আর মহাশিক্ষক হলেন, সময়। এই হল চিরকালের গল্প। এইবার আমার এক প্রিয় কবিতার শেষটা শোননা:

“যতদূর যতদূর যাও, বুদ্ধিরথে করি আরোহণ,

এই সেই সংসার-জলধি, দুঃখ সুখ করে আবর্তন।

পক্ষহীন শোন বিহঙ্গম, এ যে নহে পথ পালাবার,

বারংবার পাইছ আঘাত, কেন কর বৃথায় উদ্যম?

ছাড় বিদ্যা জপ যজ্ঞ বল, স্বার্থহীন প্রেম যে সম্বল;

দেখ, শিক্ষা দেয় পতঙ্গম— অগ্নিশিখা করি আলিঙ্গন।

রূপমুগ্ধ অন্ধ কীটাধম, প্রেমমত্ত তোমার হৃদয়;

হে প্রেমিক, স্বার্থ-মলিনতা অগ্নিকুণ্ডে কর বিসর্জন।

ভিক্ষুকের কবে বল সুখ? কৃপাপাত্র হয়ে কিবা ফল?

দাও আর ফিরে নাহি চাও, থাকে যদি হৃদয়ে সম্বল।

অনন্তের ভুমি অধিকারী, প্রেমসিন্ধু হৃদে বিদ্যমান,

‘দাও, দাও’—যেবা ফিরে চায়, তার সিন্ধু বিন্দু হয়ে যান।

ব্রহ্ম হতে কীট-পরমাণু, সর্বভূতে সেই প্রেমময়,

মন প্রাণ শরীর অপর্ণ কর, সখে, এ সবার পায়।

বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুজিছ ঈশ্বর?

জীবে প্রেম করে যেই জন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।

চোখ বুজে আবৃত্তি করছিলেন। চোখ খুলে দেখলেন, সামনে পরিপূর্ণ সংসার। সুরেলা, দৃপ্তকণ্ঠের আবৃত্তি শুনে সবাই ঘরে চলে এসেছেন। স্বামী, পুত্র, পুত্রবধ, কাজের মেয়েরা, বাগানের মালী। শিবশঙ্কর বললেন, “অনেকদিন পরে তুমি বেরিয়ে এলে। তা হলে একটা গানও হয়ে যাক।”

বৃদ্ধা এককথায় ধরলেন, রবীন্দ্রনাথের গান, “মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে/আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে।”

এক সময় গান শেষ হল। একে-একে সব আলো নিভে গেল। শুধুমাত্র একটি দেওয়ালঘড়িতে সময়ের টিকটিক চলার শব্দ।

সকাল ছ’টার সময় বাড়ি একেবারে খালি। সবাই সরলা স্টেশনে। ট্রেন আসবে ছ’টা কুড়িতে। ছেড়ে যাবে ছটা তিরিশে। মাস্টারমশাই বেরিয়ে এসেছেন প্ল্যাটফর্মে, “ডাক্তারবাবু আমারে ছেড়ে সত্যিই তা হলে চললেন!”

উদয়ন বললেন, “আমার একেবারেই যেতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু কী করব আমার চাকরি।”

“আমাদের শহরটা এইবার সত্যিই খালি হয়ে গেল। আমার চাকরি আর মাত্র এক বছর আছে। তারপর আমিও চলে যাব মুঙ্গেরে। আপনি যাচ্ছেন প্রবাসে, আর আমি যাব আবাসে, তাও আমার দুঃখ লাগছে। এই জায়গাটার একটা মায়া আছে।”

চার্চের ফাদার বললেন, “সামনের মাসে আমরাও ফিরে যাচ্ছি স্কটল্যান্ডে।”

মাস্টারমশাই বললেন, “শ্মশান হয়ে গেল! শিবশঙ্করবাবু, আপনি কী করবেন?”

“নতুন যাঁরা আসবেন আমি তাঁদের নিয়েই নতুনভাবে বাঁচতে শিখব। মানুষ চলে গেলেও জায়গাটা তো পালাচ্ছে না। আমার কোনও দুঃখ নেই। আই নো হাউ টু লিভ!”

ট্রেন আসছে। সেই নিষ্ঠুর যন্ত্র, যে মানুষের কাছ থেকে মানুষকে নিয়ে চলে যায়। শিবশঙ্কর জয় আর জয়াকে দেখছেন। কী সুন্দর বেড়ে উঠছে ছেলেমেয়ে দুটো। অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে। অসম্ভব হবে এদের ছেড়ে বেঁচে থাকা। সে-কথাটা তো বলা যায় না। বড়জোর একটা গান গাওয়া যায় মনে-মনে:

তোমার হল শুরু আমার হল সারা—

তোমায় আমায় মিলে এমনি বহে ধারা॥

তোমার জ্বলে বাতি তোমার ঘরে সাথী

আমার তরে রাতি, আমার তরে তারা॥

শিবশঙ্কর আবেগ অপছন্দ করেন, তাই মনে-মনে বললেন, যেখানেই থাক তোমরা বড় হও, মানুষ হও। তোমাদের মধ্যেই আমি বেঁচে থাকব। শিবশঙ্কর লক্ষ করছেন, সকলের চোখই ভরা নদী।

ট্রেন থামতে-থামতে একেবারেই থেমে গেল। এঞ্জিনের একটা আলাদা ধরনের ব্যক্তিত্ব আছে। বেপরোয়া কঠিন। প্রথম শ্রেণীর কামরা থেকে একজন মাত্র যাত্রী নামলেন। চোখে পড়ার মতো চেহারা। ছ’ ফুট লম্বা ছিপছিপে ধারালো চেহারা। পরনে শেরোয়ানি। দেখলেই মনে হয় যোধপুর থেকে আসছেন, ধনী মানুষ।

ভদ্রলোক এগিয়ে এসে পরিষ্কার ইংরেজিতে বললেন, “আমি খড়ক সিংজির ভাই। আপনারা!”

শিবশঙ্কর বললেন, “আমি, আমরা সবাই সিংজির বন্ধু। অনেক আগেই আপনাকে আশা করেছিলুম।”

“দুঃখিত, আমি ইংল্যান্ডে ছিলুম। আসামাত্রই আমার ম্যানেজার কাগজের বিজ্ঞাপনটা দেখালেন। সঙ্গে-সঙ্গে চলে এসেছি।”

“এই আমার ছেলে ডাক্তার উদয়ন। এই ট্রেনেই ওরা যাবে। একটু অপেক্ষা করুন, ওদের আগে তুলে দিই।”

“ও ইয়েস।”

ভদ্রলোক নিজেই মালপত্র তোলার জন্য ব্যস্ত হলেন। একেবারে নিরহঙ্কারী মানুষ, “ডক্টর ইওর ডেসটিনেশান?”

“লখনউ।”

“লখনউ! দ্যাট ইজ মাই ডেসটিনেশান। দ্যাট ইজ মাই সেকেন্ড হোম। এখান থেকে আমি ওখানেই যাব। তখন আপনার সঙ্গে দেখা হবে। ইউ উইল বি ইন দ্য জেনারেল হসপিটাল। আপনাকে আমি আমার গার্ডেন হাউসে রাখব। দ্যাটস দ্য বেস্ট লোকেশান ইন দ্য সিটি। আমাদের ক্লাবে আপনাকে মেম্বার করে নেব। ইউ উইল লাভ দ্য প্লেস।”

শিবশঙ্কর বললেন, “দেখলে, কী অভাবনীয় যোগাযোগ! সব যেন আগে থেকে ঠিক করা ছিল।”

হুইস্ল বাজল। ঠ্যাং-ঠ্যাং ঘণ্টা। ট্রেন এইবার ছাড়বে। কামরায় সবাই বেশ গোছগাছ করে বসেছে। প্রণামের পালা সাঙ্গ। কেউই কথা বলতে পারছে না। বলতে গেলেই কান্না বেরিয়ে আসবে।

ট্রেন গতি নিয়েছে। প্ল্যাটফর্ম থেকে সরে যাচ্ছে একসার মুখ। পুত্র, পুত্রবধূ, নাতি, নাতনি। দূরে, আরও দূরে। বাঁশির শব্দ। লোহার একটা সরীসৃপ সংসারের আধখানা ছিঁড়ে নিয়ে চলে গেল। শেষ, গার্ডের কামরাটা যেন ভাসতে-ভাসতে দৃষ্টিপথের বাইরে চলে গেল। পড়ে রইল প্ল্যাটফর্ম। একজোড়া নিষ্ঠুর রেল লাইন। আর কয়েকজন মানুষ। শিবশঙ্কর ফিরে তাকালেন নবাগতের দিকে, “চলুন। লেট্স গো।”

যেমন সময় বলে মানুষকে, চলো হে। চলতে তোমাকে হবেই। হয় এদিকে, না হয় ওদিকে। তুমি যদি নাও চলো, আমি তোমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাব আমার স্রোতে। আজ থেকে কালে, কাল থেকে আরও দূর কালে। অদৃশ্য এক মহাতরঙ্গ। বহুকাল পরে, কে কোথায় থাকবে! কেউ থাকবে না, কেউ থাকবে। এই নিবাস পরিত্যক্ত হবে। একটি সুখের সংসারের স্মৃতি। ভেঙে পড়া পাঁচিল। গেট নেই। পিলার দুটো আছে। আগাছায় ঢেকে গেছে বাগান। জীর্ণ বাড়ি, রোদে-পোড়া দরজায় বিশাল এক মরচে-ধরা তালা। উদয়ন কোথায়! হয়তে কলকাতায়। অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। জয় কোথায়? আমেরিকায়। জয়া? জয়া তো ইংল্যান্ডে। আর সাহারা! সে তো সরলাতেই সংসার করেছে। শিবশঙ্কর তাকে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে গেছেন।

শরতের ভোরে পরিত্যক্ত নির্জন বাগানে শিউলি তখনও আকাশের শিশির ধরে ফুল করে ঝরিয়ে চলেছে। তার তো চলা নেই। সময়েরও হিসেব সে রাখে না। সে শুধু জানে, সময়কে কেমন করে ফুলে ফোটাতে হয়, আর নিঃসীম আনন্দে নিঃশেষে ঝরাতে হয়।

____

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *