শিউলি – ৩০

॥ ৩০ ॥

একটা বড় বোতল পাওয়া গেল। গিরধারী বোতলটাকে চিনতে পেরেছে। গরমজল ভরছে আর মনে মনে বলছে, “দুবে, তোমার সব গুণই আছে। মেয়ে বিনাচিকিৎসায় মরো-মরো আর তুমি ব্যাটা নেশাভাঙ করছ। তোমাদের মতো মানুষদের কী করা উচিত জানেনা, মাটিতে পুঁতে ডালকুত্তা দিয়ে খাওয়ানো।”

জয়া বোতল দিয়ে লছমির পায়ে সেঁক দিচ্ছে। জয় কপালে জলপট্টি লাগাচ্ছে। শিবশঙ্কর, উদয়ন, দুবে, খড়ক সিং, গিরধারী বাইরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পরামর্শ করছেন, কী করা যায়! এখানে কিছুই পাওয়া যায় না। এক কবিরাজ আছেন, আর আছেন এক ওঝা। সাপে কামড়ালে কি ভূতে ধরলে চিকিৎসা করেন। সেসব ভয়ঙ্কর চিকিৎসা।

বাইরে গাছের পাতায় বাতাসের হুটোপাটি। এতক্ষণে চিনে-লণ্ঠনের মতো আকাশে একটা চাঁদ উঠেছে। পূর্ণিমার পর যেমন ওঠে। অনেক রাতে। ভৌতিক সঁদ। কোথায় কী ফুল ফুটেছে। তীব্র গন্ধ ভেসে আসছে। একটা পাখি আচমকা চ্যাঁ চ্যাঁ করে ডাকছে।

গিরধারী কোথায় ছিল কে জানে। এস বললে, “আর দেরি নয়, রাত দুটো বাজল। রান্না হয়ে গেছে। খাবেন চলুন।”

সামনের রকে যে যেমন পারলেন বসে পড়লেন। একটাই লণ্ঠন। আলোর তেমন মেজাজ নেই। শালপাতার থালায় মোটা-মোটা রুটি, জল আর আলুর তরকারি। তাই যেন অমৃত। দূরে কাঠের আগুনে ধিকিধিকি জ্বলছে। জঙ্গলের দিক থেকে নানারকম পোকা উড়ে এসে লণ্ঠনের ঘাড়ে পড়ছে। জয় ভয়ে দিদির গায়ে সিঁটিয়ে আছে।

জয়া বলছে, “ভাই! তুই এইসব পোকা আগেও কত দেখেছিস, আজ এত ভয় পাচ্ছিস কেন? এরা বেশিরভাগই হল জাতে ফড়িং, না হয় মথ, আর ওই বড়গুলো হল গুবরে। একবার চিৎ হয়ে গেলে আর উড়তে পারে না, পড়ে পড়ে সাঁতার কাটে ওই দেখ তিনটে এরই মধ্যে চিত হয়ে গেছে।”

জয় বলল, “আমার ভয় করছে ওই ঘুরঘুরেগুলোকে। এক-একটার সাইজ দেখেছিস দিদি! ঘুরঘুরে যদি কামড়ায়, মেঘ না ডাকলে ছাড়ে না।”

“কে তোকে এইসব আজগুবি কথা বলছে! আমাকে কতবার কামড়েছে! কিচ্ছু না, যেখানে কামড়াবে সেইখান থেকে অল্প একটু মাংস তুলে নেবে। একটু জ্বালা করবে, জায়গাটা লাল হয়ে ফুলে উঠবে। তাতে কী হয়েছে! পৃথিবীতে বাঁচতে গেলে মানুষকে কত কীই তো কামড়াতে পারে! আমাকে একবার কাঁকড়া বিছে কামড়েছিল। তুই তখন খুব ছোট। ট্যাঁট্যাঁ করে খালি কঁদতিস। তোয়ালের ওপর শুয়ে থাকতিস। আর মা বলত, এই আমার এক কাঁদুনে ছেলে হয়েছে। জয়ীটা আমার এইরকম ছিল না।”

“তুই তখন কী করতিস দিদি!”

“বাবু হয়ে বসে তোকে কোলে শুইয়ে হাঁটু নাচাতুম, আর আঁ-আঁ করে গান গাইতুম। খোকা ঘুমলো পাড়া জুড়লো বর্গি এল দেশে। বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দোব কিসে।”

“তখন আমি ঘুমিয়ে পড়তুম!”

“অতই সোজা! তোকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে নিজেই ঘুমিয়ে পড়তুম। তবে একটা ছড়ায় খুব কাজ হত, স্টোভের শব্দের সঙ্গে বললেই তোর ঘুম এসে যেত।” “মনে আছে?”

“মনে থাকবে না? ছড়া কেউ ভোলে? সেই ছড়াটা হল:

সৈদাবাদের ময়দা আর কাশিমবাজারের ঘি।

একটু সবুর করো খোকা, লুচি ভেজে দি।”

“লুচি! দিদি! এই সময় ফুলকো ফুলকো লুচি আর ঝালঝাল, লাললাল আলুর দম কেমন লাগত।” কথাটা বলেই কথাটা আবার ফিরিয়ে নিল জয়। “না রে দিদি, সত্যি বলছি, আমার খেতে ভাল লাগছে না। লছমি তো আমাদেরই বোন! সে মনে হয় সারাদিন কিছুই খায়নি। খেয়েছে রে দিদি!”

জয়া একটু ভেবে বলল, “মনে হয় খায়নি। কে খাওয়াবে! ওর বাবাটা যেন কেমন!”

“সকলের বাবা কেন আমাদের বাবার মতো হয় না!”

“হাতের পাঁচটা আঙুল কি সমান! হয়নি যখন হয়নি। কী আর করা যাবে বল?”

“দিদি, লছমি বাঁচবে তো!”

জয়ের গলা ধরে আসছে। জয়া জানে জয় এইবার কাঁদবে। এত নরম ওর মনটা! একবার তার খুব ধুম জ্বর হয়েছিল। জয়কে তার মাথার কাছ থেকে সরানো যায়নি। কানের কাছে মুখ এনে কখনও ফিসফিস করে বলে “দিদি, ডাঁসা পেয়ারা খাবি!” কখনও বলে, “নিমকি বিস্কুট খাবি! খুব ভাল লাগবে জ্বরের মুখে। মা সজনে ডাটা রেঁধেছে চেয়ে আনব? চিবোবি?” সারাদিনেও যখন জ্বর ছাড়ল না, তখন জয় বাবাকে কাঁদতে-কাঁদতে বলছে, “তুমি কী ডাক্তার সাতদিনেও দিদি ভাল হল না। দিদি, আমার মরে যাবে বাবা, আমার একটা মাত্র দিদি।” এমন পাগল ছেলে! শিউলি ফুলের মতোই নরম। একমাথা পশমের মতো চুল। খরগোশের মতো দুটো কুচকুচে কালো চোখ। তাকালেই মনে হয় কতকালের এক সাধু যেন বসে আছে চোখের ভেতর। বুদ্ধদেবের মতো বড়-বড় দুটো কান। হাত দুটো শরীরের তুলনায় অনেক লম্বা। দাদি বলেন, এসব নাকি ভীষণ ভাল লক্ষ্মণ। ওকে ঠিকমতো তোমরা মানুষ কোরো। শুধু লেখাপড়া করে বড়-বড় ডিগ্রি ডিপ্লোমা পেলেই, মানুষ মানুষ হয় না। সৎশিক্ষা দিতে হয়, জীবনের শিক্ষা। সব চেয়ে বড় শিক্ষা হল, মানুষকে ভালাবাসার শিক্ষা, প্রকৃতিকে ভালবাসার শিক্ষা, জীবজন্তুকে ভালবাসার শিক্ষা। সদাচার, সৎভাবনা, সৎসঙ্গ।

জয় আবার প্রশ্ন করল, “কী রে দিদি, বল না, লছমি বাঁচবে তো! তুই যা বলিস তা-ই হয়।”

“চল, ওঠ, সকলের খাওয়া হয়ে গেছে।”

বিশাল একটা গুবরে-পোকা ভো করে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে ঠকাস শব্দে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে চিৎ হয়ে পড়ে গেল মেঝেতে। যেন উড়ন্ত গণ্ডার। ইস্পাতের মতো শক্ত শরীর। মেঝেতে পড়েই সেই চিতসাঁতার কাটার ভঙ্গি। সারা রাত ওইভাবে থাকবে। ভোরবেলায় নিস্তেজ। পোকাদের যত দাপট রাতে। দিন হল পাখির, প্রজাপতির, ডানাকাঁপানো ফড়িংয়ের। ফড়িং যেন ছোট্ট ছোট্ট হেলিকপ্টার।

হাত ধুতে ধুতে জয় বলল, “কই দিদি,বললি না!”

“দাড়া, পরে বলব। ভেবে বলব।”

“তার মানে বাঁচবে না।”

“ছিঃ অমন কথা বলতে নেই। সব সময় প্লাস ভাববি। মাইনাস নয়।”

জয়ের হাই উঠল। গিরধারী পাশেই ছিল, বলল, “আমি বলি কী, তোমরা দু’জনে ট্রলিতে গিয়ে শুয়ে পড়ো। ব্যাগে কম্বল আছে, চাদর আছে। দু’ঘণ্টা ঘুমিয়ে নাও।”

শিবশঙ্কর দূরে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন। তিনি বললেন, “ফাকায় না শোয়াই ভাল। কত কী আছে। তা ছাড়া হিম পড়ছে, ঠাণ্ডা লেগে যাবে।”

“হাঁ, সো বাত তো ঠিকই হায়।”

“শের না থাক, জঙ্গলে কটাস আছে, জংলি কুকুর আছে, শেয়াল আছে।”

গিরধারী মাথা নেড়ে বলল, “শোচা নেহি।”

জয়া বলল, “দাদি, আমাদের ঘুমপায়নি। আমরা লছমির কাছে রাত জাগব।”

“সেই ভাল। আমি এই বাইরেটায় পায়চারি করব। রাতের আর কতটুকুই বা বাকি আছে!’

গিরধারী বলল, “থোড়ি হায় বাকি। সব রাত বুধ্গয়ি।”

শিবশঙ্কর বললেন, “থোড়ি কে লিয়ে, তাল নহি ছোড়ি! আহা! কী কথা! নর্তকী নাচছে। নেচেই চলেছে রাতভোর। শেষটায় আর যেন পারছে না। পা আর চলছে না। তখন একজন বলছে, এইবার না হয় বন্ধ করো। বিশ্রাম করো। নর্তকী বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখছে, রাতের আকাশে আলো ফুটছে। সারা রাতের মুজরো। সবাই দেখছে। সে হেরে যাবে! তখন বলছে, সব রাত বুধগয়ি, থোড়ি হায় বাকি, থোড়ি কে লিয়ে তাল নহি ছোড়ি। আমরাও তাল ছাড়ছি না। বুঝলে গিরধারী! দিনের প্রথম পাখিটা যেই ডেকে উঠবে, সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের ট্রলি স্টার্ট করবে। গিরধারী, একমাত্র তুমিই আমাদের মধ্যে বেশ মোটা আর থলথলে আছ।”

“মহারাজ, সে আমার যৌবনকালের কথা। আমার বাবা ছিলেন মহাজন। অঢেল পয়সা। তোফা খানা, সেই সঙ্গে কুস্তি। শরীর চড়চড় করে বেড়ে উঠল হাতির মতো।”

“তারপর!”

“তারপর সেই একই কহানিয়া। সরাবী আদমির কিছু থাকে না। সব ফৌত হয়ে গেল। পিতাজি পপার। সব বেচে, খেয়ে বেহস্তে চলে গেল। আমি আর আমার মা ভিখিরি বনে গেলুম। রামজি কা কেয়া কৃপা! তা বাবুজি, আমাকে কি করতে হবে, বাতাইয়ে!”

“তুমি কম্বলটম্বল জড়িয়ে মেয়েটাকে কোলে নিয়ে বসবে, আর আমি ট্রলি চালাব।”

“পারবেন?”

“অনেক চালিয়েছি আমি। গিরধারী! আমি রেলের এঞ্জিনিয়ার ছিলুম। এইসব লাইনটাইন আমারই পাতা।”

“ঠিক হায় বাবুজি! আমি একটু লেটে নিই।”

“উঠতে পারবে?”

“জরুর!”

গিরধারী রকের একপাশে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। সঙ্গে-সঙ্গে নাসিকাগর্জন।

॥ ৩১ ॥

একসঙ্গে এত পাখি তো শহরে ডাকে না। বউ কথা কও, দোয়েল, শ্যামা, ময়না, টিয়া, খঞ্জনা, দাঁড়কাক, শালিক, ছাতারে, হাঁড়িচাচা, টুনটুনি, মউটুসি, ফুলটুসি, তিতির, বক। সে এক মহাশোরগোল। গাছের পাঁচতলায় বসে হনুমানের হুপহাপ। সকলেই যেন বলতে চাইছে, ভাই উঠে পড়ো, উঠে পড়ো সব, সকাল এসে গেছে। আমাদের দিনের মেয়াদ ওই তো মাত্র বারো ঘণ্টা। এর মধ্যে খেতে হবে, খেলতে হবে, আকাশে উড়তে হবে, পাখনা ঝটপটিয়ে চান করতে হবে কখনও ধুলোয়, কখনও জলে, কত গান গাইতে হবে! আমাদের কাজের কি শেষ আছে! কেউ খাবে পোকা, কেউ শুধু ফল, কেউ ধরবে মাছ। কেউ আবার নিজেই খাদ্য হয়ে যাবে। সন্ধেবেলা হিসেব মেলাতে বসে দেখা যাবে, পাশের বাসার চঞ্চল ফেরেনি। সেই দুপুর থেকেই মালার কোনও খোঁজ নেই। যাও, দ্যাখোগে যাও, জঙ্গলের কোনও গাছের তলায় পড়ে আছে সাদা পালক, হলুদ পালক, কি নীল পালক। কি যাও কোনও হাটে। মানুষ ধরে নিয়ে গিয়ে খাঁচায় বন্দি করেছে। আকাশ কেড়ে নিয়েছে। মাটির জীব আকাশের স্বাধীনতার মর্ম কী বুঝবে!

গিরধারী থম মেরে একপাশে বসে এইসব ভাবছিল। ঘাড়ের কাছের একটা জায়গা লাল হয়ে ফুলে আছে। কাল রাতে কোনও এক সময় বিছেটিছে কিছু কামড়ে দিয়েছে। এইসব হলে সে এই ভাবে: আমি মানুষ, এত বড় একটা দেহ, ছোটখাটো পোকামাকড় আমার কী করবে! একটু জ্বালা করবে, জায়গাটা কিছুদিন ফুলে থাকবে। বড়জোর সামান্য জ্বর হবে। এই সময়টায় তার ভীষণ মায়ের কথা মনে পড়ে। সুখের জীবন থেকে দুঃখের জীবন। শেষে মারাই গেলেন অকালে। বড়লোক গরিব হয়ে গেলে বিশ্রী লাগে। গিরধারী ভাবল, পরের বার সে পাখি হয়ে জন্মাবে। কাঠঠোকরা হতে তার বেশি ভাল লাগে। প্রথম প্রথম ভাবত বক হবে। সাদা ধবধবে। অনেক বকের আবার লেজের দিকে সামান্য একটু হলুদের ছোঁয়া থাকে। যেন রাঁধতে-বাঁধতে তুলে হলুদের হাত মুছে ফেলেছে। বক হবে না গিরধারী। যতই সাদা হোক। সারাদিন জলে দুটো পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে তার নির্ঘাত নিমোনিয়া হয়ে যাবে।

গিরধারী এইসব ভাবছিল রেল লাইনের ওপর বসে। স্লিপারের মাঝখানের সব পাথর রাতের শিশিরে ভিজে গেছে। আর-একটু পরেই রোদ উঠবে। পুবের আকাশ সিঁদুরে হয়েছে। গিরধারী উঠে দাঁড়াল। এইবার ওঁরা আসছেন। সবার আগে খড়ক সিং। দু’ হাতের ওপর শুইয়ে নিয়ে আসছেন লছমিকে। চাদর দিয়ে মোড়া। সিংজির মাথায় জরির কাজ-করা তাজ। আলোয় চকচক করছে। পেছনেই উদয়ন। তাঁর পেছনে শিবশঙ্কর। তাঁর একপাশে জয় আর একপাশে জয়া। সবার শেষে লছমির বাবা দুবে।

গিরধারীর কাছে এসে শিবশঙ্কর বললেন, “দেখলে তো, সেই দেরি হয়ে গেল। তুমি অবশ্য ঠিকই উঠলে, আমরাই দেরি করে ফেললুম। গিরধারী, তুমি কি সাধক? সত্যি বলবে!”

“কেন মহারাজ, এ-সন্দেহ কেন হল আপনার?”

“তুমি সারাদিন একটুও না বলে পরিশ্রম করতে পারো। তোমার মুখে সবসময় একটা হাসি। বাইরের লোকদেখানো নকল হাসি নয়। ভেতরের সাচ্চা হাসি। আর পনেরো মিনিটের ঘুমেই তোমার চলে যায়। সবচেয়ে বড় কথা, তোমার কাছে এলে মনে বেশ একটা আনন্দ আসে। এ ক্যায়সে হো সেকতা। তোমার চোখ দুটো আকাশের মতো নীল। তোমার দাঁত ঝকঝকে সাদা। তোমার চুল কুচকুচে কালো। তোমার মুখে একটা আলো।”

গিরধারী শিবশঙ্করের হাত দুটো চেপে ধরে বলল, “অ্যায়সি না বোলো মহারাজ। মেরা কুছ নেহি হ্যায়। এক ইনসান। বাস্, অওর কুছ নেহি। পরে একটু কথা হবে মহারাজ! আমরা এখন স্টার্ট করি। রোদ আর একটু চড়লে আমব্রেলা ফিট করব। এখন খোলাই চলি। স্পিড় পাওয়া যাবে।”

যেমন প্ল্যান হয়েছিল, গিরধারী বসল লছমিকে কোলে নিয়ে। পাশে জয়া। তার কাছে জলের বোতল, ভাঁজকরা একটা গামছা। দিদির পাশে জয়। উদয়ন এমনভাবে বসেছেন, যাতে ছেলে মেয়ে দুটো কোনওসময় ছিটকে না পড়ে যায়। সিংজি বসেছেন খাপখোলা তরোয়ালের মতো। মাথায় ঝকঝকে জরির তাজ। শিবশঙ্কর এইবার স্টার্ট করবেন। লছমির বাবা দুবে লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে শুকনো মুখে। উদয়নকে বলছে “ডাক্তারবাবু, আমার মেয়ের জীবন আপনি ফিরিয়ে দেবেন। দেবেন তো ডাক্তারবাবু!” দুবের চোখে জল। সিংজি এমন চোখে তাকাচ্ছেন, যেন ভাল করে দেবেন। জয়ার সেই দেখে খুব কষ্ট হল। সাধারণত সে বড়দের ব্যাপারে কথা বলতে চায় না। এখনও সে বড় হয়নি। সবে একটু-একটু বড় হয়েছে। তবু সে না বলে পারল না, “আমরা সবাই খুব চেষ্টা করব। আপনি ভাববেন না। ওখানে ভাল মিশনারি হাসপাতাল আছে।”

দুবে বলল, “দিদিমণি, আমাকে ছুটি না দিলে আমি তো যেতে পারব না।”

খড়ক সিং হুঙ্কার দিলেন, “যেতে তোমাকে হবে না। মেয়ে আমাদের, আমরা বুঝব। তোমার পরশু বিয়ে, তুমি সেই বিয়েটাই ভাল করে করো, মেয়ের ভাবনা আমরাই ভাবব।”

“রেডি, ওয়ান, টু থ্রি,” শিবশঙ্কর ট্রলি ছেড়ে দিলেন। বাতাস আর বাতাস। চারদিকে জমজমাট পাখির ডাক। সবাই সুস্থ, একমাত্র গিরধারীর কোলে মেয়েটাই অসুস্থ। চোখ বুজিয়ে পড়ে আছে ন্যাতার মতো। মেয়েটার মুখে একটা কিছু আছে, দেখলেই ভীষণ মায়া হয়। সিংজির দোষ নেই। মেয়েটাই টানছে সকলকে। গিরধারী সেইটাই দেখছিল। গা বেশ গরম। জ্বরের তাড়সে মুখটা থমথমে লাল। আকাশে ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘ। সারাটা দিন একটু মেঘলা-মেঘলা থাকলে বেশ হয়। জয়া গামছার ভাঁজ খুলে রেডি হচ্ছে। প্রয়োজন হলেই বাতাস করবে। এইরকম একটা ভয়ঙ্কর সময়েও জয়ার ভাল লাগছে এই কারণে, একসঙ্গে সবাই পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি কেমন বসে আছে। সবাই কত ভাল, কত উপকারী। ভাল লাগছে আরও একটা কারণে, কত বড় একটা কাজ পাওয়া গেছে, একটা মেয়েকে যেমন করেই হোক বাঁচাতে হবে। গিরধারী কেমন যত্ন করে লছমিকে ধরে আছে। একটা ভীষণ নরম বিছানাতেও এত আরামে শোওয়া যেত না।

শিবশঙ্কর বললেন, “আমার খুব ইচ্ছে করে, ছোট-ছোট ছেলেমেয়ে, যাদের কেউ দেখার নেই, যত্ন করার নেই, তাদের জন্য হোম তৈরি করি একটা। ওইসব বিলিতি মিশনারি কায়দার নয়। ভারতীয় ধরনের। একটা বড় বাড়ি। সেখানে আমরা সবাই একসঙ্গে থাকব, একটা বড় পরিবারের মতো। যেমন ছেলেবেলায় আমাদের বিশাল বড় এক যৌথ পরিবার ছিল ভাগলপুরে, বাবা, জ্যাঠা, কাকা, দাদা, মেজদা, পিসি, খুড়ি। ভালবাসায়, শিক্ষায় সবাই বড় হবে। কেউ ভাববে না আমি পর। আমি আশ্রমে আছি, আমাকে সবাই দয়া করছে। একটা মানুষ যদি অন্যের দয়া আর উপেক্ষা নিয়ে বড় হয়, সে কোনওদিন সুস্থ সুন্দর মানুষ হতে পারে না। কুঁকড়ে যায়। কত-কত জীবন এইভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর আমরা কেবল আমাদের কথাটাই ভাবছি। আমার ছেলে, আমার মেয়ে, আমার নাতি, আমার নাতনি! আমরা সব অপরাধী, স্বার্থপর। যতদিন আমরা থাকব, ততদিন এ-দেশের কিছু হবে না।”

গিরধারী বলল, “আপনি যা বললেন, তা যদি করতে পারেন, আমি সব ছেড়ে আপনার কাছে চলে আসব। আপনার সেই হোমের সব কাজ আমি করব। বাজার করা, রান্না করা, ছেলেমেয়েদের সেবা করা। আর আমি ষাট হাজার টাকা জমিয়েছি, সেই টাকাটা আপনাকে আমি দিয়ে দেব।”

খড়ক সিং বললেন, “আমি আমার বাড়িটা আর জায়গাজমি সব দিয়ে দেব। যখন যা হুকুম করবেন, সব করে দেব। আমার শরীরে এখনও খুব শক্তি আছে।”

জয়া বলল, “আমি আর মা হাতের কাজ শেখাব।”

উদয়ন বললেন, “আমি ডাক্তার হব।”

জয় বলল, “আমি তা হলে কী করব!”

জয়া বলল, “তুই একেবার ছোট যারা তাদের পড়াবি।”

জয় খুব খুশি হল। কিছু একটা করতে না পারলে ভাল লাগে নাকি!

খড়ক সিং বললেন, “আপনারাই বলুন, মেয়েটাকে এনে আমি কোনও অন্যায় করেছি?”

শিবশঙ্কর বললেন, “খুব ভাল করেছ। এর চেয়ে ভাল কাজ আর হয় না।”

“যদি খারাপ কিছু হয়ে যায়!”

“হবে না। আমরা আছি। উদয়ন আমার ছেলে, প্রশংসা করা উচিত নয়, ও খুব ভাল ডাক্তার।”

উদয়ন এই ফাঁকে লছমির নাড়িটা একবার দেখে নিলেন। বেশ ভার হয়ে আছে। তেমন কিছু ওষুধ পড়েনি। চিকিৎসা শুরু হলে মনে হয় সেরে উঠবে। ট্রলি সাঁই-সাঁই দৌড়চ্ছে। রোদের তেমন তেজ নেই। লছমি এক-একবার চোখ খুলছে। চোখে একটা ভয়, কেমন যেন একটা আতঙ্কের ভাব। জয়া কপাল টিপে দিচ্ছে, ছোট্ট, চুলঘেরা কপাল।

তখন ক’টা হবে! রাত প্রায় দশটা। সকলে নিরাপদে সরলা স্টেশনে এসে পোঁছল। গিরধারী সেই একভাবে ষোলো-সতেরো ঘণ্টা লছমিকে কোলে নিয়ে বসে থাকার ফলে পা সোজা করতে পারছে না। অবশ হয়ে গেছে। উদয়ন লছমিকে কোলে তুলে নিলেন। খড়ক সিংয়ের কাঁধে ভর রেখে গিরধারী পায়ের রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে।

শিবশঙ্কর জিজ্ঞেস করলেন, “সোজা হাসপাতালে, না বাড়িতে।”

উদয়ন বললেন, “সোজা হসপিটাল যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। নার্সিং আর মেডিসিন—দুটোরই ভীষণ প্রয়োজন।”

“তা হলে তুমি স্টেশন মাস্টারের ঘরে বোসো, আমি চট করে গাড়িটা নিয়ে আসি।”

“আপনাকে আর কষ্ট দেব না। গিরধারী এই ট্রলিতেই কিছুক্ষণ বসুক। লছমিকে কোলে নিয়ে। আমরা সবাই বাড়ি যাই। আপনার এইবার একটু বিশ্রাম দরকার। আমি গাড়ি বের করে যা করার সব করছি।”

“আর ইউ নট টায়ার্ড!”।

“নট দি লিস্ট। আপনি যা শিখিয়েছিলেন, এতক্ষণ বসে-বসে তাই করছিলুম। প্রাণায়াম। এক, দুই, তিন, চার; এক, দুই, তিন, চার। শ্বাসের ড্রিল।”

“দেখেছ! তোমার বিশ্বাস হয়েছে তো?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ, খাসকে কন্ট্রোল করতে পারলে মানুষ অসীম শক্তির অধিকারী হতে পারে।”

“জেনে রাখো, কচ্ছপ আর হাতি প্রাণায়াম-সিদ্ধ যোগী।”

গিরধারী, খড়ক সিং, লছমি বসে রইল। এরা সবাই লাইন পেরিয়ে, তার টপকে হাঁটতে লাগল বাড়ির দিকে। গিরধারী তখন একটু ইতস্তত করে খড়ক সিংকে বলছে, “মালেক!”

“কে তোমার মালেক! মালিক এই দুনিয়ায় একজনই আছেন, ভগবান।”

“দেখতে তো পাই না, তবে হ্যাঁ, শুনতে পাই তাঁর কথা।”

“আমেরিকার কথা শুনেছ?”

“শুনেছি মালিক।”

“দেখেছ?”

“না মালিক, জিন্দেগিতে দেখাও হবে না।”

“তার মানে আছে, তুমি না দেখলেও আছে, দেখলেও আছে।”

“মালেক, আপনি খইনির নাম শুনেছেন?”

“শুনেছি।”

“দেখেছেন?”

“না, সেভাবে দেখিনি, তবে হাতের তালুতে ফেলে রগড়াতে আর পেটাতে দেখেছি।”

“তা হলে মালিক, থোড়া মেহেরবানি করে আমার বাঁ পকেটে হাত ঢোকান।”

গিরধারী গত চব্বিশ ঘণ্টা খইনি খায়নি। তার মাথা ঝাঁঝাঁ করছে। বুদ্ধি নিভে আসছে। সিংজিকে তাই কাতর অনুরোধ। মেয়েটা কোলে আছে, দুটো হাতই জোড়া। সিংজি নির্দেশমতো চুন আর দোক্তাপাতা একসঙ্গে মিলিয়ে দলতে লাগলেন। মনে হল, কাজটা নেহাত মন্দ নয়। কিছুক্ষণ বেশ সময় কেটে যায়, কত কী ভাবনা আসে মনে।

এই বেখেয়ালে তিনি এক কাণ্ড করে বসলেন। পুরো মশলাটাই নিজের মুখে ফেলে গিলে নিলেন। গিরধারী হাঁ-হাঁ করে ওঠার আগেই কাজ শেষ। হেডলাইট জ্বেলে উদয়নের গাড়ি আসছে। এদিকে সিংজি লাইনের ধারে ফ্ল্যাট। কখনও মনে হচ্ছে ওপরদিকে উঠে যাচ্ছেন ঘুরতে-ঘুরতে। কখনও মনে হচ্ছে, শুয়ে আছেন ঘুরন্ত এক চাকিতে। সব ঘুরছে চাকার মতো।

॥ ৩২ ॥

এখন যদি কেউ প্রশ্ন করে, খড়ক সিং, তোমার হলটা কী! তোমার সেই পুঁটলি, লাঠি, তোমার সেই দেশে-দেশে ঘুরে বেড়ানো। লিডার নদীর সাধু, রাজস্থানের ফকির, বিন্ধ্যপর্বতের যোগী! খড়ক সিং বলবেন, দিনদুনিয়ার মালিক আমাকে একটা মানুষ উপহার দিয়েছেন। তার নাম লছমি। দশ-এগারো বছরের সুন্দর একটা মেয়ে। এখন সেইটাই আমার সাধনা। সেই মেয়েটাকে বড় করব, মানুষ করব। উদয়নজির মতো একজন নামজাদা ডাক্তার করব।

পাঁচ মাস পরে দেখা যাচ্ছে, লছমি উদয়নের চিকিৎসায় সেরে উঠেছে। একটা মাস যমে-মানুষে টানাটানি। এক-এক সময় মনে হয়েছে আর বুঝি ধরে রাখা গেল না। উদয়ন, আরও সব ডাক্তারবাবু যাঁরা ছিলেন, বিশেষ করে ডাক্তার আব্রাহাম, তাঁরা লড়াই করে যমের হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছেন মেয়েটাকে। লছমির বাবা আর আসেনি, কোনও খবরও নেয়নি। এতে খড়ক সিং খুব খুশি। মনে করো, ভগবান তোমাকে একটা দামি হিরে উপহার দিলেন, তুমি তার মূল্য বুঝলে না, কাচ ভেবে ফেলে দিলে। দিলে, বেশ করলে। এইবার আমি সেইটাকে ঝেড়েঝুড়ে, ভাল করে মুছে, আমার কাছে রেখে দিলাম। জিনিসটা তখন আমার। লছমির বাবা যদি কোনওদিন এসে খুব হম্বিতম্বি করে, তা হলে ওই যে লাঠি, যে-লাঠি দেশে-দেশে ঘুরে বেড়িয়েছে, সেই লাঠি দিয়ে শয়তানটাকে পেটানো হবে।

“লছমি! মায়ি! তোর মন তো খারাপ হবে না?”

কেন খারাপ হবে! এত ভালবাসা, এত স্নেহ-যত্ন সে আর কোথায় পেয়েছে! কোথায় পাবে! খড়ক সিং শেষে সংসারী হয়ে গেলেন! তিন মাথার মোড়ে যেখানে এই তল্লাটের বিশাল বড় একটা শিরীষ গাছ একেবারে আকাশের ছাদে গিয়ে ঠেকেছে, সেই গাছের তলায় মিষ্টি ছায়ায় সিংজি একটা দোকান দিয়েছেন। সবাই অবাক! যতই হোক রাজার ছেলে তো! অনেক-অনেক অতীতে ফিরে গেলে দেখা যেত, পেল্লায় এক রাজপ্রাসাদে চাবুকের মতো এক যুবক ঘোড়ায় চাপা শিখছেন। নিশানা লক্ষ্য করে বন্দুক ছুড়ছেন। সায়েব শিক্ষক ইংরেজি শেখাচ্ছেন।

দোকানটা কিসের! চা, বিস্কুট, পান, বিড়ি, সিগারেট, পানমসলা আর খইনির। দোকানের সামনে তিনটে বেঞ্চ পাতা। লজ্জা-টজ্জা নেই। পরিশ্রম করে, সৎ পথে টাকা রোজগার করব। আমি গরিব মানুষ, দেশের শতকরা আশি ভাগ মানুষ গরিব। লছমি, তুই আর আমি সেই দলের। কষ্টে না থাকলে মানুষ বড় হতে পারে না। বড় লোক, পয়সাঅলা লোকের ঘরে জন্মালে মানুষ বদমাশ হয়। পেল্লায় তার অহঙ্কার, হনুমানের লেজের মতো। মানুষকে মানুষ বলে মনে করতে চায় না। দুটো চোখ থাকে ঠিকই, তবে অন্ধ। আকাশ, গাছ, পথ, নুড়ি, পথের ধুলো, ফুল, পাখি কিছুই দেখে না। একেবারে বাজে, একপেশে একটা জীব।

লছমি, তুই আমাকে দোকানের কাজে সাহায্য করবি, বাড়ি সামলাবি, আবার লেখাপড়াও করবি। চব্বিশ ঘণ্টায় দিন, সেটা কিছু কম সময় নয়। পড়ে-পড়ে না ঘুমোলে অনেক কিছু করা যায়। সিংজি বেশ খুশ মেজাজেই আছেন। দোকানটা ধরে গেছে। এই অঞ্চলের সবাই মানুষটাকে ভীষণ ভালবাসে যে! একরোখা, আত্মভোলা মানুষ। কারও পরোয়া করেন না। ভাই, তুমিও মানুষ, আমিও মানুষ। তোমার মান-সম্মান তোমার কাছে, আমার মান-সম্মান আমার কাছে। বন্ধু বলে যদি নিতে পারো, তোমার জন্য জান দিয়ে দেব। আর যদি মেজাজ দেখাও, তম্বি করো, তা হলে আমিও ছেড়ে কথা বলব না, সে তুমি যেই হও।

কাকভোরে যত লোক নানা কাজে বেরিয়ে পড়ে। কেউ যাচ্ছে মাইকার কারখানায় কাজ করতে, কেউ চলেছে দূরপাল্লার ট্রাক নিয়ে, রিকশা নিয়ে, টাঙ্গা নিয়ে। দেহাতি মেয়েরা চলেছে সব্জি নিয়ে, ঘি নিয়ে, মধু নিয়ে। বাইরে থেকে যাঁরা স্বাস্থ্য ফেরাতে এসেছেন, তাঁরা চলেছেন বেড়াতে। সকলেই সিংজির খদ্দের। খানদান চেহারা। পরিষ্কার জামা-কাপড়। সুন্দর ব্যবহার। সবাই দু দণ্ড বসে শান্তি পায়। লছমিরানি কাপ-গেলাস ধোয়, খদ্দেরকে চা-বিস্কুট এগিয়ে দেয়। সবসময় মুখে একটা মিষ্টি হাসি।

শিবশঙ্কর খড়ক সিংকে অনেক বুঝিয়েছিলেন, “তোমার এই কষ্ট করার কী মানে হয়, আমাকে বোঝাবে! লছমি তো আমাদেরও মেয়ে, আমরা কি তার দায়দায়িত্ব নিতে পারি না!”

“খুব পারেন, তবে কী জানেন, আমি আমার চরিত্রটা কিছু বদলাতে চাইছি। লোকে আমাকে পাগল বলে। দেশে-দেশে ঘুরে বেড়াই, যা খুশি তাই করি। আমার কোথাও কোনও দায়িত্ব নেই। এটা ঠিক নয়। আমি একটা মেয়েকে জোর করে তার বাবার কাছ থেকে নিয়ে এসেছি। দায়িত্বটা আমার। দেখতে চাই, সেই দায়িত্ব আমি পালন করতে পারি কি না।”

“মেয়েটাকে এত খাটালে সে লেখাপড়া করবে কখন?”

“বেশি তো খাটাই না; সকালে কয়েক ঘণ্টা, বিকেলে কয়েক ঘণ্টা। কাজ করবে, লেখাপড়াও করবে। পৃথিবীটা আয়েস করার জায়গা নয়।”

“যা ভাল বোঝো করো, তবে আমাদের একেবারে ভাল লাগছে না। তুমি আমাদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছ।”

জয় বাগানের দিকের রকে বসে-বসে খুব ভাবছে! মুখ গম্ভীর। জয়া কলম পরিষ্কার করতে-করতে দেখছিল। জয় বেশ কিছুদিন হল এইরকম হয়ে গেছে। কারণটা জানা দরকার। জয়া ভাইয়ের কাছে এসে বসে পড়ল। পিঠে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, “তোর কী হয়েছে রে? শরীর খারাপ?”

জয় সে-কথার উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করল, “দিদি! আমার ক’টা প্যান্ট, জামা, জুতো আছে রে!”

জয়া একটু ভেবে, মনে-মনে হিসেব করে বললে, “কুড়ি-পঁচিশটা হবে। জামা আর প্যান্ট। জুতো চার জোড়া। কেন? কাউকে কিছু দেওয়ার কথা ভাবছিস?”

জয় এ-প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়ে প্রশ্ন করল, “আমরা সারাদিন ক’বার খাই?”

জয়া বলল, “চারবার। সকালে ব্রেকফাস্ট, ডিম, টোস্ট, কলা, ফল, দুধ। তারপর ভাত, ডাল, মাছ, তরকারি। বিকেলে টিফিন। রাতে রুটি, কি লুচি, তরকারি, আবার দুধ। কেন, তোর কি মনে হচ্ছে খাওয়া কম? আরও কিছু হলে ভাল হত! মাঝে-মাঝে তো আমরা বাদাম, ছোলা, চকোলেট, বিস্কুটও খাই। শিঙাড়া খাই, কচুরি খাই।”

জয় হঠাৎ অন্যরকমের একটা প্রশ্ন করল, “আমরা বড়লোক, তাই না?”

“বড়লোক নই, তবে অবস্থা খারাপ নয়।”

“তার মানে, আমরা কোনওদিন বড় হতে পারব না!”

“চেষ্টা করলেই বড়লোক হতে পারবে, তবে চাকরি করে তো বড়লোক হওয়া যায় না, ব্যবসা করতে হবে।”

“আমি বড়লোক হওয়ার কথা বলছি না, বড় মানুষ হওয়ার কথা বলছি।”

“সে তুমি ভাল করে লেখাপড়া করে, বিজ্ঞানী, লেখক, দার্শনিক, অধ্যাপক হলেই হতে পারবে।”

“বড়লোকরা বড় মানুষ হতে পারে না।”

“এইসব বাজে কথা তোকে কে বলেছে?”

“শিরিনকে বলেছে খড়ক সিং। শিরিন আমাকে বলেছে।”

“কী বলেছে খড়ক সিং?”

“বলেছে, ছেলেবেলায় যারা না চাইতেই সব কিছু পেয়ে যায়, তাদের চরিত্র নষ্ট হয়ে যায়। বুদ্ধি ভোঁতা হয়ে যায়, ভিতু হয়ে যায়, জীবনের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা চলে যায়। তারা আর মানুষ হতে পারে না। তারা মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে না। তাদের খুব অহষ্কার হয়। বড়-বড় কথা বলে। তাদের সবাই তখন ঘেন্না করে। আমরাও ঠিক ওইরকম হয়ে যাব রে দিদি! আমার পঁচিশটা প্যান্ট, পঁচিশটা জামা, চার জোড়া জুতো, সারাদিন খালি খাচ্ছি আর খাচ্ছি। আমাদের কত জিনিস! মায়ের কত গয়না! বাবার কত স্যুট। কালার টিভি, টেপরেকর্ডার, ফ্রিজ। আমরা কোনওদিন মানুষ হতে পারব না দিদি।”

“তা হলে, এখন কী করবি?”

“ভাবছি সব দিয়ে দেব। আজই সব দিয়ে আসব চার্চের অর্ফানেজ-এ। চারটে প্যান্ট, চারটে জামা আর এক জোড়া জুতো থাকবে, বাকি সব দিয়ে দেব। আর চারবার খাব না, খাব দু’বার, সকালে ভাত, ডাল, তরকারি। রাতে ভাত, ডাল, তরকারি। মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, আইসক্রিম, কাস্টার্ড, কচুরি, কাটলেট, ফিশচপ, এইসব খাবই না। জানিস তো ডিম খেলে বুদ্ধি কমে যায়।”

“কে তোকে বলেছে, ডিম খেলে বুদ্ধি কমে যায়?”

“আমি শুনেছি, ছোটরা ডিম খেলে তাদের বুদ্ধি কমে যায়।”

জয় বিজ্ঞের মতো কিছুক্ষণ বসে থেকে বলল, “মাকে কিছু জানাবি না, আজ দুপুরে আলমারি থেকে সব বার করে দিয়ে আসব।”

“তারপর মা যখন জানতে পারবেন!”

“তখন মাকে সব বলব।”

“কিছু করার আগে বাবা আর মায়ের অনুমতি নিতে হয়। আমি অন্তত এইটুকু জানি। তাঁদের অনুমতি ছাড়া যে-কোনও কাজ করাটাই অন্যায়, পাকামো।”

“আমি তো ভাল কাজই করছি রে দিদি!”

“ভাল কাজও মাকে না জানিয়ে করাটা অপরাধ। আমি পড়েছি, সন্ন্যাসী হওয়ার আগে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য তাঁর মায়ের অনুমতি নিয়েই সংসার ত্যাগ করেছিলেন।”

“আমিও একটা গল্প পড়েছি, একটা ব্যাঙের একটা টাকা ছিল। সেই টাকাটা ছিল তার গর্তে। একদিন একটা হাতি সেই গর্তটা ডিঙিয়ে গিয়েছিল। তখন ব্যাঙটা বেরিয়ে এসে খুব রাগ করে হাতিটাকে লাথি দেখাতে লাগল, আর বলল, তোর এত বড় সাধ্য যে, আমায় ডিঙিয়ে যাস। গল্পটার কী মর্যাল বল তত দিদি! টাকার এত অহঙ্কার! খড়ক সিং ওই গাছতলায় বসে আমাদের সেই অহঙ্কারটাকেই ভাঙছেন। চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছেন, তোমাদের জাত আলাদা, আমার জাত আলাদা।”

“তুই বড়দের মতো কথা বলছিস, ছোটরা এইসব বড়-বড় জ্ঞানের কথা বলে না। বাবা, মা আমাদের যেমন রাখবেন, যেভাবে রাখবেন, আমরা সেইভাবেই বড় হব। খড়ক সিংয়ের মাথায় পাগলামি ঢুকলে আমরা কী করতে পারি! তোকে এত সব কে ভাবতে বলেছে!”

“শিরিন এখন কেন কেবল লছমির কাছেই থাকে? আমাদের বাড়িতে আসে না। বলে, ‘তোরা বড়লোক। তোদের পয়সার অহঙ্কার। তোর বাবা পাইপ খান। তোর মা সিল্কের শাড়ি পরেন। তোরা সবাই বাড়িতে চটি পায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়াস’।”

জয়া বলল, “বেশ করি। যাদের বাড়ির যেমন নিয়ম। আর পাইপ খেলেই লোক বড়লোক হয় না। খড়ক সিংয়ের বাড়িতে তো রুপোর আলবোলা আছে। দাঁড়া, আমি দাদিকে গিয়ে সব কথা বলছি। দাদি যা বলবেন, সেইটাই ঠিক।”

শিবশঙ্কর তাঁর ছোট্ট কারখানায় বসে একটা বিদেশি খেলনার মডেল দেখছিলেন। দেখছিলেন, কীভাবে সেটা তৈরি করা যায় এখানে। একটা মোটরগাড়ি, যেটা চলতে-চলতে সামনে বাধা দেখলেই পাশ কাটিয়ে যায়। নিজের ইচ্ছে মতো হেডলাইট, টেল লাইট জ্বালাতে পারে। হর্ন বাজাতে পারে। ব্যাক করে দিক পরিবর্তন করতে পারে। খেলনাটা তৈরি হয়েছে জাপানে। শিবশঙ্কর খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন। এমন সময় জয় আর জয়া সেই ঘরে ঢুকল।

॥ ৩৩ ॥

ফুল গাছে জল যাওয়ার জন্য বাগানে অনেক নালা কাটা আছে বেশ হিসেব করে, কায়দা করে। এক জায়গায় জল ঢাললে বেশ কুলকুল করে বহে যায় অনেকটা দূর। যেন সব ছোট-ছোট নদী। নালার ধারে-ধারে জল পেয়ে বেশ বড়-বড় ঘাস জন্মেছে। জয়ের মনে এতটুকু সুখ নেই। খড়ক সিং কেমন পর হয়ে গেলেন। লছমিকে তাদের সঙ্গে মিশতে দেন না। শিরিন এখন খড়ক সিংয়ের খুব প্রিয়। শিরিনদের বাড়িতে লছমিকে যেতে দেন। জয় একটা নালার ধারে উবু হয়ে বসে দেখছিল, একটা ছোট্ট ব্যাঙ লাফিয়ে লাফিয়ে পোকামাকড় ধরছে। সবে খেতে শিখেছে নতুন, তাই খুব খিদে। বড় ডানাওলা একটা পোকা জলে ডুবে মারা গেছে। আটকে আছে নরম মাটিতে। মনে হয় কাল সন্ধের দিকে এই মৃত্যুটা ঘটেছে। তখন নালাটা জলে পূর্ণ ছিল। কোনওভাবে পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারেনি। ডানা ভিজে গেলে ওড়া যায় না। ওড়ার জন্য শুকনো ডানা চাই।

গাছের একটা শুকনো ডাল দিয়ে জয় পোকাটাকে খুঁটে-খুঁটে তুলল। ডানার কী বাহার! দেহের চেয়ে ডানা বড়। এইটুকু একটা শরীরকে ওড়াবার জন্য এত বড় দুটো পাখনার কী দরকার ছিল! জয় চমকে উঠেছে, পিঠের ওপর কে হাত রাখল, সে খেয়াল করেনি। পেছন ফিরে তাকিয়ে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। স্বপ্ন নয় তো! হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন আর কেউ নন, খড়ক সিং। জয় তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে টাল রাখতে না পেরে উলটে গেল ঘটের মতো। তাকে আর উঠতে হল না। সিংজিই পাশে বসে পড়ে তাকে কোলের কাছে টেনে নিলেন।’

“তুমি আমার ওপর রাগ করেছ জয়?”

জয়, “হ্যাঁ করেছি?” বলেই কেঁদে ফেলল। তার চোখে জল। কুলকুল করছে।

সিংজি বললেন, “আর রাগ করতে হবে না, আমি নিজেই ভাব করতে এসেছি। আমার খুব ভুল হয়েছিল। আমার মাথায় ভূত চেপেছিল। আমি তো একটু গোঁয়ার আছি। যা-তা উলটোপালটা ভাবি। নিজের খেয়ালে চলি, কারও কথা শুনি না, তাই না আমার জীবনটা এইরকম হয়ে গেছে। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। দেখবে চলো, তোমার দাদা কী করছেন।”

সিংজি জয়কে বুকে চেপে ধরে মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন। জয়া এই সময়টায় মাকে সংসারের কাজে সাহায়, করে। মাঝে-মাঝে ছুটে যায় ঠাকুমার কাছে। এই সকালেই ঠাকুমা বসেন তাঁর লতাপাতা, জড়িবুটি নিয়ে। এই সংসারের কেউই কিন্তু অলস নয়। সকলেই খুব পরিশ্রমী। হুকুম করে কাজ করাবার অভ্যাস কারও নেই। শিবশঙ্কর, উদয়ন দু’জনেই বলেন, “সেল্ফ হেল্প ইজ বেস্ট হেল্প।”

সিংজি জয়কে নিয়ে সেই গাছতলার দোকানে এলেন। শিবশঙ্কর পাকা দোকানদারের মতো জাঁকিয়ে বসেছেন। চা তৈরি করছেন। সামনে চারজন খদ্দের। একজন হলেন চার্চের ফাদার। তিনি সাইকেলে হেলান দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। শিবশঙ্করকে নির্দেশ দিচ্ছেন, “স্ট্রং লিকার, এ ফিউ ড্রপ্স অব মিল্ক জাস্ট ফর কালারিং অ্যাণ্ড এ পিঞ্চ অব শুগার।” লছমি খলরবর করে কাপ-ডিশ ধুচ্ছে।

শিবশঙ্কর জয়কে দেখে মজা করে বললেন, “বলুন, আপনি কেমন চা চান? জাস্ট প্লেন লিকার? অর উইথ মিল্ক?”

জয় বলল, “আপনি দোকান চালাচ্ছেন?”

“জাস্ট টু শশা ইউ, সকলেই সব কাজ পারে। কোনও কাজই ছোট নয়। ডিগনিটি অব লেবার।”

ফাদার চায়ে চুমুক দিতে দিতে ঠোঁট সরিয়ে বললেন, “দ্যাট্স রাইট। রোজ সকালে আমি চার্চের সামনের রাস্তাটায় ঝাড়ু দি। আই লাইক ইট। এই তো একটু পরেই আমি আমাদের ডেয়ারিতে গিয়ে গোরুর কাজে লেগে যাব। খুব পরিশ্রম। বাট আই লাইক ইট। মাথা আর শরীর দুটোকেই খাটানো চাই।”

শিবশঙ্কর বললেন, “জয়, যাও লছমিকে সাহায্য করো। তুমি কয়লা ভাঙো। ওই যে গাছতলায় পড়ে আছে। হাতুড়িটা দ্যাখো কোথায় আছে।”

সিংজি বললেন, “আমি তা হলে জলের ড্রামটা ভরে ফেলি।”

এই কাজটা খুব সহজ নয়। জলের কল বেশ দূরে। সিংজি দু’ হাতে দুটো বড় বালতি তুলে নিলেন। সিংজির ক্ষমতা আছে। দু’ বালতি জল দু’ হাতে ঝুলিয়ে অতটা পথ আসতে তাঁর কোনও কষ্টই হবে না। জয় কয়লার চাঁই ভাঙতে-ভাঙতে ভাবছে, কাজটা সহজ মনে হলেও সহজ নয়। তার হাত খুব নরম। মনে হচ্ছে ফোস্কা পড়ে যাবে। তা পড়ক। সে তো মনে-মনে এইরকম পরিশ্রমই করতে চেয়েছিল। ‘দাদা, পারছি না, কষ্ট হচ্ছে’, এ-কথা তো এখন বলা চলবে না। দুটো হাত কয়লার গুঁড়োয় কালো হয়ে গেছে। কপালে ঘাম জমেছে। নাকের কাছটা চুলকোচ্ছে। চুলকোবার উপায় নেই। কালি লেগে যাবে।

শিবশঙ্কর একবার তাগাদা লাগালেন, “কী হল, কয়লা দাও। আগুন যে নেমে যাচ্ছে মাস্টার।”

লছমি জয়ের কাছে এসে বলল, “হাতুড়িটা আমাকে দাও। তাড়াতাড়ি ভেঙে দিই। আরও ছোট করে ভাঙতে হবে।”

জয় প্রথমে ভাবছিল রেগে যাবে। তারপর ভাবল, সত্যিই তো সে ঠিকমতো পারছে না। এদিক-ওদিকে দূরে-দূরে ছিটকে যাচ্ছে। হাতুড়িটা ঠিকমতো চালাতেও পারছে না, এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। জয় ঠাণ্ডা গলায় বলল, “আমি নতুন তো, তাই ঠিক মতো পারছি না। তুমি দেখিয়ে দাও, দেখবে, ঠিক পারব।”

লছমি হাতুড়ি নিয়ে বসল। জয় দেখছে খুব একটা জোরে মারছে না। টুকটুক করে মারছে। এক-একটা ঢেলা চার টুকরো হয়ে খুলে যাচ্ছে। বাঁ হাতের তালুটাকে এমনভাবে আড়াল দিয়ে রেখেছে যে, একটা টুকরোও দূরে ছিটকে যাচ্ছে না।

জয় অবাক হয়ে ভাবছে, যেমন অঙ্ক কষা শিখতে হয়, ছবি আঁকা শিখতে হয়, সেইরকম কয়লা ভাঙা, কাঠ কাটা সবই শিখতে হয়। মন দিতে হয়, শুধু শ্রম দিলেই হয় না। লছমি জানে কোথায় ছোট্ট একটু আঘাত দিলে ঢেলাটা সহজেই খুলে যাবে।

রাতের বেলা, খাবার টেবিলে সভা বসল, পারিবারিক সভা। সবাই আছেন। শিবশঙ্কর জয়কে জিজ্ঞেস করলেন, “ঠিক ঠিক বলো তো তোমার কেমন লাগল আজ?”

জয় বলল, “ভাল লাগল না।”

“কেন লাগল না! তুমি তো লছমির মতোই হতে চাইছিলে!”

“আমার মনে হল, সব কাজ সকলের জন্যে নয়।”

“দ্যাট্স রাইট। আমিও ঠিক ওই কথাটাই বলতে চেয়েছি, যার কাজ তার সাজে, অন্যের মাথায় লাঠি বাজে। প্রত্যেকের পরিবারের ধারা এক-একরকম। যে যে-পরিবারে জন্মেছে, তাকে সেই পরিবারের ধারায় বড় হতে হবে। সে ভালই হোক আর খারাপই হোক। গীতায় শ্রীভগবান বলছেন, স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ। এই শ্লোক তোমরা বহুবার শুনেছ। আমাদের পরিবারের ধারা লেখাপড়া, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা। আমরা অলস, ভোগী নই। আমাদের যেমন রোজগার আমরা সেইভাবেই থাকি। আমাদের জোর করে আরও নীচে নেমে যাওয়ার অর্থ হয় না। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছ জয়?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ, চা তৈরি করতে আপনার কেমন লাগছিল?”

“মনে হচ্ছিল সময় নষ্ট করছি। ওই সময়টায় আমি ইলেকট্রনিক্স সম্পর্কে আরও লেখাপড়া করে আধুনিক পৃথিবীটাকে আরও বেশি জানার চেষ্টা করতে পারতুম। সেইটাই হত আমার কাজ। পৃথিবীতে তিন ধরনের কাজ আছে জয়। একধরনের কাজ শুধু শরীর দিয়েই করা যায়। আর-একধরনের কাজ মাথা দিয়ে। ব্রেনওয়ার্ক। তৃতীয় কাজে শরীর আর মাথা দুটোই লাগে। থার্ড ওয়ান ইজ দ্য বেস্ট। বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং-এর কথা তোমরা শুনেছ। যাঁকে বলা হচ্ছে দ্বিতীয় আইনস্টাইন। তাঁর তীব্র তীক্ষ্ণ ব্রেন ছাড়া আর কিছুই নেই। মোটর নিউরন ডিজিজে শরীর সম্পূর্ণ বিকল। কিন্তু মাথা! সেই মাথা দিয়ে তিনি এই বিশ্বের সৃষ্টি রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করছেন। তাঁর লেখা বই ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ বিজ্ঞানী মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছে। হকিংকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনি কি বিশ্বাস করেন ঈশ্বর এই বিশ্ব সৃষ্টি করেছিলেন এবং তিনিই একে নিয়ন্ত্রণ করছেন?’ হকিং একটি কথায় এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন, ‘না।’ তা হলে কী? কী সেই রহস্য!”

জয় আর জয়ার চোখ উত্তেজনায় চকচক করছে, “আমরা সেই রহস্য জানতে চাই।”

“তা হলে চলো বসার ঘরে।”

॥ ৩৪ ॥

শিবশঙ্কর বেশ জমিয়ে বসলেন কার্পেটের ওপর। চেয়ার বা সোফায় বসে গল্প ঠিক জুতসই হয় না। জয়া দাদির সেই প্রিয় তাকিয়াটা এনে দিল। জয় নিয়ে এল জলের বোতল। খাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরে শিবশঙ্কর জল খান। সেইটাই হল স্বাস্থ্যকর নিয়ম। ঘরে একটা মৃদু আলো জ্বলছে। পরিবেশটা গল্পের। কাচের দরজার বাইরে গাছপালা। রাতের অন্ধকার আকাশ।

শিবশঙ্কর শুরু করলেন, “ব্ল্যাক হোল’-এর নাম শুনেছ তোমরা?”

“শুনেছি দাদি, কিন্তু ঠিক বুঝিনি।”

“তা হলে একটু পেছন থেকে শুরু করি। আলো জিনিসটা কী?”

জয় খুব বুদ্ধিমানের মতো বলল, “অন্ধকারের উলটোটাই হল আলো।”

শিবশঙ্কর বললেন, “ভালই বলেছ দাদু, তবে ব্যাখ্যাটা অত সহজ নয়। দুটো মত আছে। প্রায় দুশো বছরের পুরনো। নিউটনের মত হল, আলো হল কণার সমষ্টি, পার্টিক্ল। কণা দিয়ে তৈরি। কণার প্রবাহ। ওই সময়ের আর-একটা মত, আলো হল তরঙ্গ, ঢেউ। তখন এই নিয়ে সংশয় ছিল। আধুনিক বিজ্ঞানীরা বলছেন, দুটোই ঠিক। আলো ঢেউ, আলো কণা। এখন বিজ্ঞানীমহলে তর্ক শুরু হল, আলো যদি শুধু ঢেউ বা তরঙ্গ হয়, তা হলে মাধ্যাকর্ষণ কেমন করে কাজ করবে! বস্তুকে আকর্ষণ করা যায়, বস্তুহীন তরঙ্গ কেমন করে আকৃষ্ট হবে! কিন্তু আলো যদি বস্তুকণা হয় তা হলে গ্র্যাভিটি কাজ করবে। যেমন কামানের গোলা, রকেট, প্ল্যানেট। একদল বললেন, আলোর কণা এত জোরে ছোটে যে, গ্র্যাভিটি সেই গতিকে মন্থর করতে পারে না। তখন রোয়েমারের আবিষ্কার প্রমাণ করল, আলোক তরঙ্গের গতি অসীম নয়, তারও একটা সীমা আছে। তার মানে আলো মাধ্যাকর্ষণকে এড়াতে পারে না। গ্র্যাভিটি আলোর ওপর কাজ করে। বিজ্ঞানীরা ভাবতে বসলেন। জয় তোমাকে বলছিলুম, এই পৃথিবীতে মানুষের কাজের শেষ নেই। খডক সিং চায়ের দোকান করেছে বলে, চা করাটাই একমাত্র কাজ, তা নয়। যার মাথা আছে সে মাথার কাজ করবে। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন মিচেল সেই ১৭৮৩ সালে এক গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির পত্রিকায়। লিখলেন, যেসব তারা আকারে বিশাল এবং নিরেট ঘন, সেইসব তারার অভিকর্ষ-ক্ষেত্র বা গ্র্যাভিটেশনাল ফিল্ড ভীষণ শক্তিশালী। এমন আকর্ষক ক্ষমতা যে, সেইসব তারা আলো ছিটকে বাইরে আসতে পারে না। আলোর রশ্মি বাইরে আসতে চাইলেই টেনে ধরে রাখে। মিচেল বললেন, এইরকম অনেক অন্ধকার তারা আকাশে আছে যার আলো দেখা যায় না; কিন্তু আকর্ষণ অনুভব করা যায়। অনেকটা এইরকম, অন্ধকারে বাবু বসে আছেন সোফায়। হাত ধরে টানছেন; কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না। এই রকমের তারাকেই বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন ব্ল্যাক হোল। সত্যিই তাই, মহাকাশে অন্ধকার শূন্যতা। বস্তু অদৃশ্য অথচ আকর্ষণ বিশাল। কয়েক বছর পরে এক ফরাসি বিজ্ঞানী মার্কুইস দ্য লাপ্লেস ঠিক এই একই সিদ্ধান্তে এলেন নিজের চিন্তা ও ভাবনায়। মিচেলের গবেষণা তিনি জানতেন না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এইসব থিয়োরি একেবারে বাতিল হয়ে গেল। ফিরে এল ওয়েভ থিয়োরি। আলো বস্তুকণা নয়, তরঙ্গ। ১৯১৫ সালে আইনস্টাইন নিয়ে এলেন জেনারেল রিলেটিভিটি। বড় হলে তোমরা পড়বে। এর পর আরও কিছুকাল গেল, শেষে জানা গেল বিশাল ওজনদার তারার রহস্য। সেই জটিল বিজ্ঞান তোমরা এখনই বুঝতে পারবে না। তবে এইটুকু জেনে রাখো, এক-একটা তারা যেন হাইড্রোজেন বোমা। তারার জন্ম হল গ্যাস থেকে, যার বেশির ভাগটাই হল হাইড্রোজেন। হাইড্রোজেন অ্যাটম একটা আর-একটার ঘাড়ে এসে চাপছে। সেও তোমার অভিকর্ষের খেলা। আমি তোমাকে টানছি, তুমি আমাকে টানছ। গ্যাস যত সঙ্কুচিত হতে থাকে ততই এই ধাক্কাধাক্কি, সঙ্ঘর্ষের গতি বেড়ে যায়। অণুতে-অণুতে ঠোকাঠুকি। মত্ত মাতামাতি। এই ঠোকাঠুকিতে উত্তাপ বাড়বে, ক্রমশই বাড়বে। শেষে ওই গ্যাসের বলয় এতটাই উত্তপ্ত হবে যে, হাইড্রোজেন অণু ধাক্কাধাক্কিতে আর ছিটকে যাবে না, একটার সঙ্গে আর-একটা জড়িয়ে তৈরি করবে হিলিয়াম। হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম হওয়ার সময় যে উত্তাপ তৈরি হবে, তা ওই হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরণের উত্তাপ। আর এই কারণেই তারা আকাশে জ্বলজ্বল করে জ্বলে। এইসঙ্গে আরও এক মজার ব্যাপার হয়। গ্যাসের একটা বেলুন তৈরি হয়। প্রচণ্ড উত্তাপে গ্যাসের ভেতরের চাপ বাড়তে থাকে, এক সময় আকর্ষণ আর বিকর্ষণের শক্তি এক হয়ে তৈরি হয় উত্তপ্ত, জ্যোতির্ময় গ্যাস বলয়। রবারের বেলুনের মতো একটা ব্যাপার। ভেতরের বাতাস চাইছে আরও ফুলতে, আর রবারের শক্তি সেই ফোলাটাকে আটকে রাখছে। এইভাবে এক-একটা তারা হাজার-হাজার, কোটি-কোটি বছর ধরে তার জ্বালানির সঞ্চয় নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে। প্রত্যেকটাই এক-একটা নিউক্লিয়ার পাওয়ার হাউস।

“সে তো হল; কিন্তু এইসব হল কখন, কী করে হল, কেন হল, কেই-বা হওয়ালেন। এর কর্তাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। আমার কারখানায় সে আমি যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করছি। জয়া রান্নাঘরে বসে রাঁধছে। জয় বাগানে গাছের গোড়ায় মাটি খুঁড়ছে, পৃথিবীটাকে আমরা যখন থেকে দেখছি, তখন থেকেই এই একই দৃশ্য। কাজের পেছনে কেউ-না-কেউ একজন আছে। কেউ না থাকলে আমরা বলি ভূতের কাণ্ড। আকাশের দিকে তাকালে দেখি গ্রহ, সূর্য, চন্দ্র, তারা, ছায়াপথে তারার মেঘ। দেখছি, হাজার-হাজার বছর ধরে মানুষ এই দেখছে। দেখতে-দেখতে, বিজ্ঞানীদের আগে দার্শনিকের মাথায় প্রথম এই প্রশ্ন এল, এই জমি কার, এই আকাশ কার, গ্রহ, নক্ষত্র দিয়ে এই আকাশকে কে এমন করে সাজাল! বিশাল-এর স্রষ্টা কে? কে তা জানা যাচ্ছে না! তখন একটা সম্ভ্রম জাগছে মনে। কে তুমি, আর বলতে পারছি না। সম্মান জানাতে ইচ্ছে করছে। কে আপনি? বিশালের চেয়ে বিশালতর আপনি। বিশালতম। আপনি মানুষ নন, ভগবান, ঈশ্বর! ‘ভগ’ শব্দের অর্থ, ঐশ্বর্য। কী-কী সেই গুণ! যার জন্যে তিনি ভগবান, বীর্য, যশঃ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য। এই সৃষ্টি তাঁর। বিজ্ঞানীর এলাকা তাঁর গবেষণাগার। তিনি কার্যের পেছনে কারণের অনুসন্ধান করতে চান। তাঁর কাছে জল শুধু জল নয়, দুই অণু হাইড্রোজেন, এক অণু অক্সিজেন। এর পেছনে আর যাওয়ার দরকার নেই। হাইড্রোজেন, অক্সিজেন এল কোথা থেকে? এ-প্রশ্ন বিজ্ঞানীদের মনে এসেছে অনেক অনেক পরে। আর সেই অনুসন্ধানেরই উত্তর: বিগ ব্যাং। ‘সেকেন্ডকে একশো ভাগ করে তার একভাগ নাও। সৃষ্টি ধরো শুরু হচ্ছে। কিছু নেই, কেউ নেই। শূন্য মহাশূন্য। হঠাৎ এক বিস্ফোরণ। সময়ের শুরু। একের একশো সেকেন্ড। একটা বিস্ফোরণ নয়, একসঙ্গে অজস্র বিস্ফোরণ। ধরো গোলাকার এক মহাশূন্যের ওপরে, নীচে, এপাশে-ওপাশে একসঙ্গে অজস্র বিস্ফোরণ, বিগ ব্যাং। কালীপুজোর সময় একসঙ্গে অনেক পটকায় আগুন দিলে যা হয়। বস্তুকণা ভীমবেগে একটা থেকে আর-একটা ছিটকে-ছিটকে চলে যাচ্ছে। সেই একশো সেকেন্ড সময়ে বিশ্বের উত্তাপ একশো কোটি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। সবচেয়ে উত্তপ্ত তারার কেন্দ্রের উত্তাপের চেয়েও উত্তপ্ত সেই প্রাথমিক উত্তাপ। তোমার, আমার কল্পনার বাইরে। সেই ভয়ঙ্কর উত্তাপে বস্তু যা দিয়ে তৈরি, অণু, পরমাণু, এমনকী তার চেয়েও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ভেঙে চুরমার। কোনওটাই কোনওটার সঙ্গে সংলগ্ন নেই। বস্তুর এই অবস্থাকে আধুনিক হাই এনার্জি নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের পরিভাষায় বলা হচ্ছে, এলিমেন্টারি পার্টিকল্স। এই প্রাথমিক বস্তুকণার একটা জাত হল ইলেকট্রন, এর চার্জ হল নেগেটিভ। মাইনাস। বৈদ্যুতিক তারে এই ইলেকট্রনই প্রবাহিত হয়। বর্তমান বিশ্বের সমস্ত অণু-পরমাণুর বাইরের দিকে এই ইলেকট্রনই সাজানো আছে। এর পরেই আসছে সমান আয়তনের আর-এক ধরনের পার্টিক্ল পজিট্রন। যার চার্জ হল পজেটিভ। সৃষ্টির আদিতে পজিট্রন আর ইলেকট্রন সমান সংখ্যায় ছিল। এখন আর তা নেই। এখন হাই-এনার্জি গবেষণাগারে পজিট্রন তৈরি করা হয়, কোনও-কোনও রেডিয়ো অ্যাক্টিভ পদার্থ থেকে পজিট্রন বেরিয়ে আসে। কস্মিক-রে ও সুপারনোভায় পজিট্রন পাওয়া যাবে। সৃষ্টির সেই আদি তাণ্ডবে আরও এক ধরনের পার্টিক্ল ছিল, যার নাম নিউট্রিনো। ভৌতিক বস্তুকণা, যার না আছে আয়তন, না আছে কোনও চার্জ। সেকেন্ড অথাৎ সময় যত এগোলো, প্রলয়ঙ্কর বিস্ফোরণের পর বিচ্ছুরিত হল আলো। প্রচণ্ড আলো, ভয়ঙ্কর আলো। একালের কোয়ান্টাম থিয়োরি কী বলছে জানো, আলো আর বস্তুকণা আলাদা নয়, এক। আলো হল ফোটন। যার কোনও আয়তন নেই, বৈদ্যুতিক শক্তিও নেই। আমাদের এই ইলেকট্রিন বাল্বের দিকে তাকাও। একটা ফিলামেন্ট। বিদ্যুত্তরঙ্গ আসছে। ফিলামেন্টের এক-একটা অণু যে-মুহূর্তে উচ্চশক্তি হায়ার এনার্জি থেকে লোয়ার এনার্জিতে আসছে, সঙ্গে-সঙ্গে বেরিয়ে আসছে একটা ফোটন। এই ব্যাপারটা একের-পর-এক এত দ্রুত ঘটছে, যে সবসময় আমরা একটা স্থির আলো দেখতে পাচ্ছি। নিরবচ্ছিন্ন আলো। একমাত্র একটা ফোটো ইলেকট্রিক সেল একটা একটা করে এই ফোটন গুনে দিতে পারে।

“এদিকে সময় এগোচ্ছে, সেকেন্ডের একশো ভাগের এক ভাগ, দু ভাগ, তিন ভাগ। প্রথম বিস্ফোরণের উত্তাপ কমছে। একের দশ সেকেন্ডে তিরিশ হাজার মিলিয়ন ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। এক সেকেন্ড পরে দাঁড়াল দশ হাজার মিলিয়ন ডিগ্রি, চোদ্দ সেকেন্ড পরে দাঁড়াল, তিন হাজার মিলিয়ন ডিগ্রি। মনে করো বিশাল এক পাত্র, তার মধ্যে ভীষণ, ভীষণ গরম একটা স্যুপ। সেই অদ্ভুত স্যুপের নাম, বিজ্ঞানীদের ভাষায়, ‘কসমিক স্যুপ’। এই স্যুপ থেকে বেরিয়ে আসবে আর কিছুক্ষণ পরেই— সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র। বেরিয়ে আসবে পৃথিবী, জয়, জয়া, উদয়ন, খড়ক, শিবশঙ্কর। চলো, আজকের মতো আমরা নিদ্রা যাই।”

॥ ৩৫ ॥

সকালবেলা খড়ক সিং এসে হাজির। শিবশঙ্কর তখন সবে দাড়ি কামানো শেষ করে আর এক কাপ চায়ের জন্য চিৎকার চেঁচামেচি করছেন। দাড়ি কামানো একটা পরিশ্রমের কাজ। সেই কাজের পর শিবশঙ্কর এইভাবে বলেন, ‘চা ইজ এ মাস্ট।’ খড়ক সিংকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার চা চলবে! চায়ের দোকানের মালিক কি চা খায়?”

খড়ক সিং চেয়ারে বসতে-বসতে বললেন, “খায়। আপনাদের বাড়ির চা হল অমৃত। রাস্তা থেকে গন্ধ পাওয়া যায়।”

শিবশঙ্কর অন্দরমহলের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করলেন আবার, “এক কাপ নয় দু’ কাপ চা।”

খড়ক সিংকে এইবার শান্ত গলায় প্রশ্ন করলেন। “সাত সকালে দোকান ছেড়ে! ব্যাপারটা কী?”

“মালুম হোতা হায় কী…।”

“বাংলা তো ভালই জানো, বাংলাতেই বলো না! হালুমমালুম করছ কেন?”

“মনে হচ্ছে কী, আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি।”

“কোথায় যেতে গিয়ে হারালে? একটা রোড ম্যাপ সঙ্গে রাখলেই পারতে!”

“আমি ছিলুম নদী, হয়ে গেলুম ডোবা।”

“কেন হলে? কেউ কি তোমায় হতে বলেছিল?’

“আমার দোকানটা খুব জমেছে।”

“সে তো ভাল কথা।”

“আমি দোকান তুলে দিয়ে চলে যাচ্ছি। মেয়েটাকে আপনাদের কাছে রেখে যাব।”

“কোথায় যাবে তুমি?”

“যেমন যাই। আমার তো যাওয়ার তেমন জায়গা নেই। আমি এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে পারি না। আমার কষ্ট হয়। মাথার ওপর হিমালয়, নদী, ঝরনা, তুষার, হিমবাহ, কত তীর্থ। আমাকে কেবলই ডাকছে, চলে আয়, চলে আয়। রাতে বিছানায় শুতে যাই, বিছানা আমাকে ছুড়ে ফেলে দেয়।”

“সবই বুঝলুম, মেয়েটাকে তা হলে আনলে কেন?

“ওরা খাটিয়ে-খাটিয়ে, না খেতে দিয়ে মেরে ফেলত। মায়া পড়ে গেল, তাই নিয়ে এলুম। বড় ভাল মেয়ে। একবার ভাবছি সঙ্গে নিয়ে যাই, তারপর ভাবছি পারবে না। আমি মাইলের পর মাইল হাঁটব, পাহাড়ে চড়ব, ওর কষ্ট হবে।”

“তুমি কোথাও যাবে না, তোমাকে আমরা যেতে দেব না। তুমি এইখানে তোমার দোকান নিয়ে থাকবে। অনেক ঘুরেছ। সারা ভারতবর্ষ তোমার অন্তত একশোবার দেখা হয়েছে। এইবার এক জায়গায় বসতে শেখো।”

“সে আমি পারব না মালিক। আমি শুকিয়ে মরে যাব। আমি সেই ছেলেবেলা থেকেই ঘুরছি। কত জায়গায় আমার কত বন্ধু আছে। কত গাছ আছে! দু-তিন বছর অন্তর-অন্তর এক-একটা জায়গায় যাই খোঁজ নিতে। কে-কে বেঁচে আছে, কে-কে মারা গেছে।”

শিবশঙ্কর ঘরের এপাশ থেকে ওপাশ কয়েকবার পায়চারি করে নিলেন। চা এসে গেছে। চেয়ারে আর বসলেন না। কাপটা হাতে তুলে নিয়ে একটা চুমুক দিয়ে টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। ভয়ঙ্কর কোনও চিন্তার সময় শিবশঙ্কর বসতে পারেন না। এটা সেই ছেলেবেলার অভ্যাস। যখন কোনও অঙ্কের সমাধান আটকে যেত, শিবশঙ্কর রাস্তায় নেমে পড়তেন। হাঁটছেন আর ভাবছেন। ঠিক এক মাইলের মাথায় মাথার মধ্যে একটা চাকা ঘুরে গেল, অঙ্ক মিলে গেল খাঁজে-খাঁজে।

শিবশঙ্কর চায়ে আর-একটা চুমুক মেরে বললেন, “সারা জীবন ঘুরে-ঘুরে তুমি কী পেলে! এখন তোমার বয়েস হয়েছে, এইটা ভেবে দেখার সময় এসেছে। পেলেটা কী।”

“আনন্দ পেয়েছি। এক জায়গায় অনেকদিন আটকে থাকাটাই দুঃখের। শোনেননি বন্ধনই দুঃখের কারণ।”

“কিছু বন্ধন আছে বড় সুখের। এই যে আমি ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনি। আমিও তোমার মতো আমার যৌবনে বনে জঙ্গলে, পাহাড়ে-পর্বতে ঘুরেছি। রেলের লাইন পাতার কাজে। এখন আমার এই জীবনই ভাল লাগে। এরা বড় হবে, মানুষ হবে, আমি দেখব। আমি বেঁচে থাকব এদের মধ্যে।”

“আপনার সংসার আছে, আমার কিছুই নেই। আমি আমার ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি। বিশাল বড় একটা গাছের তলায় বসে আছি। এপাশে আমার পুঁটলি, ওপাশে আমার লাঠি। দূরে একটা জমাট পাহাড়। মাথায় তার মেঘের ডানা। সূর্য নামছে পশ্চিমে। গাছের ডালে পাখিরা সব ফিরে আসছে, আর আমি চলে যাচ্ছি। আমার ভেতর থেকে আমার আত্মা বেরিয়ে এল। ডিম থেকে ছানা বেরিয়ে এসে ডানা ঝাড়ে, সেইরকম আমার আত্মা ডানা ঝেড়ে দেহের খাঁচাটাকে একটা লাথি মেরে এগিয়ে যাবে পথিকের মতো। ছোট হতে, হতে, হতে ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে যাবে।”

“তোমার মাথা আর আমার মুণ্ড। এতই যদি সহজ হত মৃত্যু! তোমাকে বাঘে খাবে। ডাটার মতো হাড় চিবোবে। তোমার যদি বাত থাকে তা হলে অবশ্য আরাম পাবে। শোনো, ওসব রোমান্টিক কথা শুনতে ভাল, কাজের কথা ।হল,—ময়েটাকে মা-বাবার কাছে রেখে এসো। পরের দায়িত্ব কেন ঘাড়ে নিচ্ছ? পরে ওরা এসে হামলা করবে। তখন কী হবে!”

খড়ক সিং খোঁচা খেয়ে লাফিয়ে উঠল, “হামলা! হামলা করবে কে? খড়ক সিংয়ের তরোয়ালের ধার কি কমে গেছে!”

“অ্যায়, এইটাই আমি চাই। জাগো, জাগো, খডক সিং। সব যোগের সেরা যোগ, কর্মযোগ। তোমার ওই গাছতলার চায়ের দোকানটা আমার ভীষণ ভাল লেগেছে। গাছের ডালে পাখির জটলা, নীচে কতরকমের মানুষের ভিড়। উনুনে গনগনে আগুন। ছাই উড়ছে। চায়ের গন্ধ। ওরই একটা পাশে যদি থাকার ব্যবস্থা করা যায় দরমাটরমা ঘিরে, তা হলে যা হবে না?” শিবশঙ্করকে খুব খুশিখুশি দেখাচ্ছে। একটা যেন স্বপ্ন দেখছেন!

সিংজি বললেন, “আপনার আর আমার দু’জনেরই এক অভাব। সংসারে আমাদের থাকা উচিত নয়। যাক, একটা কথা বলব! এক মাসের জন্যে আমাকে ছুটি দিন, আমি ঝাঁ করে একটু ঘুরে আসি। কিছু না, চির, চিনার, গাছ আর পাহাড়গুলোকে একবার দেখে আসি। এই বিষয়ী মানুষদের সঙ্গে বেশিদিন থাকলে আমার ভেতরটা কেমন করে?”

“তোমার মেয়েকে আমরা দেখব। জয় আর জয়া যখন আছে তখন আমার আর কোনও ভাবনা নেই। মেয়ে তোমার মনের আনন্দে থাকবে। কিন্তু, তোমার দোকানটার কী হবে?”

“এক মাস বন্ধ থাকবে।”

“কত লোক ফিরে যাবে! ভোরবেলা যারা কাজে যায় তোমার দোকানে, চ খেয়ে, তাদের কী হবে! এই শীত আসছে।”

“তা হলে এক মাস দোকানটা আপনিই চালান। আপনার তো অহঙ্কার নেই। মান-সম্মানের ভয় নেই। ছেলে বড় ডাক্তার, আপনি বড় এঞ্জিনিয়ার; কিন্তু চালচলনে বোঝাই যায় না!”

“সিংজি, অহঙ্কার আমাদের নেই। তোমারও নেই, আমারও নেই। তুমি নিজেকে অতটা ছোট করছ কেন? তুমিও তো রাজার ছেলে। তবে কী জানো, চায়ের দোকান আমি চালাতে পারব না! ওটা কী হবে বলো তো, লোকদেখানো পাগলামি। নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই। আমার দিন ছোট হয়ে আসছে। এখনও অনেক কাজ বাকি। সেইসব কাজ আমাকে তুলতে হবে। তুমি অন্য কাউকে বলো। শিরিনের মাকে বলে দ্যাখো না!”

“হবে না। তার নিজের কারবার ফুলে-ফেঁপে উঠেছে।”

“তা হলে দোকানটা বন্ধই থাক। মাসখানেক পরে এসে খুলবে।”

“সেই ভাল। মেয়েটাকে আমি আজ রাতে রেখে যাব।”

রাত সাড়ে আটটার সময় খড়ক সিং লছমিকে নিয়ে এলেন। মনের মতো করে মেয়েটাকে সাজিয়েছেন! চুমকি-বসানো লাল একটা ফ্রক পরিয়েছেন। একেবারে নতুন। কপালে লাল টিপ। দু’ হাতে পরিয়েছেন গালার চুড়ি। সুন্দর একটা সুটকেসে লছমির জিনিসপত্র। দু’ বাক্স মিঠাই এনেছেন। সবাই মিষ্টিমুখ করবেন। লছমি সিংজির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। নতুন জায়গা, তাই লজ্জা করছে!

জয়া এসে মেয়েটার হাত ধরল, “লছমি! তোমার ভয় কিসের! তুমি তো আমাদের বোন।”

জয়ার মা মাথায় হাত রেখে বললেন, “এটা তো তোমার নিজের বাড়ি। আমি তো তোমার মা!”

লছমি অবাক হয়ে উমাকে দেখছে। বড়-বড় চোখ দুটো ছলছল করছে। বিশ্বাস গ্রতে পারছে না—মানুষ এত ভাল হয় কী করে! যবে তার জ্ঞান হয়েছে তবে থেকেই সে যাদের দেখে আসছে, তাদের শরীরে দয়ামায়া, স্নেহ-মমতা কিছুই নেই। তাদের কথা ছিল—হয় খাটো, না হয় মার খাও।

লছমি দৌড়ে এসে জয়ের মায়ের কোমরটা জড়িয়ে ধরল। সিংজি বললেন,

“আমি তা হলে আসি।”

তাঁর মুখটা কেমন বিষণ্ণ দেখাল। ঘর থেকে চলে যাচ্ছেন এমন ভাবে, যেন। মন চাইছে না, জোর করে যাচ্ছেন।

॥ ৩৬ ॥

জয় আর জয়া এখন দু’জনে একসঙ্গে শোয়। এই ব্যবস্থাটা নিজেরাই করে নিয়েছে। কারণ একটাই, যতক্ষণ না ঘুম আসে ততক্ষণ দু’জনে গল্প করা যায়। সারাদিন শুধু কাজ আর কাজ, পড়া আর পড়া। এদিকে কথা তো কম নেই। কত কথাই তো বলার আছে। কত গল্প! আকাশে কী আছে। আকাশের সীমা কত দূর! পৃথিবী ছাড়া আর কোথায় প্রাণী আছে! হ্যালির ধুমকেতুর তারা কবে দেখতে পাবে? ভারতবর্ষের মানুষ কি কোনওদিন চাঁদে যাবে না! পেনসিল রকেট কি তৈরি করা যায় না! হ্যাম রেডিয়ো অপারেটর হতে গেলে কী করতে হবে! সমুদ্রের তলায় কী আছে! দ্বারকা কেমন করে তলিয়ে গেল। আটলান্টিস দ্বীপ কীভাবে তলিয়ে গেল স্ট্রেটস অব জিব্রালটারে। আইসবার্জ শেষ পর্যন্ত কোথায় যায়। টাইটানিক কীভাবে তলিয়ে গেল! ডেথ ভ্যালি কোথায়। বকর-বকর করতে করতে এক সময় দু’জনেরই কথা জড়িয়ে আসে। শ্বাসপ্রশ্বাস ভারী হতে থাকে। এক সময় ঘর নিস্তব্ধ। মশারির ভেতর জয় আর জয়া গভীর ঘুমে।

আজ তারা অন্য কথা বলছে। আজকের বিষয় খড়ক সিং।

জয় বলল, “দিদি, খড়ক সিংজি ওইভাবে চলে গেল কেন? ইচ্ছে করছে না, তবু চলে গেল।”

জয় বলল, “তুই ধরেছিস ঠিক। মনে হল, সেই শক্তি নেই, সেই আনন্দ নেই। কী যেন একটা হয়েছে।”

“দিদি, সিংজি আবার ফিরে আসবে তো?”

জয়া কোনও উত্তর দিল না। বিছানায় চুপ করে বসে রইল অনেকক্ষণ। এত বড় একটা দেশ! নদী, প্রান্তর, অরণ্য, শহর! এই নির্জন রাতে অমন সুন্দর একটা মানুষ কোথা থেকে কোথায় চলেছে একা-একা কে জানে! জয়া নিজের মনেই বলে উঠল, “কোনও কথা শোনে না মানুষটা। তোমার বয়েস হচ্ছে, সেই কথাটা বোঝো না কেন? তুমি আমাদের কাছে থাকো। খাওদাও, গল্প করো, তা না, সারা ভারত ঘুরছ। তোমার ঘোরার আর শেষ নেই। কিছু একটা হয়ে গেলে, কে তোমাকে দেখবে! এমন অবাধ্য ছেলে আমি জীবনে দেখিনি।”

উত্তেজনায় জয়া মশারি তুলে খাট থেকে নেমে এল। সারা ঘরে পায়চারি করছে। জয়ার এইটাই অভ্যাস। দুশ্চিন্তা এলে সে এই রকমই করে। জয়া এই মুহূর্তে খড়ক সিংয়ের মা। পায়চারি করতে করতে বলছে, “এইবার তুমি ফিরে এসো, তোমার পায়ে আমি শেকল পরাব।”

জয় বলল, “জানিস দিদি, বেশ হত, যদি পুলিশ অ্যারেস্ট করে কিছু দিন জেলে রেখে দিত।”

“সে তো করবে না। খাঁটি একজন সাধুকে পুলিশ অ্যারেস্ট করবে কেন!”

“দিদি, তুই এইবার বিছানায় ঢুকে পড়। কাল সকালে আমরা খবর নিতে বেরোব।”

“কোথায় যাবি খবর নিতে? কোন জায়গায় যাবি? কার কাছে যাবি?”

“স্টেশনে মাস্টারবাবুর কাছে যাব। সিংজির বাড়িতে একবার যাব। শিরিনের কাছে যাব। তুই এইবার শুয়ে পড় দিদি।” আলো নিবিয়ে দু’জনে শুয়ে পড়ল। জয় জয়ার বুকে আলতোভাবে একটা হাত ফেলে রেখেছে। জয়া দু’হাতের মুঠোয় সেই হাত ধরে আছে। দু’জনে একই সঙ্গে ঘুমের সাগরে ভেসে যেতে চায়। পাশাপাশি দুটো নৌকোর মতো যেন ছাড়াছাড়ি না হয়ে যায়। একটা খাতা করেছে, ‘স্বপ্নের খাতা’। রোজ যা স্বপ্ন দেখে দু’জনে লিখে রাখে। স্বপ্নের দেশের ভূগোল আলাদা। ঘরবাড়ির রং অন্যরকম! মানুষগুলো উজ্জ্বল। সবচেয়ে আশ্চর্যের হল, স্বপ্নের দেশে রাত নেই। সেখানে যেন চির সকাল। জয় আর জয়া আর একটা খাতা করেছে, সেই খাতাটার নাম ‘দর্শন’। রোজ কিছু-না-কিছু এমন দৃশ্য বা ঘটনা চোখে পড়ে যা লিখে রাখার মতো। একটা ঘটনা বললেই বোঝা যাবে: দুটো ছেলে দোকান থেকে একটা সামোসা কিনে গাছতলায় দাঁড়িয়েছে। ভেঙে ভাগ করে দু’জনে খাবে। ভাঙতে পারছে না। ফু দিচ্ছে। এমন সময় কোথা থেকে একটা মেয়ে এল। চুলে তেল নেই। শতচ্ছিন্ন ফ্রক। কিছু বলছে না। একটু দূরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে শিঙাড়াটার দিকে। ছেলে দুটো একবার করে শিঙাড়াটা দেখছে, একবার করে মেয়েটাকে। শেষে যার হাতে শিঙাড়াটা ছিল সে এগিয়ে গিয়ে, ঠাকুরকে যেভাবে ভোগ নিবেদন করে সেইভাবে শিঙাড়াটা মেয়েটির হাতে দিল। মেয়েটা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে কেঁদে ফেলল। ছেলেটা মেয়েটার পিঠে হাত বোলাচ্ছে। মেয়েটা শিঙাড়াটা মুখে তুলতে পারছে না। হাত কাঁপছে। ছেলেটা বলছে, “বহিন, খা লো, খা লো!” মেয়েটা কাঁদছে আর খাচ্ছে। এই ঘটনার শেষে জয় লিখছে, আমার খেতে বসতে লজ্জা করে। কতরকমের খাবার! অর্ধেক খাই, অর্ধেক ফেলে দি। আমরা ক্রিমিনাল। জয় এখন বড় হচ্ছে। তার মাথায় নিজের চিন্তা আসছে। বিচার, বিশ্লেষণ আসছে। জয় লিখছে, আমরা সবাই ভণ্ড, শয়তান আমরা। স্বামীজি লিখছেন: আমি এত তপস্যা করে এই সার বুঝেছি যে, জীবে জীবে তিনি অধিষ্ঠান হয়ে আছেন; তা ছাড়া ঈশ্বর-ফিশ্বর কিছুই আর নেই। জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।

ব্রহ্ম হতে কীট-পরমাণু সর্ব ভূতে সেই প্রেমময়

মন প্রাণ শরীর অর্পণ কর সখে—এ সবার পায়।

বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?

জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।

যদি একজনের মনে—এ সংসার-নরককুণ্ডের মধ্যে একদিনও একটু আনন্দ ও শান্তি দেওয়া যায়, সেইটুকুই সত্য, এই তো আজন্ম ভুগে দেখছি—বাকি সব ঘোড়ার ডিম।

একটু ক্ষণের মধ্যেই জয় ঘুমিয়ে পড়ল। জয়ার আর কিছুতেই ঘুম আসছে না। একটু যেই আসছে, কে যেন ডেকে চমকে দিচ্ছে। বহু দূর থেকে ভেসে আসা সেই ডাক। জয়া, জয়া। জয়া আর শুয়ে থাকতে পারল না। উঠে পড়ল। নেমে এল খাট থেকে। অন্ধকার চেয়ারে বসে বোঝার চেষ্টা করল, ব্যাপারটা কী হতে পারে। মনের ভুল কী! কেবলই মনে হচ্ছে, কেউ ডাকছে।

জয়া বেরিয়ে এল ঘর থেকে। বাড়ি অন্ধকার। সবাই গভীর ঘুমে। বাইরে বাগানের দিকের আলোটা যেমন রোজ জ্বলে সেই রকম জ্বলছে। সেই আলোয় কিছু-কিছু গাছের পাতা ঝিলমিল করছে। বারান্দার শেষ মাথার কাচের জানলায় আলোর আভা। জয়া দাদির ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। দরজার ছিটকিনি ভেতর থেকে কোনওদিন বন্ধ করেন না শিবশঙ্কর। বলেই রেখেছেন যার যখন দরকার হবে আমাকে এসে ডাকবে। একটুও ইতস্তত করবে না। আমি প্রায় জেগেই থাকি। পাশের ঘরে দিদা। সেই ঘরে আজ লছমি শুয়েছে। আর একটু পরেই শেষ রাত থেকে ভোর পর্যন্ত দিদার মালা-জপ শুরু হবে। কান পাতলে শোনা যাবে তুলসীর মালা জপ করার খুটুস খুটস শব্দ।

জয়া সাবধানে, নিঃশব্দে দরজা খুলে শিবশঙ্করের ঘরে ঢুকল। দুধসাদা বিছানায় শিবশঙ্কর চিত হয়ে শুয়ে আছেন। বাগানের আলোর আভায় ঘরের অন্ধকার তেমন ঘন হতে পারেনি। স্বচ্ছ জলের মতো টলটল করছে। জয়া ঢুকতেই শিবশঙ্কর বললেন, “ঘুম আসছে না তো! মনে হচ্ছে, কে যেন দূর থেকে ডাকছে, তাই তো।”

জয়া খুব অবাক হয়ে বলল, “আপনি কী করে জানলেন দাদা?”

“আমি যে শুনতে পাচ্ছি।”

জয়া বিছানায় বসে পড়ল শিবঙ্করের পাশে। শিবশঙ্করের বুকে একটা হাত রাখল। শিবশঙ্কর দু’ হাতে সেই হাতটা ধরলেন। জয়া বলল, “এমন কেন হচ্ছে দাদি! আমারও হচ্ছে, আপনারও হচ্ছে। কে ডাকছিল দাদি?”

“অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে সেইটাই তো ধরার চেষ্টা করছি।”

“আমার কেবলই মনে হচ্ছে, খড়ক সিং ডাকছে। খড়ক সিংয়ের কোনও বিপদ হয়েছে।

“আমারও সেইরকমই মনে হচ্ছে।”

শিবশঙ্কর উঠে বসে বললেন, “এই সিগন্যালটা কি উপেক্ষা করা উচিত! মনের ভুল, কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেওয়া উচিত।”

“চলুন, আমরা দুজনে সিংজির বাড়ির দিকে একবার যাই। দেখে আসতে ক্ষতি কী!”।

শিবশঙ্কর উঠে দাঁড়াতেই জয় এল ঘরে, “ঘুমোতে পারছি না, কে ডাকছে।”

জয়া বলল, “তুইও শুনতে পেয়েছিস?”

“পাব না? খড়ক সিংয়ের গলার মতো গলা।”

তিনজনে মাঝরাতের প্রায়-অন্ধকার রাস্তায় বেরিয়ে এলেন। হিম-হিম বাতাস। এই বাতাস গায়ে লাগলেই জয়ের মনে হয়, প্রেতের নিশ্বাস কফিনের ঢাকনা খুলে বেরিয়ে আসছে।

॥ ৩৭ ॥

এত রাতে কখনও তারা রাস্তায় বেরোয়নি। দু’পাশে দু’হাত মেলে পড়ে আছে নির্জন অন্ধকারে। ঝুপুর ঝাপুর গাছে তাল তাল অন্ধকার। দু’পাশের অন্ধকার ঝোপে জোনাকির নৃত্য। বেশ লাগতে পারত; কিন্তু লাগছে না, কারণ খড়ক সিংয়ের চিন্তা। রাস্তাটা ডান দিকে বেঁকে চলে গেছে স্টেশনের দিকে, বাঁ দিকে ডাক বাংলোর মাঠ ছুঁয়ে সোজা সরলা নদীতে। চৌরাস্তার প্রশস্ত পরিসরে দুটো কুকুর ভীষণ খেলা করছে। তিরতির করে ছুটছে, লাফিয়ে-লাফিয়ে উঠছে, দু’জনে দু’জনকে জাপটে ধরে উলটে পড়ছে। লুটোপুটি খাচ্ছে। সবাই একটু থমকে দাঁড়াল সেই দৃশ্য দেখে।

শিবশঙ্কর বললেন, “বুঝলে, এইটাই হল মজা। কুকুরদের ঘড়ি নেই তো, তাই সময়ের দাসত্ব করতে হয় না। সোম নেই, শুক্র নেই, মাস নেই, বছর নেই। গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমোচ্ছে, এরা দ্যাখো কেমন মহানন্দে কুস্তি লড়ছে। দিন গেল রাত গেল, বলে কোনও দুশ্চিন্তা নেই। আমরাই কেবল, ‘সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়’ বলে হায় হায় করি।”

হঠাৎ বহু দূর থেকে হুউ-হুউ করে একটা শব্দ ভেসে এল। একটা কুকুর কাঁদছে। এই কুকুর দুটোর খেলা বন্ধ হয়ে গেল। এরা এতক্ষণ মুখে হ্যা-হ্যা করে শব্দ করছিল। সেই শব্দ বন্ধ। একপাশে চুপ করে বসে আছে। ভয় পেয়েছে ভীষণ।

জয়া বলল, “দাদি, খুব অশুভ লক্ষণ। কুকুর কাঁদছে। দূরে, ডাকবাংলোর মাঠে।”

শিবশঙ্কর প্রথমে কোনও উত্তর দিলেন না। পরে বললেন, “এসব আমাদের কুসংস্কার। কুকুর হল নেকড়ে বাঘের বংশধর। নেকড়ে হল, ‘প্যাক অ্যানিম্যাল’। দল বেঁধে ঘোরায় অভ্যস্ত। আর ভয় পেলে সমস্বরে এইভাবে চিৎকার করে অন্য দলকে জানিয়ে দেয়, বিপদের গন্ধ পেয়েছি। শিকারিরা সেই অনাদিকাল থেকে নেকড়ে শিকার করে আসছে। গুলির শব্দ বা গুলির মতো শব্দে এরা ভয় পেয়ে যায় আজও। এরই নাম ‘অ্যানিম্যাল ইনস্টিংক্ট’। কুকুরের ঘ্রাণ, কুকুরের কান খুব তীক্ষ্ম।”

শিবশঙ্করের কথার মাঝেই এই কুকুর দুটোও আকাশের দিকে মুখ তুলে একই ভাবে ডাকতে লাগল। সে ডাক সহ্য করা যায় না। গা-ছমছম করে। অজানা আশঙ্কায় বুক ভরে যায়। কুকুর দুটো ওইভাবে ডাকতে-ডাকতে ধীরে-ধীরে এগোতে লাগল ডাকবাংলোর মাঠের দিকে। মাথার ওপর তারায় ভরা কালো আকাশ। ঝুপসি গাছপালা, হিলহিলে বাতাস, কুকুরের সমবেত কান্না, জয়ের ভয় করছিল। সে দিদির হাতটা চেপে ধরল।

জয়া বলল, “কী রে, ভয় করছে!”

“কেমন গা ছমছম করছে। তোর কিছু মনে হচ্ছে না দিদি?”

‘আমারও কেমন যেন লাগছে। বাইরে বেরিয়ে এত রাত তো কখনও দেখিনি।”

শিবশঙ্কর বললেন, “কুকুর দুটো আমাদের ডিরেকশান দিচ্ছে। চলো ডাকবাংলোর দিকে যাই।”

তিনজনে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে এগোতে লাগলেন। হঠাৎ গায়ে দু-তিন ফোঁটা জল পড়ল।

জয় বলল, “কী হল? আকাশে মেঘ নেই, বৃষ্টি পড়ছে কেন?”

জয়া বলল, “মনে হয় স্বাতী নক্ষত্রের জল। এই জল ঝিনুকের পেটে পড়লে মুক্তো হয়। তাই না দাদি?”

“হোক, না হোক, ভাবতে ভীষণ ভাল লাগে। যেমন কুকুর কেন কাঁদে! অশরীরী আত্মা দেখে কাঁদে। আমরা দেখতে পাচ্ছি না। কুকুর দেখতে পাচ্ছে। পৃথিবীটাকে রহস্য দিয়ে ঘিরতে পারলে বেশ লাগে। বেঁচে থাকার একঘেয়েমিটা কেটে যায়।”

জলের রহস্যটা পরিষ্কার হল না। পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা ঘটে, যার কোনও বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই যে তারা মাঝরাতে বিছানা ছেড়ে পথে নেমে এসেছে, এর ব্যাখ্যাটা কী! কে যেন ডাকছে! তাই তো! সে ডাক কে শুনেছে? ডাকবাংলোর মাঠ এসে গেল। বিশাল সেই গুলমোহর গাছ। মাঠের মাঝখানে দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে। যে-কুকুরটা কাঁদছিল, সেটা ওই গাছটার তলাতেই দাঁড়িয়ে আছে। আর যে দুটো খেলছিল, সে দুটোও থমকে দাঁড়াল কিছু দূরে। একটা কিছু ঘটেছে ওই গাছতলায়। অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না। শিবশঙ্কর, জয় আর জয়া ধীর পায়ে এগোচ্ছেন। কিছু ঘাস, কিছু কাঁকর। জুতোর তলায় পাথরের কড়কড় শব্দ।

আরও কিছুটা এগোতেই মনে হল গাছের গুঁড়িতে হেলে আছে একটা মূর্তি। শিবশঙ্কর টর্চ ফেললেন। একপাশে পুঁটলি, আর একপাশে লাঠি, হেলে আছে খড়ক সিং। জয় আর জয়া ছুটে গিয়ে দু’পাশে বসে পড়ল। জয়া বুকে কান রাখল। খুব ক্ষীণ একটা শব্দ আছে এখনও। শিবশঙ্কর এসে নাড়িটা ধরলেন। মাথাটা নিচু করে আছেন। বোঝার চেষ্টা করছেন, মানুষটা কতদূর এগিয়েছে ওই জগতের দিকে। ঘড়ি সেকেন্ডের মাত্রায় টিকটিক করছে কি না। হাতটা সাবধানে সিংজির কোলের ওপর রেখে শিবশঙ্কর বললেন, “এই সময় উদয়নকে ভীষণ প্রয়োজন। তোমরা দু’জনে পাহারা দিতে পারবে?”

জয়া বলল, “কেন পারব না দাদি!”

“তা হলে আমি গিয়ে ডেকে আনি। তোমরা টর্চটা রাখো।”

“টর্চটা আপনি নিয়ে যান।”

“টর্চ তোমাদের কাছে রাখো। যে-কোনও সময় প্রয়োজন হতে পারে। অন্ধকারে এই পথটুকু যেতে আমার কোনও অসুবিধে হবে না।”

শিবশঙ্কর গাছকে বললেন, “বৃক্ষদেবতা। এই তিনজনকে তোমার আশ্রয়ে রেখে যাচ্ছি। দেখো কিন্তু। কোনও বিপদ যেন না হয়!”

শিবশঙ্কর বড়-বড় পা ফেলে বাড়ির দিকে চললেন। সিংজির দু’পাশে জয় আর জয়া বসে আছে। এ কী হল! খড়ক সিংয়ের তো এইরকম ইচ্ছেই ছিল। গাছের তলায় মৃত্যু আসবে রাজার পোশাকে। রাজপুত রাজাদের মতো পোশাক পরে। বর্ম, শিরস্ত্রাণ। এসে বলবেন, ‘বীর! তোমার পৃথিবীর কাজ শেষ। চলো, এইবার স্বর্গের বাগানে। সেখানে দুঃখ নেই, লড়াই নেই, শুধু আনন্দ।’

জয় আর জয়া দেখছে, মাঝরাতের তারা যেন গাছের ডাল থেকে পাতার আড়ালে ঝুলে আছে। বিরাট মাঠ ছড়িয়ে আছে চারপাশে। অন্ধকারে জমাট হয়ে আছে ডাকবাংলোটা। তিনটে কুকুর বসে আছে তিন দিকে। দূর থেকে ভেসে আসছে ট্রেনের শব্দ। কোথায় কে যেন তিনবার শাঁখ বাজাল। ভয় যে একেবারেই করছে না, তা নয়, তবে মনে হচ্ছে, কিসের ভয়! তেমন হলে, আমাদের তো সিংজি আছেন। তিনি লাফিয়ে উঠবেন। সিংজির সঙ্গে তো কারও চালাকি চলবে না!

জয়া কায়দা করে সিংজির পেছন দিকে চলে গেছে, যাতে তাঁর মাথাটা জয়ার নরম বুকে থাকতে পারে! শ্বাস-প্রশ্বাস পড়ছে বলে মনেই হচ্ছে না। শরীর বরফের মতো ঠাণ্ডা।

“তুমি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে সিংজি! তুমি এত নিষ্ঠুর! আমরা থাকব, তুমি থাকবে না! আমরা কার সঙ্গে গল্প করব! বেড়াতে যাব! খেলা করব! তুমি কেন যাবে! কে তোমাকে ডেকেছে! তুমি যে বলতে, আমার জয় আর জয়াকে বড় করে দিয়ে তারপর আমি যাব। সেই কথা তো তুমি রাখলে না সিংজি! শুনেছি, ভগবান আছেন। ভীষণ-ভীষণভাবে ডাকলে তিনি সাড়া দেন। এই গাছ, এই আকাশ, গভীর রাত, এ তো বাড়ি নয়, তা হলে ভগবান কেন আসবেন না! আমরা আরও বড় হয়ে যাই তারপর না হয় সিংজি যাবেন!”

জয়া সেই ভগবানকে ডাকছে। তিনি ইচ্ছে করলে সবই তো করতে পারেন।

জয়া জয়কে, বলল, “পুঁটলিটা একবার খুলে দেখ তো, একটা চাদর পাস কি না। গা-টা বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।”

জয়া সিংজিকে দু’-হাতে জড়িয়ে ধরে আছে। তার শরীরের গরম যতটা দেওয়া যায়! জয় পুঁটলিটা খুলতেই একটা লোটা গড়িয়ে এল বাইরে। দু-একটা জামাকাপড়। তিন-চারখানা বই। একটা কম্বল। এর বেশি কিছু নেই। জয় কম্বলটা নিয়ে সিংজির গায়ে চাপা দিয়ে দিল। কুকুর তিনটে সজাগ প্রহরীর মতো সব দেখছে। গাছের ডালে একটা পাখির নড়েচড়ে বসার শব্দ।

জয়া বলল, “পা দুটো দেখ তো জয়।”

“খুব ঠাণ্ডা রে দিদি।”

“দু’ হাত দিয়ে বেশ করে ঘষ।”

জয় পায়ের পাতা ঘষছে। আর তো কিছু করার নেই। জয়া বেশ করে জড়িয়ে ধরে আছে। একনাগাড়ে ভগবানকে ডাকছে। ‘তোমার মৃত্যুকে বারণ করো ভগবান। যার যাওয়ার সময় হয়নি, তাকে কেন নিয়ে যাচ্ছ?’ সিংজি একসময় একটু যেন নড়ে উঠলেন। জয়া ভাবল, ভগবান তার কথা বুঝি শুনছেন। দূরে একটা গাড়ির হেডলাইট দেখা যাচ্ছে। ওই তো দাদি আসছেন বাবাকে নিয়ে। এখন একটা ইনজেকশান। জয়া ডাক্তারের মেয়ে। সে জানে, কী হলে কী করতে হয়। গাড়িটা হু-হু করে আসছে। ভগবান আসছেন। সবাই তো তাই বলেন, “ডাক্তারবাবু আমাদের ভগবান!”

॥ ৩৮ ॥

জয়ার আলিঙ্গনে খড়ক সিংয়ের দেহটা একবার কেঁপে উঠেই স্থির হয়ে গেল, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই গাড়িটা এসে থামল। উদয়ন আর শিবশঙ্কর ঝটপট নেমে এলেন।

জয়া চিৎকার করে বলল, “যাঃ ফুরিয়ে গেল।”

জয়া কেঁদে ফেলেছে। জয় দাড়িয়ে আছে হতভম্ব হয়ে। জয়া কোনও ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। জানা বাংলাও মনে আসছে না। ফুলে-ফুলে কাঁদছে। তাদের বাড়িতে কান্না জিনিসটা সবাই অপছন্দ করেন। মানুষ আজ হোক কাল হোক মারা যাবেই। জীবনে হরেকরকম দুঃখ আসতেই পারে। তোমাকে সহ্য করতে হবে। সেটাও একটা শিক্ষা। মন খারাপ হবেই। সেটাকে চেপে রাখতে হবে ভেতরে। হাঁউমাউ করলে মৃত মানুষ ফিরে আসবে না। জয়া সেই কারণে ফুলছে। খড়ক সিংয়ের মাথাটা এলিয়ে আছে তার বুকে।

উদয়ন নাড়ি দেখলেন। শিবশঙ্করকে বললেন, “কিছু করা গেল না। আর পাঁচটা মিনিট আগে আসতে পারলে হয়তো টেনে রাখা যেত।”

“যে যাবে সে যাবেই। তা না হলে তোমার নতুন গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হবে কেন! ওইখানেই আমাদের দশটা মিনিট সময় চলে গেল।”

“তেলে ময়লা এসে গেল।”

“খড়ক এইভাবে এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে ভাবতেও পারিনি। আমাদের আনন্দের হাট ভেঙে দিয়ে গেল।”

উদয়ন বললেন, “মনে হচ্ছে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। যাই হোক, জয়া খুব বেকায়দায় পড়েছে। আসুন আমরা ধরাধরি করে ঘাসের ওপর শোওয়াই। তারপর অ্যাম্বুলেন্স আনতে হবে।”

শিবশঙ্কর বললেন, “দাড়াও, আগে একটা কম্বল বিছিয়ে দিই। জায়গাটায় কাঁকর বালি আছে। এমনই শোওয়ালে লাগবে। উদয়ন আর জয় খড়ক সিংয়ের পোঁটলা থেকে তার সেই বিখ্যাত গেরুয়া রঙের কম্বলটা বের করে মাঠে বিছিয়ে দিল। তারপর ধরাধরি করে খড়ক সিংকে তার ওপর শোওয়ানো হল। জয় কাদোকঁদো গলায় বলল, “বাবা, একবার চেষ্টা করে দ্যাখো না, তুমি ইচ্ছে করলে সবই পারো। তুমি তো কতজনকে বাঁচিয়েছ বাবা।”

উদয়ন জয়কে বুকের কাছে টেনে নিলেন। বুঝতেই পারছেন, ছেলেটার ভেতরে কী হচ্ছে। মানুষের ক্ষমতা কতটুকু, দেহ থেকে প্রাণ একবার বেরিয়ে গেলে কিছুই আর করার থাকে না। টিউব থেকে টুথপেস্ট একবার বেরিয়ে গেলে আর ঢোকানো যায় না।

জয়া বসে আছে খড়ক সিংয়ের মাথার কাছে। শিবশঙ্কর দাঁড়িয়ে আছেন বুকে হাত রেখে। মাথার ওপর বিশাল গাছ। শাখা-প্রশাখা হাত মেলে আছে ঊর্ধ্ব আকাশে। যেন ভয়ঙ্কর এক নৃত্য থেমে গেছে কারও আদেশে। তারারা তাকিয়ে আছে নীচের পৃথিবীর দিকে। এই দৃশ্যটাও নিশ্চয় তাদের চোখে পড়ছে। তারার মতোই ঝকঝকে একজন মানুষ খসে পড়েছে। এক রাজপুত বীর। যাঁর জীবনের ইতিহাস আভাসে কিছুটা জানা গেছে। অতীতটাকে যিনি সবসময় অতীতেই রাখতে চাইতেন। অতীত ছাড়াই যিনি একটা নতুন বর্তমান তৈরি করতে চেয়েছিলেন।

শিবশঙ্কর সেই নিস্তব্ধতায় হঠাৎ বলে উঠলেন, “এ হল ইচ্ছামৃত্যু। খড়ক এইরকম একটা মৃত্যুর কথা প্রায়ই আমাকে বলত। আর ঠিক তাই হল। সেইভাবেই চলে গেল। অসুখটসুখ নয়, বাঁচার ইচ্ছেটা চলে গেল তো মানুষের হয়ে গেল!”

সবাই প্রথমটায় একটু থমকে গিয়েছিলেন। বক্সিং-এর রিং-এ যেমন হয়। ঘুসি খেয়ে পড়ে গেল। চোখে অন্ধকার। তারপর প্রতিযোগী আস্তে-আস্তে দড়ি ধরে উঠে দাড়াল। উদয়ন বললেন, “আমি অ্যাম্বুলেন্স আনি।”

“অ্যাম্বুলেন্স এনে কী হবে! অ্যাম্বুলেন্স ডেডবডি নেবে না। আনতে হবে একটা ভ্যান। খড়ক সিংকে প্রথমে আমরা নিয়ে যাব তার বাড়িতে। তারপর সকলের সঙ্গে, ব্যবস্থা কী করা যায়, পরামর্শ নিতে হবে।”

“সৎকারই তো একমাত্র ব্যবস্থা।”

“আত্মীয়স্বজন কি কেউ নেই! অতখানি একটা বাগানবাড়ির কে ওয়ারিশান হবে! পুলিশের পারমিশন ছাড়া আমরা সৎকারেরও অধিকারী নই। অনেক ঝামেলা পরে আসতে পারে।”

“আপনারা তা হলে অপেক্ষা করুন। আমি থানা থেকেই ভ্যান আনছি।”

“দাড়াও, সেখানেও কিছু চিন্তার আছে।”

শিবশঙ্কর আর উদয়ন গাছের তলায় শিকড়ের ওপর পাশাপাশি বসলেন। পুলিশের হাতে তুলে দিলে, আইন খুব কড়া। পোস্টমর্টেম তো করবেই। অকারণ কাটা-ছেঁড়া। এখনও রাত অনেক বাকি। পৃথিবী নিদ্রিত। কিছু না, নিঃশব্দে সিংজিকে তুলে নিয়ে গিয়ে তাঁর ঘরের বিছানায় শুইয়ে দাও। সব সমস্যার সমাধান। তারপরে একটা ডেথ সার্টিফিকেট ও সৎকার।

জয় গাড়ির পেছনের দরজাটা খুলে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। শিবশঙ্কর, উদয়ন আর জয়া ধরাধরি করে সিংজিকে পেছনের আসনে আধশোয়া করে রাখল। সমস্যাটা হচ্ছিল পা নিয়ে। শরীর ক্রমশই শক্ত হয়ে আসছে। একেই বলে ‘রাইগার-মর্টিস’। জয়ার হয়তো কিছুই হচ্ছে না; কিন্তু জয়ের একটু অস্বস্তি লাগছিল। প্রাণহীন দেহ। যে মানুষটাকে সে খড়ক সিং বলে জানত, সে মানুষটা চলে গেছে। খোলটা পড়ে আছে। ক্রমশ শক্ত হয়ে যাচ্ছে শরীরটা। পা দুটোকে আরও একটু ভাজ করতে গেলে মট করে ভেঙে যাবে। এই দেহটাকে জয় চেনে না। এই দেহটা তার কাছে আতঙ্কের মতো। ভয় দেখাচ্ছে। একে নিয়ে পেছনের আসনে সে বসতে পারবে না। শরীরটা বরফের মতো ঠাণ্ডা।

শিবশঙ্কর ভাবছেন, তাঁরা কি খুনি! কীরকম ভয়ে-ভয়ে দেহটা তুলছেন। কেউ যেন দেখে না ফেলে! দেখে ফেললেই বিপদ। দিনকাল আর আগের মতো নেই। মানুষ এখন মানুষকে সন্দেহের চোখে দেখে। শিবশঙ্কর জয় আর জয়াকে বললেন, “তোমরা চট করে পেছনে ঢুকে বসে পড়ো।”

জয় যা ভেবেছিল তাই হল। মৃতদেহের পাশে বসতে তার ভয় করছে।

জয়া বলল, “দু’জনে বসা যাবে না দাদি। আমি বসছি। জয়কে আপনি সামনে নিয়ে নিন।”

উদয়ন চালকের আসনে বসতে বসতে বললেন, “কুইক, কুইক, ভোর হয়ে আসছে।”

শিবশঙ্কর পেছনের ডিকিতে খড়ক সিংয়ের পোঁটলাটা তুলে দিলেন। গাড়ি চলতে শুরু করল। সিংজির বাড়িতে পৌঁছতে দশ মিনিটের মতো সময় লাগল! বিশাল বাগান ঝিম মেরে আছে। অজস্র ঝিঁঝিঁ পোকা ঝনঝন করে ডাকছে। এইসব গাছপালা, ফুল, ফল, সিংজি আর কোনওদিনই দেখতে পাবেন না। একসময় কত কী করে রেখে গেছেন এই উদ্যানে! এইখানেই তো তাঁর বেশি সময় কাটত।

ঘরে তো ঢোকা হবে; কিন্তু দরজায় তালা। সেই তালার চাবি কোথায়! খড়ক সিং যে জামাটা পরে আছেন সেটা একটা জোব্বার মতো। অনেক তার পকেট। জয়া খুঁজছে। এক-এক পকেটে এক-একরকম জিনিস। একটা পকেটে হাঁসের ডিমের মত দেখতে ধবধবে সাদা একটা পাথর রয়েছে। আর-এক পকেটে ছোট্ট একটা ডায়েরি। বুকপকেটের ভেতর দিকের পকেটে কিছু টাকা রয়েছে। সবই আছে, কেবল চাবিটাই নেই।

পোঁটলাটা খোলা হল। সবই আছে সেখানে, এমনকী হোমিওপ্যাথিক ওষুধের একটা ব্যাগ। পাউচের মতো। কিন্তু চাবিটা নেই। এইবার কী হবে! এদিকে যে ভোর হয়ে আসছে। আকাশের কালো ক্রমে তৃরল হয়ে যাচ্ছে।

বেশ একটু দুশ্চিন্তারই কারণ হল। চাবি কোথায়! তালা ভাঙা কি সহজ কাজ। অত বড় লাগাই তালা! সেই সময় জয়ের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। অবশ্য বুদ্ধিটা সে পেয়েছে ইংরেজি সিনেমা থেকে। চাবিটা পকেটে বা পোটলায় নেই, আছে অন্য কোনও লুক্কায়িত জায়গায়। দরজার আশেপাশে কোনও ফুলগাছের টবের তলায়, অথবা কোনও গাছের গোড়ায় পাথরের তলায়।

সবাই যখন ভাবছে, জয় তখন চুপিচুপি খুঁজতে বেরিয়েছে। দরজার দু’ধারে, এপাশে-ওপাশে দুটো করে এরিকা পামগাছের টব। দরজার সামনে একটা পাপোশ বেশ বড় মাপের। জয় পাপোশটা টানতে-টানতে একপাশে নিয়ে গেল। শানবাঁধানো মেঝে। চাবির কোনও সন্ধানই নেই। খুব ভালভাবে দেখে মনে হল, একটা কিছু রহস্য এইখানেই আছে।

জয় দাদির কাছ থেকে টর্চটা চেয়ে আনতে গেল। শিবশঙ্করও এলেন রহস্য অনুসন্ধানে। পরিষ্কার মেঝে, তার মাঝখানে একটা টালি একেবারে খাপে-খাপে বসানো। কারণটা কী! জয়ের মতো শিবশঙ্করও কারণটা বুঝতে চাইলেন। ওইখানে একটা কন্দর আছে। একটা পকেট। টালিটাকে তুলতে হবে। কিন্তু কীভাবে!

এইবার আবার জয়ের সন্ধানী আবিষ্কার। একটা পামগাছের টবের মাটিতে একটা খুরপির মতো কী গোঁজা রয়েছে। জয় মাটি থেকে সেটাকে টেনে তুলল। ফলাটা বেশ শক্ত ব্লেডের মতো। জয় সেই যন্ত্রটা এনে শিবশঙ্করের হাতে দিল। এঞ্জিনিয়ার মানুষ। বুঝতেই পারলেন, এটার কোনও বিশেষ ব্যবহার আছে। এইটাই হয়তো খাজে ঢুকিয়ে টালিটাকে তোলা যাবে।

গাড়ির পেছনের আসনে খড়ক সিংয়ের মাথা জয়ার বুকে হেলে আছে। একটা মানুষ, যার কোনও শ্বাসপ্রশ্বাস পড়ছে না। হিমশীতল দেহ। জয়ার ভয় করছে না।; কিন্তু ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কে আর চাঁদের আলোয় বাগানে বসে দেশ-বিদেশের সাধুসন্তের গল্প শোনাবেন! ইতিহাসের পুরনো কথা বলবেন! ডিমের মতো সাদা পাথরটা কি শিব! ছোট্ট ডায়েরিটায় কী লেখা আছে!

উদয়ন জিজ্ঞেস করলেন, “চাবির সন্ধান পাওয়া গেল?”

শিবশঙ্কর বললেন, “হয়তো!”

“ভোর যে হয়ে এল!”

জয়ার হঠাৎ মনে পড়ে গেল সেই ছেলেবেলার কবিতা:

ভোর হল দোর খোলো

খুকুমণি ওঠো রে!

ওই দেখ জুঁইশাখে

ফুলখুকি ছোটো রে!

রবিমামা দেয় হামা

গায়ে রাঙা জামা ওই!

কী সুন্দর! রবি মামা দেয় হামা! জয়া বলল, “সিংজি ওঠো! ভোর তো হয়ে গেল!”

॥ ৩৯ ॥

চাবিটা শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল। দরজার তালায় চাবিটা কিন্তু লাগল না। এ তো মহা সমস্যা! সমস্যার সমাধান এল জয়ের মাথা থেকে। জয় বলল, “দাদি, পেছন দিকে একটা দরজা আছে। এটা মনে হয় সেই দরজার চাবি।”

শিবশঙ্কর জয়কে নিয়ে বাগানের পেছন ঘুরে বাড়ির বিপরীত দিকে চলে গেলেন। এদিকে খিড়কির দরজা। সেই দরজাতেও একটা তালা ঝুলছে। চাবিটা সেই তালাতে লাগল। দরজা খুলে তাঁরা ভেতরে ঢুকলেন। সেটা একটা ঢাকা বারান্দা। কয়েকটা চেয়ার আর টেবিল সাজানো। একপাশে সিন্দুকের মতো দেখতে বড় একটা কাঠের বাক্স। আকার-আকৃতি দেখলে মনে হবে, ভেতরে অনেক জিনিস ঠাসা আছে। শিবশঙ্করের এখন অন্য ভাবনা, সামনের দরজার চাবিটা কোথায়! এই চাবি দিয়ে বারান্দা পর্যন্ত আসা গেছে। ভেতরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সিংজি কায়দাটা বেশ ভালই করে গেছেন। একটা চাবি পেলেও ভেতরে যেতে হলে বেশ মাথা খাটাতে হবে।

জয় বলল, “দাদি, সামনের দরজার চাবিটা এইখানেই আছে কোথাও।”

“ঠিকই বলেছ, আমারও সেইরকমই মনে হচ্ছে। এসে দেখি মাথা খাটাই।”

শিবশঙ্কর একটা চেয়ারে চোখ বুজে ধ্যানে বসলেন। বারান্দার দেওয়ালে কয়েকটা ছবি ঝুলছে। ছবির পেছনে অবশ্যই রাখবে না। ওটা খুবই সহজ জায়গা। এমন একটা জায়গা যেটা খুবই সহজ, কিন্তু সহসা মাথায় আসবে না। হঠাৎ শিবশঙ্করের মনে হল, সিন্দুত্রে পায়। কোনও একটা পায়ায় ছোট্ট একটা পকেট আছে। চাবিটা আছে তার মধ্যে।

শিবশঙ্কর জয়কে বললেন, “সিন্দুকের পায়া চারটে চেক করো। একটা পায়া ফাঁপা আছে।”

জয় হাঁটু গেড়ে বসে পায়াগুলো দেখছে। সত্যিই তাই, পেছন দিকের ডান দিকের পায়াটা ফাঁপা। একটা পকেট রয়েছে। সেই পকেটে শুয়ে আছে লম্বা একটা চাবি। একটু টানতেই বেরিয়ে এল। ফাঁকটা চাবিটার মাপেই তৈরি। মানুষটার বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারা যায় না। খড়ক সিং রহস্য ভালবাসতেন। তা তো বাসবেনই। রহস্য যে তাঁর রক্তেই ছিল। আলোয়ার, যোধপুর, বুন্দেলখণ্ড, চিতোর। প্রাসাদ, দুর্গ, সুড়ঙ্গপথ, গুপ্তঘর, এইসবের মধ্যেই তো তাঁর ছেলেবেলা কেটেছিল। বয়েস যেই বাড়ল, হঠাৎ একদিন মনে হল, পৃথিবীটা অনেক বড়। রাজপ্রাসাদের চেয়ে রাজপথের আকর্ষণ অনেক বেশি। এইরকমই মনে হয় কিছু হয়েছিল। কোথাও হয়তো বড়রকমের একটা দুঃখ জমেছিল। হয়তো দেখেছিলেন, বিষয়ের জন্য ভাই ভাইকে খুন করছে। বাবা ছেলেকে আততায়ীর হাতে তুলে দিচ্ছেন। দুঃখটা যে কী, তা আর জানা হল না।

সামনের দরজাটা খোলা হল। বিশাল সেই হলঘরটা। যে-ঘরে কত জমায়েত হয়ে গেছে। গান, বাজনা, খাওয়াদাওয়া, মজলিশ। কত রাত এই ঘরে কেটে গেছে হইহই করে। অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধ ছড়িয়ে আছে সারা ঘরে। আতরের? ধূপের? ধুনোর! কোনও মসলা হয়তো জ্বলছিল। নিভে গেছে জ্বলতে-জ্বলতে। গন্ধটা ভেসে বেড়াচ্ছে। যদি এমন ভাবা যায়, এ হল খড়ক সিংয়ের পূত আত্মার গন্ধ। দেহ ছেড়ে অনেক, অনেক, কোটি, কোটি আলোকবর্ষ দূরে চলে যাওয়ার আগে দেখতে এসেছেন নিজের ফেলে যাওয়া আয়োজন। পারস্যের গালিচা, ফৈজাবাদের ঝাড়লণ্ঠন, মোরাদাবাদের বিদুরির কাজ। জয়পুরের মার্বেল স্ট্যাচু। পথে-পথে ঘুরলে কী হবে, রাজকীয় শৌখিনতা ভেতর থেকে বেরিয়ে আসত।

খড়ক সিংকে শুইয়ে দেওয়া হল তাঁর পালঙ্কে। ঘরের আলমারিতে দামি-দামি সব পোশাক, আলোয়ান, জাজিম, কাশ্মিরি শাল। খুব দামি একটা আলোয়ান বের করে খড়ক সিংয়ের দেহ ঢেকে দেওয়া হল। মুখটা শুধু জেগে রইল। চিরনিদ্রায় নিদ্রিত এক বীর। আর ঠিক তখনই আলো ফুটল। যত পাখি ছিল সব একসঙ্গে ডেকে উঠল। একদল কচি শিশুর কলরবের মতো। একটা দাঁড়কাক কোথায় বসে ডাকছে। অদ্ভুত ডাক, খং খং। জয়া খুঁজতে-খুঁজতে ছোট একটা দেরাজের মধ্যে, যা খুঁজছিল তা পেয়ে গেল। ভাল-ভাল ধূপের প্যাকেট, চন্দন তেল, গোলাপ আর খসের আতর। জয়া খড়ক সিংয়ের শিয়রে একগোছা ধূপ জ্বেলে দিল। ভাইকে নিয়ে বাগানে গেল। ফুলের সন্ধানে। সেই তো শিউলি। ফিসফিস কথার মতো ঝরে আছে কত ফুল। অন্যদিকে ফুটে আছে রাশি রাশি গোলাপ। এইসব ছেড়ে চলে গেলে তুমি। এই এত সুন্দর পৃথিবী। তুমি খুব নিষ্ঠুর খড়ক সিং। জয়া আর জয় শিউলি কুড়োচ্ছে। সাদা পাখির হলুদ ঠোঁট। শিশির তো পড়েছেই, দু-একটা বড় দানা, জয়ার চোখের ফোঁটা-ফোঁটা জল। খুব প্রাণের মানুষ যখন চলে যায় তখনই জানা যায় আমাদের ভেতরে একটা নদী আছে, একটা আকাশ আছে, মেঘ জমে সেখানে, একটা সানাই আছে। আপনি বাজে। চোখ দুটো কাচের শার্সি, ফোঁটা-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে আপনি।

একটু বেলা বাড়তেই খবর ছড়িয়ে পড়ল সারা শহরে। খড়ক সিংকা অন্ত হোগিয়া। এত লোকও ভালবাসত মানুষটাকে। চার্চের ফাদার, মসজিদের মৌলবী, মন্দিরের পুরোহিত, স্টেশনের মাস্টারমশাই, ডাকঘরের বড়বাবু, কেউই আর বাকি রইলেন না। বিশাল জনসমাগম। সবাই নীরব। সকলেরই চোখ ছলছলে। ফুল, শুধু ফুল। সিংজি চাপা পড়ে গেছেন। এই একটা ব্যাপারে মানুষের কার কিছু নেই। মেনে নিতে হবে। জয়ের খুব রাগ হচ্ছে। ভগবান ভাল নন। মানুষকে কষ্ট দেওয়াই তাঁর কাজ। জয়ের পাশে লছমি দাঁড়িয়ে আছে হতভম্ব হয়ে। একসময় খুব কেঁদেছিল। এখন আর কাঁদছে না। চোখের জল গালে শুকিয়ে আছে।

বেলা একটার সময় শবযাত্রা শুরু হল। একটা ম্যাটাডর ভ্যানে শুয়ে আছেন। খড়ক সিং। কয়েক মন ফুল তাঁর ওপর সাজানো। বেশিরভাগই গোলাপ। সবাই চলেছেন সরলার তীরে। নদী যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেইখানে নির্জন, ঘাসে ঢাকা শ্মশান। বিরাট বিরাট গাছ জায়গাটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। মাটি ফুঁড়ে কোনও এক সময় একটা পাথর ঠেলে উঠছিল একপাশে। অনেকটা শিবলিঙ্গের মতো দেখতে। হিন্দুদের কাছে তিনিই এখন শিব। বড়লোক ভক্ত মাথার ওপর একটা ছাদ চড়িয়ে দিয়েছেন। জমিয়ে দিয়েছেন পাথরবাঁধানো বেদি। চারপাশ খোলা। জায়গাটার বেশ একটা গাম্ভীর্য আছে। সন্ধের দিকে ভয়-ভয় করে।

সরলার কূল ছুঁয়ে সাজানো হল চিতা। উদয়নই সব করছেন। শ্মশানে যে কাঠ দেয় সেই বৃদ্ধ রামরিক সিংজির মৃত্যুতে এত ভেঙে পড়েছেন যে, কাঠ টানতে গিয়ে মাঝে-মাঝে বসে পড়ছেন। সিংজির সঙ্গে দুপুরে ওই শিবের চাতালের পাশে দু’জনে দাবা খেলতেন। মন ভাল থাকলে সিংজি ভজন গান শোনাতেন। শিবরাত্রির রাতে সিংজি ওই ঘাসে ঢাকা জমিতে প্রাণ খুলে নাচতেন। নাচতে-নাচতে ভোর। রামরিকের সেইসব কথা মনে পড়ছে আর জল এসে যাচ্ছে চোখে।

চিতায় শয়ন করিয়ে উদয়ন জয়কে ডাকলেন, “এসো, মুখাগ্নি তোমাকেই করতে হবে। মৃত্যুর সঙ্গে এই তোমার প্রথম পরিচয় জয়। পৃথিবীর দুটি সত্য, জন্ম এবং মৃত্যু। আর কোনও সত্য আছে কি না আমরা জানি না। যন্ত্রণা আছে, বঞ্চনা আছে, শত্রুতা আছে, হত্যা আছে, দারিদ্র্য আছে, ব্যাধি আছে, তবে তার কোনওটার মধ্যেই সত্য নেই। সবই আপেক্ষিক। মৃত্যু হল অগ্নি, পবিত্র। সকলকেই গ্রাস করে। রাজা অথবা ভিখারি। বলো, ওঁ অগ্নিং প্রজ্বলিতং বলে..।” জয়ের হাতে একটা জ্বলন্ত মশাল। হাত কাঁপছে। চিতায় চিত হয়ে শুয়ে আছেন খড়ক সিং। ঠোঁটে আগুন ছোঁয়াতে হবে। “বাবা, আমি পারছি না। আমি যে ভীষণ ভালবাসতুম। আমরা একসঙ্গে চাঁদের আলোয় সরলা নদীর তীরে জারুল গাছের তলায় বসে কত গল্প করেছি। শীতের রোদে বনভোজন। নদী পেরিয়ে আমরা নীলপাহাড়ে গেছি শীতের পাখি দেখতে। আমরা রেলে চেপে গেছি চুনারে। আমরা গড়ের অন্ধকারে লুকোচুরি খেলেছি। আমরা বাগানের গাছের ডালে দোলনা বেঁধে আচার চাখতে-চাখতে দোল খেয়েছি। আমি পারব না।”

বলো জয়, “জাতবেদং হুতাশনম সুবর্ণবর্ণমমলং… পারতে তোমাকে হবেই। পৃথিবীতে যখন এসেছ, দুঃখ, সুখ সমানভাবেই ভাগ করে নিতে হবে। হাট যেমন বসবে, হাট তেমনই ভাঙবে। ফুল যেমন ফুটবে, ফুল তেমনই ঝরবে। সবকিছুর যেমন শুরু আছে, সবকিছুর তেমনই শেষ আছে।” মশালের আগুনের লকলকে জিভ। সত্যই তার বর্ণ সুবর্ণের মতো। ফরফর করে শব্দ হচ্ছে। আগ্রাসী তার খিদে। উদয়ন মন্ত্র পড়ছেন, “ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্ৰহ্মকর্মসমবিনা। যে-কাজের জন্য তুমি এসেছিলে, সে কাজ শেষ হল। যাও, এইবার ফিরে যাও অনন্তে।”

জয় একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেল। সে আর কিছু ভাবতে পারছে না। ঘটনা তাকে ঠেলে নিয়ে চলেছে। যা হবে তা হবেই। চিতার আগুন লাফিয়ে উঠল আকাশের দিকে, যেন নাম-সঙ্কীর্তনের দল দু’হাত আকাশে তুলে নাচছে। সবাই এখন গোল হয়ে বসে খুব চাপা গম্ভীর গলায় একটানা বলে চলেছেন, “রাম নাম সত্য হায়।” ধোঁয়া উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে। নীল আকাশ। পাখি আর ডাকছে না। বাতাসও বইছে না। পড়ন্ত রোদে সরলার জল লাল। পৃথিবীতে খড়ক সিংয়ের কে রইল। পরকে করেছ নিকট বন্ধু। সবাই তোমার আপন।

জয়া লছমিকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে ভূঁইফোঁড় শিবের চাতালে। মেয়েটা দুদিনের জন্য মানুষের মতো মানুষ একজনকে পেয়েছিল। ভাগ্য খারাপ, সে চলে গেল। জয় দেখছে আর ভাবছে, সিংজি গেছেন, সে আর কী করা যাবে! কিন্তু আমরা তো আছি। আমাদের আর-এক বোন হল। জয় ভাবছে, যদি আমি কোনওদিন লেখক হতে পারি, তা হলে খডক সিংয়ের জীবনী লিখব। খুঁজতে খুঁজতে চলে যাব বিকানির, যোধপুর, আলোয়ার। অনুসন্ধান করে বের করব জন্মস্থান, পিতা-মাতা। কোন শহর, কোন প্রাসাদ। একটু-একটু করে মানুষটাকে ফিরিয়ে আনব। অস্পষ্টকে স্পষ্ট করব।

শিবশঙ্কর একটা পাথরের ওপর বসেছেন। বসে- বসে ভাবছেন, আই উইল মিস হিম ভেরি মাচ। লাঠিটা কাঁধে, তাতে একটা পুঁটলি বাঁধা, মাথায় একটা বৃহৎ পাগড়ি, পায়ে জরির কাজ করা নাগরা। কে যায়, খড়ক সিং। ওই তো সূর্য ডুবছে। চিতা নিভে এসেছে। ছাই। আগুনের রেখা কোন হরফে কী লিখে যাচ্ছে বোঝার উপায় নেই। হয়তো সেই কথাই লিখছে, যে-কথাটা তিনি নাতিকে প্রায়ই বলেন:

তুলসী যব জগমে আয়ো জগ হাসে তোম রোয়।

আয়সে কর্ণি করলো কি, তোম হাসো জগ রোয় ॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *