শিউলি – ২০

॥ ২০ ॥

সিঁড়িটা প্যাঁচ মেরে-মেরে উঠে গেছে দোতলায়। বাড়ির প্রধান অংশের সঙ্গে এদিকটার কোনও সম্পর্ক নেই। শিবশঙ্করেরই বেশি যাওয়া-আসা। জয় আর জয়া ছুটির দিনে কখনও-সখনও এসেছে। গা-ছমছম ভয়ে বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি। পালিয়ে গেছে। কিসের ভয়, কেন ভয় তা বোঝার চেষ্টা করেনি। “দিদি ভয়,” বলে, জয় আগে ছোটে, তারপর জয়া। দু’জনেই হাঁপাতে থাকে। শেষে একসময় সব ভুলে যায়। জায়গাটা গোয়েন্দা গল্পের মতো। একটা লম্বা টানা বারান্দা। কাচ দিয়ে ঘেরা। দুপুরে অদ্ভুত একটা আলো আসে। বাইরের গাছপালা পাতার ছায়া ফেলে রাখে। ডান দিকে বেশ বড় একটা ঘর। সেই ঘরের দুটো দরজা। সব সময় তালা বন্ধ। নির্জন দুপুরে কোথা থেকে ভেসে আসে ঘড়ির শব্দ। টিক টিক ঠিক ঠিক। বারান্দাটা শেষ হয়েছে আর-একটা ছোট ঘরে। দরজাটা কাচের। সেই ঘরে আছে ছোট একটা টেবিল আর একটা চেয়ার। দরজার মাথায় দেওয়ালে একটা হরিণের শিং। ফ্যাঁকড়া বের করে ভয় দেখাচ্ছে, যেন। মৃত্যু যেন জীবন্ত হয়ে আছে। মানুষের নিষ্ঠুরতা। বন্দুকের শব্দ। এই দিকটায় সবসময় কেমন যেন একটা ওষুধ-ওষুধ গন্ধ বেরোয়।

ঠিক বারোটা বাজল। রাত বারোটা। ঘড়িটা আছে ঘরের মধ্যে। শব্দের সঙ্ঘাতিক ঝঙ্কার। চড়া সুরে বাঁধা। জয়ের কী হয় জানি না, রাতের ঘড়ি জয়ার কাছে ভীষণ ভয়ের বস্তু। সবাই যখন ঘুমোয় ঘড়ি তখন একা-একা চলছে তো চলছেই। সময়টাকে টেনে-টেনে নিয়ে চলেছে। রাতের রেলগাড়ির এঞ্জিনের মতো। জয়ার তখনই মনে পড়ে যায় সেই গল্পটা—ডাইনি ও ঘড়ি। সেই ডাইনি করত কী, রোজ গভীর রাতে নিঃশব্দে তার মায়াবলে এক-একটা বাড়িতে ঢুকে পড়ত আর সেই বাড়ির ঘড়িটাকে জোরে চালিয়ে দিত, এত জোরে যে, সকালে সবাই ঘুম থেকে উঠে দেখত, বুড়ো হয়ে গেছে। সব চুল পাকা, গায়ের চামড়া কুঁচকে গেছে, চোখের দৃষ্টি মরে গেছে। দাঁত পড়ে গেছে। কোমর ভেঙে গেছে। কুকুরটা কবে মরে গিয়ে কঙ্কাল হয়ে পড়ে আছে বিছানার তলায়। সারা বাড়ি ঝুল আর ধুলোয় ভরে গেছে। বাইরের জগৎও পালটে গেছে কত। সময় চুরি করত সেই ডাইনি। মানুষের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস। বাদুড় যেভাবে ফল চোষে সেইভাবে চুষে নিত মানুষের সময়। তখন কী হল, সেই শহরের মেয়র মতলব বাতলালেন, রাতে কেউ আর যেন না ঘুমোয়। সারাদিন-রাত জেগে থাকো। তা এমনি তো জেগে থাকা যায় না। সবাই কাজ করো। সারাদিন-রাত শুধু কাজ। দেখতে দেখতে সেই ছোট্ট, শান্ত, নির্জন শহর বড় হতে লাগল। ধনে-জনে-সম্পদে-আলোয়। বিশাল থেকে বিশালতর। চারপাশে তার সমুদ্র। দূর থেকে জাহাজের নাবিকরা দেখতে পেত আলোর মালায় সাজানো সেই দেশ। বাতাসে ভেসে আসছে কনসার্টের সুর। মাথার আকাশে বাজি থেকে-থেকে রং-বেরঙের ফুল ছড়িয়ে দিচ্ছে। সমুদ্রের ধারে সুন্দর-সুন্দর পোশাক পরে ছেলেমেয়েরা ঘুরছে। ঘুরছে নাগরদোলা। অমনি তারা বলত, ওই সেই হোলিল্যাণ্ড। হোলিল্যাণ্ড থেকে হয়ে গেল হল্যাণ্ড।

শিবশঙ্কর তালা খুললেন। সেই ওষুধ-ওষুধ গন্ধটা আরও বাড়ল। শিবশঙ্কর সবার আগে ঢুকে আলো জ্বালালেন। একটা হলঘর। মেঝেটা কালো কষ্টিপাথরের। চকচকে লম্বা একটা টেবিল মাঝখানে। চারপাশে ছ’টা চেয়ার। সমস্ত দেওয়াল জুড়ে শুধু বই আর বই। এপাশে-ওপাশে নানা মাপের শো-কেস। সেই সব কেসে দেশ-বিদেশের পুতুল। দেশের নাম লেখা রয়েছে, ডেনমার্ক, জার্মানি, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, চিন, রাশিয়া, আইসল্যান্ড, আফ্রিকা, সুইজারল্যাণ্ড, ভারত। ঠিক যেমন দেশ, তেমন পুতুল। সেইরকম সাজপোশাক। রঙিন ছাতা ধরা জাপানি গেইসা। স্পেনের বুলফাইটার। রাশিয়ার ব্যালেরিনা। চিনের ভুড়িঅলা। জার্মানির গায়ক। ইংল্যাণ্ডের রয়্যালগার্ড। আমেরিকার কাউবয়। হাঁ হয়ে যাওয়ার মতো দৃশ্য। প্রতিটি দেশের চরিত্র তাকে-তাকে সাজানো। ডেনমার্কের ফুলওয়ালি। কল্পনার জোর থাকলে ওই পুতুলগুলোর দিকে তাকিয়ে সেই দেশে চলে যাওয়া যায়। ডেনমার্কের ফুলের বাগানে, ইংল্যাণ্ডের বাকিংহাম প্যালেসে। জার্মানির কনসার্টে, আমেরিকার টেক্সাসে। জয় ভাবছে, দাদা এত দিন কেন ঢুকতে দেননি এই ঘরে, কারণটা কী! ঘরের শেষ মাথায় বড়-বড় দুটো কাচের আলমারি। তার তাকে-তাকে নানা মাপের কাচের জার। প্রতিটি জারে তরল পদার্থ। আর তাতে ভাসতে সরীসৃপের দেহ। বহুরকমের সাপ, লিজার্ড, বিছে, মাকড়সা, অদ্ভুত-অদ্ভুত চেহারার কীটপতঙ্গ সব। প্রত্যেকটার গায়ে নামের লেবেল, লাতিন ভাষায়। তারপর বই। এনসাইক্লোপিডিয়া, জেনারেল নলেজ, বিজ্ঞানের বই, অ্যাস্ট্রনমি, ফিজিকস, কেমিস্ট্রি, সাইকোলজি, এসপিডিশান, শিকার, জীবনী, দর্শন। কী নেই! সব আছে। কত বই এক জায়গায়। জয় আর জয়া চোখ ফেরাতে পারছে না।

শিবশঙ্কর ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন, “এইসব তোমাদের। অনন্ত জ্ঞানভান্ডার। নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। জানব, আমি আরও জানব। কলম্বাসের সমুদ্র-অভিযানের চেয়েও রোমাঞ্চকর। জ্ঞানসমুদ্রে ভেসে যাও। কত দেশ, কত জাতি, তাদের রীতি-নীতি, ভাষা, উৎসব, কত প্রাণী, গিরি-অরণ্য, সমুদ্র-আকাশ। সব এই ঘরে তোমাদের জন্য মজুত। শুধু ভেসে পড়ো। তোমাদের এই বয়সে বোঝার মতো সহজ বইও আছে।”

“দাদা আপনি এই ঘরটা সব সময় বন্ধ করে রাখেন কেন?” জয় প্রশ্ন করল।

শিবশঙ্কর হেসে বললেন, “তার একটা কারণ আছে দাদু। আমার বাবা ছিলেন মস্ত বড় শিকারি, আবার সে-যুগের সেরা একজন জীববিজ্ঞানী। ওই যে দেখছ কোণের বড় বাক্সটা, ওর মধ্যে অনেক ফায়ার আর্মস আছে, আর ওই আলমারিটায় আছে অনেক বিষ, যার এক কণা ছড়িয়ে গেলে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ব, মারাও যেতে পারি, সেই কারণেই এই সাবধানতা।”

“তা হলে আমরা এই ঘরে আসব কী করে?”

“আমার সঙ্গে আসবে, বই নিয়ে চলে যাবে। থাকবে না বেশিক্ষণ।”

“কী কী অস্ত্র আছে দাদা?”

“প্রায় সবরকম। এখানে বাবার সময় খুব ডাকাতি হত, আর হত রায়ট। আত্মরক্ষার জন্য বাবাকে সবই রাখতে হয়েছিল। এটা কিন্তু খুব গোপনীয়, তোমরা কাউকে বলবে না। অস্ত্র রাখা এখন বেআইনি। কিন্তু কী করব! বাবার স্মৃতি। ওইসব প্রাচীন অস্ত্র এখন আর পাবে না, জাদুঘরে রাখার মতো। লোভ ছাড়া যায় না। ভবিষ্যতে তোমরা বড় হয়ে জাদুঘরে দান করে দিয়ো। নাও চলো, রাত অনেক হল।”

জয় বলল, “বাবা কেন আসেন না এই ঘরে?”

“তোমার বাবার কথা আর বোলো না। মহা ভিতু। তার নাকি ওই সাপগুলোকে দেখলে শরীর কেমন করে, রাতে ঘুম আসে না। ওর আবার ভয়ঙ্কর ভূতের ভয়। এই বয়সেও ভূত দেখতে পায় যেখানে-সেখানে। কী বলবে বলো। আমার সারা জীবনটাই তো ভূতের সন্ধানে কেটে গেল, একটিবারের জন্যও দেখা মিলল না। ভূত আর ভগবান, দুইই সমান। কৃপা না করলে দর্শন মেলে না।”

জয়া বলল, “এদিকটায় এলেই কিন্তু গা-ছমছম করে। কেমন যেন মনে হয়।’’

“সে তোমার ওই পুরনো জিনিসপত্তরের জন্য। দেখবে, একটা পুরনো আমলের আলমারি, কি খাট, কি টেবিল দেখলেও গা-ছমছম করবে। সেইজন্য আমার ব্যাখ্যা হল, অতীতই ভূত। বর্তমানের সঙ্গে যা বেমানান, সেইটাই ভূত।”

জয় বলল, “আর ওই কাচের দরজাঅলা ঘরটা! ওটা কী দাদা! ওখানে কী হত?”

“ওই ঘরটার খুব একটা স্টোরি আছে। তোমরা এখানে শুনলে ভয় পাবে। নীচে চলো, বলব।”

॥ ২১ ॥

খড়ক সিং সেই যে বেরিয়েছিলেন, তারপর হাঁটতে-হাঁটতে গান গাইতে-গাইতে সোজা স্টেশনে। সে কম দূর নয়, অনেকটা পথ। মাঝারি গতিতে হাঁটলে পাক্কা এক ঘণ্টা। এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিট লাগল। সিংজির পকেটে একটা পকেট-ঘড়ি সব সময় থাকে। পুরনো আমলের জিনিস। ঘড়িটা নিয়ে সিংজির ভীষণ অস্বস্তি। ঘড়িটা সোনার। ডায়ালের রংটা সমুদ্রের জলের মতো সবুজ। সোনার কাঁটা। এত দামি ঘড়ি পকেটে রাখতে ইচ্ছে করে না। যে-জিনিস অন্যের লোভ জাগায়, সে-জিনিস রাখা কেন বাপু! চোর কেন চুরি করে? তোমার অনেক আছে, তার কিছু নেই বলে। তোমার নেই, তার নেই, আমার নেই, কোনও ঝামেলাই নেই। খড়ক সিং যখনই ঘড়ি দেখেন, লুকিয়ে দেখেন, যেন মহা অপরাধ করছেন।

কুড়ি মিনিট বেশি লাগার কারণ, সিংজির হঠাৎ চা খেতে ইচ্ছে করেছিল। পথের পাশে দেহাতি দোকান। একজন লরি ড্রাইভার বসে-বসে চা খাচ্ছিলেন, তিনি সিংজির চেহারা আর পোশাক দেখে ভেবে নিলেন, ইনি একজন মস্ত গুনিন। এ-কথা, সে-কথা হতে-হতে পেড়ে ফেললেন নিজের অসুখের কথা। পেটের কাছে মাঝে-মাঝেই কী একটা ঠেলে ওঠে বলের মতো। তখন আর খাড়া থাকা যায় না, শুয়ে পড়তে হয়। সিংজি এতই ভদ্র যে, পাছে লোকটি ভুল ভাবার জন্য বিব্রত হয় তাই অস্বীকার করতে পারলেন না। না বললে লোকটির আশাভঙ্গ হবে তাই সিংজিকে গুনিন সাজতে হল।

সিংজি বললেন, “তা হলে চা খাচ্ছ কেন?”

“চায়ের জোরেই যে আমার গাড়ি চলে। চা হল ইস্টিম।”

কথাটা একেবারেই বেঠিক নয়। বড়লোকরা দিনে দু’বার খায়, সকালে আর বিকেলে। গরিব লোকেরা বারেবারে খায়। সিংজি নিজেই তো তিরিশবার খায়। পরীক্ষার জন্য শিরা থেকে রক্ত টানলে রক্তের বদলে চা আসবে। যেভাবেই হোক পেটের ব্যাপারটা সিংজি ভালই বোঝেন। সেটা ওই নিজের পেট বুঝতে-বুঝতে হয়েছে। হাকিমের কাছে গেছেন, তাঁদের কথা শুনেছেন, অসুখ না সারুক নিজের জ্ঞান বেড়েছে। ওইজন্য বলে, ভাল ডাক্তার হতে হলে ভাল রোগী হও আগে।

“তা তোমার পেট খালি থাকলে হয়, না যখন ভর্তি থাকে?”

“খালি থাকলে হয়।”

সিংজি বললেন, “শুয়ে পড়ো।”

লোকটি বেঞ্চের ওপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। সিংজি পেটটা খানিক টেপাটিপি করলেন আচ্ছাসে। সেটা না করলে লোকটির বিশ্বাস আসবে না। পরীক্ষার শেষে বললেন, “এক চামচে কাঠকয়লার গুঁড়ো মধু দিয়ে মেড়ে রোজ সকালে খাও। তোমার পেট আচ্ছা হয়ে যাবে।”

লোকটি উঠে বসে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সিংজির মুখের দিকে। এমন ওষুধ সে জীবনে শোনেনি। সিংজি বললেন, “সারতে ঠিক সাতদিন লাগবে।”

লোকটি কিছুটা বিশ্বাস, কিছুটা অবিশ্বাস নিয়ে তার গাড়িতে উঠে চলে গেল। চলে যাওয়ার পর দেখা গেল হয় সে ইচ্ছে করে চায়ের দাম দেয়নি, নয়তো কাঠকয়লা খাওয়ার আতঙ্কে ভুলে গেছে। খড়ক সিং দোকানের মালিককে বললেন, “কোঈ বাত নহি, আমি দিয়ে দিচ্ছি।”

দোকানের মালিক সসম্রমে জিজ্ঞেস করলেন, “জি, আপনি হাকিম আছেন?”

সিংজি মুচকি হাসলেন। মিথ্যে কথা বলাটা ঠিক হবে না। আবার এটাও ঠিক, হাকিম যে নই তাই বা কী করে বলা যায়! অনেকরকম ওষুধ তো সত্যিই জানা আছে। সেসব ওষুধ অবশ্য খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। কোথায় কোন জঙ্গলে, কোন পাহাড়ে হয়ে আছে কে জানে!

দোকানদার বললেন, “হাকিমজি! আমার একটা অসুখ ভাল করে দিতে পারেন!”

“কী অসুখ?”

“আমার রাতে ঘুম হয় না। সারারাত জেগে থাকি।”

এইসব ওষুধ সিংজির একেবারে মুখস্থ, একটুও ভাবতে হয় না। বললেন, ‘‘চন্দন বাটা খাও, রোজ সকালে। আর সূর্য ওঠার আগে সরলা নদীতে চান করো, আর যত পারো লাউ, ঢ়্যাঁড়স খাও। রোজ কমসে কম তিন মাইল জোরে-জোরে হাঁটো। আমি ফিরে এসে খবর নেব, তুমি কেমন আছ!”

সিংজি পয়সা বের করলেন, লোকটি কিছুতেই নিল না। সিংজির মহা বিপদ। তিনি কারও কাছ থেকে কিছু নেন না। এইটা তাঁর একটা ধর্ম। এখন জোর করে দিলে লোকটি দুঃখ পাবে। সিংজি দু’ কাপ চায়ের দাম উনুনের ধারে চুপিচুপি চোরের মতো রেখে পালিয়ে এলেন।

বেশ লাগছিল শেষ বেলায় হাঁটতে। সারাদিনের গরমের একটা গন্ধ বেরোচ্ছে। উত্তপ্ত পাথর, পাতা, ফল-ফুলের গন্ধ। পৃথিবীটা ভয়ঙ্কর রকমের সুন্দর বলে খড়ক সিং গান ধরেছেন। গাইতে-গাইতে চলেছেন। রাস্তাটা উঁচু। দু’পাশ ঢালু হয়ে দিগন্তবিস্তৃত মাঠে গিয়ে মিশেছে। সেখানে ছাই রঙের আলো। জায়গায়-জায়গায় কালো পাথরের স্তর। পাহাড় হতে-হতে থেমে গেছে। এই কচি পাহাড় বা পাহাড়ের সম্ভাবনা দেখতে সিংজির খুব ভাল লাগে। কখনও যদি জোর ভূমিকম্প হয়, তা হলে হয়তো আবার ঠেলে উঠতে থাকবে। এইরকমই নাকি হয়। একজন পণ্ডিত মানুষ একবার ট্রেনে যেতে-যেতে পৃথিবীর অনেক গোপন খবর দিয়েছিলেন। আকাশের অনেক রহস্যের কথা বলেছিলেন। পৃথিবী সব সময় ভেতরে-ভেতরে থরথর করে কাঁপছে। সেই কাঁপনে সমুদ্রের তল উঁচু হয়, নিচু হয়। সমভূমি হঠাৎ ওপর দিকে ঠেলে উঠতে থাকে। মানুষ এর কিছুই তেমন জানতে পারে না। কত তারা হঠাৎ মরে যায়। আকাশেও তৈরি হয় গভীর গর্ত।

খড়ক সিং এইসব ভাবতে-ভাবতে, নিজের সঙ্গে কথা কইতে-কইতে, গান গাইতে-গাইতে স্টেশনে পৌঁছে গেল। ছোট্ট স্টেশন, কিন্তু খুব সুন্দর। নদীর নামেই স্টেশনের নাম—সরলা। বড়-বড় ইউক্যালিপ্টাস গাছ। দেখলেই মনে হয়, কেউ যেন ঠাকুদা, কেউ যেন বাবা, জ্যাঠামশাই, কাকা। কোনওকালে বেড়াতে এসে, এইখানে সব স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কৃষ্ণচূড়া বাতাস করছে। অর্জুন পাহারা দিচ্ছে। এই স্টেশন থেকে ছোট একজোড়া লাইন দূর এক জঙ্গলে চলে গেছে। এককালে সেখানে বড়-বড় কাঠের ব্যবসা ছিল। এখন কাঠকাটা বন্ধ হয়ে গেছে সরকারি আইনে। ছোট রেলে চেপে লকড়ি আর আসে না। মাঝে-মাঝে পাথর আসে। কালো, সাদাটে। আর আসে গোরু, ভেড়া, ছাগল। শীতের সময় সবজি আসে।

একপাশে মাস্টারমশাইয়ের ঘর, তারবাবুর ঘর। চারপাশটা বেশ সবুজ ঘাসে ঢাকা। ছোট-ছোট ফুল গাছ, পাতাবাহার গাছ। একটা তিতকুটে গন্ধ। গন্ধটা বেশ ভালই লাগে সিংজির। কোনও একটা গাছের গন্ধ। কী গাছ, তা জানা নেই। বনতুলসী হতে পারে। ভাঁটফুল হতে পারে। গন্ধটার একটা বেশ মাদকতা আছে। মাস্টারমশাই খাতাপত্তর দেখছেন, তারবাবু টরেটক্কা। এই যন্ত্রটা খড়ক সিং ভীষণ ভালবাসে। কত দূরে কে একজন বসে আছে, কোন শহরে কোন জেলায় টরেটক্কার ভাষায় তার সঙ্গে কথা হচ্ছে।

মাস্টারমশাই মুখ তুলে বললেন, “আরে সিংজি যে, আবার কোথায়! বইঠিয়ে। ট্রেন তো চলে গেছে অনেকক্ষণ, আজ তো আর এদিকে ট্রেন নেই বাবুজি!”

খড়ক সিং একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। ছোট স্টেশন। সব ট্রেন সবদিক থেকে আসে না এখানে, এখান থেকে প্রথমে যেতে হবে পটনায়। সেখান থেকে যেখানে যাবে যাও।

তারবাবু বলেন, “খড়কজি, একটা রেক আসছে, রাত ন’টার সময় এখান দিয়ে পাস করবে। ছোট লাইন ধরে ডুমডুমায় যাবে, আপনি একবার বলেছিলেন, ওইদিকটা দেখতে ইচ্ছে করে। বলেন তো তুলে দিই। একেবারে খালি। বকরি আর শালপাতা আনতে যাচ্ছে।”

খড়ক সিং লাফিয়ে উঠলেন। ডুমডুমা! সেই লাইন! জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলে গেছে। গভীর ঘন জঙ্গল। কোনও লোকালয় নেই। শুধু গাছ আর গাছ। দিনের বেলাতেও অন্ধকার। একটা দুটো আদিবাসী গ্রাম। মাঝেমধ্যে বাঘ বেরোয়। বুনো শূকর। ডুমডুমা পৌঁছতে তা প্রায় ঘণ্টা পনেরো লাগবে।

খড়ক সিং তবু বললেন, “আমি যে কাশ্মীর যাব বলে বেরিয়েছি।”

তারবাবু বললেন, “সে তো সবাই যায়, যে-কোনও সময় যাওয়া যায়, ডুমডুমায় ক’জন যেতে পারে।”

একেবারে খাঁটি কথা। লাখ কথার এক কথা। খড়ক সিং খুব যে সাহসী, তা বলা যায় না। ভূতের ভয় তো আছেই, সেটা কিছু নয়। অনেক বড়-বড়, নামকরা মানুষের ভূতের ভয় আছে। বাঘ-ভাল্লুককে সে ভয় পায় না, ভয় পায় ছোট-ছোট কিম্ভুতকিমাকার পোকাকে। এইসব পোকা জঙ্গলে প্রচুর। রাত্তিরবেলা তিষ্ঠোতে দেয় না। তবে একটা কথা আছে। খড়ক সিং ভয় পেতে ভীষণ ভালবাসেন। সেই কারণেই ভয়ের জায়গায় ছুটে-ছুটে যান। ভয়ে শরীর হিম হয়ে যায়, সেটাই আনন্দের।

খড়ক সিং বললেন, “হ্যাঁ আমি যাব। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে।”

“তা হলে ঠিক ন’টার সময় এখানে হাজির থাকবেন।”

“বহত আচ্ছা।”

মাস্টারজি বললেন, “রাতের খাওয়াটা তা হলে কোথায় হবে!”

সিংজি বললেন, “সে যা হয় হবে।”

“আপনি আমার কোয়ার্টারে চলুন। আমি এখনই যাব।”

মাস্টারজি একা মানুষ। ত্রিভুবনে কেউ নেই। ঘরে একটা খাটিয়া, একটা কুঁজো, মুখে গেলাস চাপা। মোটা একটা শতরঞ্জি। একটা চুলা। এক সেট থালা-বাসন। চুলা ধরাতে-ধরাতে মাস্টারজি বললেন, “কাল দুপুরে পৌছবেন, সঙ্গে দশখানা রুটি অন্তত থাকা চাই, আর গুড়। জল তো নিতেই হবে। তা হলে হিসেবটা হয়ে যাক। এখন আপনার দশ, আমার দশ, কাল সকালে আমার পাঁচ, আপনার দশ, মোট পঁয়ত্রিশ, তার মানে চল্লিশ, চল্লিশখানা রুটির মতো আটা বের করে আপনি মেখে ফেলুন, আমি ততক্ষণে ডালটা তৈরি করে ফেলি। দুধ চাই নাকি, দুধ?”

সিংজি বললেন, “দুধ এখন পাবেন কোথায়?”

“ব্যবস্থা আছে, আছে। ওই ওপাশে আমার ছাগল আছে, দুয়ে নিয়ে এলেই হবে। ডালটা চাপিয়েই যাব। তবে একটা কথা, ছাগলের মেজাজ যদি খারাপ থাকে, দুধ হবে না। সে-কথা আগেই বলে রাখছি।”

সিংজি আটা মাখতে বসলেন। এই কাজটা সিংজি ভালই পারেন। তাঁর কুস্তির গুরু শিখিয়েছিলেন। বলেছিলেন, খড়ক, কুস্তি শেখার আগে আটা ঠাসা শেখ। কনুই দিয়ে আটার তালে রদ্দা মারবি। সেই রদ্দাই পরে লড়াইয়ের সময় লাগাবি। ময়দার মতো ঠাসবি প্রতিপক্ষকে।

ডালে একহাতা খাঁটি ঘি ঢেলে দিলেন মাস্টারজি। গন্ধে মাত হয়ে গেল চারপাশ। দরজার বাইরে শুয়ে আছে একটা কুকুর। সিগারেটের যেমন দুটো মাপ হয়, নর্মাল সাইজ আর কিং সাইজ, কুকুরটারও তেমনই কিং সাইজ। ডাল, রুটি খেয়ে-খেয়ে এইরকম হয়েছে। পাঁচখানা রুটি তার বরাদ্দ, এক বাটি ডাল, এক কাপ দুধ। তারপর একটা কবিরাজি গুলি খেয়ে, সামনের কম্পাউন্ডের বকুলতলায় দুর্গা বলে শুয়ে পড়ে। কারও সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ নেই। ভগবানের নাম নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। গলায় আবার একটা মাদুলি।

মাস্টারজি দুধ দুইতে গেছেন। সিংজি হাতে চাপড় মেরে-মেরে, দু’পাশে দুলিয়ে-দুলিয়ে রুটি গোল করছেন। চুলায় গনগনে আগুন। হঠাৎ একটা হুড়মুড় করে আওয়াজ। মাস্টারজির গলা, “মর গিয়া, মর গিয়া।” কুকুরটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে আওয়াজের দিকে ছুটল ঘেউ-ঘেউ করতে করতে। সিংজি গান গাইছিলেন। গান থেমে গেল। অন্ধকারে ঝটাপটির শব্দ।

॥ ২২ ॥

ঘোর অন্ধকার। কেরোসিন তেলের গন্ধ। খড়ক সিং বুঝতে পারছেন না, ব্যাপারটা কী হল। কুকুরটা সমানে চিৎকার করছে। খড়ক সিং এইবার একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, “আরে বেটা চিল্লাতা কিঁউ।” তারপর চিৎকার করে ডাকলেন, “মাস্টারজি।” অন্ধকারে একটা চ্যাটাই পড়ে ছিল, তার তলা থেকে ভেসে এল ক্ষীণ কণ্ঠস্বর, “হাঁ জি। আমাকে মেরে ফেলেছে।”

মেরে ফেললে কেউ কথা বলতে পারে না। মাস্টাজির ছাগল খুব খারাপ মেজাজে ছিল। মেরেছে শিঙের গুঁতো। তাতেও শান্তি হয়নি। মেরেছে জোড়াপায়ে লাথি। লণ্ঠনটা একপাশে ছিটকে চলে গেছে। ছাগল তার ঘরের দরমাটরমা ভেঙে বেরিয়ে চলে গেছে। সে যাক। রাগ পড়লে আবার ফিরে আসবে। আপাতত মাস্টারজি আহত। বুকে চোট লেগেছে। কেটেকুটে গেছে।

সিংজি ধরে-ধরে ঘরে নিয়ে এলেন। কপালের একটা পাশ আলুর মতো ফুলেছে।

“এই বদমেজাজি ছাগলটা রেখেছেন কেন?”

“রাখব কেন? ছাগলটা নিজের থেকেই রয়েছে। আমি তো বলেই দিয়েছি, তোমার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। তবু কি শোনে! ঠিক ফিরে আসে। ফিরে এলে কী করব! অতিথিকে না খাইয়ে রাখব! এমন নয় যে, দুধ দিতে পারে না! ইচ্ছে করলেই পারে, আসলে সেই ইচ্ছেটাই নেই।”

“ওষুধ-বিসুধ কোথায় আছে বলুন, লাগিয়ে দিই।”

“ওষুধ কিছু নেই, উনুন নিবে গেলে ছাই লাগিয়ে দোব। সবচেয়ে ভাল ওষুধ। রুটিগুলো আগে করে ফেলি, ট্রেন আসার সময় হয়ে গেল।”

মাস্টারজি উনুনে চাটু বসালেন। সিংজি বললেন, “কেন তকলিক নিচ্ছেন, আমি তো বানাচ্ছি। এসব কাজ আমার খুব ভাল আসে। প্রতাপ সিং আমার গুরু ছিলেন। কুস্তি শেখাতেন। তাঁর আখড়ায় রোজ রাতে আমাকে দুশো রুটি তৈরি করতে হত। পহেলবানদের খানা তো আপনি জানেন। ডেলি চল্লিশ সের, পঞ্চাশ সের। যতবড় পহেলবান তত ভারী খানা। শেষকালে হাতির সঙ্গে কমপিটিশন।”

এইরকম সব কথা হতে-হতে দশখানা রুটি নেমে গেল। অড়হরকা ডাল, গরমাগরম রোটি আর আচার। মাস্টারজি একটা ঢেকুর তুললেন, ঠিক যেন বাছুরের ডাক। এই ঢেকুর যতক্ষণ না উঠছে ততক্ষণ খাওয়াই হল না। খডক সিং মাপমতো খেলেন, তারপর বজ্রাসনে বসে কাঠের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ালেন। এইসব ছোটখাটো টোটকা গুরুর কাছ থেকে পাওয়া। বজ্রাসনে বসলে হজম হয়, চুল আঁচড়ালে টাক পড়ে না কোনওদিন, চুলে পাক ধরে না সহজে। মাস্টারজির এসব জানা ছিল না। হজমের কোনও গোলমাল এখনও পর্যন্ত নেই। এই অঞ্চলের জলে লোহা পর্যন্ত হজম হয়ে যায়, তবে চুল ক্রমশ পাতলা হয়ে আসছে। সামনের দিকটায় টাক পড়ার ভাব হচ্ছে। মাস্টারজিও কিছুক্ষণ বজ্রাসনে বসে রইলেন।

ট্রেন আসার সময় হয়ে গেল। ঘরের জানলা দিয়ে স্টেশন দেখা যাচ্ছে। নির্জন, নিরালা। একটি মাত্র বাতি জ্বলছে। কেমন একটা মায়া। এই রেকটা পাশ করিয়ে দিতে পারলেই মাস্টারজির ছুটি। তখন তিনি খাটিয়া ফেলে শুয়ে পড়বেন। শুয়ে শুয়ে ছেলেবেলার কথা ভাববেন। সাহেবগঞ্জের সেই বাড়ি, বাগান, গঙ্গার ধার, পাহাড়, পাহাড়ের মাথায় রাতের বেলা আগুনের রেখা। ঘাসে আগুন ধরিয়ে দিত দেহাতিরা। বাবার কথা মনে পড়বে। ফরসা, টকটকে চেহারা। কালো কোট পরে ওকালতিতে যেতেন। মায়ের কথা মনে পড়বে। সন্ধেবেলা রামচরিতমানস পড়তেন সুর করে। মনে পড়বে দিদির কথা। এইসব ভাবতে-ভাবতে মাস্টারজি ঘুমিয়ে পড়বেন। তখন দূরে বহুদূরে, নদী, পাহাড়, জলজঙ্গল টপকে ছুটছে মেলট্রেন ডিহরি-অন-সোন, দেরাদুন, দিলসাদগঞ্জ। কত কত দেশ, কত লোক, কত ভাষা!

থালাবাসন, ঘটি, গেলাস সব একপাশে পড়ে রইল। খড়ক সিংয়ের রুটি আর গুড়ের প্যাকেট তৈরি। এইবার খাওয়ার পালা। মাস্টারজি পাঁচখানা রুটি আলাদা করে রেখেছিলেন। সেই রুটি পাঁচখানা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলেন।

খডক সিং জিজ্ঞেস করলেন, “কাকে দেবেন? স্টেশনে কেউ আছে?”

মাস্টারজি ধরা-ধরা গলায় বললেন, “সে যদি ফিরে আসে তা হলে খাবে কী?”

“কার কথা বলছেন? এত রাতে আর কে আসবে?”

“আমার ছাগল। ফিরে সে আসবেই। আমাকে ছেড়ে যাবে কোথায়! রাগ করে গেছে। রাগ কমে গেলেই ফিরে এসে আমাকে খুঁজবে। মাস্টারজি, মাস্টারজি বলে ডাকবে। আমাকে ভীষণ ভালবাসে যে।”

মাস্টারজি সেই ভাঙা ঘরে একটা পাত্রে ছাগলটার জন্যে রুটি আর গুড় রাখলেন, তারপর স্টেশনের দিকে যেতে-যেতে বললেন, “সিংজি, পৃথিবীতে সকলের কথাই ভাবতে হয়, সকলকে নিয়েই থাকতে হয়। এ হল মেলামেশা, ভাব-ভালবাসা, বন্ধুত্বের জায়গা।”

সিংজি বললেন, “সে আর আপনি আমাকে কী বলবেন! আমি তো সেই ছেলেবেলা থেকেই এই কথা বিশ্বাস করে আসছি, আর সব ছেড়ে পথে-পথে ঘুরছি। লোকে ধন, অর্থ কত কী পায়, আমি পেয়েছি মানুষ আর মানুষের ভালবাসা।”

লোহার বেড়া টপকে দু’জনে প্ল্যাটফর্মে এসে গেলেন। মাস্টারজির ঘরে একটা ব্যস্ততা। রেকটা আসছে। তারবাবু আগের স্টেশনের সঙ্গে বার্তাবিনিময় করছেন। লাইনম্যান চলে গেছেন তাঁর গুমটি ঘরে। সিগন্যাল-রুমে সিগন্যাল ম্যান। একটা ট্রেন আসা কি সহজ কথা। খড়ক সিংয়ের এইসব দেখতে ভীষণ ভাল লাগে। সিগন্যালের পাখা পড়ে গেছে। জ্বলে উঠেছে সবুজ আলো। লাইনের পাশ দিয়ে যে দু’সার তার চলে গেছে, সেই তারে ঝাঁঝ একটা শব্দ। মাস্টারজির এখন অন্য চেহারা। রেলকোম্পানির সেই অদ্ভুত কোটটা গায়ে চাপিয়েছেন। কাগজপত্র রেডি করছেন। সেই একটু আগের ছেলেমানুষি ভাবটা আর নেই। এখন তিনি পুরোপুরি ইস্টিশন মাস্টার।

খড়ক সিং প্ল্যাটফর্মে খাড়া। কাঁধে সেই লাঠি-পুঁটলি। ট্রেন আসছে পিলপিল করে। পুরনো আমলের এঞ্জিন। ট্রেন ঢোকার পথে ছোট একটা পাহাড়মতো ছিল। সেটাকে ডিনামাইট দিয়ে ফাটিয়ে লাইন পাতা হয়েছে। দু’পাশে খাড়া পাথরের দেওয়াল। ট্রেন আসছে। এঞ্জিনের গুমগুম ঝঙ্কার। প্ল্যাটফর্মে ট্রেনটা ঢুকে জোরে একটা শ্বাস ফেলে হাঁফাতে লাগল। কত পথ পার হয়ে এল, ক্লান্ত তো হবেই। এঞ্জিন থেকে ফায়ারম্যান আর ড্রাইভার নেমে এলেন। অনেক পেছনের বারান্দাওলা ছোট্ট কামরা থেকে নামলেন কালো কোট, সাদা প্যান্ট পরা গার্ডসাহেব। তিনি এগিয়ে আসছেন। ফায়ারম্যান আর ড্রাইভারের মাথায় নীল টুপি। সিংজি একপাশে দাড়িয়ে ছোটাছুটি দেখছেন। সবচেয়ে শান্ত ফায়ারম্যান আর ড্রাইভার। ফায়ারম্যান হাতের তালুতে খইনি ডলছিলেন, কিছুটা ড্রাইভারকে দিয়ে বাকিটা নিজের ঠোঁটের নীচে টিপে দিলেন। বয়লারে আগুন ভলভল করছে। লাল আভা গনগন করছে।

স্টেশনমাস্টার গার্ডসাহেবের সঙ্গে কথা বলতে-বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। সোজা সিংজির কাছে।

গার্ডসাহেব বললেন, “আপনি তা হলে আমার ভ্যানে চলুন। দু’জনে গল্প করতে-করতে যাওয়া যাবে।”

সিংজি বললেন, “আমি খোলা রেকে শুয়ে-শুয়ে যাব, আকাশ দেখতে-দেখতে, তারা দেখতে-দেখতে।”

“বাবুজি, সেটা ঠিক হবে না। মাস্টারজির আত্মীয় মানে আমারও আত্মীয়। ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ট্রেন যাবে। গাছের ডালে-ডালে সাপ ঝুলে থাকে। বিষাক্ত-বিষাক্ত পোকা, জন্তু জানোয়ার, আপনার বিপদ হতে পারে সিংজি!”

সিংজিকে কিছুতেই ভয় পাওয়ানো গেল না। তখন ঠিক হল, এঞ্জিনের ঠিক পরের রেকটাতে সিংজি থাকবেন। বড় মাপের বিপদ হলে চিৎকার করবেন। সিংজির শরীর একেবারে ফিট। কোনও সাহায্য ছাড়াই রেকে উঠে পড়লেন। তিনবার বাঁশি বাজিয়ে ট্রেন চলতে শুরু করল। মাস্টারজি হাত নাড়াচ্ছেন। চিৎকার করে বললেন, “সাবধানে যাবেন।”

সিংজির পুঁটলিতে একটা কম্বল তো থাকেই। মোটা পাহাড়ি কম্বল। রেকের মেঝেতে সেটা বিছিয়ে ফেললেন। তারপর পুঁটলিটা মাথায় দিয়ে শয়ন। পাশে পাহারাদার লাঠি। ট্রেনের গতি বাড়ছে। ছোট-ছোট টিলা, পাথুরে প্রান্তর ছেড়ে ট্রেন এইবার জঙ্গলে ঢুকবে। সরলা নদীর ওপর রেলব্রিজে উঠছে। সিংজি শুয়ে-শুয়ে আশপাশের বিশেষ কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। রেকের ইস্পাত দেওয়ালে দৃষ্টি আটকে যাচ্ছে। সিংজি দেখছেন, আকাশ, ছড়ানো ছেটানো তারা। ট্রেন যত জোরেই ছুটুক আকাশের শেষ নেই। একটা পাহাড় পাশ দিয়ে ছুটে পালাতে পারে, তারা তা পারে না। কালপুরুষ সেই একই জায়গায় একইভাবে থেকে সিংজিকে দেখছে। একটুও স্থান পরিবর্তন হয়নি।

ট্রেন জঙ্গলে ঢোকার মুখে একবার থামল। এখানে একটা হল্ট আছে। সিংজি উঠে দাঁড়ালেন। ছোট্ট তিনটে কাঠের বাড়ি। তিনটি পরিবার থাকে। এঁরা রেলের কর্মচারী। একটা গোরু শুয়ে আছে। বেশ শক্তসমর্থ ইউনিফর্ম-পরা একজন মানুষ ছুটতে-ছুটতে গিয়ে গার্ডের ভ্যানে উঠে পড়লেন। তাঁর কাঁধে একটা বন্দুক। বন্দুকটা দেখে সিংজির বিশ্বাস হল, জঙ্গলটা তা হলে সত্যিই বিপজ্জনক। কপালে থাকলে বড়মামার সঙ্গে মোলাকাত হয়ে যেতে পারে। সবচেয়ে ভাল লাগছে এই তিনটে কাঠের বাড়ি। জঙ্গলের মুখে। সবুজ ঘাসে ঢাকা জমি। টিংটিং আলো। দু-চারটে বড় বড় অতি প্রাচীন গাছ। শান্ত, নিরালা। জানা রইল, কাশ্মীর, কান্দাহারে না গিয়ে এই জায়গাটায় বারেবারে আসা যায়। চুপচাপ বসে থাকো। বসে বসে দ্যাখো, প্রকৃতির খেলা। ফেরার সময় এই জায়গাটায় নামতে হবে। বাড়ির সব বাসিন্দারা রেল দেখার জন্য এত রাতেও বাইরে বেরিয়ে এসেছে। যেন কোনও উৎসব হচ্ছে। একটা তাগড়া কুকুর এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে খেলছে। ট্রেন দেখে খুব আনন্দ হয়েছে।

ট্রেন ছোট্ট একটা সিটি দিয়ে যাত্রা শুরু করল। সিংজি আবার কম্বলে বসে পড়লেন। এইবার সেই ভয়ের এলাকা। যদি এমন হয়, একটা কেঁদো বাঘ লাফিয়ে এই রেকের ওপর এসে পড়ে! আবার যদি এমন হয়, ছটাং করে একটা সাপ ছিটকে এল গাছের ডাল থেকে। ভয় পেতে যে কী মজা লাগে। সিংজির মনে হল, একটু গান গাইলে কেমন হয়! না, সেটা ঠিক হবে না। জঙ্গল এখন ঘুমোচ্ছে। বিরক্ত হবে। সিংজি পুঁটলি মাথায় দিয়ে আবার শুয়ে পড়লেন। বেশ একটা ঠাণ্ডার ভাব। গাছপাতার গন্ধ। আকাশ এইবার ছোট হয়ে আসছে। ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। বড় বড় গাছের শাখাপ্রশাখায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। ট্রেন এইবার বেশ জোরেই ছুটছে। ট্রেনও ভয় পায়!

সিংজি স্থির হয়ে শুয়ে আছেন ছ’ ফুট লম্বা একটা শরীর। পাশে শুয়ে থাকা লাঠিটাও ওইরকম লম্বা। সিংজি মাঝে-মাঝে গান গান, আমরা দুটি ভাই, শিবের গাজন গাই। তুমি আর আমি। তোমার আমি, আমার তুমি। হাত দিয়ে দেখে নিলেন লাঠিটা ঠিক আছে কি না! ঝুমঝুম শব্দে গাছের শাখাপ্রশাখা মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। ডেলা-ডেলা অন্ধকার ঘুরপাক খেতে-খেতে এসে দূরে ছিটকে চলে যাচ্ছে। খ্যাখ্যা করে ডাকছে হয় কোনও পশু, না হয় কোনও পাখি। একেবারে অচেনা একটা জগতের মধ্যে দিয়ে ছুটছে লৌহদানব। টেনিসবলের মতো ভাসমান আলো। সিংজি জানেন ওই আলোর বলগুলো হল জোনাকি। অনেকদূরে একসঙ্গে অনেক শেয়াল ডেকে উঠল। হয়তো বাঘ দেখেছে। জঙ্গলের একটা জায়গায় বাতাস মনে হল ভীষণ গরম। খড়ক সিং ব্যাপারটা বোঝার আগেই ট্রেন সেই জায়গাটাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেল। তারাদের অবস্থান দেখে মনে হল রাত অনেকটা এগিয়ে গেছে ভোরের দিকে। দুটো কি তিনটে হবে মনে হয়।

সিংজির তন্দ্রামতে এসেছিল। কিছুটা সময় বোধ হয় ঘুমিয়েও ছিলেন। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল বুকের ওপর ভারীমতো কী একটা রয়েছে। বেশ নরম-নরম। অন্ধকারে ঠাহর হচ্ছে না। হাত দিয়ে দেখতে গিয়ে হাত সরিয়ে নিলেন।

॥ ২৩ ॥

একটা ভয়। প্রথমেই খড়ক সিং যেটা ভাবলেন, সেটা হল, বিষাক্ত একটা সাপ কুণ্ডলি পাকিয়ে বুকের ওপর শুয়ে আছে। একটু নড়াচড়া করলেই শপাং করে ছোবল মারবে। এদিকে এঞ্জিন বেশ জোরেই ছুটেছে। রেকগুলোয় ঘটঘটাং শব্দ হচ্ছে। কোথাও একটা চেন ঝুলছে, সেই চেনের শব্দ। জঙ্গল আরও গভীর হয়েছে। যাকে বলে ডেন্স ফরেস্ট। আকাশটাকাশ আর দেখা যাচ্ছে না। শুধু ডালপালার ছাউনি। রাত কত হল আন্দাজ করা মুশকিল। গাছের ফাঁকে-ফাঁকে অন্ধকারের খেলা, সেই অন্ধকারে প্রেতিনীর নিশ্বাসের মতো ফিকে ধোঁয়ার সুতো। সারাদিন মাটি যে জল ছেড়েছে, শেষরাতের ঠাণ্ডায় তা বাষ্প হতে শুরু করেছে। ভোরের দিকে বনভূমি কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে যাবে। কোথায় একটা ‘ওঁয়া, ওঁয়া’ শব্দ হয়ে মিলিয়ে গেল। সিংজির এই ভয়টা ভীষণ ভাল লাগে। ভয়ে দম আটকে আসে, শরীর থ্যাসথ্যাসে, গলা দিয়ে শব্দ বেরোয় না ; কিন্তু উপভোগ্য।

বুকের ওপর নরম প্রাণীটা সিংজির কুর্তা খামচে ধরে আছে। মনে হচ্ছে চারটে ছোট-ছোট পা। তা হলে সাপ নয়, অন্য কিছু। সেটা কী! এলই বা কোথা থেকে! সিংজি পুঁটলি মাথায় দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে আছেন। ট্রেন দুলছে। জীবটাও বুকে বসে দুলছে। সিংজির হাত দুটো স্পর্শ নেওয়ার জন্য এগোচ্ছে, আবার পিছিয়ে আসছে ভয়ে। কোথাও মেঘ ডাকার মতো ভয়ঙ্কর একটা শব্দ হল। মেঘ না বাঘ! না অন্য কোনও প্রাণী! মেঘ হলেও মেঘ নয়। মেঘ ভেবে নিলে তো সব রহস্যেরই শেষ। অজানা কোনও ভয়ঙ্কর প্রাণী ভেবে নিতে পারলে আরও ভাল হয়। দৈত্য, রাক্ষস! এই জঙ্গলে কি রামচন্দ্র আসেননি! পঞ্চপাণ্ডবও তো আসতে পারেন। সেইসব ইতিহাস কি আর লেখা আছে!

প্রাণীটা গুটিগুটি শরীরের নীচের দিকে নামছে। এইবার যা থাকে বরাতে, সিংজির একটা হাত এগিয়ে এসে আলতোভাবে স্পর্শ করল। বাঃ, ভারী সুন্দর তো, নরম নরম, কচি-কচি, ভেলভেটের মতো লোম। সিংজি শুয়ে-শুয়েই ঘাড়টা একটু তুললেন। দুটো মণি যেন ধকধক করে জ্বলছে। সিংজি বুঝতে পারলেন, মণি নয়, দুটো চোখ। অন্ধকারে জ্বলছে। কোন প্রাণীর চোখ জ্বলে! বাঘের! বেড়ালের! বেড়াল এই এত রাতে আসবে কোথা থেকে! বাঘের বাচ্চাই হবে। মায়ের কোল ছেড়ে পালিয়ে এসেছে। বাঘ হয়ে কামড়াতে এখনও বহু বছর দেরি। বাঘের বাচ্চা আর বেড়ালবাচ্চায় খুব একটা পার্থক্য হবে না।

সিংজি উঠে বসলেন। বাচ্চাটা গড়িয়ে কোলের ওপর পড়ে গেল। সিংজির সাহস বেড়েছে। দু হাতে তুলে দেখলেন। কী সুন্দর! একটা হনুমানের বাচ্চা! এই কচি বয়সেই ল্যাজের কী বাহার! যে বড় হবে, ছেলেবেলা থেকেই তার মধ্যে সেইসব লক্ষণ দেখা দেয়। মহাবীরের শরীরের সবচেয়ে বড় গৌরবই তো ল্যাজ! তিন ফুট শরীরে সাত ফুট ল্যাজ। এই বয়সেই তার শোভা দ্যাখো।

হনুমানের বাচ্চাটা মনে হয় গাছ থেকে পড়ে গেছে। ঘুমোতে-ঘুমোতে পাশ ফিরেছিল। মানুষের বাচ্চা যেভাবে খাট থেকে পড়ে যায়, সেইভাবেই ধপাস। সে না হয় হল, কিন্তু সেটা কোন গাছ। মায়ের শিশুকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেওয়ার উপায় তো আর রইল না। ট্রেন তো থামতে জানে না! চলছে তো চলছেই। যখন সকাল হবে, জঙ্গলের ফেলে আসা অঞ্চলের বহু দূরে, কোনও একটা গাছে মা হনুমান জেগে উঠে দেখবে, কোলের শিশুটি নেই। তখন কী হবে! সেই হনুমানের বেদনা সিংজির মনে ছড়িয়ে পড়ল। কান্না আসছে। না, কেঁদে লাভ নেই। কোনও সমস্যারই সমাধান হবে না। যতদিন না সাবালক হচ্ছে, ততদিন সিংজিকেই মা হয়ে মানুষ করতে হবে।

শেষ রাত। বেশ একটা শীত-শীত ভাব। বাচ্চাটা কোলের গরম খুঁজছে। গায়ে একটা হনুমান-হনুমান গন্ধ। সিংজি পুঁটলি থেকে একটা চাদরমতো বের করে বাচ্চাটাকে চাপা দিলেন। বেশ গুটলিমুটলি হয়ে শুতে-শুতে বাচ্চাটা একটা ‘উ’করে আরামের শব্দ করল। সেই আরামটা যেন সিংজির সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল।

ট্রেন যত জোরেই ছুটুক, ডুমডুমা পৌঁছবে সেই দুপুরে। এর মধ্যে বাচ্চাটার ব্রেকফাস্ট আছে, লাঞ্চ আছে। ডিনার ডুমডুমাতেই হবে। ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চের ব্যবস্থা চলন্ত ট্রেনেই করতে হবে।

“আচ্ছা, হনুমান কী খায়?” অদৃশ্য কাউকে প্রশ্ন করলেন খড়ক সিং। এইটাই তাঁর অভ্যেস। তিনি মনে করেন কেউ না কেউ সদাসর্বদা তাঁর পাশে আছেন। কখনও তিনি একা নন।

সেই অদৃশ্য বন্ধু তাঁর মনে বসে থেকে উত্তর দিলেন, “কলা খায়। কারণ আমি শুনেছি বাঙালি লেড়কারা হনুমান দেখলেই চিৎকার করে, এই হনুমান কলা খাবি, বড় বউয়ের বাবা হবি। তবে একটা প্রশ্ন আছে, বড় হনুমান কলা খায়, লেড়কা হনুমান কি খেতে পারবে! ওর কি দাঁত বেরিয়েছে? একেবারে দুধের বাচ্চা তো!”

দাঁত বেরিয়েছে কি না দেখার জন্য সিংজি বাচ্চাটার মুখে একটা আঙুল ঢোকালেন। দাঁতের চিহ্ন নেই। নরম-নরম মাড়ি। হনুমানটা চকচক করে চুষতে লাগল। খুব মজা পেয়েছে মনে হল। কলা চটকে দিলে খেতে পারবে। কিন্তু ডুমডুমায় কলা কি পাওয়া যাবে!

“হনুমান আর কী খায় ভাই!” খড়ক সিং আবার প্রশ্ন করলেন।

“হনুমান পাকা পেঁপে খায়।”

“পাকা পেঁপে ডুমডুমায় অবশ্যই পাওয়া যাবে। কিন্তু সে তো দুপুরের আগে হবে না। তার আগে কী খাওয়ানো যায়! সঙ্গে রুটি আছে দশখানা। আর আছে গুড়। ছাতুও আছে। ছাতু নরম করে মেখে খাওয়ানো যায়। একটাই ভয়, যদি পেট খারাপ হয়!”

সিংজি খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। যখনই চিন্তা আসবে, শুয়ে পড়বে। বেশি চিন্তা শরীরের পক্ষে খারাপ। তিনি পুঁটলি মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়লেন। নরম পেটের ওপর চাদরের তলায় বাচ্চা হনুমান। লেজটা কোমরের পাশ দিয়ে বেল্টের মতো ঝুলছে। যেন নাইলনের দড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যেই সিংজি ঘুমিয়ে পড়লেন আবার। পুটপাট করে নানারকম পোকা এসে গায়ে পড়ছে। সিংজির পোকার ভয় নেই। জঙ্গলের এই এক দোষ, ভয়ঙ্কর পোকামাকড়ের উপদ্রব।

চড়া রোদ চোখে পড়তেই সিংজির ঘুম ভেঙে গেল। ট্রেন থেমে পড়েছে। জায়গাটা জঙ্গল নয়। কিছুটা ফাঁকা। হল্ট স্টেশন। স্টেশন মানে কী! প্ল্যাটফর্ম নেই। সবুজ একটা জমি। রেল কোম্পানির ছোট্ট একটা গুমটি। নীল জামা পরা একজন কর্মচারী। গার্ডসাহেব, ড্রাইভার, ফায়ারম্যান সবাই নেমে পড়েছেন। সিংজি দেখলেন, সকলের হাতেই চায়ের গেলাস। খুব অভিমান হল, কেউ তাঁকে ডাকেননি। সবাই স্বার্থপরের মতো চা-পান করছেন। সে যাই হোক, মানুষের কাজ মানুষ করেছে। কিন্তু হনুমান! কোথায় গেল! এদিকে-ওদিকে তাকালেন। রেকের এক কোণে কিছু খড় পড়ে ছিল। বাচ্চাটা তার ওপর শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে।

সিংজি এক লাফে রেক থেকে নেমে এলেন। ফায়ারম্যান বললেন, “আরে ভাই, আপনি! আপনার কথা আমরা ভুলেই গিয়েছিলুম। ঘুম কেমন হল?”

সিংজি বললেন, “তোফা! আপনার ঘুম কেমন হল?”

বলেই খেয়াল হল, ফায়ারম্যান, ড্রাইভার, গার্ডসাহেব, এঁরা ঘুমোবেন কী করে! তা হলে তো ট্রেন থেমে যাবে। সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, “না, না, আপনারা ঘুমোবেন কী করে !”

ফায়ারম্যান বললেন, “আমরা পালা করে ঘুমোই। এই লাইনে তো ভয় নেই। সিঙ্গল লাইন। এঞ্জিন একবার চালিয়ে দিলেই গড়গড় করে চলবে।”

হল্ট স্টেশনের সিগন্যালম্যানের নাম, দুবে। তিনি বললেন, “আপনার চা আনি। আপনি মুখ ধুয়ে নিন।”

সঙ্গে-সঙ্গে সিংজির অভিমান কেটে গেল। তিনি দুবেজির হাত দুটো ধরে বললেন, “ভাইসাব, কাল রাতে ভগবানজি আমাকে একটা জিনিস দিয়েছেন। তার জন্যে একটু দুধ চাই। আপনি ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন! যা পয়সা লাগে আমি দেব।”

“জিনিসটা কী?” সকলেরই খুব কৌতূহল।

সিংজি বললেন, “দাঁড়ান, আমি নিয়ে আসি।”

সিংজির ফিট শরীর। একেবারে চাবুকের মতো। তড়াক করে লাফিয়ে রেকে উঠে পড়লেন। নেমে এলেন বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে। সকালের আলোয় সুন্দর দেখাচ্ছে। সারা গায়ে কচি-কচি ধূসর লোম। বাচ্চা হলে কী হয়, মুখটা সেই পোড়া কালো। মহাবীর সেই যে রামচন্দ্রের সময় রাগের মাথায় লঙ্কাদাহন করতে গিয়ে এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড করলেন, অমন মুখটা পুড়িয়ে ফেললেন, সেই থেকে মহাবীরের ফ্যামিলিতে সব মুখ পোড়া। পৃথিবীতে এমন কোনও ক্লিনজিং মিল্ক নেই যা দিয়ে এটার কিছু করা যায়!

সবাই একসঙ্গে বলে উঠলেন, “আরে ভাই, এ তো বড়িয়া চিজ।”

গার্ডসাহেব বললেন, “ইউ আর ভেরি লাকি। আপনার ভাগ্য ফিরে যাবে ভাই!”

দুবেজি চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন, “লছমি, লছমি!”

দূরের কুঠিয়া থেকে একটা মেয়ে ছুটতে ছুটতে এল। দুবেজির এই একটিমাত্র মেয়ে। আর-একটু বড় হলেই হাতরাসে মামার বাড়িতে চলে যাবে লেখাপড়া করতে। এদিকে স্কুল, কলেজ কিছুই নেই। তেমন লোকজনও নেই। দুবেজি মেয়েকে বললেন, “দেখেছিস, বাবুর কোলে কী?”

সিংজির কোলে হনুমান-বাচ্চা। লেজটা ঝুলছে। লছমির কী আনন্দ!

সিংজিকে বলল, “আমাকে দেবে তুমি? আমি খাওয়াব, মানুষ করব!”

ড্রাইভারসাহেব হাসতে-হাসতে বললেন, “মায়ি, তুমি যত চেষ্টাই করো, একে মানুষ করতে পারবে না, বলো, হনুমান করব।”

মেয়েটির মুখ ভোরের শিউলির মতো সুন্দর, পবিত্র। সিংজি কেমন যেন মায়ায় পড়ে গেলেন। গলার স্বর মধুর মতো মিষ্টি। সিংজি মনে-মনে ভাবলেন, আমি একটা ভবঘুরে মানুষ, শেষে এই হনুমান-বাচ্চাটার মায়ায় মজে থাকব। তার চেয়ে দিয়ে দেওয়াই ভাল। একটু বড় হলেই তো গাছের জীব গাছে ফিরে যাবে।

সিংজি বললেন, “মুন্নি, তুমি নেবে! তোমার মা রাগ করবেন না!”

লছমির মুখ করুণ হয়ে গেল। চোখ দুটো হয়ে উঠল জল-টলটলে। লছমি বলল, “আমার মা নেই।”

মা নেই! এইটুকু মেয়ের মাকে ভগবান কেড়ে নিয়েছেন। এইবার সিংজির চোখে জল। দু’ হাতে ধরে আছেন হনুমান বাচ্চা। চোখ মুছতে পারছেন না। দু’ গাল বেয়ে জল ঝরছে। পবিত্র আলোর সকাল। চারজন রেলের পোশাক-পরা কর্মচারী, তার মাঝে সাদা কুর্তার সিংজি আর পরীর মতো একটি মেয়ে। লোহার দানবের মতো একটা মালগাড়ি। চারপাশে বিশাল-বিশাল প্রাচীন গাছ। সব সবুজ। সে যেন এক নাটকের দৃশ্য। এরই মাঝে তিলকশোভিত, হৃষ্টপুষ্ট এক মানুষ এলেন। তিনি পণ্ডিতজি। দুবেজি তাঁকে প্রণাম করলেন। তিনি অবাক হয়ে হনুমান বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে আছেন।

সিংজি লছমিকে বললেন, “তা হলে এটা তুমিই নাও। কী খাওয়াবে! এখনও দাঁত হয়নি।”

লছমি বলল, “দুধ খাওয়াব, কচিপাতা খাওয়াব, পেঁপে খাওয়াব, আমার একটা দোলা আছে, সেই দোলায় শোওয়াব।”

হনুমান-বাচ্চাটা যেন মায়ের কোলে যাচ্ছে, সেইভাবে লছমির কোলে গিয়ে তার বুকে মুখ গুঁজে দিল। লেজটা এখনই এত বড় যে, মাটিতে গিয়ে ঠেকছে। সিংজির কাছে ল্যাজটাই এক বিস্ময়!

দুবেজিকে পণ্ডিতজি বললেন, “কী, বলিনি তোমাকে! তোমার খুব সৌভাগ্য আসছে। মহাবীরের বাচ্চা এসে গেল। তুমি এইবার বড় স্টেশানে বদলি হয়ে যাবে। তোমার মাইনে বেড়ে যাবে।”

সিংজি বললেন, “বড় স্টেশানে গিয়ে কী হবে, এই জায়গাটাই তো অনেক ভাল।”

পণ্ডিতজি বললেন, “সংসারী মানুষের পক্ষে এই জায়গা ভাল নয়, তা ছাড়া দুবেজি এই অঘ্রানে আমার মেয়েকে বিয়ে করবে।”

খড়ক সিং লছমির দিকে তাকালেন। নিপাপ, সুন্দর একটা মুখ, বুকের কাছে চেপে ধরে আছে বাচ্চা হনুমান। সৎমা এসে মেয়েটার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করবে কে জানে! দুবের ওপর ভীষণ রাগ হল। লোকটা ব্যাডম্যান। লোকটা শুধু নিজের কথাই ভাবছে। মায়ের কোলছাড়া হনুমান মা-হারা একটা মেয়ের কোলে। দু’জনেই দু’জনকে চিনেছে খুব। পৃথিবীটা খুব ভাল, কিছু মানুষ ব্যাড, ভেরি-ভেরি ব্যাড।

॥ ২৪ ॥

“চা। চা খাবেন না? গরম চা, খাঁটি দুধের চা?”

সিংজি অসম্ভব রেগে গেছেন। লোকটা এই বয়েসে আবার নতুন করে সংসার করছে। আর সেই সংসারে এই ফুলের মতো মেয়ে সৎ মায়ের খিদমত খাটবে! গাছের ডাল ভাঙা ছপটি দিয়ে পটাপট পিটবে। কেউ তখন দেখার থাকবে না। পণ্ডিতজিটাও কেমন মানুষ! ধার্মিক! লোকটাকে কোথায় সংসার থেকে প্রকৃতিতে বেরিয়ে আসার পথ দেখাবে, তা না, ঠেলে সংসারে ঢোকাচ্ছে। বদস্য বদ!

সিংজি বললেন, “চা আমি খাব না।”

“কেন খাবেন না! চা খান না!”

মিথ্যে বলতে শেখেননি সিংজি। তিনি বললেন, “খাই, কিন্তু খাব না এখন। ট্রেন কখন ছাড়বে?”

গার্ডসায়েব বললেন, “চা না খেলে এখুনি সিটি মেরে দেব।”

“তা হলে তাই মারুন।”

সিংজি এক লাফে গাড়িতে উঠে পড়লেন। গার্ডসায়েব বললেন, “কী ফিট শরীর!”

এঞ্জিন ভুস করে খানিক স্টিম ছাড়ল। জায়গাটা একেবারে ধোঁয়া হয়ে গেল। সিংজির এই দৃশ্যটা দেখতে ভীষণ ভাল লাগে। দৈত্যের নিশ্বাস। সকালের রোদ ওই ধোঁয়ায় যেই সুযোগ পেয়েছে রামধনু রচনা করে ফেলেছে। সিংজি জানেন, ঈশ্বর আসলে একজন শিল্পী। বিরাট শিল্পী। সব সময় কাজ করে চলেছেন। সেই বাষ্পের ভেতর দিয়ে লছমির মুখ কখনও স্পষ্ট হচ্ছে, কখনও ঝাপসা। হনুমানের বাচ্চা কোলে দাঁড়িয়ে আছে লছমি। সিংজি বলেন, আমি একটা শুকনো মানুষ, আমার চোখে কখনও জল আসে না। কথাটা একেবারেই বেঠিক। সিংজি পূর্ণিমার চাঁদ দেখলে কেঁদে ফেলেন, গাছে বসন্তের সবুজ পাতা দেখলে চোখ জলে ভরে আসে। অপরের দুঃখ দেখলে বুক ফেটে যায়। লছমির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ খেয়াল হল, দু’গাল বেয়ে জল গড়াচ্ছে। ট্রেনের গতি বেড়ে গেছে। সব পেছনে ফেলে, সেই ছোট্ট জনপদ আর কয়েকটা মানুষকে ছেড়ে ট্রেন আবার ঢুকে পড়ল জঙ্গলে। অকারণে দু’বার সিটি মেরে জঙ্গলের স্তব্ধতাকে চমকে দিল।

সিংজি তাঁর কম্বলের ওপর বেশ গুছিয়ে বসেছেন। পাশে পোঁটলা, লাঠি আর পাগড়ি। রাতের জঙ্গল আর দিনের জঙ্গলে অনেক তফাত। কতরকমের আলোর খেলা! কতরকমের সবুজ! পাতার ফাঁকে-ফাঁকে সূর্যকিরণ ঢুকে কতরকম কাণ্ডই যে করেছে। মনে হচ্ছে, যজ্ঞ চলেছে। যেন বিশাল বড় এক মঞ্চ সাজানো হয়েছে, এখুনি রাজা-রানি, পাত্র-মিত্র সবাই এসে অভিনয় শুরু করে দেবেন। জীবজগৎও জেগে উঠেছে। কয়েক হাজার পাখির বিচিত্র কলরব। অসংখ্য বানর ডালে-ডালে কিচিরমিচির করছে। বীর হনুমানের হুপহাপ ডাক। এই সময় একটা বাঘের খুব প্রয়োজন ছিল। ট্রেনের এই খোলা বগিতে হালুম করে লাফিয়ে পড়লে বেশ মজা হত। অমন সুন্দর একটা জন্তু, কিন্তু ভাব করার উপায় নেই। সিংজির পূর্বপুরুষরা বাঘ পুষতেন। রাজা-মহারাজাদের ব্যাপারই ছিল অন্যরকম। সেইসব কথা বেশ মনে পড়ে। প্যালেসের বাগানে একসার খাঁচা। মহারাজার নিজের চিড়িয়াখানা। বেলা তিনটের সময় বাঘকে মাংস খাওয়ানো হত। সে এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য! তর্জনগর্জন, ছেঁড়াছিঁড়ি, রক্তারক্তি। বিশাল এক অজগর ছিল। গোটা একটা জ্যান্ত ছাগল স্রেফ গিলে নিত। ম্যাকাও পাখি ছিল। তারা খেত কাগজি বাদাম, কিশমিশ। নির্জন সেই বাগানে, ভরদুপুরে, সিংজি একা-একা বাঘের খাঁচার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেন। সামনের দুটো থাবার ওর মুখ রেখে শুয়ে আছে দুপুরবেলার বাঘ। লাল-লাল চোখে তাকাচ্ছে। সিংজি যত বলেন, “মেরা দোস্ত” ততই বাঘটার চোখ আরও লাল হতে থাকে। শেষে একটা হুঙ্কার। সিংজির এক লাফ। সেই বঝেছিলেন, বাঘ কখনও আপনার হয় না। আচ্ছা, মানুষই কি হয়! দুবেজি কি লছমির আপনার লোক। ঘুরেফিরে সেই লছমির চিন্তাটা আবার এসে গেল। কিছুতেই তাড়ানো যাচ্ছে না।

বাতাসে একটা শিসের শব্দ। সিংজি চমকে উঠলেন। শব্দটা কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল বিদ্যুতের মতো। কানটা যেন গরম হয়ে উঠল। পরক্ষণেই ক্ল্যাং করে একটা শব্দ হল। বগির স্টিলের দেওয়ালে লেগে কী একটা পড়ে গেল। সিংজি অবাক হয়ে দেখলেন, একটা তীর। সাচ্চা তীর, যে-তীরে মানুষ, জীবজন্তু, পশু সব মারা যায়। সিংজি উঠে গিয়ে তীরটা নিয়ে এলেন। তীক্ষ্ণ লোহার ফলা। লম্বা একটা বেতের ডাণ্ডায় বাঁধা। পেছনের খাঁজে-খাঁজে তেজপাতার মতো পাত আটকানো। দেখার মতো সৌন্দর্য! সিংজি এতদিন তীর দেখে এসেছেন ছবিতে। রাজারা যুদ্ধ করেন। কিরাতরা শিকার করে। সত্যিকারের একটা তীর। একচুল এদিক-ওদিক হলে খড়ক সিংয়ের মৃত্যু হত। কানের পাশে গেঁথে যেত। মৃত্যু যখন হয়নি, তখন মৃত্যুদূতের সৌন্দর্যের তারিফ করতে ক্ষতি কী! জঙ্গল তাকে উপহার দিয়েছে এই তীর। অনেক পেছনে পড়ে আছে জঙ্গলের সেই অঞ্চল। ট্রেন তো থেমে নেই। ঘিচিঘিচি করে এগিয়েই চলেছে। কোনও ব্যাধ পাখি শিকারের জন্যে তীরটা ছুড়েছিল। কোনওভাবে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে চলে এসেছে। কে বলে, জীবনে কোনও উত্তেজনা নেই! ট্রেনের মতো একঘেয়ে শুধু চলেই যায়। এই তো সেই উত্তেজনা। আর একটু হলেই তো মরে যেত। যুদ্ধে যেভাবে রাজা-মহারাজারা মরে। রাজার ছেলে রাজার মতো বাঁচতে না পারুক, আর-একটু হলেই রাজার মতো মরে যাচ্ছিল।

তীরটাকে সযত্নে একপাশে রাখলেন খড়ক সিং। যতদিন বাঁচবেন ততদিন এটা তাঁর কাছে থাকবে। এটা যুদ্ধের, মৃত্যুর তীর নয়, শান্তির, জীবনের তীর। যেই মনে হল, খুব বাঁচা বেঁচে গিয়েছি, অমনই ভীষণ খিদে পেয়ে গেল খড়ক সিংয়ের। পুঁটলিটা খুললেন। দশখানা রুটির মালিক আমি। গুড়ও আছে। ছাতু আছে। মেঠাইও আছে। তা হলে এইবার নাস্তাটা করে ফেলা যাক।

সিংজির পোঁটলা থেকে রুটি বেরোল। রাতের ভিজে বাতাসে গুড় একটু রসে গেছে। জঙ্গলের সবচেয়ে প্রাচীন গাছকে উদ্দেশ্য করে খড়ক সিং একটা রুটি ও একটু গুড় নিবেদন করলেন, “হে বৃক্ষদেবতা! গ্রহণ করো।” গোল করে মুড়ে ছুড়ে দিলেন জঙ্গলের দিকে। এই জঙ্গলের প্রাণীরা জীবনে রুটি দেখেছিল কি! আস্ত একটা রুটি দেখে কী আনন্দই না হবে। তা হলে আরও একটা দেওয়া যাক। সিংজি আর-একটা রুটি ছুড়ে দিলেন। ছোড়ার নেশায় ছুড়তে যাচ্ছেন। চাকার মতো ঘুরতে-ঘুরতে গিয়ে যে-কোনও একটা গাছের গুঁড়িতে লেগে পড়ে যাচ্ছে ডানাভাঙা পাখির মতো। যখন খেয়াল হল, তখন আর একটামাত্র রুটি পড়ে আছে। কী করবেন! সবই যখন দেওয়া হয়ে গেল, তখন এই একটা কেন আর বাকি থাকে! এই জঙ্গলের কোথাও-না-কোথাও সেই নন্দলালা আছেন, যিনি বুকে বসে বাঁশি বাজান, তাঁকেই নিবেদন করে দেওয়া যাক। মেরা নন্দলালা! শেষ রুটিটা সিংজি ছুড়ে দিলেন। ট্রেন তখন অরণ্যের সবচেয়ে গভীরতম অংশ দিয়ে যাচ্ছে। দিনের বেলাতেই রাতের অন্ধকার। লক্ষ-লক্ষ ঝিঁঝিঁ একসঙ্গে ঝুনঝুনি বাজাচ্ছে। এত অন্ধকার যে, রাতের প্রাণীরাও বেরিয়ে পড়েছে। শেয়াল ডাকছে—হুক্কা হুয়া, কেয়া হুয়া। শেয়াল সিংজির ভীষণ প্রিয় প্রাণী। একবার খুব ইচ্ছে হয়েছিল, কুকুরের বদলে একটা শেয়াল পুষবেন। সবাই বলল, শেয়াল কোনওদিন পোষ মানে না। সিংজি দেখলেন, গাছের ডালে বেশ একটা মোটা সাপ প্যাঁচ মারছে। কী সাপ কে জানে। ভারী বাহার। হঠাৎ জঙ্গলের ভেতর মেঘ ডাকল যেন। সিংজির কী আনন্দ! এই তো তিনি ডাকছেন। বাঘ ভাইয়া।

ট্রেনের গতি ক্রমশই কমছে। সামনেই একটা ব্রিজ। তলায় সরলা নদী খেলা করতে-করতে ছুটছে। এই ব্রিজটা শিবশঙ্কর তৈরি করেছিলেন। কাজটা অবশ্যই খুব কঠিন ছিল। খুব ধীর গতিতে ট্রেন ব্রিজে উঠল। অনেক নীচে শীর্ণ নদী। সিংজি ঝুঁকে পড়লেন নদী দেখার জন্য। সরলা এই জায়গায় ভীষণ সুন্দর। এইখানেই নাকি সোনা পাওয়া যায়। সিংজির সোনার লোভ নেই। যাদের আছে তারা আসে আর বাঘের পেটে যায়, সাপের ছোবল খায়। বেলা দুটো নাগাদ ট্রেন ডুমডুমা পৌঁছল। ঝলমলে রোদ, নীল আকাশ। ঝাঁক-ঝাঁক সাদা পায়রা উড়ছে আকাশে। স্টেশনটা ছবির মতো। একসময় খুব ব্যস্ত এলাকা ছিল। আজ আর ব্যস্ততা নেই। কিন্তু স্টেশনটা সেইরকম আছে। সবুজ ঘাসে ঢাকা প্ল্যাটফর্ম। ঘর বাড়ি সব কাঠের। সায়েবদের তৈরি সায়েবী কায়দায়।

লাঠি, পোঁটলা নিয়ে সিংজি নেমে এলেন। হাতে নতুন আর একটা জিনিস, তীর। প্ল্যাটফর্মের এপাশ থেকে ওপাশ, ওপাশ থেকে এপাশ, লম্বা-লম্বা পা ফেলে সিংজি কয়েকবার পায়চারি করে নিলেন। স্টেশনমাস্টার বেরিয়ে এলেন কাঠের ঘর থেকে। বেশ ঋষি-ঋষি চেহারা। সিংজিকে বললেন, “আপনি আসছেন খবর পেয়েছি। থাকার ব্যবস্থাও করে ফেলেছি। ওই যে দেখছেন দূরে একটা বাংলো, ওই বাংলোটার নাম ব্রাউন বাংলো। টিম্বার মার্চেন্ট ক্রিস্টোফার ব্রাউন থাকতেন। এখন তো এই জায়গাটার আর সে ইজ্জত নেই। আইন হয়ে গেছে জঙ্গল কাটা চলবে না। বাংলোটা আমিই দেখাশোনা করি। আপনি সোজা চলে যান। ওখানে আবদুল আছে। রান্নাও হয়ে গেছে। আমার নাম সীতারাম সাকসেনা।”

সিংজি বাংলোর দিকে এগোলেন। স্বপ্নের মতো জায়গাটা। এপাশে-ওপাশে আরও অনেক পরিত্যক্ত কাঠের বাংলো। একতলা, দোতলা। কেউ থাকে না। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভেঙে পড়ছে। আগাছা, পরগাছায় ঢাকা পড়ে আসছে। অনেকটা দূরে কচ্ছপের পিঠের মতো একটা বড় মাঠ। সেই মাঠে একটা মেলা বসেছে। রঙিন কাপড়ের পতাকা উড়ছে। মাদলের শব্দ। সাঁওতাল মেয়েরা নাচছে। এখন রিহার্সাল দিচ্ছে। রাতে হবে বড় নাচ। এই মেলা চলবে তিনদিন। ওদিক থেকে অনেকে এই মেলায় আসে। ওইদিকেই সেই নীল পাহাড়। যে- পাহাড়টার কাছে যাওয়ার জন্য জয় আর জয়া ছটফট করে। একদল বাচ্চার চিৎকার কানে আসছে। সিংজির মন চাইছিল এখনই মেলায় চলে যান। অনেক লোক, নানারকম ছোট-ছোট জিনিস, দেখতে ভাল লাগে। হাড়ের চিরুনি, হাড়ের মালা, কাঠের হাতা। মানুষের আনন্দ দেখলে সিংজির খুব আনন্দ হয়।

আবদুল বাইরেই বসে ছিল। সিংজিকে দেখেই বলল, “মহারাজ, আপনি এসে গেছেন!”

সিংজি বললেন, “আবদুলভাই, আমার পূর্বপুরুষ মহারাজ ছিলেন, আমি তো ভাই ফকির।”

“বড় ফকিরই তো মহারাজ, সিংজি।”

কাঠের মেঝে। চলতে গেলে শব্দ হচ্ছে। খুব একটা সাজানো না হলেও বেশ পরিষ্কার।

“মাস্টারজি এলে নাস্তা করবেন, না আগেই করে নেবেন?”

“আমি আগে চান করব।”

বাংলোর পেছন দিকে মাঠ। মাঠ পেরোলেই জঙ্গল। সবুজ হয়ে আছে। জঙ্গল যেখানে শুরু হয়েছে, তার মুখেই দোতলা একটা কাঠের বাড়ি। সেই বাড়ির দোতলার বারান্দায় একজন লোক বন্দুক হাতে পায়চারি করছে। ওই হল ফরেস্ট রেঞ্জারের বাংলো। বন্দুক হাতে বাগান পাহারা দিচ্ছে। এত বিশাল জঙ্গল পাহারা দেওয়া যায়!

সিংজি ভাবলেন, কতক্ষণ আর লাগবে, পায়ে-পায়ে মাঠটা পেরিয়ে জঙ্গলটায় একবার উকি দিয়ে আসি। ফরেস্ট অফিসারের বাংলো। তলায় অফিস। অফিসের সামনে অনেক নোটিস ঝুলছে। কাঠ কুড়োতে চাইলে কী করতে হবে, পাতা কুড়োতে চাইলে কী করতে হবে, কার কাছে অনুমতি নিতে হবে। সিংজি একটা-দুটো পড়ে আর পড়লেন না। জঙ্গলের মুখে, রোদ আর অন্ধকারের সীমানায় দাঁড়ালেন। গাছ আর গাছ। তরল অন্ধকারে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যুগের পর যুগ। এদিকটায় চচ্চড়ে রোদ, ওদিকে অন্ধকার। ও যেন আর-এক রাজার রাজত্ব। অদৃশ্য প্রহরীরা যেন হইহই করে ডাকছে, “আইয়ে জনাব, আইয়ে জনাব।”

সেই সীমাহীন অতল আকর্ষণে আর-একটু হলেই ধরা দিতে চলেছিলেন সিংজি, পেছন দিক থেকে আবদুল হাত চেপে ধরল। “মাত যাইয়ে মহারাজ। খাতরা হায়।”

জঙ্গলে চোখ দিয়ে? পথ খুঁজলে পাবে না। জঙ্গলে পথ চেনার জন্য চাই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। তেমন একজন মানুষ এখানে একজনই আছে, তার নাম আবদুল। “মহারাজ! আপ জানতে হি নেহি। গাছ ছাড়াও এই জঙ্গলে আরও অনেক কিছু আছে।”

॥ ২৫ ॥

ব্রাউন সায়েবের একটা ছবি ঝুলছে হলঘরে। খুব ধারালো চেহারা। চোখ দুটো হাসি-হাসি। খড়ক সিং একটা আরাম কেদারায় বসে আছেন। রাতের খাওয়া হয়ে গেছে। আবদুল প্রথমে মেঝেতেই বসে ছিল। সিংজি তাকে তুলে আর-একটা আরামকেদারায় বসিয়েছেন। মেঝেতে বসবে কেন আবদুল! প্রভু-ভৃত্য সম্পর্ক সে ইংরেজ আমলে ছিল। দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, এখন সবাই সমান।

বলে বটে সবাই সমান, সে কথার কথা। প্রভুও আছে ভৃত্যও আছে। আবদুল একটু আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে। এতখানি বয়েস হল, সে কখনও এমন চেয়ারে বসেনি। আবদুল ঘুম-ঘুম চোখে ব্রাউন সায়েবের গল্প বলছে। এখানকার লোক এখনও তাঁকে মনে রেখেছে। একটু পাগলাটে ধরনের ছিলেন। মানুষের উপকার করাই ছিল তাঁর কাজ। যা রোজগার করতেন তার অর্ধেকটাই দান করে দিতেন। বাংলোর পেছনে তাঁর একটা ডিসপেনসারি ছিল। রোজ সকালে সেখানে বসে রুগি দেখতেন। দাঁত তুলতে পারতেন। চোখ পরীক্ষা করতে পারতেন। মাঝে-মাঝে আবার জজসাহেব হয়ে যেতেন। মারামারি, জমিজমা নিয়ে গোলমাল, চুরির কেস, দু’ পক্ষকে দু’ পাশে বসিয়ে, বিচার করে মিটমাট করে দিতেন। সে রায় সবাই হাসিমুখে মানত। সদর আদালতে যাওয়ার দরকার হত না। সায়েবের তিনটে কুকুর ছিল।

সিংজি জিজ্ঞেস করলেন, “সায়েবের আর কেউ ছিল না?”

“হয়তো বিলেতে ছিল, এখানে কেউ ছিল না। তিনি একা। একা হলে কী হবে, এখানকার সবাই তো তাঁর আপনার লোক। আমি ছিলাম তাঁর বাবুর্চি। আমাকে ভীষণ ভালবাসতেন। দশ কাঠা জমি আমাকে দান করে গেছেন।”

“সেই জমিতে আপনি কী করেছেন? বাড়ি?”

“সেই জমি আমি বিক্রি করে দিয়েছি। না করে উপায় ছিল না। আমার খুব টাকার দরকার ছিল। কাজটা আমি ভাল করিনি। সায়েব বেঁচে থাকলে আমাকে অমন কাজ করতে হত না।”

“সায়েব মারা গেছেন?”

“সায়েবকে মেরে ফেলেছে। অমাবস্যার রাতে এই বাংলোতে ডাকাতি হয়েছিল। আপনি যে-চেয়ারে বসে আছেন, সকালে ওই চেয়ারে সায়েবকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। বুকে তিনটে গুলি।”

সিংজি একটু নড়েচড়ে বসলেন। চেয়ারটা তা হলে ভাল নয়। অভিশপ্ত চেয়ার। সিংজি ভয় ভালবাসেন। রক্ত হিম করা ভয়। সেই ভয়ই তো এই বাংলোয়। রাতটা ভালই কাটবে। আবদুল এখনই চলে যাবে। সে এখানে থাকে না। সিংজি একা থাকবেন।

আবদুল বলল, “একটা কথা বলে যাই মহারাজ, সব দরজা-জানলা বন্ধ করে শোবেন। দরজার কড়া নাড়লে কি টোকা দিলে, কি ধাক্কা দিলে দরজা খুলবেন না। খুললেই বিপদ।”

“কে ধাক্কা দেবে?”

“ সে আছে। অত জেনে কী দরকার!”

আবদুল বলছে আর নিজেই ভয়ে জড়সড় হয়ে যাচ্ছে। সিংজির সেইটাই খুব মজার মনে হচ্ছে। লোকটার কী ভাগ্য! একসঙ্গে কতরকম ভয় পাচ্ছে! ভূতের ভয়, চোর-ডাকাতের ভয়। জন্তু-জানোয়ারের ভয় পাচ্ছে কি না কে জানে!

সিংজি জিজ্ঞেস করলেন, “জঙ্গল থেকে রাতের দিকে জন্তু-জানোয়ার আসে না!”

“কেন আসবে না! ইচ্ছে হলেই চলে আসবে। তবে গভীর রাতে জঙ্গলের মায়া ছেড়ে বোকা না হলে কে আর আসবে! তবে কখনও-কখনও কেউ অসুস্থ হলে চলে আসে। সায়েব যখন বেঁচে ছিলেন তখন অসুস্থ একটা ময়াল সাপ চলে এসেছিল। পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে সোজা এই ঘরে। সাপটার পিঠে বড়-বড় তিনটে কাঁটা ফুটে ছিল। শজারুর কাঁটা। ঘা হয়ে গিয়েছিল। উপকারী, ভাল মানুষকে বনের জীবজন্তুও চেনে। মনে হয় চিকিৎসার জন্যেই এসেছিল সাপটা। সায়েবের কোনও ভয়ডর ছিল না। আমাকে বললেন, ‘আবদুল গরম পানি লে আও।’ আমি গরম জল করে আনলুম। সায়েব বললেন, ‘তুমি মুখটা চেপে ধরো’। ‘পারব না সায়েব, আমার ভয় করছে।’ সায়েব তখন ওই তিন-পায়া-অলা টেব্ল ল্যাম্পের স্ট্যান্ডটা এনে সাপের গলায় রেখে বললেন, ‘তুমি চেয়ারে দাঁড়িয়ে চেপে ধরে থাকো, কোনও ভয় নেই। তোমার কিচ্ছু হবে না।’ আল্লার নাম নিয়ে আমি তাই করলুম। সায়েব সাঁড়াশি দিয়ে পটাপট কাঁটা তিনটে টেনে তুলে ফেললেন। গরম জলে বোরিক পাউডার দিয়ে ওয়াশ করলেন, তারপর কী সব ওষুধ লাগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘যাও, সব ঠিক হো যায়েগা।’ সাপটা কিছুই করল না। নড়ল না, চড়ল না, মাথা তুলল না। সারারাত আরামসে এখানে শুয়ে রইল। ভোরবেলা উঠে চলে গেল। সায়েব আর সাপ সারারাত এই ঘরেই শুয়ে রইলেন। সাপটা মাঝে-মাঝেই সায়েবকে দেখতে আসত। ওই রাত্তিরবেলা। সারারাত থেকে চলে যেত।”

সিংজি জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু খেত না!”

“হ্যাঁ, সায়েব তাকে দুধ খেতে দিতেন।”

আবদুল আর কিছুক্ষণ থেকে চলে গেল। বাংলোতে ইলেকট্রিক আছে। স্টেশনের সঙ্গে কানেকশান। সিংজি এইবার বাংলোটা পুরো ঘুরে দেখলেন। এই বড় হলঘরটার সঙ্গে আরও দুটো ছোট ঘর আছে। শোবার ঘর। খাট আছে, পরিপাটি বিছানা। বাথরুমের সঙ্গে লাগোয়া সাজপোশাকের ঘর। সায়েবের স্টাডিটা দোতলায়। প্রচুর বই, একটা কার্পেট পাতা। লেখার টেব্ল ছাড়াও আর-একটা টেল কোণের দিকে। সেই টেব্লের ওপর ট্রেতে পর-পর পঞ্চাশটা স্মোকিং পাইপ সাজানো। সায়েবের স্মৃতি সর্বত্র। এরা সব যত্ন করে রেখেছে। একজন মানুষ ভাল হলে, সবাই তাঁকে মনে রাখার চেষ্টা করে—যত দিন পারা যায়। একটা পয়সা ফেলার বাক্স। সেই বাক্সের গায়ে লেখা, ‘পুট টেন কয়েন্স এভরি ডে। ফর আদার্স।’ পরের সেবার জন্য রোজ দশটা করে টাকা ফ্যালো। একটা দেওয়ালে একটা পোস্টার। লেখা আছে, ‘লিভ ফর আদার্স।’ অন্যের জন্য বাঁচো। সায়েবের বাস্ট ফোটোর সামনে দাঁড়িয়ে সিংজি নমস্কার করে বললেন, “আমাকে তোমার মতো করো।”

সারাদিন অনেক পরিশ্রম হয়েছে। সিংজির মনে হচ্ছে, এইবার একটু শুই। আবার মনে হচ্ছে, মেলায় মাদল বাজছে, গেলে কেমন হয়! কত আনন্দ। বাঁশের ডগা চিরে ফট-ফটাফট বাজাচ্ছে। বাচ্চাদের প্রবল কলরব। মনকে আর বশে রাখা যাচ্ছে না। অনেক কষ্টে সিংজি নিজেকে আরামকেদারায় বসিয়ে রাখলেন। কোনওমতেই আর বাইরে যাবেন না। একটা দিনের পক্ষে যথেষ্টই হয়েছে। রাত হল ভাবার সময়। এক-একটা দিন হল এক-একটা সাদা কাগজ। গভীর রাতে সেই কাগজটা চোখের সামনে মেলে ধরে দেখতে হয়, লেখায়-লেখায় ভরাতে পেরেছ কি না! সেই অদৃশ্য লেখা হল, সৎকর্ম। সিংজি ভেবে পেলেন না কোনও সৎকর্ম। আজ কিছুই করা হয়নি। একটা দিন বেকার চলে যাচ্ছে।

আধো অন্ধকারে তিনি কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলেন। সায়েবের স্টাডির দিকে যাচ্ছেন। হঠাৎ মনে হল, একটা কুকুর যেন শুয়ে ছিল, উঠে চলে গেল। ফোঁস করে শব্দও করল। মনের ভুল, ওই যে সায়েবের তিনটে কুকুরের গল্প শুনেছেন। স্টাডির আলোটা জ্বাললেন। নাকে টোব্যাকোর গন্ধ লাগল। মনের ভুল। ওই যে সায়েব পাইপ খেতেন শুনেছিলেন। ভয় পেলে মানুষ কত কী সষ্টি করতে পারে! সিংজি জোব্বার পকেট হাতড়ে দশটা কয়েন বের করে সেই বাক্সটায় এক, দুই, তিন করে ফেলতে লাগলেন। খালি বাক্স। খট-খট আওয়াজে একটা করে টাকা পড়ছে। যেই দশ হল, অমনই কানের কাছে কে যেন স্পষ্ট বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ।”

॥ ২৬ ॥

জয় পড়তে বসেছে। জয়া জানলার কাছে বসে গাছপালা, আকাশ, বাতাসের দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে গান গাইছে।

জয় বলল, “দিদি, তোর আজ লেখাপড়া নেই? গান গাইছিস খুশ মেজাজে?

“কেন গাইব না! আমার সব হোমটাস্ক, আমি কাল রাতেই সেরে ফেলেছি, সেই সময় তুমি যে ভাই বসে বসে ঢুলছিলে! তখন তো তুমি আমার কথা শোনোননি বাছা।”

“তোর গানে আমার পড়ার ডিস্টার্ব্যানস হচ্ছে।”

“আমি তো গুনগুন করছি। তোমার ডিস্টার্ব্যানসের কারণ, তোমার মন আকাশে উড়ছে। ছোটুলাল ঘুড়ি ওড়াচ্ছে, সেই ঘুড়ির দিকে তোমার মন। মনটাকে আকাশ থেকে নামিয়ে এনে তোমার বইতে রাখো, তাহলে আর আমার গান শুনতে পাবে না।”

“তুই দিদি খুব স্বার্থপর। তোর এখন কী করা উচিত বল তো?”

“বলো?”

“আমার মনোবল বাড়াবার জন্যে তোরও পড়তে বসা উচিত।”

“আর আমার মনোবল বাড়াবার জন্যে তুমি কী করেছিল ভাই, বসে বসে ঘুমিয়েছিলে! তখন তো তোমার মনোবল শব্দটা একবারও মনে আসেনি!”

“আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, জেগে থাকতে পারলে ঠিকই আসত। আমি কী করব রে দিদি, যতবার চোখ বড়-বড় করে তাকাই, ততবারই চোখ ছোট হয়ে আসতে-আসতে একেবারেই বুজে যাচ্ছিল। জানিস তো দিদি, ছোট ছোট স্বপ্নও দেখছিলুম।”

হঠাৎ জয় ফোঁসফোঁস করে কান্না শুরু করল। জয়া জানলার কাছ থেকে প্রথমে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ভাইয়ের দিকে। ফোঁপানি ক্রমশই বাড়ছে। বড়-বড় চোখে টলটলে জল। জয়া উঠে এসে জয়ের মাথার পেছনে হাত রাখল। রেশমের মতো একমাথা চুল। বেশ একটা ফুল-ফুল গন্ধ। জয়াকে ফাদার বলেছিলেন, মানুষ যত পবিত্র চিন্তা করবে ততই তার গা দিয়ে সুগন্ধ বেরোবে। চেহারা সুন্দর হবে। মুখটা হয়ে যাবে ভগবানের মতো।

জয়া বলল, “তোর কান্নার কারণটা কী বলবি?”

জয় দিদির বুকে মুখ গুঁজে দু’ হাতে কোমর জড়িয়ে ধরে আরও কাঁদতে লাগল। ফুলে-ফুলে কান্না। কাঁদছে তো কাঁদছেই।

জয়া বলল, “পাগলের মতো কাঁদছিস কেন বলবি!”

অনেক চেষ্টা করে, অনেকবার ঢোঁক গিলে, কান্নার দমকা আবেগ সামলে জয় বলল, “আমি কেন ঘুমিয়ে পড়লুম দিদি!”

“পড়েছিস-পড়েছিস, বেশ করেছিস।”

“তাই তো তুই আমার থেকে আলাদা হয়ে গেলি।”

“আলাদা হয়ে গেলুম কোথায়!”

“দিদি, তুই আমাছে ছেড়ে কখনও কোথাও যাস না দিদি।”

জয়ের আবার কান্না। আচ্ছা এক পাগল! শুয়ে আছে হয়তো দু’জনে পাশাপাশি। পাশ ফিরতে হলেও জয় জয়াকে জিজ্ঞেস করবে, “দিদি! আমি একটু ওপাশ ফিরব?”

এইবার জয়ার চোখে জল। কেন সে অমন কথা বলল ভাইকে! মজা করে বললেও মনে লেগেছে। ব্যাপারটা আরও অনেকদূর হয়তো গড়াত। হঠাৎ জানলার বাইরে বাগানে একটা মাথা দেখা গেল। জানলার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন, সরলা স্টেশনের স্টেশন মাস্টার। ভাইবোন দু’জনেই তাঁকে চেনে।

মাস্টারবাবুকে দু’জনেই খুব ভালবাসে। ভীষণ সরলমানুষ। মজার মজার গল্প বলেন। হঠাৎ কখনও ছুটির দিনে এসে বলেন, “আজ আমি তোমাদের রান্না করে খাওয়াব।” ভাল রাঁধতে পারেন। রান্না করতে ভালবাসেন। ভালই রাঁধতে পারেন কত রকমভাবে, কত কায়দায়।

মাস্টারবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “দুজনে জড়াজড়ি করে কাঁদছ মনে হচ্ছে, কী হয়েছে?”

জয়া চোখ মুখতে-মুছতে বলল, “আমাদের খুব দুঃখ হয়েছে।”

“সে তো বুঝতেই পারছি। দুঃখের কারণ নেই, এমনই দুঃখ।”

“আঃ, সে বেশ ভাল। আকাশে যেমন মেঘ করে, সেইরকম আর কী! আমারও মাঝে-মাঝে এইরকম হয়। তখন আমি যে-কোনও লাইনের একটা ট্রেনে উঠে পড়ে, দু-চারটে স্টেশন পেরিয়ে যাই। ভাঁড়ে চা খাই, ঝালমুড়ি খাই। আবার আর একটা ট্রেনে চড়ে ফিরে আসি। মন ঠিক হয়ে যায়। কখনও একটা গাছের তলায় গিয়ে বসি। গাছকে যদি মনের দুঃখের কথা বলা যায়, গাছ খুব তাড়াতাড়ি মন ভাল করে দিতে পারে। খবরদার নদীর কাছে ভুলেও যেয়ো না, মন আরও খারাপ করে দেবে। কেন জানো! নদী কেবল চলেই যায়। সবচেয়ে ভাল ঘুমিয়ে পড়া। একটা ঘুম যদি দিতে পারো, দুঃখও ঘুমিয়ে পড়বে। তবে একটা জিনিস কিছুতেই মাথায় আসছে না আমার, এই বয়েসে তোমাদের মনে দুঃখ আসছে কেন? ভাল কথা নয়।”

মাস্টারজি শিবশঙ্করের কাছে চলে গেলেন। ভীষণ দরকার। কোনওরকমে আধঘণ্টার জন্যে স্টেশন ছেড়ে এসেছেন। শিবশঙ্কর তখন তাঁর ওয়ার্কশপে হেলিকপ্টার তৈরি করছিলেন। খেলনা-হেলিকপ্টার। মাস্টারবাবুকে দেখে তিনি অবাক। এই সময়ে তো তাঁর আসার কথা নয়। শিবশঙ্কর হাতের কাজ ফেলে রেখে বললেন, “মাস্টারজি, এনি বিপদ?”

“নো বিপদ সার! একটা মেসেজ ফ্রম খড়ক সিং।”

“খড়ক সিং? সে তো কাশ্মীরে?”

“না সার, সিংজিকে আমি একটা রেকে চাপিয়ে ডুমডুমা ফরেস্টে পাঠিয়ে দিয়েছি।”

“ডুমডুমা! কী সর্বনাশ! সে তো ভূতের জায়গা!”

“সিংজি ভূত দেখতে ভালবাসেন। সিংজির মেসেজ হল, আপনাকে আর ডাক্তারবাবুকে এখুনি একবার ডুমডুমা হল্টে যেতে হবে, ভীষণ বিপদ।”

“সে কী! খড়ক সিংয়ের বিপদ! কী বিপদ!”

“মেসেজে আর কিছু নেই, এইটুকুই আছে।”

“যাব কীভাবে?”

“সে ব্যবস্থা আমি করেছি। লাইন ইনস্পেকশন ট্রলিতে চেপে আপনারা যাবেন।”

“কোনও বিপদ হবে না তো?”

“একেবারেই হবে না, তা কেমন করে বলি, তবে আপনারা তো সাহসী, বিপদের ঝুঁকি নিতে চান, নিতে পারেন। রেডি হয়ে একঘণ্টার মধ্যে চলে আসুন স্টেশনে।”

“ফরেস্টের রিপোর্ট কী? শেরটের ঘুমোচ্ছে, না জেগে আছে? সঙ্গে বন্দুক নিতে হবে?”

“একটা নিয়ে নিন। দিন কয়েক আগে পাগমার্ক দেখা গেছে। সিপলার দিক থেকে এই সময়ে আসে।”

“তা হলে তো, জমবে ভাল, কতদিন দেখা হয়নি মামার সঙ্গে। শেষ দেখা হয়েছিল কুমায়ুনের জঙ্গলে। মামা তখন লাঞ্চ করছিলেন।”

মাস্টারজি বললেন, “আমার আর দাঁড়াবার সময় নেই সায়েব, আমি চলছি, ট্রেন পাস করাতে হবে। আপনারা রেডি হয়ে চলে আসুন।”

শিবশঙ্কর উদয়নকে ডেকে বললেন, “একটা এস. ও. এস. এসেছে খড়ক সিংয়ের কাছ থেকে। আমাদের তো একবার যেতে হবে এখুনি।”

উদয়ন জামা ইস্ত্রি করছিলেন, “খড়ক সিং কোথায়! তিনি তো কাশ্মীরে!”

“তিনি কাশ্মীরে যেতে গিয়ে চলে গেছেন ডুমডুমায়।”

“ডুমডুমায়! সে তো ভয়ঙ্কর জায়গা।”

“খড়ক এখন পড়ে আছে ডুমডুমা হল্টে। মনে হয় খুব অসুস্থ।”

“তাই হবে। ওখানকার জল আর মশা! ভাইরাস ম্যালেরিয়াও হতে পারে। ওইসব জায়গায় কেউ যায়!”

“উদয়ন তুমি তা হলে রেডি হয়ে নাও। এক ঘণ্টার মধ্যে আমাদের স্টেশনে যেতে হবে। মাস্টারজি একটা ট্রলি রেখেছেন। সেই ট্রলিতে আমরা যাব।”

“ওই হনুমান দুটো যাবে কি?”

“জয় আর জয়া। কষ্ট হবে না!”

“কষ্ট আবার কী! এই বয়সে কষ্ট না করলে আর কবে করবে। আমরা চারজনে বেশ হইহই করে যাব, ওদের ওই ভয়ঙ্কর জঙ্গলটাও দেখা হয়ে যাবে। কত ভ্যারাইটিজ অব বার্ডস। অন্য প্রাণীও তো আছে!”

শিবশঙ্কর কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, “এ-যাত্রায় থাক উদয়ন। সিংজি যদি সিরিয়াসলি অসুস্থ হয়। তা হলে তাকে ওই ট্রলিতেই আনতে হবে। তখন আর জায়গা হবে না।”

উদয়ন বললেন, “জানেন বাবা, একটা রিস্ক নিয়ে দেখা যাক। মাস্টারজি আছেন, ফেরার যা হয় একটা ব্যবস্থা তিনি করবেন। দেখুন, লুক বিফোর ইউ লিপ—বলে বটে, তবে লিপ বিফোর ইউ লুক-এর আলাদা একটা মজা আছে। অ্যাডভেঞ্চারের ওইটাই তো মজা! আপনার সঙ্গে যাওয়ার সুযোগ আবার কবে আসবে, কে বলতে পারে।”

শিবশঙ্কর বললেন, “অলরাইট! চলুক তা হলে!”

জয় আর জয়া, একটু আগে খুব দুঃখে ছিল। ‘গেট রেডি’-এই আদেশটা আসামাত্রই ভাই আর বোনের দুজনেই হনুমানের মতো লাফাতে লাগল। কী মজা! ভীষণ মজা।

জয় বলল, “দিদি! আমাকে শিকারির ড্রেস পরিয়ে দে।”

জয়া বলল, “আমি, কী পরব!”

“তোরও শিকারির ড্রেস। কত বড় একটা জঙ্গলে যাবি।”

সবচেয়ে ভাল স্কাউটের পোশাক। একঘণ্টা পরেই দেখা গেল, টিম বেরিয়ে পড়েছে স্টেশনের দিকে। শিবশঙ্করের কাঁধে বন্দুক।

॥ ২৭ ॥

পথে নেমে পড়লেন সবাই। রাজার পোশাকের মতো ঝলমলে দিন। শিবশঙ্কর হাসতে-হাসতে বললেন, “এইসব ভড়ং আমার একেবারে ভাল লাগে না ।”

উদয়ন বললেন, “কোন ভড়ং?”

“এই কলোনিয়াল সাহেবদের মতো কাঁধে বন্দুক। কোথায় বাঘ? আর বাঘ যদি সামনে এসে দাঁড়ায়ও, মারতে পারব! মারার মুহূর্তেই মনে পড়বে, মানুষের চেয়ে বাঘ দামি। মানুষের সংখ্যা পোকার মতো বাড়ছে, বাঘের সংখ্যা কমছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করা উচিত।”

“আমরা যে-জঙ্গলে যাচ্ছি, সেই জঙ্গলে বাঘফাগ নেই। থাকলে খটাস আছে। বনবেড়াল।”

“তা হলে এই ভারী বন্দুকটা বয়ে নিয়ে যাচ্ছি কী কারণে! লোককে দেখাবার জন্যে! তোমরা এগোও, আমি বরং রেখে আসি।”

উদয়ন বললেন, “আমাকে দিন। জিনিসটা অনেকদিন জঙ্গলের হাওয়া খায়নি, বাইরের আলো-বাতাস পায়নি। ওরও তো ইচ্ছে করে! তারপর ধরুন যদি কিছু হয়! বাঘ না থাকুক বদমাশ লোকের তো অভাব নেই। দলমা পাহাড়ের দিক থেকে ডাকাত আসে। সেরকম হলে একটু ভয়টয় দেখানো যাবে।”

মাস্টারজি তাঁর ঘরের বাইরে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে একটা পেটি খোলাচ্ছিলেন। শিবশঙ্করদের দেখে বললেন, “আ গিয়া! বহত আচ্ছা!” একটা হাঁক ছাড়লেন, “গিরধারী!”

মোটাসোটা একজন মানুষ যেন মাটি ফুঁড়ে উঠলেন, “হাঁ জি।”

জয় দেখছিল, পেটিটা কিসের! চায়ের। ডুয়ার্স থেকে এসেছে। মাস্টারজির আবার চায়ের ব্যবসা আছে। এ কথা সে জানে। আবার মজা এই, চায়ের ব্যবসা থেকে যে-টাকা রোজগার করেন তার সবটাই দান করে দেন চার্চকে। সেই টাকায় চার্চ গরিবদের সেবা করে। সবাই বলেন, “মাস্টারজি ইজ রিয়েলি গ্রেট। মাথায় সামান্য ছিট আছে হয়তো!” তা তো আছেই, তা না হলে কেউ ছাগলের জন্য পাগল হয়। স্টেশন চত্বরে টিয়ার ঝাঁক এলে কাজ ফেলে ছুটে আসেন! যেন ভারতবর্ষের প্রেসিডেন্ট এসেছেন। কোনও মানুষ কোলাব্যাঙ পোষেন! ঘরের মধ্যে থপথপ করে ঘুরছে। কেউ এলে গর্ব করে দেখান, “বঙ্গালকা ব্যাঙ।”

“মাস্টারজি, এই বাচ্চা দুটোকে নিয়ে যাব?” প্রশ্ন করলেন উদয়ন।

“হোয়াই নট? ওদের স্টিফেন্স গর্জটা দেখিয়ে আনবেন? সিক্স মাইল্স ফ্রম ডুমডুমা।”

“সেটা কী? কখনও শুনিনি তো!”

“সরলা নদী একটা গুহায় ঢুকে আবার বেরিয়ে আসছে। নদী খেলা করছে। দুষ্টু মেয়ে সরলা। আর দেখাবেন ভৈরব মন্দির। রেলিক্স। শিবলিঙ্গ পাতালে ঢুকে গেছেন। বিশাল এক গর্ত। গর্তের মুখের কাছে দাঁড়ালে শুনতে পাবেন, ‘শিব শিব’। একটা ঠাণ্ডা গরম ভাপ ওপরে উঠে আসছে। ভাগ্য ভাল থাকলে শুনতে পাবেন পাতালে জলের শব্দ। অনেকটা হরিদ্বারের গঙ্গার শব্দের মতো, ‘হর হর’। আর-একটা জিনিস দেখে আসবেন, সেটা আছে ডিসকিম বলে একটা জায়গায়, থ্রি মাইল্স ইস্ট অব ডুমডুমা হল্ট। একটা গাছ, যার সব পাতা হলদে, আর কোনও দুটো পাতা একরকমের নয়। এক-একটা এক-একরকম। ক্রেজি ইয়েলো ট্রি।”

শিবশঙ্কর জিজ্ঞেস করলেন, “মাস্টারজি বন্দুক কি নিয়ে যাব?”

“নিশ্চয়। কখন দরকার হবে কেউ বলতে পারে? জঙ্গল, নদী, আগুন আর মানুষকে বিশ্বাস নেই।”

“শাঁ করে শব্দ। ট্রলি এসে গেল। ঠেলতে হয় না। পাওয়ারে চলে। একটু সাবধানে বসতে হয়। পড়েটড়ে গেলে সেরকম কিছু নয়, লাইনের খোয়ায় কেটেকুটে যাওয়ার ভয় আছে। মাস্টারজি হাত নেড়ে যাত্রা করিয়ে দিলেন। গিরধারীর হাতে কন্ট্রোল। জয়া জয়কে জড়িয়ে ধরে আছে। শিবশঙ্করের কোলের ওপর বন্দুক। উদয়ন আড়ষ্ট। একেবারে খোলা চারপাশ। একটু ভয়-ভয় করতেই পারে।

গিরধারী জিজ্ঞেস করল, “আমি যদি গান গাই আপনাদের অসুবিধে হবে?”

শিবশঙ্কর প্রশ্ন করলেন, “খুব জোরে?”

“না না, আস্তে-আস্তে।”

“কী গান গাইবে, হিন্দি সিনেমার!”

“না সরকার, আমি ভজন গাইব।”

“বেশ, ধরো।”

গিরধারী গলা দিয়ে সামান্য একটু সুর বের করেছে, সবাই একেবারে মোহিত।

“আরে ভাই, তুমি তো একেবারে পাকা গাইয়ে। সুর লাগাচ্ছ কী! প্রাণটা একেবারে ছটফট করে উঠছে।”

“কী যে বলেন সরকার! লজ্জা দেবেন না। বিশ বছর তালিম নিয়েছি। কিছু হয়নি। আমার গুরুজি বলতেন, গিরধর! একটা গাধাকে তালিম দিলে সে এতদিনে শিখে যেত।”

গিরধারী ধরেছে, “রাম নাম সুখদারি, সাচ্চা মনসে ভজো রাঘব তো, ইকদিন মুক্তি পায়ি।” আর গাইছে কী? মালপোর মতো গলায় ঠাসা সুর। তেমনই সব সুষম-সুষম কাজ। ভৈরবীর বাহার। উদয়ন শিবশঙ্করকে বললেন, “বাবা! এঁকে কলকাতার কনফারেন্সে নিয়ে গেলে কেমন হয়!”

“খুব খারাপ হয় বাবা। সেখানে কেউ কল্কে দেবে না। কনফারেন্সে গান বড় কথা নয়, কে গাইছে সেইটাই বড় কথা! নাম চাই, নাম।”

জয় আর জয়া দু’জনে বসে আছে জড়াজড়ি করে। বেশ ভালই লাগছে। স্লিক-স্লিক করে বেশ বড় মাপের একটা পিঁড়ে যেন সাঁই-সাঁই করে চলেছে। জমি খুব কাছে। একটু ঝুঁকে হাত বাড়ালেই ঘষড়ে যাবে। এমন অভিজ্ঞতা আগে কখনও হয়নি। জয় বলল, “দিদি! হঠাৎ ব্রেক কষলে আমরা তো ছিটকে পড়ে যাব।”

“সেই জন্যেই তো তোকে ধরে আছি। ব্রেক কেন কষবে! ধীরে-ধীরে স্পিড কমাতে-কমাতে থেমে যাবে। দূরে একটা টানেল। এগিয়ে আসছে হুহু করে। চুপচাপ অন্ধকার। এইরকম টানেল ট্রেনে পেরোবার সময় তেমন কিছু মনে হয় না। কামরায় বসে আছি। মাথার ওপর ছাত। হঠাৎ ঝলমলে আলো থেকে থকথকে অন্ধকার। অন্ধকার, অন্ধকার, আবার আলো। এই অভিজ্ঞতাটা একেবারে অন্যরকম। অন্ধকারের সিংহদুয়ার এগিয়ে আসতে-আসতে ট্রলি ঝাঁ করে ঢুকে পড়ল। হিম-হিম স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার। বিশাল এক গুহা। তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হয়তো শ্যাওলা জমেছে পাথরের দেওয়ালে। ওপাশে অনেক দূরে আলোর দরজা। বেরোবার পথ। প্রথমে ছিল প্রদীপের শিখার মতো। ক্রমে বড় হতে-হতে বৃত্তাকার। ট্রলির শব্দে ভেতরটা গমগম করে উঠল। কানে তালা ধরে যাওয়ার জোগাড়। গিরধারী বলল, “রাম রাম বলে চিৎকার করো, দেখবে এক রাম কত রাম হয়ে যাবে।”

শিবশঙ্কর ছেলেমানুষের মতো হুপ করে একটা শব্দ করলেন। ধ্বনি, প্রতিধ্বনি, ট্রলির শব্দ সব একাকার হয়ে, ভয়ঙ্কর শব্দঝঙ্কার।

ট্রলি হুস করে বেরিয়ে এল আলোয়। জঙ্গলের সীমানায় এসে গেছে ট্রলি। ছবির মতো সামনে পড়ে আছে একজোড়া রেল লাইন। ঝলমলে আলোর ধূসর পাথর। একপাল হনুমান দূরে লাইনের ওপর সভা করছে। ট্রলিটার আবার হর্ন আছে। প্যাঁক-প্যাঁক। পেছনে একটা পতাকা পতপত করে উড়ছে।

উদয়ন বললেন, “গ্রেট মিস্টেক। সঙ্গে এক ফ্লাস্ক চা থাকা উচিত ছিল।”

গিরধারী বলল, “সে আর ভাবতে হবে না, মাস্টারজি চা, বিস্কুট, পাউরুটি সব দিয়ে দিয়েছেন। তাড়াতাড়িতে আর কিছু পারেননি। তবে আটা, ঘি, ডাল, আলু দিয়েছেন।”

উদয়ন বললেন, “কেন?”

“দিল!”

“দিল মানে?”

“সরকার! মানুষটার দিল হল দিল্লি, রাজধানী। রাজার মতো। আমাকে বলেছেন, দুপুরে একটা ভাল জায়গায় ট্রলি দাঁড় করিয়ে, কাঠকুটো জ্বেলে গরম চাপাটি, ডাল আর আলুর তরকারি রেঁধে আপনাদের খাওয়াতে।”

শিবশঙ্কর শুনে বললেন, “দেখেছ! দিল্লিতে দিল নেই, দিল আছে কোনও-কোনও মানুষের মনে। এই যে জায়গাটায় আমরা আছি, এই সরলা নদীর তীর, এখানে যে কত মানুষ আছে, যাদের মনটা হল খাঁটি সোনা। এই খড়ক সিং, গিরধারী, মাস্টারজি, ফাদার।”

গিরধারী বলল, “সরকার! আপনাদের কেন বাদ দিচ্ছেন। আর আমার এই দাদা, দিদি। জয়, জয়া!”

জয়া বলল, “আপনি আমাদের চেনেন?”

“হাই দিদি, চিনব না! মনে নেই, চার্চের অনুষ্ঠানে আমরা সবাই মিলে গান করেছিলুম। আমাকে চিনতে পারোনি। আমি প্রত্যেক বছর তোমাদের সান্টাক্লজ সাজি।”

“ওমা, তাই নাকি! ইউ আর গ্রেট। ইউ আর নাইস, ইউ আর সুইট।” ট্রলির স্পিড বেড়েছে, কারণ, ঢালুতে নামছে। রোদ চড়লেও কষ্ট হচ্ছে না। ছায়া রোদ, রোদ ছায়া এইভাবেই চলছে!

গিরধারী তার ঝোলা থেকে একটা ফ্লাস্ক বের করে উদয়নের হাতে দিতে-দিতে বলল, “চায় গড়ম।”

॥ ২৮ ॥

এই জায়গাটারও একটা নাম আছে, ‘লিটল হাট’।

সেই সময় সায়েবদের খুব যাওয়া-আসা ছিল এই তল্লাটে। ডুমডুমায়, ডুমডুমা হল্টে। ফরেস্টে তাঁরা আসতেন ঘোড়ায় চড়ে। এই জায়গায় জঙ্গল হঠাৎ কোনও কারণে বেশ কিছুটা জায়গা ছেড়ে রেখেছে। একেবারে ফাঁকা। এক কণা ঘাসও নেই। কালো কঠিন মাটি। মসৃণ।

ট্রলি থেকে সবাই নেমে এসেছেন গিরধারী মালপত্র নামাচ্ছে। এইখানে দুপুরের রান্না হবে। এর পর আরও অনেকটা পথ। সে-পথ খুবই দুর্গম। জঙ্গল গভীর। বন্যপ্রাণীর উৎপাত আছে।

জয় জিজ্ঞেস করল, “দাদা, এখানে কী ভূত থাকে?”

“ভূত বলে কিছু আছে নাকি রে দাদা? হঠাৎ এমন প্রশ্ন!”

“জঙ্গল এই জায়গাটাকে ছেড়ে রেখেছে কেন?”

“কেন বলো তো! অনুমান করো। মাটিটা পা দিয়ে দ্যাখো।”

জয়া বলল, “এটা মাটি নয়, পাথর দাদা। একটা পাহাড় হতে-হতে আর হয়নি, থেমে গেছে।”

শিবশঙ্কর বললেন, “দ্যাট্স রাহট। ঠিক বলেছিস দিদি। একটা পাহাড় ফর্ম করছিল। আপাতত থেমে আছে। ভবিষ্যতে হতেও পারে। মাটির নীচে আছে। যেহেতু শিলা, সেই হেতু এই জায়গাটায় গাছপালা হয়নি। একগাছা ঘাসও জন্মায়নি। যেন মৃত্যুর শানবাঁধানো বেদি। সেইজন্যই জয়ের মনে হয়েছে ভৌতিক। সায়েবরা নাম রেখে গেছেন, লিটল হাট। হাত-পা ছড়িয়ে বেশ বিশ্রাম করা যায়। জঙ্গলের ছায়া, ঠাণ্ডা। একটা ঘুমও দেওয়া যায় পাখির গান শুনতে-শুনতে। তবে ভাই সমস্যা একটাই, সাপ আছে, নানারকম সাপ। কিলবিল করে চলে যেতে পারে পাশ দিয়ে। সাপ ভয় না পেলে মানুষকে শুধু-শুধু কামড়ায় না।”

জয় বলল, “দাদা, পাহাড় কেমন করে হয় আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে।”

“দাদাভাই, সে যে সৃষ্টির আদিকালের ব্যাপার। জিওগ্রাফির ভাষায় যাকে বলে সাইল অব ইর্শান। গঠন ও ক্ষয়। পাহাড় কীভাবে হয় জানো? আপলিফ্ট ফোল্ডিং, ফণ্টিং আর ভলক্যানিক অ্যাকটিভিটি। বড় হয়ে যখন হায়ার জিওগ্রাফি পড়বে, তখন পাবে জিওমরফোলজি। সেইখানে আছে প্লেট টেকনিক্স। খুব আকর্ষক বিষয়। পৃথিবীটাকে কার না জানতে ইচ্ছে করে!”

উদয়ন জঙ্গলে গেছেন গাছের শুকনো ডাল সংগ্রহ করতে। গিরধারী পাথরের চাঁই জোগাড় করে এনেছে। জলের ব্যবস্থা সঙ্গেই আছে। তা ছাড়া জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কিছুটা গেলেই সরলা নদীর বাঁক। সরলার জলও খারাপ নয়। তবে সেখানে যাওয়ার দরকার হবে না। যথেষ্ট জল আছে।

জয়া গিরধারীকে বলল, “আমি আপনাকে সাহায্য করি।”

“নিশ্চয় করবে। সকলকেই সাহায্য করতে হবে।”

শিবশঙ্কর বসলেন আলু কাটতে। গিরধারী তিন-চারটে বড়বড় ছুরি এনেছে। জয়া বসেছে ডাল বাছতে। ডালে বড়-বড় পাথর থাকে। উদয়ন এসে গেলেন শুকনো ডালপালার বোঝা নিয়ে। গিরধারীর সঙ্গে আছে কড়া আর চাটু। আছে একটিন ভাল ঘি। অড়হর ডাল চেপে গেছে। লকলকে আগুন। জয়ের কাজ হল, আগুনে শুকনো গাছের ডাল ঠেলা। গিরধারী ময়ান দিয়ে আটা ঠাসছে। যত ঠাসবে রুটি তত নরম হবে।

উদয়ন বললেন, “জঙ্গলে অদ্ভুত একটা জিনিস দেখে এলুম।”

শিবশঙ্কর জিজ্ঞেস করলেন, “কোনও জন্তু?”

“না, এক ধরনের ফল। লতানে গাছ। কলার মতো দেখতে থোলো থোলো ফল ঝুলছে।”

গিরধারী বলল, “বড়িয়া চিজ। ভেরি টেস্টফুল। ও জিনিসটা তরুকলা। পারেন তো দু-চার থোলো তুলে আনুন। খাঁটি ঘি আছে। শুকনো কাবাব বানিয়ে দোব মিরচা দিয়ে।”

উদয়ন ঝেড়েঝুড়ে উঠলেন। জয় বলল, “আমি যাব তোমার সঙ্গে।”

জয়া বলল, “বাঃ, বেশ স্বার্থপর তো তুই। একা-একা কেমন জঙ্গল দেখে নিবি?”

গিরধারী বলল, “তোম ভি যাও ম্যাডাম।”

“আপনাকে কে সাহায্য করবে?”

“আরে বহেনজি হিঁয়াপর দো আদমি তো হ্যায় নাকি?”

জয়া বলল, “দাদা আমি যাব?”

“যাও দিদি, তবে সাবধানে যেয়ো। তিনটে জিনিস সজাগ রেখো, চোখ, কান আর নাক।”

ওরা তিনজনে গভীর জঙ্গলের দিকে রওনা দিল। বড়-বড় গাছ। কতরকমের গাছ। ঝোপঝাড়। হঠাৎ আলো কমে গেল। একটানা ঝিঁঝি ডাকছে। তিতকুটে গন্ধ। জঙ্গলের ছোটখাটো প্রাণীরা ভীষণ ব্যস্ত। গাছের গুঁড়িতে লাল পিঁপড়ের দল অঙ্কের মতো আপ অ্যান্ড ডাউন ছে। শুঁয়োপোকার স্বাস্থ্য দেখে দু’জনেই আঁতকে উঠল।

উদয়ন বললেন, “প্রচুর ভিটামিন পায় তো, তাই সব ওইরকম চেহারা।”

গাছের শুকনো ডাল কঙ্কালের হাতের মতো ঝুলে রয়েছে। মাকড়সার জালই কত রকমের। কোথায় একটা পাখি ডাকছে অদ্ভুত শব্দে টিটির টিটির করে। উদয়ন আর সেই তরুলতা, যাতে তরুকলা ফলে খুঁজে পাচ্ছেন।।

“আশ্চর্য ব্যাপার। কোথায় গেল বল তো। এই হল জঙ্গলের খেলা! দিক ভুল হতে একটুও দেরি হয় না।”

জয় বলল, “চলো না, আর-একটু ভেতরে যাই।”

উদয়ন বললেন, “খেপেছিস! হারিয়ে যেতে পাঁচ মিনিটও লাগবে না। জঙ্গল বড় ভয়ঙ্কর জায়গা।”

জয়া কী একটা কুড়িয়ে পেল। শক্তমতো। ছুঁচলো। “এটা কী বাবা?”

উদয়ন দেখে বললেন, “বুলেট। কেউ শিকারটিকার করতে এসেছিল।”

“এখানে কী শিকার পাবে? আমরা তো কিছুই দেখছি না!”

“কিচ্ছু বলা যায় না রে জয়ী, কখন কী বেরিয়ে আসবে।”

হঠাৎ জয়ার নাকে একটা বোটকা গন্ধ লাগল। উদয়নও পেয়েছেন গন্ধটা।”

জয়া বলল, “বাবা।”

উদয়ন বললেন, “পেয়েছি মা। চল, সরে পড়ি।”

জয় জিজ্ঞেস করল, “গন্ধটা কিসের?”

উদয়ন বললেন, “হতে পারে বাঘ।”

তিনজনে পা চালিয়ে বেরিয়ে এলেন জঙ্গল থেকে। শুধু হাতে ফিরতে দেখে শিবশঙ্কর বললেন, “কী হল তোমাদের তরুকলা?”

উদয়ন বললেন, “জায়গাটা হারিয়ে ফেলেছি। ভেতরে বেশিক্ষণ থাকার সাহস হল না। মনে হল বাঘের গন্ধ। বাঘ কি আছে?”

গিরধারী বলল, “বাঘ নেই আবার। খুব আছে।”

ডাল, রুটি, তরকারি ভালই খাওয়া হল। গিরধারীর রান্না খুব ভাল। মসলাপাতি কিছুই তেমন নেই, স্রেফ হাতের কেরামতি। শিবশঙ্কর চিতপাত হয়ে শুয়ে পড়লেন পাথরের ওপর। সোনালি রঙের এক ধরনের পোকা উড়ছে ছোট-ছোট। উদয়ন উদাস চোখে তাকিয়ে আছেন বিশাল জঙ্গলের দিকে। জয় আর জয়া ছোটাছুটি করছে। গিরধারী মালপত্র সব প্যাক করে ট্রলিতে তুলছে, এমন সময় সারা জঙ্গল কেঁপে উঠল বাঘের গর্জনে।

গিরধারীর কোন ভয় নেই। হাসতে হাসতে বলল, “মামার খিদে পেয়েছে। রুটি, ডাল খাবে মামা? এখানে রেখে যাচ্ছি। আমরা চলে যাওয়ার পর এসে খেয়ে যেয়ো।”

শিবশঙ্কর বললেন, “উদয়, বন্দুকটা হাতের কাছে রাখো।”

উদয়ন বললেন, “এ-বাঘ ম্যানইটার নয়। এখানে ম্যানইটার নেই।”

জয় আর জয়া জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে।

জয় বলল, “দিদি, যদি একবারের জন্য দেখা যেত। জ্যান্ত বাঘ কখনও দেখিনি।”

জয়া বলল, “আমাদের বরাতে কি আর বাঘ দেখা আছে! ডাকটা তো ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে।”

গিরধারী বলল, “এইবার সব চলে আসুন। রাত ন’টার মধ্যে পৌঁছতেই হবে।”

ট্রলি স্টার্ট নিল। ক্রমশ স্পিড বাড়ছে। বাঘের ডাক থামেনি। মাঝে-মাঝেই ডাকছে। কোনও কারণে অসন্তুষ্ট হয়েছে। বেলা পড়ে আসছে। জঙ্গলে তাড়াতাড়ি রাত নামে। পথে তেমন কিছু আর হল না। দিদির কোলে মাথা রেখে জয় ঘুমিয়ে পড়েছিল। ন’টা পাঁচে তারা ডুমডুমা হল্টে পৌঁছে গেল। ট্রলি থেকে নামতেই দূবেজি এগিয়ে এল।

গিরধারী বলল, “সিংজি কোথায়?”

“আমার বাড়িতে।”

শিবশঙ্কর বললেন, “খুব বাড়াবাড়ি? কথাটথা বলতে পারছে?”

দুবে বলল, “সিংজির কিছু হয়নি। হয়েছে আমার লেড়কির। ডাক্তারবাবু সে আর বাঁচবে না।”

দুবে ফোঁস ফোঁস করে কাঁদতে লাগল।

শিবশঙ্কর বললেন, “আমি ডাক্তার নই, ডাক্তার আমার ছেলে।”

দুবে উদয়নের হাত ধরে বলল, “মেয়েটাকে বাঁচান ডাক্তারবাবু!”

দুবের কাঠের বাড়ি। লণ্ঠন জ্বলছে। চারপাশে জঙ্গুলে পোকা উড়ছে। এক-একটা আবার বুলেটের মতো ফটাস-ফটাস করে গায়ে এসে পড়ছে। জয় বাঘের ডাকে ভয় পায়নি, এই পোকার ভয়ে সিঁটিয়ে আছে। এক-একটা পোকার আবার বিরাট-বিরাট শুঁড়। জামার বুকের কাছে ঠ্যাং আটকে গিয়ে উড়তে পারছে না, তির তির করে ডানা নাড়ছে। পোকার জ্বালায় অস্থির অস্থির।

গলা পেয়ে সিংজি এক লাফে বেরিয়ে এলেন। দু’ হাত দিয়ে শিবশঙ্করকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “মেরা দোস্ত!”

“ব্যাপারটা কী?”

দুবের সেই মেয়েটি বিছানায় শুয়ে আছে। কোনও হুঁশ নেই।

সিংজি ডুমডুমা যাওয়ার সময় এই মেয়েটিকেই সেই হনুমানের বাচ্চাটা দিয়ে গিয়েছিলেন। এর বাবা আবার বিয়ে করছে শুনে সিংজি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন। দুবে খামখেয়ালি লোক। মেজাজ কখন কেমন থাকে বলা মুশকিল। মেয়েটাকে যখন-তখন মারে। কোনওদিন খেতে পায়, কোনওদিন পায় না। ডুমডুমা থেকে ফিরছিলেন সিংজি। দেখতে এসেছিলেন। দেখেন, মেয়েটা জ্বরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে তিনদিন। কোনও চিকৎসা হয়নি। বিছানার সঙ্গে মিশে আছে। গায়ে এক ফোঁটা রক্ত নেই। বদমাশ দুবে মনে মনে চাইছে, মেয়েটা মরে যাক। মরে গেলে সে সুখে নতুন সংসার পাতবে। ওর শ্বশুর পণ্ডিতজিটাও মহা শয়তান। ওর পুজো-অর্চনা সব বৃথা। লোকটা মহা ধান্দাবাজ।

উদয়ন বিছানার পাশে বসে পরীক্ষা করছেন রোগীকে। ময়লা চাদর। অপরিচ্ছন্ন ঘর। ভ্যাপসা গন্ধ। জ্বরে মেয়েটার গা পুড়ে যাচ্ছে। উদয়ন বললেন, “কেস খুব সিরিয়াস। এই জঙ্গলে এর কোনও ইলাইজ সম্ভব নয়। একে নিয়ে যেতে হবে আমার হাসপাতালে। সিভিয়ার ইনফেক্শান। ব্লাড দিতে হবে। মেয়েটা অ্যানিমিয়ায় প্রায় শেষ হতে চলেছে।”

সিংজি দুবেকে বললেন, “মেয়েটার কী অবস্থা করেছ বুঝতে পারছ?

“সবই রামজির হাত।”

আর যায় কোথায়! সিংজি সপাটে এক চড় হাঁকালেন দুবের গালে। “শয়তান! ইসমে রামজিকা ক্যা করনা হায়। ইয়ে তুমহারা শয়তানি। দুবে! এই মেয়ে যদি মারা যায় তা হলে তোমাকে আর তোমার ওই শ্বশুরকে শ্বশুরাল পাঠাব!”

দুবে থতমত হয়ে গেল। জয় আর জয়া মেয়েটির মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে! যেন দুটো দেবশিশু।

॥ ২৯ ॥

সায়েব আমলের রেল কোম্পানির বাড়ি যেমন হয়, সেইরকম একটা বাড়ি। দুটো ঘর, একটা উঠোন। রক, রান্নাঘর। রান্নাঘরের ছাতে ধোঁয়া বেরোবার জন্যে বাচ্চা হাতির পিঠের মতো পোড়া মাটির পাইপ। জয় আর জয়া দু’জনেরই এইগুলো দেখতে বেশ মজা লাগে। আলাদা একটা শোভা। মনে হয় এখনই বুঝি জ্যান্ত হয়ে চলতে বেরোবে। বাড়ির বাইরের দেওয়াল প্লাস্টার করা নয়। রেল কোম্পানির বাড়ি যেমন হয় আর কি। সিমেন্ট পয়েন্টিং করে লাল রং লাগানো। উঠোনে একটা কদমগাছ। ডালপালা দু’পাশে লম্বা-লম্বা হাত ছড়িয়ে নাচছে যেন।

রাত্তিরবেলা সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, বাদুড় যখন গাছের ডাল থেকে ছাতার মতো খসে পড়ে আকাশে উড়ে যায় মাঝরাতের চাঁদের গায়ে মেঘ যায় খেলা করতে, তখন পৃথিবীতে কি অনেক কাণ্ডকারখানা হয়! গাছ মাঠের ওপর দিয়ে হনহন করে হাঁটছে। অন্য গাঁয়ে তার আত্মীয়কে দেখতে যাচ্ছে। কালো হাঁস রুপোর ডিম পাড়ছে। আকাশের তারা পুকুরে চান করতে নামছে। বাঁকা রাস্তা সোজা হয়ে যাচ্ছে। কে জানে কী হয়! কেইবা সারা রাত জেগে থেকে দেখছে। জয়া একদিন জয়কে বলেছিল, “চল, আমরা সারারাত জেগে থেকে দেখি। শ্রাবণী পূর্ণিমার গভীর রাতে লম্বা লম্বা এক ধরনের ফড়িং উত্তরদিক থেকে উড়ে আসে, যাদের মুখ নাকি ঠিক মানুষের মতো।” এই সব কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না, তবু করতে হয়। পৃথিবীতে রহস্যের কি শেষ আছে!

জঙ্গল ঘেরা নতুন জায়গায় এলে এইসব অদ্ভুত-অদ্ভুত ভাবনা আসবেই আসবে। চেনাকে অচেনা মনে হবে। জয়ের একটু ভয়ভয় করছে। লণ্ঠনের আলোয় মানুষের ছায়া বড়-বড় দেখাচ্ছে। একটা কুকুর শুয়ে আছে বাঘের মতো বড় দেখাচ্ছে। গাছের পাতায় পাতায় উনোনের ধোঁয়া সরু সুতোর মতো পাক খাচ্ছে। কদমের ডালে ছোট ছোট ঘণ্টা দুলছে। তারই টিং টাং শব্দ।

জয়া দুবের মেয়ে লছমির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ফুলের মতো ফুটে আছে যেন। কত অসহায়! জয়া কপালে হাত রাখল। আলতো হাত। খুব জ্বর। জয়া বলল, “বাবা, কপালে জলপটি দেব?”

শিবশঙ্কর বললেন, “ঠাণ্ডা জলে মাথাটা বেশ করে ধুইয়ে দেওয়াই ভাল। তিনের ওপর উঠলে তাই করা হত আমাদের ছেলেবেলায়।”

উদয়ন বললেন, “ভাবছি, এত বড় বড় চুল, যদি জল বসে যায়!”

“জল বসবে না মনে হয়, হিটে টেনে নেবে। অনেকটা আরাম পাবে উদয়ন।”

“তা হলে সাহস করে দেখা যাক।”

জয়ের মনে পড়ল, তার এবার এইরকম প্রবল জ্বর হয়েছিল। তিন, চার। চোখ বুজিয়ে পড়ে থাকত সারা দিন। মাথার কাছে মা, পায়ের কাছে দিদি। বাবা মাঝে-মাঝে এসে দেখে যাচ্ছেন। জানালার কাছে চেয়ারে বসে আছেন দাদি। সকলেরই কী দুশ্চিন্তা! চার্চের ফাদার সাইকেলে আসছেন, দিনে অন্তত দুবার, “হাউ ইজ মাই সান! প্রে প্রে, প্রে টু দি লর্ড!”

জয়ের সেই কথাটা মনে পড়ল, “প্রে, প্রে, প্রে টু দি লর্ড!”

দিদি লছমির মাথা ঘোয়াচ্ছে। সিংজি গুম মেরে দাঁড়িয়ে আছেন একপাশে। দুবের চড় খেয়েও লজ্জা নেই। বলছে, “ছোটদের এইরকম জ্বর হতেই পারে। আগেও কতবার হয়েছে।”

জয় অন্ধকারে কদমগাছের তলায় এসে দাঁড়িয়েছে। মাথার ওপর নীল-কালো আকাশ। মা-কালীর গায়ের মতো রং। মা-কালীকে খুব আপন মনে হয় জয়ের। আগে অনেকবার প্রার্থনা করে দেখেছে, বেশ ফল হয়। এই বিশ্বাসের কথা সে কাউকে বলে না। শিরিন বারণ করে দিয়েছে, বলেছে, “বিশ্বাসটা নিজের মধ্যে রাখবি। তা না হলে আর কোনও কাজ হবে না। স্বপ্নে যদি কিছু দেখিস কাউকে বলবি না, তা হলে স্বপ্নের ফল ফলবে না!”

জয় আকাশের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে বলতে লাগল মনে মনে, “মা, আমার কথা শোনো মা, মেয়েটাকে ভাল করে দাও মা!” জয় বেশ বুঝতে পারল, প্রার্থনাটা বেশ জমে গেছে। মনটা খুব স্থির হয়েছে।

ফাদার একবার কথায়-কথায় আর-এক ফাদারকে বলেছিলেন, জয় পাশে দাঁড়িয়ে শুনেছিল, যার জন্যে প্রার্থনা করছ, তার চেহারাটা চোখ বুজিয়ে ভাববে। ভাবতে ভাবতে বলবে, “ও লর্ড! কিওর হিম, কিওর হিম।”

জয় চোখ বুজিয়ে লছমীর মুখটা ভাবছিল, আর প্রার্থনা করছিল। বেশ তন্ময় হয়ে গিয়েছিল, এমন সময় কদমগাছের ডালে একটা প্যাঁচা এসে বসায় ডালটা দুলে উঠল। বেশ বড় একটা প্যাঁচা। ধবধবে সাদা রং। জয়ের মনে হল, এটা খুব ভাল লক্ষণ। সাদা প্যাঁচা মঙ্গল আনে। ঠোঁটে ঠোঁট ঘষে, খটাস-খটাস শব্দ করছে। মাঝে-মাঝে দমকা বাতাসে গাছের পাতা দুলে উঠছে।

জয় ঘরে ঢুকে দেখল, লছমি চোখ মেলেছে। জয়া কপালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করছে, “কেমন লাগছে তোমার বোন? একটু ভাল?”

ঘরে এত অপরিচিত লোেক দেখে লছমি অবাক হয়ে গেছে। প্রত্যেকের দিকে এক-একবার করে তাকাচ্ছে আর চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। উদয়নের ফরসা ধারালো মুখ। চোখে চশমা। শিবশঙ্করের সাধুর মতো মুখ। গিরধারীর থলথলে হাসি-হাসি মুখ। জয়ার মুখ, জয়ের মুখ। লছমি যেন সব দেখছে। ঘরে একটা আলো জ্বলছে টিমটিম করে। সেই আলোয় বড় বড় ছায়া পড়েছে দেওয়ালে’।

লছমি খুব ক্ষীণ গলায় বলল, “বহিন, পানি পিয়ুঙ্গি।”

জয়া চারপাশে তাকিয়ে দেখল, ঘরে কোথাও কোনও জলের কুঁজো নেই। আসলে এই দুবে লোকটা মহা অলস। সব সময় পড়ে পড়ে ঘুমোয়। সংসারের কাজ কিছুই করে না। সব ওই বাচ্চা মেয়েটিকে দিয়ে করায়। লছমি জ্বরে পড়েছে, কে জল আনবে! পাশের ঘরে একটা মাটির কলসি রয়েছে, জল নেই একফোঁটা। কিছু দূরে রাস্তার ধারে একটা টিউবওয়েল আছে। জয়া দেখেছিল ঢোকার সময়! গেলাস কোথায়?

সিংজি ভীষণ রেগে চিৎকার করে উঠলেন, “অ্যায় দুবে!”

দুবে বোধ হয় সত্যিই ঘুমোচ্ছিল। একেবারে দায়-দায়িত্বহীন আকাট একটা মানুষ। আজকের দিনটা যাক তারপর না হয় ভাবা যাবে কালকের কথা। গিরধারী এক লাফে ঘরের বাইরে চলে গেল। তার এইসব ধানাই-পানাই ভাল লাগে না একেবারে। যা করতে হবে তা দুমদাম করে ফেলাই ভাল। করার পর একটু বোসো, গল্প করো, সময় নষ্ট করো। তখন কত সুখ! বাবা বলতেন, “কাজ সেরে বোসো, শত্রু মেরে হাসো।” গ্রিধারী অন্ধকারে ছুটতে-ছুটতে চলে গেল লাইনের ধারে। সেখানে ট্রলি, ট্রলিতে আছে,জলের পট।

জয়া লছমিকে জল খাওয়াল, কী ভীষণ তৃষ্ণা! কতক্ষণ জল খায়নি কে জানে!

উদয়ন একপাশে সরে গিয়ে শিবশঙ্করকে ফিসফিস করে বললেন, “এখানে রাখলে মেয়েটাকে কোনওভাবেই বাঁচানো যাবে না। লাংসে হেভি কনজেশন। মরুক বাঁচুক একে নিয়ে যেতে হবেই।”

সারাটা রাত সবাই বসে রইল লছমিকে ঘিরে। শেষ রাতে হঠাৎ টেম্পারেচার নামতে শুরু করল। হাত পা বরফের মতো ঠাণ্ডা। গরম জল! হটব্যাগ! কোথায় পাওয়া যাবে! বৃথাই ছোটাছুটি। গিরধারী ঢুলছিল। তার চটকা ভেঙে গেল। হটব্যাগ না পাওয়া যাক, গরমজল তো পাওয়া যাবে!

গিরধারী রকের একপাশে সরে গিয়ে ঝপাঝপ্ কয়েকবার ডন-বৈঠক মেরে নিল। তারপর হাঁটুতে রেখে একটা গাছের ডাল ভাঙল মটাস শব্দে। আগুন আছে, গাছের শুকনো ডাল আছে, জল আছে, “গিরধারী ভি হ্যায়। তব তো গরম পানিভি হ্যায়।” গিরধারী এইসব বলতে-বলতে আগুন জ্বেলে ফেলল। হে ভগবান! লছমি যেন বাঁচে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *