শিউলি – ১০

॥ ১০ ॥

রাত মনে হয় অনেক হল। কারও ঘড়ি দেখার কোনও তাড়া নেই। ঘড়ি হল দাসত্ব। সময়ের দাস হয়ে সব সময় বাঁচতে ইচ্ছে করে না। মানুষ কেন সময়ের হিসেব রাখবে! সময়ই মানুষের হিসেব রাখুক। ম্যানফ্রেড বলছেন, “সবই তো হল, আগুন জ্বলল কই! কখন হবে আলু কি কাবাব!”

খড়ক সিং ভাবে আছেন। মানুষটার মাঝে-মাঝেই এমন হয়। দেহ একখানে, মন আর-একখানে। আজকের পৃথিবীটা যেন ঝলমলে রুপোর পৃথিবী। গাছপালা যেন জড়োয়ার গয়না পরে বসে আছে। মাঝে-মাঝে পাখিদেরও আচমকা ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। টিক, টিক, টিটির টিক করে ডেকেই, মায়ের ধমক খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ছে, “শুয়ে পড়। রাত এখনও অনেক বাকি।”

খড়ক সিং উদাস গলায় বললেন, “আমার তো অনেক পরিকল্পনা ছিল সায়েব, আসল কথা হল আমার ঘরে আজ কিছুই নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা হল, আমার জেব আজ একেবারে খালি।”

ম্যানফ্রেড হা-হা করে হেসে বললেন, “বহুত আচ্ছা! এমন নিমন্ত্রণ আমি জীবনে দেখিনি। তা হলে আজ আমাদের কাল্পনিক ভোজ হোক। কাগজ কলম দাও, একটা মেনু করে ফেলি। সেইটা পড়লেই আমাদের খাওয়া হয়ে যাবে।”

শিবশঙ্কর বললেন, “খড়ক সিংকে আমি চিনি, আজকের পরিচয়! আচ্ছা খড়ক, তোমার স্টকে চা আছে?”

“চা আজ সকালে শেষ হয়ে গেছে। দু চামচের মতো ছিল।”

“আচ্ছা, জল আছে?”

“জল ছিল, অনেক জল। খেতে গিয়ে দেখি, একটা ব্যাং সেই জলে চান করতে নেমেছে।”

“দুধ আছে খড়ক সিং?”

“দুধ ছিল, খাঁটি মোষের দুধ। মোটা একটা বেড়াল এসে খেয়ে গেছে।”

“তা হলে তোমার আছেটা কী?”

“মহারাজ! আমি আছি। আমার সেবা আছে। আমার মন আছে।”

ম্যানফ্রেড বললেন, “একেবারে সাচ্চা মানুষ। কোনও ঝামেলা নেই। আজ রাতটা আমরা চাঁদের আলোয় বসে গল্প করে কাটাই। প্রত্যেকে একটা করে গল্প বলবে। জীবনের অভিজ্ঞতা।” একটা মোটর গাড়ি আসার শব্দ হল। ঝকঝকে একটা গাড়ি এসে ঢুকল বাগানে। দরজা খুলে নেমে এলেন উদয়ন, উমা, জয়ের ঠাকুমা আর ধর্মা।

এগিয়ে আসতে-আসতে উদয়ন বললেন, “খাওয়াদাওয়া সব হয়ে গেছে?”

শিবশঙ্কর হাসতে-হাসতে বললেন, “কিচ্ছু না। ওসবের কোনও পাট নেই। কল্পনার গার্ডেন পার্টি। কল্পনায় খাও। তোমার যা-খুশি খেয়ে যাও। ভাবো আর খাও। কোনও সমস্যা নেই। সহজ ব্যাপার। কাবাব খাও, বিরিয়ানি খাও, ফ্রাই খাও, কাটলেট খাও।”

উদয়ন বললেন, “আমরা সেইটাই অনুমান করেছিলুম।” ধর্মার দিকে ফিরে বললেন, “সব নামা।” গাড়ির বুট খুলে ধমা সব নামাতে লাগল, ঝকঝকে পোর্সিলিনের ডিনার প্লেট, কোয়াটার ডিশ, স্যুপ বোল। বেতের বাস্কেটে নানারকম খাবারদাবার, বিশাল একটা হাঁড়ি, ডেকচি। রাতের বাতাসে যাবতীয় সুখাদ্যের গন্ধ।।

খড়ক সিং ফোঁসফোঁস করে বললেন, “পোলাওয়ের গন্ধ পাচ্ছি, শাস্ত্রীয় কায়দায় রান্না!”

উদয়ন বললেন, “আমার মায়ের তৈরি।”

“পেস্তা, বাদাম, কিশমিশ যথেষ্ট পরিমাণে পডেছে তো? চপচপে খাঁটি ঘি?”

“অবশ্যই।”

“আমার অন্তরাত্মা ঠিক এই জিনিসটাই খেতে চাইছিল। তা হলে আমি ঝাড়লণ্ঠনটা জ্বালি।”

ম্যানফ্রেড বললেন, “বাইরে খাওয়া হবে না? চাঁদের আলোয়?”

খড়ক বললেন, “রাজকীয় খাওয়া রাজকীয়ভাবেই খাওয়া উচিত।”

খড়কের এক পূর্বপুরুষ খড়ককে একটা ঝাড়লণ্ঠন উপহার দিয়েছিলেন। খড়কের ঘরে সেটা ঝুলছে। খড়কের একটা দামি কাশ্মীরি কার্পেট আছে। সেইটা ঘরের মাঝখানে বিছানো হল। মাথার ওপর ঝাড়লণ্ঠন জ্বলছে। মনে হচ্ছে ছোটখাটো একটা রাজবাড়ি। একটু নাচগান হলেই ব্যাপারটা সম্পূর্ণ হয়।

খড়ক বললেন, “একটু নাচগান হোক। আচ্ছা, আমরা এতজন রয়েছি, আজ কি কারও জন্মদিন নেই!”

ম্যানফ্রেড বললেন, “সেই কাজটা আমি করেছি সিংজি। আমি আজ জন্মেছিলুম।”

খড়ক হইহই করে বললেন, “তা হলে, আজ সায়েবের জন্মদিন। হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। একটা উপহার তো দেওয়া উচিত!”

খড়ক তাঁর সিন্দুকের দিকে এগিয়ে গেলেন। ডালাটা খুলে ফেললেন। খুঁজে-খুঁজে বের করলেন জরির কাজ করা একটা যোধপুরি আচকান। মাপে বেশ বড়ই। আচকানটা ম্যানফ্রেডকে পরিয়ে দিয়ে বললেন, “কেয়া বাত! সবাই হাততালি দিন।”

ফটাফট হাততালি। প্রশ্ন হল, কে নাচতে পারে, কে গাইতে পারে। শিরিন নাচতে পারে, জয়া গাইতে পারে। আসর জমে গেল। ম্যানফ্রেডের মাউথ অর্গান, জয়ার গান, শিরিনের নাচ। তবলার অভাবে শিবশঙ্কর একটা খালি টিনের কৌটোয় বোল তুলতে লাগলেন।

উদয়ন এক সময় বললেন, “আর না, খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। ঠাণ্ডা হলে আর খেতে ভাল লাগবে না।”

রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা। খাওয়াদাওয়া শেষ হয়ে গেল। ম্যানফ্রেড বললেন, “জীবনে আমার এমন জন্মদিন হয়নি। বহুকাল মনে থাকবে। ভারতবর্ষ এক অদ্ভুত দেশ। এত ভালবাসা কোনও দেশে নেই। তাই তো আমি বারেবারে আসি। আমি তো একেবারেই একা। আমার কেউ নেই। আমি, আমার মোটর সাইকেল, আর আমার পথ। এখানে এসে দেখছি, আমার কত আপনজন!”

শিবশঙ্কর বললেন, “বাকি জীবনটা তুমি এখানেই কাটাও না, আমাদের সঙ্গে। অনেক তো ঘুরলে, অনেক তো দেখলে, অনেক রোজগারও করলে, আর কী হবে! একটা সময় সব কিছু ছাড়ার অভ্যাস করতে হয়। প্রথমে ধরবে তারপর ছাড়বে, এইটাই তো হল সুখে থাকার মন্ত্র। আমাদের ভারত তো সেই শিক্ষাই দিয়েছে। শেষটায় বাণপ্রস্ত।”

ম্যানফ্রেড বললেন, “আমার মাথাতেও সেইরকম একটা চিন্তা আসছে শঙ্কর! এই ছেলেমেয়ে তিনটেকে যদি ভালভাবে মানুষ করে দিতে পারি। জয় এঞ্জিনিয়ার, জয়া ডাক্তার, শিরিন বোটানিস্ট! ওদের সাফল্য দেখতে-দেখতে একসময় আমি ঘুমিয়ে পড়ব! ওই সরলা নদীর ধারে আমার সমাধি হবে। সেখানে একটা শিউলিগাছ? আমি শুরতেই যেতে চাই। আকাশে তখন পালতোলা মেঘের নৌকো। ফুসফুস করে শিউলি ঝরবে আমার সমাধিতে। হুইসপারিং ফ্লাওয়ার। আমার বুকে পড়বে, ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করবে, “ম্যানফ্রেড! আর ইউ স্লিপিং!”

খড়ক বললেন, “জন্মদিনে মৃত্যুর কথা আসছে কেন?”

শিবশঙ্কর বললেন, “সেইটাই তো স্বাভাবিক! অঙ্ক কি বলে জানো? জন্মদিন মানে মৃত্যুর দিকে একটা বছর এগিয়ে যাওয়া। মনে করো তোমার ব্যাগে অনেক টাকা আছে, রোজ তুমি একটা করে খরচ করছ। একদিন দেখলে, তোমার ব্যাগ খালি! দিন হল সেই টাকা! মানুষ হল দিনের ঝোলা। জগমে দো দিনকা মেলা।”

ম্যানফ্রেড বললেন, “চিনদেশে ওইজন্যেই বলে, জন্ম মানেই মৃত্যু। একটা শিশু জন্মাল, তারপর এক ঘণ্টা, দু ঘণ্টা, তিন ঘণ্টা, মানে সে মৃত্যুর দিকে এক ঘণ্টা, দু ঘণ্টা, তিন ঘণ্টা এগোল, মানে মৃত্যুর ঘড়ি চালু হয়ে গেল।”

শিবশঙ্কর বললেন, “ঘড়ি বলে টিক টিক, ঠিক ঠিক, ঠিক ঠিক। সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়। কতদিন আগে পড়েছি! মনে নেই।”

ম্যানফ্রেড বললেন, “আঃ বাইবেলে একটা জবরদস্ত কাপলেট আছে, ইন্টারন্যাল প্যাসেজ:

Time, like an ever-rolling stream

Bears all its sons away

They fly forgotten, as a dream

Dies at the opening day

একটা নদী অনন্তকাল হু-হু করে বয়ে চলেছে, খড়কুটোর মতো জীবন ভেসে চলেছে, যে গেল সে গেল, কেউ মনে রাখবে না। সব স্বপ্ন। তারপর ইংরেজিটা কী সুন্দর, Dies at the opening day, দিনের হিসেব খোলার দিনেই দিনের মৃত্যু। ক্রেডিট না ডেবিট।”

শিবশঙ্কর জয়, জয়া, শিরিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই শোনো, ইংরেজির এই ইউজটা মনে রাখো, dies at the opening day. পরে কাজে লাগবে। ভাল ইংরেজি লিখতে হলে বাইবেলটা পড়া দরকার। মহাত্মা গান্ধীর ইংরেজিকে বলা হয় বাইবেলের মতো সুন্দর। নেহরুর ইংরেজিও সুন্দর ছিল।”

ম্যানফ্রেড বললেন, “কাল থেকে তোমাদের তিনজনকে আমি বাইবেল পড়াব। As for man, his days are as grass, as a flower of the field, so he flourisheth. মানুষের দিনগুলো সব ঘাসের মতো, ফুলের মতো ফুটতেই থাকে। লেখাপড়ার মতো সুন্দর জিনিস আর কিছু নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মশগুল হয়ে থাকা যায়। আচ্ছা জয়, আজ আমরা কে কী ভাল কাজ করেছি, তার একটা হিসেব নেওয়া যাক। তুমি কী করেছ?”

জয় একটু ভেবে বলল, “শাস্তি পাওয়ার ভয় থাকলেও আজ আমি একটা সত্যি কথা বলেছি। আমাদের স্কুলের একটা দামি ফুলদানি আমি অসাবধানে ভেঙে ফেলেছিলুম। সোজা প্রিন্সিপ্যালকে গিয়ে বলেছি। তিনি দুঃখ পেলেও আমাকে কিছু বলেননি।”

“জয়া তুমি?”

“আমি আমার টিফিন আজ একজনকে দিয়ে দিয়েছি। সে দু’দিন না খেয়ে ছিল। সে জলভরা চোখে আমাকে বলেছিল, ‘মা।’ এমন মা বলা আমি কোনওদিন শুনিনি।”

“শিরিন তুমি?”

“সকালে টাঙ্গা চাপা পড়ে একটা কুকুরের সামনের ডান পা ভেঙে গিয়েছিল, আমি কাঠের টুকরো আর ব্যান্ডেজ দিয়ে সেই পা প্লাস্টার করে দিয়েছি। সে আমাকে কামড়ায়নি। সে আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে ছিল। মুখ তুলে সে যে-ডাকে ডেকেছিল, তার মানে আমি জানি—”শিরিন তোমাকে ধন্যবাদ।তুমি আমার বোন!”

“খড়ক সিং?”

“সায়েব! জীবনের সবসেরা কাম আজ হামনে কিয়া। এই দীনের আস্তাবলে আপনাদের মতো মেহমানদের সমবেত করার উপলক্ষ হাতে পেয়েছি। দুঃখের জীবন থেকে একফালি আনন্দের সময় বের করে আনতে পেরেছি।” খড়ক সিং হাত জোড় করলেন।

সবাই একসঙ্গে বলে উঠলেন, “কেয়া বাত, কেয়া বাত।”

॥ ১১ ॥

জয় অবাক হয়ে দেখছে, চার্চের দোকানে ভাল-ভাল পোস্টার এসেছে। কাচের শো-কেসে আটকে রেখেছে। একটা পোস্টার ভীষণ ভাল লাগছে। কিছুই না, নীল জমি, বড় একটা মোমবাতি জ্বলছে। মোম গলে গড়িয়ে নেমেছে কয়েক ফোঁটা। ইংরেজিতে লেখা দুটো লাইন, যার মানে, বাতির ধর্মই হল জ্বলতে-জ্বলতে, আলো দিতে-দিতে ক্ষয়ে যাওয়া।

কাচের দরজা ঠেলে জয় দোকানে ঢুকল। দরজায় ছোট-ছোট ঘন্টা লাগানো আছে। শব্দ হল, টিং লিং। এই শব্দটা জয়ের ভীষণ ভাল লাগে। সে ভাবে, দিদির সঙ্গে বিলেত যাবে। সুন্দর একটা দেশ। ভীষণ শীত। সকালে ভীষণ কুয়াশা। সেই ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে ফগলাইট জ্বেলে দোতলা বাস আসছে, আসছে সুন্দর-সুন্দর মোটর। সুন্দর পোশাক-পরা ছেলেমেয়েরা হেঁটে যাচ্ছে অফিসে, কলেজে, স্কুলে। কারও দাঁড়াবার সময় নেই। সে-দেশে শুধু কাজ আর কাজ। লেখা, পড়া, সকলের এক চেষ্টা, জীবনে বড় হতে হবে। দাদুর মুখে এইসব দেশের গল্প শুনতে-শুনতে, জয়ের মনে হয়, সেই দেশে যেন সে চলেই গেছে। একা গেলে হবে না, দিদিকেও যেতে হবে। দিদিকে ছেড়ে সে থাকতে পারবে না। দিদি যাবে ডাক্তারি পড়তে, জয় যাবে এঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। ভাবতে ভাবতে জয় একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায়।

দোকানের যে নানকে জয় সবচেয়ে ভালবাসে, মোমের মতো মিষ্টি মুখ, তিনি বললেন, “তোমার কী চাই জয়?” মিষ্টি হাসি, ঝকঝকে দাঁত। জয় বলল, “ওই পোস্টারটা আমার ভীষণ ভাল লেগেছে, কত দাম মাদার?”.

“ওনলি ফাইভ রুপিজ, মাই সান।”

জয় থমকে গেল। তার পকেটে মাত্র দু টাকা আছে। দু টাকায় তো হবে

না। জয় বিষন্ন মুখে চলে যাচ্ছিল, নান জিজ্ঞেস করলেন, “কী হল জয়?”

“মাদার, আমার কাছে অত টাকা নেই। দু টাকা আছে।”

“তুমি নিয়ে যাও, পরে টাকা পাঠিয়ে দিয়ো।”

“না মাদার, মা রাগ করবেন। আমি টাকা এনে নিয়ে যাব।”

নান বললেন, “দ্যাটস ভেরি গুড। তোমার বিচার-বুদ্ধির প্রশংসা করি। এর জন্যে তোমাকে একটা পুরস্কার দিতে চাই। হিয়ার ইজ এ ডট পেন ফর ইউ। সি হাউ নাইস। ডিপ ব্লু।”।

জয় জিনিসটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখল। গভীর নীল রং। ছোট্ট-ছোট্ট সাদা অক্ষরে লেখা, গড়্স ডিসাইপ্ল। খুব লোভ হল জয়ের। পকেটে রাখতে যাচ্ছিল, হঠাৎ কী মনে হল, ঝকঝকে মেহগিনি কাঠের কাউন্টারে কলমটা নামিয়ে রাখল।

নান জিজ্ঞেস করলেন, “হোয়াট ইজ দ্যাট জয়? হোয়াট ইজ ইয়োর থট!”

“মাদার, এক্সকিউজ মি, একটাতে আমার হবে না, তাই নেব না। আমার যে তিনটে চাই। একটা আমার জন্যে, একটা আমার দিদির জন্যে, আর-একটা আমার শিরিনের জন্যে। মাদার, তিনটে কোথায় পাবেন?”

সন্ন্যাসিনী তিনটে পেন জয়ের হাতে দিয়ে বললেন, “গড ব্লেস ইউ মাই সান। এই মনটাকে ধরে রাখার চেষ্টা কোরো। পৃথিবী খুব ভাল, আবার খুব খারাপও। মানুষ যত বড় হয়, সে ততই স্বার্থপর হয়। লিভ উইথ গড!”

দোকানের ভেতরে অনেক আলমারি। কাচের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে কত কী সাজানো। প্লাস্টার অব প্যারিসের তৈরি যিশুর মূর্তি, মেরিমাতা, মালায় গাঁথা ছোট-ছোট ক্রস, সোনালি, রুপোলি। কত সুন্দর-সুন্দর গ্রিটিংস কার্ড। অন্যসব মূর্তি। ফুলের সাজি হাতে দিদির মতো একটা মেয়ে। টুপি মাথায় এক বৃদ্ধ।

জয় অবাক হয়ে দেখছে। ইয়োরোপ, আমেরিকা, ম্যানফ্রেড দাদুর দেশ জার্মানিতে তাকে যেতেই হবে। জয় এক ছুটে দোকান থেকে বেরিয়ে এল। অকারণে অনেকটা পথ ছুটে সে সেই সাঁকোটার ওপর এসে দাঁড়াল, যার তলা দিয়ে অল্প একটু জলের ধারা নিজের মনেই কথা-বলতে বলতে কোথা থেকে কোথায় চলে যায়। যেন একটা ছেলে আর মেয়ে গল্প করতে করতে কোথাও যাচ্ছে। সাঁকোর তলায় টিয়াপাখির ঝাঁক আসে। কেন আসে কে জানে! বোধ হয় চোর-চোর খেলতে। দু’ ধারে অনেক বড় মাঠ। সেই মাঠ বেয়ে ভেসে আসে দূর দেশের বাতাস।

সাঁকোর ওপর থেকে একটা নুড়ি তুলে জয় জলে ফেলল। টিপুং করে শব্দ হল। কে একজন ছিপ আর জাল নিয়ে সরলা নদীতে মাছ ধরতে যাচ্ছেন। যেতে-যেতে জয়কে বললেন, “ডাক্তারবাবুর ছেলে না?”

জয় বলল, “আজ্ঞে হ্যাঁ।”

“বাঃ, বেশ ভদ্র তো তুমি! কেমন আজ্ঞে, হ্যাঁ, বললে। আর তা হবেই বা না কেন? কোন পরিবারের ছেলে, দেখতে হবে তো! তা তুমি এখানে একা-একা কী করছ?”

“আজ আমাদের স্কুল ছুটি তো, তাই এমনই বেড়াচ্ছি। এই জায়গাটা আমার খুব ভাল লাগে।”

“তোমার সঙ্গে দেখছি আমারও খুব মিল। আমি যখন তোমার মতো ছোট ছিলুম, তখন একা-একা এখানে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতুম।”

“এই সাঁকোটা তখনও ছিল!”

“ছিল বইকী! মানুষ ছাড়া পৃথিবীতে অনেক কিছু অনেকদিন থাকে। ওই চার্চটা যখন তৈরি হয়েছিল, তখনই সাঁকোটা তৈরি হয়। সায়েবরা তৈরি করেছিল। সেই সায়েবের নাম ছিল ফুলার।”

“তখনও টিয়া আসত?”

“আসবে না! ঝাঁক ঝাঁক টিয়া। এই যেমন ধরো, তুমি এলে। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, আমার ছেলেবেলাটা দাঁড়িয়ে আছে। ধরো, আজ হোক কাল হোক আমি চলে যাব, তখন তুমি কিন্তু থাকবে এই সাঁকোর ওপর দাঁড়িয়ে। তারপর ধরো, অনেক বছর চলে গেল, তখন তুমি আর নেই ; কিন্তু কেউ না কেউ তো থাকবেই। এইটাই হল মজা। ভীষণ মজা।”

“আপনি মাছ ধরেন কেন?”

“আমি তো মাছ ধরি না।”

“তা হলে ছিপ নিয়ে যাচ্ছেন কোথায়?”

“হ্যাঁ, এই প্রশ্নটা করতে পারো! তা হলে শোনো, আমার অনেক বয়েস। আশি তো হবেই, তার বেশিও হতে পারে। আমি অনেক বছর চাকরি করেছি। কি চাকরি জানো? আমি রেলের এঞ্জিন চালাতুন। উঃ, সে একটা চাকরির মতো চাকরি। মাঠ, পাহাড়, নদী, জঙ্গল পেরিয়ে আমার লোহার এঞ্জিন ছুটছে। নিশুত রাত। কখনও ঘোর অন্ধকার কখনও চাঁদের আলো, ঝড়, বৃষ্টি, তুফান, চলেছে এঞ্জিন। লোকটাকে আমার ভীষণ ভাল লাগত।”

“কোন লোকটা?”

“আরে, ওই ক্যানাডিয়ান এঞ্জিন। কী একখানা চরিত্র বলো তো! কী সাহস, কী তেজ। সেই তো আমার গুরু। কোনও বাধা মানে না, এতটুকু ভয় নেই। মাঝরাতে উঠে পড়ল একটা ব্রিজে, সে কী শব্দ। গুমগুম। অনেক নীচে ঠাণ্ডা একটা নদী। পাহাড়ের পেটকাটা টানেল, ঢুকে গেল তার ভেতর। আমার খুব এঞ্জিন হতে ইচ্ছে করে। তোমার?”

“আমার ইচ্ছে করে ঘোড়া হতে।

“সেটাও মন্দ নয়, বেশ বাদামি রঙের তেজী একটা ঘোড়া। অবশ্য ঘোড়ার পিঠে একজন বীরকে চেপে বসতে হবে, যেমন ধরো বীর হামির, কি রানা প্রতাপ ! বেশ, তুমি তা হলে ঘোড়াই হও, আমি কিন্তু এঞ্জিন হব, ক্যানাডিয়ান এঞ্জিন। দাউদাউ আগুন জ্বলবে, আর আমি ছুটব বাঁশি বাজিয়ে, চারপাশ কাঁপিয়ে।”

“না, তারপর কী হল বলুন?”

“কিসের কী হল?”

“ওই যে অনেক বছর চাকরি করলেন।”

“ও হ্যাঁ, তারপর আমি বুড়ো হয়ে গেলুম। রেল কোম্পানি বলল, ভগবান দাস, গুডবাই। আমার ছুটি হয়ে গেল। তখন আমার খুব দুঃখ হল। আমার পাহাড়, আমার নদী, ওভারব্রিজ, অন্ধকার, চাঁদনি রাত, এইসব ছেড়ে আমি বাঁচব কী করে ! তখনই আমি একটা ফন্দি করে ফেললুম, এই ছিপ। মজাটা দেখেছ, সুতো আছে, ফাতনা আছে, বঁড়শি নেই, একটা লোহা বাঁধা। টোপও নেই।”

জয় অবাক হয়ে বলল, “সে আবার কী?”

“তোমাকে একটা জিনিস শিখিয়ে দিই, তোমার এই বয়েস থেকে যদি করতে পারো, তা হলে দেখবে, বড় হয়ে কী হয়ে গেছ! কেউ তোমার কিছু করতে পারবে না। যখনই সময় পাবে, চুপ করে জলের দিকে তাকিয়ে বসে থাকবে। আমি মাছ ধরার নাম করে জলে ছিপ ফেলে ফাতনার দিকে তাকিয়ে বসে থাকি,ঘন্টার পর ঘন্টা। স্রোত বয়ে যাচ্ছে, আমি তাকিয়ে আছি। চোখ দুটো ঠাণ্ডা হয়ে আসছে, ভেতরে যা কিছু শক্ত-শক্ত ছিল, যেমন ধরো রাগ, হিংসে, লোভ, সব গলে যাচ্ছে, ভেতরটা টলটল করছে। কী সুখ, কী শান্তি, আমার ছটফটানি কমে যাচ্ছে, নদী আমাকে বলছে, চলো চলো, তরতর করে চলো, কিছুই থাকবে না, থাকতে পারে না, এইটাই জগতের নিয়ম। কী, শক্ত লাগছে ?”

জয় বলল, “কই, না তো। আমার খুব ভাল লাগছে আপনাকে।”

“এই দ্যাখো, তোমার দেখছি হবে।”

“আমার দিদিরও হবে।”

“তোমার দিদি আছে, হ্যাঁ তাই তো, দেখেছি তাকে।”

“দিদি আমার চেয়েও ভাল। ফাদার নাম রেখেছেন দয়া।”

“তার তো হবেই। তোমাদের বংশটা যে ভাল। তোমার দাদু, দিদিমা, বাবা, মা। আর একটা কথা বলে যাই, মাঝে-মাঝে রাতের দিকে ফাঁকা জায়গায় কাঠকুটো জড়ো করে আগুন জ্বালাবে। লকলকে শিখার দিকে তাকিয়ে থাকবে। ভাববে, সব পুড়ে যাচ্ছে, ভেতরের সব জঞ্জাল। তিরিশটা বছর আমি এঞ্জিনের গনগনে আগুনের দিকে তাকিয়ে থেকেছি।”

জয় সাহস করে জিজ্ঞেস করল, “তাতে আপনার কী হয়েছে?”

“আমার সব ভয় চলে গেছে। সমস্ত দুশ্চিন্তা চলে গেছে, ঝড়, বৃষ্টি, রোদ, নদী, পাহাড়, জঙ্গল আমাকে কাছে টেনে নিয়েছে। আমি ভীষণ ভাল আছি। লোকে আমাকে বলে পাগল। তা বলুক, আমি তো আনন্দে আছি।”

কাঁধে ছিপ নিয়ে তিনি হনহন করে চলে গেলেন। মনেই হয় না, অত বয়স হয়েছে। জয় ভাবল, শিরিনকে ডট পেনটা দিয়ে তারপর সে বাড়ি যাবে। না, আগে শিরিনকে কেন? আগে তার দিদি। অনেকক্ষণ দিদিকে দেখেনি সে।

জয় ছুটল বাড়ির দিকে। কিছুদূর যেতেই সে দেখতে পেল ম্যানফ্রেডদাদু সেই বিশাল মোটর সাইকেল চেপে আসছেন।

“হ্যালো জয়।” তিনি গাড়িটা থামালেন। ভুটুভুট আওয়াজটা থামল না।

“কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”

“ওই সরলা নদীর ওপারে, যেখানে সবাই সারাদিন ধরে গোল্ড নাগেট খোঁজে।

তুমি যাবে?”

“আমাকে যে দাদুর অনুমতি নিতে হবে!”

“আ, দ্যাট্‌স ফাইন। তা চলো, অনুমতিটা নিয়ে আসি, তুমি আমার পেছনে উঠে বসতে পারবে? ক্লাইম্ব।”

জয় কোনওমতে উঠে বসল। মোটর সাইকেল ছুটল বাড়ির দিকে।

॥ ১২ ॥

শিবশঙ্কর তখন বাগানে কাজ করছিলেন। হাতে একটা খুরপি। খালি পা। সবুজ ঘাসের ওপর ধবধবে সাদা দুটো পা। গোলাপ গাছের অদ্ভুত স্বভাব। তার আবার গোড়ার মাটি আলগা করে দিয়ে শিকড়ে শিশির খাওয়াতে হয়। যত শিশির খাবে গাছ তত তাজা হবে। শিবশঙ্করকে সাহায্য করছে জয়া। তার হাতে একটা কোটো। সেই কৌটোয় বোনমিল, সুপার ফসফেট সব মিশিয়ে একটা সার তৈরি হয়েছে। গাছের খাদ্য! কৌটোর মধ্যে একটা চামচে আছে। জয়া মেপে-মেপে গাছদের খাবার দিচ্ছে। মা যেভাবে ছোট ছেলেদের খাওয়ায়। মাঝে-মাঝে জয়ার কপালে চুল ঝুলে পড়ছে। ওপর হাত দিয়ে চুল সরিয়ে দিচ্ছে অদ্ভুত কায়দায়। আবার সেই নিচু হচ্ছে, ঝুলে পড়ছে চোখের ওপর। শেষে বিরক্ত হয়ে দাদুকে বলছে, “কেউ যদি অবাধ্য হয় তাকে কি করা উচিত?”

শিবশঙ্কর মাটি আলগা করতে করতে বললেন, “তাকে প্রথমে ভাল কথায় বুঝিয়ে বলতে হবে, অবাধ্যতার ভবিষ্যৎ যে ভাল নয়, এ-কথা তাকে জানাতে হবে।’

“আর সে যদি মানুষ না হয়!”

“মানুষ ছাড়া আর কে অবাধ্য হবে দিদি! ওই গুণটা একমাত্র মানুষেরই আছে। বাধ্য মানুষ, অবাধ্য মানুষ—এই নিয়েই পৃথিবী।”

“অবাধ্যতা করছে আমার চুল। খালি কপালের ওপর ঝুলে পড়ছে।”

“ওটা চুলের অবাধ্যতা নয় দিদি, তোমার ম্যানেজমেন্টের অভাব। বেশ করে বাঁধতে পারোনি। আমার কাছে এসো, ঠিক করে বেঁধে দি।”

বাগানের যত গাছ, যত পাখি সেই অপূর্ব দৃশ্য দেখল, খুরপি ফেলে, হাতের মাটি ঝেড়ে শিবশঙ্কর উঠে দাঁড়ালেন। ফুটফুটে সুন্দর একটি মেয়ে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে।

শিবশঙ্কর বললেন, “চুলের আর দোষ কী! এই বয়সেই এত চুল, পিঠ ছাপিয়ে নেমে গেছে! তায় আবার এমন সুন্দর কপাল! আমি চুল হলে, আমিও ঝাঁপিয়ে-ঝাঁপিয়ে কপালে পড়তুম। দাঁড়া, আমি একটা সাঁওতালী খোঁপা বেঁধে দি’ তোর।”

“তুমি পারবে?”

“কেন পারব না?”

কয়ফার ইজ অ্যান আর্ট। কয়ফার মানে কি?”

“খোঁপা।”

“দ্যাটস রাইট। আমাদের দেশের আদিবাসীরা খোঁপার কায়দায় বিদেশীশাস্ত্রকেও হার মানিয়ে দেবে। অজন্তার গুহাচিত্র দেখেছিস?”

“দেখেছি।”

“সুন্দরীদের খোঁপা দেখেছিস, কতরকম! এইভাবে চুল বাঁধার জন্য দেহাতী গ্রাম থেকে তোকে একটা হাড়ের কাঁটা এনে দেব।”

জয়া চুপ করে দাদুর দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। একমাথা কালো কুচকুচে চুল। রোদ পড়ে চিকচিক করছে। শিবশঙ্কর মাথার ওপর তুলে একটা খোঁপা বাঁধছেন। শবরীরা যেভাবে বাঁধে।

বেঁধে দেওয়ার পর জয়া বলল, “তুমি এসব শিখলে কোথায়?”

“দেখে আর সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে। আমাদের সবচেয়ে বড় শিক্ষক দু’জন, আমাদের চোখ, আমাদের কমন সেনস। এইবার ঠিক আছে?”

“একেবারে টাইট। নো প্রব্‌লেম। এবার যখন আমাদের স্কুলে নাটক হবে, তোমাকে নিয়ে যাব, আমাদের সাজিয়ে দেবে।”

“আমাকেও একবার অভিনয় করতে দে না। সেই কবে কোনকালে কলেজে অভিনয় করেছি। সেই সময় আমার খুব নাম হয়েছিল রে!”

“তুমি করবে? সেলফিশ জায়েন্টের জায়েন্ট হবে?”

“হ্যাঁ, হব। কেন হব না!”

“মেকআপ নিলে তোমাকে খুব মানাবে। দাঁড়াও, আমাদের প্রিন্সিপ্যালের সঙ্গে কথা বলব।”

“তা হলে আমি দাড়িটা রাখতে শুরু করি।”

মোটর সাইকেলের বিপুল গর্জনে দু’জনের কথা চাপা পড়ে গেল। ম্যানফ্রেড আর জয় এসে দেখল, দাদু আর নাতনীতে অন্তরঙ্গ কথা হচ্ছে। জয়ের খুব মনখারাপ হল, এতক্ষণ সে কেন ছিল না! দিদি আর দাদি দু’জনে মিলে তাকে ছাড়াই কেমন কত কী করে ফেলল! সে বাদ পড়ে গেল! একটু অভিমান হল। সে যখন নেই, তখন দু’জনে কেন এইসব কাজে লেগে গেলেন! টিমে যখন একজন নেই তখন কি ফিল্ডে নামা উচিত হয়েছে?

জয়ের চোখ ছলছল করছে। জয়া বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা। ভাইটাকে তো চেনে। ভীষণ নরম। ভীষণ ভালবাসে সকলকে। ভোরের মিষ্টি ফুলের মতো। শিউলির মতো।

জয়া বলল, “এখন ঠেটি ফোলালে হবে কী! তুই-ই তো তেজ করে বেরিয়ে গেলি।”

“তোকে বললুম, “চল দিদি একটু ঘুরে আসি, তুই তখন কাজ দেখালি।”

“বা রে ছেলে, মা আমাকে বললেন, ঠাকুর ঘরের জোগাড় করে দিতে, দিদা পুজোয় বসবেন, সেটা কে করবে শুনি! তুই আমাকে ফেলে অমনই হনহন করে চলে গেলি। যেমন গিয়েছ, এখন বোঝো ঠেলা। আমরা কত কী করে ফেললুম।”

ম্যানফ্রেড বললেন, “দেখি, একা-একা সাঁকোর দিক থেকে আসছে, বললুম, চলে। সরলার ওপার থেকে একটা রাউন্ড মেরে আসি। বলল, দাদু আর দিদির অনুমতি ছাড়া যাবে না। গুড ট্রেনিং। “।

জয় দিদির কাছে এগিয়ে এসে বলল, “তোর জন্য সুন্দর একটা উপহার এনেছি।”

সেই নীল রঙের সুন্দর ডটপেনটা দিদির হাতে দিল। গায়ে সাদা অক্ষরে লেখা, গডস ডিসাইপল।

শিবশঙ্কর বললেন, “আমাকে দাও। আপাতত এইটাই হাড়ের কাঁটার কাজ করবে।”

ডটপেনটা জয়ার খোঁপায় গুঁজে দিলেন।

ম্যানফ্রেড বললেন, “চুলটা বেশ কায়দায় বাঁধা হয়েছে, একেবারে অন্যরকম দেখাচ্ছে।”

জয়া বলল, “দাদু করে দিয়েছেন।”

“তোমার দাদু একটা জিনিয়াস। কী না জানেন? জয়, তুমি কি যাবে? আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

“দিদি না গেলে যাব না।”

ম্যানফ্রেড বললেন, “দিদি, তুমি কি যাবে?”

“আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?”

“সরলা নদীর ওপারে একবার যাব। দেখে আসি নদী সত্যিই কোনও অজানা জায়গা থেকে সোনা বয়ে আনছে কি না!”

জয়া বলল, “দাদি, যাবে?”

“তিনজনে একটা মোটর সাইকেলে?”

ম্যানফ্রেড বললেন, “দ্যাট্‌স, নো প্রবলেম। আমার গাড়িতে ইজিলি চারজন চাপতে পারে।”

জয় বলল, “আমরা তো ঠিক-ঠিক চারজনই আঙ্ক্‌ল।”

“আর-একজন কে?”

“কেন, শিরিন! তাকে ফেলে আমরা যাই কী করে?”

“দ্যাট্‌স ট্রু, সেও তো একটা কথা।”

শিবশঙ্কর বললেন, “তোমরা তো খুব স্বার্থপর! আমাকে ফেলে রেখে এমন একটা এক্সপিডিশনে চললে! জানো কি, সরলা ইজ মাই রিভার, আমার নদী। সরলা আমাকে বড় করেছে। সরলার ধারে বসে আমি আমার জীবনের কত সমস্যার সমাধান খুঁজে পেয়েছি। সেখানে তোমরা যাচ্ছ আমাকে ফেলে রেখে! আমিও যাব !”

ম্যানফ্রেড বললেন, “তা হলে আমাদের অন্যভাবে যেতে হবে।”

“তাই যাব। আমরা মোটরে যাব। ফেরার সময় সরলায় চান করে আসব। চান করার সব সাজসরঞ্জাম নিয়ে যাব সঙ্গে করে।”

“সে তো খুব ভাল হবে। নদীতে কতকাল স্নান করিনি।”

খুশির হাওয়া খেলে গেল। ছুটিটা তা হলে খুবই জমে যাবে। বেশ বড়সড় রকমের একটা অভিযান।

জয়া বলল, ‘খাওয়াটাও যদি আমরা বাইরে করে নিই, তা হলে কেমন হয়!”

শিবশঙ্কর বললেন, “সে তো খুবই ভাল হয় , কিন্তু খাব কোথায়!”

জয়া বলল, “কাছাকাছি একটা জায়গা আছে, আমাদের একটা কাজ করতে হবে, যাওয়ার সময় বলে যেতে হবে, আমরা ক’জন খাব, কী খাব।”

“পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন তো?”

“সে দেখলেই তুমি বুঝতে পারবে।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ল গাড়ি। চালাচ্ছেন ম্যানফ্রেড, পাশে বসে আছেন শিবশঙ্কর। পেছনে বসেছে জয় আর জয়া। পথেই পড়বে শিরিনের বাড়ি। তাকে তুলে নেওয়া হবে। কিছুদূর যাওয়ার পরই দেখা গেল, চার্চের ফাদার ব্রাউন, সাদা পোশাক, কাঁধে একটা কুড়ল। গাড়িটাকে রাস্তা দেওয়ার জন্য ফাদার পাশে সরে দাঁড়ালেন। শিবশঙ্কর ম্যানফ্রেডকে বললেন, “স্টপ।” ফাদারের সামনে গাড়ি দাঁড়াল।

শিবশঙ্কর জিজ্ঞেস করলেন, “ফাদার, হোয়্যার টু?”

প্রবীণ মানুষ। ধবধবে ফরসা মুখ, চামড়ায় অল্প-অল্প ভাঁজ, চোখে সোনার ফ্রেমের গোল চশমা। রোদ পড়ে ঝলমল করছে। হাসি-হাসি মুখে বললেন, ‘টু ফরেস্ট, অন দি আদার সাইড অফ দি সরলা।”

“কাম ইন। আমরাও ওদিকে যাচ্ছি।”

ফাদার কুড়ল নিয়ে সাবধানে পেছনে বসলেন, জয়ার পাশে। সুন্দর একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। ফুল-ফলের গন্ধ। যেমন বেরোয় ঠাকুরঘরে।

শিবশঙ্কর বললেন, “ফাদার, জঙ্গলে যাচ্ছেন কেন?”

“গাছের ডাল কাটতে। আমার ওই একটা হবি, ডালপালার স্বাভাবিক ভাস্কর্যকে ফুটিয়ে তোলা। নেচার, দি গ্রেট আর্টিস্ট। আমি তার উদ্যানে এক অনুসন্ধানকারী। যখনই সময় পাই ঘুরে বেড়াই জঙ্গলে-সঙ্গলে। এ এক ভয়ঙ্কর নেশা।”

শিরিনের বাড়িতে গাড়ি থামল। শিরিন তার পোষা খরগোশের জন্য ঘাস কাটছিল। কোনওরকমে খরগোশের খাঁচায় ঘাস ঢুকিয়ে লাফাতে-লাফাতে গাড়িতে এসে উঠল। এইবার গাড়ি ছুটল সরলার দিকে।

সরলার দিকে বাঁক নিচ্ছে পথ, জয়া বলল, “সামনের বাঁ দিকের রাস্তায় আমাদের একটু ঢুকতে হবে।”

ম্যানফ্রেড গাড়ি ঢোকালেন। কাঁকুরে পথ। দু’পাশে ঘাস। সার-সার ইউক্যালিপ্‌টাস গাছ। মিষ্টি একটা বাতাস বয়ে আসছে উত্তর থেকে। পথ ক্রমশ খাড়া হতে-হতে একটা উঁচু মাঠে গিয়ে উঠল। সেখানে একটা বহুকালের বাড়ি। লোহার গেট। বড় নির্জন। মানুষ আছে বলে মনেই হয় না। অজস্র পাখি হরেক সুরে গান গায়।

॥ ১৩ ॥

সরলার তীরে এসে গাড়ি দাঁড়াল। রোদ ঝলমলে অপূর্ব একটা দিন। সোনার মোহরের মতো। শিশুগাছের ছায়ায় গাড়িটাকে রেখে সবাই নেমে এল। বড়, ছোট, মাঝারি অজস্র পাথরের ঢল নেমে গেছে। অনেকটা নীচে নদী। কুলকুল করে বহে চলেছে। নদীর ওপারে যেতে হবে। সেখানে বন। প্রথমে পাতলা, ক্রমে গভীর হতে হতে নীল পাহাড়ে গিয়ে ঠেকেছে। সে যে কত গভীর আর কত দূর, বলা সহজ নয়।

জলের কাছে দাঁড়িয়ে ছোটখাটো একটা গবেষণা চলেছে, নদীর ওপারে কীভাবে যাওয়া যায়! কত জল! মাঝখানের গভীরতা কত! জয় দেখছে পাথরের আড়ালে আড়ালে জলের আবর্তে মাছ খেলা করছে। রুপোর মতো চকচকে ছোট ছোট মাছ। শিরিন দেখছে, বড় বড় ঘাসের ডগায় ফড়িং নাচছে। জয়া দেখছে, এক ঝাঁক টিয়া শিশুগাছের মাথায় মহা গুলতানি করছে। কী একটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে ভীষণ করমচর। দাদু বলেছেন, ওদেরও নিজস্ব ভাষা আছে। বোঝার চেষ্টা করলে বোঝা যায়। দিনের পর দিন শুনতে হবে, লক্ষ করতে হবে, মনে রাখতে হবে।

জয় সেই মজার মানুষটাকে দেখতে পেল। ছিপ নিয়ে যিনি আসছিলেন সাঁকোর ওপর দিয়ে। অনেকটা ওপাশে একটা বড় পাথরের ওপর বসে আছেন জলে ছিপ ফেলে। পরিষ্কার, কাচের মতো নীলচে জল। বালির কণা সোনার মতো চিকচিক করছে।

ফাদার ব্রাউন বললেন, “আই ক্যান সল্‌ভ দ্য প্রবলেম। দেয়ার ইজ এ পয়েন্ট ফ্রম হোয়ার উই ক্যান ওয়াক আক্রশ দ্য রিভার। উত্তরে এক ফারলং হাঁটতে হবে। সেখানে নদীর ওপর অনেক বোল্ডার পড়ে আছে, তার ওপর দিয়ে ব্যালান্স করে যেতে পারলে পা ছাড়া আর কিছু ভিজবে না।”

শিবশঙ্কর বললেন, “আই নো দ্য প্লেস। তবে জায়গাটা খুব ডেঞ্জারাস। ব্যালান্সের একটু এদিক-ওদিক হলেই পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙার চান্স।”

ফাদার বললেন, “আমার অভ্যাস আছে। আমি পাথরগুলোকে ভালবাসি, পাথরগুলোও আমাকে ভালবাসে। দিস ইজ রেসিপ্রোক্যাল। আই লাভ ইউ অ্যান্ড ইউ লাভ মি।”

ম্যানফ্রেড বললেন, “পৃথিবীতে এমন কোনও কাজ নেই যা মানুষ পারে না। শঙ্কর, ইউ রিমেম্বার, মধ্যপ্রদেশের র‍্যাভাইনে আমাদের সেই অভিযান! আমরা মরেও যেতে পারতুম। মরিনি, কারণ আমরা মরতে চাই না। এই না-টাই আমাদের শক্তি। আমরা হারতে চাই না, পালাতে চাই না, দুঃখ চাই না, মৃত্যু চাই না অসুস্থ হতে চাই না।”

ফাদার ব্রাউন বললেন, “তা হলে আমাদের যাত্রা শুরু হোক। স্পটে গিয়ে পরীক্ষা হবে, কোন থিয়োরিটা ঠিক।”

নদীর তীর ধরে হাঁটা শুরু হল। পাথর আর পাথর। জায়গায় জায়গায় সামান্য সামান্য ঘাস। হরেক রকমের আগাছা। পথ কখনও ওপরে উঠছে, কখনও গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে নীচে। জয়, জয়া, শিরিন তিনজনেই খুব মজা পাচ্ছে। ঝলমলে রোদ, ফুসফুস হাওয়া, জল বয়ে যাওয়ার কুলকুল শব্দ। জুতোর তলায় পাথরের আওয়াজ। সঙ্গে তিনজন মনের মতো মানুষ। ফাদার ব্রাউন আসায় ব্যাপারটা আরও জমে গেছে। এই অঞ্চলের সবাই ফাদারকে ভীষণ ভালবাসে তাঁর অপূর্ব ব্যবহারের জন্যে। দেবতার মতো মানুষ। মুখে সব সময় একটা হাসি লেগে থাকে। অমলিন হাসি। ফাদার চলেছেন আগে আগে, পেছনে শিবশঙ্কর, মাঝে ছোটরা, সব শেষে ম্যানফ্রেড। ম্যানফ্রেডের’ হাতে একটা হান্টিং নাইফ। ম্যানফ্রেড গান গাইছেন। কয়েকটা বিশাল বিশাল গাছ আকাশের নীলে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। দ্যাখো, আরও কত বড় হতে পারি।

সবাই এসে হাজির হলেন সেই বোল্ডার পয়েন্টে। এই জায়গাটার একটা ইতিহাস আছে। বিশাল বিশাল এই পাথর এল কোথা থেকে! সিপাহি বিদ্রোহের সময় পলাতক ইংরেজ সৈন্যরা এখানে একটা ঘাঁটি গেড়েছিল, তারাই না কি নদী পারাপারের জন্যে এই পাথর সাজিয়েছিল। সেই থেকে এইভাবেই পড়ে আছে। সবাই বিশ্বাস করে এই কথা। এ ছাড়া আর কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু পাথরগুলো আনা হয়েছিল কোথা থেকে? এই প্রশ্নের উত্তর আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি।

দেখলে মনে হয় সার সার বাচ্চা হাতি এপার থেকে ওপারে চলে গেছে। জল লেগে লেগে শ্যাওলা হয়েছে। ম্যানফ্রেড দেখে শুনে বললেন, “ব্যাপারটা খুব সহজ হবে না। স্লিপ করার চান্স আছে। ফাদার বললেন, “জুতো পায়ে হবে না। খালি পায়ে যেতে হবে।”

শিবশঙ্কর বললেন, “পা হড়কালে কী হতে পারে।”

ফাদার বললেন, “কিছুই না, জলে পড়ে যেতে হবে। সামান্য চোট লাগবে, এই আর কী!”

“তা হলে পড়ে গেছি ভেবে জল ভেঙে যাওয়াই ভাল।”

ফাদার বললেন, “তা হলে দেখুন, আমি কীভাবে পার হচ্ছি! আমি কোনও কিছু ভাবব না। কেবল ভাবব, আমার আগে আগে চলেছেন প্রভু যিশু। আমি তাঁর পেছন-পেছন চলেছি। আমি বিশ্বাসে পার হব।”

ফাদার জুতো খুললেন না। ছোট্ট একটা লাফ মেরে প্রথম পাথরের ওপর উঠে পড়লেন। কাঁধে কুড়ল। তারপর যেন কিছুই নয়, টকটক করে ওপারে চলে গেলেন।

ম্যানফ্রেড বললেন, “আমার তেমন বিশ্বাস নেই, আমি আমার অহঙ্কারের হাত ধরে পার হব।” এই কথা বলে ম্যানফ্রেড পাথর থেকে পাথরে লাফাতে লাফাতে সোজা ওপারে চলে গেলেন।

জয়া জিজ্ঞেস করল, “দাদু তুমি কী করবে?”

“আমি তোমাদের সামনে একটা উদাহরণ হওয়ার জন্যে তোমাদের সামনে রেখে পার হব। আমাদের দাদু পেরেছে, এই ভাবনা ভাবতে ভাবতে আমি পেরিয়ে যাব।”

শিবশঙ্কর হাসতে হাসতে অতি সহজেই পেরিয়ে গেলেন।

জয় বলল, “দিদি, আমরা?”

“আমরা পরপর তিনজন। দাদু পেরেছেন আমাদেরও পারতে হবে।”

“যদি পড়ে যাই!”

“কখনই পড়ব না। কেন পড়ব! পড়া যায় না। সে তো লজ্জার। আমি আগে তারপর তুই, তারপর শিরিন।”

জয়া একটা হালকা প্রজাপতির মতো প্রথম পাথরের চাঁইটায় উঠে পড়ল। মসৃণ, হড়হড়ে, পিছল। কোথায় কীভাবে দাঁড়িয়ে আছে চিন্তা করলেই পড়ে যেতে হবে। জয় শিরিনের মুখের দিকে তাকাল। শিরিন বলল, “মনে নেই, খড়ক সিংয়ের বাগানের গাছে তুই কীভাবে উঠেছিলিস। আমি ভয় করব না ভাই করব, না দুবেলা মরার আগে মরব না। ওঠ, আমি ধরছি, উঠে পড়।”

জয়া হাত ধরে জয়কে তুলে নিল। শিরিন নিজেই উঠে পড়ল। তিনজনে পরপর এগোচ্ছে। পাথরের মাঝে মাঝে ফাঁক। সেই ফাঁকের ভেতর দিয়ে জল চলেছে, কবিতার মতো কথা বলতে বলতে। জলচর প্রাণী পাথরের গা বেয়ে কিছুটা উঠেই আবার জলে ঝাঁপ মারছে। আগে জয়া, মাঝে জয়, পেছনে শিরিন। শিরিন জয়কে বলছে, “একেবারে নীচের দিকে তাকাবি না, ওপারের দিকে তাকা।” জয় তাই করছে। দূরে নীল বন, ধূসর পাহাড়। দাদু আর সায়েব দু’জন। সবাই মিলে যেন ডাকছে—আয়, আয় চলে আয়, অজানাকে জানবি আয়।

নদীর মাঝখানে জল বেশ গভীর। স্রোতও বেশি, জোর বাতাস। রোদ যেন হলুদ কণায় পাউডারের মতো উড়ে যাচ্ছে। জয় আর ভয় পাচ্ছে না একটুও। তার বেশ মজা লাগছে। চারপাশ দিয়ে জল ছুটে চলেছে তরতর করে। এপার ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে, ওপার এগিয়ে আসছে ক্রমশ। মনে হচ্ছে এপারের চেয়ে ওপারটা অনেক ভাল। মাঝে মাঝে পা স্লিপ করতে চাইলেও জয় মনে দিয়ে পা দুটোকে নিয়ন্ত্রণ করছে। নদীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে নদীর দু’পাশের বাঁক যেন আরও ভাল করে দেখা যাচ্ছে। সেও এক বিস্ময়!

তারা তিনজনেই একটুও টাল না খেয়ে নদী পেরিয়ে এল। এপারটা একটু অন্ধকার অন্ধকার। বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা। অদূরেই ঘন জঙ্গল। লাখখানেক ঝিঁঝিঁ অবিরাম ঘুঙুর বাজিয়ে চলেছে। প্রকৃতির আসরে যেন হাজার নর্তকী মহারানিকে নাচ দেখাচ্ছে। একটা তিতিরের কর্কশ ডাক। শরীর হিম করে দেয় এমন অপ্রাকৃত ডাক।

ফাদার ব্রাউন বললেন, “এই ডাকের একটাই মানে, দেখতে পেয়েছে।”

ম্যানফ্রেড বললেন, “কী দেখতে পেয়েছে?”

“বাঘ। বাঘ বেরোলে সারা জঙ্গলের আবহাওয়া পালটে যায়। বাতাস পর্যন্ত থমকে যায়। কী হয় এই আশঙ্কায় সব স্তব্ধ। সাক্ষাৎ মৃত্যু। একটা প্রাণ যাবেই যাবে।”

শিবশঙ্কর বললেন, “আমাদের সঙ্গে তো কোনও অস্ত্রই নেই।”

ফাদার বললেন, “প্রয়োজনও নেই। এ বাঘ মানুষ খায় না। খুবই ভদ্র। ভয় একটাই, সাপের ভয়। সাবধানে চলাফেরা করবেন। সাপ অনেক সময় গাছের ডালে দোল খায়। মাথায় বা ঘাড়ে ছোবল মারতে পারে। অজগরও আছে।”

সব শুনে জয় ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল। জঙ্গলের মুখে দাঁড়িয়ে আছে তারা ভেতরে মাইলের পর মাইল ঘন জঙ্গল। মাথার ওপর সূর্য। টর্চ লাইটের ফোকাসের মতো সূর্য-কিরণ পাতার ফাঁকে ফাঁকে নেমেছে। জঙ্গলের ভেতরটাকে মনে হচ্ছে থিয়েটারের স্টেজ। নাটকের পরের অঙ্ক এখনই শুরু হবে।

ম্যানফ্রেড বললেন, “জঙ্গলের ভেতরে আমাদের যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। আমাদের অনুসন্ধানের বিষয় এই নদী।”

ফাদার বললেন, “বুঝেছি। সোনা। কীভাবে যে গুজবটা ছড়িয়েছে। আমি তো প্রায়ই আসি, আমার চোখে কিছু পড়েনি।”

“ওভাবে তো পড়বে না চোখে। নদীর তলা থেকে বালি তুলে ছেঁকে ছেঁকে দেখতে হবে।”

“সে তো খুব পরিশ্রমের ব্যাপার। তা ধরুন এক-আধ কণা সোনা পেলেন, তাতে কার কী লাভ!”

“লাভ একটাই, সত্যিই যদি পাওয়া যায়, তাহলে আমাদের দেখতে হবে উৎসটা কোথায়। আসছে কোথা থেকে!”

“নদী আসছে ওপর থেকে! তা হলে নদী ধরে আপনাকে আরও উত্তরে এগোতে হবে। সে পথ তো সহজ নয়। অনেকেই চেষ্টা করে পারেনি।”

“সেইটাই তো চ্যালেঞ্জ।”

ফাদার তখন বললেন, “আমি জঙ্গলে ঢুকছি। এখন আলো সবচেয়ে ভাল। এর পর ছায়া নেমে আসবে।” ফাদার হাসতে হাসতে জঙ্গলে ঢুকে গেলেন। শিবশঙ্কর বললেন, “আমরা অপেক্ষা করে থাকব। খুব দেরি করবেন না।”

ম্যানফ্রেড বললেন, “এইবার আমরা জলে নামব। ছোটরা এই কাপড়টা টান করে ধরবে, আর আমি বালি তুলে তুলে এর ওপর ফেলব। জল ঝরে যাবে, থাকবে বালি। এইবার সেই বালি ধুয়ে চেলে দেখতে হবে সোনার দানা আছে কি না! আজ যদি না-ও পাই, একদিন না একদিন পাবই।”

শিবশঙ্কর বললেন, “যদি থাকে, যদি না থাকে?”

“আমি জানি আছে। ওল্ড ডক্যুমেণ্ট্ বলছে, এখানে আছে। যে পাথরগুলো পেরিয়ে আমরা এলুম সেগুলো এখানে অকারণে ফেলা হয়নি। ফেলা হয়েছে বালি আটকাবার জন্যে।” ম্যানফ্রেড নেমে গেলেন হাঁটু জলে।

॥ ১৪ ॥

তরতর করে জল বয়ে যাচ্ছে। পায়ের তলার বালি, নুড়ি পাথর সরে-সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি! চলন্ত জমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা। ম্যানফ্রেড আর শিবশঙ্কর জল আর বালি তুলে-তুলে কাপড়ে ফেলছেন। কাপড়টা যেন চালুনি। জল পড়ে যাচ্ছে তলা দিয়ে, বালিটা থেকে যাচ্ছে। চিকচিকে বালি, ছোট-ছোট নুড়ি। জয় কেবলই ভাবছে, এই বুঝি সোনার ঢেলা উঠবে। কোথায় কী! বালি আর বালি।

জয় জিজ্ঞেস করল, “সোনা কখন উঠবে দিদি!”

শিরিন বলল, “দাঁড়া, অত সহজে সোনা উঠলে তো হয়েই গেল। ছাঁকতে-ছাঁকতে এক সময় উঠবে।”

শিবশঙ্কর বললেন, “সোনার আশা আমি করি না। আমার এই ব্যায়ামটাই বেশ লাগছে। একবার নিচু হচ্ছি, একবার সোজা হচ্ছি। কোমরের ব্যায়াম হচ্ছে। আর ভাল লাগছে এই প্রকৃতি। নদী, পাহাড়, জঙ্গল। কত ভাগ্য করলে মানুষ এমন একটা জায়গায় আসতে পারে!”

ম্যানফ্রেড বললেন, “তোমাদের দেশটা খুব সুন্দর। তোমাদের কবি লিখেছিলেন, এমন দেশটি কোথাও তুমি পাবে নাকো খুঁজে।”

হঠাৎ একটা কী উঠল। বেশ ভারী! পাথরের সঙ্গে ঠোকা লেগে ঠং করে শব্দ হল।

জয় চিৎকার করে উঠল, “সোনা, সোনা।”

সবাই ঝুঁকে পড়লেন কাপড়ের ওপর। দেখা গেল সোনা নয়, বেশ বড় একটা চাবি। চকচক করছে। বালি ছাঁকা বন্ধ হয়ে গেল। সবাই চাবিটা নিয়ে তীরে উঠে পড়লেন। চাবি এমন একটা জিনিস। চাবির সঙ্গে অনেক রহস্য জড়িয়ে থাকে। তা ছাড়া এত বড় চাবি সচরাচর দেখা যায় না। কার চাবি, কিসের চাবি!

শিরিন বলল, “চাবি যখন পাওয়া গেছে, তখন গুপ্তধনও পাওয়া যাবে।”

জয়া বলল, “আমার মনে হয়, ওই নীল পাহাড়ে গুহা আছে, সেই গুহায় বিশাল বড় একটা সিন্দুক আছে, সেই সিন্দুকের এই চাবি। সিন্দুকটা খুলতে পারলেই…।”

ম্যানফ্রেড বললেন, “কিং সলোমন মাইন। হিরে, চুনি, পান্না।”

চাবিটা পরীক্ষা করতে করতে ম্যানফ্রেড বললেন, “চাবিটা ইংল্যান্ডের তৈরি, পরিষ্কার লেখা আছে, চাবস, ইংল্যান্ড, এইট টু নাইন জিরো।”

শিবশঙ্কর চাবিটা হাতে নিলেন। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বললেন, “ইংল্যান্ডের এই কোম্পানি সিন্দুক তৈরির জন্যে বিখ্যাত। একটা কাজ করলে হয়, এই নম্বরটা জানিয়ে ওদের একটা চিঠি লিখলে, ওরা আমাদের জানিয়ে দিতে পারে, সিন্দুকটা কত সালে তৈরি হয়েছিল, কে কিনেছিল?”

ম্যানফ্রেড বললেন, “এত পুরনো রেকর্ড কি ওরা রাখবে?”

“নিশ্চয় রাখবে। চাবিটার আকার আকৃতি দেখে মনে হচ্ছে, কাস্টমস বিল্ট। কেউ না কেউ অর্ডার দিয়ে তৈরি করিয়েছিল।”

“ওরা যদি সত্যিই জানায় তা হলে কী হবে!”

“নিশ্চয় কোনও রাজা-মহারাজার নাম জানাবে। আমরা তখন এই চাবিটা নিয়ে সেই রাজদরবারে যাব।”

জয়, জয়া, শিরিন তিনজনেই একসঙ্গে বলে উঠল, “আমরাও যাব। আমরা

রাজদরবার দেখিনি।”

ম্যানফ্রেড বললেন, “ধরো, এটা যদি দুশো-আড়াইশো বছর আগের হয়! সেসব রাজা তো আর নেই। “

“তাঁদের বংশধরেরা আছেন। তাও যদি না থাকেন, ইতিহাস আছে। ইতিহাস তো লোপাট করা যাবে না।”

একটা চাবি কত কল্পনার দরজা খুলে দিতে পারে! নদী কথা বলতে-বলতে হেঁটে চলেছে, পাথরবিছানো পথ। কোন সুদূর থেকে ঠেলতে-ঠেলতে নিয়ে এসেছে বিশাল এক চাবি। চাবিটা হয়তো কোনও সিন্দুকের, এখন এটা সময়ের চাবি, এই চাবি দিয়ে খোলা যাবে শতাব্দীর দরজা। ফাদার ব্রাউন কুঠার কাঁধে বেরিয়ে এলেন গভীর জঙ্গল থেকে। হাতে কিছু বিচিত্র গঠনের ডালপালা। তিনি কাছে এসে দেখলেন, বিরাট একটা চাবি নিয়ে চলেছে গবেষণা। তিনিও যোগ দিলেন।

“ফাদার, এই চাবি সম্বন্ধে আপনি কিছু জানেন?” প্রশ্ন করলেন শিবশঙ্কর।

“একটা গল্প জানি।”

“চাবির গল্প?”

“একটা সিন্দুকের গল্প। এখানে পুরনো লোক যারা আছে, তারা সবাই জানে। সিপাইদের তাড়া খেয়ে ইংরেজরা যখন পালাচ্ছে, তখন কর্নেল ওয়াটসনের ঘোড়ার পিঠে একটা সিন্দুক চাপানো ছিল। সিন্দুক মানেই ভ্যালুয়েবক্স। লুটপাট করা যত গয়না, হিরে, জহরত। সরলা নদীর মাঝামাঝি এসে, সিপাইদের গুলি খেয়ে কর্নেলের ঘোড়া নদীতে পড়ে গেল। কর্নেল প্রাণ বাঁচাতে কোনওরকমে পালিয়ে গেলেন। জলে তলিয়ে গেল সিন্দুক।”

ম্যানফ্রেড বললেন, “সিন্দুক তলাক, চাবিটা তো কর্নেলের সঙ্গেই চলে যাওয়ার কথা। এ তো দেখছি চাবি আছে, সিন্দুকটাই নেই।”

ফাদার বললেন, “স্টোরিটা আমার শেষ হয়নি। ভারী সিন্দুক জলে পড়ে বালিতে গেঁথে রইল। কর্নেল জানতেন, জলের স্রোত যতই হোক, সিন্দুকটাকে বেশিদূর ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। আফটার থ্রি ডেজ, তিনদিন পরে, গভীর রাতে সিন্দুকের লোভে কর্নেল কেম ব্যাক। একেবারে একলা। পরিকল্পনাটা ছিল, সিন্দুকটা উদ্ধার করে, সব মালপত্র নিয়ে ইংল্যান্ডে পালাবেন। জানতেন না সিপাইরা এই সুযোগটার অপেক্ষায় থাকবে। হি ওয়াজ বুচার্ড। হ্যান্ড টু ডেথ। তারপর সেই সিন্দুকটা হয়ে গেল গল্প। কেউ বলে, সেটা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। কেউ বলে, সিন্দুকটা সিপাইদের হাতে পড়েছিল। সে যাই হোক, আজ আপনারা সেই চাবিটাই মনে হয় পেলেন। সেই সিন্দুকের তল্লাশ আজও শেষ হয়নি। মানুষ অমর না হলেও, মানুষের লোভ অমর।”।

শিবশঙ্কর বললেন, “চাবিটা আমরা কী করব? ফেলে দেব জলে?”

ফাদার বললেন, “সেটা ঠিক হবে না। ওর গায়ে প্রায় তিনশো বছরের ইতিহাস লেগে আছে। প্রিজার্ভ ইট। এমনও তো হতে পারে, এই বোল্ডারের তলায় কি ওই জঙ্গলে বা নীল পাহাড়ের কোনও গুহায় সেই সিন্দুকটা যখের ধনের মতো পড়ে আছে। আমাদের খড়ক সিং কিন্তু এখনও আশা ছাড়েনি। আপনারা চাবিটা সিংকে প্রেজেন্ট করতে পারেন। সে খুব উৎসাহ পাবে। মানুষটা জেগে স্বপ্ন দেখে।”

ম্যানফ্রেড বললেন, “খুব ভাল বলেছেন, এটা তার স্বপ্নের চাবি। সিন্দুক পাওয়া যাক না যাক এই চাবি দিয়ে সে কত স্বপ্নের সিন্দুক খুলে ফেলবে।”

চাবি-পর্ব শেষ হয়ে গেল। বেলা বেশ প্রখর হয়েছে। আর কি বালি ছাঁকা হবে? দুপুরের পাখিরা সব ডাকতে শুরু করেছে। এইসব নিয়ম প্রকৃতির। সকালে ডাকে এক জাতের পাখি, তারা গান শেষ করে চলে যাওয়ার পর বসে দুপুরের আসর। সবশেষে বসে বিকেলের আসর। তারপর রাত এসে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। তখন জঙ্গলে শুরু হয় হিংস্র পশুদের দাপাদাপি। সে আসরে গানবাজনা নেই, কেবল গর্জন আর আর্তনাদ। ধকধক করে চোখ জ্বলছে শিকারী পশুর। নিঃশব্দে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে শিকারের দিকে। প্রকৃতিতে জীবে জীবে সম্পর্ক খাদ্য-খাদকের।

শিবশঙ্কর বললেন, “আমাদের তো আবার নিমন্ত্রণ আছে। সেই সুন্দর বাড়িতে।”

“হ্যাঁ, তাই তো!” জয়ার মনে পড়ল।

সেই যে আসার পথে তারা যে বাড়িটায় গিয়েছিল। উঁচু একটা টিলার ওপর। বড়বড় গাছ চারপাশে। বিশাল একটা গেট। গেটের বাইরে মার্বেল পাথরের ফলকে আজও পড়া যায় বাড়িটার অস্পষ্ট নাম, লিলি ফোর্ট। বাড়িটা ছিল এক দয়ালু সাহেবের। সেই সাহেবের কেউ ছিল না। তিনি এক ভারতীয় মেয়েকে নিজের মেয়ের মতো মানুষ করেছিলেন। মৃত্যুর সময় বাড়ি, বিষয়-সম্পত্তি সব তাঁকেই দান করে যান। শর্ত ছিল একটাই, তুমি কোনওদিন বিয়ে করতে পারবে না। সেই মহিলার যখন বয়স হল, তখন তিনি সব দান করে গেলেন তাঁর পালিতা কন্যাকে। সেই মেয়েটি সন্ন্যাসিনীর জীবন যাপন করেন। অনাথ মেয়েদের মানুষ করেন। তারা নানারকম হাতের কাজ করে। সেইসব জিনিস বিক্রি হয়, বিদেশেও যায়। সেই মহিলার একটা কিচেন আর বেকারি আছে। খাবারদাবার উৎসবে-অনুষ্ঠানে যায়, স্কুলে লাঞ্চ-প্যাকেট, হাসপাতালে রোগীদের খাবার। এইভাবেই নারীপ্রতিষ্ঠানটি ক্রমশ বড় হচ্ছে। জয়ার সঙ্গে মহিলার খুব ভাব। সেই মহিলাকে এই তল্লাটের সবাই নিবেদিতা বলে। সেই সাহেবের ঘরসংসারের খবর জানা নেই। তিনি ছিলেন স্কটল্যান্ডের মানুষ। ভাগ্যের সন্ধানে ভারতে এসেছিলেন। তাঁর মেয়েরই হয়তো নাম ছিল লিলি। কত কী যে হয় এই পৃথিবীতে! ভগবানও বোধ হয় খবর রাখেন না।

ম্যানফ্রেড বললেন, “তা হলে তো লাঞ্চটাইম হয়ে গেছে, আমরা চান টান করে নিই।”

জয় বলল, “সোনা?”

“সোনা তো আমাদের শোনা কথা। আছে বলে মনে হয় না।”

ফাদার বললেন, “হতাশ হবেন না। থাকতেও পারে, তবে এই জায়গায় নয়, আরও ডাউন স্ট্রিমে।”

“সে তা হলে আর-একদিন হবে।”

সবাই তখন স্নানের জন্য নেমে গেলেন কোমর-জলে। পরিষ্কার টলটলে জল। নীচে শীতল স্রোত, ওপরে উষ্ণ। সে বেশ মজার অনুভূতি! তিরতির করে জল বইছে। ছোট-ছোট মাছ ঘুরপাক খাচ্ছে। মাথার ওপর ভীষণ নীল একটা আকাশ। সেই আকাশে পায়রার ঝাঁক। গাছের ফাঁকে-ফাঁকে নীল পাহাড়। বনের ভেতরে বনমোরগের কড়কড়ে ডাক।

ম্যানফ্রেড সাঁতার কাটার চেষ্টা করছেন। জল তেমন গভীর নয় বলে সুবিধে হচ্ছে না। জয় দু হাতে একটা পাথর ধরে খলবল করে পা ছুড়ছে। শিরিন আর জয়া একটা পাথরে বসে জলে পা দোলাচ্ছে। ফাদার স্নান করবেন না। তিনি ভোরে সেকাজ সেরে নিয়েছেন।

ম্যানফ্রেড জয়কে বললেন, “তোমাকে আমি সাঁতার শিখিয়ে দিয়ে যাব। একজন মানুষের সব কিছু শেখা উচিত, সাইক্লিং, ড্রাইভিং, ক্লাইম্বিং, ট্রেকিং, লাইফ সেভিং, ফাইটিং, বক্সিং। তোমাকে আমি সব শেখাব।”

এক সময় সবাই স্কুল থেকে উঠে পড়লেন। গাছের আড়ালে গিয়ে যে-যার জামাকাপড় পালটে নিলেন। এইবার ওই বোল্ডারের ওপর দিয়ে ওপারে যেতে হবে। আবার সেই ব্যালান্স। প্রথমে জয়। এবার জয়ের আর একটুও ভয় করল সে বেশ তরতর করে এগোতে লাগল। ম্যানফ্রেড তো লাফাতে-লাফাতে চলেছেন। সবার পেছনে ফাদার, কাঁধে কুঠার, হাতে ডালপালা, শিকড়বাকড়। ফাদারের আজকের শিকার।

সবাই এসে গাড়িতে উঠছেন। জয় তাকিয়ে দেখল, নদীর বাঁকে সেই লোকটি ছিপ ফেলে সেই একইভাবে বসে আছে, নদী, পাখি, বাতাস তাকে গান শোনাচ্ছে।

গাড়ি স্টার্ট নিল।

॥ ১৫ ॥

রুটি যখন বেক করা হয় তখন চারপাশের আকাশ বাতাস আমোদিত হয়ে ওঠে। এত সুন্দর একটা স্বাস্থ্যকর খিদে-খিদে গন্ধ। লিলি ফোর্টে ঢোকার মুখে সেই গন্ধটাই পাওয়া গেল। পাউরুটি তৈরি হচ্ছে। গম আর ইস্ট মিলেমিশে আগুনের উত্তাপে এই সুগন্ধ তৈরি করেছে।

বাগানের মধ্যে দিয়ে পথ চলে গেছে। দু’পাশে নানারকম মরসুমি ফুল ঝলমলে বাতাসে রঙের প্রজাপতি হয়ে আছে। ছোট-ছোট নুড়ি পাথর আলোর তীর ছুড়ছে। সিঁড়ির উঁচু ধাপে দাঁড়িয়ে আছেন নিবেদিতা। সারা মুখে মোমের মতো হাসি। তিনি বললেন, “এ লিটল লেট।”

ফাদার বললেন, “আমরা নদীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলুম। এমন একটা দিনে নদী যেন আলোর টোপর পরে নেচে চলেছে। কত তার কথা, কত তার গান! আমরা আর আসতে পারছিলাম না। “

সাদা-ধবধবে শাড়ি-পরা নিবেদিতা বললেন, “প্লিজ কাম ইন। লাঞ্চ ইজ রেডি।”

সেগুন কাঠের দরজা, ঝকঝকে পালিশ ত্রা। এত উচু যে, একটা হাতি চলে যেতে পারে। সেকালের মানুষরা মনে হয় খুব লম্বা লম্বা হতেন। অথবা তাঁদের মন ছিল খুব উচু। লম্বা একটা করিডর এপাশ থেকে ওপাশে চলে গেছে। শেষ মাথায় আলোর ইশারা। সবাই সেইদিকেই চলেছেন। শেষ মাথায় একটা চাতাল। চারপাশে রেলিং দিয়ে ঘেরা। সেইটা পেরোতেই আর-একটা ব্লক। প্রথমেই একটা হলঘর। সেই ঘরে নানা শিল্পকর্মের প্রদর্শনী। বিক্রির কাউন্টার। ম্যানফ্রেড থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। শিবশঙ্কর বললেন, “চলো, আগে লাঞ্চটা সেরে আসি। তারপর সব দেখা যাবে।”

ম্যানফ্রেড ছেলেমানুষের মতো বললেন, “কী আনন্দ হচ্ছে! ছেলেবেলার মনটা ফিরে আসছে। সেই পুতুল, পরীর গল্প, সেই আমার স্কুল, খেলার মাঠ, আমার সহপাঠীরা আমার সেইসব স্বপ্নের দিন।”

শিবশঙ্কর বললেন, “কিছুই হারায় না, সব স্মৃতিতে জমা থাকে। ব্যাঙ্কে যেমন জমা থাকে আমাদের সঞ্চয়।”

জয়া বলল, “মাদার, আমার আঁকা সেই ছবিটা?”

“সেটা বিক্রি হয়ে গেছে মা। ফরেস্ট অফিসারের স্ত্রী কিনে নিয়ে গেছেন। ছবিটা তাঁর ভীষণ পছন্দ হয়েছে।”

হল পেরিয়ে এমনই একটা বড় ঘর। সেই ঘরে একটা পিয়ানো। একসার চেয়ার। একটা দেওয়ালে একটিমাত্র ছবি, ম্যাডোনার হাসিমুখ। ম্যানফ্রেড বললেন, “একেই বলে টেস্ট। একটিমাত্র ছবি। সমস্ত ঘরটা যেন হাসছে। অন্য কেউ হলে দশ-বিশটা ছবি ঝুলিয়ে একটা ক্রাউড তৈরি করে ফেলত।”

এই ঘরটার পরেই খাবার ঘর। বেশিরভাগটাই কাচ দিয়ে ঘেরা। আলোর বন্যা বইছে। সাদা কাপড়-ঢাকা লম্বা টেবিল। চারপাশে দশ বারোটা কালো কুচকুচে চেয়ার। মেঝেটাও কালো কুচকুচে। সাদাকালোর খেলায় সকলে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। ঘরের চারকোণে চারটে ফার্ন গাছের সুদশ্য টব। একটা অ্যাকোয়ারিয়াম। হরেক রকমের মাছ ঘুরপাক খাচ্ছে। সবচেয়ে রাজকীয় গোল্ড ফিশ। রাজার মতো বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে জলাধারে। জয়ের দিদির এসব দেখা আছে। জয় আর শিরিন হাঁ হয়ে গেছে। কিছুই নয়, অথচ কত কিছু।

সবাই যার-যার চেয়ারে বসে পড়লেন। একটা কার্ডে লেখা আছে দিনের মেনু। স্যপ, ব্র্যাকেটে লেখা ডাল। ডাল স্যুপ। তারপর গরম ওভেন ফ্রেশ ব্রেড উইথ হোমমেড বাটার। স্যালাড়। বেড পিজ। ভেজিটেল আ-লা-কার্তা। স্মোকড় ফিশ। ফ্রায়েড পোট্যাটো। পুনস ইন হানি। হোমমেড আইসক্রিম।

ম্যানফ্রেড বললেন, “একেবারে ইউরোপিয়ান মেনু!”

নিবেদিতা বললেন, “আপনারা রয়েছেন, সেই কারণে এই ব্যবস্থাই করা হল। সামান্য অনুরোধ খাওয়া শুরুর আগে, জয়েন মি ইন প্রেয়ার।”

স্যুপ এসে গেল। যাঁরা পরিবেশন করছেন, তাঁদেরও পোশাক ধবধবে সাদা। চুল স্কার্ফে ঢাকা। ঠোঁটে সাদা পটি বাঁধা। চুলে স্কার্ফ বাঁধার কারণ খাবারে যাতে চুল না পড়ে। ঠোঁটে পটি বাঁধার কারণ, হঠাৎ যাতে খাবারে না থুতু পড়ে। হঠাৎ তো কেউ কথা বলে ফেলতেও পারে। স্বাস্থ্যের কারণে পটি বাঁধা। কত সাবধানতা।

নিবেদিতা হাতজোড় করে বললেন, “আজ আমরা যা খাচ্ছি, তা কিন্তু বাসী খাবার।”

শিবশঙ্কর বললেন, “সে আবার কী! গরম স্যুপ, ধোঁয়া উঠছে। বলছেন বাস

“ব্যাপারটা এইরকম, এইটা আমাদের কালকের অর্জন। কালকের ফল আমরা আজ ভোগ করছি। বর্তমানে বসে আমরা অতীতের ফল ভোগ করি। Cast thy bread upon the waters: for thou shalt find it after many days. আজ ভাসাও জলে তোমার রুটি, কারণ সেই রুটিই পরে তোমার কাছে ফিরে আসবে। প্রভু! আজ আমি যা ভোগ করছি তা আমার অতীতের কৃতকর্মের পুরস্কার।

Give us grace that we may cast away

the works of darkness, and put

upon us the armour of light.

নিন শুরু করুন।”

স্বচ্ছ নীল পাত্রে গরম সুপ, ছোট-ছোট ভাজা রুটির টুকরো ভেসে বেড়াচ্ছে। অসাধারণ তার স্বাদ। কচি কাঁচালঙ্কার গন্ধ, সামান্য লেবুর ছোঁয়া। শিরিন জয়ের কানে কানে বলল, “এইরকম একটা সুপ রোজ পেলে তিনদিনে চেহারা ফিরে যাবে। কী সুন্দর খেতে!”

এসে গেল গরম তাজা পাউরুটি। এক-একটা ফুলের মতো দেখতে। সেই সুন্দর গন্ধ। একটা দিকের রং পালিশ করা বাদামি। রুমাল দিয়ে ঝকঝকে করতে ইচ্ছে করে। এমন জিনিস কি খেতে ইচ্ছে করে! ছোট-ছোট পাত্রে নরম মাখন। মাখন মাখাবার জন্য ঝকঝকে ছোট-ছোট ছুরি।

শিবশঙ্কর বললেন, “ম্যানফ্রেড, খাওয়াটাকেও শিল্পের স্তরে নিয়ে যাওয়া যায়।”

“অবশ্যই যায়। সেইজন্যেই বলে, জীবন শিল্প। শুধু জন্মালেই হয় না, বাঁচাটাও শিখতে হয় শিবশঙ্কর। শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প, রসবোধ। ফুলের গন্ধ, চাঁদের আলো, পাখির সুর, সুন্দর গল্প, সুন্দর গান, সুন্দর সাহিত্য, সুন্দর বাড়ি, সুন্দর পরিবার, সুন্দর মানুষ, সুন্দর কথা, সুন্দর ব্যবহার, ফুলের পাপড়ির মতো জীবনের বাহার।”

ফাদার বললেন, “এর অনেকটাই আমাদের জীবনে নেই। সাধনাই জীবন। এই কথাটা আমরা সবাই ভুলে গেছি। “

সবাই মনের আনন্দে খেয়ে চলেছেন। কাচের জানালার বাইরে সবুজ, ঝাঁঝালো মধুর মতো রোদ, একঝাঁক প্রজাপতি রঙিন কাগজের মতো উড়ছে। ফিনফিনে ডানা মেলে। জয়ের মনে হচ্ছিল এই অপূর্ব জায়গায় সে যেন চিরদিন থাকতে পারে। সব কেমন সাজানো-গোছানো, সুন্দর একটা নিয়মে বাঁধা। কেমন করে মানুষ এমন সুন্দর হয়ে ওঠে! স্বপ্নকেও সত্য করে তোলে!

ম্যানফ্রেড নিবেদিতাকে বললেন, “আমার একটা প্রস্তাব আছে।”

নিবেদিতা হাসতে-হাসতে বললেন, “বলুন, কী প্রস্তাব আপনার?”

“আপনার সাধনা আমাকে মুগ্ধ করেছে। একা একজন এত সব করতে পারেন, আমি ভাবতেও পারি না। আমার ইচ্ছে করছে আপনার কাজের সঙ্গী হতে। আমার জীবনের সব সঞ্চয় আপনার সেবায় লাগাতে চাই। এটাকে আরও, আরও বড়, বিশাল বড় করতে চাই। আরও, আরও সব বিভাগ যোগ করতে চাই। হচ্ছে যখন, বেশ ভাল করেই হোক না। আপনার আপত্তি আছে? এমন প্রস্তাব নিয়ে ক’জন আসেন বলুন?”

“ আপত্তি থাকবে কেন?”

“আমি তো আপনাকে বিদেশি মুদ্রা দিয়ে সাহায্য করব, সেইরকম একটা পরিকল্পনা ভাবুন।”

“আমার ভাবাই আছে। একটা সর্বাধুনিক হাসপাতাল। মানুষ বিনা চিকিৎসায় মরছে।”

“আমিও ঠিক এই কথাটাই ভাবছিলুম।”

“আমার আর-একটা ভাবনাও আছে। সেটা আপনাকে পরে জানাব।”

“আমারও একটা পরিকল্পনা আছে।”

শিবশঙ্কর বললেন, “আমারও একটা প্ল্যান আছে। আমার ওই খেলনার কারখানাটাকে যদি আরও বড় করা যায়, তা হলে অনেকের রোজগারের ব্যবস্থা হতে পারে। এই অঞ্চলের মানুষের খুব অভাব। ম্যানফ্রেড তুমি যদি সত্যিই কিছু করো, তা হলে আমিও লেগে যেতে পারি। জীবন ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে ভাই। সারাজীবন তো নিজেদের জন্যই করা হল, এইবার অন্যের কথা ভাবার সময় এসেছে। শুনলে অবাক হবে, আমার বাবা অন্যের জন্যে ভিক্ষে করতেন। সেই টাকায় কারও চিকিৎসা হত, কারও পড়ার খরচ চলত। কারও মেয়ের বিয়ে! দু’হাতে তিনি পরের সেবা করে গেছেন। সারা জীবন ধরে তিনি আমাদের একটা কথাই বলতেন, লিভ ফর আদার্স। একানে ঢুকে ওকান দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আমরা শুনেও শুনিনি।”

শিবশঙ্কর দুঃখ-দুঃখ মুখ করে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। নিবেদিতা বললেন, “ আপনার সব কথা আমরা জানি। আপনার আর আপনার ছেলের মতো মানুষ এই তল্লাটে আর ক’জন আছেন? আপনার স্ত্রী তো দেবীর মতো। আপনার নাতি-নাতনিও সেইভাবেই বড় হচ্ছে। জয়া তো এই বয়সেই আমার ডান হাত। জয়া কী বলেছে জানেন, ও বিয়ে করবে না, আমার সঙ্গে কাজ করবে, বড় হয়ে লেখাপড়া শিখে এখানে চলে আসবে।”

সবাই বাগানে বেরিয়ে এলেন। ফাদার বললেন, “তোমার এই বাগানে আমার একটা হাতের কাজ রেখে যাই। কিছুই না, আমার এই ডালপালার শিল্প।”

নিবেদিতা বললেন, “সে তো আমার মহা-সৌভাগ্য। ফাদার, আপনার জীবন থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। ফাদার ইউ আর গ্রেট। ক্রাইস্টের জীবন আপনিই ঠিক-ঠিক নিতে পেরেছেন। আমরা পারিনি। আমাদের অহঙ্কার আছে। আমরা এখানেও অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছি। গ্ৰোপিং ইন দি ডার্ক। আমরা এখনও সকলের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাইনি।”

“তুমি একটু বেশি বলছ মেয়ে। আমি জানি, আমি কী! আমাকে সবাই পাগল বলে।”

“আপনার মতো পাগল আমরাও হতে চাই। পারি না। চেষ্টা করে কি আর পাগল হওয়া যায়?”

সবাই লনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসলেন। ফাদার বসলেন গাছের ডাল নিয়ে। একটা রূপ চেষ্টা করলেই খুঁজে পাওয়া যায়। ফাদার সেই রূপটাকেই ফুটিয়ে তুলছেন ধীরে-ধীরে। সকলের চোখ সেই দিকে। কায়দাটা হল কোনটা রাখবেন, কোনটা ছাঁটবেন! একটা করে ডাল কাটছেন, আর বসে থাকছেন কিছুক্ষণ, ধ্যানে বসে থাকার মতো। কারও কোনও কথা বলার সাহসই হচ্ছে না। যেন একটা ধ্যানের ক্লাস চলেছে। ফাদারের সাধনা ও নিমগ্নতা সকলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। বিকেল প্রায় হয়ে এল বলে! সূর্য পশ্চিমে অনেকটা ঢলে পড়েছে। নীল পাহাড়ের দিকে। পাহাড়ের মাথায় আলোর খেলা চলেছে। ছোট-ছোট গাছগুলোও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। একজোড়া কাঠঠোকরা বাগানের গাছে ঠোটের তাল ঠুকছে । জয় জয়া শিরিন, তিনজনে বসেছে পাশাপাশি। জয়া মাঝখানে আর দু’জন দু’পাশে।জয়ার একটা হাত জয়ের কাঁধে, আর-একটা হাত শিরিনের মুঠোয়। অল্প-অল্প গরম জলে স্নান করার মতো নরম রোদে বসে জয়ের শরীর আরামে যেন এলিয়ে আসছে। একপাশে দিদি, আর-একপাশে শিরিন। ম্যানফ্রেড আর শিবশঙ্কর পাশাপাশি। ফাদারের পাশে নিবেদিতা। ম্যানফ্রেডের নীল চোখে সমুদ্র।

ফাদার কুটকুট করে ডাল কাটছেন, আবার চুপচাপ বসে থাকছেন বেশ কিছুক্ষণ। আবার যেই খুঁজে পাচ্ছেন পথ, হাত চলছে দ্রুত। কোনওদিকে খেয়াল নেই। পিঠ বেয়ে কাঠপিঁপড়ে উঠছে ঘাড়ের দিকে। নিবেদিতা সাবধানে সরিয়ে দিচ্ছেন, আলতো আঙুলে। কী একটা হতে চলেছে, কেউই বুঝতে পারছেন না। ম্যানফ্রেড আধশোয়া হয়ে আছেন।

ফাদার শেষ একটা ডাল কুট করে কাটামাত্রই পরিপূর্ণ রূপ। তিনজন পাশাপাশি বসে আছে। তিনটি কিশোর। ফাদার শরীরের টানটান ভাব আলগা করে বললেন, “যা চেয়েছিলাম তাই হল—জয়, জয়া, শিরিন। বসে রইল এই বাগানে।”

পাঁচিলের ওপারে জেগে উঠল বিশাল এক জরির পাগড়ি, একটা লাঠির অংশ, ডগায় ঝুলছে পুঁটলি। তিনটেই এগোচ্ছে।

॥ ১৬ ॥

খড়ক সিং। শিরিন বলল, “নাচতে নাচতে কোথায় আবার চললেন আমাদের সিংজি?” শিবশঙ্কর ছুটে গেলেন পাঁচিলের দিকে, “খড়ক সিং, খড়ক সিং।”

পাগড়ি, লাঠির ডগা, পুটলি প্রথমে স্থির হল। কিছু পরেই পাঁচিলের মাথার ওপর জেগে উঠল পরিচিত সেই মুখ। বহু দেশ ঘুরেছে এই মুখ। রোদ মেখেছে, বরফে শীতল হয়েছে, বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে। মুখের ভাঁজে-ভাঁজে, খাঁজে-খাঁজে যেন সেইসব অভিজ্ঞতার কথা লেখা রয়েছে। চোখ দুটো হয়ে গেছে আকাশের মতো।

জয়কে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, তুমি বড় হয়ে কী হবে! যেমন সবাই জিজ্ঞেস করে, হোয়াট ইজ ইয়োর অ্যাম্বিশান! জয় একটুও চিন্তা না করেই বলবে, আমি খড়ক সিং হতে চাই। ফুটছয়েক লম্বা ছিপছিপে একজন মানুষ। লোহার মতো শরীর। ছুরির মতো ধারালো মুখ। দেশে-দেশে যে নেচে বেড়ায়। সবাই যার বন্ধু।।

খড়ক সিং গেট ঠেলে বাগানে এসে ঢুকলেন। সব্বাইকে এক জায়গায় দেখে তাঁর কী আনন্দ!

জয়া বলল, “তুমি আমাদের ফেলে রেখে আবার কোথায় চললে?”

খড়ক সিং লাঠি, পুঁটলি নামিয়ে ঘাসের ওপর প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে বললেন, “আমার দানাপানি ফুরিয়ে গেছে দিদি। আমার ফুসফুসে আর বাতাস নেই। আমার লণ্ঠনে আর তেল নেই। বলার মতো আমার আর কোনও গল্প নেই। এখন আমি আমার তালুকে খাজনা তুলতে যাচ্ছি।”

এইসব কথার অন্য মানে। জয়া তা জানে। হেঁয়ালি। দানাপানি মানে চোখ অনেক দিন একই দৃশ্য দেখছে। মনের খোরাক শেষ হয়ে গেছে। নতুন-নতুন দেশ, নতুন-নতুন দৃশ্য না দেখলে খড়ক সিংয়ের প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে। মন মরুভূমি হয়ে যায়। লণ্ঠনে আর তেল নেই মানে, সেইসব মানুষের সঙ্গে অনেক দিন দেখা হয়নি যাঁরা আশা জাগাতে পারেন, বাঁচার উৎসাহ দিতে পারেন, এমন কথা বলতে পারেন যা শুনলে ভেতরের আলো জ্বলে উঠে চারপাশ আলোকিত করে। তালুক আবার কী! খড়ক সিং কি জমিদার নাকি! গোটা পৃথিবীটাই তাঁর জমিদারি। খড়ক সিং যখন যেখানেই যান সেইটাই তাঁর নিজের হয়ে যায়। সবাই আত্মীয়, সবাই আপনার লোক।।

শিবশঙ্কর বললেন, “কোনও ননাটিস না দিয়ে আমাদের এইভাবে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছ যে বড়!”

খড়ক বিষন্ন মুখে বললেন, “কত দিন দেখিনি যে!”

“কাকে দেখনি?”

“সে এক দুষ্টু মেয়ে, নেচে-নেচে চলে যায় এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায় গান গাইতে গাইতে।”

শিরিন বলল, “জানি। সে এক নদী। তুমি প্রায়ই সেই নদীটার কথা বলতে। নদীটার নাম লিডার। ঠিক কি না?”

“ঠিক, ঠিক। সে এক মজার নদী। এই জল আছে, আবার এই জল নেই। চারপাশে পাহাড়। পাহাড়ের মাথায় মেঘ জমবে। কালো মেঘ। তখনই সাবধান। যেই একপশলা বৃষ্টি হল, তখনই অপেক্ষা করো। কান পেত শোনা। জলের আওয়াজ। আসছে আসছে। হঠাৎ নদী ফুলে ফেঁপে উঠল। নাচতে-নাচতে নেমে এল জল। সে কী তোড়! পাথরটাথর সব ছিটকে দিয়ে জল চলল আর-এক দেশে। সমুদ্র থেকে মেঘ, মেঘ থেকে বৃষ্টি, বৃষ্টি থেকে নদী। কেমন মজা!”

জয়া বলল, “ওই নদীতে তোমার একবার কী সাংঘাতিক কাণ্ড হয়েছিল!”

“ও হো, সেই তো আমার প্রথম পরিচয়। আমি কি ছাই জানতুম খটখটে শুকনো নদী হঠাৎ ফুলেফেঁপে উঠবে অমন! শুধু নুড়ি। মাঝে-মাঝে, খাঁজে-খাঁজে চিকচিক জল।”

ম্যানফ্রেড বললেন, “একে বলে গর্জ। চারপাশে খাড়া পাহাড়, মাঝখান দিয়ে চলে গেছে নদীপথ।”

আবার গল্প জমে উঠল। এইবার খড়ক সিং পা মুড়ে বসেছেন। আর বোধহয় মনে নেই কোথায় যাওয়ার জন্যে লাঠি, পোঁটলা নিয়ে বেরিয়েছিলেন। ফাদার একপাশে কাত হয়ে আছেন। শিবশঙ্কর যেন ধ্যানে বসেছেন! নিবেদিতা কোলে হাত জড়ো করে বসে আছেন বালিকার মতো। খড়ক সিং গল্প বলছেন।

লিডার নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। সে এক সুন্দর দুপুর। চারপাশে বড়-বড় চির, চিনার গাছ। পাহাড়ের দেওয়াল। হিমঠাণ্ডা হাওয়া। অজস্র নুড়ি ফেলে-ফেলে নদী গেছে ডান দিক থেকে বাঁ দিকে। কোন খাঁজে একটু জল কুলুক কুলুক শব্দ করছে। ডান দিকের পাহাড়ের মাথায় ঝুলছে ঝুলকালো একটুকরো মেঘ। সেই মেঘের কোলে বকসাদা টুকরো টুকরো মেঘ। মানুষ বড় অদ্ভুত জীব। সব মানুষেরই ধারণা, এপারের চেয়ে ওপার ভাল। স্বদেশের চেয়ে বিদেশ ভাল। আমার চেয়ে তুমি ভাল। খড়কের দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হল, লিডারের ওপারটা আরও সুন্দর। আরও অনেক গাছ, ফুল, ফল, ছায়া, পাখি। তা গেলে কেমন হয়! যাওয়া তো তেমন কঠিন নয়। আমার এত বড়-বড় পা, আর ওই তো গোল-গোল নানা মাপের পাথর! একটা থেকে আর-একটায় পা ফেলে-ফেলে চলে যাব। নদীতে তো জলই নেই। যাঁহাতক ভাবা তাঁহাতক খড়ক সচল। পাথর থেকে পাথরে পা ফেলে-ফেলে ব্যালেন্স করে-করে যেই নদীর মাঝামাঝি গেছেন, ডান দিকের পাহাড়ের মাথায় গড়াম করে একটা ভয়ঙ্কর শব্দ হল। খড়ক বুঝতেই পারলেন না ব্যাপারটা কী হল। যা হল তাকে বলে মেঘ ভেঙে পড়া, ক্লাউডবার্স্ট। খড়ক এত সব জানেন নাকি! তিনি মনের আনন্দে মাঝনদীতে দাঁড়িয়ে। এপার যত দূরে ওপারও তত দূরে। হঠাৎ খড়ক দেখেন ডান দিক থেকে জল ছুটে আসছে। জলের পাঁচিল। খড়ক জানেন এর পর কী হবে! জলের তোড়ে উলটে পড়ে ভেসে চলে যাবেন। পাথরের ঠোকাঠুকিতে শরীর চুরমার। মৃত্যুভয় মানুষকে বিকল করে দেয়। খড়কের তাই হল। বাঁচার উৎসাহটাই চলে গেল। যা হয় হবে। নিজেই পাথরের মতো ভারী। দেখছেন প্রচণ্ড বেগে ফুলে-ফুলে ছুটে আসছে দুগ্ধধারার মতো জল। হঠাৎ কোনও এক শক্তির টানে খড়ক ছিটকে গিয়ে পড়লেন নদীর ওপারে, আর ঠিক সেই মুহূর্তে প্রচণ্ড গর্জনে এসে গেল জলের ধারা। সব তোলপাড় করে বইতে লাগল নদী। খড়ক চোখ বুজে ছিলেন। চোখ চেয়ে দেখলেন তিনি কার পায়ের কাছে পড়ে আছেন। ওপর দিকে তাকালেন, দীর্ঘদেহী এক সাধু। মিষ্টি হেসে বললেন, “এখনও তোমার যাওয়ার সময় হয়নি। তোমার এখনও অনেক অকাজ বাকি।”

খড়ক সেই সাধুর পেছন-পেছন এক গুহায় এসে ঢুকলেন। সাধু এক ধমক দিয়ে বললেন, “পেছন-পেছন আসছিস কেন, কী মতলব!”

খড়ক সাধাসিধে সরল মানুষ। তেমন ভয়ডরও নেই। বললেন, “সে তো আপনিই জানেন। আমাকে বাঁচালেন কেন? ধারেকাছে কোথাও তো আপনি ছিলেন না। আমি নদীর মাঝখানে, আপনি নদীর তীরে। হাত ধরে নিশ্চয় টানেননি। কায়দাটা কী করেছিলেন, সে আপনিই জানেন। তা যখন বাঁচালেন তখন শুধু হাতে ফিরব নাকি!”

সাধু বললেন, “বোস। তোর ভেতরটা একটু খুলে দিই।”

ম্যানফ্রেড জিজ্ঞেস করলেন, “খুলে দিই মানে?”

খড়ক বললেন, “জামা খোলা। আমরা সবাই একটা জামা পরে থাকি। অহঙ্কারের জামা। আমার এই নাম। আমি অমুকের ছেলে, আমার এত টাকা, ক্ষমতা, মান-সম্মান, ডাঁটের ঠেলায় অন্ধকার। সাধুজি আমার সেই জামাটা একটানে খুলে দিলেন।”

শিবশঙ্কর বললেন, “সেটা কীভাবে খুললেন?”

‘মাত্র দুটো কথায়। তুমি আছ, তুমি নেই। নেই মানে একেবারেই নেই। আর কোনওদিন ফিরবে না। তোমার ঘরবাড়ি, ঘটিবাটি সব পড়ে থাকবে। কিছুই তোমার সঙ্গে যাবে না।”

“এই কথাতেই হয়ে গেল! অমন কথা আমি লক্ষবার শুনেছি, আমার কিছুই হয়নি।”

“শুধু শুনলে তো হবে না, ধ্যান করতে হবে। আমি আছি, আমি নেই। সাধু সাতদিন আমাকে এই ধ্যান করালেন। মাঝে-মাঝে সুন্দর সব গল্প বলতেন। একটা গল্প আমার এখনও মনে আছে। আমাদের জীবনটা কেমন।”

নিবেদিতা বললেন, “গল্পটা শুনি।”

খড়ক সিং সকলের মুখের দিকে এক একবার তাকালেন, তারপর জয়াকে প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা, আমার কি এখন খিদে পেয়েছে? পেটে চোঁচাঁ শব্দ হচ্ছে।”

“কখন খেয়েছ তুমি?”

“কাল সকালে।”

“সে কী! তারপর আর খাওনি কিছু?”

“একটু গাফিলতি হয়ে গেছে দিদি, খাওয়ার কথা মনে ছিল না। এই সময়টায় কি খাওয়া যায়!”

নিবেদিতা বললেন, “ভাবনা নেই, চা এসে গেছে। আমি কেক আনতে বলছি।”

চা আর কেক এসে গেল। প্লাম কেক। খড়ক খাচ্ছেন। খাওয়ার ধরনটা ছোট ছেলের মতো। কোনও মন নেই। কোলের ওপর গুঁড়ো পড়ছে। টুকরো পড়ছে। কোনও খেয়াল নেই। চায়ের কাপে কেক ডুবিয়ে ফেলছেন। একেবারে অমনোযোগী খাইয়ে।

জয়া বলল, “একটু মন দিয়ে খাও না গো! অমন ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছ কেন?”

“আমি ফেলব কেন! কেকের যেমন স্বভাব। ভেঙে-ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। ও তুমি ভেবো না, আমি যখন শেষ করব, তখন সব তুলে তুলে খেয়ে নেব। এখন আমি মানুষ, তখন আমি মুরগি। খুঁটে-খুঁটে খেতে ভীষণ ভাল লাগে। কোনওদিন খেয়ে দেখো।”

ম্যানফ্রেড বললেন, “এইবার সেই গল্পটা হোক না।”

খড়ক সিং গল্প শুরু করলেন। এক পথিক একদিন একটা মাঠের পথ ধরে হেঁটে চলেছে। বেশ যাচ্ছে। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। হঠাৎ সামনে একটা বাঘ। পথিক অমনি উল্টো দিকে দে ছুট। চোঁ-দৌড়। বাঘ কি সহজে ছাড়ে! বাঘও ছুটছে পেছন-পেছন। পথিক একটা খাড়াই বেয়ে পাহাড় চূড়ায় উঠে পড়ল। বাঘ তখনও পেছনে। এইবার কী হবে! আর তো পালাবার জায়গা নেই। সামনে বিশাল খাদ। তখন একটা মোটা আঙুরলতা ধরে সে খাদে ঝুলে পড়ল। বাঘটা শিকারের দিকে ঝুঁকে পড়ে ফোঁস-ফোঁস করছে। লোকটি ভয়ে কাঁপছে। নীচের দিকে তাকাল। বিশাল খাদ। অনেক নীচে ওটা কী! আর-একটা বাঘ। অপেক্ষা করে আছে। হাত ফসকে কি লতা ছিঁড়ে একবার পড়লে হয়, ছিঁড়ে টুকরো করে ফেলবে। লোকটার শরীর ভয়ে হিম হয়ে এল। এইবার ভয়ের ওপর আর-এক ভয়। কোথা থেকে দুটো ইঁদুর বেরিয়ে এল, একটা সাদা আর একটা কালো। ইঁদুর দুটো লোকটির ঝুলে থাকার একমাত্র অবলম্বন সেই লতা চিবোতে শুরু করল। একটু পরেই ছিঁড়ে যাবে, আর লোকটি পড়ে যাবে কয়েক হাজার ফুট নীচে। সেখানে অপেক্ষা করে আছে আর-একটা বাঘ। হঠাৎ লোকটির নজর চলে গেল পাশে, সেখানে এক থোলো পাকা আঙুর ঝুলছে। ডান হাত বাড়িয়ে একটা আঙুর ছিঁড়ে লোকটি মুখে পুরল, আঃ, কী অপূর্ব স্বাদ!

খড়ক সিংয়ের গল্প শেষ হয়ে গেল।

“এই গল্পের অর্থ?” ম্যানফ্রেড জিজ্ঞেস করলেন।

ফাদার বললেন, “খুব গভীর অর্থ। এই হল মানুষের জীবন। আঙুরলতা হল আয়ু। সাদা ইঁদুর আর কালো ইঁদুর হল দিন আর রাত্রি। একটা করে দিন যাচ্ছে আর মানুষ একদিন করে এগিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর দিকে। সামনে মরণ, পেছনে মরণ।”

ম্যানফ্রেড বললেন, “এ আর নতুন কথা কী! অতসব ভাবতে গেলে কাজকর্ম মাথায় উঠবে। আসল কথা হল জীবনটাকে ফেলে না রেখে কাজ করে যাও। মোমবাতি জ্বলবে, আলো দেবে, গলবে। তরোয়াল খাপে থাকবে না, যুদ্ধে যাবে। কলমে কালি শুকোবে না, লিখবে। নদী স্থির থাকবে না, বয়ে যাবে! এই তো ধর্ম! জীবন নিয়ে নাকেকাঁদার তো কোনও কারণ নেই।”

“নেইই তো!” ফাদার বললেন, “তাই তো ওপরে বাঘ, নীচে বাঘ, ইঁদুর কাটছে লতা, তবু হাত বাড়িয়ে একটি আঙুর ছিঁড়ে মুখে পোরো।”

শিবশঙ্কর সেই বিশাল চাবিটা খড়কের হাতে দিলেন। খড়ক লাফিয়ে উঠলেন, “এ কী!”

॥ ১৭ ॥

চাবি! একটা চাবি দেখে খড়ক সিং এমন আশ্চর্য হয়ে গেলেন কেন?

“ব্যাপারটা কী?” জিজ্ঞেস করলেন শিবশঙ্কর।

“এই চাবিটা আমারই। আমিই নদীর জলে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলুম তিন মাস আগে।”

“আর সিন্দুকটা!”

“সেটা আছে যোধপুরে।”

“তা সিন্দুক আছে যখন, চাবিটা ফেলে দিলে কেন?”

“সিন্দুকটা কোনওদিন আমি খুলে দেখিনি, দেখতেও চাই না।”

“সে আবার কী কথা! দেখতে চাও না কেন?”

“বড়লোক হয়ে যাওয়ার ভয়ে। যদি অনেক কিছু বেরিয়ে পড়ে, তা হলে আমার বুকে একটা ধাক্কা লাগবে। আমি সঙ্গে-সঙ্গে মরে যাব।”

“বড়লোক হতে তোমার ইচ্ছে করে না?”

“একদম না। বড়লোক হলে আমি আর হাঁটতে পারব না। আমার এই পুঁটলি, লাঠি, সব চলে যাবে। আমার এই পাগড়ির রং পালটে যাবে। আমার নাগরা ছুটি পেয়ে যাবে। আমি আর হাসতে পারব না। নাচতে, গাইতে পারব না। আমাকে সবাই খাতির করবে। পেছনে অনেক লোক লেগে যাবে। আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে।”

“তোমার মতো অদ্ভুত মনের মানুষ পৃথিবীতে আর ক’জন আছে?”

“অনেক আছে, অনেক। আমার মতো বেরিয়ে পড়ুন পথে, দেখতে পাবেন তাদের। পৃথিবীটা যে কী মজার, আপনাদের ধারণা নেই বড়বাবু। আপনারা বড় হিসেব করে চলেন। চামচে দিয়ে জীবন মাপেন।”

ম্যানফ্রেড বললেন, “তা হলেও সিন্দুকটা একবার খুলে দেখা উচিত। ট্রেজার চেস্ট! তা ছাড়া চাবিটা যখন আবার ফিরে এল! চাবিটা সিন্দুকের কাছে আবার ফিরে যেতে চাইছে, তাই না!”

“আপনাদের খুব লোভ হচ্ছে, তাই না?”

“লোভ নয়, কৌতূহল। সেই রাজা-মহারাজাদের জিনিস। সোনার মুকুট, হিরে বসানো। মুক্তোর মালা, লাল রুবি, সবুজ পান্না।”

খড়ক বললেন, “আর যদি দেখা যায় কিছুই নেই, তা হলে কী হবে! সেই দুঃখ তখন সামলাব কেমন করে! তার চেয়ে আমার কিছু আছে কি নেই, না জেনেই আমি বড়লোক।”

ম্যানফ্রেড হতাশ হয়ে বললেন, “এ-লোকটা বড় গোলমেলে। একেবারেই অন্য ধরনের, আমাদের সঙ্গে মেলে না।”

শিবশঙ্কর বললেন, “সেই কারণেই তো ওকে সবাই ভালবাসে। সব সময় আনন্দে নেচে বেড়াচ্ছে। ঘরদোর, ঘটিবাটি, সুখদুঃখ, কোনও কিছুই ওকে ধরে রাখতে পারে না। আচ্ছা খড়ক! আচ্ছা, আমরা যদি সবাই মিলে, ধরো এই সামনের শীতে তোমার যোধপুরে গিয়ে সকলের সামনে সিন্দুকটা খুলি, তা হলে কেমন হয়।”

“সে হয়। তা হলে চাবিটা আপনাদের কাছেই রাখুন, আমি যাই, আমাকে সেই লিভার নদীর সাধু খুব ডাকছেন। আমি শুনে আসি। আসি আর না আসি, আপনারা যাবেন। যোধপুর প্যালেসে।”

“প্যালেসে?” শিবশঙ্কর হাঁ হয়ে গেলেন, “প্যালেসে কী করতে যাব?”

“বড়বাবু, সেইখানেই যে আমার পূর্বপুরুষ থাকতেন!”

খড়ক এমনভাবে কথাটা বললেন, যেন কিছুই নয়। পূর্বপুরুষ প্যালেসে থাকতেন, তার মানে রাজার ছেলে।

সে ফকিরের মতো পথে-পথে ঘুরছে। তাইতেই তার আনন্দ! আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ। জয়া ঠিক সেই কথাটাই গেয়ে উঠল রবীন্দ্রনাথের গানে :

আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ।

খেলে যায় রৌদ্রছায়া, বর্ষা আসে বসন্ত ॥

ফাদার আর থাকতে পারলেন না, জয়ার সঙ্গে তিনিও গলা মেলালেন। বাংলা উচ্চারণে সামান্য গোলমাল থাকলেও, বেশ ভরাট গলা, সুরও আছে। দু’জনে গাইছেন :

কারা এই সমুখ দিয়ে আসে যায় খবর নিয়ে

খুশি রই আপন মনে—বাতাস বহে সুমন্দ ॥

সন্ধে নেমে গেছে, পাতলা পেঁয়াজের খোসার মতো। গোলাপি আকাশ।

বিন্দু বিন্দু পাখির ঝাঁক দূর আকাশে। গান ভেসে যায়। এ-পৃথিবীতে যেন দুঃখ নেই, পরীক্ষা নেই, পাশ-ফেল নেই। বাতাস সত্যিই সুমন্দ বইছে। নিবেদিতাও চেষ্টা করছেন গলা মেলাবার :

 সারাদিন আঁখি মেলে দুয়ারে রব একা,

 শুভখন হঠাৎ এলে তখনি পাব দেখা।

ততখন ক্ষণে ক্ষণে হাসি গাই আপন-মনে,

 ততখন রহি রহি ভেসে আসে সুগন্ধ ॥

সন্ধ্যার আধো-অন্ধকারে সবুজ ঘাসের ওপর সাদা-সাদা চায়ের কাপ আরও সাদা দেখাচ্ছে। দিন এইবার রাতের বিছানায় একেবারেই ঘুমিয়ে পড়বে। একটা দিনের কর্মকান্ড সব শেষ হয়ে এল। এইবার সবাই ঘাসের কার্পেট ছেড়ে উঠে পড়বেন।

শিবশঙ্করের শেষ প্রশ্ন খড়ককে, ‘‘তা হলে তুমি রাজার ছেলে! এ-কথা তো আগে বলোনি!”

“আমরা তো সবাই রাজার ছেলে বড়বাবু। এ আর আলাদা করে বলার কী আছে! এই মুলুকের যিনি রাজা, যাঁর চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা, আমরা সবাই তো তাঁর সন্তান!”

“তবু তোমার ইতিহাসটা জানতে ইচ্ছে করে। তোমার পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহের কথা। একজন রাজপুত বীর তুমি। তোমার সিংহাসন ছিল, বর্ম, শিরস্ত্রাণ ছিল, তুমি যোদ্ধা, তোমার মধ্যে এত প্রেম কোথা থেকে এল! এত ত্যাগ, বৈরাগ্য!”

“সে আসে বড়বাবু! হঠাৎ এসে যায়। যেমন হঠাৎ মেঘ আসে, আসে বৃষ্টি। সেইরকম! যেমন হঠাৎ জ্বর আসে।”

ফাদার উঠে দাঁড়িয়েছেন। সাদা পোশাকে তাঁকে মনে হচ্ছে পাথরের মূর্তি।

তিনি বললেন, “গ্রেস! গড়স গ্রেস। হঠাৎ নেমে আসে। রবীন্দ্রনাথের সেই গান! তোমরা কেউ গাও না। বড় সুন্দর। আমি যে রোজ শুনি, সেই গান :

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

শুষ্ক হৃদয়লয়ে আছে দাঁড়াইয়ে

ঊর্ধ্বমুখে নরনারী ॥

না থাকে অন্ধকার, না থাকে মোহপাপ

না থাকে শোকপরিতাপ।

খড়ক সিং তাঁর লাঠি-পুঁটলি নিয়ে উঠে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে বললেন, “সে-গল্প আর-একদিন বলব। আমার একটা ঘোড়া ছিল। সেই গল্পটা এইভাবেই শুরু হবে। আজ আমি যাই।”

পড়ে রইল শূন্য বাগান। মন কেমন-করা রাতের বাতাস। পাতার শব্দ। মোটর স্টার্ট নিচ্ছে। পেছনে লাল আলো। চার্চের ঘন্টা বাজছে রাতের অন্ধকারে।

॥ ১৮ ॥

জয়কে জয়ের মাস্টারমশাই বনমালীবাবু বলেছিলেন, “বেশ টাইট করে বাঁধানো ছোট্ট একটা খাতা নিজের কাছে রাখবে, আর রোজ রাতে পড়াটড়া সব শেষ করে নিজের অভিজ্ঞতার কথা যেমন পারো সব লিখে রাখার চেষ্টা করবে। সেইসব ঘটনা, যা তোমাকে ভাবায়, চিন্তা করায়, আনন্দ দেয়।”

জয় লিখছে, সেই খাতাটায় লিখছে : আজ দিদি শিউলিতলায় বসে কাঁদছিল। আমি আড়াল থেকে দেখেছি। দিদি কেন কাঁদছিল আমাকে খুঁজে বের করতে হবে। কে দুঃখ দিয়েছে দিদিকে! দিদির চোখে জল দেখলে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। দিদি সব সময় হাসবে তাই তো আমি চাই। আমাদের বাড়ির সবাই যেন আনন্দে থাকে। গান, গল্প, বেড়ানো, বনভোজন। লেখাপড়া তো আমরা ঠিকই করছি। কেউ তো বলতে পারবে না আমরা ফাঁকিবাজ। দিদি বলছিল, কেউ এসে চলে গেলে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। ম্যানফ্রেড জেঠু গ্যাংটক চলে গেছেন কাল, তাই কি দিদি কাঁদছিল। তিনি তো পনেরো দিন পরে ফিরে আসবেন, তা হলে বোকা মেয়ের মতো কাঁদছিল কেন! মাকে আমি বলতে পারি, কিন্তু বলব না। আরও কয়েকদিন দেখব। এটা আমার আর দিদির ব্যাপার। শিরিন আমার জন্যে নীল একটা সোয়েটার বুনছে, আজ আমার মাপ নিয়েছে কাঁধের। শীত তো আসছে! শিরিনকে আমি কী দেব! আমি তো বুনতে জানি না। শিরিনকে আমার অনেক কিছু দিতে ইচ্ছে করে। আমি যখন বড় হব, চাকরি করব, তখন শিরিনকে একটা ফুলের বাগান দেব। সবুজ ঘাসে ঢাকা। শিরিন বাগান ভীষণ ভালবাসে। পাখি ভালবাসে। আমি মরিসাস থেকে পাখি এনে দেব। ফিজি থেকে এনে দেব ম্যাকাও। শিরিন আর আমার দিদিকে নিয়ে বেড়াতে যাব গ্রিসে। কবে যে আমি বড় হব! মানুষ কেন তাড়াতাড়ি বড় হয় না! এক বছরে মাত্র একবছর বয়েস বাড়ে! সার দিলে গাছ তাড়াতাড়ি বাড়ে, কী দিলে মানুষ তাড়াতাড়ি বেড়ে উঠবে। দাদুকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলুম, তিনি বলেছিলেন, শিক্ষা আর অভিজ্ঞতায় মানুষ তাড়াতাড়ি বড় হয়।

এর পর জয় আর-এক পাতায় লিখল, খড়ক সিংয়ের চাবিটা নিয়ে আমার যোধপুর যেতে ইচ্ছে করছে। আমার বন্ধু বিমলকে কথাটা বলেছি। সে বলেছে পরীক্ষার পর শীতের সময় আমরা যাব গভীর রাতে প্যালেসের রক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে আমরা ভেতরে ঢুকব। ও বলছে বটে, কাজটা তেমন সহজ হবে না। প্রাসাদ মানে বিশাল বড় একটা বাড়ি। সেই বাড়িতে কত ঘর! কোন ঘরে সেই সিন্দুক আছে আমরা জানব কেমন করে! অতই সোজা নাকি! চোরেরাই পারবে ম্যানফ্রেড জেঠু গ্যাংটক থেকে ফিরলে কথা হবে। সায়েব জেঠ আমাকে বীর হতে বলেছেন। বীর হতে গেলে তিনটে জিনিস চাই। শরীর, শিক্ষা, সাহস। আমাকে বলেছেন, ভাজাভুজি বেশি খাবে না। তেলেভাজা, আলুর চপ, ডালফুলুরির দিকে একদম তাকাবে না। ফুচকা ছোঁবে না। শীতকালে আইসক্রিম খেতে পারো, গ্রীষ্মকালে একেবারেই নয়। সব কিছু সেদ্ধ-সেদ্ধ খাবে, স্ট্রুর মতো করে। প্রচুর সবজি খাবে। দুধ না খেলেও চলবে, টক দই খাবে। ফল খাবে। আমাদের পেটে নাকি একটা বাগান আছে! ফ্লোরা, ফনা। আমাদের হজমে সাহায্য করে, রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে। টক দই খেলে সেই বাগান খুব ভাল থাকে। প্রচুর জল খেতে বলেছেন। জলই স্বাস্থ্য। বলেছেন, সূর্য ওঠার আগে বিছানা ছাড়বে। সেই বিছানার দিকে সারাদিনে আর ফিরেও তাকাবে না। আবার সেই রাতে, যখন শুতে যাবে। কী শীত, কী গ্রীষ্মে, ভোরবেলা ঠাণ্ডা জলে স্নান করবে। সাবান খুব কম মাখবে। নিজের কাজ নিজেই করে নেবে, যেমন জামাকাপড় কাচা, ইস্ত্রি করা, বিছানা করা, ঘর পরিষ্কার, বাথরুম পরিষ্কার, ঝুল ঝাড়া। রোজ এক ঘণ্টা বাগান করবে। সন্ধেবেলা সূর্যাস্তের ঠিক পরেই নির্জনে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকবে। তখন ভাববে, একটা দিন তো চলে গেল, কাজ কী হল! দিনটাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পেরেছি তো! আকাশের দিকে তাকাবে। দেখবে, উড়ে যাচ্ছে পাখির ঝাঁক। দূর থেকে দূরে। ভাববে, পৃথিবীর সীমা আছে, আকাশ কিন্তু অসীম। আকাশে কারও অধিকার নেই। মাটি কেনা যায়, বাঁধা যায়, আকাশ কেনা যায় না, পাঁচিল দিয়ে ঘেরা যায় না। আকাশের কাছে প্রার্থনা করবে, শক্তি দাও, স্বাধীনতা দাও। পবিত্রতা দাও। মন্দিরের চুড়ো, চার্চের চুড়োর দিকে তাকিয়ে থাকবে যতক্ষণ পারবে। দেখবে আস্তে-আস্তে তোমার মন বড় হচ্ছে। মন হয়ে উঠছে দেহের চেয়ে বড়। বিশাল, বিরাট। রোজ কিছু-না-কিছু ভাল কবিতা পড়বে। সকলের সঙ্গে সবসময় হেসে কথা বলবে। কখনও রাগ করবে না। রাগ খুব খারাপ জিনিস। শরীর আর মনের ক্ষতি করে। বন্ধু করবে তবে জানবে, তোমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু তুমি নিজে। জীবজন্তুর কাছ থেকেও অনেক কিছু শেখার আছে। কুকুরের কাছ থেকে নেবে বিশ্বস্ততা। গোরুর কাছ থেকে নেবে সরলতা, পাখির কাছ থেকে নেবে আনন্দ, ঘোড়ার কাছ থেকে নেবে সহিষ্ণুতা, সিংহের কাছ থেকে নেবে শৌর্য, বাঘের কাছ থেকে নেবে গতি, হরিণের কাছ থেকে চঞ্চলতা, প্রজাপতির কাছ থেকে নেবে ভারহীনতা, উইপোকার কাছ থেকে নেবে লেগে থাকার ক্ষমতা, হাতির কাছ থেকে নেবে বিশালতা।

যেসব বস্তু প্রাণহীন তারাও তোমাকে অনেক কিছু দিতে পারে। ধরো, একটা চেয়ার। যখন ঘরে কেউ নেই, চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে থাকবে। সামান্য একটা চেয়ার। তাকিয়ে থাকতে-থাকতে তোমার মনে হবে, চেয়ার হল সাধনা। তোমাকে বসে থাকা শেখায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা। টেবিল তোমাকে দেয় জ্ঞান। বন্ধ দরজা বলে, খোলো, খুলে এগিয়ে যাও। চৌকাঠ বলে, টপকে যাও। জানলা হল, আলো, বাতাস, শব্দ। এইভাবে তুমি শেখো। নিজেকে প্রস্তুত করো। দেহে নয়, মনে লম্বা হও। নির্জনতার সঙ্গে বন্ধুত্ব করো। পথে যখন চলবে, কোনওদিকে তাকাবে না। দেখারও একটা নিয়ম আছে। যেটা দেখবে সেইটাই দেখবে, অন্যটা নয়। মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলবে। যা বলবে, তা গুছিয়ে বলবে। সব সময় সত্য কথা বলবে।

জয় ডায়েরি বন্ধ করে ঘরের বাইরে এল। দুধের মতো চাঁদের আলো থইথই করছে চারপাশে। শিবশঙ্করের পড়ার ঘরে আলো জ্বলছে। দিদি দিদাকে গল্প শোনাচ্ছে। জয়া মুখে-মুখে গল্প তৈরি করতে পারে। গল্পের মুখটা ধরিয়ে দেন দিদা। এক গ্রামে এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ ছিল। দিদা আর কিছু বলবেন না, এইবার দিদি সেইটাকে টেনে-টেনে বাড়াবে। মজার খেলা দিদি এইটা খুব পারে। গল্পটাকে কোথা থেকে কোথায় যে টেনে নিয়ে যাবে, কেউ জানে না।

জয় দিদার ঘরে গিয়ে ঢুকল। বিশাল খাটে খদ্দরের রঙিন চাদর। মৃদু একটা আলো জ্বলছে। টেবিলে খোলা রয়েছে দিদার পুরু কাঁচের চশমা। ঝিনুকের মতো দেখাচ্ছে। কবিরাজি গাছগাছড়ার সুন্দর গন্ধ। দেওয়ালে সেই বড় ছবিটা, রাম, লক্ষ্মণ, সীতা। বনবাসে চলেছেন। এই ছবিটা দেখলেই জয়ের খুব মন খারাপ হয়ে যায়। রাজার ছেলে কেন বনে যাছে! সীতাকে তার দিদি বলতে ইচ্ছে করে। রাম জামাইবাবু। খাটে বেশ জমিয়ে বসে আছে দু’জনে। দিদা আর দিদি। জয় গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঠেলেঠুলে শুয়ে পড়ল দিদার পাশে। একপাশে জয়, অন্যপাশে জয়া, মাঝখানে দিদা। দিদার এক হাতে ধরা জয়ার হাত। অন্য হাতে ধরলেন জয়ের হাত। চারটে হাতই আলতো পড়ে আছে তাঁর বুকের ওপর। বালিশে মাথা। পাকা চুল ঘেরা প্রসন্ন মুখ। আধবোজা চোখ। সুন্দর একটা সুখের ছবি।

জয় জিজ্ঞেস করল, “আজ কী গল্প ধরিয়েছ দিদা?”

“এখনও ধরাইনি। তুমি ধরাও আজ।”

শুয়ে-শুয়ে জয়ের মনে হচ্ছিল, একটা সমুদ্র। সমুদ্রটা শান্ত খাটটা যেন একটা জাহাজ। তিন জনে সেই জাহাজের ডেকে ভাসছে। জয়ের মনে হল, গল্পটাকে এইভাবে ধরালে দিদি আর বেশিদূর এগোতে পারবে না। বিপদে পড়ে যাবে।

জয় বলল, “বেশ, আমিই বলছি। ভারত সাগরে একদিন রাতে দেখা গেল একটা জাহাজ এলোমেলো ভেসে চলেছে, তার ওপরের ডেকে চিত হয়ে পড়ে আছে তিনজন মানুষ।”

॥ ১৯ ॥

জয় ভেবেছিল, দিদি গল্পটা সুবিধে করতে পারবে না। দিদি সমুদ্রের কী জানে, কতটুকু জানে! একটা জাহাজ, বিশাল সমুদ্র। ওপরের ডেকে তিনটে লোক। সহজ নাকি এমন গল্প! জয়া প্রথমটায় একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল। গল্পটাকে কোথা থেকে ধরে কোন দিকে নিয়ে যাবে! রূপকথার গল্প করে ফেললে চলবে না। অরুণ-বরুণ-কিরণমালা। ওরা তিনজন বড় হয়ে বাণিজ্যে যাচ্ছিল, এমন সময় মাঝসমুদ্রে সর্বনাশা ঝড়। মাস্তুল ভেঙে গেল, পাল উড়ে গেল। জয়া জানে জয় এই গল্প বিশ্বাস করবে না। বলবে, ‘দিদি, আমি কী এখনও অতটাই ছোট আছি যে, আমাকে রূপকথার গল্প শোনাচ্ছিস!’

জয়কে সত্যি গল্প বলতে হবে, যে-গল্পে ইতিহাস আছে। জয়া শুরু করল, “স্পেনের মানুষ সমুদ্র ভালবাসে। তাদের কেউ ভীষণ ভাল নাবিক। কেউ আবার দুর্দান্ত জলদস্যু। ছেলেরা যেই বড় হয়। সাবালক হয়, স্বাস্থ্যে যখন তাদের শরীর ফেটে পড়ে। তারা আর ঘরে থাকতে পারে না! সমুদ্র তাদের ডাকে, নতুন দেশ হাতছানি দেয়। তারা ভূগোল-টুগোলের ধার ধারে না। প্রাকৃতিক দৃশ্য, মানুষজন তাদের সেইভাবে টানে না, যেমন আমাদের টানে। তারা চায় দেশজয় করতে, ধনসম্পদ লুঠ করে নিজের দেশে এনে ফেলতে। নিজের দেশকে তারা বড়লোক করবে। ভীষণ নিষ্ঠুর, তেমন দয়ামায়া নেই। রক্ত দেখলে তাদের আনন্দ হয়। এইভাবেই তারা একদিন দক্ষিণ আমেরিকা, মেক্সিকো এইসব দেশ জয় করেছিল, দখল করেছিল। সেখানে তখন প্রচুর ঐশ্বর্য। সোনা, রুপো, দামি পাথর। সে হল গিয়ে সপ্তদশ শতাব্দীর কথা। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের কিছু পরেই। সব হইহই করে আসতে লাগল নতুন দেশে। যে-দেশের নাম হল নিউ ওয়ার্ল্ড।”

জয় বলল, “দিদি, কলম্বাসের কথা আগে একটু বল।”

“কলম্বাসের পুরো নাম, ক্রিস্টোফার কলম্বাস, জাতিতে ইতালীয় ; কিন্তু স্পেনের রাজার চাকরি করতেন। ১৪৯২ সালে আবিষ্কার করেন সান সালভাদর, এখন যার নাম হয়েছে ওয়াটলিং আইল্যান্ড। ওই সময়ই আবিষ্কার করেন বাহামাস, কিউবা আর হাইতি। ১৪৯৩ থেকে ‘৯৬-এর মধ্যে আবিষ্কার করেন। গুয়াদেলপা, মন্টসেরাট, অ্যান্টিগুয়া, পুয়েরটোরিকো আর জামাইকা। ১৪৯৮ সালে কলম্বাস হাজির হলেন দক্ষিণ আমেরিকায়। এই হল কলম্বাসের কথা।”

“তুই এত সব জানলি কী করে? আমি কেন জানি না!” জয়ের অভিমান হল।

জয়া বলল, “আমি যে তোর চেয়ে বড়। ফাদার আমাকে একটা বই দিয়েছেন, সেই বইয়ে সব আছে। এতে চোখ ছলছল করার কী আছে! আমি জানলে তুইও জানবি পাগলা।”

“ফাদার যে তোকে একটা বই দিয়েছেন, সে-কথা বলিসনি কেন?”

“কী আশ্চর্য! বইটা তো আমাদের পড়ার টেবিলেই রয়েছে।”

“তুই আর আমাকে আগের মতো ভালবাসিস না দিদি! তুই আর আমাকে কিছু বলিস না। তুই একা-একা সব জায়গায় যাস। আমাকে সঙ্গে নিস না। তুই কেমন নিবেদিতাদির লিলি কোর্টে একা-একা গিয়ে ভাব জমিয়ে নিয়েছিস। ওখানে বসে তুই ছবি আঁকিস, ওদের কত কাজে সাহায্য করিস! আমাকে বলিসনি।”

এইবার জয় সত্যিই কেঁদে ফেলবে। দিদির ওপর ভয়ঙ্কর অভিমান হয়েছে। দিদি তাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, দিদি তার চেয়ে বেশি সব জেনে ফেলছে, শিখে ফেলছে। কেন, কেন? এমন কেন হবে! এই দিদিই তো একদিন বলেছিল, দেখ জয়, আমি আর তুই একই গাছের দুটো ডাল। একই পাখির দুটো ডানা।

জয়া জয়কে জড়িয়ে ধরে বললে, “বোকা ছেলে, লিলি ফোর্টে যে ছেলেদের যেতে দেয় না। যেতে দিলে তোকে আমি নিশ্চয় নিয়ে যেতুম।”

“যেখানে আমি যেতে পারব না সেখানে তুই যাস কেন?”

“আমাকে যে অনেক কিছু শিখতে হয় ভাই, যা তোকে কোনওদিন শিখতে হবে না, যেমন সেলাই, বোনা, রান্না, ফুল সাজানো, রোগীর সেবা, ইনজেকশান দেওয়া, ফ্লুইড চালানো, ঘর সাজানো।”

“এমন কোনও ওষুধ নেই দিদি, যা খেলে মেয়ে হওয়া যায়! আমরা বেশ দুই বোন হয়ে যেতুম?”

দিদা বললেন, “সে উপায় নেই রে গাধা। ছেলে হওয়াই তো ভাল। তোর দাদা, তোর বাবার মতো লম্বা-চওড়া হবি। লেখাপড়া শিখে একা-একা দেশ-বিদেশ ঘুরবি। কত মানুষ দেখবি, কত অভিজ্ঞতা হবে। দিদির বিয়ে হলে দিদি তো তোকে ছেড়ে চলে যাবে, তখন তুই কী করবি?”

জয়ের আর গল্প শুনতে ভাল লাগল না। সমুদ্র, জাহাজ, নিউ ওয়ার্ল্ড, স্পেনের নাবিক, যাক, সব ভেসে চলে যাক। জয় বিছানা থেকে ছিটকে নেমে পড়ল। ছুটে চলে গেল বাগানে। আকাশে একটা ভাঙা চাঁদ। নরম আলোয় প্রকৃতিতে যেন সেতার বাজছে রিমঝিম করে। অনেক অনেক দূরে কেউ কাঠ কাটছে। কোথায় একটা পাম্প চলছে ঘিনঘিন শব্দে। জয় রক থেকে বাগানে লাফিয়ে পড়ে শিউলি গাছের তলায় চলে গেল। এই গাছের তলায় তাদের জীবনের অনেক সুন্দর মুহূর্ত ফুলের মতো ঝরে আছে। জয় গাছ তলায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল। পাতার ফাঁকে-ফাঁকে আলোর আকাশ। ঘাসের ওপর পাতার ছায়া। সেই দিকে তাকিয়ে জয় ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। দিদি তার পাশে নেই, এ তো সে ভাবতেই পারে না। বিয়ে হয়ে গেলেই হল। দিদি বিয়ে করবে না। বিয়ে খুব বিচ্ছিরি ব্যাপার। দিদিদের নিয়ে চলে যায়। দিদি যদি বিয়ে করেও জামাইবাবু এই বাড়িতে থাকবে।

উদয়ন ঠিক এই সময়েই সরোদে ধরেছেন বাগেশ্রী। এই সুরটা শুনলেই জয় হয়ে যায় পথিক। পথ চলে গেছে দূরে, বহু দূরে নীলপাহাড়ের কোল দিয়ে। অনেক রাতের পথিক সে। খড়ক সিংয়ের মতো লাঠি-পোঁটলা নিয়ে চলেছে। পায়ে কড়া নাগরা। পাথর চুরচুর হয়ে যাওয়ার শব্দ। তারা মিটমিট করানো বাতাস। বিশাল-বিশাল দৈত্যের মতো গাছ। ডালে-ডালে বানরছানার কিচিমিচি।

ভাইয়ের খোঁজে জয়া ছুটে এসেছে। জয়া আজ শাড়ি পরেছে, ফিকে হলুদ রং। জয়া বলল, “এখানে অন্ধকারে কী করছিস? কিছু কামড়ালে কী হবে?”

“কামড়ালে কামড়াবে, তাতে তোর কী? তোর তো বিয়ে হয়ে যাবে, তুই তো জামাইবাবুর!”

“তোর মতো এমন নরম ভাইটাকে নিয়ে আমি কী করি! আমার যখন বিয়ে হবে তখন তুইও তো বড় হয়ে যাবি। বড় হয়ে গেলে তোর নিজের কত বন্ধুবান্ধব হবে, তখন আমাকে কি তোর মনে থাকবে! তুই তখন বিলেত চলে যাবি। সেই সব দিন একেবারে অন্যরকম হয়ে যাবে।”

“দেখিস, আমি তোর শ্বশুরবাড়িতে কোনওদিন যাব না। তোর বরটা অসুর। রাবণের মতো। দশটা মাথা, ডাবের মতো চোখ। বিটকেল একটা লোক। সারা শরীরে ভালুকের মতো লোম।”

“তুই দেখেছিস বুঝি?”

“এখনও দেখিনি, দেখতে চাইও না।”

“তোর তো শিরিন আছে, প্রাণের বন্ধু। আমাকে তোর আর দরকার কী?”

জয় একটু লজ্জা পেল। চাপা গলায় বললে, “ধ্যাত।”

“আজকাল আমাকে আর বলাও হয় না। কোথায় জয়, কোথায় জয়! জয় শিরিনদের বাড়িতে।”

“শিরিনের সঙ্গে আমি লেখাপড়া করি। শিরিন আমাকে পড়ায়, আমি পড়াই শিরিনকে।”

“সে তো ভালই, তা হলে আর দিদি-দিদি করছিস কেন?”

জয় ঘাসের উপর বসে পড়ল। একটু স্যাঁতসেতে। ফুলের গন্ধ। পিটিং পিটিং করে লাফিয়ে পালাল কয়েকটা পোকা। জয় জানে ওগুলো কী? ঘোড়া ফড়িং। রাতে বেরোয়। ছোট-ছোট দেখতে। কী করে সারারাত কে জানে! এই গাছতলাতেই বিশাল একটা ব্যাঙ থাকে। জয় আর জয়া তার নাম রেখেছে, কোলাভোলা। ভীষণ ভাল। বন্ধুর মতো। চুপচাপ পড়ে থাকে একপাশে। মুড়ি-লজেন্স খেতে ভালবাসে। মহাকৌতূহলী একটা ইঁদুরও আছে। সারারাত ঘুরে-ঘুরে বেড়ায় চৌকিদারের মতো।

দূর থেকে একটা সাদা মূর্তি এগিয়ে আসছেন। দিদা।

কাছে এসে বললেন, “কী, অভিমান ভেঙেছে! কাপ ভাঙে, ডিশ ভাঙে, অভিমান কি অত সহজে ভাঙে! কোথাকার জল কোথায় গড়াল, তাই না! খুব হয়েছে, এইবার সব চল। রাত প্রায় বারোটা হল। কালপুরুষ কতটা নীচে নেমে পড়েছে, দেখেছ?”

জয়ার হঠাৎ খড়ক সিংয়ের একটা কথা মনে পড়ল, “রাত না জাগলে পথিবীটাকে জানা যায় না। একটা অন্য পৃথিবী ওইসময় জেগে ওঠে। অন্যধরনের সব প্রাণী ঝোপঝাড় গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। কতরকমের বাদুড় আর প্যাঁচা। গাছেরা এইসময় অন্যরকমের শ্বাস ছাড়ে। আকাশের যত তারা সব এইসময় বেরিয়ে পড়ে মিছিল করে। চাঁদ একা-একা ভেসে পড়ে, যে-সব শব্দ দিনের পৃথিবীতে শোনা যায় না, সেই সব শব্দ শোনা যায় রাতে। খড়ক বলেছিলেন, ‘রাতে চুপ করে বসবে একপাশে। শরীরের শক্ত ভাবটা আলগা করে দেবে। ধীরে-ধীরে তলিয়ে যাবে, যে-ভাবে একটা ঢিল তলিয়ে যেতে থাকে সরোবরের জলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুনতে পাবে, কে যেন কথা বলছে তোমার ভেতরে। এই ভেতরের মানুষটাই তো বাইরের মানুষটাকে চালায়।’ খড়ক সিং নিজের মতো করে নিজের উচ্চারণে রবীন্দ্রনাথের গান গায় :

যারা কাছে আছে তারা কাছে থাক, তারা তো পারে না জানিতে—

তাহাদের চেয়ে তুমি কাছে আছ আমার হৃদয়খানিতে।

যারা কথা বলে তাহারা বলুক, আমি করিব না কারেও বিমুখ

তারা নাহি জানে ভরা আছে প্রাণ তব অকথিত বাণীতে।

নীরবে নিয়ত রয়েছ আমার নীরব হৃদয়খানিতে ॥

জয় তাকিয়েছিল জয়ার মুখের দিকে। আলোছায়ায় মুখটা যেন জ্বলজ্বল করছে। ফিকে-হলুদ শাড়ির আঁচল বাতাসে দুলছে। জয়ের সব অভিমান গলে গেল। দু’ হাতে দিদির কোমর জড়িয়ে ধরে বলল, “আজ আমি তোর কাছে শোব দিদি।”

দিদা বললেন, “তা হলে তোমার মনের সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে?”

শিবশঙ্কর পড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, “এ বাড়ির কোনও মানুষের চোখেই দেখি ঘুম নেই! এত রাতে কিসের সভা হচ্ছে এখানে?”

দিদা বললেন, “মান-অভিমানের পালা।”

“কার আবার অভিমান হল?”

“জয় সুন্দরের। বিষয়টা হল, দিদি কেন তার চেয়ে বেশি শিখে ফেলছে!”

“তাই তো! এ অতি সাঙ্ঘাতিক কথা। তুমি যাচ্ছ এগিয়ে আমি পড়ছি পিছিয়ে। তা তুমিও সমান তালে এগোও। আমার কাছে আছে খনি। আছে সোনা-হিরে-জহরত। ওরে তোরা কে নিবি আয়!”

শিবশঙ্কর দু’জনের হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এলেন। কিশোরের হাত কিশোরীর হাত। বাইরে ছিল তাই ঠাণ্ডা। দু’জনেই পবিত্র, তাই ফুলের গন্ধ। বারান্দা পেরিয়ে চলেছেন তিনজন। উদয়নের ঘর। কার্পেটে বসে তন্ময় হয়ে সরোদ বাজাচ্ছেন, এইবার ধরেছেন কেদারা। মুখের চেহারাটাই অন্যরকম হয়ে গেছে। মা উমা কুকুরের গায়ে বুরুশ দিচ্ছেন। দিনের শেষ কাজ। দিদার ঘরে ধূপ জ্বলছে। সারা বাড়িতে সেই গন্ধ।

শিবশঙ্কর এসে দাঁড়ালেন সিঁড়ির মুখে। ঘুরে-ঘুরে উঠে গেছে ওপর দিকে। এই সিঁড়িটা সাধারণত ব্যবহার করা হয় না। কেউ তেমন আসে না এদিকটায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *