শিউলি – ১

॥ ১ ॥

শরৎ এসে গেছে। নীল আকাশে সাদা মেঘের হাতি ভেসে যাচ্ছে শুঁড় তুলে। দক্ষিণের জমিতে ঝাঁকড়া একটা শিউলি গাছ। সবে ভোর হচ্ছে। আকাশ থেকে অন্ধকারের পাতলা সর সরে যাচ্ছে। দিন যে চোখ রগড়াচ্ছে। সেই পাতলা আলোয় শিউলিগাছের তলায় একটি ছেলে আর একটি মেয়ে ফুল কুড়োচ্ছে। দূরে ঝিরিঝিরি নিমগাছের ডালে একজোড়া দোয়েল খুব শিস দিচ্ছে। সবার আগে দোয়েল উঠে পড়ে। আকাশে দিনের আলোর একটা আঙুল পড়লেই হল। দোয়েল আর বিছানায় থাকতে পারে না। কাক তখনও ঘুমজড়ানো গলায় একজন আর একজনকে জিজ্ঞেস করতে থাকে, ক’টা বাজল রে! ভোর কি হল! শালিকটালিক অনেক বেলায় ওঠে। কিছু মানুষের মতো। বেড-টি না পেলে বিছানা ছাড়তে পারে না। টিয়ারা অবশ্য বেশ ভোরেই ওঠে। উঠেই আকাশে দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ে জগিং করার জন্য। ভোরবেলাটা সব পাখিরই গান সাধার সময়। গুরুর নির্দেশ, ভোরবেলা খালি পেটে একঘন্টা গলা সাধবে। সূর্যের আলোর রং বেশ মিহিদানার মতো না হলে দিনের প্রথম ফলে ঠোকর মারা চলবে না। একমাত্র ব্যক্তিক্রম চড়াইপাখি। তারা উঠেই পাঠশালায় চলে যায় নামতা পড়তে। চড়াই গান সাধে না। অঙ্কে ভাল, তাই কেবল নামতা পড়ে।

জয় এইসব খবর খুব জানে। ছেলেটির নাম জয়, মেয়েটির নাম জয়া। জয়া জয়ের চেয়ে দু’ বছরের বড়। একজোড়া ভাই, বোন। ফুলের মতো সুন্দর। জয়ের একমাথা কোঁকড়া-কোঁকড়া চুল। বাঁশির মতো নাক। জয়ার গায়ের রং পদ্মফুলের মতো। চোখ দুটো নীল সরোবরের মতো। তাদের বাবা হলেন জেলার সদর হাসপাতালের বড় ডাক্তার। মা স্কুলের প্রধানশিক্ষিকা। তারা যে-বাড়িটায় থাকে, সেটা একটা সুন্দর বাংলো। চারপাশে অনেকটা জায়গা। ইংরেজ আমলের তৈরি। ইংরেজ-ডাক্তাররা থাকতেন। সেইভাবেই তৈরি। উঁচু-উঁচু, বড়-বড় ঘর। খাওয়ার ঘর। বিশাল একটা রান্নাঘর একপাশে। ঢাকা বারান্দা দিয়ে জোড়া। দু’পাশে বড়-বড় দুটো বাথরুম। বসার ঘরে একটা ফায়ার প্লেস। সেকালে মনে হয় খুব শীত পড়ত। দক্ষিণের বারান্দায় দাঁড়ালে অনেক দূরের আকাশে একটা পাহাড় দেখা যায়। ভোরবেলা পাহাড়টার রং হয় গাঢ় নীল। দুপুরে জমাট কালো। সন্ধের আগে সোনালি হয়ে রাতের অন্ধকারে হারিয়ে যায়।

রোজ ভোরবেলা জয়া এসে জয়কে ডাকে, “ভাই, ওঠ। দ্যাখ, ভোর হচ্ছে।”

জয়া দিদিমার কাছে শোয়। জয় শোয় দাদুর কাছে। দাদু সারা বছর জানলা খুলে শোন। ঘরে যত আলো-বাতাস খেলবে তত শরীর ভাল থাকবে। সব জানলা খুলে শুলে ঠাণ্ডা লাগার ভয় থাকে না। একটা খুলে শুলে ঘর গরম-ঠাণ্ডা হয়ে সর্দি-কাশি হওয়ার ভয় আছে। দাদু বলেন, এর নাম ‘চিল’। দাদু বলেছেন, যারা খুব ভোরবেলা বিছানা ছাড়তে পারে, তারা মালিক হয়। কিসের মালিক? বিশাল বড় একটা দিনের মালিক। তাদের সূর্য দেরিতে অস্ত যায়। তার মানে? তারা অনেকদিন বাঁচে। যারা রোদ-চড়ার আগে স্নান করে নিতে পারে, তাদের কোনওদিন জ্বর হয় না। যারা ভোরবেলা শিশিরভেজা সবুজ ঘাসে পা রাখতে পারে, তারা প্রাণ পায়। প্রাণ মানে আনন্দ। আর যারা পাখির গান শোনে তারা ভগবানের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়।

জয়া যেই ডাকে, “ভাই ওঠ, দ্যাখ, ভোর হচ্ছে।”

অমনই জয় চোখ মেলে তাকায়। ওই সময়টা ঘুম পাতলাই হয়ে আসে। ইচ্ছে করলে নিজেই উঠতে পারে। দিদির মিষ্টি গলায় ‘জয়’ ডাকটার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। মাথার কাছে বড় জানলায় দক্ষিণের আকাশ। ফলসার মতো রং। সরু সুতোর মতো আলোর চুল-ফাট। ধ্যানমগ্ন সেই পাহাড়। পিপারমেন্টের মতো সিরসিরে বাতাস। দাদু বলেছেন, “ঘুম থেকে ওঠার সময় নিজেকে ভাববে, তুমি একজন চিনা ছাত্র। তারা কী করে! বিছানা থেকে উঠেই, বিছানায় ক্যাঁত করে একটা ব্যাক-কিক ঝাড়ে। সারাদিন বিছানার সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক নেই। বিছানায় লাথি মারে কেন? বিছানা হল মানুষের শত্রু। মানুষ যতক্ষণ ঘুমোয়, ততক্ষণ সে মৃত। ঘুম হল, সাময়িক মৃত্যু। রোজ যদি কেউ আট ঘন্টা ঘুমোয়, তা হলে বছরে ঘুমিয়ে কাটাচ্ছে দু’ হাজার ন’শো কুড়ি ঘন্টা। বছরের চারটে মাস ঘুমিয়েই কাটছে। তা হলে কেউ যদি সত্তর বছর বাঁচে, তার ঘুমেই চলে গেল তেইশটা বছর। গোটা একটা যৌবন। সেই কারণেই চিনারা বিছানায় লাথি মারে। জীবনে যাঁরা বড় হন, তাঁরা সকলেই নিদ্রাকে জয় করেন। নেপোলিয়ান ঘোড়ার পিঠেই সামান্য সময় ঘুমিয়ে নিতেন।” জয় বিছানাটাকে লাথি মারে না। দাদুর বিছানা। বিছানাটাকে সে প্রণাম করে। মনে-মনে বলে, “বিছানা, তুমি আমার জীবনের তেইশটা বছর কেড়ে নিয়ো না। আর আমার ঘুম তুমি ভাল-ভাল, মজার-মজার স্বপ্নে ভরে দাও।”

জয়ের দাদুর নাম শিবশঙ্কর। মহাদেবের মতোই চেহারা। প্রায় ছ’ ফুট লম্বা। অনেকটা গ্রিক দেবতার মতো দেখতে। বড় এঞ্জিনিয়ার ছিলেন। দেশ-বিদেশ অনেক ঘুরেছেন। অনেক বড়-বড় কাজ করেছেন। বড়-বড় সেতু তৈরি করেছেন। অনেক খেতাব, অনেক পুরস্কার পেয়েছেন কাজের জন্য। বনে-জঙ্গলে-পাহাড়ে গিয়ে কাজ করেছেন। বাঘ এসে তাঁবুর চারপাশ শুঁকে গেছে। পাগলা হাতি এসে খোঁটা উপড়ে দিয়েছে। গাছের গুঁড়ি ভেবে পাইথনের পিঠে বসেছেন। কুমির এসে তীরে বেঁধে রাখা ছাগল টেনে নিয়ে গেছে। পাহাড় থেকে নেমে এসেছে মহুয়া-মাতাল ভালুক। ক্যাম্প চেয়ারে ঘুমিয়ে থেকেছে। শেয়াল এসে স্যাণ্ডউইচ খেয়ে গেছে। মাথার বালিশের তলায় সাপ কুণ্ডলি পাকিয়ে সারা রাত শুয়ে গেছে। ব্রিজের উঁচু গার্ডার থেকে পাগলা নদীতে পড়ে গেছেন। বন্যায় বাঁধ ভেঙেছে। সারারাত জলের তোড়ে দাঁড়িয়ে বাঁধ মেরামত করেছেন। ভাই-বোনের চোখে দাদু একজন হিরো। প্রথম রাতে ঘন্টা-দুই বিছানায় বিশ্রাম করেন। তারপরেই নিজের টেবিলে গিয়ে বসেন। ব্যাঙের ছাতার মতো ছোট্ট একটা বিলিতি টেবিল ল্যাম্প আছে। ভেতর দিকে আয়না লাগানো। ছোট্ট বাল্বেও জোর আলো। সেই আলোটা জ্বেলে দাদু অঙ্ক কষতে বসেন। যত কঠিন, জটিল অঙ্ক। নিজের একটা জীবনকাহিনী লিখছেন, বন-জঙ্গল-নদী-পাহাড়। মাঝে-মাঝে জয় আর জয়াকে সেটা পড়ে শোনান। লেখাটা অসাধারণ হচ্ছে। কত কী জানা যায়! কী ভীষণ উত্তেজনা। একজন শিক্ষিত, সাহসী, চরিত্রবান মানুষের জীবনকথা। কখনও মাঝরাতে ছাঁত করে জয়ের ঘুম ভেঙে গেলে দেখেছে, দাদু পিঠখাড়া চেয়ারে বসে আছেন তার দিকে পিছন ফিরে, পাথরের মূর্তির মতো। একমাথা পাকা চুল। কত রাতে জয় দাদুকে স্বপ্নে দেখেছে। পাহাড়চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন দু’ হাত তুলে। জয়কে ডাকছেন, “কমরেড, উঠে এসো। এখানে আকাশ অনেক নীল। বাতাস অনেক হালকা। এখানে দাঁড়ালে পৃথিবীর শেষ দেখা যায়। ” জয় যতবার চেষ্টা করে কিছুতেই উঠতে পারে না। চিৎকার করে বলে, “দাদু, আমি পারছি না।” তখন পাহাড়ের মাথা থেকে ভেসে আসে কণ্ঠস্বর, “নিজের মনের হাত ধরো, ঠিক উঠতে পারবে। মনের চেয়ে বড় মই কিছু নেই।”

জয়ার ডাকে জয় যখন বিছানা ছেড়ে ওঠে, তখন শিবশঙ্কর বাংলোর পুব দিকের বাগানে একটা বেদির ওপর বসে থাকেন। ওদিকেই পাথর ছড়ানো রাস্তা। ময়াল সাপের মতো এঁকেবেঁকে স্টেশনের দিকে চলে গেছে। দু’পাশে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে ইউক্যালিপটাস, সেগুন আর দেবদারু। ঝলমলে রোদ উঠলে পথটা ছায়ায় ঢেকে যায়। পথের ঝাঁকে সাদা রঙের ছোট্ট একটা চার্চ। চূড়ার ওপর ঘন্টা দুলছে। আর কিছু দূরে একটা আশ্রম আছে। ভেতরে ছোটমতো একটা মন্দির। সেই মন্দিরে আছে জীবন্ত রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ। চার্চের দরজা। দরজাটা ঠেললেই টিংলিং করে ঘন্টা বাজে। ভেতরটা সুন্দর সাজানো। চমৎকার গন্ধ। বাহারি মোমবাতি, বাহারি কাগজ, যিশু খ্রিস্টের বই, পেনসিল, খাতা, কলম, ছবি আঁকার রং, তুলি, শিশুদের জামা, লজেন্স, চকোলেট সব পাওয়া যায়। শীতকালে ফুল বিক্রি হয়। বড়দিনের আগে ক্রিসমাস ট্রি। প্লাস্টার অব প্যারিসের নানারকম মূর্তি। ব্রোঞ্জের আইকন। দোকানে সব সময় সুন্দর চেহারার একজন নান থাকেন। জয় আর জয়া গেলেই তিনি বলেন, “ হ্যাল্লো গড্! হোয়াট ইউ ওয়ান্ট?” তাঁর শরীর থেকে আইভি লতার গন্ধ বেরোয়। চোখে ঝকঝকে সোনালি ফ্রেমের গোল চশমা। ফরসা মুখের সঙ্গে একেবারে মিশে থাকে। দোকানটা তাদের কাছে স্বপ্নের মতো। চারপাশে তাকায়, মনে করে স্বপ্ন দেখছে। রাস্তাটা যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে, সেখানে একটা নদী আছে। নদীর নাম, সরলা।

জয়ের ঘরে স্বামী বিবেকানন্দের বড় একটা ছবি আছে। স্বামীজির মাথায় পাগড়ি। হাত দুটো বুকের ওপর ভাঁজ করে রাখা। মাথায় পাগড়ি। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। মুখে লেগে আছে মৃদু হাসি। চোখ খুললেই জয় ছবিটা দেখতে পায়। শুনতে পায় স্বামীজি যেন বলছেন, “উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত। ওঠো, জাগো, জ্ঞানলাভ করো।” দাদু শিবশঙ্কর জয়কে ভাল-ভাল শ্লোক মুখস্থ করিয়েছেন। যেগুলো মনে-মনে আওড়ালেই বেশ বল পাওয়া যায়। শিবশঙ্কর বলেছেন, “জল যেমন ফোটাতে হয়, ফিল্টার করতে হয়, সেইরকম মনকেও ফোটাতে হয়, ফিল্টার করতে হয়। ভাল-ভাল চিন্তার মধ্যে দিয়ে মনকে নিয়ে যেতে হয়। চোখকে দেখাতে হয় সুন্দর দৃশ্য। কানকে শোনাতে হয় সুন্দর গান, সুন্দর কথা, সুন্দর শ্লোক। হাত দিয়ে স্পর্শ করতে হয় সুন্দর ফুল।”

জয় বিছানা থেকে নেমেই একটু হাত-পা ছুড়ে নেয়। দাদু কয়েকটা ফিগার শিখিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, “লক্ষ করে দেখবে, জীবজন্তু অনেকক্ষণ শুয়ে থাকার পর, যেমন ধরো, বেড়াল. কি কুকুর, যখন ওঠে তখন শরীরটাকে স্ট্রেচ করে। আড়মোড়া ভাঙে। দোয়েল পাখি ভোরবেলা লেজের ব্যায়াম করে। পিড়িক-পিড়িক করে লেজ নাচায়। মৌটুসি ফুলের মধু খাওয়ার নাম করে একই জায়গায় ভেসে থেকে খুব খানিক ডানার ব্যায়াম করে নেয়। ব্যাঙ হাইজাম্প প্র্যাকটিস করে। ফড়িং বাতাস সেলাই করে। যেন সুচ মুখে নিয়ে একবার এদিক যাচ্ছে, একবার ওদিক যাচ্ছে। প্রজাপতি হয়ে যাচ্ছে হালকা কাগজ। কাঠঠোকরা গাছের গুঁড়িতে ঠোঁটের হাতুড়ি ঠুকে ঘাড়ের ব্যায়াম করে নিচ্ছে। কাঠবেড়ালি দৌড় কম্পিটিশন করছে। সবাই সব কিছু করছে, মানুষ পড়ে আছে বিছানায়। অতি কষ্টে যাও-বা উঠল, ছেতরে পড়ল চেয়ারে। চা ছাড়া চলার শক্তি নেই। তারপরেই মুখের সামনে মেলে ধরবে খবরের কাগজ।”

জয় বেক বেণ্ড, ফ্রন্ট বেণ্ড, স্ট্রেচিং এইসব করে, চটপট মুখ ধুয়ে নেবে ; তারপরেই বাসী জামাকাপড় ছেড়ে দিদির সঙ্গে চলে যাবে বাগানের ঘাসে। এখন শরৎকাল। শিশিরে ঘাস ভিজে-ভিজে। ঘাসের ডগায় নীল-নীল নাকছবি ফুল। দিদির কচি কলাপাতা রঙের ফ্রকটা জয়ের ভীষণ ভাল লাগে। দিদির গায়ের রঙের সঙ্গে বেশ মিশে যায়। তারা দু’জনে শিউলি গাছের তলায় এসে দাঁড়ায়। দিদি ঠোঁটে আঙুল রেখে কোনওরকম শব্দ করতে বারণ করে। শিউলি ফুল ঝরে পড়ার নাকি একটা শব্দ আছে। দিদি শুনতে পায়। খুব ফিসফিসে শব্দ। বাতাসের মতো। ঝরে পড়ার সময় প্রতিটি ফুল বলে, “মা-আ, তোমার কোল থেকে আমি মাটির কোলে গেলুম।”

“দিদি, গাছ তখন কী বলে? হায়!”

“হায় বলবে কেন? গাছ বলে, আয় মা।”

“ফুলেরা কি সব মেয়ে?”

“ফুল, ফল, গাছ, এরা সব মেয়ে।”

“তুই শুনতে পাস, আমি কেন পাই না?”

“তুই তোর কানটাকে খাড়া কর। ঠিক শুনতে পাবি। গাছের সঙ্গে ফুলের কথা।”

জয় খুব চেষ্টা করে। দিদি কত কী শুনতে পায়, দেখতে পায়। দিদির গায়ে নাকি তারার আলো এসে পড়ে। সে নাকি আলপিন ফোটার মতো। চাঁদের আলোয় দিদির চুল ভিজে-ভিজে হয়ে যায়। জয় দেখেছে। মিথ্যে নয়। সত্যিই হয়। দিদি কচুপাতার ওপর শিশিরের ফোঁটাটাকে মুক্তোর মতো জমিয়ে দিতে পারে। দিদির মাথায় কোথা থেকে উড়ে এসে সাদা পায়রা বসে। কাঁধে এসে বসে ছিট-ছিট ঘুঘু। কাঠবেড়ালি হাত থেকে বাদাম খেয়ে যায়। একটুও ভয় পায় না। দিদি যখন শালিক পাখির ঝাঁকে গিয়ে দাঁড়ায় একটা পাখিও উড়ে যায় না। ক্যাঁচর-ম্যাচর করে দিদির সঙ্গে সমানে গল্প করে। জয়ের বেলায় এইসব হয় না। কেন হয় না! দিদি বলেছে, ভেতরে একটুও হিংসে থাকলে হবে না। একেবারে মাটির মানুষ হতে হবে।

শিউলি গাছের তলায় দিদি উবু হয়ে বসেছে। সবুজ ঘাসের সঙ্গে সবুজ ফ্রক মিশে গেছে। একমাথা কালো চুল। ফিসফিস করে শিউলি ঝরছে। ঝরে পড়ছে দিদির মাথায়, ঘাড়ে, পিঠে। এই সময় দিদিকে মনে হয় দেবী।

শিউলি গাছের তলাটা ফুলে-ফুলে সাদা। সবুজ ঘাস। সাদা ফুল। হলুদ বোঁটা। ফিনফিনে শিশির। সব মিলিয়ে সে এক কাণ্ড! হঠাৎ জয়া বলবে, “জয়, অনুমতি নিয়ে গাছটাকে খুব করে ঝাঁকা।”

“কার অনুমতি, দিদি?”

“গাছের অনুমতি। গাছ হল দেবতা। গাছকে বল, বৃক্ষদেবতা, তোমাকে একটু ঝাঁকাচ্ছি। আজকের সব ফুল ঝরিয়ে দাও। আমাদের পুজো হবে।”

বেশ গায়েগতরে, হুড়ম-দুড়ুম কাজ হলে জয়ের ভীষণ মজা লাগে। মনে হয় বেশ একটা কিছু হচ্ছে। মাঝে মধ্যে বাগানে ছাগল ঢুকে পড়ে। রাম খেলোয়ানদের রামছাগল। জয়ের ওপর ভার পড়ে ছাগলটাকে তাড়াবার। সে এক দক্ষযজ্ঞ ব্যাপার। ছাগল ছুটছে এদিক থেকে ওদিকে, পেছনে ছুটছে জয়। ছাগল ঝুল কাটছে। তেড়ে আসছে গুঁতোবার জন্য। একবার-দু’বার জয়কে হয়তো ল্যাং মেরে ফেলে দিচ্ছে। শেষে ছাগলও হাঁপাচ্ছে, জয়ও হাঁপাচ্ছে। ছাগলটা আবার মাঝে-মাঝে হুঁহুঁ করে হেসে ওঠে। কিন্তু রাম খেলোয়ানের মেয়ে এসে যেই ডাকলে, ‘চাচা, আ যাও।’ অমনি ছাগলটা বাধ্য ছেলের মতো গুটি-গুটি চলে যাবে। ছাগলটার নাম, চাচা। রাম খেলোয়ানের মেয়ের নাম গৌরী। মেয়েটা একটু দুষ্টুমতো আছে। জয়কে জিভ দেখায়। ভেংচি কাটে। ছোট-ছোট পাথরের টুকরো ছুড়ে মারে। জয় বুঝতে পারে না, মেয়েটা কেন অমন করে। সে তো কিছুই করেনি, তা হলে গায়ে পড়ে ঝগড়া কেন? একদিন ভুট্টা ছুড়ে মেরেছিল। এবার আখের খাদি দিয়ে খোঁচা মেরেছিল। জয় কিছু বলে না। অবাক হয়ে মেয়েটাকে দেখে। ধারালো মুখ, ঝকঝকে দুটো চোখ। এক মাথা এলোমেলো চুল। সামান্য লালচে রং। সব সময় একটা ঘাগরা পরে থাকে। হাতে নানা রঙের গালার চুড়ি। জয় কোনও-কোনও সময় তাড়া করলে মেয়েটা হাসতে-হাসতে ছুটে পালায়। হরিণের মতো ছুটতে পারে।

জয় যখন গাছটাকে বলে, “তোমাকে একটু ঝাঁকাচ্ছি,” তখন গাছকে মনে হয় বড়সড় একজন মানুষ। বাবার মতো, দাদুর মতো। মায়ের মতো। জয় শুনতে পায়, গাছ যেন বলছে, “ঠিক আছে জয়, তুমি যত পারো আমাকে দোলাও।”

জয় গাছটাকে ঝাঁকায়। পাতায়-পাতায় খসখস শব্দ হয়। শিশিরের ফোঁটা ঝরে। অজস্র সাদা ফুল ঝরে পড়ে দিদির গায়ে, মাথায়। একেবারে চাপা পড়ে যায়, এত ফুল। তারপর তারা ঘাসের ওপর সাদা একটা চাদর বিছিয়ে মুঠো-মুঠো ফুল তোলে। ফুলের একটা পুঁটলি তৈরি হয়। হঠাৎ জয়া দৌড়তে শুরু করে। “জয়, রান।” জয় ছুটতে থাকে দিদির পেছনে-পেছনে। তারা বাগানের এ-মাথা থেকে ও-মাথা চলে যায়। ওদিকে গোলাপ বাগান। ধর্মা মালী এসে রোজ খুব যত্ন করে। অনেকদিনের পুরনো মানুষ। অনেকের অনেক বাগান করেছে। নিজের কিন্তু এক ছটাকও জমি নেই। মানুষটার কবির মতো চেহারা। চোখ দুটো যেন স্বপ্ন দেখছে। রোদে পুড়ে, জলে ভিজে শরীরটা ফাটা-ফাটা হয়ে গেছে। জীবনে কখনও অসুখ করেনি। পেট খারাপ, মাথাধরা, জ্বর এসব কখনও হয়নি। পোড়া মাটির পুতুলের মতো শরীর। মানুষটা গাছের সব কিছু জানে। গাছের কখন খিদে পায়, কখন দুঃখ হয়, কখন আনন্দ।

সেই গোলাপ বাগানে এসে তাদের দৌড় থেমে যায় ভাই আর বোন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সারারাত ধরে গোলাপ ফুটেছে। লাল, কালো, হলুদ, সাদা। টাটকা, তাজা গোলাপ। দূরের পাহাড়টা তখন আরও কাছে এগিয়ে আসে। আরও স্পষ্ট। পাথরের খাঁজ দেখা যায়। পাহাড়ের মাথায় একটা সমাধি আছে। একটা ক্রস পোঁতা আছে। পরিষ্কার দেখা যায়। জয় ভাবে, পাহাড় এত পাথর কোথা থেকে পায়!

দিদি গোলাপদের সাবধানে আদর করে। লাল, হলুদ, কাগজের টুকরোর মতো বড় বড় প্রজাপতি নেচে বেড়ায়। আর ঠিক সেই সময় চার্চের ঘন্টা বাজে। জয় আর জয়া জানে, এইবার তাদের স্কুলে যাওয়ার সময় হয়েছে। সকালের স্কুল। তাদের সকালের খাওয়াটা দাদুর তদারকিতে হয়। বিলিতি ব্রেকফাস্ট নয়, দিশি নাস্তা। কল বেরনো ছোলা, আখের গুড়, বাদাম, পাকা পেঁপে, দুধ-রুটি। বাড়িতে পাউরুটির প্রবেশ নিষেধ।

॥ ২ ॥

জয়, আ!

দাদুর এইটাই কায়দা। অঙ্কের মানুষ। জয় আর জয়ার কমন ফ্যাকটার জয়টা বের করে নিয়ে একটা আ যোগ করলেই ভাই আর বোন দুজনকেই ডাকা হল।

“জয়-আ।”

বাগানের পুব দিকের বেদীতে বসে শিবশঙ্কর ডাকছেন। বড়-বড় চুল কাঁচাপাকা, গ্রিকদের মতো খাড়া নাক। ঋষির মতো দেখায়। সুর্যের লাল গোল থালা পুব দিগন্তে মাথা তুলেছে। যেন জল থেকে মাথা ঠেলে উঠছেন শক্তিশালী এক দেবতা। সোনার মতো তাঁর রং। যত বেলা বাড়বে ততই তাঁর তেজ প্রখর থেকে প্রখরতর হবে। শিবশঙ্করের পাশেই চারটে জবা গাছ, ঝাঁকড়া হয়ে আছে। একটা লাল টুকটুকে জবা মা কালীর মতো লাল লকলকে জিভ বের করে বাতাসে দোল খাচ্ছে। সূর্যের প্রথম কিরণ বড় মিষ্টি। সোনালি মায়ায় চারপাশ ভরে দিতে চায়। জীবনপাত্র যেন কানায়-কানায় ভরে উঠছে। চারপাশ ঝকঝক করছে। আকাশ এই মুহুর্তে ঘন নীল। দুলারিদের একঝাঁক সাদা পায়রা আকাশে ডিগবাজি খাচ্ছে। আনন্দে মাতোয়ারা। একটু পরেই তো এই মুহুর্তটা আর থাকবে না। আগুন ধরে যাবে প্রকৃতিতে। তখন আর পাথরে পা রাখা যাবে না। জল থেকে ধোঁয়া উঠবে। প্রজাপতিরা পাতার আড়ালে ছায়া খুঁজবে। কাক ক্লান্ত হয়ে ডাকবে কি ডাকবে না!

দাদুর ডাক শুনে জয় আর জয় প্লাস আ, জয়া দু’জনেই তীরবেগে দৌড়ল। এই ডাকটার জন্যে তারা অপেক্ষা করে থাকে। বাগানের গাছে-গাছে জল যাওয়ার জন্যে মালী ধর্মা নালি কেটে রেখেছে। তার পাশে-পাশে ছোট-ছোট ঘাস, ছোট-ছোট চারা গাছ। নুড়িপাথর নানা রঙের। কম উচ্চতার ছোট-ছোট বেড়া এখানে ওখানে। জয় এই সব বাধা মানতে চায় না। জয়া বেড়াগুলো পাশ কাটিয়ে যায়। জয়ের কাছে সেগুলো হার্ডলের মতো। টপাটপ টপকে যায়। দৌড়বীরের মতো।

তারা জানে কী করতে হবে! দৌড়ে গিয়ে দাদুর দু’পাশে বসে পড়তে হবে। হাঁপালে চলবে না। দাদু বলবেন, “ছুটবে, কিন্তু হাঁপাবে না।” সেটা কী করে সম্ভব হবে! ছোটার তালে-তালে শাস নেবে। রিদ্মিক ব্রিদিং। ছন্দোবদ্ধ শ্বাস-প্রশ্বাস।

শিবশঙ্কর বললেন, “এসে গেছ, আমার দুই খরগোশ। আজ কতক্ষণ সময় লাগল দেখি।” বুকপকেট থেকে স্টপওয়াচ বের করে দেখলেন, “চল্লিশ সেকেন্ড। কালকের চেয়ে দু’সেকেন্ড কম। গুড।” শিবশঙ্কর জয় আ, বলে ডেকেই স্টপওয়াচ চালু করে দেন। এটাও তাঁর একটা হিসেব। ফিট্নেস পরীক্ষা। যেদিন সময় বেশি লেগে যায়, সেদিন বুঝতে হবে শরীর ঠিক যাচ্ছে না। কমজোর হয়ে আছে। সঙ্গে-সঙ্গে খোঁজ নেবেন, ঠিকমতো খাচ্ছে কি না ! কী খাচ্ছে! খাদ্যে কোনও কিছু অভাব ঘটছে কি না! মিনারল, সল্ট, ভিটামিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট। জল ঠিকমতো খাওয়া হচ্ছে কি না। যাবতীয় তথ্য তিনি সংগ্রহ করে ঘাটতি পূরণের ব্যবস্থা নেবেন।

শিবশঙ্কর বললেন, “এই মাসের বেস্ট টাইম। সেদিন তোমরা পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড নিয়েছিলে। ওয়াস্ট রেকর্ড অব দিস মান্থ। ইউ হ্যাভ ইমপ্রুভড। আরও দশ সেকেন্ড কমাতে হবে। লেটুস আরও বেশি খেতে হবে। গাজর আর ছোলার মাত্রা বাড়াও। দুটোই হর্সপাওয়ার।”

দিগন্ত ছুঁয়ে থালার মতো সূর্য সম্পূর্ণ প্রকাশিত। শিবশঙ্কর বললেন, “হাত জোড় করো। এসো, দিনকে আমরা আবাহন করি। লেট আস স্টার্ট দি ডে।”

সমবেত প্রার্থনার সময় এটা। চাইবার সময়। ধন নয়, জন নয়, এমন এক চাওয়া, যা কেউ চায় না—

তেজোহসি তেজো ময়ি বৈহি।

বীর্যমসি বীর্যং ময়ি বৈহি।

বলমসি বলং ময়ি বৈহি।

ওজোহস্যোজো ময়ি বৈহি।

মনুরসি মনুং ময়ি বৈহি।

সহোহসি সহো ময়ি বৈহি।

শিবশঙ্কর গম্ভীর গলায় বলতে লাগলেন, “তুমি তেজ, আমাতে তেজ স্থাপন করো। তুমি বীর, আমাতে বীরত্ব স্থাপন করো। তুমি বল, আমাতে বল স্থাপন করো। তুমি শক্তি, আমাতে শক্তি স্থাপিত করো। তুমি মানসিক তেজ, আমাতে মানসিক তেজ স্থাপন করো। তুমি প্রভাব, আমাতে প্রভাব স্থাপিত করো।”

দু’পাশে দু’জনের মাথায় দুটো হাত রেখে শিবশঙ্কর অনেকক্ষণ বসে রইলেন স্থির হয়ে। এই ছেলে আর মেয়ে বড় হবে। পৃথিবীর মুখোমুখি হবে। শক্তি, তেজ, বীরত্ব নিয়ে। জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। জগৎকারণ সূর্য তুমি এদের তেজ দাও, দীপ্তি দাও, সৎ গুণ দাও। আমাদের দিন শেষ হয়ে আসছে। আমাদের ছাইয়ের ওপর অমিত তেজে এদের সভ্যতা যেন জেগে ওঠে। এক প্রদীপ থেকে আর-এক প্রদীপে শিখা এইভাবেই ছড়ায়। শিবশঙ্করের চোখে জল। শেষ নাহি যার শেষ কথা কে বলবে। গির্জায় প্রেয়ারের ঘন্টা। সোনার পাতের আকাশের গায়ে গাঢ় নীল পাহাড়।

দেখার সকাল শেষ হল। বাতাস গরম হয়ে উঠছে। রোদের তেজ বাড়ছে। দূরে বহুদূরে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে মেন লাইনের ট্রেন যাচ্ছে ময়াল সাপের মতো এক পেট লোক নিয়ে। দূরে জৈন মন্দিরের চূড়ায় সাদা একটা পতাকা উড়ছে পতপত করে।

বাইরের বাগানে যখন এই সব হচ্ছে, ভেতরের বাড়িও জেগে উঠেছে। দিদিমার গায়ের রং কাশীর পাকা পেয়ারার মতো। চোখে সোনালি চশমা। পরে আছেন চওড়া লাল পাড় সাদা শাড়ি। তিনি তদারকি করছেন একটা জিনিস। দাদু যার নাম রেখেছেন, স্বাস্থ্য-নির্যাস। রান্নাঘরের বাইরে লাগাদাঁই একটা শিলে দুলারি দুলে-দুলে কালমেঘ পাতা বাটছে। সকালে সকলের প্রথম খাওয়া হচ্ছে কালমেঘের রস। সে যত তেতোই হোক হাসি মুখে খেতে হবে। ওইসময় ছেলে আর মেয়ের মুখ দেখে, মা সুর করে গাইবেন, কালো সে যতই কালো হোক, মেঘ তো নয়, সে যে সবুজ পাতা।

দিদিমা খুব রাশভারী মানুষ। তাঁর মুখের ওপর কথা বলার সাহস কারও নেই। কলকাতার খুব নামকরা কবিরাজের মেয়ে। নিজেও কবিরাজি করেন। এ-তল্লাটের যত মানুষ তাঁর ওষুধ খেয়ে বেঁচে আছে। সপ্তাহে তিনদিন চার্চে বসে রুগি দেখেন। বিনাপয়সায়। সেই-সেই দিনে ভিড় লেগে যায়। দিদার চিকিৎসার খুব নামডাক। জয় আর জয়ার গায়ে মাঝে-মাঝে হাত রেখে উত্তাপ দেখেন। শরীর হবে পাথরের মতো শীতল। হাতের তালু ছ্যাঁক-ছ্যাঁক করলে বুঝতে হবে লিভার ঠিক চলছে না। পিত্ত বাড়ছে। কবিরাজি মতে শরীরের তিনটি উপাদান, বায়ু, পিত্ত, কফ। তিনের সমতাই হল সুস্বাস্থ্য! দিদার অনেক বই আর পুঁথি আছে। দিদার সহকারী হল দুলারি। কুড়ি-বাইশ বছরের দেহাতি একটি মেয়ে। মিশনারিদের স্কুলে ছেলেবেলায় পড়েছে। মিশনারিদের প্রভাবে সবসময় ঘাগরার মতো একটা পোশাক পরে থাকে। ঘাড় পর্যন্ত কাটা চুল ঝুমুর ঝুমুর করে। শ্যামলা কিন্তু সুন্দরী। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ভাল ইংরেজি বলতে পারে। চোখে মুখে বুদ্ধির ছাপ। দিদাকে বলে, মাদার মেডিসিন। দিদা ফর্মুলা বলে দেন, দুলারি গাছগাছড়া কিনে এনে ওষুধ তৈরি করে। মেয়েটি খুব খাটতে পারে। যত পরিশ্রম করে তত হাসে। মুখের হাসি যেন ফুরোয় না। কোনও বিরক্তি নেই। যা বলবে তাই রবে হাসিমুখে। জয় আর জয়ার দিদা প্রায়ই বলেন, “দুলারি, আমার এই বিদ্যা সব তোকে দিয়ে যাব। দেখবি, জীবনে তোর কোনও অভাব থাকবে না। তবে একটা কথা, অন্যকে ভাল করতে গেলে নিজেকে ভাল হতে হবে। সৎ, সুন্দর। অন্যের অনিষ্ট চিন্তা করলে হবে না। রোজ সকালে উঠে বলতে হবে, পৃথিবীর সকলের মঙ্গল হোক।”

সেই কালমেঘের রস সকলকেই খেতে হয়। কারও মুক্তি নেই। জয়ের বাবা মজা করে বলেন, “জানো মা, তোমার কল্যাণে গুড ডে আর বলার উপায় রইল না, বলতে হবে বিটার ডে। ”

দাদু শিবশঙ্কর ছোট একটা কারখানা করেছেন। তিনি বলেন, “কোনও মানুষেরই অলস বসে থাকা উচিত নয়। কিছু-না-কিছু একটা করা উচিত। বাইবেলে আছে, আর্ন ইয়োর ব্রেড বাই দি সোয়েট অব ইয়োর ব্রাউ। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করবে। শিবশঙ্কর মডেল তৈরি করেন। ব্রিজের মডেল, কালভার্টের মডেল, কারখানার মডেল, বহুতল বাড়ির মডেল। আর-একটা জিনিস করেন, মেকানিক্যাল টয়, কলের পুতুল। যে খেলনা দম দিলেই চলবে। সে-সব অসাধারণ জিনিস। বিলিতি ছাঁচে, বিলিতি ধাঁচে তৈরি। খুব ভাল বাজার। পাটনা, দিল্লি, কলকাতা সব জায়গায় চালান যায়। শিবশঙ্করের ছোটমতো একটা কারখানা আছে। সব কাজ নিজেই করেন। সারাদিন সেইখানেই থাকেন। দিনের বেলা ভাত খান না। আলস্য আসার ভয়ে। বিলিতি ধরনের জীবনে বিশ্বাসী। সকালে হেভি ব্রেকফাস্ট, মডারেট একটা লাঞ্চ, হেভি সাপার। তারপর তেড়ে মাইলখানেক বেড়ানো। সেই বেড়ানোর দু’জন সঙ্গী, জয় আর জয়া।

যে-রাস্তাটা ময়াল সাপের মতো এঁকে বেঁকে পাহাড়ের দিকে চলে গেছে নদী পেরিয়ে, সেই সরলা নদীর তীরে এসে তাদের চলা থেমে যায়। সারাটা পথ শিরশিরে বাতাস। পথের নুড়িতে জুতোর মশমশ শব্দ। কখনওসখনও ছিটকে যায় ছররার শব্দে। দেবদারু আর ইউক্যালিপটাসের পাতায় বাতাসের শনশন শব্দ। পাতার ফাঁকে রাতের গাঢ় নীল আকাশ কাঁপে। তারা ছড়িয়ে থাকে হিরের কুচির মতো। সরলা যত এগিয়ে আসে বাতাস তত হিম হয়। সরলার তীরে কোনও বিশাল গাছ নেই। শীর্ণ নদী। বর্ষায় তার দু’কূল ছাপিয়ে যায়। অন্যসময় সামান্যই জল। পায়ের পাতা ডোবে কি ডোবে না। অস্ফুট কুলুকুলু শব্দ। নদী যেন হৃদয়ের কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলেছে রাতের দুই পথিকের মতো। দিনের বেচাকেনা শেষ করে হাট থেকে ফিরছে।

নদীর ধারে মসৃণ পাথর আছে। শিবশঙ্কর নাতি আর নাতনিকে নিয়ে বড় একটা পাথরে পাশাপাশি বসেন। মাথার ওপর নীল-কালো আকাশ। নক্ষত্রপুঞ্জ। গ্যালাক্সি, মিল্কিওয়ে। অদূরে নদী। জলে ভেজা বালিতে সিনসিন শব্দ। জয় আর জয়ার প্রথম-প্রথম গা ছম ছম গ্রত। যেতে-যেতে সাহস বেড়ে গেল। এখন আর করে না। এখন ভালই লাগে। একদিন যেতে না পারলে মন ছটফট করে।

শিবশঙ্কর ছেলে আর মেয়ে দুটোকে কনস্টিলেশান চেনান। তারা চেনার একটা ছড়া শিখিয়েছেন, 0 Be A Fine Girl, Kiss Me Right Now। এই ছড়ায় লুকিয়ে আছে তারাদের রং আর উত্তাপ। সাদাটে সবুজ রঙের তারা হল সবচেয়ে উত্তপ্ত। গ্রিন হোয়াইট স্টার। এরা হল ও গ্রুপের তারা। বি হল ব্লু নীল। উত্তাপ অনেক কম। এ হল ব্লু হোয়াইট। হিরের মতো। আরও শীতল। ফাইনের এফ হল হলদে তারা, সাদাটে-হলদে। গার্লের জি হল একেবারেই হলদে। কিসের কে হল কমলা রঙের তারা। হলুদ-কমলা। মি-র এম হল নির্ভেজাল কমলা। রাইটের আর হল লাল-কমলা। নাও-এর এন হল টকটকে লাল। একেবারেই শীতল। মাথার ওপর অন্ধকার আকাশ। তারাদের দ্যাখো। চেষ্টা করো রং চিনতে। তাকিয়ে দ্যাখো কালপুরুষকে। ওই দ্যাখো কালপুরুষের কুকুর। সপ্তর্ষি কেমন শুয়ে আছে। ধ্রুবতারা খুঁজে পাওয়ার সহজ নিয়মটা শিখে নাও। আকাশ থেকে চোখ ফিরিয়ো না। এখনই উল্কাপাত হতে পারে। গ্রহ-নক্ষত্রের সাম্রাজ্য ছেড়ে জ্বলন্ত রকেটের মতো নেমে আসছে উল্কাপিণ্ড। পৃথিবীতে পৌঁছবার আগেই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। সেই পাথরের ওপর বসে শিবশঙ্কর রবীন্দ্রনাথ আবৃত্তি করেন। এপাশে জয়, ওপাশে জয়া। দু’জনের কাঁধে দু’হাত—

ফুরাইলে দিবসের পালা

আকাশ সূর্যেরে জপে

লয়ে তারকার জপমালা।

কোনও-কোনও দিন সত্যিই উল্কাপাত দেখা যায়। আকাশ আলোকিত করে নেমে আসছে জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ড। নীল পাহাড়ের মাথায়। জয় আর জয়া কান খাড়া করে থাকে, যদি ঠকাস করে, পাথরে পাথর পড়ার শব্দ শুনতে পায়। পায় না। তার আগেই সব ছাই।

শিবশঙ্করের অদ্ভুত একটা হিসেব আছে, কতক্ষণ বসবেন, কখন উঠে বাড়িমুখো হবেন। হিসেবটা করেন বাতাস বুঝে। জলে-জঙ্গলে-পাহাড়ে থাকতে-থাকতে বাতাসের উত্তাপ অনুভব করে রাত বোঝার ক্ষমতা হয়েছে। আকাশের নক্ষত্রমণ্ডলও সেই নির্দেশ দেয়। প্রকৃতির নিজস্ব একটা ঘড়ি আছে। প্রকৃতির মধ্যে থাকলে সেই ঘড়ির সময় বোঝা যায়। শিবশঙ্কর ঠিক সময়ে বলবেন, “চলো, এইবার ফেরা যাক।” সরলা নদী তখন স্বপ্নের মধ্যে বিড় বিড় করে বলছে যেন, “কল্লোলমুখর দিন / ধায় রাত্রি-পানে/ উচ্ছল নির্ঝর চলে সিন্ধুর সন্ধানে।”

॥ ৩ ॥

বাড়িতে একটা গাড়ি আছে। দুধসাদা রং। সেই গাড়িটা কেউ চাপে না। খুব প্রয়োজন হলে ডাক্তারবাবু গ্যারাজ থেকে গাড়িটা বের করেন। যারা গাড়ি চাপে তারা সাধারণ মানুষ থেকে অনেকটা দূরে সরে যায়। বাবু হয়ে যায়, সুখী হয়ে যায়। সাধারণ মানুষ তাদের আর ভালবাসে না। বড়লোকদের মানুষ ঘৃণা করে, অবিশ্বাস করে। যখন তোমার খুব বিপদ, একমাত্র তখনই গাড়ি চাপতে পারো।

ডাক্তারবাবু সাইকেল চাপেন। কোনও অহঙ্কার নেই। বিলেত ফেরত ডাক্তার। ইচ্ছে করলেই সাদা গাড়িতে চেপে হুস্ করে হাসপাতালে যেতে পারেন। জয়, জয়াকে স্কুলে দিয়ে আসতে পারেন। না, সে নিয়ম নেই। শিবশঙ্করের কড়া হুকুম—হেঁটে যাবে, হেঁটে আসবে। এক মাইল পথ কিছুই নয়। হাঁটলে মানুষের আত্মবিশ্বাস বাড়ে। হাঁটলে ভাল চিন্তা আসে মনে। হাঁটলে শরীর সুস্থ থাকে। বিদ্যাপ্রতিষ্ঠানে বিনীতভাবে যেতে হয়। স্কুল বড়লোকি দেখাবার জায়গা নয়। অধ্যয়ন এক তপস্যা। যত কষ্ট করবে তত ভাল ফল পাবে। রোদে হাঁটতে হবে, তাতে কী হয়েছে! গরমের দেশে গরম সহ্য করতে হবে। শীতের দেশে শীত। পৃথিবীটা সুখের জায়গা নয়। কষ্ট সহ্য করতে পারলেই সুখ। কষ্ট যখন আর কষ্ট থাকবে না, তখন দুঃখও আর থাকবে না। পৃথিবীটা বীরের জায়গা। স্বাস্থ্যই শ্রেষ্ঠ সম্পদ। মানুষ ছাড়া পৃথিবীর আর কোন প্রাণী পরনির্ভর! পাখি কি পালকি চাপে? নিজের ডানায় ভর করে ওড়ে। ঘোড়া কি গাড়ি চাপে? ঘোড়া গাড়ি টানে। শিবশঙ্করের কাছে পনেরো মাইল টানা হেঁটে যাওয়াটা কিছুই নয়। বৈশাখের চড়া রোদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাগান কোপাতে পারেন। একটা কথা তিনি প্রায়ই বলেন। শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়।

সকাল হল কাজের সময়। ছ’টা থেকে ন’টা টানা পড়তে হবে। ন’টা থেকে দশটা স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি। ঠিক দশটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে সাড়ে দশটায় স্কুল। সরলা নদীর তৃতীয় বাঁকে জোড়া বটের মাঠে তাদের মিশনারি স্কুল। এক ফরাসি পাদরি এই শতাব্দীর প্রথম দিকে এই স্কুল স্থাপন করেছিলেন। ছেলে মেয়ে একসঙ্গে পড়ে। শুধু লেখাপড়া নয়, নানারকম হাতের কাজ শেখানো হয়। উঁচু ক্লাসের ছেলেমেয়েদের সমাজসেবা করতে হয়। স্কুলটা যখন হয় তখন এই অঞ্চলের লোকসংখ্যা খুব কম ছিল। এখন সংখ্যা অনেক বেড়েছে। শহর এগিয়ে এসেছে। বড়-বড় কলকারখানা হয়েছে। গালার চাষ হয়, মাইকা তো আছেই। এই অঞ্চলের মাইকা খুব উঁচুদরের। মাটির তলায় পরতে-পরতে সঞ্চিত আছে ঝকঝকে এই অভ্র। অবাক হয়ে দেখার মতো। মাটির তলায় কে এমন করে সাজিয়ে রেখেছে! সরলা নদীর জলে এই অভ্রের কণা চিক চিক করে। মাটির তলায় উৎকৃষ্ট চুনাপাথর আছে। অনেকের ধারণা। সরলা নদীর আশপাশে কোথাও সোনা আছে। প্রায়ই কিছু-কিছু মানুষ আসেন অনুসন্ধানে। দল বেঁধে। চুপিচুপি খোঁজপাত চালান। তাঁদের হাবভাব অপরাধীর মতো। যেন কোনও অন্যায় করতে এসেছেন। সরলা নদীতে সোনার নুড়ির সন্ধান করেন। বৃদ্ধ আদিবাসীদের সাহায্য নেন। যাঁরা খুব বৃদ্ধ তাঁরা অনেক খবর রাখেন। তাঁরা এক-একজন এক একটা ইতিহাসের মতো। অতীত ঐশ্বর্যের খবর রাখেন তাঁরা। শিবশঙ্কর জানেন, ওঁরা কী জন্য আসেন। যতই লুকোবার চেষ্টা করুন, শিবশঙ্করকে ফাঁকি দেওয়া শক্ত। তিনি জানেন কোন অঞ্চলে কী থাকতে পারে! সরলা নদী আর ওই নীল পাহাড়। এর মাঝের জায়গাটা খুবই রহস্যময়। ওখানে অনেক কিছু থাকা সম্ভব। কে আর সেভাবে অনুসন্ধান করে দেখছে।

জয় আর জয়ার বাবার নাম উদয়ন। টুকটুকে ফরসা। হাসিখুশি একজন মানুষ। তাঁর অনেক গুণ। শুধু একজন নামকরা ডাক্তার নন। ভীষণ ভাল সরোদ বাজান। রোজই রেওয়াজে বসেন, একটু বেশি রাতে। শিবশঙ্কর বলেন, “যারা কাজের লোক তাদের কখনও সময়ের অভাব হয় না। ইচ্ছে করলে তারা সব কাজের জন্যে সময় বের করতে পারে। যারা অলস তারাই বলবে, সময় পাই না।” মায়ের নাম উমা। মা খুব ভাল ছবি আঁকেন। আর্ট কলেজের পাশ করা। বাবা আর মাকে পাশাপাশি দেখলে, ঠাকুমা বলেন, হর-পার্বতী। ঠাকুমাই পছন্দ করে মাকে এনেছিলেন। তাই মায়ের কথা বলতে ঠাকুমার ভীষণ গর্ব। জয়ের প্রায়ই মনে হয়, সে স্বপ্নের মধ্যে আছে। বাবা গভীর রাতে সরোদে দরবারী আলাপ করছেন। দাদু টেবিলল্যাম্পের সামনে বসে তাঁর জীবন কাহিনী লিখছেন, হলুদ রঙের মোটা পার্কার কলম দিয়ে। সকালবেলা দিদা ও দুলারি হামানদিস্তায় কবিরাজি ওষুধ কুটছেন। বেলা শেষের পড়ন্ত আলোয় মা বাগানের বেদীতে বসে জলরঙে ছবি আঁকছেন। নীল রঙের মোটা ভাঙ্গেরি সুট পরে শিবশঙ্কর তাঁর ওয়ার্কশপে নতুন কোনও খেলনার মডেল তৈরিতে ব্যস্ত। কোথাও কোনও দুঃখ নেই, অভাব নেই, খ্যাচাখেচি নেই। তাই কি বাংলোটার নাম, ‘আনন্দ ধাম’।

ডাক্তার উদয়ন চট্টোপাধ্যায় সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যেই হাসপাতালে বেরিয়ে যান। জয় আর জয়া পড়া ছেড়ে সেই সময়টায় গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। পাশে মা, দিদা, দুলারি, শিবশঙ্কর, ধর্মা, রামখেলোয়ান, এমনকী তাদের কুকুরটাও। কুকুরের নাম ‘মোহর’। মোহরকে কুকুর বললে জয়া ভীষণ রেগে যায়। বলে, ও কুকুর নয়, মানুষ। কথাটাই যা বলতে পারে না, আর দু’পায়ে দাঁড়াতে পারে না, এইটুকুই যা তফাত। পুরো পরিবার গেটের সামনে হাসিমুখে। উদয়ন হাসতে-হাসতে হাত নেড়ে তাঁর সবুজ সাইকেলে উঠবেন। সবাই একসঙ্গে বলতে থাকবেন, “দুর্গা, দুর্গা।” শিবশঙ্কর রোজই যেমন সাবধান করেন সেইরকম সাবধান করবেন, স্নেক বেন্ডের কাছে ধীরে চালিয়ো। আধমাইল দূরে রাস্তাটা সাপের মতো আঁকাবাঁকা হয়ে আছে, জায়গাটা একটু বিপজ্জনকও। গাছপালাও বেশি। এপাশ থেকে ওপাশে কী আসছে দেখা যায় না। ওই জায়গায় সাঁওতালদের বোঙ্গা মন্দির। কলকাতার লাহিড়িদের বিশাল বাগানবাড়ি। ভেতরে তিন-চারটে বিশাল অ্যালসেশিয়ান ঘাঁউ-ঘাউ করে। বাতাসে ইউক্যালিপটাসের ঝস-ঝস শব্দ। রাস্তাটা ওই জায়গায় একটু গড়ানে মতো। নুড়ি পাথরে সাইকেলের চাকা হড়কে যেতে পারে। উদয়ন যতক্ষণ না রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন ততক্ষণ সবাই গেটের সামনে। সে এক সুন্দর চিত্র। উদয়ন চলে যাওয়ার পর বাড়িটা যেন ফাকা-ফাঁকা হয়ে যায়। সকলেরই মনে একটা দুঃখ-দুঃখ ভাব। উদয়ন যতক্ষণ থাকেন, বাড়ি একেবারে জমজমাট। কখনও রবীন্দ্রসঙ্গীতের লাইন গাইছেন, কখনও চলতি হিন্দি গান। কখনও সাধারণ কথা কবিতার মতো করে বলছেন। কখনও জয়াকে রাগিয়ে দিচ্ছেন। জয়ের সঙ্গে ককফাইট করছেন। আবার শিবশঙ্করের সঙ্গে যখন গভীর কোনও আলোচনা করেন তখন আবার অন্য মানুষ। যখন ধর্মার সঙ্গে গাছের আলোচনা করেন তখন এক অভিজ্ঞ মালী। যখন উমার সঙ্গে রান্নার আলোচনা করেন তখন পাকা রাঁধুনি। যখন নিজের মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকেন তখন একেবারে শিশু। আকাশের মতো উদার এক মানুষ ডাক্তার উদয়ন চট্টোপাধ্যায়। আর শিবশঙ্কর হলেন সমুদ্রের মতো গভীর।

জয় আর জয়াদের স্কুলের পোশাক ধবধবে সাদা। রাজহাঁসের মতো। জয়া যখন ফ্রিল দেওয়া সাদা ফ্রকটা পরে জয় তখন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, দিদিটা কী সুন্দর ! লাহিড়িদের বাগানের শ্বেতপাথরের পরীটার মতো। আবার জয় যখন সাদা প্যান্ট, শার্ট, মোজা, জুতো পরে সামনে এসে দাঁড়ায়, জয়া ভাবে, ভাইটা তার কী সুন্দর! চার্চের দেবদূতের মূর্তিটার মতো।

ভাই বোন একা-একাই স্কুলে যায়। এখন তারা বড় হয়েছে। যাওয়ার পথে একে-একে আরও অনেক ছেলেমেয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। একটা দল তৈরি হয়। প্রথমেই পড়ে শিরিনদের বাড়ি। মেয়েটা জয়ার ক্লাসে পড়ে। ভীষণ ভাল নাচতে পারে। শিরিনের এক বুড়ি দিদা ছাড়া আর কেউ নেই। বাবা কাজ করতেন কয়লার খনিতে। বিশাল এক খনি দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান ; তখন শিরিন খুবই ছোট। আজ পাঁচ বছর হল শিরিনের মা মারা গেছেন। খুব কষ্টে সংসার চালাচ্ছেন শিরিনের দিদা। তিনি কারুকাজ করা মোমবাতি তৈরি করেন। চার্চের সুন্দর দোকানে সেই সুন্দর বাতি বিক্রি হয়। এক-একটার এক-এক রকম ডিজাইন। কোনওটা পরী, কোনওটা বৃদ্ধ, কোনওটা লতাপাতাজড়ানো স্তম্ভ! নানারকমের রং। দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। শিরিনের দিদা এইসব কাজ মিশনারি মেমসায়েবের কাছ থেকে শিখেছেন। এত খেটেও রোজগার তেমন হয় না। তাই বাড়ির জমিতে বাগান করেছেন। সবজি তো ফলেই, সেই সঙ্গে ফুল। সেরা গোলাপ ফোটে শিরিনদের বাগানে। বেতের ছোট-ছোট বাস্কেটে রাঁচিতে চালান যায়। ঠাণ্ডা গাড়ি এসে রোজ সকালে নিয়ে যায়। অবশ্যই ফুল ফোটার সিজ্নে।

শিরিনদের একটা কুকুর আছে। অনেক বয়েস তার। নাম আসমান। বাড়ির বাইরে উঠোনের একপাশে ছায়ায় শুয়ে থাকে সারাদিন। চোখ দিয়ে জল পড়ে। শুয়ে-শুয়ে অতীতের কথা ভেবে কাঁদে, যখন শিরিনের বাবা আর মা বেঁচে ছিলেন। যখন এই বাড়িতে আনন্দ ছিল। হাসি ছিল, গান ছিল। সেই সব দিনের কথা ভেবে কাঁদে। জয়া রোজই এই আসমানের জন্যে স্যান্ডউইচ করে আনে। জয়া এলেই আসমান বুঝতে পারে, এমন একজন কেউ এসেছে যে তাকে ভালবাসে।

আসমান টলমলে পায়ে উঠে দাড়িয়ে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দীর্ঘ ডাকটা ডেকে উঠল আকাশের দিকে মুখ তুলে। যার ভাষা হল, “দেবি, তুমি এসেছ! ভগবান তোমার মঙ্গল করুন।” আসমান জয়ার গায়ে গা ঘষছে আর তার চামরের মতো লেজটা এপাশে-ওপাশে আনন্দে দোলাচ্ছে। জয়া খাবার এনেছে সেইটাই একমাত্র কারণ নয়। জয়া ভালবাসা এনেছে। বৃদ্ধ অ্যালসেশিয়ানের চোখে জল। এ জল দূঃখের নয়, আনন্দের। শিবশঙ্কর শিখিয়ে দিয়েছেন, নাকের পাশ দিয়ে জল বেরোলে বুঝবে কাঁদছে, আর কানের দিক দিয়ে জল বেরোলে বুঝবে আনন্দের। সে মানুষই হোক আর পশুই হোক।

আসমানের এই ডাক শুনলেই শিরিন বুঝতে পারে জয় আর জয়া এসেছে। আকাশছোঁয়া এই ডাক আসমানের গলা দিয়ে অন্য সময় বেরোয় না। শিরিন বইয়ের ব্যাগ নিয়ে দালানে বেরিয়ে এল। ছোট্ট ছিমছাম একটা বাংলো। সামনে দুটো বড় ঘর। পেছনে ঢাকা বারান্দা। টালির গড়ানে ছাদ। পেছনের বারান্দায় শিরিনের দিদার মোমের কারখানা।

সাদা ফ্রকপরা শিরিনকে দেখলে জয় চমকে ওঠে। ধারালো ছুরির মতো চেহারা। মুখটা যেন মোম দিয়ে ছাঁচে ঢালাই করে দিয়েছেন শিরিনের দিদা। হরিণের মতো টলটলে চোখ। দিঘির মতো ছলছলে। হাত দুটো লম্বা-লম্বা। প্রায় হাঁটুর কাছ পর্যন্ত চলে গেছে। লম্বা-লম্বা চাঁপার কলির মতো আঙুল। ঘাড়ের কাছ পর্যন্ত ঝুমকো চুল। জয় অবাক হয়ে শিরিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। দিদি একরকমের সুন্দরী, শিরিন আর একরকমের। দিদি জলের মতো, শিরিন আগুনের মতো। প্রদীপের শিখার মতো।

জয়ার ব্যাগ থেকে একটা আই ড্রপসের ছোট শিশি বেরোল। নরম একটা ন্যাকড়া। আসমানের মুখটা ওপর দিকে তুলে ধরে জয়া দু’ চোখে ড্রপস দিয়ে দিল। তারপর নরম ন্যাকড়া দিয়ে চোখ দুটো মুছিয়ে বললে, “আমার লক্ষী ছেলে।” আসমান বললে, “ভৌ ঔ ঔ।” এ ভাষা জয়া বোঝে। জয়া বললে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি তো আমার লক্ষী ছেলে।” জয়া আসমানকে ফিশ-স্যান্ডউইচ খাওয়াতে লাগল। শিরিনের দিদা পা টেনে-টেনে ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। ধবধবে সাদা একটা শাড়ি পরে আছেন। গোলাপি রঙের পাড়। বৃদ্ধার শরীর ক্রমশই অচল হয়ে আসছে, কিন্তু মুখে উজ্জ্বল হাসি! এ-হাসি তাদেরই মুখে লেগে থাকে, জীবনের কাছে যারা পরাজিত হয় না।

জয়া জিজ্ঞেস করল, “দিদা, আজকের রান্না হয়ে গেছে?”

“হ্যাঁ মা।”

“কে রাঁধল?”

“শিরিনই সব করে আজকাল, আমার শরীরে আর তেমন জোর পাই না। আমি এইবার আমার বাতির কাজ নিয়ে বসব। দেখছ না, আকাশ কেমন নীল হয়েছে। পুজো এসে গেল।”

“কে সাহায্য করবে?”

“নিজেকেই নিজে সাহায্য করব। গড হেল্প দোজ, হু হেল্প দেমসেল্ভস, আমার গুরু বলতেন।”

জয়া আসমানকে বললে, “যাও, খাওয়া হয়ে গেছে, এইবার লক্ষী ছেলে হয়ে আবার শুয়ে পড়ো। দিদাকে দেখবে, কেমন?”

তিনজনে পথে নেমে এল। ঝাঁঝালো রোদ। পথের নুড়িগুলো ব্রাশকরা দাঁতের মতো ঝকঝকে হাসছে। পিচফলের মতো আকাশ। চার্চের চুড়াটা ছবির মতো। তিনজনে স্নেক বেন্ডের কাছে এসে দেখল, দূর থেকে বিশাল এক মোটর সাইকেল চেপে একজন সায়েব আসছেন। লাল রঙের মোটর সাইকেল। এত বড় গাড়ি তারা আগে কখনও দেখেনি। এই সায়েবই বা কে? চার্চের কেউ নন তো!

॥ ৪ ॥

সেই লাল, প্রায় একতলা উঁচু মোটর সাইকেল বাঘের মতো এগিয়ে আসছে। লাল টকটকে, দৈত্যের মতো একজন মানুষ তার আরোহী। সোনালি চুল বাতাসে ফরফর করে উড়ছে। জয়, জয়া আর শিরিনদের সামনে এসে গাড়িটা ঝপ করে থেমে গেল।

সায়েব বললেন, “গুড মরনিং মাই বয়েজ। ”

কেউ ইংরেজি বললে জয়ের ভীষণ ভাল লাগে। সে নিজেও দু-চারটে ইংরেজি বলতে পারে। শিবশঙ্কর ইংরেজিতে কথা বলা শেখান। ভুল হোক ক্ষতি নেই, ঝরঝর বলে যাবে। ইংরেজি না জানলে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে হবে।

জয় বলল, “গুড মরনিং। হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?”

সায়েব হেসে বললেন, “ভেরি গুড। আমি অল্প-অল্প বাংলা বলতে পারে। শিবশঙ্করবাবুর বাংলোয় যেতে চায়। সে আর কোতো দূর?”

জয় বলল, “তিনি আমার দাদু, গ্র্যাণ্ড ফাদার। এই রাস্তার শেষে সেই বাংলো, আর এক কিলোমিটার গেলে পেয়ে যাবেন।”

“তোমরা স্কুলে যাচ্ছে?”

“ইয়েস আঙ্কল।”

জয় আঙ্কল বলায় সায়েব ভীষণ খুশি। সামনের দিকে একটা বাক্স। সেই বাক্সে হাত ঢুকিয়ে বড় একটা প্যাকেট বের করে জয়ের হাতে দিয়ে বললেন, “লজেন্স। এনজয় ইট ইন ইয়োর ক্লাস।” সায়েব হাত নেড়ে গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেলেন। জয় দেখল লজেন্সের প্যাকেটের গায়ে লেখা, ‘জার্মানি’। সায়েব তা হলে জার্মান। দাদুর কোনও এক সময়ের বন্ধু হয়তো। স্কুল থেকে বাড়ি না ফিরলে রহস্য পরিষ্কার হবে না। যেমন সায়েব, তেমনই তার গাড়ি।

জয় শিরিনের হাতে প্যাকেটটা দিয়ে বলল, “তুই ভাগ করে দিস।”

শিরিন আর জয় সমবয়সী। একই ক্লাসে পড়ে। পাশাপাশি বসে।

শিরিন অবাক হয়ে বলল, “আমাকে দিচ্ছিস কেন? জয়াদি ভাগ করে দেবে।”

জয়া প্রশংসার চোখে ভাইয়ের দিকে তাকাল, যার অর্থ, ঠিক করেছিস ভাই। তোর শিক্ষাটা ঠিক-ঠিক হয়েছে। এইভাবেই পরকে আপন করে নিতে হয়। দাদু শিবশঙ্কর যেমন বলেন, গোটা পৃথিবীটাই তোমার সংসার। সবাই তোমার আত্মীয়। সকলকেই ভালবাসতে শেখো, আপন করে নিতে শেখো। দাদু শিবশঙ্কর প্রায়ই একটা সংস্কৃত বলেন, বসুধৈব কুটুম্বকম্। কোনও কোনও জিনিস আছে, যতই করিবে দান তত যাবে বেড়ে। সেই জিনিস হল, শিক্ষা আর ভালবাসা।

তিনজন পথ হাঁটছে। জয় আগে-আগে। সে আস্তে হাঁটতে পারে না। লাফিয়ে চলে। পথের দু’ পাশে অনেক আকর্ষণ। রোজই দেখে তবু পুরনো হয় না । রসকষহীন বাবলাগাছ। মজার গাছ। শাখা-প্রশাখা আছে। পাতা আছে, কাঁটা আছে, কিন্তু ঘন ছায়া নেই। তরল ছায়া। ছোট-ছোট বেতগাছ। সেই গাছে আবার ছোট-ছোট থোকা-থোকা ফল। নানারকমের ফার্ন। হরেক রঙের নুড়ি। বহুরকমের পোকা। কচ্ছপের মতো এক ধরনের ছোট-ছোট পোকা আছে। পিঠটা তেলা, নানারকমের রঙের বাহার। সোনার রঙের মাছি। গেরুয়া রঙের ফড়িং। জয় বিভোর হয়ে যায়।

সরলা নদীর ধার দিয়ে পথ চলে গেছে। চড়া রোদে জল ঝলমল করছে। বালির কণা আগুনের মতো জ্বলছে। চোখে ধাঁধা লেগে যায়। মাথা ঝিমঝিম। ওই পথ ধরে কিছু দূর এগোলেই স্কুলবাড়িটা চোখে পড়ে। বিশাল একটা গম্বুজ। তার মাথায় হাওয়া-মোরগ। বড়-বড় অক্ষর বসানো গোল একটা ঘড়ি। স্কুলবাড়িকে ছায়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে বড়-বড় গাছ। শিশু, অর্জুন, দেবদারু। বাতাসের সাঁই-সাঁই শব্দ। স্কুলের পাশে সরলা নদী ধাপ ভেঙে ঝরনার মতো হয়েছে। ঝিরঝির শব্দ সারাদিন। পাথরের খাঁজে-খাঁজে মাছের ঘুরপাক। এই দিকের সব মানুষই জৈন ধর্মাবলম্বী। কেউ মাছ-মাংস খায় না। তাই মাছেরা নির্ভয়ে সাঁতার কাটে।

পাঁচিল-ঘেরা স্কুলবাড়ি। লোহার গেট কারুকার্য-করা। সাদা নুড়ি বিছানো পথ সবুজ ঘাসে ঢাকা একটা জমিতে গিয়ে শেষ হয়েছে। ছেলেমেয়েরা ক্লাসে যাওয়ার আগে এইখানে সমবেত হয় প্রার্থনা করার জন্য। পরিচালনা করেন স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল, স্টিফেন্স সায়েব। বড় মিষ্টি মানুষ। কখনও কড়া কথা বলেন না। বেত ব্যবহার করেন না। কেউ কোনও অন্যায় করলে নিজেকে শাস্তি দেন। এতে ছেলেমেয়ে, এমনকী শিক্ষকরাও লজ্জা পেয়ে যান। পরের বার অন্যায় করার সময় ভাবতে হয়, গম্ভীর এক মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় রোদে দাঁড়িয়ে থাকবেন।

দু’শোর মতো ছেলেমেয়ে সবুজ মাঠে। তাদের সাদা পোশাক। সবাই সার বেঁধে দাঁড়িয়ে। পামগাছের পাতার ছায়া জমির ওপর কাঁপছে ঝিরিঝিরি করে। চারপাশে ফুলের বেড। পিটার দাঁড়িয়ে আছেন অ্যাকর্ডিয়ান নিয়ে। পিটার বড় মজার মানুষ। দক্ষিণ ভারতের বড় একটা সাকার্স দলে ছিলেন তিনি। সব ছেড়ে চলে এসেছেন। ছেলেমেয়েদের অ্যাথলেটিক্স শেখান। মাঝে-মাঝে আউটিং-এ নিয়ে যান। স্কাউটিং শেখান। নীল পাহাড়ের জঙ্গলে তখন তাঁবু পড়ে। রাতে ক্যাম্প-ফায়ার। অ্যাকর্ডিয়ান বাজিয়ে গান। আগুনে মেটে আলু পুড়িয়ে নুন দিয়ে খাওয়া। আসছে সেই সব দিন। শরতের পরেই আসবে হেমন্ত। রোদ আরও নরম হবে। শীতের হাওয়ায় লাগবে নাচন আমলকীর ওই ডালে ডালে।

পিটারের অ্যাকর্ডিয়ান বেজে উঠল অর্গানের সুরে। গানের প্রথম লাইন জয়াই ধরে। তারপর আর সকলে :

আলোয় আলোকময় করে হে এলে আলোর আলো।

আমার নয়ন হতে আধার মিলালো মিলালো ॥

সকল আকাশ সকল ধরা আনন্দে হাসিতে ভরা,

যে দিক-পানে নয়ন মেলি ভালো সবই ভালো! ॥

এই গানটা জয়ের ভীষণ ভাল লাগে। গাইতে গাইতে সে বিভোর হয়ে যায়। আলো শুধু আলো, চারপাশে আলোর আঁচল উড়ছে। অ্যাকর্ডিয়ানের একটানা গম্ভীর সুর। পামগাছের পাতার খসখস শব্দ। পাখির ডাক। সমবেত কণ্ঠ :

তোমার আলো গাছের পাতায় নাচিয়ে তোলে প্রাণ।

তোমার আলো পাখির বাসায় জাগিয়ে তোলে গান ॥

তোমার আলো ভালোবেসে পড়েছে মোর গায়ে এসে

হৃদয়ে মোর নির্মল হাত বুলালো বুলালো ॥

প্রার্থনা শেষ হয়ে গেল। প্রিন্সিপ্যাল সায়েব এইবার একে-একে সকলের পোশাক পরীক্ষা করছেন। সামান্য ময়লা থাকলে তাকে আর ক্লাস করতে দেবেন না। দাঁত আর নখও পরীক্ষা করবেন। ময়লা পোশাক, বড় নখ, নোংরা দাঁত নিয়ে কেউ তাই আসে না। ভয় পায় ভীষণ। স্টিফেন্স সায়েব বলেন, “ক্লিনলিনেস ইজ নেক্স্ট টু গডলিনেস।’

ক্লাসরুমের দরজা ঝকঝকে পালিশ করা। প্রতিটি বেঞ্চ, হাইবেঞ্চ ঝকঝক করছে। কেউ ছুরি দিয়ে নাম লেখার চেষ্টা করে না। মেঝে মুখ দেখার মতো পরিষ্কার। এই স্কুল প্রত্যেকের গর্ব। মাস্টারমশাইয়ের টেবিলে ফুলদানিতে ফুল। সমস্ত জানলা খোলা। আকাশের নীল যেন আবিরের মতো ঘরে উড়ে-উড়ে আসছে।

শিরিন আর জয় একই বেঞ্চে পাশাপাশি বসে। জয় শিরিনকে ভীষণ ভালবাসে। তার অল্প লালচে চুল। খাড়া নাক, ধারালো চোখ। লম্বা-লম্বা হাতের আঙুল। পাকা পেয়ারার মতো গায়ের রং। তার বসার ধরন, কথা বলার ভঙ্গি, জয় যত লক্ষ করে ততই অবাক হয়ে যায়। শিরিন যেদিন ক্লাসে আসে না, সেদিন জয় মনমরা হয়ে থাকে।

তাদের স্কুলের সব ক্লাসেই অদ্ভুত একটা ব্যাপার হয়। মাঝে-মাঝেই শিক্ষক এসে বলেন, আজ আর আমি পড়াব না, আজ তোমাদের পড়াবে—যে-কোনও একজন ছেলে বা মেয়ের নাম বলবেন, তাঁর ইচ্ছামতো। ভয় পেলে চলবে না। তরতর করে ডায়াসে গিয়ে উঠতে হবে। অভিজ্ঞ একজন শিক্ষকের মতো পড়াতে হবে। মাস্টারমশাই একপাশে চুপ করে বসে শুনবেন।

আজ প্রথমেই ইতিহাসের পিরিয়ড। ক্লাসে এলেন সরলবাবু। লম্বা, ফিনফিনে মানুষ। চোখে ভারী চশমা। নিখুঁত সাজপোশাক। ওলটানো চুল। ফরসা রং। ভীষণ শান্ত মেজাজ। চেয়ারে বসলেন। ক্লাসের সবাই দাঁড়িয়ে উঠেছিল, তারাও বসে পড়ল। সরলবাবু সকলের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। হাসিটা ভারী মিষ্টি। জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা সবাই ভাল আছ?”

সকলে একসঙ্গে বলে উঠল, “হ্যাঁ সার। আপনি কেমন আছেন?”

“তোমরা ভাল থাকলে আমিও ভাল থাকতে বাধ্য।”

ক্লাসের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “আজ জয় তোমাদের ক্লাস নেবে। জয়, কাম হিয়ার, টেক দি ক্লাস। আজ তোমার বিষয় হল, কেন আমরা ইতিহাস পড়ব!”

জয় প্রথমটায় একটু ঘাবড়ে গেল। ইতিহাস পড়ে। কিন্তু কেন পড়ে! হঠাৎ মনে হল, দাদু, শিবশঙ্কর বলেছিলেন, “কোনও অবস্থাতেই ঘাবড়াবে না। ভয়কে জয় করতে পারলেই সব কাজ সহজ। নিজেকে প্রশ্ন করলেই জবাব আপনি পাবে। তোমার মনই উত্তর দেবে।”

শিরিন হেসে ইশারা করল, “যাও।”

জয় এমনিতে ভীষণ স্মার্ট। টকটক করে ডায়াসে গিয়ে উঠল। মাথা নিচু করে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ সার!” এইসব আদব-কায়দা এই স্কুলের সবাই জানে। জয় ক্লাসের দিকে তাকিয়ে বলল, “গুড মরনিং ফ্রেণ্ডস—আজ আমাদের প্রশ্ন হল, কেন ইতিহাস পড়ব! অতীতকে জানার জন্যে ইতিহাস পড়ব। ইতিহাস পড়তে আমার কেমন লাগে? ভীষণ ভাল লাগে। আমি আমার দাদুকে জিজ্ঞেস করি, দাদুর বাবার কী নাম ছিল, তাঁর বাবার নাম। আমি ক্রমশই পেছোতে থাকি। একসময় আমার দাদু হেরে যান। আর বলতে পারেন না। আমি জিজ্ঞেস করি, এখানে আসার আগে আমরা কোথায় ছিলুম। আমার দাদু দু’শো বছর পর্যন্ত পেছোতে পারেন, যখন আমরা হুগলিতে ছিলাম, তারপর আর পারেন না। এই যে আমার জানতে ইচ্ছে করে, অনেক, অনেক বছর আগে কী হয়েছিল, কী হত, এই জানতে ইচ্ছে করে বলেই ইতিহাস পড়ি। ইংরেজ আসার আগে ভারতে কারা ছিলেন, শক, হুন দুল, মোগল, পাঠান, আমি জানতে চাই, তাই ইতিহাস পড়ি। পলাশিতে সিরাজের সঙ্গে ক্লাইভের কী হয়েছিল আমার জানা দরকার, কীভাবে আমরা পরাধীন হলুম। সব কিছুরই ইতিহাস আছে, মোটরগাড়ির, প্লেনের, কামানের, বন্দুকের, এমনকী দাঁত মাজার ব্রাশের। ইতিহাস আমাদের পিতা।”

সরলবাবু উঠে এসে জয়কে জড়িয়ে ধরে বললেন, “স্পেল্নডিড। সুন্দর বলেছ। শনিবার আমাদের গেট টুগেদারে আই প্রমিস ইউ এ প্রাইজ।”

এই স্কুলে সকলকে ফ্রি লাঞ্চ দেওয়া হয়। সেও বেশ মজার ব্যাপার। ঝকঝকে একটা ট্রলি। তার ওপর বিশাল এক পাত্রে গরম স্যুপ। পাউরুটির ভাজা টুকরো। কাঠের একটা হাতা। গাড়িটা ঠেলতে-ঠেলতে নিয়ে আসছেন পিটার। তাঁর মাথায় সাদা চোঙা টুপি। স্যুপটা তিনিই তৈরি করেন। স্যুপের একটা গানও আছে, “সুইম ইন মাই স্যুপ বাট নেভার গেট ড্রাউন্ন্ড।”

॥ ৫ ॥

সেই লাল মোটর সাইকেল বাগানের একপাশে বিশ্রাম করছে। জয় আর জয়া গেট খুলে বাগানে ঢুকতে- ঢুকতে দেখতে পেল। সেই সায়েব তা হলে এসেছেন। বিরাট মোটর সাইকেলটার সামনে ভাইবোন দাঁড়িয়ে পড়ল। বিস্ময়কর জিনিস! লেখা আছে, হোন্ডা। বহু দেশের পতাকার স্টিকার লাগানো। সামনে-পেছনে, পাশে বড়-বড় বাক্স ফিট করা। হাতলটা এত চওড়া যে, দৈত্যের মতো মানুষ না হলে দু’ হাত ফাঁক করে ধরতে পারবে না। মোটর সাইকেল নয় তো, যেন নিরেট শক্তি। জয় পাশে দাঁড়িয়ে নিজেকে একবার মেপে নিল। আরও অনেক বড় হতে হবে।

বসার ঘর থেকে হাহা হাসির শব্দ ভেসে আসছে। বাড়ি একেবারে জমজমাট। সায়েবের বুট জুতো বারান্দায় খোলা রয়েছে। সেটাও দেখার মতো। উঁচু হিল। একগাদা বকলস লাগানো বিচিত্র এক জিনিস !

বসার ঘরে ঢুকতেই সায়েব হইহই করে উঠলেন, “এসো, এসো, আমার নাতি এসো, আমার নাতনি এসো।” শিবশঙ্করের কাছ থেকে শব্দ দুটো সকালেই শিখেছেন জয় হ্যান্ডশেক করার জন্য ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল। সায়েবের বিশাল পাঞ্জার মধ্যে টুনটুনি পাখির মতো ঢুকে গেল। লোহার মতো শক্ত হাত। চাপ দিয়ে নারকোল ফাটাতে পারেন।

শিবশঙ্কর বললেন, “আমার বন্ধু ম্যানফ্রেড। আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। আমার চেয়ে অনেক বড় এঞ্জিনিয়ার। জার্মানি থেকে ওই মোটর সাইকেলে চেপে চলে এসেছে। সাহসটা একবার ভাবো! তোমাদেরও ওইরকম সাহসী হতে হবে ।”

ম্যানফ্রেড বললেন, “আরে তুমি কী বলছ! তোমার মতো এঞ্জিনিয়ার ভারতে ক’জন আছে! আমি তো তোমার কাছে লোড ডিস্ট্রিবিউশান, সেন্টার অব গ্র্যাভিটি শিখেছি। ইউ আর মাই গুরু। আর সাহস! তোমার চেয়ে বেশি সাহস আমার নেই। তুমি বর্ষার নদীতে যেভাবে পিলার তৈরি করেছ, আমাদের সাহসে কুলোত না। অসমের জঙ্গলে তুমি পাগলা হাতিকে ভয় পাওনি। কোনও কিছুর সাহায্য না নিয়ে তুমি যেভাবে পাহাড়ে চড়তে, আমরা ইউরোপিয়ানরা তা ভাবতেও পারব না কোনওদিন। আমার মতো সাহসী হতে না বলে, বলো তোমার মতো সাহসী হতে। ”

শিবশঙ্কর বললেন, “যাও, তোমরা ড্রেস চেঞ্জ করে জলখাবার খেয়ে এসো। আমরা ততক্ষণ দুই বন্ধুতে গল্প করি।”

ছড়ছড় শব্দ করে সামনের পাথুরে পথ ধরে গোরুর পাল ঘরে ফিরছে। সন্ধে নামছে। ধর্ম ইঁদারা থেকে জল তুলে বাগানে ঢালছে। নালিতে-নালিতে জল বইছে কুলকুল শব্দে। ধর্মার মেয়ে গৌরী গান গাইছে আপন মনে। সন্ধেবেলায় মেয়েটার ভাব আসে, তখন গান গায় সুরেলা গলায়। যা মনে আসে তাই গায়। শুনতে ভালই লাগে। সাঁঝের পাখিদের কিচিরমিচির জলসা, গোরুর হাম্বা, জলের কুলকুল শব্দ, গৌরীর গান। একটা মায়াবী পরিবেশ।

বসার ঘরে মাউথ অর্গান বেজে উঠল। ম্যানফ্রেড বাজাচ্ছেন বিলিতি সুর। বাড়ি একেবারে জমজমাট। উদয়ন হাসপাতাল থেকে ফিরছেন সাইকেল করে। দূর থেকে বাড়িটা দেখতে পাচ্ছেন। জানলায়-জানলায় আলো। গেট খুলে ঢুকতে-ঢুকতে মাউথ অগানের শব্দ পেলেন। চোখে পড়ল বিশাল মোটর সাইকেলটা। গেট খোলার শব্দ পেলেই জয় আর জয়া ছুটে আসে। একদিনও ভুল হয় না। জয়া কেরিয়ারের পেছন থেকে বাবার অ্যাটাচিটা খুলে নেয়। বাবা ফেরা মানেই ভীষণ আনন্দ।

উদয়ন মোটর সাইকেলটা দেখিয়ে বললেন, “কে এসেছেন?”

জয় বললে, “দাদির অনেকদিনের বন্ধু ম্যানফ্রেড সায়েব। জার্মানি থেকে এসেছেন এই মোটর সাইকেলে চেপে। এখন মাউথ অর্গান বাজাচ্ছেন।”

“ম্যানফ্রেড এসেছেন? বলিস কী! গ্রেট ম্যান।”

“তুমি চেনো?”

“চিনব না? ভারতবর্ষে থাকার সময় আমাদের এখানে প্রায়ই আসতেন। ”

উদয়ন বসার ঘরে ঢোকামাত্রই সায়েব হইহই করে উঠলেন, “হ্যালো ডক্টর। আফটার সো মেনি ইয়ার্স। হাউ আর ইউ মাই সান?”

“আমি ভীষণ ভাল আছি। আপনি?”

“আমিও ভাল। আমি এখন একজন গ্লোবট্রটার। সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াই, আর আমাদের দেশের কাগজে ফিচার লিখি। আই ডোন্ট কেয়ার মাই এজ। আমি বীর।”

‘বীর’ বলে সায়েব অদ্ভুত একটা ভঙ্গি করলেন। সবাই হোহো করে হেসে উঠলেন। দমকা বাতাস ঘরে ঢুকল শিউলির গন্ধ নিয়ে। ফুল ফুটতে শুরু করেছে। ফুল কখনও ভুল করে না।

জয় আর জয়ার মা উমা অদ্ভুত নিয়মে চলেন। তিনি বলেন, সকলের সব কাজ শেখা উচিত। করা উচিত। শুধু লেখাপড়া নিয়ে থাকলেই হবে না, সংসারের কাজও শিখতে হবে। মানুষ গাছতলায় থাকে না, পাঁচতারা হোটেলে থাকবে না। তাকে সংসারেই থাকতে হবে। তাই জয়াকে সন্ধেবেলায় ঘন্টাখানেকের জন্য রান্নাঘরে ঢুকতে হয়। মা তাকে রান্না শেখান। উমা নিজে গ্র্যাজুয়েট। লেখাপড়ায় সেরা ছাত্রী ছিলেন, আবার ভীষণ ভাল ছবি আঁকেন। রবীন্দ্র, নজরুল, অতুলপ্রসাদের গানে ওস্তাদ। রান্নায় যে-কোনও সেরা হোটেলের বাবুর্চিকে হার মানিয়ে দেন।

রান্না শিখতে জয়ার বেশ ভালই লাগে। বিরক্ত হয় না। সায়েবকে মাছের কচুরি খাইয়ে অবাক করা হবে। তারই আয়োজন চলেছে। উমা জয়াকে শেখাচ্ছেন কী করে চামচে দিয়ে মাছ থেকে কাঁটা আলাদা করে ফেলতে হয়। উমার নির্দেশে গৌরীর মা একপাশে বসে মসলা তৈরি করছে। আর একদিকে কাপড় জড়ানো ময়দার তাল একটু-একটু করে ফুলছে।

জয়কে সন্ধের পরেই পড়তে বসতে হয় ঠাকুমার ঘরে। ঘরটা বেশ বড়। একপাশে খাট। বিছানায় একটা কালো কম্বল পাতা। ঠাকুমা তার ওপর বসে মালা জপ করেন। দক্ষিণ দিকে জানলার কাছে টেবিল। পরী ধরে আছে টেবিল আলো। জানলার বাইরে বাগান। ঘরে একটা ধূপের গন্ধ ঘুরপাক খাচ্ছে। বড় শান্ত এই ঘর। পুব দিকের জানলার কাছে আর-একটা টেবিল। সেটা দিদির। সেই টেবিলে পাথরের তৈরি মা-সরস্বতীর ছোট্ট সুন্দর একটা প্রতিমা আছে। দিদি রোজ ফুল দিয়ে সাজায়। এই টেবিলে মাঝারি মাপের হাঁস-টেবিল ল্যাম্প। টেবিল সাজানো নিয়ে ভাইবোনে জোর প্রতিযোগিতা। কে কত ভালভাবে সাজিয়ে রাখতে পারে। জয়ের টেবিলে একটা পাখির বাসা আছে। তার মধ্যে ডিমের মতো দেখতে সাদা-সাদা পাথর। এক ঝড়ের বিকেলে জয় বাসাটা কুড়িয়ে পেয়েছিল শিশুগাছের তলায়। সেই থেকে বিস্ময়কর বাসাটা খুব যত্নে আছে জয়ের টেবিলে। টেবিল সাজানোর প্রতিযোগিতায় জয় দিদির সঙ্গে কিছুতেই পেরে ওঠে না। জয়া ভালসা কাঠ দিয়ে সুন্দর তিনতলা একটা বাড়ি তৈরি করেছে। সেই বাড়ির বারান্দা আছে। বাইরে থেকে ওপরতলায় ওঠার সিঁড়ি আছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ছোট একটা মেয়েপুতুল। মাঝে-মাঝে সেই বাড়ির ভেতর আলো জ্বলে ওঠে। আলোর কায়দাটা দাদি করে দিয়েছেন।

সারাদিন হুটোপাটি হয় খুব, তাই বই খুলে বসার পর জয়ের চোখে ঘুম ঢুলে আসে। তখন সে ছোট্ট একটা ডিবে খোলে। ডিবেটা দিয়েছে শিরিন। ডিবের মধ্যে নস্যি আছে। আঙুলের ডগায় সামান্য একটু নিয়ে চোখে ঘষে দেয়। হুহু করে জল বেরোতে থাকে, ঘুম ছুটে যায়। শিরিন জয়কে এই কায়দাটা শিখিয়েছে। শিবশঙ্কর অবশ্য জয়কে বলেছেন, ঘুম পেলে একটু দৌড়োদৌড়ি করে আসবে, ঘুম ছেড়ে যাবে। জয় করে কোনও ফল পায়নি। বাবা বলেছেন চোখে ঝাপটা মারবি। তাতেও কিছু হয় না। শিরিনের দাওয়াইটাই অব্যর্থ। ঘুম বেশ কিছুক্ষণের জন্যে ছিটকে পালায়।

জয় ইংরিজি দিয়ে শুরু করেছে। মন ছটফট করছে। বসার ঘরে কত কী কাণ্ড হচ্ছে। কত গল্প। কত দূর থেকে একজন মানুষ এসেছেন কত গল্প নিয়ে। আজ পড়ায় মন বসছে না। ঠাকুমা জয়কে লক্ষ করছিলেন। বললেন, “মন চঞ্চল হয়েছে দাদাভাই?”

“একটু, একটু। বসার ঘরে যেতে ইচ্ছে করছে।”

“ম্যানফ্রেডদাদু কয়েকদিন থাকবেন। আগে কালকের পড়া। মনটাকে যে বাঁধতে হবে দাদাভাই। সেইটাই যে আসল সাধনা। খেতে বসে গল্প হবে। খাওয়ার পর গল্প হবে। এখন মন দিয়ে পড়ো।”

মন স্থির করার একটা কায়দা ঠাকুমা শিখিয়ে দিয়েছেন জয়কে। জয় টেবিলের ড্রয়ার থেকে সেইটা বের করল। জিনিসটা আর কিছুই নয়, সাদা একটা কার্ড, তার মাঝখানে সবুজ একটা টিপ। তিন হাত দূরে চোখের সামনে রেখে এক দৃষ্টিতে সেই সবুজ ডটটার দিকে তাকিয়ে থাকা। জলে চোখ ভরে আসবে, তখন চোখ বুজিয়ে ফেলে দুই ভুরুর মাঝখানে নাকের ওপর কপালের কাছে সেই বিন্দুটাকে দর্শন। দেখতে-দেখতে ধীরে-ধীরে নিজের মধ্যে নিজে তলিয়ে যাওয়া। এই কায়দাটা জয়ের ভীষণ ভাল লাগে। ভেতরটা তখন সমুদ্রের মতো শান্ত, গভীর হয়ে যায়। মনে হয় রুপোর মতো সাদা চাঁদের আলোয় বসে আছে। ঠাকুমার হাতে জপের মালা নিঃশব্দে ঘুরে চলেছে। রান্নাঘর থেকে উত্তম রান্নার গন্ধ ভেসে আসছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই জয়া এসে তার টেবিলে হাঁস-আলো জ্বেলে বসে পড়ল। নীল ফ্ৰকপরা দিদির ঘাম-ঘাম মুখের দিকে জয় একবার তাকাল। এইবার জয়ের পড়াটা খুব জমে যাবে। দিদির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পড়বে। জয়া খাতা খুলে খসখস করে লিখতে-লিখতে ঠাকুমাকে বললে, “তোমার ওষুধ খেয়েছ?”

ঠাকুমা অপরাধীর মতো মুখ করে বললেন, “আজও ভুলেছি।”

“তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না ঠাম্মা। একদিন খাও, তো একদিন খাও না।”

“ওষুধ দেওয়ার দায়িত্ব তো তোর!”

“দেখছ তো আজ রান্নাঘরে এলাহি ব্যাপার। নিজে নিয়ে একদিন একটু খেতে পারলে না! ওষুধ খেলে কার অসুখ ভাল হবে?”

“আমার। কিন্তু দিদিভাই ওষুধটা তুমি হাতে করে না দিলে আমার যে তেমন কাজ হয় না। তুমিও ভুলেছ, আমিও ভুলেছি। ”

ছ’ ফুট লম্বা বিশাল ম্যানফ্রেড ঘরে ঢুকে বললেন, “হ্যাল্লো, গ্র্যান্ড ওল্ড লেডি! স্বর্গসুখ উপভোগ করছ?”

ঠাকুমা বললেন, “এই স্বর্গ মানুষের তৈরি। আপনি বসুন।”

সায়েব একটা চেয়ারে বসলেন। জয়া ততক্ষণে ঠাকুমার বিস্ময়কর ওষুধের আলমারিটা খুলে ফেলেছে। ভেতরে ওষুধের জার, বয়াম, কৌটো। অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধ ঘরে ছড়িয়ে পড়ল।

সায়েব বললেন, “ওয়ান্ডারফুল! এটা কিসের ট্রেজার হাউস?”

“আয়ুর্বেদিক মেডিসিন্স।”

জয়া সুন্দর একটা কড়ির পাত্র থেকে ছোট্ট একটা গুলি বের করে খলে ফেলে মধু দিয়ে মাড়তে শুরু করল। খল আর নুড়ি একসঙ্গে ঠাকুমার সামনে ধরল। তিনি চেটে-চেটে খেয়ে ফেললেন।

সায়েব প্রশ্ন করলেন, “এফেক্ট?”

“বুকে সর্দি বসতে পারে না। ফুসফুস পরিষ্কার থাকে।”

ম্যানফ্রেড জয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “জাস্ট লাইক অ্যান এঞ্জেল?”

॥ ৬ ॥

বসে আছেন সায়েব। সামনের দেওয়ালে আদ্যিকালের দেওয়ালঘড়ি। পেন্ডুলামটা বিশাল। ধীরে দোলে। এত ধীর, যেন সেকেন্ড, মিনিটের তোয়াক্কাই নেই। সায়েব ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে বললেন, “টাইম ইউ ওল্ড জিপসি ম্যান। কবে জীবন শুরু করেছি খেয়ালই নেই। আজও চলেছি, আরও কতদিন চলব। পৃথিবীটা এখনও আমার কাছে পুরনো হল না। সব সময় নতুন। আই লাইক ইট। আই লাইক ইট ভেরি মাচ।”

ঠাকুমা বললেন, “আমিও তো বুড়ি হয়েছি, আমারও খুব ভাল লাগে। আরও অনেক, অনেকদিন বাঁচতে ইচ্ছে করে। জয়, জয়া বড় হবে। মানুষ হবে। সেইসব দেখে যেতে ইচ্ছে। ওরাই আমার স্বপ্ন।”

“আমি যে-ক’দিন আছি তার মধ্যেই ওদের আমি কিছু ভাল জিনিস শিখিয়ে যাব যা ওদের জীবনে খুব কাজে লাগবে। না আমি যাই, ওরা পড়ছে। পরে কথা হবে।” ম্যানফ্রেড বেরিয়ে গেলেন।

জয় প্রশ্ন করল, “দিদা বলতে পারো কী করে অমন লম্বা হওয়া যায়!”

উত্তর দিল জয়া, “পারি, গাছের ডাল ধরে রোজ ঘন্টাখানেক ঝুলে থাকলে তুই দশ বছরে ওইরকম লম্বা হয়ে যাবি। ”

ঠাকুমা বললেন, “শুনেছি রিং করলে অমন লম্বা হওয়া যায়। আমার বাবাকে করতে দেখেছি। তিনি বেশ লম্বা ছিলেন।”

জয়া বলল, “লম্বা হয়ে তোর কী লাভ হবে?”

“বেশ অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পাব। কেমন মজা হবে!”

জয়া বলল, “বকবক না করে কালকের পড়াটা করে নাও খোকা।”

“আমার পড়া হয়ে গেছে দিদি।”

“ওরে আমার বিদ্যাসাগর! বসতে না বসতেই পড়া হয়ে গেল। ”

“তুই আমাকে একটা অঙ্ক দেখিয়ে দিবি দিদি!”

“এই তো পথে এসো। এখনও তোর অঙ্ক হয়নি। চলে আয় টেবিলে। ”

জয় খাতা নিয়ে দিদির টেবিলে গেল। মাঝে-মাঝে জয়ের অঙ্ক আটকে যায়। দিদির পাশে চেয়ার টেনে বসতে-বসতে জয় প্রশ্ন করল, “দিদি, লম্বা হলে মাথা খোলে রে!”

“খুলতে পারে, আবার নাও খুলতে পারে। মাথা একটা আলাদা জিনিস।”

“মাথার জন্যে কী করা উচিত?”

“মাথাকে খাটাতে হয়। যেমন ধর তোর এই অঙ্কটা, কুড়িটা গুলি সাতজনের মধ্যে সমান ভাগ করে দিতে হবে, কীভাবে করবি?”

“অনেকক্ষণ মাথা খাটিয়ে দুটো রাস্তা পেয়েছি।”

“পেয়েছিস? কী কী রাস্তা!”

“কুড়িটা গুলি সাতজনের মধ্যে সমান ভাগ করা যায় না, একুশটা হলে যেত।”

“তা হলে কী করবি।”

“এক নম্বর সমাধান, ভাগ না করা। বুঝিয়ে বলা, ভাই! কিছুদিন অপেক্ষা করো, আর-একটা গুলি জোগাড় করতে পারলেই তোমাদের সমান ভাগে ভাগ করে দেব। তোমরা আজ শুধু দেখে রাখো। দু’ নম্বর সমাধান, সাতজনের দু’জনকে বুঝিয়ে-বাঝিয়ে সরিয়ে দেওয়া, গুলি বাজে জিনিস, গুলি খেললে লেখাপড়ার ক্ষতি। তোমরা ভাল ছেলে হবে, বড় হবে, মানুষ হবে। তোমাদের কি গুলি-গুলি করা উচিত? দু’জনকে কাটাতে পারলেই, রইল পাঁচজন। হাতে কুড়িটা গুলি। তখন প্রত্যেককেই চারটে করে দেওয়া যাবে।”

জয়া ভাইকে জড়িয়ে ধরে গালে একটা চুমু খেল। ফোলাফোলা ঠাণ্ডা গাল, দৃষ্টদুষ্টু দুটো চোখ। জয় দিদির বুকে মাথা গুঁজে বলল, “দিদি হল রে! হল না।”

“খুব হল। অঙ্ক না হয়ে ম্যানেজমেন্ট হল। যদি তোকে বলা হয় সমান ভাগে ভাগ নয়, শুধু ভাগ করে দাও, তা হলে কতরকমে ভাগ করবি!”।

জয় সোজা হয়ে বসল, এ আর-এক সমস্যা। সাতজনকে দুটো করে দিলে হাতে থাকে ছ’টা। তারপর! আচ্ছা! দু’জনকে তিনটে করে দিলে। হাতে থাকে দুটো, সেই দুটো দিয়ে শেষেরজনকে সন্তুষ্ট করতে হবে। এ ছাড়া এলোমেলো অনেক কিছু হতে পারে। হাতে থাকে ছ’টা। তারপর! আচ্ছা! ছ’জনকে তিনটে করে দিলে। হাতে থাকে দুটো, সেই দুটো দিয়ে শেষেরজনকে সন্তুষ্ট করতে হবে। এ ছাড়া এলোমেলো অনেক কিছু হতে পারে।

জয় আর জয়া। দু’জনই অঙ্কে মশগুল। ধীরে-ধীরে রাত বাড়ছে। ঠাকুমা চোখে গোল চশমা লাগিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘শান্তিনিকেতন’ পড়ছিলেন। বই মুড়ে উঠে পড়লেন। এইবার সংসারের কাজে একটু সাহায্য করতে হবে। কেউ চায় না তিনি কিছু করেন। বয়েস হয়েছে। এখন তাঁর বিশ্রামের সময়। তিনি মনে করেন, শ্রমই বিশ্রাম। এ কথা সবাই জানে, তাঁর কাজের ধরনটাই আলাদা। পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি, অনেকটা শিল্পকর্মের মতো। প্লেটে খাবার সাজাবার ধরনটাই আলাদা। গেলাসে জল দেবেন, গেলাসের বাইরে এক ফোঁটাও লেগে থাকবে না এমনভাবে স্যালাড সাজাবেন, যেন ফুল ফুটে আছে। ধীর, স্থির, গম্ভীর। একটাও বাজে কথা বলেন না, অকারণে হাসেন না। ঠাকুরমার মধ্যে একটা সাধিকার ভাব আছে। বাইরে তিনি মাতাজি নামে পরিচিত। মাতাজি সামনে গিয়ে দাঁড়ালে সব সমস্যার সমাধান। অসুখ সেরে যায় তাঁর দেওয়া কবিরাজি ওযুধে, পারিবারিক সমস্যা মিটে যায় তাঁর উপদেশে।

ঠাকুমা একবার উঁকি মারলেন বসার ঘরে। পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ম্যানফ্রেড বসে আছেন সোফায়, আরাম করে। শিবশঙ্কর তাঁকে নিজের লেখা ভ্রমণকাহিনী পড়ে শোনাচ্ছেন। সায়েব তন্ময় হয়ে শুনছেন। একপাশে ছোট একটা টেবিল। টেবিলের ওপর একটা ব্রিজের মডেল। মধ্যপ্রদেশে ভয়ঙ্কর একটা নদীর ওপর এই রেল-ব্রিজটা শিবশঙ্কর তৈরি করেছিলেন। দুরূহ কাজ। এইটা করার পর এঞ্জিনিয়ার হিসেবে তাঁর খ্যাতি দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেইসব দিনের কথা মনে পড়ছে ঠাকুমার। বাড়িতে মাঝেমধ্যে একটা-দুটো চিঠি আসত। সেই চিঠি থেকে জানা যেত শিবশঙ্কর ভাল আছেন। একটা কিছু বিপদ ঘটলেও ঘটতে পারত। শিবশঙ্কর একটা কথাই বলতেন, সাবধানের মার নেই, আবার মারেরও সাবধান নেই। ব্রিজটা তৈরি করতে গিয়ে অনেকেই দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন। শিবশঙ্কর বলতেন, প্রোফেশনাল হ্যাজার্ড। সেই অসীমসাহসী জীবনের কথা শিবশঙ্কর ইংরেজিতে লিখছেন। যতটা লিখেছেন সবটাই ঠাকুমা শুনেছেন। অনবদ্য হচ্ছে। ভীষণ টান। ছোট-ছোট রসিকতা। মজার-মজার ঘটনা। শিবশঙ্কর এখন যেটা পড়ছেন, সেখানে একটা মজার ঘটনা আছে। তখন শিবশঙ্কর উত্তর ভারতে। ক্যাম্প করে আছেন। জঙ্গল সাফ করে নতুন রেল লাইন পাতার কাজ চলছে। রাতে ক্যাম্পে এসে দেখলেন, বিছানায় আরাম করে শুয়ে আছে পেল্লায় মাপের একটা ভালুক। এত আরামে শুয়ে আছে যে, শিবশঙ্করের ডাকতে ইচ্ছে করল না। শিবশঙ্কর ক্যাম্প-চেয়ারে বসে রইলেন। ভালুকের ঘুম ভাঙার অপেক্ষায়। ক্লান্ত শিবশঙ্কর বসে থাকতে-থাকতেই এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছেন। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। মৃদু আলোয় দেখলেন, ভালুক তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে, শিবশঙ্কর এতটুকু ভয় না পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যালো মিস্টার, ঘুম ভাল হয়েছে?” ভালুকের ভাষা থাকলে বলত, “ইয়েস, থ্যাঙ্কস।” ভাষা নেই, তাই শব্দ করে হাসল। ক্যাম্পের পরদা তুলে চলে গেল বাইরে। সেই ভালুকটা শিবশঙ্করের বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। প্রায় রোজই আসত। পাউরুটি, কলা, এইসব খেত। ভালুক যথেষ্ট ভদ্রলোক।

জয় হঠাৎ দালানে বেরিয়ে এসে ছোটাছুটি শুরু করে দিল। ঘুম তাড়াচ্ছে। শিবশঙ্কর পড়া থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যালো ব্রাদার! আক্রমণ করেছে?”

জয় বলল, “অ্যাটাক্ড বাই স্লিপ।”

“তোমার চক্ষুচূর্ণে কাজ হচ্ছে না?”

“নো সার, ফুরিয়ে গেছে।”

“আর কতটা বাকি?”

“এখনও একটা সাবজেক্ট।”

জয় দালানের এ-মাথা থেকে ও-মাথায় ছোটাছুটি করছে। দেওয়ালে মানুষ-মাপের লম্বা একটা আয়না। মাঝে-মাঝে তার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে নিচ্ছে। চোখ দুটো করমচার মতো লাল। ঘুম কোথায় আসে? মাথায়, না চোখে!

ম্যানফ্রেড পরামর্শ দিলেন, “সিঙ এ সঙ। গান গাইলে ঘুম ছেড়ে যায়।”

জয় চার-পাঁচটা ডন মেরে ঘরে ঢুকে গেল। জয়া একমনে পড়ছে। নড়াচড়া নেই, স্থির। পিঠের ওপর ঝুলছে মোটা একটা বিনুনি। টেব্ল-ল্যাম্পের আলো এসে পড়েছে সুন্দর মুখে। খাড়া একটা নাক।

“তোর কেন ঘুম পায় না দিদি!”

“আমি অ্যালাউ করি না। আমি আমার কাজে ঢুকে যাই।”

“কী করে ঢুকিস?”

‘আমার মনটাকে ঢুকিয়ে দি।”

“আমি পারি না কেন?”

“তুই ভীষণ ছটফটে। একসঙ্গে অনেক কথা ভাবিস। যখন পড়বি তখন কেবল পড়বি। যখন খেলবি তখন কেবল খেলবি।”

“তোর হাতটা আমার মাথায় ঠেকিয়ে একটু আশীর্বাদ করে দে না দিদি!”

“ঠাট্টা করছিস!”

“বিশ্বাস কর, তোকে দেখলে মনে হয়, মা সরস্বতী!”

“আর আমার মনে হয়, তুই একটা আস্ত পাগল।”

“দিদি, পাগলদের নাকি সর্দিকাশি হয় না!”

“এইবার শুরু হল তোর গবেষণা। ভীষণ বকব জয়। কাল তোর ক্লাস এগ্জাম।”

“আমি জোরে-জোরে পড়ব কিন্তু।”

“তোর যা খুশি তাই কর। আমাকে বকাবি না।”

জয় বিজ্ঞান খুলে বসল। ফুল। দু-চার লাইন পড়ামাত্রই মন ঢুকে গেল বিষয়ে। ফুল কাকে বলে! রোদই কি ফুল হয়ে ফোটে? মাটি, জল, জৈব পদার্থ, বাতাস, রোদ। সব মিলিয়ে একটা ম্যাজিক। একটা ফুলের কত অংশ, ক্যালিক্স, সেপাল্স, করোলা, পেটাল্স, স্ট্যামেন্স, স্টিগ্মা, স্টাইল, ফুলের সুগন্ধ, নেক্টাব। শর্ট ডে প্ল্যান্ট, অল্প সময় আলো পেলেই ফুল এসে যায়। লং ডে প্ল্যান্ট, বহুক্ষণ আলো না পেলে ফুল ফোটে না। সূর্যমুখী রোদের দিকে মুখ ঘোরায়, কেন ঘোরায়! মাধ্যাকর্ষণে শিকড় কীভাবে মাটির তলায় নামতে থাকে। অন্ধকারে একটা গাছের চারাকে মাটিতে শুইয়ে রাখলে দেখা যাবে শিকড় ঘুরে গেছে মাটির দিকে, আর ডগা বেড়ে উঠছে ওপর দিকে। শিকড়ের অনুসন্ধান জল।

জয়ের চোখে আর ঘুম নেই। পৃথিবীর বিস্ময়ে মন ঢুকে গেছে, যেভাবে শিকড় ঢোকে মাটিতে। জয়ের কানের কাছে এখন বোমা ফাটালেও শুনতে পাবে না।

॥ ৭ ॥

খড়ক সিং বড় মজার মানুষ। তিনি এসেছেন। মাঝে-মাঝেই মানুষটা অদৃশ্য হয়ে যান। ফিরে আসেন একঝোলা গল্প নিয়ে। কঞ্চির মতো পাকানো চেহারা। ফুটছয়েক লম্বা তো হবেনই। ঠাকুর্দা সাত ফুট লম্বা ছিলেন। বাবা সাড়ে-ছয়। ক্রমশই কমছে। খড়ক সিং বলেন, “খড়করা ছোট হয়ে যাচ্ছে ক্রমশই, সেইটাই আমার ভয়। লম্বা হলে মানুষ অনেক দূর দেখতে পায়। আর যারা দূর দেখতে পায়, তাদের জ্ঞান খুব বেড়ে যায়।” খড়ক সিংয়ের বিশাল একজোড়া গোঁফ। দুটো ডগা মোম দিয়ে সরু করা। পায়ে খটখটে নাগরা। চুস্ত পাজামা, কুর্তা গায়ে। বড় বড় দুটো কান। কানের পাশে চুল। আতরের তুলো গোঁজা। ভীষণ মেজাজি মানুষ বড়দের সঙ্গে একেবারে মেশেন না, ছোটদের সঙ্গে ভীষণ খাতির। বলেন, “বড়রা সব ফুরিয়ে এসেছে, তাদের সঙ্গে মেলামেশা করলে নিজেও ফুরিয়ে যাব।”

খড়ক সিংয়ের ছোট একটা বাড়ি আছে। এত ছোট, যেন খেলাঘর। একটা ঘর, চারপাশে বারান্দা, একটা বাথরুম। ছোট একটা সাজঘর, ছোট্ট একটা বসার ঘর। বাড়িটা একটা বাগানের মধ্যে বসানো। বড় বড় গাছ। পাতায়-পাতায় বাতাসের সিমসিম শব্দ। নানারকম পাখির ডাক। কাঠবেড়ালির খেলা। বছরের বেশিরভাগ সময় বাড়িটা বন্ধ থাকে। খড়ক সিং এলে আলোয় আলোকময়। কেউ নেই খড়ক সিংয়ের। খড়ক সিং বলেন, “খড়ক সিংয়ের খড়ক সিং আছে।” বলে, হা-হা করে হাসেন। কেউ না থাকাটা যেন ভীষণ আনন্দের।

খড়ক সিং এসেছেন জেনে জয়, জয়া আর শিরিন ছুটল স্কুল ছুটির পরেই। তাদের কাছে এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু নেই। তাদের বন্ধু এসে গেছেন। শেষ বিকেলের আলোয় চারপাশ ঝলমল করছে। নীল কাগজের আকাশ পশ্চিমে সূর্যের লাল রং শুষেছে। কালো বিন্দুর মতো ঝাঁক-ঝাঁক পাখি উড়ছে। খড়ক সিং সামনের খোলা জায়গায় পায়চারি করছেন। পায়ে জরির কাজ-করা খটখটে নাগরার জুতো, মাথায় একটা পাগড়ি। খড়ক সিং অনেক সময় অনেককে দেখতে পান। যে নেই, যারা নেই। তাদের সঙ্গে কথা বলেন। সেইরকমই একজন অদৃশ্য কেউ খড়ক সিংয়ের পাশাপাশি ঘুরছেন। সিং হাত-পা নেড়ে কথা বলছেন। কিছু একটা বোঝাচ্ছেন তাকে। এমনই তন্ময়, তিনজনকে দেখতেই পাচ্ছেন না। সিং এ-পাশ থেকে ও-পাশে যাচ্ছেন, পেছন-পেছন তিনজন। আবার, ও-পাশ থেকে এ-পাশ। কাকে বোঝাচ্ছে, মাথা জিনিসটা খুব খারাপ জিনিস। কোনও কিছু ঢুকলে সহজে বেরোতে চায় না। বেরোতে চায় না কি, বেরোবেই না। একেবারে গেড়ে বসবে। যেন গাড়ি চেপেছে। আবার হুকুম করবে, হিঁয়া চলো, হুঁয়া চলো। যেই বলব, “অ্যায় উতারো, আভি উতারো।” সঙ্গে-সঙ্গে বলবে, “চোপরাও। কী মজা।”

খড়ক সিং হা-হা করে হেসে বললেন, “এ কেয়া চক্কর, কেয়া তামাশা! ড্রাইভার, চৌক মে চলো।”

“কাহে জি?”

“হাম লাড়ডু খায়েগা।”

জয়, জয়া, শিরিন, তিনজনে একসঙ্গে চিৎকার করল, “লাড্ড লায়া হুঁ।”

সিংজি চমকে পেছন ফিরে তাকালেন, “আরে মেরা দোস্ত, তোমরা খবর পেয়ে গেছ!”

“তোমাকে আর চৌকে যেতে হবে না। আমরা লাডডু এনেছি, ছাতু এনেছি।”

“তোমাদের জন্যে আমিও এনেছি। জবরদস্ত সব জিনিস।”

খড়ক সিংয়ের ঘরে একটা যোধপুরী সিন্দুক আছে। তার গায়ে অসম্ভব সব কারুকার্য। হাঁ হয়ে যেতে হয়। এমন সিন্দুকেই রাজারা মণিমুক্তো রাখতেন। হিরে, জহরত, চুনি, পান্না। সিংজি একটা বেতের মোড়ায় বসলেন। ওরা তিনজন কার্পেটে। ঘরের চারপাশে নানা মাপের ঘন্টা ঝুলছে। কোনওটার শব্দ খুব মিঠে, কোনওটার খুব ভারী। কোনওটা সা, কোনওটা রে, কোনওটা গা। সব মিলিয়ে পরিপূর্ণ স্বরগ্রাম। বাতাসে দোল খায়, সা রে গা মা পা ধা নি। দরজায় একটা ভারী সিল্কের পরদা। ঘরের কোণে একটা আলবোলা। ঘরে যেন স্বপ্ন খেলা করছে। দেওয়ালে একটা তরোয়াল বাঁকা করে রাখা। দোনলা একটা বন্দুক। একপাশে একজনের শোওয়ার মতো একটা চারপায়া। বিছানায় ভেলভেটের চাদর। টেবিলের ওপর ফুলসমেত ফুলদানি।

খড়ক সিং মোড়ায় বসে-বসেই সিন্দুকের ডালা খুললেন। ঘরটা সুগন্ধে ভরে গেল।

জয় বলল, “আঃ, কিসের গন্ধ রে দিদি?”

সিংজি বললেন, “মৃগনাভি। আসলি জিনিস। এবার আমি নিয়ে এসেছি। এই গন্ধে হরিণ পাগল হয়ে যায়। সহজে পাওয়া যায় না। অনেক কষ্টে জোগাড় করেছি।”

সিংজি সিন্দুক থেকে প্রথমে বের করলেন সিল্কের কাপড়। তুলতুলে নরম। সোনার মতো রং। একটা টুকরো তুলে দিলেন জয়ার হাতে, “এইতে তোমার একটা ফ্রক হবে। তোমাকে মানাবে! আর এই টুকরোটা শিরিনের। দুটো মেয়ের দুটো ফ্রক। এইবার দেখি ছেলেটার জন্যে কী আছে!”

সার্জের একটা পিস বেরোল। সুন্দর রং। রংটা যে কী, জয় তা বুঝতে পারল না। কাপড়টা হাতে নিয়ে খড়ক সিং বললেন, “এইটাতে আমার জয়ের একটা স্যুট হয়ে যাবে। এইসব আমি যোধপুর থেকে কিনেছি। গোটা কতক বড়-বড় আসরে আমি গান গাইলুম, রোজগারটা বেশ ভালই হল, বুঝলে। মোটা টাকা। রাজা। মহারাজার দেশ।”

“আমাদের খুব আনন্দ হচ্ছে ; কিন্তু তুমি গান শিখলে কবে?” জয়া প্রশ্ন করল।

“গান? তোমরা আমার গান শোনোনি?”

“তুমি তো রেওয়াজই করো না!”

“আমার যখন যা মনে আসে, আমি তাই করি। আমার ভেতরে সব আছে। এক-এক সময় এক-একটা বেরিয়ে পড়ে। কী করে কী হয়, সে আমি বলতে পারব না।”

“কী গান গাইলে?”

“কেন, খেয়াল, ঠুংরি। বিশ্বাস হচ্ছে না। বেশ, তা হলে একটু শোনো।”

খড়ক সিং খেয়ালের একটা মুখ গেয়ে শোনালেন। শুনিয়ে বললেন, “বাপ্রে বাপ, কী সুর! নিজের গানে নিজেই অবাক। কে গাইছে রে বাবা! ভেতরে কে বসে আছে!”

ওরাও অবাক হয়ে গেছে। যেমন সুর তেমনই কাজ, একেবারে পাকা ওস্তাদ।

শিরিন বলল, “ঠিক একেবারে বড়ে গোলাম আলির মতো। তার মানে তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে গান গাও। আমরা শুনতে পাই না।”

সিংজি বললেন, “সে আমি বলব না। আমি কী করি, আমি নিজেই জানি না। আচ্ছা, অত কথার দরকার কী! আমি যা করি, আমিই করি, তাতে কার কী! আরও জিনিস আছে, সেসব বের করি। আজ রাত্তিরে আমার আবার নেমন্তন্ন আছে। বড়িয়া ভোজ।”

জয়া বলল, “কে করেছে?”

“খড়ক সিং।”

তিনজনেই হাঁ হয়ে গেল। এ আবার কেমন কথা!

জয়া বলল, “সে আবার কোন খড়ক সিং?”

“কেন? এই খড়ক সিং। খড়ক সিং আবার ক’জন আছে!”

“নিজেকেই নিজে নেমন্তন্ন করলে?”

“তা হলে কে করবে। আমার কে আছে! আর কারই বা কে থাকে! আমার আমিই থাকে। একে শূন্য দশ, দশে শূন্য একশো। সেই এক। একশোয় শূন্য হাজার। সেই এক। সবাই বলে, হাজার হাজার, লাখ, কোটি। অনেক, অনেক। সবই শূন্যের খেলা। আসল হল এক। তা এসব কথা কেন? পাকা-পাকা কথা। বুড়োদের মতো পাকা-পাকা কথা আমি একদম লাইক করি না।”

জয়া বলল, “কে রাঁধবে?”

“রোজ যে রাঁধে। খড়ক সিং। আমি রাঁধব, আমিই আমাকে খাওয়াব। সোজা কথা।”

“কী রাঁধবে?”

“এখনও ঠিক করিনি। ওস্তাদ যা খেতে চাইবে, তাই করে দেব।”

“তোমার কথা কিছু বুঝি না বাপু।”

“পারবে, পারবে। ভাল করে অঙ্ক শিখলেই পারবে। অঙ্কে স্ট্রং না হলে এসব বোঝা যায় না। আমাকে আর বকিয়ো না। আমি এখন সিন্দুক খুলেছি।”

সিন্দুক থেকে নানা জিনিস বেরোতে লাগল। হার, চুড়ি, সোনার জলের কাজ-করা বাঁধানো নোটবুক। নানারকমের টিপ, চামড়ার ব্যাগ, বেল্ট, আতরের শিশি। সব ভাগাভাগি হয়ে গেল তিনজনের মধ্যে। খড়ক সিং উঠে পাশের ছোট ঘরে গেলেন। সেখান থেকে নিয়ে এলেন এক ঝুড়ি প্যাঁড়া। বেশ পেস্তাটেস্তা দেওয়া।

টেবিলের ওপর রেখে বললেন, “যে যটা পারো খাও, তারপর বাড়ি নিয়ে যাও। এ যা খেতে! তবে আমাদের চৌকের লাড্ড়ুর কাছে লাগে না।”

জয়া বলল, “তুমি ভারী একগুঁয়ে। তবু তোমাকে বলি, আমাদের বাড়িতে এক জার্মান সায়েব এসেছেন। দাদির বন্ধু। তুমি আমাদের বাড়িতে চলো না। আজ আমাদের বাড়িতে তুমি রাত্তিরে খাবে।”

“ধুত! আমার কারও বাড়ি যেতে ভাল লাগে না। বোকা-বোকা লাগে। চুপ করে বসে থাকো, মাঝে-মাঝে এক-আধটা কথা বলো। হাসতে ইচ্ছে করছে না, তবু জোর হাসো। ওসব আমি পারি না। বড়-বড় লোকদের এড়িয়ে চলতে হয়। সমানে-সমানে মিশবে, সামনে-সামনে লড়বে। এইসব আমি শিখেছি। আমাকে তোমরা মুখ্য ভেবো না। আমি বলি কী, তোমরা আজ এখানে খেয়ে যাও। সে একটা হবে। নতুন একটা রান্না বের করেছি।”

শিরিন বলল, “কী সেটা?”

“কাবাব।”

“কাবাব অনেককালের পুরনো।”

“এ হল আলুর কাবাব। খেলে বুঝবে, কী জিনিস! মাথা খাটিয়ে বের করেছি। আরে, মানুষ তো জীবজন্তু খেয়ে-খেয়ে দুনিয়াটা ফাঁক করে দিলে। ছাগল খাচ্ছে, ভেড়া খাচ্ছে, মুরগি খাচ্ছে। খেয়েই যাচ্ছে, খেয়েই যাচ্ছে। ওদের বন্দুক নেই, ভাষা নেই, নেতা নেই, সব রাজ্যেই আছে নিজেদের কোনও রাজত্ব নেই, দুর্বল। ধূর্ত মানুষ মেরেকেটে খেয়ে সব শেষ করে দিলে।”

খড়ক সিংয়ের খড়খড়ে মুখ করুণ হয়ে এল। চোখ দুটো খুব বড় বড়। সেই চোখে জল।

জয় বলল, “তুমি কাঁদবে না কি?”

“কান্না পেলে কী করব? আমার যখন যা পায়, আমি তখন তাই করি। আমার ভেতর আছে। সেই ভেতরে আর-একটা লোক আছে। সেই কলসিটার কথা মনে আছে? আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের সেই কলসিটা। যার মধ্যে দৈত্য ছিল ধোঁয়া হয়ে। যাক, সেসব কথা থাক। তোমরা আবার ভয় পেয়ে যাবে। ব্যাপারটা তো মোটেই সোজা নয়। একের মধ্যে দুই। সেই দু নম্বরটাই আমাকে চালায়। তা বলো, আজ আমাদের ফিস্ট হবে কি না! কাল তো রবিবার। আজ না পড়লেও চলবে। আজ আবার চাঁদের রাত। বলো তো, তোমাদের বাড়িতে একটা চিঠি লিখে দি, অনুমতি চেয়ে।”

খড়ক সিং উঠে গেল জানলার ধারের টেবিলে। কারুকার্য করা ছোট্ট একটা আবলুস কাঠের টেবিল।

॥ ৮ ॥

তা মন্দ হল না। খড়ক সিংয়ের চিঠি কেউ ‘না’ করতে পারে কি। কাল রবিবার, তবে আর ভয় কী! শনিবারের একটা বেলা একটু ফুর্তি করে নাও। ম্যানফ্রেড বললেন, “মানুষটাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। ভেরি ইন্টারেস্টিং। আমি যদি যাই, কিছু মনে করবেন?”

শিবশঙ্কর বললেন, “কিছু মনে করার লোকই নয় সে। খড়ক সিংয়ের ঠাকুর্দা ছিলেন রাজপুতনার এক নেটিভ স্টেটের রাজা। তারপর একটু-একটু করে রাজ্যপাট সবই গেল। গেলে কী হবে, মেজাজটা রাজা-মহারাজার মতোই আছে। চলো, আমিও যাব।”

ঘন্টাখানেকের মধ্যেই খড়ক সিংয়ের বাড়িতে জোর জমায়েত। সিং সেজেছে কী। সাদা পাজামা, কুর্তা, গেরুয়া পাগড়ি। বুকের কাছে ঝকঝকে একটা লকেট দুলছে। পায়ে জরির নাগরা। ম্যানফ্রেড ফটাস-ফটাস করে গোটাকতক ছবিই তুলে ফেললেন।

শিবশঙ্কর বললেন, “কিছু লিখবে না কি?”

“ভাবছি একটা স্টোরি করব। এইরকম চরিত্র কোথায় পাব। আমাদের দেশে নেই।”

“ঘন্টাখানেক মিশলেই বুঝতে পারবে, এমন মানুষ কল্পনাও করা যায় না।”

সিং বললেন, “আমার একটাই গুণ, আমি পাগল।”

শিবশঙ্কর বললেন, “কেমন করে বুঝলে?”

“খুব সহজ। পাগলের দুটো অসুখ কখনও হয় না, সর্দি-কাশি,

জ্বর-পেটখারাপ। আমারও হয় না, আমি পাগল। পাগলদের গায়ে ভীষণ জোর হয়। আমারও খুব জোর।”

“তোমার মতো পাগল আমিও হতে চাই।” শিবশঙ্কর বললেন।

“পাগল তো হওয়া যায় না, পাগল হয়ে যায়। অনেক বছর আগে একদিন সকালে উঠে আমি দেখি কী, আমি পাগল হয়ে গেছি। সে খুব মজা।”

“সেটা কীরকম?”

“ঘুম থেকে উঠেই ধেই-ধেই করে নাচতে লাগলুম। যত নাচি, তত আনন্দ। ছুটে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলুম। সকলকে ডেকে বললুম, আমার ভাল-ভাল জিনিস যা আছে, সব তোমরা নিয়ে যাও। আধ ঘন্টার মধ্যে আমার ঘর ফাঁকা। আমি, শুধু আমিই দাঁড়িয়ে আছি। সে কী মজা! একেবারে হালকা।”

“তারপর এইসব এল কোথা থেকে? এই ফার্নিচার টার্নিচার।”

“সেও এক মজা। যেই সব দিয়ে দিলুম, অমনই সব এসে গেল। দেখলুম, দিলেই তবে আসে। খালি না করলে ভর্তি হয় না। ধরুন, এক কলসি জল আছে। সেই জলটা না ফেললে নতুন জল ভরা যাবে না। আগে খালি করতে হবে। বুঝলেন, এসব হল ওপরওয়ালার কথা। আমরা তো বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস করলে হাতে-হাতে ফল। আপনার সেই ওয়াটসন সাহেবকে মনে আছে? গালার চাষ করতেন। জঙ্গলে গিয়ে বাঘ মারতেন।”

“খুব মনে আছে। শেষের দিকটায় সাধুর মতো হয়ে গিয়েছিলেন।”

“সেই ওয়াটসন সাহেব বিলেত চলে যাওয়ার আগে আমাকে ডাকলেন। ডেকে বললেন, ‘খড়ক সিং, সব লে যাও। আমি বললুম, সাহেব, আমি তো নিতে পারি না, দিতে পারি।’ সাহেব বললেন, ‘তা হলে তুমি উপার্জন করো। আমি শুনেছি তোমার অনেক জুড়িবুটি জানা আছে।’ সাহেবের হাঁপানির টান উঠত। সারারাত জেগে থাকতেন। একটা ওষুধ তৈরি করে দিলুম, সাহেবের কিছুটা ইলাইজ হল। সাহেব বললেন, ‘এইটটি পারসেন্ট সেরেছে, এইবার তোমার ফি হিসেবে সব নিয়ে যাও।’ আমি বললুম, ‘সাহেব তুমি পাঠিয়ে দাও। যা তুমি দিতে চাইছ, সব পাঠিয়ে দাও।’ আবার আমার ঘর ভরে গেল।”

শিবশঙ্কর বললেন, “আমরা এই যে এলুম, এতে তোমার কোনও আপত্তি আছে?”

“আমার আপত্তি! এ তো আমার সৌভাগ্য। তবে একটাই কথা, বুড়ো হয়ে বসে থাকলে হবে না, ছোট হয়ে যেতে হবে।”

“সেটা এই বয়সে কী করে সম্ভব হবে খড়ক সিং?”

“খুব হবে। বাইরে চলুন, আমি কায়দাটা দেখিয়ে দিচ্ছি।”

বাইরেটা চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে। কৃষ্ণচূড়ার পাতা ঘুমিয়ে পড়েছে। পড়লেও ঝলমলে আকাশের গায়ে তুলির আঁচড়ের মতো বেশ দেখাচ্ছে। ছোট-ছোট ঝোপ চাঁদের আলোয় রুপার পাতের মতো দেখাচ্ছে। মিষ্টি একটা বাতাস বইছে। ইউক্যালিপটাস গাছ সোজা আকাশের দিকে উঠে গেছে। কিছু দূরেই ঝাঁকড়া দেবদারু। গোটা বাগানটায় আলোছায়ার খেলা। থই থই আলো, ভারী-ভারী ছায়া। জমজমাট রহস্য।

খড়ক সিং বললেন, “কেমন লাগছে?”

ম্যানফ্রেড বললেন, “ওয়াণ্ডারফুল! রোমান্টিক ইন্ডিয়ান নাইট।”

সিং বললেন, “আমরা এইবার কিছুক্ষণ চোর-চোর খেলব।”

শিবশঙ্কর বললেন, “এই বয়েসে? সবাই যে পাগল বলবে খড়ক সিং।”

ম্যানফ্রেড বললেন, “সেটা কী খেলা?”

“হাইড অ্যান্ড সিক গেম। একজন চোর হবে, বাকি সবাই লুকিয়ে থাকবে। যে চোর, সে খুঁজবে। একটা বুড়ি থাকবে। লুকনো জায়গা থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে যে বুড়ি ছুঁয়ে ফেলবে, সে আর চোর হবে না।”

ম্যানফ্রেড বললেন, “ইন্টারেস্টিং! হয়ে যাক এক রাউণ্ড।”

গোনা শুরু হল, দশ, কুড়ি, তিরিশ, চল্লিশ। গুনছে জয়া। চোর হলেন খড়ক সিং। সিং বললেন, “জানা আছে নিয়মটা? পাঁচ মিনিটের মধ্যে সব লুকিয়ে পড়ুন। আমি রেডি বলেই খুঁজতে বেরোব। এই বেদিটা হল বুড়ি।”

শিবশঙ্কর আর জয়া উত্তর দিকে গেলেন। জয় আর শিরিন দক্ষিণে। ম্যানফ্রেড পুবে। লুকোবার মতো একটা জবরদস্ত জায়গা খুঁজতে গিয়ে শিবশঙ্করের মনে হল, সত্যিই তিনি ছোট হয়ে যাচ্ছেন। জয়ার সমবয়সী হয়ে গেছেন। বেশ উৎসাহ পাচ্ছেন। এমনভাবে লুকোতে হবে, কেউ যেন খুঁজে না পায়। খুঁজে-খুজে একেবারে হয়রান হয়ে যাবে। হাতে মাত্র পাঁচ মিনিট সময়।

জয়া বলল, “এই রঙ্গনের ঝোপের পাশে হামাগুড়ি দিয়ে থাকলে কেমন হয়!”

“এটা খুব সহজ জায়গা। আর-একটু এগিয়ে চলল। ওই দ্যাখো, ওদিকটা সবচেয়ে অন্ধকার।”

অন্ধকার জায়গাটায় পাথরের স্তৃপ। বড় একটা ব্যারেল পড়ে আছে। কোনও কাজে কোনওকালে কেউ এনেছিল। শিবশঙ্কর বললেন, “জয়া, ফ্যান্টাস্টিক! ভগবান আছেন। আয়, এইটার ভেতর ঢুকে বসে থাকি।”

“ওটার ভেতর ঢোকার চেষ্টা কোরো না। পরে আর বেরোতে পারবে না। বরং এর আড়ালে বোসো। সাপ বা বিছে কামড়ালে জানি না। “

“সাপ, বিছে এই সিজনে থাকে না।”

দু’জনে ব্যারেলের আড়ালে ঘাপটি মেরে বসলেন। শিবশঙ্করের বেশ মজা লাগছে। ফিসফিস করে জয়াকে বললেন, “কথা বলবি না। হঠাৎ হাঁচি পেলে, চেপে যাবি।”

ম্যানফ্রেড পুব দিকে যেতে-যেতে ভাবলেন, “বাঃ, বেশ মজা! সেই ছেলেবেলাটা ফিরে এসেছে। যখন কোনও ভাবনাচিন্তা ছিল না। পড়া আর খেলা। নদীতে নৌকো বাওয়া। হে হিটলার, কোথায় যুদ্ধ, আণবিক বোমা, কে মাথা ঘামায়! ওসব বড়দের ব্যাপার! সবুজ মাঠ, সাদা গোরু, ভেড়ার পাল। এক বন্ধু। খেলার, মাঠে সন্ধ্যা নেমে আসত। চিমনির ধোঁয়া। অর্কেস্ট্রার সুর। বিছানায় নীল ঘুম। মিকি মাউসের ছবি। ম্যানফ্রেডের সঙ্গে কিশোর ম্যানফ্রেডের যেন দেখা হয়ে গেল, “হালো ফ্রেড! তুমি এতদিন ছিলে কোথায়! আমাকে ছেড়ে কোথায় গিয়েছিলে ফ্রেন্ড!” সামনেই একটা ঝুপড়ি আমগাছ। ম্যানফ্রেড তার ডালে চেপে বসলেন। ইন্টারেস্টিং! গাছে চড়ার অভ্যেসটা বজায় আছে। নাকের ডগায় পাখির বাসা। এক থোপা চাঁদের আলো পড়েছে। মা তার বাচ্চাকে বুকে নিয়ে শুয়ে আছে। ম্যানফ্রেড মনে-মনে বললেন, “ডোন্ট স্টার!”

জয় আর শিরিন যে-দিকটায়, সেদিকে বড়-বড় গাছ। মোটা গুঁড়ি। সিমেন্ট-বাঁধানো শুকনো একটা চৌবাচ্চা। জয় বলল, “এই চৌবাচ্চাটা!”

শিরিন বলল, “মাথামোটা! আগেই তো এই জায়গাটা খুঁজবে! এমন জায়গায় লুকোতে হবে, যাতে চোখে না পড়ে।”

“সেটা তা হলে কোন জায়গা!”

“আর-একটু এগিয়ে চলো।”

কিছুদূরেই একটা বাহারি পাতার ঝোপ। নরম সবুজ ঘাস। গাছের পাতার ভেতর দিয়ে নেমেছে ছাপকা-ছাপকা চাঁদের আলো। শিরিন বলল, “এই ঝোপের আড়ালে আমরা চুপটি করে শুয়ে থাকব। কেউ খুঁজে পাবে না। জায়গাটা খুব সুন্দর!”

“ঘাসে যে ঠাণ্ডা। যদি জ্বর হয়?”

“তোর যাতে জ্বর না হয়, সে আমার দায়। তোকে আমার এই ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখব।”

শিরিন গোলাপি রঙের শালোয়ার-কামিজ পরে আছে। তার ওপর পেঁয়াজ রঙের ওড়না। ওড়নায় ছোট-ছোট চুমকি বসানো। যেখানে-যেখানে একটু-একটু চাঁদের আলো পড়েছে, সেই জায়গাটা ঝলমল করছে। শিরিনের গায়ে গোলাপের গন্ধ। আতর মেখেছে।।

“আর তোর যদি জ্বর হয়?”

“মেয়েদের সহজে অসুখ করে না। বকবক না করে লুকিয়ে পড় বোকা।”

অনেক দূর থেকে খড়ক সিং চিৎকার করলেন, “রেডি?”

জয় আর শিরিন জড়াজড়ি করে ঝোপের আড়ালে নরম ঘাসে বসে পড়ল। শিরিন ওড়না দিয়ে ঢেকে দিল জয়কে। জয় শিরিনের সঙ্গে একেবারে মিশে আছে। শীত-শীত, ভয়-ভয়। শিরিনের শরীরের উষ্ণতা তাকে ঘিরে রেখেছে। নরম ওড়না। চারিদিক একেবারে নিস্তব্ধ। শিরিনের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ জয় শুনতে পাচ্ছে। কোথায় কে যেন খসখস করে কেসে উঠল। জয় দু হাত শক্ত করে শিরিনকে জড়িয়ে ধরল। শিরিন ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “ভয় করছে?”

“কে কাসছে?”

“চুপ করো।”

খড়ক সিং। লম্বা শরীর। মাথায় পাগড়ি। বিশাল বিশাল গাছ। পাতাবাহারের ঝোপ। রঙ্গনা, টগর, জবা, গোলাপ, মুসান্ডা। খড়ক সিং ছায়ার জালিকাটা চাঁদের আলো-ধোয়া মাঠে একা দাঁড়িয়ে। ম্যানফ্রেড গাছের ডালে বসে দেখতে পাচ্ছেন। সিং ছেলেমানুষের মতো এক রাউন্ড নেচে নিলেন। তারপর আরামসে এগিয়ে গেলেন পশ্চিম দিকে।

জয়া দাদুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমাদের যদি কোনওদিন খুঁজে না পায়!”

“ভালই তো, তা হলে আমরা চিরকালের মতো হারিয়ে যাব।”

॥ ৯ ॥

আবার সেই কাশির শব্দ। একটা বিশ্রী খসখসে আওয়াজ। সাধারণত সন্দেহজনক চরিত্রের লোকেরাই এইভাবে কাশে। জয়ের সেইরকমই ধারণা। চাঁদের আলো আরও জোর হয়েছে। চারপাশ ফুটফট করছে। কোথাও কোনও ঝোপে হাসনুহানা ফুটেছে। গন্ধে মাতোয়ারা। দূরে কোথাও একটা পাখি ডাকছে টিটির-টিটির করে।

ভয় করছে। শীত শীত লাগছে। জয় শিরিনের বুকের কাছে ঢুকে গেছে। স্বচ্ছ ওড়নার ভেতর দিয়ে চন্দ্রালোকিত প্রকৃতি দেখছে। যেন স্বপ্ন দেখছে। শিরিনের রেশমি চুড়িদার আর জামা পিছলে রুপোর মতো চাঁদের আলো নামছে। ছোট্ট কপালে সোনালি টিপ। আবার সেই করাত-কাটা কাশি।

জয় ফিসফিস করে বলল, “ভয় করছে।”

দু হাতে জয়কে জড়িয়ে ধরে শিরিন বলল, “কিসের ভয়! আমি তো রয়েছি। কোনও ভয় নেই।”

গাছের ডালে বসে ম্যানফ্রেড সব দেখতে পাচ্ছেন। খড়ক সিং যেন সেকালের এক মহারাজা। সেইরকম পোশাক। বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছেন। মাথায় পাগড়ি। পরে আছেন শেরওয়ানি। নাকতোলা জরির নাগরা। খড়ক সিং খুঁজছেন। কে কোথায় লুকিয়ে আছে। চোর-চোর খেলার সময় সবই কেমন রহস্যময় হয়ে ওঠে। সবাই আছে। হাতের কাছেই আছে, তবু সব যেন কেমন ফাঁকা-ফাঁকা। সন্দেহ, কেউ আছে তো! যদি না থাকে। চারপাশে অনেক ঝোপঝাড়। সবক’টাই সন্দেহজনক। আড়ালে যদি কেউ থাকে! সেও এক ভয়ঙ্কর চমক। বুকটা ধড়াস করে উঠবে। খড়ক সিং ভয়ে-ভয়ে এগোচ্ছে। ম্যানফ্রেডের খুব মজা লাগছে। অসহায় লোকটিকে দেখে মনেই হচ্ছে না, সে খুব সাহসী। ম্যানফ্রেডের পকেটে আখরোট ছিল। তাক করে ছুড়লেন। খড়ক সিংয়ের পায়ের কাছে পড়ল। সিংজি চমকে উঠলেন। এপাশ-ওপাশ তাকালেন। আকাশের দিকে তাকালেন যেন জিনিসটা আকাশ থেকে পড়েছে! সাবধানে নিচু হয়ে ঘাসের ওপর পড়ে থাকা আখরোটটা দেখে বোঝার চেষ্টা করলেন জিনিসটা কী। হাত বাড়িয়েও তুললেন না জিনিসটা। ভয় পেয়েছেন।

জয়া দাদুকে বলল, “আমরা কিন্তু এখন বুড়ি ছুঁতে পারি। সিংজি সামনে এগিয়ে গেছেন।”

“তা হলে আর কষ্ট করে লাভ কী! জায়গাটা তো খুব সুখের নয়। চলো বেরিয়ে পড়ি।”

দু’জনে নিঃশব্দে বেরিয়ে, গাছের আড়ালে আড়ালে বেদির ওপর। আর কিছু করার নেই। শিবশঙ্কর বললেন, “বড় তাড়াতাড়ি আমরা বুড়ি ছুঁয়ে ফেললুম। আরও কিছুক্ষণ সাসপেন্সে থাকলে হত!”

জয়া বলল, “একটা ব্যাঙ আমাকে খালি গোত্তা মারছিল। তা না হলে তো বেশ মজাই লাগছিল।”

“ব্যাঙ তো বর্ষাকালে!”

“সে হল ভিজে ব্যাঙ, এটা শুকনো ব্যাঙ। শীতের মুখে বেরোয়।”

“ব্যাঙের আবার শুকনো ভিজে আছে নাকি?”

“ফলের মধ্যে যেমন তরমুজ আর গোলাপজাম। একটা ভিজে আর একটা শুকনো। যেমন হাঁস আর মুরগি।”

“বুঝে গেছি। অ্যাজ ক্লিয়ার অ্যাজ এবিসি।”

খড়ক সিং সোজা-বাগানের শেষ মাথায়। সেখানে নিচু পাঁচিল। পাঁচিলের ওপাশের জমি অনেকটা ঢালু হয়ে নেমে গিয়ে এক দৌড়ে চলে গেছে সরলা নদীর দিকে। নদীর দিকটা ধোঁয়া-ধোঁয়া। কুয়াশা উঠছে। রাতের দিকে নদী যেন নিশ্বাস ফেলে। চাঁদের আলো যেন রুপোর আঁচল দুলিয়ে দিয়েছে। খড়ক সিং চোর-চোর খেলা ভুলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। পৃথিবীটা কী ভয়ঙ্কর সুন্দর! মানুষ কেন তাকিয়ে দ্যাখে না! কেবল কাজ কাজ করে দৌড়ে মরে। সব কেবল পেটের ধান্দা। সুন্দর যা-কিছু সবই পেটের জগতের বাইরে।।

শিরিন বলল, “সিংজি বাগানের শেষ মাথায়, চল জয়, আমরা বুড়ি ছুঁয়ে ফেলি।”

“পারব তো! সেই বেদিটা অনেক দূরে।”

“খুব পারব। আমরা দুজনে পাঁই পাঁই করে ছুটব।”

শিরিন আর জয় জড়াজড়ি করে বসেছিল। সেইভাবেই উঠে দাঁড়াল। শিরিন জয়ের মাথা থেকে ওড়নাটা টেনে খুলে নিল। জয়ের চুল এলোমেলো হয়ে গেছে। সেইদিকে তাকিয়ে শিরিন বলল, “পাগল, পাগল দেখাচ্ছে।” তারপর জয়কে আদর করে বলল, “সোনা ছেলে।” আর তখনই সেই কাশির শব্দটা আবার। কে যেন দেশলাই ঘষছে। মার ছুট।

ম্যানফ্রেড গাছের ডালে বসে দেখছেন। চাঁদের হাঁসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়া আলো। সবুজ ঘাস। অন্ধকার ঝোপ গেরিলা সৈন্যদের মতো ওত পেতে আছে। একটা ছেলে, একটা মেয়ে ছুটছে। ছুটছে। ছুটছে পাতলা ছায়া। ম্যানফ্রেডের মনে হচ্ছে তিনি যেন কোনও শেকস্পিয়রের নাটক দেখছেন।

বেদিতে বসেই তারা হাঁপাতে লাগল। খুব ছুটছে।

শিবশঙ্কর বললেন, “তোরা কোথায় ছিলিস?”

“ওই ওপাশে অনেকটা দূরে, সেখানে একটা বদমাইশ লোক লুকিয়ে আছে। কেবল খসখস করে কাশছে।”

জয়ের কথা শুনে শিবশঙ্কর হেসে বললেন, “বদমাইশ লোক লুকিয়ে থাকলে কাশবে কেন? কাশলে তো ধরা পড়ে যাবে! বরং বলো, একটা লোক বসে-বসে কাশছে, তার কাশি হয়েছে। সে তো আর চোর-চোর খেলছে না?”

শিরিন বলল, “লোকটা কে?”

শিবশঙ্কর বললেন, “কোনও দেহাতি হবে। খড়ক সিংয়ের বন্ধুও হতে পারে।”

দূরে দেখা গেল, খড়ক সিং আসছেন। যেন সম্রাট শাজাহান। মাথায় পাগড়ি। চাঁদের আলোয় জরি ঝলমল করছে। সিংজির চলনটা অদ্ভুত। একেবারে সোজা, খাড়া। লাঠির মতো।

সিংজি এসে শিবশঙ্করকে বললেন, ‘আপনারা সবাই এসে গেছেন, কিন্তু সেই সায়েব কোথায়?

“নিশ্চয় কোনও জব্বর জায়গায় লুকিয়ে আছেন।”

“আমি তো সব খুঁজে এলাম।”

“তোমার খোঁজা তেমন সুবিধের নয়। আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল। দেখতে পেলে না।”

“কে বলেছে দেখতে পাইনি। আপনারা দু’জনে ছিলেন ব্যারেলের ভেতর। আর ওরা দু’জন ছিল রামছাগলের ঝোপে।”

শিরিন বলল, “রামছাগল মানে?”

“তা হলে আপনারা যে চোর হয়ে যেতেন।”

হঠাৎ মাউথ অগান বেজে উঠল। বিদেশি মার্চিং সুর। যুদ্ধের বাজনা। সুরটা আকাশে ভাসছে।

সিংজি বললেন, “কে বাজাচ্ছে! যুদ্ধের বাজনা।”

শিবশঙ্কর বললেন, “আমার বন্ধু ম্যানফ্রেড।”

সেই সুর লক্ষ্য করে সবাই এগিয়ে চলল। বাজনাটা আকাশ থেকে নামছে। কোনও ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে নয়। সবাই তখন ওপর দিকে তাকাচ্ছে আর এগোচ্ছে। দেখা গেল আমগাছের ডালে দুটো পা ঝুলছে। সেই গাছের নীচে সবাই গিয়ে দাঁড়াল। পাতার ফাঁকে-ফাঁকে চাঁদের আলো। সেই আলো ছাপকা-ছাপকা হয়ে ম্যানফ্রেডের গায়ে পড়েছে। গাছের ডালে বেশ কায়দা করে বসে ম্যানফ্রেড বিভোর হয়ে মাউথ অর্গান বাজাচ্ছেন।

শিবশঙ্কর বললেন, “তোমার সাহস তো কম নয়! রাত্তিরবেলায় গাছে উঠে বসে আছ!”

ম্যানফ্রেড বাজনা থামিয়ে বললেন, “ফ্যান্টাসটিক জায়গা। সাহস থাকে তো উঠে এসো। ওপর থেকে নীচেটা ফাইন দেখাচ্ছে। স্বপ্নের মতো। চাঁদের আলোয় চরাচর ভেসে যাচ্ছে। জমিটাকে মনে হচ্ছে রুপোর কার্পেট। জয়, তুমি ক্লাইম্ব করতে পারবে?”

শিবশঙ্কর হইহই করে উঠলেন, “না, না, পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙবে।”

ম্যানফ্রেড গাছের ডাল থেকে বললেন, “শঙ্কর, তোমাদের অ্যাপ্রোচটা ঠিক নয়। তোমরা হলে ভয়ের উপাসক। সাহস দাও, সাহস। পৃথিবীটা সাহসীদের। তারাই পৃথিবীটাকে ভোগ করতে পারে। আগেই নেগেটিভ চিন্তা কেন? থিঙ্ক পজেটিভ। পড়ে যাবে কেন? আমি তো সহজেই উঠে এলুম, আমার এই বয়সে, এত বড় একটা শরীর নিয়ে। কাম আপ জয়। এখানে এলে তুমি এই চাঁদের আলোর রাত আরও বেশি এনজয় করতে পারবে।”

জয় ভয় পেয়েছে। জীবনে সে গাছে চড়েনি। গাছটার মোটা গুঁড়ি। তলার দিকে কিছু সরু-সরু ডালপালা। অনেকটা উঁচুতে দুটো মোটা ডাল দু’ভাগ হয়ে দু’দিকে চলে গেছে। সেই ডালের আরও শাখা-প্রশাখা।।

ম্যানফ্রেড বললেন, “গাছের গুঁড়িটাকে, মায়ের মতো দু হাতে জড়িয়ে ধরে, দুটো পায়ের চাপে তরতর করে উঠে এসো। মনকে বলো, মন, আমি ওপরে যাব। দেহ হল মনের দাস।”

শিরিন বলল, “যা না। ঠিক পারবি। আমি বলছি, তুই পারবি। আমি পারি আর তুই পারবি না। নিজেকে একটা হনুমান ভাব। “

জয়ের ইতস্তত ভাবটা কেটে গেল। সে এগিয়ে গিয়ে গাছের গুঁড়িটা জড়িয়ে ধরল। ঠাণ্ডা খড়খড়ে। ম্যানফ্রেড ওপর থেকে বললেন, “পারবে, তুমি নিশ্চয় পারবে। না পারার কোনও কারণ নেই। ইট ইজ সো ইজি।”

জয় দু’ পা দিয়ে গুঁড়িটা জড়িয়ে ধরল, যেন মায়ের কোলে উঠতে চাইছে। হঠাৎ মনে হল, সে পারবে। গাছটাকে বড় আপন মনে হল। মনে হল, একটু আগে, সে যেমন ভয়ে শিরিনকে জড়িয়ে ধরেছিল, সেইরকম গাছটাকে জড়িয়ে ধরেছে। শরীরটাকে ওপর দিকে একটু হ্যাঁচকা মারতেই সে হাতখানেক উঠে গেল। তখন তার খুব আনন্দ। এই তো পারছে। সে পেরেছে। শিরিন আর জয়া দু’জনেই উৎসাহ দিচ্ছে, “ওঠ, ওঠ। উঠে যা ওপরে, আরও ওপরে।” ম্যানফ্রেড বলছেন, “আপ, আপ, ক্লাইম্ব আপ।”

দুটো বড় ডাল যেখানে বিভক্ত হয়েছে, জয় সেই জায়গাটায় পৌঁছে গেল। আর কোনও ভয় নেই তার। ইট ইজ সো ইজি। দুটো হাত আর দুটো পা অসাধ্য সাধন করতে পারে। জয় যে ডালে বসেছে, তার ওপরের ডালে ম্যানফ্রেড।।

ম্যানফ্রেড বললেন, “হ্যালো, মাই ব্রেভ ম্যান! এইবার বলো নীচের দিকটা কেমন লাগছে!”

জয় বলল, “ওয়াণ্ডারফুল। স্বপ্নের মতো।”

“ইয়েস! জীবন হল স্বপ্ন। যে সেই স্বপ্ন দেখতে পারে, সেই আনন্দে থাকে।”

জয় চিৎকার করে বলল, “গ্র্যান্ডফাদার, আমি পেরেছি।”

খড়ক সিং বললেন, “নামবে কী করে?”

ম্যানফ্রেড বললেন, “মাটির টানে।”

“ধপাস করে পড়ে যাবেন?”

“সে যখন আমরা নামব তখনই দেখবেন। চিতাবাঘের মতো।”

ম্যানফ্রেডের মাউথ অর্গান বেজে উঠল। বিজয় উল্লাসের সুর। চাঁদের আলোর ওড়না দুলছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *