শিউলি ফুল
‘একমুঠো শিউলি ফুল আমাদের আলাদা হতে দেবে না…’
সাতসকালেও কথাটা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে তন্ময়৷ কাল রাত থেকে এই কথাগুলো শুনতে শুনতে কানে কু লেগে গেছে ওর৷ অপরাজিতা কখনও ফুঁপিয়েছে, কখনও তারস্বরে চেঁচিয়েছে, আবার কখনও স্রেফ শান্ত হয়ে বাষ্পমাখা গলায় বলেছে ওই এক কথা, ‘একমুঠো শিউলি ফুল…’
ফোঁপানো শুনতে শুনতে ভোররাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল তন্ময়৷ উঠেই সবার আগে ওকে ফোন করেছে৷ কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েছে, ‘কাল যেটা বলেছিলি সেটা মনে আছে তো? তুই কিন্তু প্রমিস করেছিলি আমাকে৷ এইরকম একটা টক্সিক সম্পর্কে থাকার থেকে…’
‘থাকব না৷’ ওর কথা শেষ হবার আগেই জবাব দিয়েছে অপরাজিতা৷
‘কখন বেরোবি বাড়ি থেকে?’
‘জানি না, এগারোটায় আসতে বলেছি৷ কিন্তু একটাই ভয় হচ্ছে আমার তন্ময়…’
‘কিসের ভয়?’
‘রঙ্গিণী পার্কের ওদিকটায় একটা শিউলির গাছ আছে৷ ও যদি মুঠো ভরে শিউলি নিয়ে আসে…’
‘আরে নিকুচি করেছে তোর শিউলি ফুলের৷ এখানে একটা মানুষের জীবনের কথা হচ্ছে৷ তার সুখে থাকা শান্তিতে থাকা নিয়ে কথা হচ্ছে৷ আর ওই লোকটা যতদিন আছে কোনওদিন সেটা হবে না৷ এই শিউলি ফুল শিউলি ফুল করে ন্যাকামি মারাটা বন্ধ কর…’
কথাটা বলেই অপরাধবোধে ভোগে তন্ময়৷ ও নিজেও কি দিন দিন সায়ন্তনের মতো টক্সিক হয়ে যাচ্ছে? অপরাজিতার মনের অবস্থা না বুঝে নিজের অনুভূতিটাকে রোড রোলারের মতো চালিয়ে দিতে চাইছে ওর বুকের উপর দিয়ে?
তন্ময়ের গলা খাদে নেমে আসে, ‘আমি ওভাবে বলতে চাইনি৷ দেখ তোর এবার নিজের দিকে তাকানো দরকার৷ চেহারার কী অবস্থা করেছিস দেখেছিস? তাছাড়া সামনে পড়াশোনা আছে, বাড়ির লোকজনের কথাও তো ভাব অন্তত…’
‘আর তুই? তোর কথা কে ভাববে?’
‘আমি!’ একটু ঘাবড়ে যায় তন্ময়, ‘আমার তো কোনও সমস্যা নেই…’
‘নেই যখন আমার এত যত্ন নিচ্ছিস কেন? আমার প্রেম টিকল কি টিকল না, ভালো থাকলাম কি না, তাতে তোর এত যায়-আসে কেন বলতো?’
তন্ময় আর কিছু উত্তর দিতে পারে না৷ ওপাশ থেকে কেবল অখণ্ড নীরবতা ভেসে আসে৷
‘আচ্ছা আমি বিছানা থেকে উঠি৷ শুয়ে থাকলে গায়ে মনে কোথাও জোর পাব না…’
‘বেশ, মন খারাপ লাগলে আমায় ফোন করিস৷ আর বেরুনোর আগে জানাস, কেমন?’
ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে যেতে সেটা পাশে টেবিলের উপর রেখে দেয় অপরাজিতা৷ তারপর সোজা হয়ে বসে৷ বিছানার পায়ের কাছে রাখা আয়নায় নিজের মুখটা দেখতে পায়৷ কাল সারারাত ঘুম হয়নি বলে চোখ মুখ ফুলে আছে৷ চুলও অবিন্যস্ত৷ এই এক মাসে ওর মুখটা ভয়ঙ্কর রকমের সরু হয়ে গেছে৷ চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল এত গাঢ় হয়েছে যে দেখে মনে হয় পুরু কালি জমেছে৷ হাত দিয়ে একবার সেটার উপর রগড়ে নেয় অপরাজিতা৷ তাতে আরও গাঢ় হয় সেই রং৷
বিছানা থেকে উঠে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় অপরাজিতা৷ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নিজের মুখের দিকে৷ হাত বাড়িয়ে যেন নিজেকে স্পর্শ করার চেষ্টা করে৷ আয়নার ঠিক পাশেই ঝুলছে ওর পুরনো একটা ছবি৷ আজ থেকে তিন বছর আগে তোলা৷ তন্ময় তুলে দিয়েছিল৷
তিন বছর কেটে গেছে মাঝখানে৷ ওই মুখ আর এই মুখের মাঝে তিন-তিনটে বছর৷ ঠিক তিনবছর আগেই কোন এক অপরিচিত ভোরে প্রথম আলাপ হয়েছিল সায়ন্তনের সঙ্গে…
(২)
ভেজা ঘাসের উপরে ক্যাম্বিসের জুতোর আওয়াজ হতেই ঝিলের ধার থেকে কয়েকটা বক জলের উপর উড়ে গেল বিরক্ত হয়ে৷ আজ এই নিয়ে দ্বিতীয় দিন দৌড়াতে এসেছে অপু৷ কাল পার্কের চারনম্বর বেঞ্চ অবধি দৌড়াতেই জিভ বেরিয়ে গেছিল৷ আজ বাড়ি থেকে ঠিক করে এসেছে ছ’নম্বরে গিয়েই একেবারে দেহ রাখবে৷ নিঃশ্বাসের উপর শাসন কায়েমের চেষ্টা করল অপু৷ উঁহু, অন্য কোনওদিকে মন দিতে হবে৷
উড়ন্ত বকের ডানার দিকে একবার চেয়ে কনুইয়ের উল্টো দিক দিয়ে কপালের ঘাম মোছে৷ ভোরের রোদ এসে ছিটকে যাচ্ছে ওদের ধবধবে ডানায়, সেটা দেখতে দেখতেই অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল৷ পাঁচনম্বর বেঞ্চের কাছে প্রায় এসেই পড়েছিল, এমন সময় কিসে একটা হোঁচট খেয়ে পা পিছলে গেল৷ অপুর বাকি দেহটা সজোরে এসে পড়ল রাস্তার উপরে৷
ঘাসের উপরে সশব্দে আছড়ে পড়ল শরীরটা৷ ভয়ানক জোরে কোমর ঠুকে গেল মাটিতে৷ চোখে অন্ধকার দেখল সে৷
‘শুয়োরের বাচ্চা…’ ঘাসের উপরে ওলট পালট খেতে খেতেই ককিয়ে উঠল অপু৷ যে জায়গায় ও পড়েছে তার ঠিক কাছেই পাঁচ নম্বর বেঞ্চের উপর থেকে একটা ছেলে বসেছিল৷ সে হাঁই-হাঁই করে উঠে এসে চিৎকার করে কী যেন বিলাপ করতে লাগল৷
যন্ত্রণার মধ্যে অপু শুনতে পেল ছেলেটা বলছে, ‘দিলেন, দিলেন তো আমার সকালবেলার ব্যবসাপাতি নষ্ট করে৷ এদের মতো আনাড়ি লোকজন রাস্তায় চলাফেরা করে বলেই…’
অদ্ভুত! একটা মানুষ পড়ে গেছে, তাকে সাহায্য করার নাম নেই, উল্টে হম্বিতম্বি করছে!
কোনওরকমে উঠে দাঁড়িয়ে গা হাত পায়ে ধুলো ঝাড়ে অপু৷ ব্যবসা! ছেলেটার সঙ্গে ব্যবসা করার মতো কিছুই নেই! কোমরের কাছটা ঘষতে ঘষতে তার দিকে চেয়ে অপু বলে, ‘আপনার ব্যবসা কিসের?’
ছেলেটা মাটির দিকে তাকিয়ে কপাল চাপড়াতে থাকে, ‘মালা!’
যন্ত্রণার মধ্যেও ছেলেটাকে আপদমস্তক একবার দেখে নেয়৷ তার হাতে সুতো গোছের এক গোছা কিছু ঝুলছে বটে, কিন্তু মালাটালার তো চিহ্ন নেই!
‘আপনি মালা বেচেন! কই আশপাশে কোথাও তো কোনও মালা দেখছি না!’
সে উত্তর দেয় না৷ আবার ফিরে বেঞ্চের উপর দিয়ে বসতে বসতে বলে, ‘আরে যান যান, সকালবেলা ফালতু বকবেন না তো৷ শালা মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল আজ… ধুর…’
ছেলেটার কথার মধ্যে কেমন একটা তাচ্ছিল্যের ভাব আছে৷ অপু সেখানে দাঁড়িয়েই একটু ঝাঁজ মেশানো গলায় বলল, ‘আমি না হয় কোমরে চোট, আপনার কি মাথায়? আলবাল বকছেন কেন? এই ভোরবেলা পার্কের বেঞ্চে ব্যবসা করেন আপনি?’
‘কেন আপনার থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হবে নাকি?’
‘না তা নিতে হবে না, কিন্তু একটা মানুষকে দু-কথা শোনানোর আগে কী নিয়ে শোনাচ্ছি সেটা একবার বুঝিয়ে দেওয়া দরকার, আপনার ব্যবসার কাঁচামাল কই যে ব্যবসা করছেন?’
ছেলেটা আবার বিশ্রী ভেংচি কাটে, ‘কাঁচামাল ছিল, আপনিই মায়ের ভোগে পাঠিয়ে দিয়েছেন…’
‘মানে?’
আঙুল তুলে এবার অপুর পায়ের দিকটা দেখায় ছেলেটা, ‘দেখতে পাচ্ছেন না? আপনার ওই হাতির মতো চেহারা নিয়ে সেই কাঁচামালের উপরেই পড়ে সব থেঁতলে দিয়েছেন…’
‘থেঁতলে দিয়েছি!’
মাটির দিকে তাকায় অপু৷ ওদের ঠিক মাথার উপরেই একটা ঝাঁকড়া শিউলি গাছ৷ সারারাত সেই গাছ থেকে ফুল খসে পড়েছে মাটিতে৷ সাদা চাদরের মতো বিছিয়ে আছে সেটা৷ অপু হোঁচট খেয়ে তার উপরে এসে পড়ায় চাদরের একটা বড় অংশের শিউলি ফুল প্রায় চেপ্টে গেছে৷
সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অবাক গলায় অপু বলে, ‘কিন্তু এ তো রাস্তায় পড়ে থাকা ফুল! এই নিয়েই আপনি মালা বানান বুঝি?’
অপুর মনটা খারাপই হয়ে যায়৷ ছেলেটাকে দেখে তেমন একটা গরিবগুর্বো বলে মনে হয় না৷ অন্তত ফুল বেচে যে তার পেট চলে না তা বোঝা যায়৷ হয়তো ভোরবেলা শখেই এই সমস্ত করে, কিংবা ভালোমতন গড়বড় আছে মাথায়৷
সে তাকিয়ে দেখে চাদরের এককোণে বেশ ক-টা ফুল এখনও অক্ষত অবস্থায় রয়ে গেছে৷ সেটা দেখিয়ে গলাটা একটু নরম করে বলে, ‘কই, দিন দেখি আমাকে একটা মালা…’
ছেলেটা সজোরে ঘাড় নাড়ে, ‘ওরকম হয় না৷’
‘কেন হয় না?’
‘আমি ফুল কুড়াই না, ফুল আপনাকেই বেছে দিতে হবে৷ আমি শুধু মালাটা গেঁথে দেব, আপনি যেমন বলবেন’
অপু অবাক গলায় বলে, ‘মহা মুশকিল তো! একি আলু নাকি যে বেছে বুছে কিনব, ফুল তো সব একই, তার আবার বাছবিচারের কী আছে?’
ছেলেটা এতক্ষণে যেন উৎসাহ পায়, সুতোগুলো পাশে নামিয়ে রেখে বলে, ‘হ্যাঁ, ওইখানেই আপনাদের ভুল৷ যে কারণে লোকে আলু কেনে আর যে কারণে ফুল কেনে, তার মধ্যে একটা বেসিক ডিফারেন্স আছে৷’
‘কীরকম ডিফারেন্স?’
‘আপনি ভেবে দেখেছেন, মানুষ আলু কেনে খেয়ে ফেলার জন্য৷ রান্না করার জন্য৷ কিন্তু ফুল তো খাওয়া যায় না তাহলে কেনে কেন?’
‘কেন?’
ছেলেটা বড় বক্তৃতা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে, ‘তাকে শুকিয়ে মরে যেতে দেখার জন্য!’
‘ধুর! কীসব বলেন আপনি!’
‘ওমা! আপনি জানেন না? যেকোনও সুন্দর কিছু দেখলে আসলে ওইটাই মনে হয় আমাদের৷ সুস্বাদু খাবার দেখলে আমাদের ব্রেন সংকেত দেয় সেটা খেয়ে ফেলতে, নরম বিছানা দেখলে সংকেত দেয় ঘুমাতে, ভালো গান শুনলে ভলিউম বাড়িয়ে দেওয়ার সংকেত দেয়, কিন্তু সৌন্দর্য? সৌন্দর্যর সামনে দাঁড়িয়ে ব্রেন কী রেসপন্স করবে ভেবে পায় না৷ কনফিউজড হয়ে যায়৷ ফলে সে সৌন্দর্যকে শত্রু মনে করে আর নষ্ট করে ফেলতে চায়…’
‘মানে আপনি বলছেন…’
‘এই যে ধরুন আপনি বাচ্চা দেখলেই তার গাল টিপে দিচ্ছেন, কেন? ওর সৌন্দর্য নষ্ট করার জন্য… খানিকটা সেই কারণেই মানুষ প্রেমও করে জানেন, একটা সুন্দর মানুষ দেখলাম৷ ভাবলাম এত সৌন্দর্য আমার পছন্দ হচ্ছে না! অতএব চলো, এর খারাপ দিকগুলো খুঁজে বার করি৷ তারপর খারাপ দিক বের করতে করতে এক সময় আলাদা হয়ে যায়…’
ছেলেটার সত্যি মনে হয় গোলমাল আছে মাথায়৷ পাগলের মতো কীসব বলে চলেছে৷ অপু প্রতিবাদ করে বলে, ‘আপনাকে কে বলেছে যারা প্রেম করে সবাই আলাদা হয়ে যায়?’
ছেলেটা মুচকি হেসে কাঁধ ঝাঁকায়, ‘সবাই হয় তো বলিনি…’ হাতের সুতোটা তুলে ধরে ছেলেটা, ‘এই যে, মালা গেঁথে রাখতে হয়… এই মালায় যেসব ফুল গাঁথা হবে তার একসঙ্গে পচে যাবে, একসঙ্গে কালো হয়ে যাবে…’
নিচু হয়ে একমুঠো ফুল এনে ছেলেটার হাতে ধরিয়ে দেয় অপরাজিতা, ছেলেটা একটা সুতো টেনে নিয়ে একটা একটা করে ফুল সেই সুতোয় ঢোকাতে ঢোকাতে বলে, ‘এই জন্যই বেছে নিতে হয়, বুঝলেন? রোজ রাতে এতগুলো ফুল ঝরে পড়ে, কে কার সঙ্গে মিশতে চায়, কে কার সঙ্গে শুকিয়ে যেতে চায়, সেটা তো বুঝে নিতে হবে নাকি?’
ছেলেটার মুখের দিকে তাকায় অপরাজিতা৷ ভারি নরম, মিষ্টি একটা মুখ৷ মোটামুটি ফর্সা, মোটা ঠোঁট, গালে মিহি একপরত স্নেহপদার্থের প্রলেপ৷ তবে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে কোথায় যেন একটা উদাসীন ভাব চোখে পড়ে৷ যেন চারপাশের দুনিয়ার দিকে বিশেষ নজর নেই ছেলেটার, একমনে মালা গেঁথে চলেছে সে৷
‘আপনি রোজ ভোরে আসেন এখানে?’ অপু জিগেস করে৷
‘হুম, রোজ৷’
‘রোজ মালা গাঁথেন?’
উপরে নিচে মাথা নাড়ায় ছেলেটা, ‘আগে একটা বুড়ি বসত এখানে৷ আমি এখানে হাঁটতে আসতাম, রোজ একটা করে শিউলি ফুলের মালা কিনতাম তার থেকে৷ সে মরে যেতে ভাবলাম নিজেই করি৷ নইলে এমন একটা ম্যাজিক…’
‘ম্যাজিক?’
ছেলেটা আনমনেই বলে, ‘সেয়ানা ছিল বুড়িটা, বলত শিউলি ফুলে নাকি ম্যাজিক থাকে৷ কেউ কাউকে শিউলি ফুল দিলে সে তাকে আর ছেড়ে যেতে পারে না!’ মালাটা ওর দিকে এগিয়ে দেয় ছেলেটা, ‘এই নিন…’
হাসি মুখেই সেটা হাতে গলিয়ে পরে নেয় অপরাজিতা, ‘আচ্ছা এই মালাটা কতক্ষণ থাকবে?’
‘ও থেকে যাবে৷ কোথাও যাবে না৷ তবে একটা সময় পরে আপনি হয়তো রাখতে চাইবেন না৷ ঘণ্টাখানেক রেখে দিন…’
এবার হেসে ফেলে অপরাজিতা, ‘আপনি বেশ বানিয়ে বানিয়ে কথা বলতে পারেন, তা করেন কী? মানে ভোরবেলা শিউলি ফুল বেচে তো আর মানুষের পেট চলে না…’
‘চাকরি? করি না, করতাম…’
‘কীসের?’
‘ওই বানিয়ে বানিয়ে কথা বলে যা করা যায়৷ সাংবাদিকতা… আপাতত কাঠ বেকার, আপনি?’
‘আমার সেলসের চাকরি, ছোটাদৌড়ির কাজ মেইনলি…’
একটা বাঁকা হাসি হাসে ছেলেটা, তারপর বলে, ‘আমাদের জীবনটাও এই পার্কের মতোই, বুঝলেন? আপনি ছুটছেন, আমি বসে আছি৷ নেহাত আপনি ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলেন নইলে কোনওদিনও আলাপ হত না৷ যাই হোক, আমি উঠি…’
হঠাৎ করেই কথাটা বলেছে ছেলেটা, অপুর মুখ দিয়ে অজান্তেই প্রশ্ন বেরিয়ে যায়, ‘উঠবেন! কেন?’
ছেলেটা ফিরে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘প্রথমত আর মালা গাঁথার মতো ফুল নেই এখানে, দ্বিতীয়ত বেশিক্ষণ বসে থাকলে আমি যে বেকার সেটা আরও প্রকট হয়ে উঠবে… আর…’
‘আর?’
‘আর আমি না উঠলে আজ সারাদিন আপনাকে এখানেই বসে থাকতে হবে…’
‘মানে! কেন?’
আঙুল বাড়িয়ে অপরাজিতার হাতে গলানো মালাটা দেখায় ছেলেটা, ‘ওই ফুলগুলোর জন্য, বললাম না ওই শিউলি ফুল কেউ কাউকে দিলে সে আর ছেড়ে যেতে পারে না…’
কথাটা বলতে বলতেই হনহন করে উল্টোদিকে হাঁটা লাগায় ছেলেটা৷ কয়েক সেকেন্ড সেখানে হতভম্ব হয়ে বসে থাকে অপরাজিতা৷ কী অদ্ভুত পাগলাটে কিন্তু রহস্যময় একটা মানুষ৷ এমন জোর দিয়ে কথাটা বলল যেন নিজেও বিশ্বাস করে এইসব আজগুবি গালগল্প৷
হাতটা নাকের কাছে তুলে গন্ধ নেয় অপরাজিতা৷ অপরিচিত সুবাসে ভরে যায় তার বুকটা… সত্যি কি ম্যাজিক আছে ফুলে?
(৩)
আধঘণ্টার মধ্যে ফ্রেশ হয় নেয় অপরাজিতা৷ জানলা দিয়ে সকালের রোদ ওর গায়ে এসে পড়ছে৷ মাঝে মাঝে ছেঁড়া রোদের ছটা সরে যাচ্ছে মুখের উপরে থেকে৷ প্রথম যেদিন ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল সায়ন্তনের সেদিন মনে হয়নি মানুষ ভেতরে কোথায় যেন একটি কুটিল স্বার্থপরতা আছে৷ একটা ভয়ানক শক্ত ইটের দেওয়াল আছে যা পেরিয়ে ও কাউকে ঢুকতে দেয় না৷
শেষ কবে দেখা হয়েছিল ওর সঙ্গে? না হলেও আজ থেকে ছ’সাতমাস আগে৷ এমনিতে দেখা হওয়ার একবছর পরে ও চাকরি সূত্রে ব্যাঙ্গালোর চলে আসে৷ সায়ন্তনও ব্যাঙ্গালোরে পোস্টিং পেয়েছিল, কিন্তু নেয়নি৷ কলকাতা ছেড়ে সে নড়তে চায় না৷ অপরাজিতার সঙ্গে নিয়ত দেখা হওয়ার থেকে ওর কাছে ঢের বেশি দরকারি ছিল ওর শহরের মধ্যবিত্ত নিরাপত্তা আর চেনা রিক্সাওয়ালার মুখ৷
খানিকটা অভিমানেই কলকাতায় ফিরতে চাইত না অপু৷ এর মধ্যে ওর খারাপ দিন এসেছে, হতাশা এসেছে৷ অফিসে গালাগাল খেয়েছে, বাড়ির লোক ফোন করে মুখ ঝামটা দিয়েছে, ওর রুমমেট মেয়েটি দোতলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে, এর মধ্যে কোনওটাতেই সায়ন্তনকে কাছে পায়নি অপরাজিতা৷ সামনে থেকে যন্ত্রণায় হাত বুলিয়ে দেওয়া আর ফোনের ওপাশ থেকে বড় বড় বাণী শোনানোয় আকাশপাতাল ফারাক৷
একদিন পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে রাগ আর অভিমান মেশানো চিৎকারে ফেটে পড়েছিল অপরাজিতা, ‘এত কিছু ঘটে গেল আর তোমার একবারও মনে হল না একবার আমার সামনে আসা দরকার তোমার? তুমি কি মানুষ না পিশাচ?’
‘আসলে ফ্লাইটটা বুক করতে গেলেই…’
‘জাস্ট শাট আপ, তোমার এইসব অজুহাত বহুত শুনেছি আমি৷ তুমি আসলে কুয়োর ব্যাঙ একটা৷ তোমার পক্ষে শুধু মানুষ কেন, একটা পোষা বিড়ালেরও দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব না…’
‘কেন? আমি দায়িত্ব নিইনি তোমার?’
‘নিয়েছ? শুধু ক-টা উঁচু উঁচু কথা বলা আর মোটিভেশন দেওয়া ছাড়া আমার জন্য আর কী করেছ তুমি?’
‘আর কী করতে পারি বলো?’
‘আর কিছুই যখন করতে পারতে না তখন আমার জীবনটা যেচে পড়ে নষ্ট করলে কেন… বলো কেন করলে জানোয়ার? আজ একটা অচেনা শহরে রোজ রাতে আমাকে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমোতে যেতে হয়৷ তুমি ঘুরেও তাকাও না, খোঁজও নাও না… তোমার কাছে তোমার কাজ ছাড়া, আর্টিক্যাল লেখা ছাড়া দুনিয়ার আর কোনও জিনিসের কোনও মুল্য আছে?’
কথাগুলো বলতে বলতে নিজের মাথার চুল খামচে ধরে অপরাজিতা, অশ্রু আর উন্মাদ চিৎকারে কথা হারিয়ে গেছে তার, ‘আজ শুধু রিগ্রেট হয় একদিন তোমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল বলে…’
সায়ন্তন ঝগড়া করত না কখনও, চিৎকার চেঁচামেচিও না৷ চুপ করে যেত একসময়৷ কেবল এপাশ থেকে ওর নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেত অপু৷ বুকে মাথা রেখে যে নিঃশ্বাসের আওয়াজ একসময় শান্ত করে যেত ওকে সেই নিঃশ্বাসের নিস্পন্দতা ভীষণ অসহ্য মনে হত৷
ব্যাঙ্গালোরে এসে নতুন বন্ধু-বান্ধব হয়েছিল অপুর৷ ওদের বয়ফ্রেন্ডরা ওরা রাগ করলে দরজায় গোলাপ ফুল কিংবা টেডি বিয়ার রেখে যায়৷ কেউ কেউ নিজে হাতে বিরিয়ানি বানিয়ে সটান বাড়ি চলে আসে৷ অপরাজিতার অবশ্য এসব একটু আদিখ্যেতাই লাগে৷ ওর কেবল ভীষণ একা লাগে৷ ওর জীবনের কোথাও কোনও ভালোবাসার স্পর্শ নেই৷ ছায়া নেই, সায়ন্তন যেন থেকেও থাকে না, যেন উপন্যাসে পড়া কোন ভবঘুরে চরিত্রের প্রেমে পড়েছিল ও৷
বছরখানেক আগে থেকেই সায়ন্তনের সঙ্গে সম্পর্কটা কেমন যেন ঘুমিয়ে পড়তে চাইছে৷ প্রিয় খেলা নিয়ে খেলতে খেলতে বিরক্ত হয়ে যাওয়া শিশু যেমন করে খেলনা দূরে সরিয়ে রাখে, ঠিক তেমন করেই৷
এই এক বছরেই উষ্ণতা বেড়েছে তন্ময়ের সঙ্গে বন্ধুত্বে৷ তন্ময় অপরাজিতার স্কুল জীবনের বন্ধু৷ ছেলেটা ভালো গিটার বাজায়, ফটোগ্রাফি করে, খুব ভালো ছবিও আঁকতে পারে৷ অপরাজিতা আর তন্ময় একই মিউজিক স্কুলে গিটারে ভর্তি হয়েছিল৷ কিছুদিন শিখেওছিল৷ শেষে অপু ব্যাঙ্গালোর চলে আসতে সেটা কন্টিনিউ করা হয়নি৷ তবে মিউজিক নিয়ে আগ্রহ আছে দু-জনেরই৷
অপু মন খারাপ করলে কীভাবে যেন বুঝতে পেরে যায় তন্ময়৷ তখন গিটারে গান গেয়ে পাঠায় ওকে৷ তাতে কিছুক্ষণের জন্য মনটা অন্যদিকে থাকে৷ অপরাজিতা জানে তন্ময় ওকে পছন্দ করে৷ হয়তো ভালোওবাসে৷ কিন্তু সায়ন্তনকে ঠকাতে চায় না অপু৷ সায়ন্তন ওকে কখনও ঠকায়নি৷
মাঝে মাঝে এটা ভাবলেই বড় বিরক্ত লাগে ওর৷ অন্তত কিছু মিথ্যে যদি বলত, বন্ধুদের সঙ্গে হুট করে কোথাও ঘুরতে যাওয়া নিয়ে, কোনও বান্ধবীর সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়া নিয়ে, কিংবা কোনও সেলিব্রেটি ক্রাশকে ইনস্টাগ্রামে পিং করা নিয়ে… কিন্তু কোথায় কী? ছেলেটা গড়গড়িয়ে সব বলে দিয়েছে ওকে৷ আর যাই হোক ঠকাতে পারবে না অপরাজিতা৷
তাই কাল রাতে ঠিক করেছে সব কিছু বলে দেবে৷ বলে দেবে অনেকদিন আগেই এই সম্পর্কটা মরে গেছে৷ যেটুকু পড়ে আছে তা কেবল কিছু নিয়মকানুনের বেড়াজাল৷ অমুক সময়ে ফোন করা, অমুক জায়গায় যাওয়ার আগে টুক করে একটা সেলফি তুলে পাঠানো, কিংবা ক-দিনের জন্য কোথাও ঘুরতে গেলে একবার জানিয়ে যাওয়া— আগামী দু-দিন ফোনে অতটা অ্যাভেলেবেল নাও থাকতে পারি৷
কবে যেন মানুষটা, মানুষটার সঙ্গে থাকতে চাওয়াটা, একটা নুন হলুদের দাগ লাগা, গামছা হারিয়ে ফেলা, পিঠে সাবান বুলিয়ে দেওয়া দুপুরের স্বপ্ন ছোট হতে হতে মিলিয়ে গেছে ওর বুকের ভেতরে, কেবল নোনা জলের দাগ রয়ে গেছে৷ আজ সেই দাগটুকু মুছে ফেলার পালা৷
তন্ময় অবশ্য ওকে জোর করেনি৷ কাল রাতে বার বার বলেছে, ‘তুই ভেবে দেখ অপু৷ যদি সম্পর্কে থাকতে চাস, আরো সময় দিতে চাস নিজেদের, তাহলে আমিও অন্তত তোকে জাজ করব না৷ তোর দিক থেকে ডেডিকেশন তো কোনওদিন কম ছিল না…’
নিজেকে সামলে নিতে নিতে অপু বলেছে, ‘আমার আসলে একটা মায়া পড়ে গেছে ওর উপরে৷ এতটা সময় একসঙ্গে কাটানো, ছোট থেকে অনেকগুলো মানুষকে হারিয়ে ফেলেছে তো৷ ওর মায়ের মৃত্যু, দাদুর ওরকম একটা অ্যাক্সিডেন্টে বিকলাঙ্গ হয়ে যাওয়া, পোষা কুকুরটাকে খুব ভালোবাসত, সেও চোখের সামনে গাড়ি চাপা পড়ে… এতকিছুর মধ্যে আমি একটা আলো হয়ে ছিলাম ওর কাছে, এখন আমি চলে গেলে সেটাকে…’
‘আর তুই? তুই কিছু পাসনি?’
‘পেয়েছি…’ কবজির উল্টোদিক দিয়ে নাক মুছে উত্তর দিয়েছে অপু, ‘পেয়েছি৷ অবহেলা, অবজ্ঞা, আমার চোখের জল দেখেও মুখ ফিরিয়ে থাকা৷ ও মানুষটাই ওরকম তন্ময়, জীবনের যে দিনগুলোতে আমার পাশে দরকার ছিল ওকে, ও ছিল না৷ ওর কাছে ওর নিজের অনুভূতি ছাড়া অন্য কোনও কিছুর দাম নেই…’
বাথরুমে ঢুকে আসে অপু৷ ওর কানে এখনও বেজে চলেছে নিজের গলাটা, ‘অবজ্ঞা আর অবহেলা ছাড়া আর কী দিয়েছ তুমি আমাকে? কী দিয়েছ আমাকে এতদিন? বল?’
তন্ময়কে একটা ফোন করতে ইচ্ছা করে অপরাজিতার৷ কিছু একটা আছে ছেলেটার গলার আওয়াজের মধ্যে৷ শুনলে মন শান্ত হয়ে যায়৷ হঠাৎ মনে পড়ে যায় ওর ঘুম না আসার চক্করে তন্ময়ও কাল সারারাত ঘুমায়নি৷ এখন হয়তো ঘুমোচ্ছে৷ এখন জাগানো ঠিক হবে না৷
বাথরুমে ঢুকে শাওয়ারের তলায় দাঁড়ায় অপু৷ একটু দূরে ব্লুটুথ স্পিকারে একটা গান বাজছে৷ কাল সন্ধ্যেয় গিটার বাজিয়ে সেটা রেকর্ড করে পাঠিয়েছে তন্ময়৷ গানের কথাগুলো ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়,
মেরি প্রীত কা কাজল তুম আপনে নায়নো মে মালে আনা…
যাব শাম ঢালে আনা, যাব দীপ জ্বালে আনা…
(৪)
‘উঃ শালা পুড়ে গেল হাতটা!’ অপু চেঁচিয়ে উঠতেই খপ করে ওর হাতটা চেপে ধরে সায়ন্তন৷ দ্রুত পকেট থেকে একটা বোরোলিনের টিউব বের করে ওর হাতের উপর লাগাতে থাকে৷
সেদিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে অপু, বলে, ‘তুই পকেটে বোরোলিন নিয়ে ঘুরিস নাকি?’
‘ঘুরি না৷ আজ নিয়ে এসেছি৷’
‘কেন?’
‘জানতাম, ফানুসে আগুন লাগাতে গিয়ে তুই ছড়াবি৷’
আজ কালীপুজো৷ আকাশটা আলোয় আলোয় উজ্জ্বল হয়ে গেছে৷ চারদিক থেকে মুহুমুর্হু ভেসে আসছে বাজির শব্দ, কখনও বা গোটা আকাশের বুকে ফাটা নক্ষত্রের মতো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে রকেট৷ অপুর মুখ ভরে উঠছে সেই আলোর ছটায়৷ অপরাজিতাদের ছাদেই বাজি পোড়াতে উঠেছে ওরা দু-জনে৷ বাকি বন্ধুরাও আছে, তবে ওদের দু-জনকে প্রাইভেসি দিতে ছাদের অন্য দিকে ভিড় করেছে তারা৷ অপুর জন্য আগে থেকেই ক-টা ফানুস কিনে রেখেছিল সায়ন্তন৷ ওর অন্য বাজি পোড়ানোয় তেমন আগ্রহ নেই৷ কেবল ফানুস উড়িয়ে অনেকক্ষণ সেদিকে চেয়ে থাকতে ভারি ভালো লাগে তার৷ আজও সেই চেষ্টাই করছিল৷ সায়ন্তন ধরেছিল ফানুসটাকে৷ এমন সময় লাইটারের খোঁচায় ছ্যাঁকা লেগেছে হাতে৷
সায়ন্তনের উদ্বিগ্ন মুখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে অপু বলে, ‘তুই প্রেমে পড়ে কেমন যেন বদলে যাচ্ছিস ভাই…’
‘বদলে? কেমন?’ সায়ন্তন চোখ না সরিয়েই বলে৷
‘এই যেমন আগে স্বার্থপর, উদাসীন টাইপের ছিলি৷ এখন বেশ কেয়ারিং গোছের হয়ে গেছিস!’
‘এখনও আছি, ভুল ধারণা তোর…’
‘বটে! তাহলে হাতে ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছিস যে, এতগুলো সাদা ফানুস কিনে আনলি যে…’
‘মায়ের শরীরটা ভালো নেই৷ জ্বর এসেছে৷ তাও ফেলে রেখে এখানে চলে এলাম৷ কারও না কারও প্রতি স্বার্থপরতা করলাম তো…’
অপুর মুখের হাসিটা নিভে আসে, চাপা গলায় বলে, ‘তুই চাইলে চলে যেতে পারিস এখন৷ আমি একা একাই ফানুস ওড়াব৷’
ওর কাঁধে একটা হাত রাখে সায়ন্তন, ‘চিন্তার কিছু নেই৷ ওষুধ খাইয়ে এসেছি৷ আপাতত কম আছে জ্বরটা…’ দূরে আকাশের দিকে দেখায় ছেলেটা, ‘ওই রকেটটা দেখ অপু…’
অপুর মুখটা আবার আলোয় ভরে ওঠে, সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই বলে, ‘জানিস সান, আমার তোর মতো ছেলের সঙ্গে প্রেম হবে আমি কোনওদিন ভাবতেই পারিনি…’
‘তাহলে কেমন ছেলের সঙ্গে হবে ভেবেছিলি?’
‘এই যেমন ধর একটু ছটফটে জ্যাক-অফ-অল ট্রেডস গোছের৷ ধর ভালো গিটার বাজাতে জানে, গান গাইতে জানে, ছবি আঁকতে পারে আমার মন খারাপ হলে গান শোনাবে, আমার পোর্ট্রেট একে দেবে, নানারকম পোজে ছবি তুলে দেবে৷ আবার ভীষণ ডেডিকেটেড আর কেয়ারিং একটা মানুষ হবে৷ সোজা কথায় যার ভালোবাসার মধ্যে একটা বাড়াবাড়ি থাকবে৷ মানে সিনেমার হিরোরা যেমন হয় আর কী…’
‘আমি এসব কিছুই পারি না…’ সায়ন্তনের গলা ভেঙে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে, ‘একটু-আধটু লিখতে পারি, তাও গান বা কবিতা না৷ এককালে কিছু গল্প লিখেছিলাম… সেসব…’
‘তাও কেন ভালোবেসে ফেললাম বলতো?’
সায়ন্তন একটা অদ্ভুত হাসি হাসে, ‘হয়তো আমার মধ্যে এমন কিছু আছে যার খোঁজ তুই এখনও জানিস না৷’
‘সেটা কী?’
‘হতে পারে আমি কোনও সুপারহিরো৷ মেরি জেন কি আর জানত পিটার পার্কারই স্পাইডারম্যান…’
‘হুঁহ, তুই যদি হোস তাহলে উদাসম্যান হবি৷ যার কিছুতেই কিছু এসে-যায় না৷ ওটাই তোর সুপারপাওয়ার!’
ওর দু-কাঁধে দুটো হাত রাখে সায়ন্তন, ছেলেটার চোখের মণিতে এখন হাজার নক্ষত্রের ছটা খেলা করছে৷ হাতদুটো যেন নরম হাওয়ার মতো স্পর্শ করে রেখেছে অপুকে, ‘তোকে কে বলেছে আমার কিছুতে যায়-আসে না?’
‘আসে? আচ্ছা, বল আজ আমি এখানে না থাকলে, তোর কাছে না থাকলে কী মনে হত তোর? কতটা কষ্ট হত? চারিদিকে এত আলো, এত আওয়াজ, এত কোলাহল, শুধু আমি নেই… কেমন লাগত তোর?’
‘আমার কুকুরটার কথা মনে পড়ত…’
‘কুকুর! মানে আমি…’
‘ও এই দিনটায় খুব ভয় পেত, জানিস? বাজির আওয়াজ আর বারুদের গন্ধে ভয়ে গুটিয়ে খাটের তলায় লুকিয়ে পড়ত৷ কেউ ডাকলেও আর বেরিয়ে আসত না৷ আমার মনে হত ও আশপাশেই কোথাও আছে৷ ভয় পেয়ে লুকানোর জায়গা খুঁজছে…’
‘কিন্তু আমি…’
‘আর একটা বিশাল ঈগলের মতো দেখতে পাখি, বুঝলি৷ ছুটন্ত গাড়ির জানলা দিয়ে দেখেছিলাম, চারটে লোক মিলে ওকে ধরে জবাই করতে নিয়ে যাচ্ছে৷ এমন করে বিশাল ডানা মেলে আছে যে এক-একটা ডানা দু-জন লোক মিলে ধরে নিয়ে যাচ্ছে৷ পাখিটার কী ভাব! যেন ওর যোগ্য সিংহাসনে বসাতে নিয়ে যাচ্ছে ওকে… আমি জবাই করাটা দেখিনি৷ কিন্তু ওই ডানা মেলা পাখিটার কথা মনে পড়লে খুব কষ্ট হয় আমার…’
‘কিন্তু আমার না থাকার সঙ্গে এসব কথা…’
‘আমার খুব ভয় করত অপু…’ সায়ন্তনের গলা দূরে ভেসে যায়, ‘এই শহরের সব আলো আর আওয়াজের মধ্যেও ভীষণ ভয় করত আমার তুই না থাকলে৷ আমার মাথার ভিতর সব অন্ধকার আর বিষণ্ণ ভাবনাগুলো দূরে সরিয়ে দেওয়া একটা সুপারহিরো তুই…’
দুটো হাত সায়ন্তনের গালের উপরে রাখে অপু, ‘এই সব আলো থাক না থাক আমি থাকব সবসময়…’ ওর মাথাটা সায়ন্তনের বুকের উপরে নেমে আসে৷ হঠাৎ করেই ওর মনে হয় বাজির আওয়াজ কমে গেছে৷ সেই জায়গার কানে আসছে একটা নিরবচ্ছিন্ন হূদস্পন্দনের শব্দ!
‘চল একটু নিচে যাই, হেঁটে আসি…’
‘চল…’
ছাদ থেকে সিঁড়ি বেয়ে একতলায় নেমে আসে ওরা৷ রাস্তাটাও ফাঁকা নেই আজ৷ দু-পাশে বাচ্চা ছেলেপুলের দল কেউ চরকি ঘোরাচ্ছে তো তুবড়ির সলতেতে আগুন লাগাচ্ছে কেউ৷ সেই আগুনের আলোয় ভরে আছে রাস্তাটা৷ সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বারুদের গন্ধ!
অপু সায়ন্তনের কনুইয়ের উপরটা চেপে ধরে৷ নিঃশব্দে হেঁটে আসে কিছুদূর৷ মাঝে মাঝে দু-জনের মধ্যে থাকা শারীরিক দূরত্বটা শূন্য হয়ে যায়৷ দু-জনের কারও অস্বস্তি হয় না তাতে৷
‘তোর আফসোস হয়?’ সায়ন্তন উদাস গলাতেই জিজ্ঞেস করে৷
‘কী নিয়ে?’
‘এই যে আমি কিছু পারি না৷ গিটার, গান, ফটোগ্রাফি?’
‘ওগুলো নিয়ে তেমন হয় না৷ কিন্তু আর একটু কেয়ারিং হলে ভালো হত— এই যেমন বোরোলিন লাগিয়ে দিলি, ওইটাই, আর একটু বেশি…’
‘হাতটা যেভাবে শক্ত করে চেপে ধরেছিস তাতে সে বোরোলিন উঠে গেছে এতক্ষণে…’
‘হুঁহ, ওষুধটা বড় কথা নয় মিস্টার৷ যত্নতেই অসুখ সারে…’
সায়ন্তন ওর দিকে একবার চেয়ে মুখ বাঁকায়, ‘এইটা খুব ক্রিঞ্জ হচ্ছে ভাই৷ পনেরো বছরের খোকাখুকিরা এইসব বলে প্রেম করে…’
‘আচ্ছা? আমি একটা পঁচিশ বছরের ছেলেকে চিনি যে বিশ্বাস করে ভোরের শিউলি ফুল দিয়ে মানুষকে আটকে রাখা যায়!’
সায়ন্তন প্রতিবাদে ঘুরে দাঁড়ায়, ‘এই ওটা নিয়ে ইয়ার্কি না কিন্তু৷ ওর ফল আমি সত্যি সত্যি পেয়েছি!’
‘তাই! কবে?’
‘এইরকম একটা ন্যালাখ্যাপা ছেলের সঙ্গে যে এতদিন থেকে গেলি সেটা কিসের জন্য মনে হয় তোর? হুঁ?’
ওদের ঠিক পাশেই একটা তুবড়ি জ্বলে নিভে যায়৷ দুটো মানুষের শরীর সাদা আলোতে ভরে ওঠে৷ আবার অন্ধকার ঢেকে ফেলে ওদের৷
‘সাবধানে দে, তুবড়ি কিন্তু বার্স্ট করে…’ পাশ থেকে চেঁচিয়ে ওঠে কেউ৷
‘বেশ তাহলে আর ক-দিন আটকে রাখতে পারিস দেখি…’ অপরাজিতা আবার সামনে পা চালাতে চালাতে বলে৷
‘মানে? তুই যাচ্ছিস কোথায়?’
‘ব্যাঙ্গালোর৷ প্রবাবলি নেক্সট মান্থ! বিশ্বনাথ আঙ্কেলকে বাবা সেই বলেছিল মনে আছে?’
‘সেকী! এতদিন তো বলিসনি আমাকে?’
‘আমি তো জানতে পারলামই আজ দুপুরে৷ ভেবেছিলাম কালীপুজোটা মিটে গেলে তোকে জানাব৷’
সায়ন্তন দাঁড়িয়ে পড়েছে৷ অপু একটু এগিয়ে গিয়েও ফিরে তাকায় ওর দিকে, ‘কী হল, থেমে গেলি কেন?’
‘তুই সত্যি চলে যাবি?’
‘কেন, ভয় করবে তোর?’ ওর মুখে একটা মিহি হাসি খেলে যায়৷
‘তুই থাকতে পারবি আমাকে না দেখে?’
কী যেন মিশে ছিল প্রশ্নটায়৷ অপুর মাথা বুকের উপর নেমে আসে৷ আশপাশে আর কোনও বাজি জ্বলছে না৷ অন্ধকারে ঢাকা মুখটা আর দেখতে পায় না সায়ন্তন৷ কয়েক সেকেন্ড পরে ফিসফিসে গলায় শোনা যায়, ‘তুই একটা চাকরি নিয়ে চলে আসতে পারবি না ওখানে? আমার কাছে তো উপায় নেই বল?’
‘কিন্তু আমি এই শহরটা ছেড়ে…’
‘এই যে বললি ভয় লাগবে এখানে?’
সায়ন্তনের গলা আবার মিলিয়ে আসে দূরে, ‘কী জানি, আমার সঙ্গে এই শহরটার কোথায় একটা যেন মিল আছে অপু, ঠিক বুঝতে পারি না৷ কেবল মনে হয় অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে পারব না৷’
‘বেশ৷ আসিস না৷ আমি বাড়ি যাই…’
কথাটা বলেই দ্রুত হাঁটা লাগাতে যাচ্ছিল অপু, কিন্তু তার আগেই ওর ফোনটা বেজে ওঠে৷ সেটা পকেট থেকে বের করে সায়ন্তনের দিকে তাকায় অপু, ‘তোর বাড়ি থেকে ফোন আসছে, কিন্তু আমার নম্বরে কেন?’
‘আমার ফোনটা সাইলেন্ট মনে হয়৷ দেখ কী বলছে…’
মাকে পুড়িয়ে ফিরতে ফিরতে রাত হল সায়ন্তনের৷ হঠাৎ করেই হার্ট অ্যাট্যাক৷ যে কয়েক সেকেন্ড জ্ঞান ছিল ছেলেকেই দেখতে চেয়েছিলেন কয়েকবার৷ একসময় সব চাওয়াই নিভে আসে৷
ফিরতি পথে গাড়িতে অপরাজিতার পাশেই স্থবির হয়ে বসেছিল সায়ন্তন৷ মুখে সেই উদাস ভাব৷ রাতের হাওয়া ওর অবিন্যস্ত চুলগুলোকে আরও এলোমেলো করে দিচ্ছে৷ জলের গন্ধ নেই কোথাও৷ কেবল পোড়া ধোঁয়া বারবার নিঃশ্বাস ঢেকে দিচ্ছে৷
হাতের চাপে ওর মাথাটা নিজের কাঁধের উপর নামিয়ে আনে অপু৷ মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করে, ‘তোর খুব ভয় করছে, না রে সান?’
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে দু-দিকে মাথা নাড়ায় সায়ন্তন, ‘না, একটা ভয় চিরকালের মতো জিতে নিলাম…’
(৫)
‘কী করেছ তুমি আমার জন্য? এই তিনটে বছরে কী দিয়েছ আমাকে?’
প্রশ্নটা হাহাকারের মতো শোনায়৷ বাজতেই থাকে অপরাজিতার কানে৷ অবহেলা, অবজ্ঞা, প্রায়োরিটি লিস্টে শেষের দিকে একটা দায়সারা সাত্ত্বনা পুরস্কার? কী প্রয়োজন ছিল এই সম্পর্কে জড়ানোর?
বাড়ি থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরতেই ফোনটা বেজে ওঠে অপুর৷ তন্ময় ফোন করছে, ও কানে লাগিয়ে একটু বিরক্তি মাখা গলাতেই বলে, ‘তুই এক্ষুনি তো ঘুমালি, এর মধ্যেই উঠে পড়তে হল!’
‘তোকে একা একা ওখানে যেতে দেব ভেবেছিস?’ তন্ময়ের গলায় যেন চাপা বিদ্রুপ, ‘যে লেভেলের ইমোশনাল তুই৷ কী বলতে কী বলে গোটা ব্যাপারটা ছড়িয়ে দিবি…’
‘এত বছর পাশে কেউ ছিল না, সব দিব্যি সামলেছি৷ এখন এত প্যাম্পার করার দরকার নেই আমাকে৷’
‘সামলেছিস? তাহলে ওই লোকটা এখনও তোর জীবনে থেকে যেত না৷’
মাথার উপর থেকে চুল সরিয়ে জানলার কাচ দিয়ে বাইরে তাকায় অপু, ‘তোকে অনেকবার বলেছি তন্ময়, ও আমার জীবনে আজ মাসছয়েক হল নেই৷ আমার ওকে, ওর আমাকে দরকার হয় না৷ যেটা রয়ে গেছে সেটা অভ্যেস৷ সারাদিন ওর সঙ্গে কথা বলতাম একটা সময়ে৷ সেটা একেবারে নীল হয়ে গেলে একটু অস্বস্তি হবেই… তাছাড়া ওর ওই ছোট ছোট পাগলামিগুলো মিস করলে…’
‘ওই… ওই দিয়েই জাদুটোনা করে রেখেছে তোকে৷ ক-টা আজগুবি কথা বলে টক্সিক সম্পর্কে ফেলে রেখেছে…’
উপরে নিচে মাথা নাড়ায় অপু, ‘জানি, সম্পর্কটা টক্সিক হয়ে গেছে৷ আমি হুট করে কিছু ডিসিশন নিই না…’
আজ সকালেই ব্যাঙ্গালোর এসে অপুকে জানিয়েছে সায়ন্তন৷ ফোনে অবশ্য কিছু খুলে বলেনি অপু৷ বলেছে বিশেষ জরুরি কিছু কথা আছে৷ তার জন্য একঘণ্টা সময় দিলেই যথেষ্ট৷ কিন্তু সামনাসামনি দেখা হওয়া দরকার৷ তেমন হলে সে বিকেলের ফ্লাইট ধরেই আবার কলকাতা ফিরে যেতে পারে৷ অপু জানে একটা গোটা দিন কিছুতেই অকারণে এখানে পড়ে থাকবে না সায়ন্তন৷
‘এটা নভেম্বর মাস, না রে?’ ফোনটা এখনও ধরা আছে দেখে ও জিজ্ঞেস করে৷
‘হ্যাঁ, কেন?’
‘শিউলি ফুল তো অক্টোবরে হয়, নভেম্বরেও হয় মনে হয়?’
‘উফ!’ তন্ময় এবার তিতিবিরক্ত হয়ে ওঠে, ‘শিউলি ফুলে কোনও ম্যাজিক নেই অপু৷ নিকট্যান্থেস আরবর ট্রিস্টিস, ইটস জাস্ট আ ফ্লাওয়ার লাইক এনি আদার৷ তোকে যেটা আটকে রাখতে পারে সেটা তোর মায়া, আর দু-চারটে ছেঁদো ইমোশনাল কথা৷ আর এই মায়া কাটিয়ে তোকে বেরিয়ে আসতে হবে৷ ফর ইয়োর সেক!’
অপুর মুখেও একটা হাসি ফুটে ওঠে এবার, ‘আসলে এতটা সময় ধরে বিশ্বাস করতাম তো ব্যাপারটা, বিশ্বাসটাও একটা অভ্যেস হয়ে গেছে!’
বাইরে ব্যস্ত ঝাঁ চকচকে শহর ছুটে চলেছে৷ গত দু-বছরে এই শহরটার সঙ্গে একটা আপাত বন্ধুত্ব হয়ে গেছে অপুর৷ এখানে মানুষ খুব স্ট্রেট ফরওয়ার্ড৷ সবকিছুর মধ্যে একটা ওয়ার্কিং অর্ডার আছে৷ হচ্ছে হবে করে কিছু চলে না৷
কলকাতাকে খুব একটা মিস করে না অপু৷ ওর তেমন কিছু আর নেই ওখানে৷ ও শহরের মুখগুলোর মধ্যে কোথায় যেন একটা স্লথ জীবন যাপন, একটা ঝিমন্ত ভাব৷ এরপর ও ঠিক করেছে বাইরের কোনও দেশে গিয়ে সেটল করবে৷
ট্যাক্সিটা যখন রঙ্গিণী পার্কের বাইরে থামে তখন কাঁটায় কাঁটায় এগারোটা বাজছে৷ ভাড়াটা মিটিয়ে পার্কের ভিতরে ঢুকে আসে অপু৷ অজান্তেই চোখ চলে যায় ভিতরে কারশেডের ঠিক পাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা ঝাঁকড়া শিউলি গাছগুলোর দিকে৷ সায়ন্তন কি এসেছে এতক্ষণে? এর মধ্যেই কি ফুল কুড়িয়ে নিয়েছে? যা খুশি করুক ও৷ যেভাবে খুশি, যা খুশি নাটক করুক, অপু নিজের মন গলতে দেবে না৷
চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় অপরাজিতা৷ জ্যাকেটটা ভালো করে টেনে নেয় গায়ে৷ সায়ন্তনকে দেখা যাচ্ছে না৷ লেট করছে মনে হয়৷ লেট কালচারটা কলকাতার সিগনেচার৷ প্রেমিকার সঙ্গে শেষবার দেখা করতে এলেও ঘড়ির কাঁটা রেসে হারিয়ে দেয় এদের৷
ফোনটা বেজে ওঠে৷ সেটা সাইলেন্ট করে আবার পকেটে ঢুকিয়ে দেয় অপরাজিতা৷ দূরে কয়েকটা বাচ্চা রঙিন বল নিয়ে খেলা করছে৷ আজ মনে হয় রবিবার৷ স্কুল ছুটি৷ পার্কের ভিতরেই শীতের আমেজ মাখতে মাখতে জগিং করছে কেউ৷ একজন পরিচিত মনে হয় অপরাজিতার৷ ওকে দেখে অল্প হাসে পরিচিতা, আবার ছুটতে থাকে দূরের দিকে৷
‘একটু দেরি হয়ে গেল অপু, রাগ করিসনি তো?’ পেছন থেকে গলাটা শুনে অপরাজিতার বুকের মধ্যে একটা ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল, ‘আসলে ফ্লাইটটা এমন ঝোলাল…’ হাতের ব্যাগটা কালো বেঞ্চের উপরে রেখে পাশে বসতে বসতে বলল সায়ন্তন৷
‘আমার তোর উপর আর রাগ আসে না৷’
‘আচ্ছা?’ সায়ন্তনের মুখে আলগা হাসি খেলে যায়, ‘তাহলে ওদিকে মুখ ঘুরিয়ে আছিস কেন বাবা? কতদিন দেখিনি বল তো তোকে?’
‘দেখিসনি?’
সায়ন্তন হাত ঝেড়ে যেন সরিয়ে দিতে চায় প্রসঙ্গটা, ‘আরে ওসব ভিডিও কল-ফল সব তোদের কর্পোরেট প্রেমের কালচার৷ আমাদের শহরে বুঝলি, রাস্তার ধারের চায়ের দোকানে মাটির ভাঁড়ে…’
‘আমি আর তোর সঙ্গে থাকতে চাই না৷’ কাঠকাঠ গলায় কথাটা বলে ওর দিকে চোখে তুলে তাকাল অপরাজিতা৷ কাঠিন্য ঝরে পড়ল সেই চোখে৷
‘তো তুই আমার সঙ্গে আছিস কই? আই মিন দু-বছর ধরে তো…’
‘তুই নিজেকে যতটা বোকা প্রিটেন্ড করিস ততটা তুই নোস সায়ন্তন৷ তুই জানিস আমি কী বলতে চাইছি৷ অ্যান্ড দ্যাটস ফাইনাল৷ ইউ হ্যাভ লস্ট মি…’
কয়েকটা অদ্ভুত মুহূর্ত কেটে যায়৷ সায়ন্তন কোনও কথা বলে না৷ বাচ্চাগুলো মনে হয় এতক্ষণে খেলা থামিয়ে ওদের দিকে চেয়ে আছে৷ সেই চেনা মুখটাও কোনও গাছের আড়ালে লুকিয়ে ওদেরই দেখে চলেছে৷
‘আমাকে ভালোবাসিস না আর, এই তো?’ সায়ন্তনের গলা কাঁপে না৷ ভারি স্বাভাবিক একটা প্রশ্ন করেছে যেন৷
‘বাসি, কিন্তু তোর সঙ্গে আর থাকতে পারব না৷’
‘কেন?’
‘কারণ আই ফাকিং সাফার৷ তোর সঙ্গে এক-একটা দিন কাটে আর আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে৷ দম বন্ধ হয়ে আসে আমার৷ ডোন্ট ইউ ফাকিং গেট ইট? আমার জীবনের সব থেকে বড় রিগ্রেট তোকে ভালোবাসা…’ একদমে কথাগুলো বলে হাঁপাতে থাকে অপু৷ নিজের মাথার রগটা চেপে ধরে ও৷
‘জল খাবি?’
‘প্লিজ ডোন্ট ডু দিস৷’
ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে ওর দিকে এগিয়ে দেয় সায়ন্তন, ‘বাড়ি থেকে জলের বোতল নিয়ে বেরবি সবসময়৷ শীতকালে তেষ্টা কম পায় বলে মনে থাকে না…’ কথাটা বলে বেঞ্চ থেকে উঠে পড়ে সায়ন্তন৷ আর না দাঁড়িয়ে পা বাড়ায় দূরের দিকে৷
অপু ডেকে ওঠে ওকে, ‘কোথায় যাচ্ছিস তুই?’
সায়ন্তন অবাক হয়ে ফিরে তাকায় ওর দিকে, ‘কোথায় আবার, বাড়ি… ফ্লাইট দেরি আছে৷ ততক্ষণ লাউঞ্জে বসে…’
কী যেন ভেবে একটু থতমত খায় অপরাজিতা৷ ঠোঁট দুটো কয়েকবার কেঁপে ওঠে, ‘তোর কিছু দেওয়ার নেই আমাকে?’
‘আমি ধার নিয়েছিলাম নাকি তোর থেকে?’
আর কিছু বলে না অপু৷ একটা অদ্ভুত অনুভূতি ক্রমশ ঘিরে ধরছে ওকে৷ দূরে কারশেডের পাশে গাছগুলোর নিচে ফুল পড়ে আছে৷ তার গন্ধ, সেই ম্যাজিকের মতো গন্ধ এখান অবধি ভেসে আসছে৷
‘ঠিক আছে, ভালো থাকিস সান…’
কথাটা বলে দ্রুত পা চালায় অপরাজিতা৷ পার্কের ভিতরেই বেশ কিছুদূর হেঁটে আসে ও৷ না, ওর পেছনে কোনও পায়ের শব্দ নেই৷ ও বুঝতে পারে যেতে যেতে ওর দিকে শেষবারের মতো ফিরে তাকায়নি কেউ৷
ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে সেটা বেজে চলেছে এখনও, তন্ময়৷ রিসিভ করে কানে ধরে অপু৷ ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন গলা শোনা যায়, ‘ডান?’
‘হ্যাঁ বলে দিয়েছি সব…’
‘দেন? ও কী বলল?’
‘নাথিং, ওর কিছু যায়-আসে না৷ জাস্ট শুনল, চলে গেল…’
কয়েক সেকেন্ড কিছু উত্তর দেয় না তন্ময়৷ অপরাজিতা রেখে দিতে যাচ্ছিল ফোনটা৷ ওপাশ থেকে নৈঃশব্দ্য ভেঙে প্রশ্ন আসে, ‘তোর কষ্ট হচ্ছে, নারে অপু?’
এই প্রশ্নটাতেই থমকে যায়— সে৷ দু-দিকে মাথা নেড়ে বলে, ‘সেটাই আশ্চর্য রে ভাই৷ এতদিন এত পাগলের মতো ভালোবাসলাম ওকে, আমি জানি আজও ভালোবাসি, কিন্তু ওকে ছেড়ে আসতে এতটুকু কষ্ট হচ্ছে না কেন আমার…’
ওপাশ থেকে আবার কিছু বলছে তন্ময়৷ সেসব কানে ঢোকে না অপুর৷ ওই একটা প্রশ্ন ভাঙা রেকর্ডের মতো কানে বাজতে থাকে ওর, কষ্ট হল না কেন? সায়ন্তনকে ছেড়ে আসতে কষ্ট হল না কেন?
ঠিক এই সময়ে কোনও অচিন ইশারায় কে যেন ওর কানের কাছে শুনিয়ে গেল একটু আগের প্রশ্নটা, ‘কী করেছ তুমি আমার জন্য? এই তিনটে বছরে কী দিয়েছ আমাকে?’
ওর মনে হল আবার একটা রাত নেমে এসেছে৷ আবার ওদের চারপাশ জুড়ে বাজি ফাটতে শুরু করেছে৷ আলোয় আলোয় ভরে যাচ্ছে আকাশ৷ ওর ঠিক সামনে ওর কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে সায়ন্তন৷ মুখে সেই পুরনো নরম হাসিটা খেলা করছে ওর, ওর চোখের দিকে চেয়ে বলছে, ‘এই যে ছেড়ে যাওয়াটা, যে যাওয়াটায় তোমার কষ্ট হল না৷ এমন করে তোমাকে ভালোবাসলাম যে অনায়াসে ভুলে যেতে পারলে৷ তোমার বুকে কোনও চিরকালীন ছাপ রেখে গেলাম না৷ সেই ভাঙাচোরা শহরটার মতো, যেখানে আর তুমি ফিরে যেতে চাও না৷ ওটাই আমার আর্ট অপু, ওটাই আমি পারি… আমার মাকে, আমার মরে যাওয়া কুকুর, বিড়াল, দাদু সবাইকে ওটাই দিয়ে এসেছি আমি… এই যে তোমার আজীবনের ভালো থাকায় কোনও অভ্যাসের শিউলি ফুল রেখে গেলাম না৷ বলো, আমি কিছু দিইনি তোমাকে অপু?’
রাতটা নিভে আসে হুট করে৷ বাজির আওয়াজ মিলিয়ে যায় দূরে৷ কী মনে হতে একবার শেষবারের মতো পেছন ফিরে তাকায় অপু৷
নাঃ, কেউ নেই সেখানে৷ কেবল মৃত্যুপথযাত্রী কিছু শিউলি ফুলের গন্ধ নাকে আসে…
-সমাপ্ত-