শিউলির গন্ধ

শিউলির গন্ধ

মিত্তির বাড়ির দুই ভাই। বড় বিমল মিত্তর, মেজো নির্মল মিত্তির অনেকদিন পরে আজ দাবা খেলতে বসেছে। দোতলার রাস্তার ধারের ঘরে মাথার ওপর আলো জ্বলছে। সুন্দর সাজানো ঘর। সম্পন্ন পরিবার। একটু আগে সুন্দর গন্ধওয়ালা চা খাওয়া হয়েছে সুন্দর দামি কাপে। বড় নামকরা ডাক্তার। মেজো নামকরা অধ্যাপক। দুজনের খুব সদ্ভাব। যেন দুই ইয়ার বন্ধু। সামনে একটা সুন্দর টেবিলে দাবার ছক। ঘুঁটি সাজান। বড় আর মেজো মুখোমুখি। বড় চাল দেওয়ার পর চা এসে গিয়েছিল। মেজোর চালটা বাকি ছিল। চা শেষ করে মেজো দাবার ছকের ওপর ঝুঁকে পড়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘বড়দা, কিছু একটা কেরামতি করেছ মনে হচ্ছে? তোমার এই বোড়েটা তো এখানে ছিল না, এটা আবার কোথা থেকে এল!’

বড় বলল, ‘কোথা থেকে আসবে? ওটা ওখানেই ছিল।’

মেজো তাল ঠুকে বলল, ‘না, না হতেই পারে না। আমি অনেকক্ষণ ধরে তাক করে আছি। ওই রুট দিয়ে ঢুকে তোমার রানিকে কব্জা করব বলে, এটা তোমার জোচ্চুরি। তুমি কোন ফাঁকে ওটাকে তুলে এনে বসিয়েছ!’

বড় গম্ভীরকণ্ঠে বলল, ‘দ্যাখ মেজো মিথ্যে কথা বলবি না। জীবন আর খেলা দুটোতেই সত্যকে ধরে থাকবি।’

মেজো বলল, ‘শোন বড়দা, এই দাবার ব্যাপারে তোমার একটা ব্যাড রেপুটেশন আছে। তোমার সঙ্গে যে খেলতে বসে সেই হারে। তুমি যদি দাবায় এত বড় চ্যাম্পিয়ান হতে তবে কারপভকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছ না কেন? তোমার যত কেরামতি বাড়িতে, আর সে কেরামতিটা হল জোচ্চুরি। কুসি আমায় আগেই সাবধান করেছিল—মেজদা চোখ বুজিয়ে থেক না, চোখ খোলা রেখ, আমি এই উপদেশটাকে একটু অ্যাডজাস্ট করে নিয়েছিলাম। চোখ বুজিয়ে মিটিমিটি করে দেখছিলুম তুমি কী কর। তুমি এদিক ওদিক তাকিয়ে টুক করে ওঠা ঠেলে দিলে!’

বড় সুর করে বলল, ‘তুমি স্বপ্ন দেখছিলে মানিক! ওটা প্রথম থেকেই ওখানে আছে।’

মেজো বলল, ‘না ওটা ছিল না।’

বড় বলল, ‘দাদাকে জোচ্চর বলতে তোর লজ্জা করছে না! তোর অন্তরে লাগছে না!’

মেজো আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলল, ‘জোচ্চুরি করলে অন্তরে লাগবে না?’

বড় উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, ‘তার মানে আমি একটা চিট!’

মেজো বলল, ‘আমি ইংরেজি বলিনি। জোচ্চর আর চিট দুটো আলাদা ব্যাপার। আকাশ পাতাল তফাৎ। চিট অনেক বড় ব্যাপার। সে তোমার দ্বারা হওয়া সম্ভব নয়। তুমি ছিঁচকে চোর হতে পারবে, ডাকাত কোনওদিনই নয়।’

বড় বলল, ‘ছিঁচকে চোর কথাটা ভালো হল? ছিঁচকে চোর, সিঁধের চোল ঘৃণ্য জীব। বরং ডাকাত অনেক রেসপেকটেবল।’

মেজো এইবার আদেশের সুরে বলল, ‘ঘুঁটিটা ওখান থেকে সরাও।’

বড়ও ভেতরে ভেতরে তেতে উঠছে। বলল, ‘কেন সরাব?’

মেজো তর্জনী নাড়িয়ে বলল, ‘ওটা ওখানে ছিল।’

বড় দৃঢ়কণ্ঠে বলল, ‘ওটা ওখানেই ছিল না।’

মেজো বলল, ‘না ছিল না।’

বড় বলল, ‘হ্যাঁ ছিল।’

মেজো বলল, ‘না ছিল না—ছিল না, ছিল না, ছিল না।’

মেজোর রকম দেখে বড় যেন ঝড়ে ওল্টান ছাতার মতো ছেতরে গেল। ঘেমো মুখখানায় বাইরের আলো পড়ে চকচক করছে। মনে হচ্ছে যেন ঘাম তেল মাখানো হয়েছে। বড় মিত্তির যেন বড় ঠাকুর হয়ে শনিবারের পুজো নেবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে।

বড় মেজোর দিকে তাকিয়ে দেখল অবস্থা বিশেষ সুবিধের নয়। এ অবস্থায় কুসিই রেসকিউ করতে পারে। বড় গলা খুলে চেঁচাল, ‘কুসি, কুসি।’ ডাক তো নয় জয়ঢাক! বাড়ি কেঁপে গেল। কুসি রান্নাঘরে ছিল, ছুটে এঘরে চলে এল। হাতে লিকলিকে খুন্তি, বিচারকের হাতুড়ির মতো উঁচিয়ে ধরে বলল, ‘তোমাদের জ্বালায় বাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে। তোমরা বিয়ে কর বাপু, বেঁচে যাই!’

বড় বলল, ‘সে পরে দেখা যাবে। আগে তুই বল আমাকে তুই চোর বলিস, ছিঁচকে চোর! আমি নাকি ফ্রিজ খুলে চুরি করে মিষ্টি খাই? ছেলেবেলায় আমার জন্যে মা আচারের বয়াম সিন্দুকে চাবি দিয়ে রাখত? শেষ জীবনে আমি ডাকাতি করব? আমি ব্যাগ দেখলেই খুলে টাকা সরাই? তোর কানের দুল বিক্কিরি করে আমি বাদাম ভাজা খেয়েছি?’

মেজো হাত তুলে বলল, ‘দাঁড়াও, দাঁড়াও, তুমি এসব কী বলছ?’

বড় বলল, ‘আরে দাঁড়া, দাঁড়া, কুসির নাম করে তুই যা বলেছিস, তারপর এই গুলোই আসে। একটা রোগের পেছনে পেছনে দশটা রোগ এসে জোটে।’

কুসি বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আঃ কী হয়েছে বলবে তো?’

মেজো বলল, ‘আরে সেই ওল্ড কেস। খেলতে খেলতে অন্যমনস্ক হয়েছি অমনি ঘুঁটি সরিয়েছে!’

বড়র দিকে ফিরে কুসি বলল, ‘বড়দা, এই রোগটা তোমার আছে। তুমি যখনই আমার সঙ্গে লুডো খেলতে বসেছ তখনই আমি গোহারান হেরেছি। তুমি পাঁচ ফেলে ছয়ের চাল দাও। আঙুলের কায়দায় ছক্কা ফেল। এ তোমার অনেকদিনের ব্যামো। তোমার ভেতর স্পোর্টসম্যান স্পিরিট নেই। তুমি হারতে ভয় পাও, হারাতে চাও খালি!’

বড় বলল, ‘তার মানে আমি ক্যারেক্টার লেস! আমি একটা বদলোক! তাহলে কাল থেকে তোরা আমাকে দাদা বলিস না!’

মেজো আবার উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, ‘তুমি আচ্ছা ক্রুকেড লোক তো!’

বড় জানতে চাইল, ‘ক্রুকেড মানে?’

মেজো বলল, ‘বাঁকা লোক!’

বড় আদুরে গলায় সুর করে বলল, ‘আর তুমি বুঝি খুব সোজা লোক!’

কুসি এবার ভয়ানক রেগে গেল। দুই ভাইয়ের দিকে কটমট করে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে দাবার ছক শুদ্ধু টেবিলটাকে উলটে দিল। রাগে বিরক্তিতে তার চোহারা অন্যরকম। বড়, মেজো দুই মিত্তিরই কুসির এমন মূর্তি অনেককাল দেখেনি। কিছুটা দমে গেছে তারা। কুসি গরগর করতে করতে বলল, ‘তোমরা ফের যদি কোনওদিন দাবা খেলতে বসেছ তাহলে এই খুন্তি গরম করে ছ্যাঁকা দোব!’

বড় চুপসে গিয়ে বলল, ‘তা তুমি দিতে পার। বড় ভাইকে যখন চোর বলতে পার, তখন ছ্যাঁকাও দিতে পার!’

কুসির রাগ হতেও যতক্ষণ যেতেও ততক্ষণ। ওর মনটা আসলে শরতের আকাশের মতো, এই রোদ, এই বৃষ্টি। গেরস্ত ঠিক তাল রাখতে পারে না। কুসি এবার নরম সুরে বড়কে বলল, ‘তোমার অনেক পয়সা আমি জানি, তবে আমার হাতের চায়ের মতো চা কোথাও পাবে না।’

বড় বলল, ‘কোন হাত? যে হাত খুন্তি ছ্যাঁকা দেয়! আমি জানি যেদিন আমার মা মারা গেছেন সেদিন থেকে আমার আদরও চলে গেছে। আর এই মেজো জ্ঞানের অহঙ্কারে একেবারে ফেটে পড়েছে। অধ্যাপক!’

মেজো খানিক দম নিয়ে বলল, ‘বড়দা, তুমি তিলকে তাল করছ!’

বড় হাত নেড়ে নাকে সুরে বলল, ‘আজ্ঞে না, আমি তিলকে তাল করছি না? তোমরা যা বলছ, অন্য কেউ হলে গৃহত্যাগ করত।’

দাদার এই কথায় মেজো যেন হাতে অস্ত্র পেল। বেশ আয়েশ করে জমিয়ে বসে বলতে শুরু করল, ‘শোন বড়দা, এই গৃহত্যাগের কথা যখন বললে তখন আমার স্ট্যাটিসটিক্সের কথা শোন। আমি জনে জনে জিজ্ঞাসা করে দেখেছি, গৃহত্যাগ করে কে কতদূর যেতে পেরেছে। ওই গেট পর্যন্ত, কিংবা ওই গেটের বাইরে রাস্তা পর্যন্ত। একজনই একটু বেশিদূর পর্যন্ত গিয়েছিল, তাও মোড়ের ল্যাম্পপোস্ট পর্যন্ত! রাত বারটার সময় পান বিড়ির দোকান বন্ধ করতে করতে দোকানদার বলল, ”আমি তো চললাম, আপনি কি করবেন?” সে তখন কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ”ভাই বাড়িতে একটু বলে পাঠাওনি আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি, একবার ডাকলেই যেতে পারি।” অতএব গৃহত্যাগ করবার আগে ভেবে নাও কোথাও যাবে, কার কাছে!’

বড় ছেলেমানুষের মতো বলে উঠল, ‘আমার যাবার অনেক জায়গা আছে!’

কুসি বলল, ‘ঠিক আছে, জায়গাগুলো বলো!’

বড় ফ্যাঁস করে হাই তুলে বলল, ‘যেমন ধর, যেমন ধর, যেমন ধর, যেমন…’ বড় পাংচার হাওয়া টিউবের মতো ফুস করে নেতিয়ে পড়ে, অসহায়ের মতো বলে উঠল, ‘যাবার কোথাও জায়গা নেইরে! এক কাপ চা খাওয়াবি!’

মেজোর আহ্লাদ এবার দেখে কে! চেয়ার থেকে ছিটকে উঠে দাঁড়াল। মুখে যুদ্ধজয়ের হাসি। নিজের বুকে অহঙ্কারীর মতো চাপড় মারতে মারতে একপা-দু’পা করে এগোচ্ছে আর বলছে, ‘পথে এস! শোন বড়দা, আমরা যে গোয়ালে আছি সেই গোয়ালেই মিলে মিশে থাকতে হবে। তুমি হলে বড় ষাঁড়, আমি হলুম মেজো ষাঁড়, ভাইগুলো ষণ্ড, আর…’

মেজো আবেগের আলসেতে হাঁটছে। হড়কালেই বিপদ! কুসি বলে উঠল, ‘আর এগিও না মেজদা!’

হঠাৎ দরজার কাছ থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘আসতে পারি!’

বলতে বলতে ঢুকে পড়লেন এক প্রৌঢ়। ঠোঁট দুটো পানের পিকে রাঙা হয়ে আছে।

কুসি খুশি হয়েছে তাঁকে দেখে। ‘আরে প্রমোদ জ্যাঠা!’

প্রমোদ জ্যাঠা ঘরটা নিরীক্ষণ করতে করতে বলতে লাগলেন, ‘অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা নিয়ে আমি তোমাদের কাছে এলাম। দেখ এ পাড়ায় আমার নাম মিস্টার অ্যাংজাইটি। কিন্তু তোমরাই বল, দুশ্চিন্তা না করে থাকা যায়! এটা কী একটা দিনকাল, কোনও ভদ্রলোক এভাবে বাঁচতে পারে!’

বড় বলল, দাঁড়িয়ে কেন বসুন! আচ্ছা আপনার জন্ডিস হয়েছিল কেমন আছেন?’

প্রমোদ জ্যাঠা বললেন, ‘অ্যাই ভালো কথা জিজ্ঞাসা করেছ, জন্ডিসে কী হয় তুমি জানো?’

কুসি জানতে চাইল, ‘আপনি চা খাবেন?’

প্রমোদ জ্যাঠা, ‘অবশ্যই।’

বড়মিত্তির বললেন, ‘তার মানে লিভারটা ভালো যাচ্ছে।’

প্রমোদ জ্যাঠা বললেন, ‘ডাক্তার হয়ে এ কথাটা কী করে বললে? চায়ের সঙ্গে লিভারের কী সম্পর্ক? গলায় চা ঢালবে, সড়াক করে স্টমাকে নেমে যাবে। সেখান থেকে জলীয় পদার্থটি তার পথ ধরে বেরিয়ে যাবে টয়লেটে। আর চায়ের কষটা লেগে যাবে পাকস্থলীর ভেতরের দেয়ালে। তাহলে কী দাঁড়ায়? চায়ের সঙ্গে আলসারের সম্পর্ক। লিভারের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। তবে হ্যাঁ জন্ডিসের সঙ্গে লিভারের সম্পর্ক আছে।’

বড় ডাক্তারি চালিয়ে বলল, ‘জল ফুটিয়ে খাচ্ছেন?’

প্রমোদ জ্যাঠা ব্যঙ্গ করে বলল, ‘জল ফুটিয়ে! আমার জন্যে এত তদবির করবে কে? তোমাদের জীবনের দাম আছে। আমার জীবনের কী দাম!’

মেজো মিত্তির এতক্ষণ ধরে চুপ করে শুনছিল, এবার বলল, ‘আপনি এক সময় কত ভালো বেহালা বাজাতেন।’

প্রমোদ জ্যাঠা আবার ব্যঙ্গ করে বললেন, ‘একালে বেহালা বাজারে লোকে মারতে আসে। বেহালা নাকি শুধু কাঁদতে জানে। কথাটা খুব মিথ্যে নয়। যাত্রা থিয়েটার সিনেমায় কান্নার সিন হলেই বেহালা বেজে ওঠে।’

মেজো বলল, ‘বেহালায় আপনি ক্ল্যাসিক্যাল সুর টুর বাজাতে পারেন, সময়টা ভালো কাটবে। বিদেশি কনসার্টে একসঙ্গে পঞ্চাশটা বেহালা বাজে।’

প্রমোদবাবু গলা তুলে বলে উঠলেন, ‘বিদেশের সঙ্গে কেন তুলনা করছ, তোমরা শুনেছ?’

হঠাৎ সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। প্রমোদবাবু বসেছিলেন চেয়ারে, টুপ করে মাটিতে বসে পড়লেন। যেন যোগাসনে বসেছেন। শরীরটা থেকে থেকে কেমন যেন গুলিয়ে উঠছে। পেট, পেট থেকে বুক, বুক ঠেলে সুরের ফোয়ারা যেন উঠতে চাইছে গলায়।

মেজো বড়র ডানদিকে চলে এসেছে। বড়র হাতটা মেজোর কাঁধে। অনেকক্ষণ পর কুসি ঢুকছে চা নিয়ে। দৃশ্যটা দেখেই একটু নড়ে উঠল। কাপ চলকে থিপিক করে চা পড়ল মেঝেতে। ঠোঁট কামড়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ল।

বড় মেজোর কানে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, ‘একেই বলে ঠিক ঠিক সুর সাধক। আই বল দুটো দেখেছিস! কোন জগতে আছেন বল তো?’

মেজো বলল, ‘আবার ডাক্তারি? এখন তুমি তোমার চেম্বারে নও, বসে আছ মিত্তিরদের জলসাঘরে।’

বড় বলল, ‘ঠিক আছে ঠিক আছে।’

মেজো বলল, ‘আজ মনে হয়, বেহালায় নয়, কণ্ঠে।’

বাতাসে শিউলির গন্ধ। আকাশে কে যেন কালির দোয়াত উলটে দিয়েছে। না জানি আজ প্রমোদ জ্যাঠা কি গান ধরবেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *