পরিশিষ্ট

শাস্ত্র ও স্বাভীষ্ট : বিদ্যাসাগরের আধুনিকতা

শাস্ত্র ও স্বাভীষ্ট : বিদ্যাসাগরের আধুনিকতা

স্বপন চক্রবর্তী

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রচনা বলে একটি লেখা চলে আসছে। সংক্ষিপ্ত রচনাটির শিরোনাম ‘বাল্যবিবাহের দোষ’। ১৮৫০ সালে সেটি বেরিয়েছিল সর্ব্বশুভকরী নামের মাসিক কাগজে। অনামা লেখাটি যে বিদ্যাসাগরের কীর্তি তা বলেছেন শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন। বিদ্যাসাগর-রচনার বিভিন্ন সংগ্রহে সংকলিতও হয়েছে নিবন্ধটি। তবুও প্রবন্ধের একটি জায়গায় পৌঁছে খটকা লাগতে পারে পাঠকের। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে লেখক বলছেন যে, স্মৃতিশাস্ত্রের অনুজ্ঞা এবং লোকাচার মিলে এমনই এক দুর্বহ সামাজিক চাপ সৃষ্টি করে গৃহস্থের উপর যে, বাল্যবিবাহ ও তার লঙ্ঘনের শাস্ত্রবিহিত শাস্তিকে নীতিবিরুদ্ধ মনে হলেও ব্যক্তিবিশেষের গত্যন্তর থাকে না, তিনি নিরুপায় চিত্তে ‘… চিরাচরিত লৌকিক ব্যবহারের পরতন্ত্র হইয়া স্বাভীষ্ট সিদ্ধি করিতে সমর্থ হন না। তাঁহার আন্তরিক চিন্তা অন্তরে উদয় হইয়া ক্ষণপ্রভার ন্যায় ক্ষণমাত্রেই অন্তরে বিলীন হইয়া যায়’ (১.৩৫৫)।

দুই পরস্পরবিরোধী ভাব একত্রিত হয়েছে উৎকলিত শব্দগুলিতে। একদিকে স্মৃতিশাস্ত্র এবং লোকাচার, অন্যদিকে অন্তর এবং ‘আন্তরিক চিন্তা’; এক প্রান্তে ‘পরতন্ত্র’, অপর প্রান্তে ‘স্বাভীষ্ট’। ইঙ্গিত স্পষ্ট। শাস্ত্র ও লোকাচারের আশ্রয় হল ব্যক্তির সমাজভীতি, লোকনিন্দার আশঙ্কা, পরের ভয়; আর স্বাভীষ্ট সিদ্ধির পথ হল ব্যক্তিবিশেষের আপাতমুক্ত চিন্তা, তার অন্তরের স্বরাট ইচ্ছা। ‘স্ব’ ও ‘পর’-এর এই বিরুদ্ধভাব ঊনবিংশ ও গত শতাব্দীর ভারতীয় আধুনিকতার আলোচনায় এক চেনা ঠাটের মধ্যেই পড়ে। এক বছর আগে, ১৮৪৯ সালে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রকাশ করেছিলেন জীবনচরিত। উইলিয়াম ও রবার্ট চেম্বর্সের মূল ইংরেজি বই থেকে আংশিক অনুবাদে এমনভাবেই আলোচিত হয়েছিল সৌরবিশ্ব সম্বন্ধে কোপার্নিকাসের নতুন মতবাদের প্রেক্ষাপট। একদিকে প্রাচীন বিচার, অন্যদিকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বনির্ণয়:

তৎকালীন লোকদিগের এই রীতি ছিল, পূর্বাচার্যেরা যাহা নির্দেশ করিয়া গিয়াছিলেন, কোনও বিষয়, তাহার বিরুদ্ধ বা বিরুদ্ধবৎ আভাসমান হইলে, তাঁহারা শুনিতে চাহিতেন না। বস্তুতঃ, তাঁহারা কেবল প্রমাণপ্রয়োগেরই বিধেয় ছিলেন, তত্ত্বনির্ণয়নিমিত্ত স্বয়ং অনুধ্যান বা বিবেচনা করিতেন না। (১.১৯৭)

এখানেও দেখি সেরকমই এক দ্বন্দ্ব। একদিকে অতীত সিদ্ধান্ত, অন্যদিকে নিজস্ব— ‘স্বয়ং’— অনুধ্যান ও বিবেচনা। ‘পর’ ও ‘স্ব’— এই বিরোধের রাজনৈতিক নিহিতার্থ আলোচনার জন্য পরে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখবেন ‘ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এবং পরাধীনতা’ প্রবন্ধ, যেটি প্রবন্ধ-পুস্তক গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়ে বেরবে ১৮৭৯ সালে। এই কাঠামোর মধ্যেই বাল্যবিবাহের বিচার হওয়া উচিত বলে মনে করতেন বিদ্যাসাগর— এমন ভাবাটাই প্রবন্ধের পাঠকের কাছে প্রত্যাশিত। ‘এইরূপে লোকাচার ও শাস্ত্রব্যবহারপাশে বদ্ধ হইয়া আমরা চিরকাল বাল্য বিবাহনিবন্ধন অশেষ ক্লেশ ও দুরপনেয় দুর্দশা ভোগ করিতেছি’ (১.৩৫৫)।

‘বাল্যবিবাহের দোষ’ প্রবন্ধের লেখক এখানেই থামছেন না। এরপর তিনি এক ধাপ এগিয়ে পাড়ছেন পুরুষ-নারীর প্রেম ও মৈত্রীভিত্তিক দাম্পত্যের বিপজ্জনক প্রসঙ্গ। ‘মনের ঐক্যই প্রণয়ের মূল’ (১.৩৫৭)। ‘বালদম্পতিরা পরস্পরের আশয়’ (১.৩৫৭) জানার সুযোগ পায় না, পাওয়ার কথাও নয়। ‘এই জন্যই অস্মদ্দেশে দাম্পত্যনিবন্ধন অকপট প্রণয় প্রায় দৃষ্ট হয় না, কেবল প্রণয়ী ভর্তাস্বরূপ এবং প্রণয়িনী গৃহপরিচারিকাস্বরূপ হইয়া সংসারযাত্রা নির্বাহ করে’ (১.৩৫৭)। এ কথা ১৮৫০ সালে বাঙালি পণ্ডিত বলছেন ভাবলে নিজেদের বেশ ‘আধুনিক-আধুনিক’ লাগে। এমন প্রণয় বাঙালির দাম্পত্যে দুষ্প্রাপ্য বুঝে মাইকেল মধুসূদন দত্ত জীবনে ও কাব্যে প্রেমের পটভূমি সরিয়ে নিয়েছিলেন প্রবাসে, সুদূর অতীতে বা তাঁর সময়কার ইউরোপে, কিংবা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রেমের কাহিনি সাজিয়েছিলেন নির্জন সাগরতটে, সমাজবহির্ভূতা কপালকুণ্ডলাকে নায়িকা করে। শাস্ত্র মেনেও স্ত্রী-পুরুষের জীবনে প্রেম থাকতে পারে, যদি-না তারা প্রেমের বোধোন্মেষের আগেই বিয়ে করে ফেলে: ‘বাল্যকালে বিবাহ হওয়াতে বিবাহের সুমধুর ফল যে পরস্পর প্রণয়, তাহা দম্পতিরা কখন আস্বাদ করিতে পায় না…’ (১.৩৫৫)। বলা যেতে পারে, নর-নারীর বাসনার স্বরাজকেও একরকম জায়গা করে দিয়েছেন নিবন্ধকার।

শকুন্তলা কিংবা ভ্রান্তিবিলাস ঠিক অনুবাদ নয়, এক ধরনের আহরিত বা নিষ্পন্ন রচনা। সেহেতু এগুলিতে অন্তর্ব্যাপ্ত প্রণয়চেতনা মেকি, এমন কথা বিদ্যাসাগরের কোনও পাঠক বলেন না, অন্তত আজকাল বলেন না। সুতরাং, বিদ্যাসাগর নর-নারীর প্রেমে ব্যক্তির স্বরাট ইচ্ছাকে খাটো করছেন না। ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ প্রবন্ধে ব্যক্ত অভিমত নিয়ে খটকা অন্য জায়গায়। শাস্ত্রবিধান ও লোকাচার— এই দুই বিষয় বিদ্যাসাগরের অন্য লেখায় এভাবে সমীকৃত হয়নি। স্মৃতিকাররা কেবল সমাজে ব্যক্তির স্বাধীনতাকে কড়া হাতে নিয়ন্ত্রিত করার স্বার্থে নানা নিয়ম চালু করেছিলেন, এ কথা সত্যের অপলাপ মাত্র— এমনটাই বরং বলেছিলেন বিদ্যাসাগর অন্যত্র।

অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়, কিন্তু একটি বিশেষ দৃষ্টান্তের উল্লেখ করছি। দৃষ্টান্তটির সূত্র বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার গ্রন্থের প্রথম পুস্তকের দ্বিতীয় ক্রোড়পত্র। বিদ্যাসাগর সেখানে বহুবিবাহ সম্পর্কে দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের মত উদ্ধৃত করছেন। বিদ্যাভূষণের বক্তব্য এই যে, একাধিক বিবাহ পুরুষের ক্ষেত্রে শাস্ত্রনিষিদ্ধ নয়। তার প্রমাণ লোকাচার। শাস্ত্রে প্রতিষিদ্ধ হলে, এদেশের মানুষের মধ্যে এমন ভুল চল থাকত না। বিদ্যাভূষণের সিদ্ধান্তমতে পুরুষ শাস্ত্রপ্রণেতারা নিজেদের সুবিধা ও লোভের দিকে চোখ রেখেই নিয়ম রচনা করেছেন, নারীদের কথা আদৌ ভাবেননি। ‘আপনাদিগের সুখস্বচ্ছন্দ ও সুবিধার অন্বেষণেই চিরকাল ব্যস্ত ছিলেন, স্ত্রীজাতির সুখদুঃখাদির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন নাই। এতাদৃশ স্বার্থপর পুরুষেরা স্বহস্তে শাস্ত্রকর্ত্তৃত্বভার প্রাপ্ত হইয়া যে আপনাদিগের একটি প্রধান ভোগপথ রুদ্ধ করিয়া যাইবেন, ইহা কোন ক্রমেই সম্ভাবিত নহে’ (৪.৭৮)।

এমন কথায় আমাদের তথাকথিত ‘আধুনিক’ মন তৎক্ষণাৎ সায় দিতে উন্মুখ হয়ে থাকে। দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ বলছেন যে, স্মৃতিশাস্ত্র লিখেছেন পুরুষেরা, তাঁদের পক্ষপাত ও কাম-ক্রোধ-লোভ সামাজিক বিধান হিসেবে গ্রাহ্য হতে পারে না। আপাতভাবে মনে হয় নারীদের প্রতি বিদ্যাভূষণের মমতা ও সার্বিক ন্যায়বোধের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ প্রবন্ধের মনোভাবের মিল আছে। শাস্ত্র ও লোকাচার মিলে পর্যুদস্ত করছে ব্যক্তিমানুষের বিবেকবোধকে— এ কথা ছিল শেষোক্ত রচনায়। শাস্ত্রের গেরোয় সামাজিক শুভবুদ্ধির যে বিপন্নতার কথা সেখানে বলা হয়েছে তার সুদূর প্রতিধ্বনি শুনি বিদ্যাভূষণের লেখায়, যদিও পুরুষ শাস্ত্রকারদের অভিসন্ধির কথা তোলা হয়নি ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ নামের নিবন্ধে। সজ্ঞানে কেউ বলবেন না যে, বিদ্যাসাগর মেয়েদের কষ্ট তাঁর বন্ধু বিদ্যাভূষণের চেয়ে বুঝতেন কম। ওই একই বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার বইতে তিনি কুলীনদের বহুবিবাহের ফলে মেয়েদের জীবন যে দুর্বিপাকে পড়ে, সেই কুপ্রথার কারণ সম্পর্কে এবং কুলীনে দান করা কন্যাদের কালান্তক দুঃখ নিয়ে ঢের কথা লিখেছেন। নিতান্ত হতভাগ্য কন্যারা ‘নাম মাত্রে বিবাহিতা হইয়া, বিধবা কন্যার ন্যায়, যাবজ্জীবন, পিত্রালয়ে কাল যাপন করেন’। পিতার মৃত্যুর পর ননদ-ভাজদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সংসারের সব কাজ করেও তাঁদের রেহাই নেই: ‘তাঁহাদের অশ্রুপাতের বিশ্রাম নাই বলিলে, বোধ হয়, অত্যুক্তিদোষে দূষিত হইতে হয় না’ (৪.৩৫)। বাঁচা অসহ্য হয়ে উঠলেও তাঁদের লোকাচার-ভক্তি কিছু কমে না। লাঞ্ছনা সহ্য করতে না পেরে তাঁরা পড়শিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ‘আপন অদৃষ্টের দোষ কীর্তন এবং কৌলীন্যপ্রথার গুণকীর্তন করিয়া থাকেন’ (৪.৩৫), এবং দুনিয়ার কোনও জায়গায় চলে যাওয়ার উপায় থাকলে সেখানে পালাবার অসম্ভব ইচ্ছা জানিয়ে বিলাপ করতে করতে মনের অসহায় ক্ষোভ মেটান। এখানেই শেষ নয়। কোনও কোনও ‘… বয়স্থা কুলীনমহিলা, যন্ত্রণাময় পিত্রালয় ও মাতুলালয় পরিত্যাগ করিয়া, বারাঙ্গনাবৃত্তি অবলম্বন করেন’ (৪.৩৫), এমন অপ্রিয় সত্যও লিখছেন বিদ্যাসাগর। আবার ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ প্রবন্ধেও মেয়েদের প্রতি অন্যায়ের কথা লেখক বলছেন সমাজনায়কদের ভ্রুকুটির তোয়াক্কা না করেই। ‘বিধবার জীবন কেবল দুঃখের ভার’ (১.৩৬১)। কুমারী অথচ বালবিধবার উপোসের দিনে তেষ্টায় বা অসুখে এক ফোঁটা জল দিতে এগিয়ে আসে না কোনও মানুষ: ‘… এইরূপ কত শত হতভাগা কুমারী উপবাসশর্বরীতে ক্ষুৎপিপাসায় ক্ষামোদরী শুষ্কতালু ম্লানমুখ হইয়া মৃতপ্রায় হইয়া যায়, তথাপি কোন কারুণিক ব্যক্তি তাহার তাদৃশ শোচনীয়াবস্থাতে করুণা দর্শাইয়া নিষ্ঠুর শাস্ত্রবিধি ও লোকাচার উল্লঙ্ঘনে সাহস করিতে চাহেন না’ (১.৩৬১)।

‘বাল্যবিবাহের দোষ’ প্রবন্ধে তা হলে স্পষ্টই বলা হচ্ছে যে, শাস্ত্রবিধি ‘নিষ্ঠুর’। অথচ বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার ক্রোড়পত্রটিতে বিদ্যাসাগর যুক্তি শানাচ্ছেন শাস্ত্রবিরূপ বিদ্যাভূষণের বিরুদ্ধেই। বিদ্যাসাগরের মনে হয়েছিল যে, পুরুষতন্ত্রের দোহাই পেড়ে শাস্ত্ররচয়িতাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করলে কোনও উপায়েই আর প্রতিপন্ন করা সম্ভব হবে না যে, কোন আচরণ বিধেয়, আর কোন আচরণ গর্হিত। উপরন্তু, এভাবে লোকাচারকে শাস্ত্রবিধির সাক্ষ্য মানলে সমাজের নানাবিধ অন্যায় আচারকে শাস্ত্রসম্মত বলে চালিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে, সেগুলির সংস্কারের প্রয়োজন বোধ করার গরজটাই চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে ষোলো আনা।

অদ্য বিদ্যাভূষণ মহাশয় কহিতেছেন, ‘বহুবিবাহ যে এ দেশের শাস্ত্রনিষিদ্ধ নয়, এ দেশের ব্যবহারই তাহার প্রধান প্রমাণ; শাস্ত্রপ্রতিষিদ্ধ হইলে উহা কখন এরূপ প্রচরদ্রূপ থাকিত না’। তদীয় ব্যবস্থার অনুবর্ত্তী হইয়া, কল্য, অন্য এক মহাশয় কহিবেন, কন্যাবিক্রয় যে এ দেশের শাস্ত্রনিষিদ্ধ নয়, এ দেশের ব্যবহারই তার প্রধান প্রমাণ; শাস্ত্রপ্রতিষিদ্ধ হইলে উহা কখনও এরূপ প্রচরদ্রূপ থাকিত না। তৎপর দিন, দ্বিতীয় এক মহাশয় কহিবেন, ভ্রূণহত্যা যে এ দেশের শাস্ত্রনিষিদ্ধ নয়, এ দেশের ব্যবহারই তার প্রধান প্রমাণ; শাস্ত্রপ্রতিষিদ্ধ হইলে উহা কখনও এরূপ প্রচরদ্রূপ থাকিত না। (৪.৭৮-৯)

এভাবে একে একে নানা দুষ্কর্মের কথা তোলেন বিদ্যাসাগর। মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া, জাল দলিল বানানো, ঘুষ খাওয়া— সবই যখন দেশে চালু আছে তখন ধরে নিতে হবে শাস্ত্রে এসবের বারণ নেই। শাস্ত্র যেখানে নির্মম, সেখানেও এটা ধরে যদি এগোই যে, শাস্ত্রের উদ্দেশ্যই অসাধু, তবে সংস্কারের লড়াই চলবে স্রেফ শাস্ত্রবিরোধিতার পথে, দেশের জনসাধারণের বিশ্বাসকে উপেক্ষা করে। বিদ্যাভূষণের প্রতিপাদ্য যে, ‘… ভারতবর্ষীয় শাস্ত্রকারেরা স্বার্থপর, যথেচ্ছচারী, ও ইন্দ্রিয়সুখপরায়ণ ছিলেন; স্ত্রীজাতির সুখদুঃখাদির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন নাই’ (৪.৭৯)। অর্থাৎ, এক রকমের ইচ্ছে করেই বিবাহ বিষয়ে স্বেচ্ছাচারের পথ, ‘পুরুষজাতির প্রধান ভোগসুখের পথ’ (৪.৭৯), পুরুষের জন্য খোলা রাখা হয়েছিল। এ কথা বলে ‘নিরপরাধ’ শাস্ত্রকারদের প্রতি বিদ্যাভূষণ এক ‘নৃশংস অভিপ্রায়’ প্রকাশ করেছেন, যা ‘অদৃষ্টচর ও অশ্রুতপূর্ব্ব’ (৪.৮০)। অর্থাৎ, বিদ্যাভূষণের শাস্ত্রবিচার ছিল মূলত অভিপ্রায়বাদী, ‘ইনটেনশনালিস্ট’। বিদ্যাসাগরের শাস্ত্রবিচার রক্ষণশীল নয়— হলে হিন্দু সামাজিক নেতৃত্বের সযত্নে গড়ে তোলা বাধাবিপত্তির কাঁটাতারে তাঁকে এমন বিক্ষত হতে হত না। বিদ্যাসাগরের কাছে হিন্দু শাস্ত্ররাজি ছিল এক ইতিহাসবিদ্ধ পাঠমালা, কার্যকারিতাসাপেক্ষ এবং কার্যকারণ-ভিত্তিক, যার অর্থ আলগাভাবে এবং অপূর্ণ মাত্রায় ইংরেজি ‘ফাংশানাল’ শব্দটি দিয়ে বোঝানো যায়। এমন ধারণায় ‘স্ব-পর’ বাধ্যত একে অন্যের ভিতরে প্রবিষ্ট হয়ে আছে, কার্যকারিতার সূত্রে গাঁথা হয়ে আছে অন্তর ও বাহির। বিদ্যাসাগরকে ‘সেকুলার’ অথবা ‘আধুনিক’ বলার আগে এই কূটাভাসটি বোঝা প্রয়োজন।

দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের সঙ্গে তর্কটি আসলে গৌণ। মূল বিবাদটি ছিল তারানাথ তর্কবাচস্পতির বিরুদ্ধে, যে তর্কবাচস্পতি ছিলেন বিদ্যাসাগরের সহকর্মী এবং সহযোদ্ধা। বিধবাবিবাহের সপক্ষে বহু শাস্ত্রবচনের হদিশ তিনি দেন বিদ্যাসাগরকে। এই তর্কবাচস্পতিই আবার সনাতনধর্মরক্ষিণী সভায় ১২৭৮ বঙ্গাব্দের ১৬ শ্রাবণ তারিখে (১৮৭১ সাল) হিন্দু পুরুষের বহুবিবাহকে মনুবচন ও মদনপারিজাতস্মৃতির ভিত্তিতে শাস্ত্রানুগ বলে রায় দেন (দ্রষ্টব্য: ৪.৭০-৭)। সেই বিবাদেও দেখি বিদ্যাসাগরের যুক্তিতে পুরুষই বলুন বা নারী, উভয়েরই ‘স্বাভীষ্ট’ বা ‘অন্তর’ শাস্ত্র দিয়ে তৈরি, স্মৃতি দিয়ে ঘেরা। ধর্মশাস্ত্র ‘অন্তর’-এর বিপরীত মেরুতে, বা তার বাইরের কোনও শক্তির অনুশাসন নয়। সেগুলি বিষয়ীর ও কর্তার— ‘সাবজেক্ট’ ও ‘এজেন্ট’, যে অর্থেই ব্যক্তির ‘অন্তর’-এর কথা ভাবি না কেন— যুগপৎ অন্তঃপদার্থ ও বাহ্যপদার্থের সূচক।

‘বাল্যবিবাহের দোষ’ রচনাটি যদি একান্তই বিদ্যাসাগরের হয়— এবং না হওয়ার কোনও হেতু দৃশ্যত নেই— তবে সেখানে শাস্ত্রের অহেতুক বিধিনিষেধের প্রশ্ন যতটা প্রকট, বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার বইয়ের ক্রোড়পত্রে তা ততটা নয়। বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার হওয়ার প্রকাশকাল ১৮৭১ সাল। অর্থাৎ ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ ছাপা হয়ে যাওয়ার পর প্রায় একুশ বছর পার হয়ে গিয়েছে তখন, বিধবাবিবাহের সমর্থনে ১৮৫৫ সালের বইগুলির স্মৃতি ততদিনে ষোলো বছর পুরনো। ততদিনে বিদ্যাসাগর বুঝে গিয়েছেন যে, সংস্কারের বিরোধীদের ধরাশায়ী করতে হবে তাঁদেরই অস্ত্রে, এবং সংস্কারের নামে নির্বিচার শাস্ত্রবিরোধিতা বঙ্গদেশে ব্যর্থ হতে বাধ্য, যেমন ব্যর্থ হয়েছিলেন রামগোপাল ঘোষের মতো ডিরোজিয়ো-পন্থীরা বা তাঁদের পরে যাঁরা হিন্দু কলেজে পড়েছেন, অথবা কিয়ৎ পরিমাণে ব্রাহ্মসমাজের সংস্কারকেরা। রামগোপাল চেয়েছিলেন ১৮৪২ সালে শুরু করা তাঁর বেঙ্গল স্পেকটেটার কাগজ যেন ১৮১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্যাপটিস্টদের সমাচার দর্পণ অথবা ১৮৩১ সালে ডিরোজিয়োর ছাত্রদের প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানেন্বেষণ পত্রিকার মতো নারীশিক্ষা এবং হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহের সমর্থনে প্রচার চালিয়ে যায়। এমন ইচ্ছা ব্যক্ত করে গোবিন্দচন্দ্র বসাককে লেখা একটি চিঠিও আছে তাঁর। হাজারো পার্থক্য সত্ত্বেও হিন্দু কলেজের মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং প্যারীচরণ সরকার কিংবা ব্রাহ্মসমাজের অক্ষয়কুমার দত্তের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সৌহার্দ্যে তাঁদের কর্মপন্থার পার্থক্যগুলি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি। বিশ্বেশ্বর বিলাপ নামে একটি বই দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ উৎসর্গ করেন বিদ্যাসাগরকে। ১৮৭৪ সালের উৎসর্গপত্রটি পড়লে মনে হবে বন্ধুর প্রতি বিদ্যাভূষণের শ্রদ্ধা অটুট ছিল। শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন যখন প্রথম বিধবাবিবাহ করেন, রামগোপাল ঘোষ এবং আরও অনেকে পায়ে হেঁটে বরের পালকির সঙ্গে সঙ্গে যান।১০

তবু কেন এত শাস্ত্রনির্ভরতা? বিদ্যাসাগর কি তবে কোপার্নিকাস-চরিতে বর্ণিত তেমন অতীতচারী লোকেদের একজন যাঁরা নিজস্ব বিবেচনার উপরে স্থান দেন পূর্বাচার্যদের সিদ্ধান্তকে? বলা বাহুল্য, এ ব্যাপারে বিদ্যাসাগর আগের-আগের ব্যর্থতা থেকে শিখে তাঁর নিজের যুক্তি ও রণকৌশল রচনা করেছিলেন। তার চেয়েও বড় কথা, তিনি অর্জন করেছিলেন প্রতিপক্ষের সঙ্গে অসহকামী সহযোগিতার বিরল সক্ষমতা। এমন সহযোগিতাকে ‘কৌশলী অসহযোগিতা’ বললেও খুব একটা ভুল হবে না, যদিও অর্থ যৎসামান্য হলেও বদলে যেতে পারে। যা খেয়াল করা জরুরি তা হল এই যে, বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে শাস্ত্রপ্রমাণ সমানভাবে অন্তঃপাতী এবং অন্তর্ঘাতী। ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ প্রবন্ধে ‘আন্তরিক’ ও ‘অন্তরের’ পদ দু’টির প্রয়োগ মনে রেখে বিষম বিশেষণ দু’টি ব্যবহার করলাম।

উনিশ শতকে বাংলার আধুনিকতার আলোচনায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে নিয়ে একটু মুশকিলে পড়তে হয়। তিনি সংস্কৃত পণ্ডিত, শাস্ত্রজ্ঞ, অথচ এডুকেশন কাউন্সিলকে জানাচ্ছেন যে, তিনি বেদান্ত ও সাংখ্যকে ভ্রান্ত দর্শন হিসেবে জ্ঞান করেন (৩.৪৫৫)।১১ তিনি বাংলা ও ইংরেজি ভাষার সমন্বয়ে সংস্কৃত কলেজের আধুনিক ব্যাবহারিক পাঠক্রমের আদি স্রষ্টা, অথচ বিদ্যালয়ের শিক্ষায় সংস্কৃত ভাষা বর্জনের ঘোর বিরোধী। উপরের দৃষ্টান্তে বলতে চেষ্টা করেছি যে, এই আপাত বিরোধের মূলে রয়েছে বিদ্যাসাগরের সামাজিক কার্যাবলির জন্য এক সুচিন্তিত নীতি। ধর্ম তাঁর তরজমায় ‘ভার্চু’ (virtue), এক রকমের ব্যক্তিগত কর্তব্যবোধ, তথা সামাজিক মঙ্গলের ভাবনাতাড়িত নীতি।১২ এটা মনে রাখলে বিদ্যাসাগরের জীবনীকারের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলা সম্ভব যে, ‘ধর্মরূপ ভিত্তির উপর যাহার প্রতিষ্ঠা, সেই সংস্কারকার্যই বাস্তবিক সুসিদ্ধ হয়।’১৩ শাস্ত্রের প্রতি অবজ্ঞা না দেখিয়ে শাস্ত্রের মধ্যেকার ঐতিহাসিক গতির সূত্রগুলির সন্ধান এই নীতির অন্তর্গত। শাস্ত্রপ্রণেতারা পক্ষপাতদুষ্ট বললে কালাপাহাড়িদের চলে, সংস্কারের কাজ সমাজে দৃঢ়মূল হয় না।

ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী এবং ব্রাহ্মদের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সংস্কারপন্থার পার্থক্য সম্পর্কে অশোক সেন লিখেছেন যে, বিধবাবিবাহের মতো সংস্কারের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন জনসমর্থন, চেয়েছিলেন খাঁটি অর্থে সামাজিক বৈধতা, ‘Vidyasagar was striving in a more real sense to achieve the social legitimacy of reforms’।১৪ তাঁর শাস্ত্রনির্ভরতার মূল ছিল এই বৃহত্তর লক্ষ্যে। অশোক সেন সংগত কারণেই বলেছেন যে, বিস্তৃত হিন্দু ও তৎসংলগ্ন জনজাতিদের সমাজে তাঁর প্রচেষ্টা ব্যাহত হয় কারণ শাস্ত্রে আলোচিত বিষয়গুলি ছিল একান্তভাবেই উচ্চবর্ণ হিন্দুদের।১৫ ইংরেজদের চালু করা বিধবাবিবাহ আইনে প্রয়াত স্বামীর ধনে অধিকার ত্যাগে বাধ্য হত পুনর্বিবাহিত হিন্দু নারী। এ ব্যাপারে বিদ্যাসাগর আপত্তি তোলেননি, রক্ষণশীল হিন্দু সমাজপতিদের নতুন করে ক্ষুব্ধ করতে চাননি বলেই হয়তো। অশোক সেনের মতে, ঔপনিবেশিক বঙ্গদেশে সমাজের উচ্চবর্গের সুবিধাভোগী অবস্থানের সঙ্গে সামাজিক উৎপাদনের কোনও নিবিড় যোগ ছিল না, ফলে প্রতিষ্ঠিত হয়নি তাদের ব্যাপক ‘হেগেমনি’। এই শ্রেণি-আধিপত্যের ন্যূনতার কারণে তাদের সামাজিক সংস্কারপ্রকল্প, এমনকী দেশের পরম্পরাগত অগ্রণী চিন্তকদের— যাদের গ্রামশি-র অনুসরণে অশোক সেন ‘traditional intellectuals’ বলে অভিহিত করছেন— তাদেরও স্বতঃস্ফূর্তবাদী সংস্কার প্রচেষ্টা খর্ব হতে বাধ্য ছিল।১৬

সামাজিক বৈধতা ও সম্মতির জন্য কিন্তু প্রয়োজন ছিল অপ্রত্যাশিত অবস্থান থেকে বাধাগুলির দিকে বাণ নিক্ষেপ করা, প্রধান বিপত্তিগুলির লক্ষ্য খানিক আড়ালে রেখে অতর্কিতে সেগুলিকে শরবিদ্ধ করা। এভাবেই বিদ্যাসাগর যুক্তি সাজিয়েছিলেন শাস্ত্রের আপতিকতার স্বীকৃতি আদায়ের স্বার্থে। এই প্রসঙ্গে তীক্ষ্ণধী বিশ্লেষণ পাওয়া যাবে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের ‘শাস্ত্র বনাম পরিবর্তন: বাঙলার পণ্ডিতসমাজ ও ঈশ্বরচন্দ্র’ প্রবন্ধে। ‘পণ্ডিতসমাজ চিরদিন অন্ধর মতো বিশ্বাস করে এসেছেন: শাস্ত্র নিত্য, আচার নিত্য।’ ‘মুক্ত চিন্তাবিদ্‌’ বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন হিন্দুসমাজও পরিবর্তনসাপেক্ষ।১৭ এক, শাস্ত্র; দুই, বর্ণহিন্দুর কর্তব্য; এবং তিন, হিন্দু বিধবা তথা নারীর সতীত্ব— এই তিনটি বিষয়ে বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিল মূল বিপত্তি, এবং এই তিনটিই ছিল বিদ্যাসাগরের যুক্তিবাণের নিশানায়। শাস্ত্র ইতিহাসের প্রয়োজনে বিরচিত, কলিযুগের বর্ণহিন্দুও হৃতবল (অন্তত পরাশরসংহিতা-য় তা-ই বলা হচ্ছে), এবং ‘সতীত্ব’ কোনও নিরঙ্কুশ বাহ্য ক্ষমতা দ্বারা নির্ণীত নয়— এই তিন মোক্ষম আঘাত সংস্কারের লড়াইয়ে অপরিহার্য ছিল। এগুলির ধারণার ভিত্তিমূলে নানা স্ববিরোধ, ‘স্ব’ ও ‘পর’-এর স্থানবদলের ছল অনাবৃত করেই বিদ্যাসাগর ভবিষ্যৎ সংস্কারের পক্ষে জনসম্মতির ভূমিটি তৈরি করে গিয়েছিলেন। সে কাজ যে আজও অনিষ্পন্ন তা তো নতুন করে বলার প্রয়োজন দেখি না। অমলেশ ত্রিপাঠী যথার্থই বলেছিলেন— বিদ্যাসাগর ছিলেন ‘ট্র্যাডিশনাল মডার্নাইজার’।১৮ আমার মনে হয় বিদ্যাসাগর তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছেছিলেন পণ্ডিতসমাজের কাছে প্রতিপন্ন করে যে, ‘ট্র্যাডিশন’ বস্তুটাই ‘মডার্ন’, অন্তত হিন্দু স্মৃতিশাস্ত্রের বেলা। এই দিকটা উপেক্ষা করে বিদ্যাসাগরের শাস্ত্রবোধের মধ্যে কেবল স্ববিরোধ দেখলে, অথবা অনেকানেক ক্ষেত্রে সংস্কারবিরোধী শাস্ত্রের প্রতিও শ্রদ্ধার মধ্যে অমীমাংসিত দোটানা আবিষ্কারে মন দিলে, তাঁর উদ্দেশ্য ও পথের মধ্যে আধুনিকতার উৎসটা খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য হবে।১৯

পরম্পরার অর্থ উত্তরাধিকার। পৌর্বাপর্যের ঐতিহাসিক কার্যকারণ ছাড়া ঐতিহ্য নেহাতই এক স্থবির প্রাতিষ্ঠানিক পাষাণপুরী— এ কথা প্রতিষ্ঠিত করতে অসামান্য মেধা ও বৈদগ্ধ্য প্রয়োগ করেছিলেন বিদ্যাসাগর। কথাটা জানা মনে হলেও ধর্মশাস্ত্রের সেকুলার ও ইতিহাসমনস্ক এই ব্যবহারের চমকপ্রদ তাৎপর্য আজও ধরতে পারা সহজ নয়। এর ফলে ‘অন্তর’ ও ‘স্বাভীষ্ট’ তথাকথিত ব্যক্তিচেতনার মধ্যে আবদ্ধ থাকে না আর, তা চারিয়ে যায় সমাজের সামূহিক যাপনে; ব্যক্তির সৎ ও চিৎ, এমনকী বিদ্যাসাগরের সুবিদিত কারুণিক চিত্তবৃত্তি, হয়ে ওঠে মানবিক কাল তথা ইতিহাসের নির্মাণ। এ ব্যাপারে শাস্ত্রজ্ঞ বিদ্যাসাগর নিঃসন্দেহে বাংলার অশাস্ত্রীয় আধুনিকতার অগ্রনায়ক।

বিধবাদের পুনর্বিবাহ প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগরের যুক্তি কিছুটা অনুধাবন করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। এ কথা অজানা নয় যে, বিধবাদের পুনর্বিবাহের পক্ষে সওয়াল করার জন্য বিদ্যাসাগর মূলত পরাশরসংহিতা-র আশ্রয় নিয়েছিলেন। অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রে বিধবার জন্য যেমনই বিধান থাক, পরাশর বলছেন কেবল পুনর্বিবাহ, সহমরণ ও ব্রহ্মচর্যের অনুকল্পের কথা। সেক্ষেত্রে হিন্দু বিধবাদের পক্ষে কোন কল্প গ্রহণীয়? বিদ্যাসাগর এ ব্যাপারে সবিস্তারে আলোচনা করেছেন, প্রশ্ন তুলেছেন মাধবাচার্যের মতো গুণী ব্যাখ্যাতাদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। কিন্তু আমার বিশ্লেষণে প্রাসঙ্গিক যে প্রশ্নটি সেটি হল— কী কারণে পরাশরকে বেছে নিলেন বিদ্যাসাগর?

প্রথম কারণটি হল, বিদ্যাসাগরের একটি শাস্ত্রনির্দেশের প্রয়োজন ছিল যার দ্বারা তাঁর প্রতিপক্ষদের কাছে তিনি দাবি করতে পারেন যে, শাস্ত্রের বিধানের মধ্যেই আছে ইতিহাসের জঙ্গম প্রক্রিয়ার স্বীকৃতি। যে নিয়ম এক যুগের পক্ষে উপযুক্ত ছিল, সেই নিয়মই পরের কালপর্বে অচল এটা প্রমাণ করার গরজ ছিল বিদ্যাসাগরের। তাঁর বলার দরকার ছিল যে, ‘আধুনিকতা’ আদতে একটি কালানুগ ধারণা, সময়ের ধারণার ব্যতিরেকে ‘ঐতিহ্য’ বা ‘আধুনিকতা’— কোনওটারই কোনও বাস্তব আশ্রয় নেই। সময়োপযোগী পরিবর্তন শাস্ত্রের রচনাবিধিরই অন্তর্গত। ‘অন্তর্গত’ শব্দটি আমাদের মনে করাবে ‘অন্তর’ ও ‘শাস্ত্র’-এর সেই বিরোধপ্রবণ সন্নিধি। শাস্ত্রের মধ্যেই আছে অন্তর, তার বাইরে নয়।

বিদ্যাসাগরের প্রথম যুক্তি, পরাশর কলিযুগের প্রধান বিধানকর্তা। এক এক যুগের এক এক ধর্মশাস্ত্র—এমন বিচার কি শাস্ত্রসম্মত? বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৮৫৫ সালে। সেখানে বিদ্যাসাগর মনুবচন, ১.৫৮ উদ্ধৃত করছেন:

অন্যে কৃতযুগে ধর্ম্মাস্ত্রেতায়াং দ্বাপরেঽপরে।

অন্যে কলিযুগে নৄ ণাং যুগ হ্রাসানুরূপতঃ ।। (২.১১৬)

শ্লোকের অর্থও দিয়েছেন লেখক, যা সংক্ষেপ করলে দাঁড়ায়: যুগানুসারে মানুষের শক্তি হ্রাস পায়, এবং সেহেতু সত্য যুগের ধর্ম অন্য, ত্রেতা, দ্বাপর এবং কলি যুগেরও ধর্ম ভিন্ন ভিন্ন। এরপর শক্তি হ্রাসের প্রসঙ্গ অল্পে সেরে বিদ্যাসাগর বলছেন যে, ধর্মের ভিন্নতার কথা থাকলেও মনুসংহিতা-য় ‘ভিন্ন ভিন্ন যুগের ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের নিরূপণ করা নাই’ (২.১১৭)। তা হলে হিন্দুর করণীয় কী? (আজকাল দেশে হিন্দুত্বের যে একাকার চেহারা খাড়া করা হয়েছে তাতে বলে নেওয়া ভাল যে, এই শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত বেদ-বেদান্ত-সাংখ্য দর্শনকে ভ্রান্ত জ্ঞান করতেন, এমনকী তাঁর প্রথাগত ঈশ্বরভক্তির তেমন সাবুদ মজুত নেই। তবু এ কথা শর্তসাপেক্ষে না মানার কোনও কারণ নেই যে, ‘হিন্দুভাব ও হিন্দুসংস্কারের রক্ষাকল্পে তিনি অপর কোনও আস্থাবান হিন্দু অপেক্ষা ন্যূন ছিলেন না।’২০) পরাশরসংহিতা-র প্রথম অধ্যায়ের উল্লেখ করছেন বিদ্যাসাগর। সেখানে বলা হয়েছে যে, সত্যযুগে মনু, ত্রেতায় গৌতম, দ্বাপরে শঙ্খ-নিরূপিত ধর্মই আচরণীয়। কলিযুগের জন্য এ কাজ করে গিয়েছেন পরাশর: ‘কলৌ পারাশরাঃ স্মৃতাঃ’ (২.১১৭)।

তা পরাশরসংহিতা নাহয় কলিযুগের শাস্ত্র হল, কিন্তু বিধবাদের পুনর্বিবাহের প্রশ্নে তাঁর মত কী? পরাশর চতুর্থ অধ্যায়ে বলছেন যে, স্বামী গৃহত্যাগ করলে, নিরুদ্দেশ হলে, মারা গেলে, ক্লীব বলে ধার্য হলে, বা পতিত হলে স্ত্রীর পুনর্বিবাহ শাস্ত্রসম্মত। ‘নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ। পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরন্যো বিধীয়তে’ (২.১২০)। পরাশর এ ছাড়াও অন্য দু’টি বিধি দিয়েছেন কলিযুগের বিধবাদের জন্য— ব্রহ্মচর্য ও সহগমন। ব্রহ্মচারীবিধবার স্বর্গলাভ হয়, এবং— এটাই খেয়াল করার মতো কথা— যে নারী সহগমন করে, মনুষ্য শরীরে যে সার্ধ ত্রিকোটি লোম আছে, তৎসম কাল সে স্বর্গে বাস করে: ‘তিস্র কোট্যোঽর্দ্ধকোটি চ যানি লোমানি মানবে। তাবৎ কালং বসেৎ স্বর্গংভর্ত্তারংযানুগচ্ছতি’ (২.১২০)।

এরপর বিদ্যাসাগরের যুক্তি যে মোড় নিল তা চমকপ্রদ। সহগমনের যা-ই পুণ্যফল হোক, তা যদি সর্বোত্তম কল্পও হয়, তা বাস্তবে অনুসরণ সম্ভব নয় কারণ রাজাদেশে সে পথ বন্ধ। ‘তন্মধ্যে রাজকীয় আদেশক্রমে, সহগমনের প্রথা রহিত হইয়া গিয়াছে’ (২.১২০)। শাস্ত্র যুগের প্রয়োজন বুঝে বদলায়, বদল হয় শাসকের আইনব্যবস্থা। ধর্মশাস্ত্রের ভূমিকা এহেন আধুনিক সংস্রবে হয়ে দাঁড়ায় সেকুলার নীতি ও আইনের সদৃশ আকরসূত্রের সমষ্টি, অর্থটি আলোচনার গোড়ায় সচেতনভাবে সূত্রকারের বাঞ্ছিত না হয়ে থাকলেও এবং দুয়ের মধ্যে আর যা-ই বৈসাদৃশ্য থাকুক না কেন। কোম্পানির বিদেশি শাসকরা আইন করে হিন্দু বিধবাদের সহমরণ রদ করেছেন, ফলে ‘এক্ষণে বিধবাদিগের দুই মাত্র পথ আছে, বিবাহ ও ব্রহ্মচর্য; ইচ্ছা হয় বিবাহ করিবেক, ইচ্ছা হয় ব্রহ্মচর্য করিবেক’ (২.১২০)। হঠাৎই যেন বুঝতে পারি কেন সনাতন ধর্মের সংরক্ষণবাদীদের শত চেষ্টাকে পরাস্ত করে ১৮৫৬ সালের জুলাই মাসে বিধবাবিবাহ আইন পাশ করানো এবং তার পরে পরেই বিধবাবিবাহের উদ্যোগ নেওয়া বিদ্যাসাগরের কাছে এত গুরুত্বের ছিল। উনিশ শতকের কোনও চিন্তককে যদি আমূল সংস্কারের অভিপ্রায় ব্যক্ত করতে অথবা স্ত্রী-পুরুষের সমানাধিকারের ঘোষণা করতে দেখি, আমরা সেই মানুষটিকে আধুনিক ও যুক্তিনিষ্ঠ বলতে প্রবৃত্ত হই। কিন্তু কাজের কাজটা করবেন কে? ‘কিন্তু, তাঁকে [বিদ্যাসাগরকে] তো কাজটা করতে হবে।’২১ তারজন্য শাস্ত্রপ্রমাণ এবং আইনের জোর— দু’টিরই প্রয়োজন বিদ্যাসাগরের ছিল।

এত শাস্ত্রবচন উদ্ধারের শেষে বিদ্যাসাগর কিন্তু প্রাধান্য দিচ্ছেন দৈনন্দিন, আপাতভাবে অন্তত, বাহ্যিক সমস্যাগুলিকে, এবং সেই সমস্যাগুলিকে তিনি বিচার করছেন মেয়েদের দিক থেকে, যতটা একজন পুরুষের পক্ষে তা করা সম্ভব তা মাথায় রেখে। ‘কলিযুগে, ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করিয়া, দেহযাত্রা নির্বাহ করা বিধবাদিগের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হইয়া উঠিয়াছে। এই নিমিত্তই, লোকহিতৈষী ভগবান্‌ পরাশর সর্বপ্রথম বিবাহেরই বিধি দিয়াছেন’ (২.১২০)। এমন যুক্তি কিন্তু বিষ্ণুসংহিতা-য় বা আদিপুরাণে নেই। কলিতে স্ত্রী ও পুরুষ উভয়েই পাপে নিমজ্জিত, অতএব ‘… সত্য যুগে যে ধর্ম বিহিত, কলি যুগে সে ধর্মের অনুষ্ঠান করিতে পারা যায় না’(২.১৮৫)। এ সম্পর্কে মাধবাচার্যের সিদ্ধান্তের দ্বিতীয় পুস্তকে আলোচনা করলেও বিদ্যাসাগর বইয়ের দু’টি ভাগেই এই পাপের প্রশ্নের মধ্যে ঢুকলেন না তেমন। বেদ সবার উপরে, স্মৃতি ও পুরাণের উপরে তো বটেই। আর স্মৃতি ও পুরাণের মধ্যে মতদ্বৈধ দেখা দিলে স্মৃতিই মান্য, পুরাণ নয়। ‘এই নিমিত্ত, ভগবান্‌ বেদব্যাস মীমাংসা করিতেছেন, বেদ, স্মৃতি ও পুরাণের পরস্পর বিরোধ হইলে, স্মৃতি ও পুরাণ অনুসারে না চলিয়া, বেদ অনুসারে চলিতে হইবেক; আর স্মৃতি ও পুরাণের পরস্পর বিরোধ হইলে, পুরাণ অনুসারে না চলিয়া, স্মৃতি অনুসারে চলিতে হইবেক (২.১২৬)। এত বেদ-স্মৃতি মন্থন করেও বিদ্যাসাগর নেমে এলেন ব্যাবহারিক জীবনের সমস্যায়। পরাশরদত্ত বিধির অনুক্রম এখানে প্রাসঙ্গিক তেমন নয়, দুরতিক্রম্য তো নয়ই। যা লক্ষ করার বিষয় তা হল, ব্রহ্মচর্য থেকে গার্হস্থ্যে নিষ্ক্রমণের একটি পথ যেন নির্মাণ করতে চাইছেন পরাশরসংহিতা-র টীকাকার। ‘দেহযাত্রা নির্বাহ করা’র দুর্বহ সমস্যার কথা উত্থাপন করার কোনও প্রাসঙ্গিকতা থাকে না যদি পতিবিয়োগান্তে হিন্দু বিধবার অনন্ত ব্রহ্মচর্যের আশঙ্কা টীকাকারের মাথায় না থাকে। বিদ্যাসাগর যেন বলতে চাইছেন যে, বিধবাদের বিষয়ীসত্তা শাস্ত্রকারেরা অসম হাতে নির্মাণ করে যাননি। পুরুষ যদি ব্রহ্মচর্য থেকে গার্হস্থ্যাশ্রমে অবাধে প্রস্থান করতে পারে, তবে নারীর ক্ষেত্রেও সেই ব্যবস্থা বাঞ্ছনীয় বলেই শাস্ত্রকাররা সিদ্ধান্ত করেছিলেন।

শাস্ত্রবাক্যে ইতিহাসের স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠিত করতে বিদ্যাসাগর কালানৌচিত্য দোষ বা অনৈতিহাসিকতার ঝুঁকি নিতে রাজি ছিলেন, তা তো দেখাই যাচ্ছে। নতুবা সতীদাহের বিরুদ্ধে বিদেশি শাসকদের রাজাজ্ঞাটিকে এবং কলিযুগে বিধবাদের সম্পর্কে পরাশরের বিধানের তিনটি কল্পের অনুক্রমকে তিনি একরকম জোর করে পুনর্বিবাহের যুক্তি হিসেবে পেশ করতেন না। বিষয়ীর, বিশেষত হৃতক্ষমতা বিষয়ীর, ব্যক্তিসত্তার অসমঞ্জস নির্মাণের প্রতিবিধান যদি উনিশ-বিশ শতকের আধুনিকতার একটি মুখ্য গতিমুখ হয়, তবে বিদ্যাসাগর এই বিচারেই এশিয়ার আধুনিকতার এক মুখ্য নির্মাতা। নারীমুক্তির সংগ্রাম, বর্ণবিদ্বেষ-বিরোধী লড়াই, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ যুদ্ধ, অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য নানা সংঘাত, যৌন স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন—‘আধুনিক’ সময়ের অধিকার ও ‘স্বাভীষ্ট’ সর্বত্র বিষয়ীসত্তার স্বাধিকারের উপর নির্ভর। কর্তার কর্তৃত্ব বা ‘এজেন্সি’ হৃতবল বিধবাদের আসবে অনেক পরে, আসবে বিদ্যাসাগরের কাটা নারীশিক্ষার পথ ধরে, আসবে নারীদের নিজস্ব আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এই ‘স্ব’ অধিকার করার লড়াইয়ে, ইতিহাসের ‘সাবজেক্ট’ হিসেবে বঞ্চিতকে কায়েম করতে, শাস্ত্রকে বাইরের বাধা হিসেবে না দেখে ইতিহাসের অন্তরঙ্গ সপক্ষ হিসেবে প্রতিপন্ন করার প্রয়োজন ছিল, ছিল বিধবাদের— এবং ব্যাপ্তার্থে নারীদের— ইতিহাসের তথা হিন্দু পরম্পরায় সংশয়াতীত শরিকের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠাপন করার। এই বিশেষ ভূমিকাটি পালনে সফল হওয়ার কারণেই শাস্ত্রনিষ্ঠ বিদ্যাসাগর ছিলেন যথার্থ আধুনিক মানুষ। আমি আরও এক ধাপ এগিয়ে বলব উনিশ শতকের বঙ্গীয় বুধজনদের মধ্যে বিদ্যাসাগরকে আরও বেশি করে আমাদের সময়কার সংবাদী বলে মনে হয়। সারা পৃথিবীতে ‘স্ব’-এর সার্বভৌমতার ধারণা গত পঞ্চাশ বছরে ক্ষয়গ্রস্ত। ‘স্ব’ এবং ‘পর’-এর গোপন সাজশে বরঞ্চ আমাদের আগ্রহ বেশি। বিদ্যাসাগর যেহেতু স্বাভীষ্টের নিরঙ্কুশতার উপর তেমন ভরসা রাখতে চাননি, শাস্ত্রের মধ্যেই দেখেছিলেন ইতিহাস, ‘স্ব’ এবং ‘পর’-এর মধ্যে এক অস্থির দোলাচল, তাই তাঁকেই আজ আমাদের অতি ঘনিষ্ঠ বলে ঠেকে।

ফিরে আসি ধর্মশাস্ত্রের প্রয়োগের কথায়। প্রতিবাদীদের আরও দু’টি জোরালো যুক্তি খণ্ডন করার জন্য ধর্মশাস্ত্র থেকে পঙ্‌ক্তি উদ্ধার করেন বিদ্যাসাগর। প্রথম আপত্তি, পুনর্বিবাহে উৎপন্ন সন্তান কি পৈতৃক ধনের অধিকারী হতে পারে? মনু ও অন্য ধর্মশাস্ত্রে দ্বাদশ পুত্রের উল্লেখ থাকলেও এবং ঔরস পুত্রকে সম্পত্তির অধিকারী বলা হয়ে থাকলেও (যদিও অন্যান্য সন্তানদের ধনের কিয়দংশ দেওয়ার কথাও আছে বিবিধ ধর্মশাস্ত্রে), পরাশর বলছেন তিন রকম পুত্রের কথা: ঔরস, কৃত্রিম ও দত্তক।

অতএব, যখন পরাশর কলিযুগে বিধবার বিবাহের বিধি দিয়াছেন এবং দ্বাদশ প্রকারের মধ্যে কেবল তিন প্রকারের পুত্রের বিধান করিয়াছেন, এবং যখন বিবাহিতা বিধবার গর্ভে স্বয়ং উৎপাদিত পুত্রে দত্তক ও কৃত্রিম লক্ষণ ঘটিতেছে না, কিন্তু ঔরস পুত্রের লক্ষণ সম্পূর্ণ ঘটিতেছে, তখন তাহাকে অবশ্যই ঔরস পুত্র বলিয়া স্বীকার করিতে হইবেক। কলিযুগে বিধবার গর্ভে স্বয়ং উৎপাদিত পুত্রকে পৌনর্ভব বলিয়া গণনা করা কোনও ক্রমে পরাশরের অভিপ্রেত বলিয়া প্রতিপন্ন করা যাইতে পারে না। (২.১২২)

দ্বিতীয় আপত্তি প্রথমটির সংলগ্ন। সেটির প্রত্যক্ষ হেতু যৌন শুচিতা সংক্রান্ত প্রতিবাদীদের বিভ্রান্তি। বিবাহযোগ্যা বিধবা কে? যিনি অক্ষতযোনি, না কি যে-কোনও বিধবা? না কি ক্ষতযোনি-অক্ষতযোনি নির্বিশেষে পতিহারা, পতি-পরিত্যক্তা, ক্লীবভার্যা ইত্যাদি সেইসব নারীদের যে-কেউ যার জন্য শাস্ত্র পুনর্বার বিবাহের অনুমতি দিয়েছে? বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব: দ্বিতীয় পুস্তক নামের বইতে বিষ্ণুসংহিতা ও যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতি থেকে উদ্ধৃতি সংকলিত করে দেখান যে, অক্ষতযোনি স্ত্রী বা পুনর্ভূর গুণ গাওয়া হয়েছে, সুতরাং স্ত্রীদের পুনর্বার বিবাহসংস্কারের বিধি শাস্ত্রপ্রণেতারা দিয়েছেন। এর মধ্যে যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতি-র প্রথম অধ্যায়ে সাতষট্টি সংখ্যক শ্লোকে অক্ষতযোনি কি ক্ষতযোনি— যে-কোনও পুনর্বিবাহিত স্ত্রীকেই পুনর্ভূ আখ্যা দিয়েছেন: ‘অক্ষতা চ ক্ষতা চৈব পুনর্ভূঃ সংস্কৃতা পুনঃ’ (২.১৯৮)। এখানেও বিদ্যাসাগর হিন্দু বিধবার বিষয়ী-পরিচয়ের বিষম নির্মাণ রুখতে সচেষ্ট দেখতে পাই। বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব বইয়ের প্রথম ভাগে বলা আছে যে, কোনও কোনও পণ্ডিত আদিত্যপুরাণ ও বৃহন্নারদীয় পুরাণের কিছু বচনের উপর স্মার্ত রঘুনন্দনের টীকাকে ‘কলিযুগে বিধবাবিবাহের নিষেধক’ (২.১২২) বলে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। ১৮৫৫ সালে বিদ্যাসাগরের প্রতিযুক্তি ছিল বিশদ (২.১২৩-৫)। ১৮৮৬ সালের রত্নপরীক্ষা বইতে প্রায় তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে আপত্তিটা উড়িয়ে দেন তিনি। রত্নপরীক্ষা মধুসূদন স্মৃতিরত্নের বিধবাবিবাহ প্রতিবাদ পুস্তিকার জবাবে লেখা। ভুবনমোহন বিদ্যারত্ন ও প্রসন্নচন্দ্র ন্যায়রত্ন ছিলেন মধুসূদনের পরামর্শদাতা। এই তিন রত্নের বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগর আক্রমণ চালান তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ধারালো গদ্যে। সেখানে যাজ্ঞবল্ক্যের শ্লোক ফের উদ্ধার করেন বিদ্যাসাগর, সঙ্গে যোগ করেন স্মার্ত রঘুনন্দনের টীকা: ‘ক্ষতযোন্যা অপি সংস্কারমাহ যাজ্ঞবল্ক্যঃ। অক্ষতা চ ক্ষতা চৈব পুনর্ভূঃ সংস্কৃতা পুনঃ।।’ বিদ্যাসাগর বলছেন, ‘… এই লিখন দ্বারা, ইহাই প্রতিপন্ন হইতেছে, অক্ষতযোনির ত কথাই নাই, ক্ষতযোনিরও বিবাহ শাস্ত্রকারদিগের অভিমত কর্ম্ম’ (৪.৫৫৮)। পৃথিবীর নানা জায়গায় নিজ শরীরের উপর নারীর নিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের আন্দোলন নানা সংক্ষুব্ধ পর্ব হয়ে এসেছে গত শতাব্দীতে, ‘এজেন্সি’ অর্থে ব্যক্তি-নারীর স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রাম এই পর্বের সঙ্গে ছিল অচ্ছেদ্য। মনে রাখা প্রয়োজন, নারীর বিষয়ীসত্তার বিষম নির্মাণের মূল ছিল পুরুষপ্রকল্পিত নারীর শরীর। নারীশরীর ছিল স্বাভীষ্টের বয়ানে অ-সাঙ্গীকৃত, অন্তরের সংসারে আগন্তুক, নারীর ব্যক্তিত্বহারা অস্তিত্বে একান্তভাবেই পরস্ব। এই মূলটি উৎপাটন করার কাজটি আরম্ভ অন্তত করে গিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। অন্নদাশঙ্কর রায়ের কথায় এ সিদ্ধান্তের সমর্থন পাওয়া যায়। সেই কবে লিখেছিলেন তিনি: ‘সতীদাহের পেছনে ছিল সতীত্ব সম্বন্ধে বহুকালের সংস্কার। তাকে টলিয়ে যান রামমোহন। সেটা না টললে সতী নারীর বৈধব্যের পর পুনর্বিবাহ-বিরোধী সংস্কার টলত না। এটাকে টলিয়ে দেন বিদ্যাসাগর।’২২

১৮৫৫ সালেই প্রকাশিত হয় বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব: দ্বিতীয় পুস্তক। সেখানে বিদ্যাসাগর রাখঢাক না করে সরাসরিই বললেন যে, শাস্ত্র যেমন, লোকাচারও তেমনই বিবর্তনশীল। ‘দেশাচারের দাস’ (২.২৯৯) হওয়া ইতিহাসদ্রোহিতাও বটে। ‘আর, আপনারা ইহাও বিবেচনা করিয়া দেখুন, আমাদের আচার এক বারেই অপরিবর্তনীয় নহে। ইহা কেহই প্রতিপন্ন করিতে পারিবেন না, সৃষ্টিকাল অবধি, আমাদের দেশে আচার পরিবর্ত হয় নাই, এক আচারই পূর্বাপর চলিয়া আসিতেছে’ (২.৩০০)। নমুনা হিসেবে বিদ্যাসাগর বললেন যে, এককালে দেশে চার বর্ণ ছিল, আজ নেই; আগে শূদ্রেরা ব্রাহ্মণের সঙ্গে একাসনে বসত না, এখন বসে২৩; রাজা রাজবল্লভের কাল অবধি বৈদ্যেরা উপবীত ধারণ করত না এবং জ্ঞাতির মৃত্যুর এক মাসের মাথায় অশৌচ ভাঙত, এখন তারা পইতে পরে এবং পনেরো দিন ধরে অশৌচ পালন করে। এই সমস্ত অপেক্ষাকৃত গৌণ ব্যাপারে নতুন আচার গৃহীত হয়েছে, এমনকী দত্তকচন্দ্রিকাগ্রন্থ-এর মতো অর্বাচীন বই রচনা করে প্রামাণ্য শাস্ত্র বলে চালানো হয়েছে (২.৩০০-১)। অথচ বিধবাবিবাহের বেলা শাস্ত্র ও লোকাচারের দুর্বল দোহাই পেড়ে সংস্কার ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে। একটু বিশদে বিদ্যাসাগরকে উদ্ধৃত করি। তবেই বোঝা যাবে দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের সঙ্গে তাঁর তফাত কোথায়।

এই সকল স্থলে, নূতন শাস্ত্র অথবা শাস্ত্রের নূতন ব্যাখ্যা অনুসারে, পূর্বপ্রচলিত আচারের পরিবর্তে, যে নূতন নূতন আচার প্রচলিত হইয়াছে, যখন আপনারা তাহাতে সম্মতি প্রদান করিয়াছেন; তখন, হতভাগা বিধবাদের দুর্ভাগ্যক্রমে, প্রস্তাবিত বিষয়ে সম্মতি প্রদানে এত কাতরতা ও এত কৃপণতা প্রদর্শন করিতেছেন কেন।… আপনারা, ইতঃপূর্বে, কেবল শাস্ত্র দেখিয়াই, পূর্বপ্রচলিত আচারের পরিবর্তে, অবলম্বিত নূতন আচারে সম্মতি প্রদান করিয়াছেন; এক্ষণে, যখন শাস্ত্র পাইতেছেন, এবং সেই শাস্ত্র অনুসারে চলিলে, বিধবাদিগের পরিত্রাণ ও শত শত ঘোরতর অনিষ্ট নিবারণের পথ হয়, স্পষ্ট বুঝিতেছেন; তখন আর প্রস্তাবিত বিষয়ে অসম্মতি প্রদর্শন করা আপনাদের কোনও মতেই উচিত নহে। (২.৩০২)

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, বিদ্যাসাগরও তো বিদ্যাভূষণের মতো লোকাচারকে শাস্ত্রাজ্ঞার সাক্ষ্য হিসেবে দেখছেন, অন্তত পণ্ডিতসমাজের বাইরে। বদলে যাওয়া লোকাচারের সমর্থনে হাতের কাছে শাস্ত্র না পাওয়া গেলে অর্বাচীন গ্রন্থ রচনা করে শাস্ত্র বলে চালানো হয়েছে সমাজে। কিন্তু এ ব্যাপারে দুই বন্ধুর মধ্যে পার্থক্য ছিল মৌলিক। বিদ্যাভূষণের অভিযোগ যে, শাস্ত্রকারেরা পুরুষ এবং নারীদের দুঃখ সম্পর্কে উদাসীন; বিদ্যাসাগরের নালিশ তাঁর নিজের সময়ের কপটতার বিরুদ্ধে। বিদ্যাভূষণের ক্ষোভ শাস্ত্রের বিরুদ্ধে; বিদ্যাসাগরের খেদোক্তি শাস্ত্রের অপব্যাখ্যা নিয়ে, শাস্ত্রের ঐতিহাসিকতা সম্পর্কে পরিব্যাপ্ত অজ্ঞতা সম্বন্ধে। এবার সেই খেদোক্তি সবিস্তারে শুনি:

হা শাস্ত্র! তোমার কি দুরবস্থা ঘটিয়াছে! তুমি যে সকল কর্মকে ধর্মলোপকর, জাতিভ্রংশকর বলিয়া ভূয়োভূয়োঃ নির্দেশ করিতেছ, যাহারা, সেই সকল কর্মের অনুষ্ঠানে রত হইয়া, কালাতিপাত করিতেছে, তাহারাও সর্বত্র সাধু ও ধর্মপরায়ণ বলিয়া আদরণীয় হইতেছে; আর, তুমি যে কর্মকে বিহিত ধর্ম বলিয়া উপদেশ দিতেছ, অনুষ্ঠান দূরে থাকুক, তাহার কথা উত্থাপন করিলেই, এককালে নাস্তিকের শেষ, অধার্মিকের শেষ, অর্বাচীনের শেষ, হইতে হইতেছে। এই পুণ্যভূমি ভারতবর্ষ যে বহুবিধ পাপ প্রবাহে উচ্ছলিত হইতেছে, তাহার মূল অন্বেষণে প্রবৃত্ত হইলে, তোমার প্রতি অনাদর, ও লৌকিক রক্ষায় একান্ত যত্ন, ব্যতীত আর কিছুই প্রতীত হয় না। (২.৩০৩)

এই মানুষটাই আবার সংস্কৃত ভাষার পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে প্রাচীন আইন-কানুন ও শাস্ত্রবিধির প্রচারের উপর জোর দেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। তার বদলে তিনি চেয়েছিলেন সেই যুক্তিবিন্যস্ত সংস্কৃত ভাষার চর্চা যা ভাষাবিজ্ঞানের গবেষণা সমৃদ্ধ করবে, আবার একইসঙ্গে পাশ্চাত্য জ্ঞানের উপযোগী আধুনিক ভারতীয় ভাষার মজবুত ভিত গড়ে তুলবে। ১৮৫৩ সালে লেখা সংস্কৃতভাষা ও সংস্কৃতসাহিত্যশাস্ত্রবিষয়ক প্রস্তাব গ্রন্থে তিনি একদিকে সংস্কৃত ভাষার চর্চার ফলে ইউরোপীয় শব্দবিদ্যার উন্নতির প্রসঙ্গ তোলেন, অন্যান্য ভাষার মূলনির্ণয়ে ও মর্মোদ্ধারে সংস্কৃতের উজ্জ্বল অবদানের কথা স্মরণ করেন; আবার হিন্দি, বাংলা ইত্যাদি ভাষাগুলিকে তাদের হীন অবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য সংস্কৃত ভাষার অনুশীলনের প্রয়োজনীয়তার উল্লেখ করেন (২.৪৫)। কিন্তু আরও দু’টি লাভের কথাও বলেন বিদ্যাসাগর, এবং আমাদের পক্ষে এ দু’টির প্রথমটিই প্রাসঙ্গিক। অন্যান্য দেশে রীতি-নীতি-আচার-ধর্ম-বুদ্ধির বিকাশ ইত্যাদির জন্য পুরাবৃত্ত আছে, ভারতবর্ষে তা বলতে গেলে নেই। ‘সুতরাং, প্রকৃত পুরাবৃত্তের নিতান্ত অসদ্ভাবস্থলে, বেদ, স্মৃতি, দর্শন, পুরাণ, ইতিহাস, সাহিত্য প্রভৃতি শাস্ত্রের অনুশীলন ব্যতিরেকে, পূর্বকালীন ভারতবর্ষীয়দিগের আচার ব্যবহার প্রভৃতি পরিজ্ঞানের আর কোনও পথ নাই’ (২.৪৬)। এখানেও দেখি যে, বেদাদি শাস্ত্রসমূহকে এক সেকুলার ব্যাখ্যার অঙ্গীভূত করছেন বিদ্যাসাগর। (‘ইতিহাস’ যে এখানে পাশ্চাত্য অর্থে ‘হিস্ট্রি’ নয়, তা বলা বোধ করি বাহুল্য।)২৪

ওই ১৮৫৩ সালেই এডুকেশন কাউন্সিলকে লেখা বিদ্যাসাগরের চিঠি পড়লে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, যিনি ‘হা শাস্ত্র!’ বলে বিলাপ করতে পারেন, তিনিই আবার শাস্ত্রসর্বস্ব (অথবা শাস্ত্রজ্ঞানহীন) লোকাচার সম্পর্কে কতটা নির্মম মন্তব্য করতে প্রস্তুত ছিলেন।

The bigotry of the learned of India, I am ashamed to state, is not in the least inferior to that of the Arab. They believe that their shastras have all emanated from omniscient Rishis and, therefore, they cannot but be infallible. When in the way of discussion or in the course of conversation any new truth advanced by European science is presented before them, they laugh and ridicule. Lately, a feeling is manifesting among the learned of this part of India, especially in Calcutta and its neighbourhood, that when they hear of a scientific truth, the germs of which may be traced out in their shastras, instead of shewing any regard for that truth, they triumph and the superstitious regard for their own shastras is redoubled. (৩.৪৫৭-৮)২৫

সেই চিঠিতেও তাঁর উৎকণ্ঠা দেশীয় ভাষার বিদ্যালয় নিয়ে, কারণ সেখানেই অন্ধকার জমাট হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধতা এবং বিধবাবিবাহের প্রচলনের সঙ্গে শিক্ষার, বিশেষত স্ত্রীশিক্ষার, প্রসারের যোগ যেমন সরাসরি, তেমনই বিদ্যাসাগরের বিদ্যাভিত্তিক বাণিজ্য উদ্যোগের সঙ্গে তাঁর শিক্ষাপ্রকল্প অচ্ছেদ্য। এ ব্যাপারে হিন্দু কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে, যেমন রামগোপাল ঘোষের সঙ্গে, বিদ্যাসাগরের তফাত, এবং তাঁর নিজের চিন্তা ও কর্মের অন্তঃসংহতি লক্ষ করেছেন বিনয় ঘোষ এবং অন্য কেউ কেউ।২৬

অন্তর ও বাহির, ‘স্ব’ এবং ‘পর’-এর বিরোধ তথা বিরোধাভাসের প্রসঙ্গ দিয়ে আলোচনা আরম্ভ করেছিলাম। অনেক ক্ষেত্রের মতো এখানেও রবীন্দ্রনাথের বিচার আজ অভ্রান্ত মনে হয়, যদিও তাঁর ভাষা আমাদের নয়, তাঁর কালের।

যাঁহাদের মধ্যে মনুষ্যত্বের পরিমাণ অধিক, চিরাগত প্রথা ও অভ্যাসের জড় আচ্ছাদনে তাঁহাদের সেই প্রবল শক্তিকে চাপা দিয়া রাখিতে পারে না। ইঁহারাই নিজের চরিত্রপুরীর মধ্যে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার প্রাপ্ত হন। অন্তরস্থ মনুষ্যত্বের এই স্বাধীনতার নামই নিজত্ব। এই নিজত্ব ব্যক্তভাবে ব্যক্তিবিশেষের, কিন্তু নিগূঢ়ভাবে সমস্ত মানবের।২৭

যা আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে বিদ্যাসাগরের মননের মধ্যে, এমনকী তাঁর প্রগতিচিন্তার অন্তর্দেশে, স্ববিরোধ, তাকে শাস্ত্রের ইতিহাসসাপেক্ষতা প্রতিপন্ন করার তাগিদ হিসেবে দেখার প্রয়োজন আছে। উপরন্তু, এই তথাকথিত স্ববিরোধকে যদি সমাজবদলের লড়াইয়ে শাস্ত্রপ্রমাণের অন্তঃপাতী এবং অন্তর্ঘাতী প্রভাবকে সক্রিয় করার কৌশল হিসেবে মানি, এবং দেশীয় বিষয়ীসত্তার নির্মাণের বৈষম্য প্রতিহত করার সৎ প্রচেষ্টা হিসেবে দেখি, তা হলে বিদ্যাসাগরের আধুনিকতার ইতিহাসনিষ্ঠ মাত্রাটি চেনা সম্ভব হবে বলে আমার বিশ্বাস।

টীকা ও সূত্রনির্দেশ

. শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন, বিদ্যাসাগর-জীবনচরিত, ঈশানচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত (১৮৯১; ৩য় সংস্করণ, কলকাতা: সিদ্ধেশ্বর প্রেস ডিপোজিটরি, ১৯১৪), পৃ. ৮৭। দ্রষ্টব্য: ‘বাল্যবিবাহের দোষ’, বিদ্যাসাগর রচনাবলী, দেবকুমার বসু সম্পাদিত, ৪ খণ্ড (কলকাতা: মণ্ডল বুক হাউস, ১৯৬৬-১৯৬৯), প্রথম খণ্ড, পৃ. ৩৬২, পাদটীকা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রচনা থেকে উদ্ধৃতির সূত্র এই সংস্করণ। প্রবন্ধের মূল অংশে উদ্ধৃতির শেষে সূত্রের খণ্ড ও পৃষ্ঠাসংখ্যা বন্ধনীর মধ্যে দেওয়া আছে।

. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ‘ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এবং পরাধীনতা’, বঙ্কিম-রচনাবলী, যোগেশচন্দ্র বাগল সম্পাদিত ২ খণ্ড (কলকাতা: শিশু সাহিত্য সংসদ ১৯৫৩-৫), ২য় খণ্ড (সংশোধিত ১২শ মুদ্রণ, ১৯৯৪), পৃ. ২১০-১৪।

. বিদ্যাসাগরের লেখা বিধবাবিবাহ সংক্রান্ত শাস্ত্রবিচার এবং বাংলা গদ্যে তাঁর শকুন্তলা-র মতো প্রণয় উপাখ্যান উপস্থাপনার মধ্যে এক সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করেছেন ব্রায়ান হ্যাচার। ‘…one might argue that these two works, Shakuntala and Hindu Widow Marriage, represent the two prongs of a concerted strategy to advance the cause of women’s welfare.’ Brian A. Hatcher, Vidyasagar: The Life and After-life of an Eminent Indian (2014; repr. London: Routledge, 2019), p. 85.

. বিদ্যাসাগরের লেখায় একইসঙ্গে শাস্ত্রনির্ভরতা ও শাস্ত্রবিরোধিতা প্রকাশ পেয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন অলোক রায়। দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব, বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার এবং ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ রচনাগুলির নাম করেছেন। অলোক রায়, ‘উনিশ শতকে বাঙালির শাস্ত্রানুশীলন’, উনিশ শতকে নবজাগরণ: স্বরূপ সন্ধান (কলকাতা: অক্ষর প্রকাশনী, ২০১৯), পৃ. ৩৭।

. বিদ্যাসাগর যে একজন সেকুলার সংস্কারক ছিলেন, এই মন্তব্য প্রায়ই শুনি। তবু মনে হয় তাঁর ধর্মশাস্ত্র নির্ভরতার সতর্ক ব্যাখ্যার প্রয়োজন। বিদ্যাসাগরের ‘সেকুলার’ চরিত্র সম্পর্কে মন্তব্যের দৃষ্টান্ত হিসাবে দ্রষ্টব্য: তপোধীর ভট্টাচার্য, ‘বিদ্যাসাগর’, কবিতীর্থ, ৩৭ (গ্রীষ্ম, ১৪২৫), পৃ ১৭৬-৮। গভীরতর বিশ্লেষণ রয়েছে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের লেখায়। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, ‘লেখকের উত্তর’, বিদ্যাসাগর: নানা প্রসঙ্গ (কলকাতা: চিরায়ত প্রকাশন, ২০১১), পৃ ১৬৫-৭২।

. বিদ্যাসাগর ও তর্কবাচস্পতির সম্পর্ক বিষয়ে দ্রষ্টব্য: Hatcher, Vidyasagar: The Life and After-life of an Eminent Indian, pp. 130-55.

. দ্রষ্টব্য: Ram Gopal Sanyal, A General Biography of Bengal Celebrities, Both Living and Dead (Kolkata: Uma Churn Chuckerbutty, 1889), pp. 181-2. এই সূত্রটির হদিশ আমাকে দেন পূর্বাশা আঢ্য।

. দ্রষ্টব্য: গৌতম নিয়োগী, ‘বিদ্যাসাগর ও তৎকালীন ব্রাহ্মসমাজ’; অভ্র বসু, ‘বিদ্যাসাগর ও মধুসূদন: সম্পর্কের রসায়ন’; মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম, ‘হিরণ্ময় বন্ধুত্ব: অক্ষয়কুমার দত্ত ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’; পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, ‘চির অমলিন বন্ধুত্বের বন্ধন: প্যারীচরণ ও বিদ্যাসাগর’। এই প্রবন্ধগুলির সূত্র তাপস ভৌমিক সম্পাদিত বিদ্যাসাগর ও অন্যান্য ব্যক্তিত্ব (কলকাতা: কোরক, ২০১৪), পৃ. ৬২-৭৬, ৮৯-১০৬, ১৫২-৬০, ১৮৬-৯৫। এ ছাড়া দ্রষ্টব্য: চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর (১৮৯৫; কলকাতা: আনন্দধারা, ১৯৭০),পৃ. ৪৬৫-৭।

. উৎসর্গপত্রটি উদ্ধৃত আছে ইন্দ্রমিত্রের বিদ্যাসাগর-জীবনীতে। দ্রষ্টব্য: ইন্দ্রমিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসাগর (১৯৬৯; ২য় পরিবর্ধিত সংস্করণ, কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯২), পৃ. ৫৪১-২।

১০. রাজনারায়ণ বসুর আত্ম-চরিত, তৎকর্ত্তৃক হস্তলিপি হইতে মুদ্রিত (কলিকাতা: কুন্তলীন প্রেস, ১৯০৯), পৃ. ৯৯-১০০।

১১. যে সাংখ্য দর্শনের বিরোধিতা বিদ্যাসাগর করেছিলেন তা সম্ভবত ছিল সাংখ্যকারিকা ও সাংখ্যসূত্রের বৈদান্তিক ভাষ্যকারদের সাংখ্য। এঁদের ব্যাখ্যার ফলে বস্তুবাদী সাংখ্যের সঙ্গে চেতনবাদী বেদান্ত দর্শনের পার্থক্য অনেকটাই কমে আসে। দ্রষ্টব্য: রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, ‘বিদ্যাসাগর কোন্‌ সাংখ্যের কথা ভেবেছিলেন’, বিদ্যাসাগর: নানা প্রসঙ্গ, পৃ. ১২২-২৬।

১২. বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব গ্রন্থের দুই খণ্ডের এক সংক্ষিপ্ত ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। Marriage of Hindu Widows নামের অনুবাদটিতে এই virtue শব্দটি ব্যবহার করেন তিনি। দ্রষ্টব্য: Marriage of Hindu Widows (Calcutta: K. P. Bagchi and Company, 1976), pp. i-ii; এবং Brian A. Hatcher, Idioms of Improvement: Vidyasagar and Cultural Encounter in Bengal (Calcutta: Oxford University Press, 1996), p. 254. বিদ্যাসাগরের ‘ধর্ম’ সম্পর্কিত ধারণার আলোচনা আছে বইটির ২৫২ থেকে ২৬৩ সংখ্যক পৃষ্ঠায়।

১৩. চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর, পৃ. ২৬০।

১৪. Asok Sen, Iswar Chandra Vidyasagar and His Elusive Milestones (1977; Ranikhet: Permanent Black, 2016), p. 73.

১৫. Asok Sen, Iswar Chandra Vidyasagar and His Elusive Milestones, pp. 75, 86. বিধবাবিবাহ আইনে প্রয়াত স্বামীর ধনের উত্তরাধিকার ত্যাগ করতে বাধ্য হত পুনর্বিবাহিত নারী। এ ব্যাপারে বিদ্যাসাগর আপত্তি তোলেননি, রক্ষণশীল হিন্দু সমাজনায়কদের নতুন করে ক্ষুব্ধ করতে চাননি বলেই হয়তো। কিন্তু ন্যায্য অধিকারে পাওয়া ধন বিধবার হাত থেকে কাড়তেও চাননি ‘অসতীত্ব’-এর অজুহাতে। দ্রষ্টব্য: Asok Sen, Iswar Chandra Vidyasagar and His Elusive Milestones, pp. 78-9.

১৬. Asok Sen, Iswar Chandra Vidyasagar and His Elusive Milestones, pp. 85-6.

১৭. রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, বিদ্যাসাগর: নানা প্রসঙ্গ, পৃ. ৩৪।

১৮. Amales Tripathi, Vidyasagar: The Traditional Moderniser (Bombay: Orient Longman, 1974).

১৯. এহেন মত ও দৃষ্টিভঙ্গির নমুনার জন্য দ্রষ্টব্য: Brian A. Hatcher, Idioms of Improvement: Vidyasagar and Cultural Encounter in Bengal, pp. 257-63. হ্যাচার পরে বিদ্যাসাগরের আধুনিকতা সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা পরিমার্জনা করেছিলেন। দ্রষ্টব্য: Brian A. Hatcher, Vidyasagar: The Life and After-life of an Eminent Indian, pp. 122-6.

২০. চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদ্যাসাগর, পৃ. ২৯৭।

২১. রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, ‘মূর্খ বড়, আধুনিক নয়, অথবা প্রোক্রাস্টেস-এর খাটে বিদ্যাসাগর’, বিদ্যাসাগর: নানা প্রসঙ্গ, পৃ. ৫৭।

২২. অন্নদাশঙ্কর রায়, বাংলার রেনেসাঁস (১৯৭৪; কলকাতা: বাণীশিল্প, ১৯৯৯), পৃ. ৪২।

২৩. ব্রাহ্মণ-শূদ্রের আসনভেদ সংস্কারে বিদ্যাসাগর উৎসাহী ছিলেন না, ব্রাহ্ম প্রচারক রাজনারায়ণ বসুও এই কুপ্রথার বিরোধিতা করেননি। ১৮৭৩ সালে ব্রাহ্মসমাজে পৌত্তলিকতা বর্জিত নতুন উপনয়ন রীতি চালু হয়। সোমেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপনয়ন অনুষ্ঠান যে দালানে হয়, সেখানে শূদ্রের বসা নিষিদ্ধ করেছিলেন পিতা দেবেন্দ্রনাথ। উপবীত ধারণের সমর্থক রাজনারায়ণ বসু ভুল করে সেখানে বসে লজ্জায় পড়ে যান। দ্রষ্টব্য: রাজনারায়ণ বসুর আত্ম-চরিত, তৎকর্ত্তৃক লিখিত হস্তলিপি হইতে মুদ্রিত, পৃ. ১৯৯।

২৪. সংস্কৃত না জানলে শাস্ত্রের ইতস্তত অযৌক্তিকতা থেকেও মুক্ত হতে পারবে না ভারতবাসী, এমন দুশ্চিন্তাও বিদ্যাসাগরের ছিল। এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, ‘লেখকের উত্তর’, বিদ্যাসাগর: নানা প্রসঙ্গ, পৃ. ১৬৮। বিদ্যাসাগরের শিক্ষাভাবনা সম্পর্কে দ্রষ্টব্য: অলোক রায়, ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শিক্ষাভাবনা ও সংস্কৃত কলেজ’, উনিশ শতকে নবজাগরণ: স্বরূপ সন্ধান, পৃ. ২২০-৩০। বিদ্যালয়ের শিক্ষায় সংস্কৃত ভাষা বর্জনের বিরোধিতা করে বিদ্যাসাগর শূদ্রদের এবং মুসলমানদের সংস্কৃত ভাষা শেখার সু্যোগ করে গিয়েছিলেন, এটা অনেকেই খেয়াল করেন না। দ্রষ্টব্য: অন্নদাশঙ্কর রায়, বাংলার রেনেসাঁস, পৃ. ৩৪।

২৫. চিঠিটির এই অংশের অনুবাদ পাওয়া যাবে সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা, দ্বিতীয় খণ্ডে। ‘আমার বলিতে লজ্জা হয়— ভারতীয় পণ্ডিতগণের গোঁড়ামি ঐ আরব খলিফের গোঁড়ামির চেয়ে কিছু কম নয়। তাহাদের বিশ্বাস, সর্ব্বজ্ঞ ঋষিদের মস্তিষ্ক হইতে শাস্ত্র নির্গত হইয়াছে, অতএব শাস্ত্র-সমূহ অভ্রান্ত। আলাপ অথবা আলোচনার সময় পাশ্চাত্ত্য বিজ্ঞানের নূতন সত্যের কথা অবতারণা করিলে তাহারা হাসি ও ঠাট্টা করিয়া উড়াইয়া দেয়। সম্প্রতি ভারতবর্ষের এই প্রদেশে— বিশেষতঃ কলিকাতা ও তাহার আশেপাশে— পণ্ডিতদের মধ্যে একটি মনোভাব পরিস্ফুট হইয়া উঠিতেছে; শাস্ত্রে যাহার অঙ্কুর আছে, এমন কোন বৈজ্ঞানিক সত্যের কথা শুনিলে, সেই সত্য সম্বন্ধে শ্রদ্ধা দেখান দূরে থাক, শাস্ত্রের প্রতি তাহাদের কুসংস্কারপূর্ণ বিশ্বাস আরও দৃঢ়ীভূত হয় এবং “আমাদেরই জয়” এই ভাব ফুটিয়া উঠে।’ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা, ২য় খণ্ড (বঙ্গাব্দ ১৩৪৯; সংশোধিত পঞ্চম সংস্করণ, বঙ্গাব্দ ১৩৬২; ষষ্ঠ সংস্করণ; কলকাতা: বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ১৩৭৭), পৃ. ৩৫-৬।

২৬. দ্রষ্টব্য: বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙ্গালী সমাজ, ৩ খণ্ড (বঙ্গাব্দ ১৩৬৪-৬৬), তিন খণ্ড একত্রে (কলকাতা: ওরিয়েন্ট লংম্যান, ১৯৭৩), পৃ. ১৫৯-৮৯।

২৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘বিদ্যাসাগরচরিত’, চারিত্রপূজা, রবীন্দ্র-রচনাবলী (১৯৪১; কলকাতা: বিশ্বভারতী, ১৯৫৭), পৃ. ৪৮০।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *