শালিক ও ছোটকাকা

শালিক ও ছোটকাকা

তিনজন তিন জায়গায় দাঁড়িয়ে। মিনি আর শানু দুটো জানলার ধারে, আর পিণ্টু দরজার পাশে। কেউ কোনো কথা বলছে না। মনে হতে পারে যেন ওদের তিনজনের মধ্যে খুব ঝগড়া, তাই তিনজন তিন দিকে মুখ ফিরিয়ে আছে। ঘরের মধ্যে একটা আলপিন পড়লেও তার শব্দ শোনা যাবে।

ঠিক পাঁচ মিনিট বাদে শালিক পাখিটা ঢুকল ঘরে। ফর—ফর করে দু—পাক ঘুরে তারপর বসল ডান দিকের দেয়ালের ঘুলঘুলিটা আঁকড়ে।

আর ঠিক তখনই স্প্রিং—এর মতন তিন জোড়া হাত ঝপাঝপ বন্ধ করে দিল দরজা আর জানলা দুটো। একেবারে নিখুঁত কাজ। শালিক পাখিটা কিছু সন্দেহ করারও সময় পায়নি।

পিণ্টু চেঁচিয়ে বললো, পাখা বন্ধ করে দে! শিগগির পাখা বন্ধ করে দে!

মিনি পাখার সুইচ অফ করে দিল সঙ্গে সঙ্গে। আর আলোটা জ্বেলে দিল। তিনজনের মুখেই এবারে ফুটে উঠল জয়ের হাসি।

দরজা—জানলা বন্ধ হবার আওয়াজ পেয়েই শালিকটা উড়তে শুরু করেছিল, পাখার ব্লেড বাঁচিয়ে তিনি পাক ঘুরেই সে বুঝে গেল ব্যাপারটা। শালিক পাখিরা খুব চালাক হয়। পিন্টুর বন্ধু টাবলু এই কায়দায় একটা চড়াই পাখি ধরতে গিয়েছিল, কিন্তু সেই চড়াইটা জানলার কাঁচকে খোলা জানলা ভুল করে এমন জোরে ধাক্কা খেল যে আধ—মরা হয়ে গেল। পিন্টুরা তো তা চায় না। তারা জ্যান্ত আর সুস্থ অবস্থায় শালিকটাকে ধরতে চায়।

দরজার ঠিক সামনের দেয়ালটাতেই পিণ্টুর ঠাকুরদার একটা বেশ বড় বাঁধান ছবি ঝুলছে। শালিকটা সেই ছবির ওপর বসে বেশ গাঢ় চোখে তাকাল ওদের দিকে। পাখিটা খুব যে একটা ভয় পেয়েছে তা মনে হলো না। শালিকের চোখ দুটো কাজলটানা, সব সময় একটা অবাক—অবাক ভাব।

মিনি জিজ্ঞেস করল, এবারে কী করে ওটাকে ধরবি?

পিন্টু বললো, দ্যাখ না ও উড়ে উড়ে ক্লান্ত হয়ে যাবে, তারপর এক সময় ঝুপ করে মাটিতে পড়বে!

শানু বললো, কিন্তু ও তো উড়ছে না! এক জায়গায় বসে আছে।

পিণ্টু ততক্ষণে বুক—শেলফের পাশ থেকে একটা ফুলঝাড়ু বার করেছে।

আগে থেকে সব ব্যবস্থা করে রেখেছে পিণ্টু। তিন—চার দিন ধরেই শালিকটা ঠিক দুপুরে এই সময়টায় ঘরের মধ্যে এসে ঘুলঘুলিতে কী যেন খোঁজে। আজ একটা দারুণ সুযোগ পাওয়া গেছে। বাবা অফিসে, মা গেছেন ছোটমাসিদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে। গোবিন্দও এই সময় আড্ডা মারতে যায়। পিণ্টু তার দুই ছোট বোনকে বুঝিয়ে এই পাক্কা ব্যবস্থা করেছে।

সে অবশ্য শালিক পাখিটাকে মারতেও চায় না, পুষতেও চায় না। বাবা পাখি—পোষা খুব অপছন্দ করেন। আর শুধু শুধু একটা পাখিকে পিণ্টু মারবে কেন? শালিক তো আর মুরগি নয় যে রান্না করে খাওয়া যাবে।

পিণ্টু একটা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করতে চায়। সে শালিক পাখিটাকে ধরে দেখবে, ওরা পিড়িং শব্দটা করে কী করে! যে কোনো শালিক একটা জায়গা ছেড়ে যাবার সময় ঠিক ওইরকম একটা শব্দ করবেই। ওটা কি ওদের ডানার শব্দ? শালিক তো অন্য সময় পিড়িং করে ডাকে না। শালিকের ডাক তো কিচু—কচু— কিচু—কুচু—ককেটাং—ককেটাং এই ধরনের। শুধু এক জায়গা ছেড়ে ওড়বার সময় ওরকম শব্দ করে কেন? যেন, যে জায়গাটা ছেড়ে গেল, সেখানে ওই শব্দটা রেখে গেল। আর কোনো পাখি তো এরকম করে না!

পিণ্টু ফুলঝাড়ুটা আস্তে আস্তে উঁচু করল শালিকটার দিকে। গভীর মনোযোগ দিয়ে শালিকটা সেটা দেখতে লাগল, খুব কাছে এসে পড়ার পর ঠাকুরদার ছবি ছেড়ে সেটা উড়ে গেল ডান দিকের জানলার পর্দার পেলমেটের ওপর।

এবার কিন্তু সেই পিড়িং শব্দটা করল না।

পিণ্টু আবার ফুলঝাড়ুটা নিয়ে সেদিকে যেতেই শালিকটা অবিকল মানুষের গলায় বলে উঠল, ওহে মূর্খ বালক—বালিকাগণ! তোমরা আমায় ধরিতে পারিবে? হাঃ হাঃ হাঃ! এই দ্যাখ, আমি অদৃশ্য হইয়া যাইতেছি!

এই কথা বলেই শালিকটা পেলমেট ছেড়ে দিয়ে ঘরের চারপাশে ঘুরপাক খেয়ে উড়ল কয়েকবার। তারপর সত্যি তাকে আর দেখা গেল না।

পিণ্টুরা দারুণ অবাক হয়ে গেল তিনটে কারণে। প্রথমত শালিকটা কথা বলল মানুষের মতন। ওর গলার আওয়াজ একদম ছোটকাকার মতন। ছোটকাকা তো থাকেন দুর্গাপুরে। আর শালিকটা সত্যিই অদৃশ্য হয়ে গেল?

শুধু অবাকই নয়, মিনি আর শানুর মুখও শুকিয়ে গেছে ভয়ে।

কিন্তু পিণ্টু অত সহজে ঘাবড়াবার ছেলে নয়। সে বললো, নিশ্চয়ই ছোটকাকা ফিরে এসেছেন দুর্গাপুর থেকে। সে ছুটে গেল রাস্তার দিকে জানলার কাছে। কাচের পাল্লাটা সামান্য একটু ফাঁক করে এদিক ওদিক চেয়ে দেখল। হ্যাঁ, ঠিক দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন ছোটকাকা।

ছোটকাকা হাসতে হাসতে বললেন, কী হচ্ছে, অ্যাঁ? তখন থেকে সদরে বেল বাজাচ্ছি, কেউ দরজা খুলছে না!

পিণ্টু বেশ রেগে গেছে। গম্ভীরভাবে বললো, খুলছি।

জানলাটা আবার বন্ধ করে পিণ্টু ফিরে এসে খুব সাবধানে দরজাটা খুলে বললো, মিনি, যা তো সদর দরজা খুলে দিয়ে আয়!

আবার দরজা বন্ধ করে পিন্টু ঘরের চারপাশে তাকাল। শালিক পাখিরা মানুষের মতো কথা বলতে পারে না, পিণ্টু জানে আগেকার দিনে রূপকথার আমলে বলতে পারত বোধ হয়। কিন্তু পাখিটা গেল কোথায়? ওপরের দিকে কোথাও নেই। পিণ্টু বুক—শেলফের পেছনে, পড়ার টেবিলের নিচে, সব জায়গায় তন্নতন্ন করে খুঁজল, কোথাও দেখা গেল না পাখিটাকে।

পিণ্টু তখন ফুলঝাড়ুটা হাতে নিয়ে সারা ঘর দৌড়ে দৌড়ে হুস হুস করে শব্দ করতে লাগল। তবু কোনো পাত্তা নেই।

ছোটকাকা দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ে বললেন, পেলি না তো? দৌড়ে দৌড়ে তুই নিজেই ক্লান্ত হয়ে যাবি, তখন শালিক পাখিটা তোকে দেখে হাসবে।

পিণ্টু খানিকটা অভিমানের সুরে বললো, পাখিটা কোথায় গেল বল তো ছোটকা? কিছুতেই তো ঘরের বাইরে যেতে পারে না!

ছোটকাকা বললেন, তুই জানিস না, শালিক পাখিরা হলো পাখিদের মধ্যে ম্যাজিশিয়ান! ওরা অদৃশ্য হতে পারে, মানুষের গলা নকল করতে পারে, অন্যরকম চেহারা ধরতে পারে।

পিণ্টু অবিশ্বাসের সুরে বললো, যাঃ!

ছোটকাকা বললেন, বিশ্বাস করছিস না, আচ্ছা সব জানলা—দরজা খুলে দে।

পিণ্টু খুলে দিল সব দরজা—জানলা।

ছোটকাকা বললেন, এর মধ্যে শালিকটা বেরিয়ে যায়নি তো? আর কোনো শালিক ঢুকেছে? তাও ঢোকেনি! তাহলে ওই দ্যাখ!

ছোটকাকা আঙুল তুললেন, আর পিন্টুরা সেই দিকে তাকিয়ে দেখল, ঠাকুরদার ছবির ওপর পাশাপাশি দুটো শালিক বসে আছে!

ছোটকাকা হাততালি দিতেই দুটো শালিক একসঙ্গে পিড়িং শব্দ তুলে বেরিয়ে গেল জানলা দিয়ে।

ছোটকাকা বললেন, ওরা ওই পিড়িং শব্দ করে কেন জানিস! ওটাই হলো ম্যাজিকের মন্ত্র। ওর মানে হলো ”হায় গগন নহিলে তোমারে ধরিবে কেবা?”

পিণ্টুরা হাঁ করে চেয়ে রইল ছোটকাকার দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *