শালপাতার ডাক – ননী ভৌমিক
আজ থেকে যদি এক-এক করে একশোটি বছর পেছিয়ে যাও, তাহলে? তাহলে ভারি এক অবাক কাণ্ড দেখা যাবে৷ শাল পাতা কথা কইছে৷
ভাবছ, দূর, তাই কখনো হয়? কিন্তু হয়৷ হয়েছিল৷ শাল পাতা শুধু কথা কয়নি, এমন এক ভয়ানক ডাক পাঠিয়েছিল চারিদিকে যে ইংরেজ রাজত্বে কাঁপন লেগেছিল৷ বাংলা দেশের উত্তর-পশ্চিমে যে এক মস্ত জঙ্গল আর পাহাড়-ভরা পরগনা আছে সেখান থেকে থানা পুলিশ আইনকানুন রাজ্য রাজত্ব সব ছেড়ে ইংরেজদের পাততাড়ি গুটাতে হয়েছিল৷
সে এক মস্ত কাহিনি৷ বড়ো হয়ে তা আরও ভালো করে জানবে৷ আমি তা সবটুকু বলব না৷ আমি এর ভেতরে বলব শুধু সোমা সাঁওতালের গল্প৷ কারণ কী জানো? ওই যে শাল পাতা সেদিন ডাক পাঠিয়েছিল তার মানে যারা সেদিন বুঝতে পেরেছিল তার মধ্যে সোমা বুড়ো হল একজন৷
কে সোমাবুড়ো জানো না বুঝি৷ সে ওই সাঁওতাল পরগনার পিয়ালজোড় গাঁয়ের এক সাঁওতাল৷ সে ছিল এক ভারি সুন্দর গাঁ৷ বনের কোল আর পাহাড়ের ঢালুতে তকতক করত কয়েকটা নিকোনো কুঁড়ে৷ দূর থেকে দেখলে মনে হত বুঝি ছাই ছাই বাদামি রঙের কয়েকটা পাখি৷ হঠাৎ কোনো রূপকথার দেশ থেকে উড়ে এসে ওর পালকে মুখ গুঁজে দু-দণ্ড জিরিয়ে নিচ্ছে৷
বনের কোল আর পাহাড়ের ঢালটুকু কিন্তু সাঁওতালরা নিজেরাই বানিয়ে নিয়েছিল গায়ে গতরে খেটে৷ বন কেটে বসত হল৷ পাহাড় কেটে আবাদ হল৷ অগ্রহায়ণ মাসে পাহাড়ের ঢালে ধান-সিঁড়ি খেতগুলো পেকে উঠত হলুদ হয়ে৷ কালো কালো মানুষগুলো সেই পাকা ধান ঘরে তুলে তারপর ঢুকত বনের মধ্যে শিকারে৷ ছাই রঙের খরগোশ আর তিতির, খয়েরি রঙের সজারু আর বনমুরগি ঘাড়ে করে চৈত মাসে আবার ফিরে আসে সবাই৷ চারিদিকে তখন শিমুলে পলাশে মাতন৷ মহুয়া ফুলের মধু-মধু গন্ধের ঘোর৷ বিয়ে-শাদি পাল-পার্বণ যা করার শেষ করে আবার জষ্ঠির শেষ থেকে খেতের দিকে মন দেওয়ার পালা৷ মেয়েরা হেঁটে হেঁটে চলে যেত জাড়ুই নদীর বালিতে৷ বালি খুঁড়ে খুঁড়ে তুলত ঠান্ডা জল৷ মোষগুলো হাঁসফাঁস করে শুকনো নদীর কোল খুঁজে খুঁজে দেখত কখন আসবে পাহাড়ে বন্যার গেরুয়া জলের ঢল৷ আর তখন সোমা সাঁওতালের মতো পাকা চাষিরা বাতাস শুঁকে, আকাশ দেখে বলে দিত এইবার বর্ষা নামবে৷
বর্ষা নামলে ভুরভুরে সোঁদা গন্ধের মধ্যে লাঙল নিয়ে আবার শুরু হয়ে যাবে চাষের মরশুম৷
কিন্তু এমনি করে চলতে দিলে তো৷ ওদিকে ইংরেজ তখন দেশের রাজা৷ শ-খানেক বছর ধরে হিন্দুস্তানের নানান যুদ্ধে জিতে ওদের তখন ভারি দেমাক৷ দেশময় তখন নানা ওলট-পালট৷
সাঁওতালরা ভালো জমি আবাদ করেছে শুনে অমনি কোথা থেকে জমিদারদের পেয়াদা গোমস্তারা এসে হাজির৷
‘বাপুরে, এ জমির মালিক কিন্তু তোরা নস, জমিদার৷ যা ধান তুলেছিস সব দিয়ে জমিদারের খাজনা শোধ কর৷’
ব্যাপারী, মহাজনরা এসে হাজির৷ ‘বাপুরে, লোহা, পুঁতি, কাচের চুড়ি যা ব্যবহার করছিস তার দাম দে, সুদ দে৷’
কিন্তু মাপের পর মাপ ধান দিয়েও না সুদ না খাজনা কিছুই পরিশোধ হত না৷ ওরা তো লেখাপড়া জানত না৷ হিসাব কিতাব জানত না৷ দিনের পর দিন শুধু ঠকত৷ আজকেও যদি ও সব দিকে যাও দেখবে এক-শো আমের দাম নিয়ে ওরা এক-শো ত্রিশ-চল্লিশটা আম গুণে দেবে৷ ঠগ লোকেদের এতই দাপট এতদিন পর্যন্ত চলে এসেছে যে ওরাও মেনে নিয়েছে এক-শো মানে এক-শো পঁচিশ, এক সের মানে এক সেরের অনেক বেশি, এক সের ধান মেপেই যেতে হবে যতক্ষণ না লেখাপড়া-জানা বাবুরা সদয় হয়ে বলবে, ‘থাক, হয়েছে৷’
কিন্তু এ-ই সব নয়৷ এই সব জমিদার, মহাজন, পুলিশ, দারোগার সঙ্গে সঙ্গে এল নতুন আর এক বস্তু-রেল লাইন৷ দেশে তখন সবে রেল চলা শুরু হয়েছে৷ বাংলা ছাড়িয়ে বিহারের দিকে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে রেলপথ৷ যত সব সাহেব ঠিকাদার আর ইঞ্জিনিয়াররা এসে তাঁবু গেড়েছে জায়গায় জায়গায়৷ দেদার তাদের মাইনে৷ বাঁ-হাতে ডান হাতে টাকা লোটার বেজায় মরশুম৷ কিন্তু তাঁবু গাড়া এক জিনিস আর কাজ করা আর এক জিনিস৷ উঁচু-নীচু বনজঙ্গল পাহাড় নদী পার হয়ে মাইলের পর মাইল সমান করে লাইনের পথ গড়ে তুলবে কে? না, ওই সাঁওতালরা৷
তাই জমিদার মহাজনের সঙ্গে সঙ্গে হানা দিতে লাগল নতুন ধরনের সব ঠিকাদার! ‘বাপুরে, সাহেবদের জন্যে হাঁস মুরগি শুয়োর চাই৷ ক্যাম্পে চাকরানির জন্যে চাই সাঁওতাল মেয়ে৷ আর লাইন বানাবার জন্যে চাই সাঁওতাল বেগার৷’
-‘কেনে যাব গো? যদি না যাই?’
-‘জোর করে ধরে নিয়ে যাব!’
-‘ধরে লিয়ে যাবি? তো আমাদের কী হবে তাহলে?’
ঠিকাদারের লোকেরা হো-হো করে হাসত৷ কী হবে আবার? কুলি হবি! কুলি! কুলি!
জানো তো, বড়োলোক ইংরেজরা চিরকাল আমাদের দেশকে কুলির দেশ বলে ঘেন্না করে এসেছে৷ সে কুলি তৈরি তখন সবে শুরু হয়েছে৷
তাই অমন মেহনতের দেশ যে সাঁওতাল পরগনা, দেখতে দেখতে হয়ে উঠল এক ছন্নছাড়া সর্বনাশের দেশ৷ যেদিকে দু-চোখ যায় সর্বনাশ৷ পুবদিক গেলে সর্বনাশ, পশ্চিম দিকে গেলে সর্বনাশ৷ চারিদিকে চার রকমের শুধু সর্বনাশ!
রেলের রাস্তা বানাবার জন্যে এমনি করে জোর করে যাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে একজন ছিল সোমা সাঁওতাল৷ পিয়ালজোড় গাঁ থেকে সারবন্দি করে সোমা আর আরও কিছু মেয়ে-মরদকে যখন নিয়ে গেল রেল-সাহেবরা, তখন কেউ ভাবেনি, ওরা আবার কেউ ফিরে আসবে৷ কেউ বলত : কী সব টিপসই করে নিয়েছে, আর ফিরতে দেবে না৷ কেউ বলত, টিপসই নয় বাপু, রেলের সব পুল হচ্ছে না? তাতে এক-শো আট করে নরবলি দিতে হবে৷ ওদের সেইজন্যেই নিয়ে গেছে৷
নরবলি হোক আর না হোক, পিয়ালজোড় গাঁয়ের সে লোকগুলো কিন্তু আর ফেরেনি৷ তা ছাড়া নিজেদের জ্বালাতেই বলে লোকে তখন মরছে৷ খেতে ফসল ফলে, কিন্তু সে ফসল ঘরে তোলা যায় না৷ গোরু, ছাগল পোষে, কিন্তু মহাজনের হাতে তা ছেড়ে দিতে হয়৷
শুধু অনেক দিন পরে এক সন্ধ্যায় দেখা গেল বুড়ো মতো কে একটা লোক এসে বসে আছে পিয়ালজোড় গাঁয়ের সিঙে বোঙা দেবতার থানের সম্মুখে৷
কে লোকটা? গাঁয়ের লোকেরা এসে জিজ্ঞেস করে, ‘কী জাত?’
তারপর ভালো করে ঠাহর করে চিনতে পেরে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘সোমা? সোমা সাঁওতাল? এত বুড়ো হয়ে গেলি কেমন করে?’
বুড়ো লোকটা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে৷ বলে, ‘সোমা সাঁওতাল মরে গেইছে৷ কুলি বটি, সোমা কুলি!’
-‘তাহলে ছেড়ে দিল তুদের?’
-‘কেনে ছাড়বে? পালিয়ে এলম৷ তিন মাস ঘুরলাম জঙ্গলে, তারপর থাকতে না পেরে ফের চলে এলম গায়েঁ৷’
-‘কেমন ছিলি? তোদের বলি দিয়ে রাস্তা বাঁধেনি?’
কী একটা কথা ভাবে সোমা৷ অতীতের কীসব স্মৃতি মনে পড়ে যায়৷ তারপর দুঃস্বপ্ন দেখার মতো করে চমকে ওঠে৷ ‘বলি দেয়নি৷ কিন্তু বলি দেওয়ার চেয়েও বোধ হয় বেশি৷’
সবাই চুপ করে যায়৷ থমথম করে সারা গাঁ-খানা৷ শুধু অন্ধকারে খ্যাপার মতো কে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কিন্তু এমনি করে কতদিন চলবে? কতদিন?’
কেউ তার জবাব দেয় না৷ আর তাতে যেন আরও বেশি করে থমথমে হয়ে ওঠে পিয়ালজোড় গ্রাম৷ সোমাকুলি আপন মনে শুধু বলে-‘দিন আসবে, দিন আসবে একসময়৷’
তারপর সত্যি সত্যি বুঝি দিন এল৷ এল সেই শাল গাছের ডাক৷
দু-পা তার ফাটাফাটা৷ জট-পাকানো কটা কটা চুল তার সাপের মতো চাপ বাঁধা৷ চোখের চাউনি তার জংলা জংলা৷ কালো মতো একটা লোক একদিন গাঁয়ের পর গাঁ ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছোল পিয়ালজোড় গাঁয়ে৷ ঘাড়ে তার একটা শাল পাতার ডাল৷ এক-একদিন সূর্য ওঠে আর এক একটা পাতা সে ছিঁড়ে উড়িয়ে দেয় বাতাসে৷ এমনি করে সব পাতা যেদিন নিঃশেষ হবে, সেইদিন৷ ওরা তো লেখাপড়া জানত না৷ চিঠি, ইস্তাহার কিছুই ছিল না৷ ছিল শুধু ওই শালের ডাল৷ ওই ওদের সংকেত, তাতেই খবর রটত৷ যারা বুঝবার তারা বুঝত৷
পিয়ালজোড় গাঁয়ের লোকেরা ঝাঁক বেঁধে এসে ঘিরে ধরল লোকটাকে৷ আর হাত দিয়ে ডালের পাতাগুলো গুণে গুণে হঠাৎ থরথর করে কেঁপে উঠল বুড়ো সাঁওতাল সোমা কুলি!
তা দেখে খ্যাপার মতো সবাই শুধাল, ‘কী দেখলি সোমা? কী বলছে পাতাগুলান?’
বুড়ো সোমার শরীরে যেন দেবতা ভর করেছে৷
দেবতার মতো গমগমে গলায় সোমা হুংকার দেয়, ‘কী বলছে পাতাগুলান? বলছে ডাক এসে গেইছে! লাঙল ছেড়ে হাতিয়ার তোল এবার!’
-‘আর কী বলছে?’
-‘বলছে, ভাগনাদিহির সাঁওতাল ভাই সিধু আর কানুর হুকুম মানতে হবে৷ সিধু আর কানু তোদের রাজা হল, সেনাপতি হল . . .’
-‘আর কী বলছে?’
-‘বলছে, সাঁওতালরা আর ঘাড় নীচু করে থাকবে না৷ তারা এবার জিতবে!’
-‘জিতব বলছিস সোমা? কিন্তু কীসের ভরসায়৷ ইংরেজদের কত সৈন্য, কত আইন-কানুন বইপত্তর, কত কলকব্জা, কামান বন্দুক, তাহলে কীসের ভরসায়?’
সোমা পাগলের মতো একদৃষ্টে পাতাগুলোর দিকে তাকায়৷ সেও জানতে চায়, কীসের ভরসায়? কীসের জোরে তারা জিতবে? খানিক বোঝে খানিক বোঝে না৷ খানিক বলতে যায় খানিক বলতে পারে না৷ তারপর হঠাৎ ছটফট করে খ্যাপার মতো এসে শুধু বাড়ি মারে ঢাউস ঢাউস সাঁওতালি নাগড়ায়-ডুম! ডুম! জিতব! জিতব! জিতব! আজ বলতে পারলাম নাই, কিন্তু জিতব!
আর সে ডাক শুনে অন্যেরাও পাগল হয়ে ওঠে৷ পাগল হয়ে ছেলেপুলে, গোরু, ছাগল, তির ধনুক সব সঙ্গে নিয়ে রওনা দেয় ভাগনাদিহি গাঁয়ের দিকে৷ সেইখানে সিধু কানুকে সামনে নিয়ে জমা হচ্ছে তামাম এলাকার সাঁওতাল৷
তারপর শুরু হল সে তুমুল কাণ্ড৷ মাস ছয়-সাত ধরে সারা পরগনায় ইংরেজ শাসনের চিহ্নমাত্র রইল না৷ সিধু-কানুর বীরত্ব আর হাজার হাজার আধান্যাংটা সাঁওতালের অদম্য লড়াইয়ের মুখে দারোগা পুলিশ, সৈন্যসামন্ত, রেলসাহেব, হাকিমসায়েব ঊর্ধ্বশ্বাসে রাজত্ব ছেড়ে পালাল শহরের দিকে৷ ইতিহাসে এর নাম দেওয়া হয়েছে সাঁওতাল বিদ্রোহ৷ বড়ো হয়ে ভালো করে তার কথা তোমরা জানবে৷
তবে সোমা যা বলেছিল তা কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফলল না৷ শেষ পর্যন্ত বন্দুক আর শিক্ষিত গোরা-পল্টনদের কাছে হেরে যেতে লাগল আদিম জাতের সাঁওতালরা৷ চারিদিকে শুধুই তখন হারার পালা৷ কাটা কচু গাছের মতো শুধুই লুটিয়ে পড়া৷ শুধুই রক্ত৷
ইংরেজের ফৌজ পা মেপে মেপে এগিয়ে আসছে আর প্রতিহিংসার জ্বালায় যা-কিছু সামনে পড়ছে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে৷
লড়াইয়ে পিয়ালজোড় গাঁয়ে বেশ ক-জন জোয়ান কাটা পড়েছিল আগেই৷ ছিটকে ছুটকে বাকি যেগুলো ছিল-ছেলেপুলে, বউ-বিটি, জোয়ান মরদ-তারা তাড়া খেতে খেতে একদিন এসে ডেরা বাঁধল বনের কাছে এক পোড়ো ভিটেতে৷ দিনের পর দিন খাওয়া হয়নি তাদের৷ সারা বর্ষা চাষ হয়নি৷ ধান পান ছাগল ভেড়া যা ছিল কবে নিঃশেষ হয়ে গেছে৷ বনের জন্তু পুড়িয়ে খাবে তারও উপায় নেই৷ পোড়াতে গেলেই জঙ্গলের ওপরে ধোঁয়া দেখলেই ইংরেজের ফৌজ গুলি চালাতে শুরু করবে৷
না খেয়ে খেয়ে বাচ্চাগুলো মায়ের কোলের মধ্যেই মরতে শুরু করেছে৷ জোয়ানেরা ঝড়ে-ভাঙা বটের মতো নেতিয়ে পড়ে আছে৷ মাঝে মাঝে দূর থেকে শোনা যায়, ইংরেজ সৈন্যরা আন্দাজে আন্দাজেই হাঁক পাড়ছে-সারেনডার! আত্মসমর্পন করো! নইলে . . .
আর যখন সইতে পারা যায় না তখন ছেলে-মরা এক মা জিজ্ঞেস করে, ‘সোমা, তুই বলেছিলি জিতব৷ কিন্তু আর কী ভরসা, আর কীসের ভরসা?’
সোমার শরীর তখনও যেন দেবতা ভর করে আছে৷ খ্যাপা খ্যাপা চোখে সে একবার তার সঙ্গীদের দিকে তাকায়৷ তারপর মনে মনে ভাবে সেই শাল গাছের ডালটার কথা৷ কী বলেছিল পাতাগুলো? কী? কী? কীসের ভরসা সে দেখেছিল সেদিন? সোমার সারা শরীর যন্ত্রণায় টনটন করে৷ তারপর থরথর করে কেঁপে ওঠে সে৷ দেবতা ভর-করা মানুষের মতো গমগমে গলায় বলে, ‘আমি কে? না আমি সোমা সর্দার! সব সাঁওতাল সর্দার রাজা করেছে সিধুকে৷ আমাকে ভরসা না করিস সাঁওতাল জাতকে ভরসা করবি তো? সেই জাতের রাজাকে ভরসা করবি তো? আমরা হেরেছি, কিন্তু সিধু এখনও ধরা পড়েনি৷ এই ভরসা!’
গমগম-করা সে গলা থেকে একটা জাদু যেন ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে৷ মুমূর্ষু লোকগুলো সত্যি সত্যি যেন বল ফিরে পায়৷ তির-ধনুক হাতে নিয়ে অপেক্ষা করে ঘরটার মধ্যে৷
কিন্তু দু-দিন বাদে পিয়ালজোড় গ্রামের আরও একটা লোক কোথা থেকে বুকে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে এসে জোটে ওদের সঙ্গে৷ সারা গায়ে তার রক্ত৷ সে খবর দেয়, কানু মারা পড়েছে৷ সিধু ধরা পড়েছে৷ সাঁওতাল ফৌজটার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই৷
এক মুহূর্তে খাঁ-খাঁ করে ওঠে সব কিছু৷ জাদুর মতো যে জিনিসটা এতক্ষণ ওদের ভরসা দিয়েছিল তা হঠাৎ টুকরো হয়ে হারিয়ে গেছে৷ সোমা বুড়ো থরথর করে কাঁপতে থাকে আতঙ্কে ওর মনে হয় যে-দেবতাটা এতদিন ওকে ভর করেছিল তা আর নেই৷ একদম নেই৷ এখন কোন ভরসা? কী ভরসা? কী কথা বলেছিল পাতাগুলো?
ওদিকে বুটের শব্দ করতে করতে এগিয়ে আসছে গোরাদের একটা দল৷ হাঁকছে, সারেনডার! এখনও সারেনডার করলে বাঁচবে, নইলে . . .
সবাই উশখুশ করে, কী করবি? কী করবি? কী করবি?
হঠাৎ আবার থর থর করে কেঁপে ওঠে সোমা৷ যেন আবার দেবতা ফিরে এসেছে ওর দেহে৷ গমগমে গলায় সোমা বলে, ‘আমি কে? না, আমি সোমা সাঁওতাল! সর্দারকে ভরসা না করিস সিধু-কানুকে ভরসা না করিস-সাঁওতাল ধরমকে তো ভরসা করবি, সাঁওতাল দেবতাকে ভরসা করবি৷ মারাং বুরু ভরসা! মারাং বুরু ওদের গুলি সব ধুঁয়া করে দিবে!’
যারা উশখুশ করছিল তারা আবার শক্ত হয়ে দাঁড়ায়৷
ইংরেজ ফৌজ ততক্ষণে পোড়ো বাড়িটা চারিদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলেছে৷ বন্দুক উঁচিয়ে শেষবারের মতো হাঁক দিচ্ছে ‘সারেনডার নইলে . . .’
দরজা বন্ধ ঘরের মধ্যে গাদাগাদি করা পিয়ালজোড় গাঁয়ের সাঁওতাল৷ থমথম করছে সকলের মুখচোখ৷ এর মধ্যে কে একজন তবু জিজ্ঞেস করে, ‘যদি ধোঁয়া না হয় তবে?’
তবে কি জানে না সোমা৷ শুধু আরও খেপে উঠে ফিসফিসিয়ে হুকুম দেয়-ওঠা তির-ধনুক! জিতব! জিতব!
বাইরে ঘরখানা ঘেরাও করে ইংরেজ সৈন্যরা দাঁড়িয়েছিল৷ তারা চমকে উঠল৷ বন্ধ ঘরের দরজা একটু ফাঁক হয়ে হঠাৎ এক ঝাঁক তির ছুটে এসেছে তাদের দিকে৷
প্রতিহিংসার জ্বালায় রুখে উঠল ইংরেজ কম্যান্ডার! এখনও লড়াই করার সাধ? বেশ দেখাচ্ছি!
ভেতর থেকে ঘরের দরজা বন্ধ৷ কোথাও কোনো ফাঁক নেই৷ শুধু একপাশে ছিল ফোকরের মতো একটা জানলা৷ ভেতরের অন্ধকারে ইঁদুরের মতো গাদাগাদি করে আছে একদল কালো মানুষ৷ সেই ফোকরে সারি বন্দুকের নল ঢুকিয়ে শুরু হল গুলির পর গুলি৷ কতক্ষণ গুলি চলেছিল খেয়াল নেই কারও৷ ক্লান্ত হয়ে যখন বন্দুকের নলগুলো সরিয়ে আনা হল ফোকর থেকে, তখন চারিদিক কবরের মতো স্তব্ধ হয়ে গেছে৷ আর ধীরে ধীরে বন্ধ দরজাটার ফাঁক গলে মেঝে ছাপিয়ে উঠে নিঃশব্দে বাইরে বেরিয়ে আসতে থাকে একটা লাল রক্তের ধারা৷
কম্যান্ডার হুকুম দেয়, ‘ভাঙো দরজা৷’
দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকতে গিয়ে চমকে পিছিয়ে এল সেপাহিরা৷ স্তূপাকৃতি লাশের মাঝখানে হতভম্বের মতো রক্তাক্ত দেহে দাঁড়িয়ে আছে এক বুড়ো৷
সোমা বুড়ো!
দেখে শেষ মুহূর্তে বুঝি দয়া হল কম্যান্ডারের৷ বললে, ‘তুমি বুঢঢা আছ৷ তোমাকে কিছু করব না৷ বেরিয়ে এসো . . .’
কিন্তু ওদের কারও কথা তখন সোমার কানে ঢুকছিল না৷ স্তূপাকৃতি মরণের মুখোমুখি এবার একেবারে একলা দাঁড়িয়ে আছে শুধু সে৷ আর ভয়ানক আতঙ্কে সে টের পেয়েছে-গুলি ধোঁয়া হয়নি৷ সঙ্গীরা কেউ বাঁচেনি৷ সিধু পারেনি৷ মারাং বুরু পারেনি৷ দেবতার মতো যে জিনিসটা ওকে ভর করতে, তা কোথাও নেই আর৷ একদম নেই৷
এখন কী ভরসা? কীসের? কী কথা বলেছিল পাতাগুলো? আতঙ্কে আর যন্ত্রণায় থরথর করে কাঁপে সোমা৷ তার মরা সঙ্গীদের কী কথা সে এখন শোনাবে?
একটা সেপাই এগিয়ে আসে ওর দিকে . . .৷ ‘বুড়ো তোর নাম কী? বাইরে চল . . .’
আর হঠাৎ সেই মুহূর্তে শেষ বারের মতো গমগম করে ওঠে সোমার গলা৷ না, এবার আর দেবতা ভর করেনি তার দেহে৷ তবু গমগম করে ওঠে তার কথা৷ বলে, ‘আমি? আমি সোমা কুলি৷ সোমা কুলি বলছে শোনো৷ যারা মরে গেছে তারা শোনো৷ তবু জিতব! একদিন জিতব৷ জিতব৷ জিতব৷ জিতব৷ কোন ভরসায়? না আমরা মানুষ, আমরা . . .’
আর মুহূর্তে হাতের কুড়ুল দিয়ে সোজা দ্বিখণ্ড করে ফেলে সামনের গোরা সেপাইটাকে৷ তারপর গুলি খেয়ে নিজেও লুটিয়ে পড়ে তার মরে যাওয়া সঙ্গীদের বুকের ওপর৷
সাঁওতাল বিদ্রোহ সেদিন জেতেনি৷ এক-শো বছর পরে আজও কি জিতেছে? আমি জানি না৷ শুধু যখনই পিয়ালজোড় গ্রামে যাই, দেখি এখনও অশান্তের মতো শাল পাতা খসে খসে উড়ে যাচ্ছে বাতাসে৷ মনে হয় কিছু একটা কথা বলছে তারা৷ কিছু একটা ডাক দিচ্ছে৷ সে ডাকের মানে যারা বোঝার তারা হয়তো বুঝবে৷ তোমরা কেউ বুঝতে পারবে কি? দেখো তো চেষ্টা করে৷